ইমাম শামিল

উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ

ইমাম শামিল

ইমাম শামিল ( আভের: Шейх Шамил; তুর্কি: Şeyh Şamil; রুশ: Имам Шамиль; আরবি: الشيخ شامل) (২৬ জুন ১৭৯৭ - ৪ই ফেব্রুয়ারি ১৮৭১) ছিলেন উত্তর ককেশাসের আভার জাতিগোষ্ঠীর একজন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা। তিনি  দাগেস্তানককেশাসের একজন ধর্মীয় নেতা ও মহান বীর। তিনি ককেশাসের প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্যতম নেতা।[] অর্ধশত বছর ধরে তিনি প্রতাপশালী জার সম্রাটদের সাথে লড়াই করেছেন।[] এক যুদ্ধে তার পাঁজরের তিনটি হাড় কেটে যায় ও তাকে ঘেরাও করে ফেলে জার সৈন্যরা। তখন তিনি তার বিখ্যাত ঘোড়ায় চড়ে এক লাফে তিন সারি সৈন্যের মাথার উপর দিয়ে চলে যান। এরপর থেকেই তিনি সিংহ বলে পরিচিত। তাকে শেরে দাগেস্তানও বলা হয়। অর্ধশত বছর লড়াই করে শেষ বয়সে এক প্রচন্ড যুদ্ধে তিনি খুব অল্প সংখ্যক সেনা নিয়ে তার মোকাবেলা করেন এবং দূর্বল হয়ে পড়েন,পরিশেষে জার তাকে আত্মসমর্পণের জন্য চাপ দেন কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং শান্তি চূক্তিতে আবদ্ধ হন। তাকে যথাযথ সম্মান দিয়ে রাশিয়া নিয়ে যান তার কয়েকজন নায়েব সহ। কিন্তু আত্মসর্মপন করেন নি তিনি। যথা সম্ভব জার সম্রাট আলেক্সজ্যান্ডারই তাকে স্বস্মানে সেন্ট পিটার্সবার্গে নিয়ে তার ইচ্ছা অনুযায়ী মদিনায় পাঠিয়ে দেন এবং তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন এবং জান্নাতুল বাক্বীতে তার সমাধি করা হয় । তাকে কেউ কেউ যুলফিকার নামেও স্মরণ করেন।[][]

দ্রুত তথ্য ইমাম শামিল, দাগেস্থানের ইমাম ...
ইমাম শামিল
Thumb
দাগেস্থানের ইমাম
রাজত্ব১৮৩৪–১৮৫৯
পূর্বসূরিগামজাত বেক
উত্তরসূরিরুশ সাম্রাজ্য দ্বারা ক্ষমতাচ্যূত
জন্ম২৬ জুন ১৭৯৭
গিমারি, দাগেস্থান
মৃত্যু৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৭১(1871-02-04) (বয়স ৭৩)
মদিনা, হেজাজ, উসমানীয় সাম্রাজ্য
সমাধি
পিতাদেন্গু
ধর্মসুন্নি ইসলাম (নকশবন্দি সুফিবাদ)
বন্ধ

প্রাথমিক জীবন

মুসলিম ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নতুন বছরের প্রথম দিনে অর্থ্যাৎ মুহররমের প্রথম দিনের ১৭৯৭ সালে ২৬ জুন বর্তমানে রাশিয়ার দাগেস্তানের গিমরা[][][][][][১০][১১](জেনুব) অভ্র গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ইমাম শামিল। তার পিতামহ আলীর সম্মানে তার নাম দেওয়া হয় আলি। ছোটবেলায় সে অনেক অসুস্থ ছিল, এবং বিশ্বাস অনুযায়ী তার পিতামাতা তাকে একটি নতুন নাম দিয়েছিলেন - শামিল যা ছিল তার মামার সম্মানে।[১২]

অভ্র উজডেনের পুত্র,[১৩] একজন ব্ল্যাকস্মিথ, ডেঙ্গাভ-মাগোমেদ, যার প্রপিতামহ ছিলেন কুমিক আমিরখান[১৪][১৫][১৬] এবং অভ্র শিম পীর-বুদার কন্যা - বহু মেসেদা।[১৭][১৮][১৯] একটি সংস্করণ অনুসারে শামিলের মা ছিলেন আশিলতা গ্রামের একজন অভ্রকা[২০] বা কুমিচকা।[২১]

