বালিদ্বীপীয় হিন্দুধর্ম
ইন্দোনেশিয়ার বালি প্রদেশে হিন্দুধর্মের সংক্ষিপ্ত বিবরণ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বালিদ্বীপীয় হিন্দুধর্ম (ইন্দোনেশীয়: Agama Hindu Dharma; Agama Tirtha; Agama Air Suci; Agama Hindu Bali) হল ইন্দোনেশিয়ার বালি প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের আচরিত হিন্দুধর্মের একটি বিশেষ রূপ।[১][২] এই ধর্মমতটি বিশেষভাবে বালি দ্বীপের অধিবাসী বালি জাতির সঙ্গে জড়িত। স্থানীয় সর্বপ্রাণবাদ, পূর্বপুরুষ পূজা এবং বোধিসত্ত্ব পূজার সংমিশ্রণে এটি হিন্দুধর্মের একটি স্বতন্ত্র রূপ হয়ে উঠেছে।


ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলমান (প্রায় ৯০%)।[৩] বালি দ্বীপ সেখানে একটি ব্যতিক্রম। এই দ্বীপের অধিবাসীদের ৮৭% নিজেদের হিন্দু বলে চিহ্নিত করেন (যা ইন্দোনেশিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ১.৭%)।[৩] ওলন্দাজ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৪৫ সালের ইন্দোনেশীয় সংবিধান দেশের সকল নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষিত করেছিল।[৪] নৃতত্ত্ববিদ ও বালিদ্বীপীয় ইতিহাস ও ধর্ম বিশারদ মিশেল পিকার্ড বলেন, ১৯৫২ সালে যখন ইন্দোনেশীয় ধর্ম মন্ত্রক ইসলামপন্থীদের নিয়ন্ত্রণাধীনে আসে, তখন তারা "ধর্মে"র এক গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞাকে বলপূর্বক সীমাবদ্ধ করে দেন।[৪] সরকারি ইন্দোনেশীয় ধর্ম হিসাবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে মন্ত্রক একেশ্বরবাদ, বিধিবদ্ধ ধর্মীয় আইন সংবলিত এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি প্রয়োজনীয় বিষয়ের ভিত্তিতে "ধর্মে"র সংজ্ঞা নির্ধারণ করে।[১][৪] অধিকন্তু, সরকারিভাবে স্বীকৃত একেশ্বরবাদী কোনও ধর্মের অনুগামী নন, এমন ব্যক্তিরা ইন্দোনেশিয়ায় ভোটাধিকার সহ কয়েকটি নাগরিক অধিকারের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।[১] সংখ্যালঘু বালি হিন্দুরা তাঁদের আচরিত হিন্দুধর্মের যে রূপটি গ্রহণ করেছিলেন, সেটিকে তাঁরা একেশ্বরবাদী হিসাবে ঘোষণা করেন এবং সেটিকে "আগম" হিসাবে রাজনৈতিকভাবে গ্রহণ ধর্ম হিসাবে উপস্থাপনা করেন। ইন্দোনেশীয় সরকার বালিদ্বীপীয় হিন্দুধর্মকে বালিতে আচরিত অন্যতম সরকারি ধর্ম হিসাবে স্বীকৃত দিয়েছে।[১][৪]
ইতিহাস
সারাংশ
প্রসঙ্গ

ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে হিন্দুধর্মের প্রথম প্রভাব পড়েছিল খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী নাগাদ।[৫][৬] ভারত থেকে সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ধারণা কীভাবে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল, সেই বিষয়ে ঐতিহাসিক প্রমাণগুলি অস্পষ্ট। জাভা কিংবদন্তিতে ৭৮ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হওয়া শকাব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম শতাব্দী থেকেই ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতের কাহিনিগুলি ইন্দোনেশীয় দ্বীপগুলিতে পরিচিত ছিল বলে জানা যায়। এই কাহিনিগুলির যে পাঠ ইন্দোনেশিয়ায় প্রচারিত হয়, তা পাওয়া যায় দক্ষিণপূর্ব ভারতীয় উপদ্বীপে (অধুনা তামিলনাড়ু ও দক্ষিণ অন্ধ্রপ্রদেশ) প্রচলিত মহাভারতের পাঠে।