মৈতৈ ভাষা
ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্য মণিপুরের প্রধান ভাষা, ভারতের একটি সরকারি ভাষা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
মৈতৈ/ˈməɪtəɪ/[৪] (মৈতৈ ভাষায়: মেইতেই লোন্, মণিপুরী ভাষা নামেও পরিচিত[৫][৬]) উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্যের প্রধান ভাষা। সরকারি দপ্তরে এই ভাষা ব্যবহার করা হয়। মণিপুর ছাড়াও আসাম, ত্রিপুরা, বাংলাদেশ ও মায়ানমারে ভাষাটি প্রচলিত।[৭]
মৈতৈ | |
---|---|
মণিপুরী, মেইতেই লোন্ | |
ꯃꯤꯇꯩꯂꯣꯟ | |
![]() | |
অঞ্চল | উত্তর-পূর্ব ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার |
জাতি | মৈতৈ |
মাতৃভাষী | ১২ লক্ষ ৫০ হাজার (২০১০)[১] থেকে ১৪ লক্ষ ৮৫ হাজার (২০০১ জনগণনা)[২]
|
চীনা-তিব্বতি
| |
মৈতৈ লিপি, পূর্ব নাগরী লিপি লাতিন বর্ণমালা | |
সরকারি অবস্থা | |
সরকারি ভাষা | (মণিপুর) |
ভাষা কোডসমূহ | |
আইএসও ৬৩৯-২ | mni |
আইএসও ৬৩৯-৩ | দুইয়ের মধ্যে এক:mni – Meiteiomp – Old Manipuri |
ভাষাবিদ তালিকা | omp Old Manipuri |
গ্লোটোলগ | mani1292 [৩] |
মৈতৈ একটি চীনা-তিব্বতি ভাষা যার সঠিক শ্রেণিবিভাগটি এখনও স্পষ্ট নয়। এই ভাষার সঙ্গে কুকি ভাষা এবং তাংখুল ভাষার অভিধানিক মিল আছে।[৮]
মৈতৈ ভাষা মণিপুরের সমস্ত জাতিগুলো নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য এটি ব্যবহার করে, এবং এই ভাষাটি এই জাতিগুলোকে সমন্বিত উপাদান হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এটি ভারতীয় সরকার কর্তৃক স্বীকৃত এবং ১৯৯২ সালের সংবিধানের ৭১তম সংশোধনী দ্বারা ৮ম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতোকত্তর (পিএইচডি) স্তর অবধি মৈতৈ ভাষা একটি বিষয় হিসাবে পড়ানো হয়, এবং স্নাতক স্তর অবধি মৈতৈ মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হয়। সরকারী বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণী অবধি মৈতৈ ভাষায় শিক্ষাদান করা হয়।[৯]
ব্যুৎপত্তি
মৈতৈয়ের অনেক স্থানীয় ভাষাভাষীরা "মণিপুরী" নামটি থেকে "মৈতৈ" (বা "মৈতৈলোন্") নামটি বেশি পছন্দ করেন। "মৈতৈলোন" শব্দটি মৈতৈ জাতির নাম এবং মৈতৈ শব্দ "লোন্" ভাষা থেকে এসেছে। মৈতৈ শব্দটি হয়ত "মি" মানুষ + "থৈ" আলাদা; স্বতন্ত্র শব্দ দুটি থেকে এসেছে। পশ্চিমি ভাষাবিদরাও "মৈতৈ" নামটি ব্যবহার করেন।[১০]
আবার রাজ্যের নাম "মণিপুর" থেকেও এর নাম "মণিপুরী" বলা হয়।[১০] "মণিপুর" শব্দটির একটি পৌরাণিক লোক-ব্যুৎপত্তি আছে, যেখানে বলা হয় নাগদেবতা বাসুকির মাথা থেকে একটি উজ্জ্বল হীরক "মণি" নিক্ষিপ্ত করা হয় এবং যার ফলে সারা পৃথিবীতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে দেয়।[১০] ভারতের সরকারী ক্ষেত্রে এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানে ভাষার নামটি "মণিপুরী" হিসাবে ব্যবহার করা হয়। কখনও "মণিপুরী" শব্দটি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা এবং বিষ্ণুপ্রিয়া জাতির ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়।এছাড়াও "মণিপুরী" শব্দটি মণিপুর রাজ্য সম্বন্ধীয় যে কোন বিষয় ব্যবহার করা হয়।