দাগেস্তানের প্রথ্ম ইমাম গাজি মোল্লা ছিলেন তার আধ্যাতিক গুরু এবং ছেলে বেলার বন্ধু ছিলেন। হযরত ইমাম গাজি মোল্লা ছিলেন বিখ্যাত নকশবন্দী সুফী ধারার অনুসারী। তিনি তার কাছ থেকে আধ্যাতিক শিক্ষার পাশাপাশি আরবী এবং তর্ক-শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করেন। ইমাম শামিল কোরআন-হাদীস এবং সমকলীন সমর জ্ঞানে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

ইমাম শামিল এমন সময় জ্ন্মগ্রহণ করেন য্খন রাশিয়ান সাম্রাজ্য বিস্তৃত হচ্ছিল এবং উসমানী খেলাফত সঙ্কুচিত হয়ে আসছিল। এতে অনুমান করা যায় পরবর্তী জীবন কেমন কঠিন গিয়েছিল।[২২]

রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ

সারাংশ
প্রসঙ্গ
Thumb
থিওডর হরশেল্ট দ্বারা শামিলের ক্যাপচার
Thumb
কার্তে দেস কাউকাসিচেন ইস্তমাস
Thumb
ইমাম শামিল
Thumb
"শামিলের পরিবার"। বাম থেকে ডানে: গাজি মুহাম্মদ, মুরিদ হাজিও; শামিলের ছেলে মুহাম্মদ-শফি; শামিলের জামাতা: আবদুররহিম এবং আবদুর রহমান (ছবি: কালুগা, ১৮৬০)

১৮৩২ সালে, গাজী মোল্লা জিমরিরের যুদ্ধে মারা যান, এবং শামিল এবং গাজী মোল্লার আরেক মুরিদ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেঁচে পালিয়ে আসেন। তবে শামিল সে যুদ্ধে গুরুতর আহত হন। এই লড়াইয়ের সময় তাকে বেয়নেট দিয়ে ছুরিকাঘাত করা হয়। যুদ্ধে আহত হওয়ার পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। তবে রাশিয়ার পক্ষ থেকে তাকে মৃত বলে ধরে নেওয়া হয়। সুস্থ হয়ে উঠার পর, তিনি আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসেন এবং দ্বিতীয় ইমাম গামজাত-বেকের নেতৃত্বে মুরিদদের সাথে পুনরায় যোগ দেন। ১৮৩৪ সালে গামজাত-বেককে হত্যা করার পর, শামিল ককেশীয় প্রতিরোধের প্রধান নেতা এবং ককেশীয় ইমামতের তৃতীয় ইমাম হিসাবে তার স্থান গ্রহণ করেন।[২৩][২৪]

১৮৩৯ সালে (জুন-আগস্ট), শামিল এবং তার অনুসারীরা, প্রায় ৪০০০ জন পুরুষ, মহিলা এবং শিশুসহ আখৌলগোর তাদের একটি পাহাড়ী দুর্গে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। জেনারেল পাভেল গ্র্যাবের নেতৃত্বে, রাশিয়ান সেনাবাহিনী শামিল ও তার অনুসারীদের অবস্থান সনাক্ত করে। তবে দূর্গটি তিন দিক থেকে সুরক্ষিত থাকার কারণে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে রুশ বাহিনীর প্রচন্ড অসুবিধায় পড়তে হয়। শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষ আলোচনায় বসে। গ্র্যাবের দাবি মেনে, শামিল তার ছেলে জামালদিনকে জিম্মি করে সরল বিশ্বাসের চিহ্ন হিসেবে প্রদান করে। তবে শামিল তার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া এবং এই অঞ্চল থেকে নির্বাসন গ্রহণ করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। শেষ পর্যন্ত রুশ সেনারা এ ঘাঁটিতে আক্রমণ করে এবং লড়াই দুই দিন অব্যাহত থাকে। হামলার প্রথম রাতেই শামিল অবরোধ থেকে পালিয়ে যায়। শামিলের বাহিনী ভেঙে দেওয়া হয় এবং অনেক দাগেস্তানি এবং চেচেন সর্দার জারের আনুগত্য স্বীকার করে। শামিল দাগেস্তান থেকে চেচনিয়ায় পালিয়ে যায়। সেখানে তিনি নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য দ্রুত কাজ করেন।[২৫]

