Loading AI tools
নোবেল বিজয়ী (২০২৩) মার্কিন রসায়নবিদ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
মুঞ্জি গেব্রিয়েল বাওয়েন্ডি (Moungi Gabriel Bawendi; জন্ম ১৫ই মার্চ ১৯৬১) ফরাসি ও তিউনিসীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন রসায়নবিদ।[1] তিনি ২০২৩ সালে আলেক্সেই ইয়েকিমভ ও লুইস ব্রুসের সাথে যৌথভাবে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। "কোয়ান্টাম বিন্দু (ডট) আবিষ্কার ও বিকাশের জন্য" তাদেরকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়।[2] কোয়ান্টাম বিন্দুগুলি এতই ক্ষুদ্র যে এগুলির আকার এগুলির বিভিন্ন ভৌত ধর্ম নির্ধারণ করে। ন্যানোপ্রযুক্তির ক্ষুদ্রতম এই অংশগুলি বর্তমানে টেলিভিশন ও এলএইডি বাতিতে আলো ছড়ানোর পাশাপাশি শল্যচিকিৎসকদের টিউমার (অর্বুদ) অপসারণসহ আরও অনেক কাজে সহায়তা করছে।
মুঞ্জি বাওয়েন্ডি | |
---|---|
জন্ম | মুঞ্জি গেব্রিয়েল বাওয়েন্ডি ১৯৬১ (বয়স ৬২–৬৩) |
শিক্ষা | হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় |
পিতা-মাতা |
|
পুরস্কার | রসায়নে নোবেল পুরস্কার (২০২৩) |
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন | |
কর্মক্ষেত্র | রসায়ন কোয়ান্টাম রসায়ন |
প্রতিষ্ঠানসমূহ | ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি |
ডক্টরাল উপদেষ্টা | কার্ল ফ্রিড তাকেশি ওকা |
মুঞ্জি বাওয়েন্ডি বর্তমানে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি-র লেস্টার উলফ অধ্যাপক।[3][4][5] তিনি কোলয়েডীয় কোয়ান্টাম ডট বিষয়ক গবেষণায় অংশগ্রহণকারী আদি গবেষকদের একজন। এছাড়া তিনি ২০১০-এর দশকের সবচেয়ে উদ্ধৃত রসায়নবিদদের একজন।[6] ২০২০ সালে তাঁকে ক্ল্যারিভেট উদ্ধৃতি বিজয়ী (Clarivate Citation Laureates) হিসেবে সম্মান দেওয়া হয়।
বাওয়েন্ডি ১৯৬১ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন তিউনিসীয় ফরাসি গণিতবিদ মোহাম্মেদ সালাহ বাওয়েন্দি, আর তার মা ছিলেন এলেন বোবার (পরবর্তীতে এলেন বাওয়েন্দি)। মুঞ্জি বাওয়েন্ডি ১৯৮২ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলাবিদ্যায় স্নাতক উপাধি অর্জন করেন।[7] ১৯৮৮ সালে তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নবিদ্যায় ডক্টরেট উপাধি লাভ করেন। এসময় তিনি কার্ল এফ ফ্রিড ও তাকেশি ওকার সাথে গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেন।[8]
বাওয়েন্ডি ২০২৩ সালে আলেক্সেই ইয়েকিমভ ও লুইস ব্রুসের সাথে "কোয়ান্টাম ডট বা বিন্দু আবিষ্কার ও সংশ্লষণে অবদানের জন্য" যৌথভাবে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
কোয়ান্টাম বিন্দু বা ডট হল অর্ধপরিবাহী পদার্থের অতিক্ষুদ্র ন্যানোমাপনীর কণা, যেগুলির ব্যাস মাত্র কয়েক ন্যানোমিটার, যা কিনা একটি আলপিনের মাথার দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ। এই কণাগুলি অসাধারণ রকম বিশুদ্ধ আলো নিঃসরণ করে। এই কণাগুলি আণবিক ও স্থূল পদার্থ (bulk matter) -উভয়ের থেকে ভিন্ন একটি পদার্থের দল গঠন করেছে। এই কণাগুলি এতই ছোট যে গাঠনিক দিক থেকে স্থূল সাধারণ পদার্থের মতো হলেও এগুলি ধর্ম ভিন্ন হয়ে থাকে। এর পরিবর্তে এগুলি আংশিকভাবে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের সূত্রগুলি দ্বারা শাসিত হয়, যে সূত্রগুলি পরমাণু ও অতিপারমাণবিক কণাগুলি কীভাবে আচরণ করবে, তার বর্ণনা দেয়। অতিবেগুনি রশ্মি দ্বারা আলোকিত হলে এই কোয়ান্টাম বিন্দুগুলি তাদের আকার অনুযায়ী বিভিন্ন বর্ণের (রঙের) উজ্জ্বল প্রতিপ্রভা প্রদর্শন করে। এই একটি মাত্র ধর্ম তথা কণার আকারের পরিবর্তন করে এগুলির ধর্ম পরিবর্তন করা সম্ভব। যেমন ক্যাডমিয়াম সেলেনাইডের (CdSe) কোয়ান্টাম বিন্দুগুলির আকার নিয়ন্ত্রণ করে দৃশ্যমান বর্ণালীর প্রায় সমস্ত রঙের আলো উৎপাদন করা সম্ভব।[9][10]
