Remove ads
১৯৯২-এ ভারতে ধর্মীয় দাঙ্গা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং এর সহযোগী সংগঠনের হিন্দু কর্মীরা উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যাতে ষোড়শ শতাব্দীর বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে। ঐ স্থানে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো দ্বারা আয়োজিত এক রাজনৈতিক সমাবেশে আগত লোকজন সহিংস হয়ে উঠার পর ধ্বংসযজ্ঞটি সংঘটিত হয়।
বাবরি মসজিদ ধ্বংস | |
---|---|
স্থান | অযোধ্যা, ভারত |
তারিখ | ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ |
লক্ষ্য | বাবরি মসজিদ |
হামলার ধরন | দাঙ্গা |
নিহত | ২,০০০ (মসজিদ ভাঙার পর সংগঠিত দাঙ্গা সহ)[১] |
হামলাকারী দল | বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও ভারতীয় জনতা পার্টির কর সেবক |
হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী অযোধ্যা হল রামের জন্মভূমি। ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘল সেনাপতি মির বাকি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যা বাবরি মসজিদ নামে পরিচিত। তিনি যে স্থানে মসজিদটি নির্মাণ করেন তা কিছু হিন্দুর কাছে রাম জন্মভূমি বলে অভিহিত হয়ে থাকে। আশির দশকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তাদের (ভিএইচপি) তাদের রাজনৈতিক সহযোগী ভারতীয় জনতা পার্টিকে সাথে নিয়ে ঐ স্থানে রাম মন্দির নির্মাণের জন্য প্রচারাভিযান চালায়। রাম মন্দির নির্মাণের জন্য কিছু শোভাযাত্রা ও মিছিল আয়োজন করা হয়েছিল। এসব শোভাযাত্রা ও মিছিলের মাঝে অন্তর্ভুক্ত ছিল রাম রথ যাত্রা, যার নেতৃত্বে ছিলেন লাল কৃষ্ণ আদভানি।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভিএইচপি ও বিজেপি ঐ স্থানে দেড় লাখ করসেবককে নিয়ে একটি শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রা চলাকালে তারা সহিংস হয়ে পড়ে এবং আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধা উপেক্ষা করে মসজিদটি ভেঙে ফেলে। পরবর্তীকালে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা যায় যে, ঘটনাটির সাথে ৬৮ জন জড়িত, যাদের মাঝে কিছু বিজেপি এবং ভিএইচপির নেতারও নাম বিদ্যমান। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দরুন ভারতের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মাঝে সৃষ্টি হওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কয়েকমাস ধরে চলেছিল, যা কমপক্ষে ২,০০০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটায়; যাদের বেশিরভাগই মুসলিম।[২] পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল।
হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী, হিন্দু ধর্মীয় দেবতা রামের জন্মভূমি "রাম জন্মভূমি" নামে পরিচিত, যাকে হিন্দুরা তীর্থস্থান বলে বিশ্বাস করে থাকেন। এটা বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে, অযোধ্যার যে স্থানে বাবরি মসজিদ নির্মিত, সে স্থানটি রামের জন্মভূমি। কিন্তু, এর স্বপক্ষে ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই বললেই চলে।[৩][৪] মোটামুটিভাবে ঐতিহাসিকেরা একমত যে, ১৫২৮ সালে ঐ অঞ্চল মুঘল শাসনের আওতাভুক্ত হয় এবং মুঘল সেনাপতি মির বাকি মুঘল সম্রাট বাবরের নামে "বাবরি মসজিদ" এর নামকরণ করেন।[৫][৬][ক] জনসাধারণের মাঝে এই বিশ্বাস প্রচলিত যে, মির বাকি একটি রাম মন্দির ধ্বংস করে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন কিন্তু, এর পক্ষে যে ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায়, তা বিতর্কিত।[৩][৪] প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণার পর মসজিদটির ভূমির নিচে একটি কাঠামো আবিষ্কৃত হয়। কাঠামোটি বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু মন্দির এবং বৌদ্ধ স্থাপত্য বলে অভিহিত হয়েছে।[৩][৫]
