ভারতের একটি হিন্দু মন্দির উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির (হিন্দি: महाकालेश्वर ज्योतिर्लिंग) হল হিন্দু দেবতা শিবের একটি মন্দির এবং বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম। এই মন্দিরটি ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের উজ্জয়িনী শহরে রুদ্রসাগর হ্রদের তীরে অবস্থিত। এই মন্দিরের শিবলিঙ্গটিকে স্বয়ম্ভু বা শিবের সাক্ষাৎ-মূর্তি মনে করা হয়।
মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির | |
---|---|
ধর্ম | |
অন্তর্ভুক্তি | হিন্দুধর্ম |
অবস্থান | |
অবস্থান | উজ্জয়িনী |
রাজ্য | মধ্যপ্রদেশ |
দেশ | ভারত |
ওয়েবসাইট | |
http://www.mahakaleshwar.nic.in |
শিবপুরাণ অনুসারে, একবার সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা ও রক্ষাকর্তা বিষ্ণু তাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে বিবাদে রত হন।[১] তাদের পরীক্ষা করার জন্য শিব ত্রিভুবনকে ভেদ করে জ্যোতির্লিঙ্গ নামে এক বিশাল অন্তহীন আলোকস্তম্ভ রূপে আবির্ভূত হন। বিষ্ণু ও ব্রহ্মা এই লিঙ্গের উৎস অনুসন্ধান করতে যান। ব্রহ্মা যান উপর দিকে এবং বিষ্ণু নামেন নিচের দিকে। কিন্তু তারা কেউই এই লিঙ্গের উৎসটি খুঁজে পাননা। ব্রহ্মা মিথ্যা বলেন যে তিনি উৎসটি খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু বিষ্ণু তার পরাজয় স্বীকার করে নেন। শিব তখন একটি দ্বিতীয় জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে আবির্ভূত হয়ে মিথ্যা বলার জন্য ব্রহ্মাকে শাপ দেন যে অনুষ্ঠানে তার কোনো স্থান হবে না। অন্যদিকে সত্য কথা বলার জন্য তিনি বিষ্ণুকে আশীর্বাদ করে বলেন যে সৃষ্টির অন্তিমকাল পর্যন্ত তিনি পূজিত হবেন। জ্যোতির্লিঙ্গ হল সেই অখণ্ড সর্বোচ্চ সত্যের প্রতীক, যার অংশ শিব নিজে। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরগুলিতে শিব স্বয়ং অগ্নিময় আলোকস্তম্ভ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন।[২][৩] শিবের ৬৪টি রূপভেদ রয়েছে। তবে এগুলির সঙ্গে জ্যোতির্লিঙ্গকে এক করা হয় না। প্রত্যেক জ্যোতির্লিঙ্গের নির্দিষ্ট নাম আছে – এগুলি শিবের এক এক রূপ।[৪] প্রতিটি মন্দিরেই শিবলিঙ্গ শিবের অনন্ত প্রকৃতির প্রতীক এক আদি ও অন্তহীন স্তম্ভের প্রতিনিধিত্ব করে।[৪][৫][৬] বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির হল গুজরাতের সোমনাথ, অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীশৈলমের মল্লিকার্জুন, মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর, মধ্যপ্রদেশের ওঙ্কারেশ্বর, হিমালয়ের কেদারনাথ, মহারাষ্ট্রের ভীমশংকর, উত্তরপ্রদেশের বারাণসীর বিশ্বনাথ, মহারাষ্ট্রের ত্র্যম্বকেশ্বর, ঝাড়খণ্ডের দেওঘরের বৈদ্যনাথ, গুজরাতের দ্বারকায় নাগেশ্বর, তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমের রামেশ্বর এবং মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গাবাদের ঘৃষ্ণেরশ্বর।[১][৭]
মহাকালেশ্বরের মূর্তিটি দক্ষিণামূর্তি নামে পরিচিত। ‘দক্ষিণামূর্তি’ শব্দের অর্থ ‘যাঁর মুখ দক্ষিণ দিকে’। এই মূর্তির বিশেষত্ব এই যে তান্ত্রিক শিবনেত্র প্রথাটি বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে একমাত্র মহাকালেশ্বরেই দেখা যায়। ‘ওঙ্কারেশ্বর মহাদেবে’র মূর্তিটি মহাকাল মন্দিরের গর্ভগৃহের উপরে স্থাপিত। গর্ভগৃহের পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব দিকে যথাক্রমে গণেশ, পার্বতী ও কার্তিকের মূর্তি স্থাপিত। দক্ষিণ দিকে শিবের বাহন নন্দীর মূর্তি স্থাপিত। মন্দিরের তৃতীয় তলে নাগচন্দ্রেশ্বর মূর্তি আছে। এটি একমাত্র নাগপঞ্চমীর দিন দর্শনের জন্য খুলে দেওয়া হয়। মন্দিরের পাঁচটি তল আছে, তার মধ্যে একটি ভূগর্ভে অবস্থিত। এছাড়া মন্দিরে একটি বিশাল প্রাঙ্গণ রয়েছে। হ্রদের দিকে অবস্থিত এই প্রাঙ্গণটি প্রাচীরবেষ্টিত। মন্দিরের শিখর বা চূড়াটি শাস্ত্রে উল্লিখিত পবিত্র বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে। ভূগর্ভস্থ কক্ষটির পথটি পিতলের প্রদীপ দ্বারা আলোকিত হয়। মনে করা হয়, দেবতাকে এই কক্ষেই প্রসাদ দেওয়া হয়। এটি মন্দিরের একটি স্বতন্ত্র প্রথা। কারণ, এই রকম প্রথা অন্য কোনো মন্দিরে দেখা যায় না।[৮]
হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, এই মন্দিরের প্রধান উপাস্য দেবতা শিব অনন্তকাল ধরে উজ্জয়িনীর শাসক। এই শহরের অধিবাসীদের ধর্মবিশ্বাসে মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গের প্রভাব অপরিসীম। শিবরাত্রি উৎসবের দিন মন্দিরের কাছে একটি বিশাল মেলা বসে।[৯] মহাকালেশ্বর মন্দিরের কাছে স্বপ্নেশ্বর মহাদেব মন্দির আছে। এই মন্দিরে ভক্তেরা পূজা করেন তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্নটি অনুধাবন করার জন্য। এখানে স্বপ্নেশ্বর শিবের শক্তির নাম স্বপ্নেশ্বরী।[১০]
মহাকালেশ্বর মন্দিরটিকে ১৮টি মহাশক্তিপীঠের একটি বলে মনে করা হয়।[১১][১২][১৩]
হিন্দু পুরাণ অনুসারে, শিব যখন সতীর দেহ বহন করে নিয়ে চলেছিলেন, তখন সতীর অঙ্গগুলি খণ্ডবিখণ্ড হয়ে ৫১টি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এই স্থানগুলিকে শক্তিপীঠ বলা হয়। মহাকালেশ্বর মন্দিরে সতীর উপরোষ্ঠ পড়েছিল। এখানে শক্তির নাম মহাকালী বা হরসিদ্ধি।
পুরাণ অনুসারে, উজ্জয়িনী শহরটির নাম ছিল অবন্তিকা। এই শহরটি ছিল অত্যন্ত সুন্দর এবং ধর্মীয় চিন্তার কেন্দ্র। দূরদূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে আসত হিন্দুশাস্ত্র শিক্ষা করতে। কিংবদন্তি অনুসারে, উজ্জয়িনীতে চন্দ্রসেন নামে এক শাসক ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত শিবভক্ত। একদিন শ্রীখর নামে এক কৃষকবালক প্রাসাদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে শুনতে পায় রাজা শিবের নাম করছেন। সেও ছুটে মন্দিরে গিয়ে তার সঙ্গে প্রার্থনা শুরু করে দেয়। প্রহরীরা তাকে টেনে সেখান থেকে বের করে শহরের বাইরে শিপ্রা নদীর তীরে রেখে দিয়ে আসে। উজ্জয়িনীর পার্শ্ববর্তী দুই শত্রুরাজ্যের রাজা রিপুদমন ও সিংহাদিত্য সেই সময় উজ্জয়িনীর সম্পদের লোভে রাজ্য আক্রমণের কথা ভাবছলেন। এই কথা শুনে শ্রীখর প্রার্থনা শুরু করে। সেই খবর পৌঁছায় বৃধি নামে এক পুরোহিতের কাছে। তিনি এই কথা শুনে ভয় পেয়ে যান এবং ছেলেদের একান্ত অনুরোধে শিপ্রা নদীর তীরে গিয়ে শিবের কাছে প্রার্থনা শুরু করেন। ব্রহ্মার আশীর্বাদে দূষণ নামে এক দৈত্য অদৃশ্য হয়ে যাবার ক্ষমতা পেয়েছিল। শত্রুরাজারা দূষণের সাহায্যে উজ্জয়িনী আক্রমণ করেন। যুদ্ধে তাদেরই জয় হয় এবং তারা সকল শিবভক্তের উপর অত্যাচার শুরু করে দেন।
অসহায় ভক্তদের প্রার্থনা শুনে শিব মহাকালের রূপে উজ্জয়িনীতে আবির্ভূত হয়ে চন্দ্রসেনের শত্রুদের ধ্বংস করেন। শ্রীখর ও বৃধির অনুরোধে শিব উজ্জয়িনীতে বাস করতে রাজি হন। তিনিই হন রাজ্যের প্রধান দেবতা এবং শিবভক্তদের রক্ষাকর্তা। সেই থেকে উজ্জয়িনীতে মহাকাল রূপে শিব তার শক্তি পার্বতীকে নিয়ে বাস করছেন।[১৪]
১২৩৪-৩৫ সালে সুলতান শাসুদ্দিন ইলতুৎমিস উজ্জয়িনী লুণ্ঠনকালে মহাকালেশ্বর মন্দির চত্বর ধ্বংস করেছিলেন।[১৫][১৬][১৭] ১৭৩৬ সালে হিন্দু পাদ পাদশাহির ছত্রপতি শাহু মহারাজ ও পেশোয়া বাজি রাওয়ের সেনাপতি রানোজিরাও সিন্ধে মহারাজ (সিন্ধিয়া) বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করান। পরবর্তীকালে মহাদজি সিন্ধে মহারাজ (প্রথম মাধবরাও সিন্ধে, ১৭৩০-১৭৯৪) ও মহারানি বায়জাবাই রাজে সিন্ধে (১৮২৭-১৮৬৩) এই মন্দিরের সংস্কার ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
১৮৮৬ সাল পর্যন্ত রাজা জয়াজিরাও সাহেব সিন্ধে আলিজার শাসন পর্যন্ত তৎকালীন গোয়ালিয়র রিয়াসতের প্রধান অনুষ্ঠানগুলি এই মন্দিরে অনুষ্ঠিত হত। ভারতের স্বাধীনতার পর দেবস্থান ট্রাস্টের পরিবর্তে উজ্জয়িনী পৌরসংস্থা এই মন্দিরের ভার নেয়। বর্তমানে এটি একটি কালেক্টরয়েটের অধীনে রয়েছে।[১৫][১৬][১৭]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.