১৯৩০-এর দশক থেকেই বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যৎবাণী করেন যে এরকম কণা এতই ক্ষুদ্র যে উপাদানের ইলেকট্রনগুলির জন্য স্থান সংকুলান করা সম্ভব হয় না, ফলে এগুলি চেপে আসে। ফলাফল হিসেবে ধারণা করা হয় যে এই কণাগুলির আকার সেগুলির ভৌত ধর্ম, যেমন এগুলি থেকে নিঃসৃত আলোর রঙ বা বর্ণের উপর প্রভাব ফেলবে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের এই অনুমান পরীক্ষা করে দেখা দুরূহ ছিল কেননা এই ধরনের কণা উৎপাদন করার কোনও উপায় ছিল না। শেষ পর্যন্ত ১৯৮০-র দশকের শুরুতে এসে রুশ বিজ্ঞানী ইয়েকিমভ ও মার্কিন বিজ্ঞানী ব্রুস পরস্পর থেকে স্বাধীনভাবে কোয়ান্টাম বিন্দু বা ডট উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করেন।[9][10]
লুইস ব্রুস বিশ্বের প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে একটি তরলে ভাসমান ন্যানোকণাগুলিতে আকারের উপর নির্ভরশীল কোয়ান্টাম ক্রিয়া প্রমাণ করে দেখান। তিনি ১৯৮৩ সালে একটি দ্রবণে প্রস্তুত ক্যাডমিয়াম সালফাইডের (CdS) কেলাসাঙ্কুর (Crystallite ক্রিস্টালাইট) তদন্ত করে দেখতে পান যে নতুন ও পুরাতন কণাগুলির মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান, যেখানে পুরাতন কণাগুলি পুনঃকেলাসিত হয়ে অপেক্ষাকৃত বড় কণা গঠন করেছে। বৃহত্তর পুরাতন কণাগুলি স্থূল ক্যাডমিয়াম সালফাইডের মতো উদ্দীপন বর্ণালী (Excitation spectrum) প্রদর্শন করে, কিন্তু অপেক্ষাকৃত নতুন, ক্ষুদ্রতর কণাগুলি একটি নীল সরণ (Blue shift) প্রদর্শন করে।[9][10]
এর আগে ১৯৮০ সালের দিকে আলেক্সেই ইয়েকিমভ তামার ক্লোরাইডের ন্যানোকণা দ্বারা ঈষৎ রঞ্জিত কাচের কাচের ভেতরে কণাগুলির আকারের উপর নির্ভরশীল কোয়ান্টাম ক্রিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। এক্ষেত্রে কাচের রঙটি তামার ক্লোরাইডের ন্যানোকণা থেকে নিঃসৃত হয়। কাচের উৎপাদনের সময় তাপমাত্রা ও তাপ প্রয়োগের স্থায়িত্বকালের ভিন্নতা প্রয়োগ করে ইয়েকিমভ তামার ক্লোরাইড কণার গড় আকার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন ও কোয়ান্টাম ক্রিয়ার বদৌলতে কণাগুলির আকার ভিন্ন হলে যে কাচের রঙের পরিবর্তন হয়, তা প্রদর্শন করতে সক্ষম হন।[9][10]
কিন্তু ইয়েকিমভ ও ব্রুসের প্রযুক্ত কৌশলগুলি দিয়ে সুষম আকারের (monodisperse) কোয়ান্টাম বিন্দু বা ডট উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। ১৯৯৩ সালে মুঞ্জি বাওয়েন্ডি ও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা কোয়ান্টাম বিন্দুর রাসায়নিক উৎপাদনে বিপ্লব সাধন করেন এবং উচ্চমানের ও প্রায় নিখুঁত কোয়ান্টাম বিন্দু তৈরি করতে সক্ষম হন। তারাই প্রথম এমন একটি পদ্ধতির প্রতিবেদন প্রদান করেন, যে পদ্ধতির সাহায্যে আকার সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করে কোয়ান্টাম বিন্দু বা ডট সংশ্লেষণ করা সম্ভব। কোয়ান্টাম বিন্দুগুলি যেসব শর্তের অধীনে কেলাসিত হয়, প্রণালীবদ্ধভাবে সেই শর্তগুলিতে ভিন্নতা এনে বাওয়েন্ডি ও তাঁর সহযোগীরা একটি নির্দিষ্ট আকারের ন্যানোকেলাস গজাতে সক্ষম