প্রায় চার শতাব্দী ধরে মসজিদটিতে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষেরাই প্রার্থনা করেছে। ১৮২২ সালে প্রথমবারের মত ফৈজাবাদ আদালতের এক চাকরিজীবী দাবি করেন যে, মসজিদটি যে মন্দিরের জমির উপরে অবস্থিত। [৫][৬] নির্মোহী আখড়া সংগঠন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ঐ জমির উপরে তাদের দাবি জানায়। ১৮৫৫ সালে ঐ ভূখণ্ডের দখল নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।[৬][৭] ১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন সংঘর্ষ এড়াতে দেয়াল দিয়ে হিন্দু ও মুসলমানদের প্রার্থনার জায়গা আলাদা করে দেয়। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক মতই চলছিল। ১৯৪৯ সালে হিন্দু মহাসভার সদস্যদের মসজিদের অভ্যন্তরে রাম মূর্তি স্থাপন করার অভিযোগে দুই পক্ষের মাঝে সৃষ্টি হয় উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং তারা আইনের আশ্রয় নেয়। ইসলাম ধর্মে মসজিদে মূর্তি স্থাপনকে অপবিত্রতা হিসেবে গণ্য করা হয়। মসজিদটিকে বিতর্কের বিষয় বলে অভিহিত করে সরকার এবং মসজিদের দরজায় তালা লাগানো হয়।[৬][৮]
আশির দশকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) তাদের রাজনৈতিক সহযোগী ভারতীয় জনতা পার্টিকে (বিজেপি) সাথে নিয়ে ঐ স্থানে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচারাভিযান চালায়।[৬][৯] তাদের প্রচারাভিযানের আগুনে ঘি ঢালেন এক জেলা জজ, যিনি ১৯৮৬ সালে দরজার তালা খোলার এবং ঐ স্থানে হিন্দুদের প্রার্থনা করার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন।[৬][৮] আদালতের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানান ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিবিদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, যিনি শাহ বানো বিতর্কের দরুন গোঁড়া হিন্দুদের সমর্থন হারানোর পর পুনরায় গোঁড়া হিন্দুদের সমর্থন লাভে উদ্যত হয়েছিলেন।[৫][৬] তা সত্ত্বেও, কংগ্রেস ১৯৮৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হয় এবং লোকসভায় বিজেপির আসন ২ থেকে বেড়ে ৮৮ তে দাঁড়ায় যা, ভি. পি. সিং সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।[৬][১০]
১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিজেপি নেতা এল. কে. আদভানি রাম রথযাত্রা নামের একটি রাজনৈতিক শোভাযাত্রার আয়োজন করেন। শোভাযাত্রাটি গোটা উত্তর ভারত ঘুরে অযোধ্যাতে এসেছিল। এই শোভাযাত্রা প্রস্তাবিত মন্দিরের জন্য সমর্থন আনার জন্য এবং মুসলিমবিরোধী মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে হিন্দু ভোটগুলোকে একটি দলের বাক্সে আনার পক্ষে কাজ করেছিল।[১১] অযোধ্যায় পৌঁছানোর পূর্বে বিহার প্রাদেশিক সরকার তাকে গ্রেফতার করে। তা সত্ত্বেও, বহু করসেবক বা সংঘ পরিবার কর্মী অযোধ্যায় পৌঁছেছিল এবং মসজিদটি আক্রমণ করতে চেষ্টা করেছিল। ফলশ্রুতিতে, আধাসামরিক বাহিনীর সাথে তারা পূর্বপরিকল্পিত সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সংঘর্ষের ফলে কিছু করসেবক নিহত হন। এরপর, বিজেপি নতুন নির্বাচনের দাবি জানায় এবং ভি. পি. সিং সরকার থেকে তাদের সমর্থন তুলে নেয়। এরপর, বিজেপির লোকসভা আসন সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং তারা উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।[১০]
