শরণার্থী বা উদ্বাস্তু (ইংরেজি: refugee) একজন ব্যক্তি যিনি নিজ ভূমি ছেড়ে অথবা আশ্রয়ের সন্ধানে অন্য দেশে অস্থায়ীভাবে অবস্থান করেন। জাতিগত সহিংসতা, ধর্মীয় উগ্রতা, জাতীয়তাবোধ, রাজনৈতিক আদর্শগত কারণে সমাজবদ্ধ জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তাহীনতাই এর প্রধান কারণ। যিনি শরণার্থী বা উদ্বাস্তুরূপে স্থানান্তরিত হন, তিনি আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে পরিচিত হন। আশ্রয়প্রার্থী ব্যক্তির স্বপক্ষে তার দাবীগুলোকে রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত হতে হবে।[1]

Thumb
২০০৬ সালে দক্ষিণ লেবাননে অবস্থানকারী লেবাননীয় শরণার্থী

৩১ ডিসেম্বর, ২০০৫ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান, ইরাক, সিয়েরালিওন, মায়ানমার, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান এবং ফিলিস্তিন বিশ্বের প্রধান শরণার্থী উৎসস্থল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। আইডিপি অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শরণার্থী ব্যক্তি এসেছে দক্ষিণ সুদান থেকে, যা প্রায় ৫ মিলিয়ন। জনসংখ্যা অনুপাতে সবচেয়ে বেশি আইডিপি রয়েছে আজারবাইজানে। সেখানে ২০০৬ সালের তথ্য মোতাবেক প্রায় আট লক্ষ শরণার্থী অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।[2]

সংজ্ঞার্থ নিরূপণ

১৯৫১ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক শরণার্থীদের মর্যাদা বিষয়ক সম্মেলনে অনুচ্ছেদ ১এ-তে সংক্ষিপ্ত আকারে শরণার্থীর সংজ্ঞা তুলে ধরা হয়। একজন ব্যক্তি যদি গভীরভাবে উপলদ্ধি করেন ও দেখতে পান যে, তিনি জাতিগত সহিংসতা, ধর্মীয় উন্মাদনা, জাতীয়তাবোধ, রাজনৈতিক আদর্শ, সমাজবদ্ধ জনগোষ্ঠীর সদস্য হওয়ায় তাকে ঐ দেশের নাগরিকের অধিকার থেকে দূরে সরানো হচ্ছে; সেখানে ব্যাপক ভয়-ভীতিকর পরিবেশ বিদ্যমান এবং রাষ্ট্র তাকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে ; তখনই তিনি শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হন।[3] ১৯৬৭ সালের সম্মেলনের খসড়া দলিলে উদ্বাস্তুর সংজ্ঞাকে বিস্তৃত করা হয়। আফ্রিকাল্যাটিন আমেরিকায় অনুষ্ঠিত আঞ্চলিক সম্মেলনে যুদ্ধ এবং অন্যান্য সহিংসতায় আক্রান্ত ব্যক্তি কর্তৃক নিজ দেশত্যাগ করাকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এই সংজ্ঞায় শরণার্থীকে প্রায়শই ভাসমান ব্যক্তিরূপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সম্মেলনে গৃহীত সংজ্ঞার বাইরে থেকে যদি যুদ্ধের কারণে নির্যাতন-নিপীড়নে আক্রান্ত না হয়েও মাতৃভূমি পরিত্যাগ করেন অথবা, জোরপূর্বক নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হন - তাহলে তারা শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হবেন।[4]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

Thumb
১৯৪২ সালে স্ট্যালিনগ্রাদের যুদ্ধে রুশ শরণার্থীদের অন্যত্র গমনের দৃশ্য।

সংঘর্ষ এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অগণিত লোক শরণার্থী হয়েছিলেন। যুদ্ধশেষে একমাত্র ইউরোপেই ৪০ মিলিয়নেরও অধিক লোক শরণার্থী ছিল।[5] ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি জাতিসংঘ ত্রাণ ও পুণর্বাসন প্রশাসন (ইউএনআরআরএ) গঠন করে; যার প্রধান কাজ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন দেশসহ ইউরোপ ও চীন থেকে আগত শরণার্থীদেরকে সহায়তা করা। তাদের নিয়ন্ত্রণে ও প্রত্যক্ষ সহায়তায় ৭ মিলিয়ন লোক নিজ বাসভূমিতে ফিরে যায়। কিন্তু উদ্বাস্তু এক মিলিয়ন লোক মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।

বিশ্বযুদ্ধের শেষ মাসে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন জার্মান বেসামরিক নাগরিক পূর্ব প্রুশিয়া, পোমারানিয়া এবং সিলেসিয়া রাজ্য থেকে রেড আর্মির প্রচণ্ড আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে ম্যাকলেনবার্গ, ব্রান্ডেনবার্গ এবং স্যাক্সনিতে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেয়।

পটসড্যাম সম্মেলনের সিদ্ধান্ত মিত্রশক্তি অনুমোদন না করায় যুগোস্লাভিয়া এবং রোমানিয়ায় অবস্থানরত হাজার হাজার জাতিগত জার্মানদেরকে সোভিয়েত ইউনিয়নে দাস শ্রমের জন্য ফেরত পাঠানো হয়। বিশ্বের ইতিহাসে এটিই ছিল সবচেয়ে বেশি শরণার্থী স্থানান্তর প্রক্রিয়া। ১৫ মিলিয়ন জার্মানদের সবাই এতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এছাড়াও, দুই মিলিয়নেরও অধিক জার্মান বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে বিতাড়িত হয়ে প্রাণ হারান।[6][7][8][9][10]

পূর্ব ইউরোপ থেকে ব্যাপক সংখ্যায় দলে দলে লোক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে শরণার্থীরূপে বিবেচিত হয়। প্রধানত ইউরোপীয় শরণার্থী হিসেবে ইহুদী এবং স্লাভগণ জোসেফ স্টালিন, নাজি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়গ্রহণকে নিরুৎসাহিত করা হয়।[11]

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী

১৯৯১-৯২ সালে আড়াই লক্ষাধিক মুসলিম রোহিঙ্গা শরণার্থী বার্মার (বর্তমান: মায়ানমার) সামরিক জান্তার নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তাদের অনেকেই বিশ বছর যাবৎ বাংলাদেশে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে দু'টি ভাগে ভাগ করেছে। শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থানকারী স্বীকৃত রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের সাথে মিশে যাওয়া অস্বীকৃত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রয়েছে। কক্সবাজারের নয়াপাড়া এবং কুতুপালং এলাকার দু'টি ক্যাম্পে ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গা বাস করছে।

আরাকান রাজ্য থেকে গত কয়েক মাসে রোহিঙ্গাদের উপর ব্যাপক নির্যাতনের ফলে তাদের বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। কঠোর নিবন্ধিকরণ আইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, চলাফেরায় বিধিনিষেধ আরোপ, ভূমি বাজেয়াপ্তকরণ, বার্মার বৌদ্ধদের অবস্থানের জন্য জোরপূর্বক উচ্ছেদকরণ, ২০০৬ সালের শেষ পর্যায়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় আরাকানের ৯টি মসজিদের আশেপাশে অবকাঠামোগত প্রকল্প গ্রহণ এর জন্য দায়ী বলে ধারণা করা হয়।[12][13]

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

বহিঃসংযোগ

Wikiwand in your browser!

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.

Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.