[৫] খ্রিস্টীয় ১৪শ শতাব্দীতে রচিত জাভাদ্বীপীয় গদ্য গ্রন্থ টান্টু পাগেলারান ইন্দোনেশিয়ার প্রাচীন কাহিনি, শিল্পকলা ও হস্তশিল্পের একটি সংকলন। এই গ্রন্থটিতে সংস্কৃত শব্দ, ভারতীয় দেবদেবীর নাম ও ধর্মীয় ধ্যানধারণার বহুল ব্যবহার লক্ষিত হয়। একইভাবে জাভা ও পশ্চিম ইন্দোনেশীয় দ্বীপগুলিতে খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত বিভিন্ন প্রাচীন চণ্ডী (মন্দির) এবং ইন্দোনেশিয়ায় আবিষ্কৃত খ্রিস্টীয় ৮ম শতাব্দীর চাঙ্গাল শিলালিপির মতো প্রাচীন শিলালিপিগুলি থেকে নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় যে, শিবলিঙ্গ ও পার্বতী, গণেশ, বিষ্ণু, ব্রহ্মা, অর্জুন সহ অন্যান্য দেবদেবীর পূজা খ্রিস্টীয় ১ম সহস্রাব্দের মধ্যভাগ থেকে শেষভাগের মধ্যে ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল।[৭] ৪১৪ খ্রিষ্টাব্দে সিংহল থেকে চীনে প্রত্যাবর্তন কালে ফা হিয়েনের লেখা প্রাচীন চীনা নথিতে জাভায় দু-টি হিন্দু সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়।[৫] অন্যদিকে ৮ম শতাব্দীর চীনা নথিপথে রাজা সঞ্জয়ের হিন্দু রাজ্যটিকে হোলিং নামে উল্লেখ করে সেটিকে "অত্যধিক ধনী" রাজ্য হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই নথিগুলিতে আরও বলা হয়েছে যে, এই রাজ্যটি বৌদ্ধ জনসাধারণ ও জাভা দ্বীপের কেডু সমভূমির শৈলেন্দ্র শাসকের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে।[৮]
১৪০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ উপকূলভিত্তিক মুসলমান সেনাবাহিনীগুলি ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের রাজ্যগুলি আক্রমণ করতে শুরু করে।[৬] ১৫শ ও ১৬শ শতাব্দীতে সুলতানদের নেতৃত্বাধীন মুসলমান সামরিক অভিযানগুলির লক্ষ্য ছিল ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের হিন্দু-বৌদ্ধ রাজ্যগুলি এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠী। কারণ, প্রত্যেক সুলতানই একটি অঞ্চল বা দ্বীপকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করতেন।[৯] উত্তর সুমাত্রা (আকেহ), দক্ষিণ সুমাত্রা, পশ্চিম ও মধ্য জাভা ও দক্ষিণ বোর্নিওতে (কালিমান্তান) চারটি ভিন্ন ও বিবদমান সুলতানি রাজ্য গড়ে ওঠে।[১০] এই জাতীয় হিংসাত্মক ঘটনাক্রমে ইন্দোনেশিয়ার অনেক দ্বীপেই হিন্দু-বৌদ্ধ রাজ্যগুলির পতন ঘটে ও একাধিক জনগোষ্ঠী অবলুপ্ত হয়।[৬] অন্যান্য ক্ষেত্রে হিন্দু ও বৌদ্ধরা পালিয়ে গিয়ে যে দ্বীপগুলি তারা রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল, সেগুলিতে একক জনগোষ্ঠী হিসাবে বসবাস করতে শুরু করে। পশ্চিম জাভার হিন্দুরা পূর্ব দিকে চলে আসে এবং তারপর চলে যায় বালি ও তার পার্শ্ববর্তী ছোটো ছোটো দ্বীপগুলিতে। এইভাবেই বালিদ্বীপীয় হিন্দুধর্মের সূত্রপাত ঘটে।[১১] ধর্মীয় সংঘাত ও আন্তঃসুলতানি যুদ্ধের এই যুগ যখন ক্রমশ উন্মোচিত হচ্ছিল এবং ক্ষমতার নতুন নতুন কেন্দ্র যখন বিভিন্ন অঞ্চলে নিজ কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করার চেষ্টা করছিল, সেই সময় এই অঞ্চলে আবির্ভাব ঘটে ইউরোপীয় ঔপনিবেশকতার।[১১] অনতিকাল পরেই ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ ওলন্দাজ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়।[১২] ওলন্দাজ কর্তৃপক্ষ আন্তঃধর্মীয় সংঘাত রোধে সহায়তা করে এবং ধীরে ধীরে খননকার্যের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ার প্রাচীন হিন্দু-বৌদ্ধ সাংস্কৃতিক ভিত্তিটিকে অনুধাবন ও সংরক্ষণের প্রক্রিয়া শুরু করে। এই কাজ বিশেষভাবে চলেছিল জাভা ও ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম দিকের দ্বীপগুলিতে।[১৩]
মূল বিশ্বাস
ঈশ্বর এবং দেবতা
তথ্যসূত্র
আরও পড়ুন
Wikiwand - on
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.