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলো ঐ বিতর্কিত স্থানে এক শোভাযাত্রার আয়োজন করে। শোভাযাত্রায় শামিল হয়েছিল দেড় লাখ ভিএইচপি এবং বিজেপি "কর সেবক"। এছাড়া, অনুষ্ঠানে আদভানি, মুরলি মনোহর জোশি ও উমা ভারতীর মত বিজেপি নেতা ভাষণ দিয়েছিলেন।[১২] শোভাযাত্রা চলাকালের প্রথম দিকে জনতা ক্লান্তিহীনভাবে স্লোগান দিচ্ছিল। সহিংসতা প্রতিরোধে স্থাপনাটির চারদিকে পুলিশি বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছিল। দুপুরের দিকে এক যুবক বেষ্টনী অতিক্রম করে স্থাপনাটির উপরে চলে যায় এবং গেরুয়া পতাকা উত্তোলন করে। এই ঘটনা ছিল সহিংসতার আগমনবার্তা। এরপর, উন্মত্ত জনতার সামনে পুলিশি বেষ্টনী বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। এরপর, উন্মত্ত জনতা কুঠার, হাতুড়ি এবং গাইতি দিয়ে ইমারতটি ভাঙা শুরু করে। কয়েক ঘণ্টার মাঝে কাদা ও চুনাপাথর দ্বারা নির্মিত ইমারতটি মাটির সাথে মিশে যায়।[১৩][১৪]
২০০৯ সালে মনমোহন সিং লিবারহানের লিবারহান কমিশনের প্রতিবেদনে ৬৮ জন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সাথে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়, যাদের অধিকাংশই ছিলেন বিজেপি নেতা। দোষী ব্যক্তিদের নামের তালিকায় বাজপেয়ী, আদভানি, জোশি এবং বিজয় রাজে স্কিন্দিয়ার নাম ছিল। উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংয়ের সমালোচনা করা হয় প্রতিবেদনটিতে। প্রতিবেদনটিতে সে সময়ে ইমারতটি ভাঙার সময় অযোধ্যার পুলিশ ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কথা উল্লেখ করে হয়েছে।[১৫] সেদিন আদভানির নিরাপত্তার অঞ্জু গুপ্তা বলেছেন যে, আদভানি ও জোশির বক্তব্য জনতাকে আরো উন্মত্ত করে তুলেছিল।[১৬] প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে কিছু বিজেপি নেতা মসজিদ ভাঙার সময়ে "কর সেবকদের থামতে দুর্বল অনুরোধ করেছিলেন... হয়ত মন থেকে অথবা গণমাধ্যমে সহানুভূতি পাবার জন্য।" কর সেবকদের পবিত্র গৃহে প্রবেশ করা কিংবা ইমারতটি ধ্বংস করা থেকে বিরত করার জন্য কেউ কোন অনুরোধ করে নি। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে যে : "নেতাদের কাজ তাদের মনের গহীনে বিতর্কিত ইমারতটি ভাঙার সুপ্ত ইচ্ছাকেই ফুটিয়ে তোলে।" প্রতিবেদনটিতে আরাও বলা হয়েছে যে, "আন্দোলনের উদ্দেশ্য বর্তমানে [সেই সময়ে]... খুব সহজেই... ধ্বংসযজ্ঞটি থামাতে পারত।"[১৭]
২০০৫ সালের মার্ভে একটি বইয়ে সাবেক গোয়েন্দা প্রধান মলয় কৃষ্ণ ধর দাবি করেন যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস), বিজেপি এবং ভিএইচপির নেতারা ইমারতটি ভাঙার দশ মাস পূর্বেই এটি ভাঙার পরিকল্পনা করেছিলেন। বইটিতে ইস্যুটির ব্যাপারে পি. ভি. নরসিমা রাওয়ের পদক্ষেপের সমালোচনা করা হয়। ধর আরো দাবি করেন যে, তিনি বিজেপি ও সংঘ পরিবারের ব্যক্তিদের একটি বৈঠকের নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্বে ছিলেন এবং বৈঠকটিতে নিঃসন্দেহে "তারা (আরএসএস, বিজেপি, ভিএইচপি ১৯৯২ সালে অযোধ্যায় হিন্দুত্বের জিগির তুলে প্রলয় সৃষ্টির নীল নকশা রচনা করেছিলেন। আরএসএস, বিজেপি, ভিএইচপি এবং বৈঠকে উপস্থিত বজরং দলের নেতাদের সবাই সুসংগঠিতভাবে কাজটি সম্পন্ন করতে চাইলেন।" তিনি উল্লেখ করেন যে, তিনি ঐ বৈঠকের কথাবার্তা রেকর্ড করে তার উপরের কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, তিনি নিশ্চিত যে ব্যাপারটা তার উপরের কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রী (রাও) এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে (শঙ্কররাও চবন) অবহত করেছেন। তিনি আরো দাবি করেন যে, এ বিষয়ে কেউ প্রকাশ্যে স্বীকার করুক আর নাই করুক, মনে মনে সবাই স্বীকাফ করে যে, অযোধ্যার ঘটনা " হিন্দুত্বকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অনন্য সুযোগ" হিসেবে কাজ করেছে।[১৮]