শামিল তার ক্যারিশমা, ধার্মিকতা এবং শরিয়া আইন প্রয়োগে ন্যায্যতার জোরে রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বহু বিবাদমান ককেশীয় উপজাতিকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিল। একটি রুশ সূত্র তাকে "একজন মহান কৌশলী এবং একজন সূক্ষ্ম রাজনীতিবিদ" বলে মন্তব্য করেছে। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে এই অঞ্চলে রুশ অ্যালকোহল প্রবর্তন ঐতিহ্যগত মূল্যবোধকে কলুষিত করেছে। রুশ সামরিক বাহিনীর নিয়মিত অভিযানের বিরুদ্ধে, শামিল অনিয়মিত এবং গেরিলা কৌশলের কার্যকর ব্যবহার করেছিলেন। ১৮৪৫ সালে কাউন্ট মাইকেল ভোরনটসভের নেতৃত্বে আট থেকে দশ হাজার সদস্যবিশিষ্ঠ শক্তিশালী বাহিনী,চেচনিয়ার বনে কলাম ইমামতের বাহিনীর পিছু করে। ইমামতের বাহিনী রাশিয়ান স্তম্ভটিকে ঘিরে ফেলে এবং এটি ধ্বংস করে ।[২৬] ফলে ভোরন্তসভের চেচনিয়াকে ইমামতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

কাউন্ট মিখাইল সেমিওনোভিচ ভোরন্তসভ চেচনিয়াকে ইমামতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন:[২৭]

শামিল এই বছর দুর্দান্ত কার্যকলাপ দেখাচ্ছে এবং তাকে এটি করতে বাধ্য করা হয়েছে। আমরা এমন ব্যবস্থা নিচ্ছি যা শীঘ্রই বা পরে অবশ্যই ... তার প্রভাবকে ধ্বংস করে তার কাছ থেকে চেচেনদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে।

কাউন্ট মিখাইল ভোরন্টসভ

একজন সামরিক নেতা হিসাবে তার ভাগ্য বৃদ্ধি পায় যখন তিনি হাদজি মুরাদের সাথে যোগদান করেন। মুরাদ ১৮৪১ সালে রাশিয়ানদের কাছ থেকে সরে এসেছিলেন। তার সঙ্গে যোগদানের পর শামিলের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলের দৈর্ঘ্য তিনগুণ বেড়ে যায়। তবে হাদজি মুরাদ এক দশক পরে শামিলের বিরুদ্ধে চলে যান। কারণ তিনি শামিলের উত্তরসূরিকে ইমাম হিসাবে অভিষিক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে হতাশ হয়েছিলেন। শামিলের বড় ছেলেকে সেই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল, এবং একটি গোপন কাউন্সিলে, শামিল তার লেফটেন্যান্টকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল। হাদজি মুরাদ রায় জানতে পেরে, রুশদের কাছে ফিরে যান।[২৩][২৪] যদিও শামিল আশা করেছিল যে ব্রিটেন, ফ্রান্স বা অটোমান সাম্রাজ্য ককেশাস থেকে রাশিয়াকে তাড়ানোর জন্য তাকে সাহায্য করবে। কিন্তু তার এ আশা সঠিক হয় নি। ক্রিমিয়ান যুদ্ধের পর, রাশিয়া ইমামতের বিরুদ্ধে তার প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করে। এরপর রাশিয়ান বাহিনী ইমামতের অঞ্চলকে মারাত্মকভাবে হ্রাস করে এবং ১৮৫৯ সালের সেপ্টেম্বরে শামিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। তবে পূর্ব ককেশাসে সংঘাত আরও কয়েক বছর অব্যাহত থাকে।[২৮]

তথ্যসূত্র

Loading related searches...

Wikiwand - on

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.