হন। মুঞ্জির পদ্ধতিতে কোয়ান্টাম বিন্দু সংশ্লেষণের জন্য প্রথমে অভীষ্ট ন্যানোকণাগুলির জন্য জৈব-ধাতব অগ্রসূচক (organometallic precursor) পদার্থগুলিকে সূচিপ্রয়োগের মাধ্যমে একটি উত্তপ্ত দ্রাবকে প্রবিষ্ট করানো হয় এবং সাথে সাথে এগুলির তাপ-বিশ্লেষণ (pyrolysis) ঘটে। এর ফলে আকস্মিক অতি-সম্পৃক্তি (supersaturation) ঘটে এবং একটি সুসংজ্ঞায়িত মুহূর্তে একটি কণার কেলাসকেন্দ্র গঠিত (Nucleation) হয়। সূচিপ্রয়োগের সাথে সাথেই তাপমাত্রা হঠাৎ কমিয়ে দেওয়া হয় ও অগ্রসূচক পদার্থগুলিকে লঘু করে দেওয়া হয়, যাতে কণার বৃদ্ধি বন্ধ হয়। পুনরায় উত্তপ্ত করে কেলাস বৃদ্ধির জন্য অনুকূল অভীষ্ট তাপমাত্রায় আনয়নের পর একটি সমন্বয়কারী দ্রাবকের অভ্যন্তরে কণাটির ধীরগতির বৃদ্ধি ও কোমলায়ন (annealing) ঘটানো হয়, যার ফলে উৎপন্ন কলয়েডীয় বিক্ষেপটি সুস্থিত হয়। পরিশেষে বিশোধন ও আকারের-উপর-নির্ভরশীল অধঃক্ষেপণের মাধ্যমে কণা নির্বাচন করে সুষম আকারের ন্যানোকণা (monodisperse nanoparticle) পাওয়া যায়। বাওয়েন্ডির দলের কাজটি ছিল কোয়ান্টাম বিন্দুর অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলি উদ্ঘাটনের জন্য সম্পূর্ণ তাত্ত্বিক একটি গবেষণা ও উদ্দেশ্য ছিল এগুলিকে মৌলিক বিজ্ঞানের আওতায় নিয়ে আসা; এগুলির ভবিষ্যৎ প্রয়োগ কী হতে পারে, তা নিয়ে তাদের কোনোই ধারণা ছিল না। বাওয়েন্ডি এরপর বিন্দুগুলির আলোক নিঃসরণের দক্ষতা নিয়ন্ত্রণের উপায় বের করেন এবং এগুলির মিটিমিটি করে জ্বলার প্রবণতা দূর করেন, ফলে এগুলি বহু ক্ষেত্রে বাস্তবমুখী প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত হয়।[9][10]
এই অতিক্ষুদ্র কণাগুলি বর্তমানে পরিগণক (কম্পিউটার) ও দূরদর্শন (টেলিভিশন) যন্ত্রের সমতল পর্দাতে (ফ্ল্যাট স্ক্রিন) ব্যবহৃত হচ্ছে, যেখানে সেগুলি সনাতন এলইডি-ভিত্তিক (আলোকনিঃসারী দ্বি-তড়িৎদ্বার তথা লাইট-এমিটিং ডায়োডভিত্তিক) পর্দার তুলনায় অনেক বেশি প্রাণবন্ত চিত্র সৃষ্টি করছে। এই নতুন প্রযুক্তির নাম হল কিউএলএইডি তথা কোয়ান্টাম বিন্দু আলোকনিঃসারী ডায়োড প্রযুক্তি (Quantum-dot light-emitting diode)। কোয়ান্টাম বিন্দুগুলিকে বিভিন্ন ধরনের জীব-চিকিৎসাবৈজ্ঞানিক চিত্রণ (বায়োমেডিকাল ইমেজিং) পদ্ধতিতে জীবকোষের ভেতরের অণুগুলির গায়ে তকমা বা লেবেল আঁটার জন্যও ব্যবহার করা হচ্ছে, যার ফলে ঐসব অণুর চিত্রণ আরও সহজ হয়েছে। এছাড়া অস্ত্রোপচারের সময় দেহকলা (টিস্যু) আলোকিত করে এগুলি শল্যচিকিৎসকদের সহায়তাকারী সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।[9][10]
বিজ্ঞানীরা আরও বহুসংখ্যক প্রযুক্তিতে কোয়ান্টাম বিন্দু বা ডটের প্রয়োগ বিবেচনা করে দেখছেন। ভবিষ্যতে অধিকতর পাতলা সৌর বিদ্যুৎকোষ, নমনীয় বৈদ্যুতিন (ইলেকট্রনীয়) সরঞ্জাম, আলোক-অনুঘটন, কোয়ান্টাম পরিগণন (কোয়ান্টাম কম্পিউটিং) ও গুপ্তায়িত কোয়ান্টাম যোগাযোগের ক্ষেত্রে এগুলি ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। সাম্প্রতিককালে বাওয়েন্ডির পরীক্ষাগারে এমন একটি কোয়ান্টাম বিন্দুভিত্তিক বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে, যেটি এতই ছোট যে এটিকে একটি বুদ্ধিমান মুঠোফোনের (স্মার্টফোনের) আলোকচিত্রগ্রাহকের (ক্যামেরা) ভেতরে বসানো সম্ভব এবং এর মাধ্যমে বিভিন্ন রোগব্যাধি, বিশেষ চর্মরোগ নির্ণয় এবং পরিবেশ দূষক পদার্থগুলি শনাক্তকরণের মতো কাজগুলি করা সম্ভব।[9][10]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.