২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে কোবরাপোস্ট এর একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয় যে, ধ্বংসযজ্ঞটি শুধু উন্মত্ত জনতার কাজ ছিল না, এটা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত এবং এর ভিত রচিত প্রচণ্ড গোপনীয়তার মাঝে, যাতে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা এটি সম্পর্কে কোন কথা জানতে না পারে। প্রতিবেদটিতে আরো দাবি করা হয় যে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং শিব সেনার সদস্যরা আলাদা আলাদা ভাবে ইমারতটি ধ্বংসের কয়েক মাস পূর্বেই ইমারতটি ধ্বংসের পরিকল্পনা করেছিল।[১৯]
১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ১০ মাস পর চার্জশিট দেয় সিবিআই। প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে নাম ছিল। লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলী মনোহর জোশী, উমা ভারতী, কল্যাণ সিং, বিনয় কাটিয়ার, সাক্ষী মহারাজ, সাধ্বী ঋতম্ভরা , নৃত্য গোপাল দাস, চম্পত রাইয়ের , অশোক সিঙ্ঘল, গিরিরাজ কিশোর, বিষ্ণুহরি ডালমিয়া, শিবসেনা সুপ্রিমো, বাল ঠাকরে,[২০]
২৮ বছরে নানা নাটকীয় টানাপোড়েনের সাক্ষী থেকেছে বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলা। ঘটনার পর সাবেক ফৈজাবাদ জেলায় পুলিস ২টি এফআইআর দায়ের করে। ১৯৭ নম্বর এফআইআরে অজ্ঞাতপরিচয় লাখো করসেবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়। লখনউয়ের আদালতে শুরু হয় মামলা। ১৯৮ নম্বর এফআইআরে আডবাণী, জোশী, উমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করা হয়। রায়বরেলির আদালতে শুরু হয় মামলা। তদন্ত শুরুর পর তিরানব্বইয়ের অক্টোবরে ২ মামলায় যৌথ চার্জশিট দেয় সিবিআই। ৪৮জন নেতার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাও মসজিদ ধ্বংসে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে। ২০০১-এ আডবাণী-সহ ১৪ জন নেতাকে, ষড়যন্ত্রের অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয় নিম্ন আদালত।
সে সময়ে বাবরি মসজিদ ও অন্যান্য স্থাপনার ধ্বংসযজ্ঞ সারা ভারতে মুসলমানবিরোধী সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়। হিন্দু ও মুসলমানরা একে অপরের সাথে কয়েক মাস ধরে সাম্প্রদায়িক সংঘাতে লিপ্ত হয়; তারা অন্য ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি, দোকান এবং প্রার্থনাগৃহ জ্বালিয়ে দেয় এবং তাতে লুটপাটে লিপ্ত হয়।[১৩] কিছু বিজেপি নেতাকে কাস্টডিতে নেওয়া হয় এবং সরকার ভিএইচপিকে নিষিদ্ধ করে। তা সত্ত্বেও তা মুম্বাই, সুরাট, আহমেদাবাদ, কানপুর, দিল্লি ও ভোপালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামাতে পারে নি যে দাঙ্গায় দুই হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান।[১৩] ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে বোম্বে দাঙ্গা সম্পন্ন হবার ক্ষেত্রে শিব সেনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। দাঙ্গায় প্রায় ৯০০ জন নিহত এবং প্রায় ৯,০০০ কোটি ভারতীয় রুপির (৩৬০ কোটি মার্কিন ডলার) সম্পদ বিনষ্ট হয়।[২১][২২][২৩] বাবরি মসজিদ ধ্বংসযজ্ঞ ১৯৯৩ সালে বোম্বে বোমা হামলা এবং পরবর্তী সময়কালে সম্পন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটনের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।[২৪] ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের মত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো তাদের সন্ত্রাসী হামলাগুলোর কারণ হিসেবে বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে উল্লেখ করেছিল।[২৫][২৬]
১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে কেন্দ্রীয় সরকার মসজিদ ধ্বংসের বিষয়টি তদন্ত করার জব্য অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ আদালত বিচারক মনমোহন সিং লিবারহানের নেতৃত্বে লিবারহান কমিশন গঠন করে। ১৬ বছরে ৩৯৯ বার বৈঠকের পর ২০০৯ সালের ৩০ জুন কমিশন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১,০২৯ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।[২৭] প্রতিবেদন অনুসারে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের ঘটনা "অপ্ররোচিত কিংবা অপরিকল্পিত" ছিল না।[২৮] ২০১৫ সালের মার্চ মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পিটিশনে অভিযোগ করা হয় যে, বিজেপি সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সিবিআই এল. কে. আদভানি এবং রাজনাথ সিংয়ের মত প্রবীণ বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে না।[২৯] আদালত সিবিআইকে তাদের কাজকর্মে দেরি হবার কারণ দর্শাতে অনুরোধ করে।[৩০][৩১] ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে মুরলি মনোহর জোশি, উমা ভারতী, বিনয় কাটিয়ার এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের উপর আনীত অভিযোগের বিচার কার্যক্রম চালানোর জন্য একটি বিশেষ সেন্টার ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন আদালত গঠিত হয়।[৩২]
পাকিস্তানে সেদেশের সরকার বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদ জানানোর জন্য ৭ ডিসেম্বর সব অফিস ও স্কুল বন্ধ বলে ঘোষণা করে।[৩৩] পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করেন এবং এই ঘটনার কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেন। তিনি আরো জানান যে, তিনি জাতিসংঘ ও অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্সকে ভারতীয় মুসলমানদের অধিকার রক্ষার জন্য ভারতকে চাপ প্রয়োগ করতে অনুরোধ করবেন।[৩৩] পাকিস্তানজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতা একদিনে আগুন এবং বুলডোজারের সাহায্যে প্রায় ৩০ টি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে এবং লাহোরে অবস্থিত ভারতীয় জাতীয় বিমানসংস্থা এয়ার ইন্ডিয়ার কার্যালয়ে হামলা চালায়।[৩৩] বিক্ষুব্ধ জনতা ভারত এবং হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম স্লোগান দিতে থাকে।[৩৩] ইসলামাবাদের কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পি. ভি. নরসিমা রাওয়ের কুশপুত্তলিকা দাহ করে এবং হিন্দুদের বিরুদ্ধে "জিহাদ" এর ডাক দেয়।[৩৩] পরবর্তী বছরগুলোতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর নির্যাতন ও বৈষম্য বাড়ার কারণ দেখিয়ে ভারত গমনকারী বহু পাকিস্তানি হিন্দু ভিসার মেয়াদ বাড়াতে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতীয় নাগরিকত্বের আবেদন করে।[৩৪]
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর বিক্ষুব্ধ জনতা দেশজুড়ে হিন্দুদের মন্দির, দোকান এবং বাড়িতে আক্রমণ করে এবং অগ্নিসংযোগ করে।[৩৫] প্রায় পাঁচ হাজার লোক ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ভারতীয় ও বাংলাদেশি ক্রিকেট দলের ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালে তা পণ্ড করার চেষ্টা করলে খেলা বিঘ্নিত হয়।[৩৫] ঢাকায় অবস্থিত এয়ার ইন্ডিয়া অফিসে হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা ঘটে।[৩৩] ১০ জন মানুষ নিহত হওয়া ছাড়াও ১১ টি হিন্দু মন্দির এবং হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবার খবর জানা যায়।[৩৫][৩৬][৩৭] সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশি হিন্দু সম্প্রদায়, ১৯৯৩ সালে দুর্গাপূজার জাঁকজমক কমিয়ে দেয় এবং ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হওয়া হিন্দু মন্দির মেরামত এবং এই সহিংস ঘটনার তদন্তের দাবি জানায়।[৩৫]
আবুধাবিতে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) এক সম্মেলনে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের তীব্র নিন্দা জানানো হয়। সেখানে ঘটনাটিকে "মুসলিম পবিত্র স্থানে বিরোধী অপকর্ম" অভিহিত করে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর সদস্য দেশগুলোর মাঝে, সৌদি আরব কয়েকবার ঘটনার নিন্দা জানায়। বহু ভারতীয় অভিবাসী অধ্যুষিত সংযুক্ত আরব আমিরাত তুলনামূলক নরম প্রতিক্রিয়া জানায়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে, ভারত সরকার জিসিসির সমালোচনা করে এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক না গলাতে অনুরোধ করে।[৩৮] ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনেই ঘটনার নিন্দা জানান এবং ভারতকে সেদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় আরো তৎপর হতে অনুরোধ করেন।[৩৩] ঘটনার পর সরকার নিন্দা জানানো সত্ত্বেও সংযুক্ত আরব আমিরাতে কিছু বিক্ষোভ মিছিলের সৃষ্টি হয়েছিল।[৩৯] বিক্ষোভকারীরা একটি হিন্দু মন্দির ও দুবাইয়ে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসে পাথর ছোঁড়ে [৩৯] আবুধাবির ২৫০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত আল-আইনে উন্মত্ত জনতা একটি ভারতীয় বিদ্যালয়ের বালিকা শাখায় অগ্নিসংযোগ করে।[৩৯] সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির পুলিশ সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে সেদেশে বসবাসকারী বহু ভারতীয় ও পাকিস্তানি অভিবাসীকে গ্রেফতার ও দ্বীপান্তরিত করে। দুবাই পুলিশ প্রধান দাহি খালফান সেদেশে বিদেশি নাগরিকের উপর সংঘটিত হামলার নিদা জানান।[৩৯]
সন্দেহভাজন প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্তরাজ্যে বেশ কয়েকটি মন্দিরে হামলা হয়েছিল।[৪০] হামলার মধ্যে পেট্রোল বোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ছিল।[৪১] হিন্দু ও শিখ মন্দির, হিন্দু কমিউনিটি সেন্টার ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক ভবনে হামলা চালানো হয়। অগ্নিসংযোগের কারণে একটি মন্দির সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বলে জানা যায়।[৪২] হামলার পর হিন্দু-মুসলিম নেতারা শান্তির আবেদন জানান।[৪৩]
মালয়ালম লেখক এন. এস. মাধবনের গল্প থিরুথু বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কাহিনিকে ভিত্তি করে লেখা হয়েছে।[৪৪] ২০১৬ সালে প্রকাশিত অন্তরা গাঙ্গুলির তানিয়া তানিয়া উপন্যাসটির পটভূমিক অযোধ্যা বিতর্ক এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।[৪৫]
আনন্দ পটবর্ধনের প্রামাণ্যচিত্র রাম কে নাম বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা সংঘটনের কারণ অনুসন্ধান করা হয়েছে।[৪৬] ২০১১ সালের হিন্দি চলচ্চিত্র মৌসম বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পারিপার্শ্বিক ঘটনাকে ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে।[৪৭] বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা বিভিন্ন চলচ্চিত্রের গল্পে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে। বোম্বে (১৯৯৫) চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে বোম্ব দাঙ্গার গল্পকে ভিত্তি করে।[৪৮] দাইভানামাথিল (২০০৫) কেরালার মুসলমানদের ওপর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রভাব অনুসন্ধান করেছে।[৪৯] বোম্বে এবং দাইভানামাথিল নার্গিস দত্ত জাতীয় অন্তর্ভুক্তিমূলক সেরা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছিল।[৫০][৫১] ২০০৭ সালের হিন্দি চলচ্চিত্র ব্ল্যাক ফ্রাইডে নির্মিত হয়েছে ১৯৯৩ সালের বোম্বে বোমা হামলার কাহিনিকে ভিত্তি করে, যে বোমা হামলাকে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে গণ্য করা হয়।[৫২][৫৩]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.