উপভাষা
মৈতৈ ভাষার বহু উপভাষা আছে, কিন্তু ইদানিংকালে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং অসবর্ণ বিবাহের ফলে উপভাষাগুলোর মধ্যে যে পার্থক্য আছে তা প্রায় নগণ্য হয়ে গেছে। এর ব্যতিক্রম হচ্ছে ত্রিপুরা, বাংলাদেশ ও মায়ানমারে পাওয়া উপভাষার বাক্-পার্থক্য।[১১] মৈতৈয়ের উপভাষার সঠিক সংখ্যা অজানা।[১২]
এই ভাষার প্রধান উপভাষাগুলো হল প্রমিত মৈতৈ, লোই এবং পাঙ্গাল। মৈতৈয়ের উপভাষাগুলোর মূল পার্থক্যগুলো হল নতুন ধ্বনির বিস্তার এবং সুরাঘাতীয় অপসরণ। প্রমিত মৈতৈকে অন্য দুটি উপভাষার চেয়ে বেশি পরিবর্তনশীল বলে মনে করা হয়। উপভাষাগুলোর সামান্য পার্থক্যগুলো নিম্নলিখিত সারণিতে দেওয়া হল:[১৩]
প্রমিত মৈতৈ[১৪] !! লোই !! পাঙ্গাল !! বাংলা | |||
---|---|---|---|
চাঃবা | চাঃপা | চাঃবা | খাওয়া |
কপ্পা | কপ্মা | কব্বা | কাঁদা |
সাঃবিবা | সাঃপিপা | সাঃবিবা | বানানো |
থাম্বা | থাম্পা | থাম্বা | রাখা |
চুপ্পিবা | চুপ্পিপা | চুবিবা | চুম্বন দেওয়া |
দেবী (২০০২) মৈতৈয়ের ইম্ফল, আন্দ্রো, কৌত্রুক এবং কাকচিং উপভাষাগুলোর তুলনা করেছেন।
ধ্বনিতত্ত্ব
সারাংশ
প্রসঙ্গ
মৈতৈ নিম্নলিখিত ধ্বনিগুলো ব্যবহার করে:[১৫]
স্বরধ্বনি
টিকা: মৈতৈ সংক্রান্ত সাম্প্রতিক লেখায় মধ্য স্বরধ্বনি /ɐ/-কে <ə> হিসাবে লেখা হচ্ছে। কিন্তু ধ্বনিগতভাবে এটা কখনই [ə] নয়, [ɐ]। এটি সমীভবন হয়ে নৈকট্যধ্বনি হয়ে যায়: /ɐw/ = /ow/, /ɐj/ = [ej]।
ব্যঞ্জনধ্বনি
শব্দ-সুরাঘাত
মৈতৈ ভাষা একটি সুরাঘাতীয় ভাষা। তবে এই ভাষাতে দুটি না তিনটি সুর আছে তা নিয়ে বিতর্ক আছে।[১৬]
ধ্বনিতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া
পশ্চাত্তালব্য ধ্বনির লোপ
-lək প্রত্যয় যখন/k/-অন্ত শব্দাক্ষরের পরে বসে তখন তার পশ্চাত্তালব্য ধ্বনিটি লোপ পায়।[১৬]
গ্রাসমানের সূত্র
সংস্কৃত এবং প্রাচীন গ্রীক ভাষায় পাওয়া গ্রাসমানের সূত্রে ব্যক্ত বিষমীভবনের মত একটি প্রক্রিয়া মৈতৈ ভাষায়।[১৭] এই ক্ষেত্রে একটি মহাপ্রাণিত ব্যঞ্জনধ্বনি যদি এমন কোন শব্দাক্ষরের পরে বসে যার শেষ ব্যঞ্জনধ্বনিটি মহাপ্রাণ (যেমন /h/, /s/) তবে প্রথমোক্ত ব্যঞ্জনধ্বনিটি মহাপ্রাণহীন হয়ে যায়। এই মহাপ্রাণহীন ধ্বনিটিই রণনশীল ধ্বনির মধ্যবর্তি অবস্থায় ঘোষ ধ্বনি হয়ে যায়।
- /tʰin-/ ('ভেদ করা') + /-khət/ ('ঊর্ধ্বাভিমুখী') → /tʰinɡət/ ('উপরের দিকে ভেদ করা')
- /səŋ/ ('গরু') + /kʰom/ ('বাঁট') → /səŋɡom/ ('দুধ')
- /hi-/ ('ছাঁটা') + /-tʰok/ ('বহির্মুখী') → /hidok/ ('বাইরের দিকে ছাঁটাই করা')
লিখন পদ্ধতি
সারাংশ
প্রসঙ্গ
মৈতৈ লিপি
১৮শ শতক অবধি মৈতৈয়ে লেখার জন্য নিজস্ব লিপি ব্যবহার করা হত, কিন্তু এর প্রথম ব্যবহার সম্বন্ধে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। মনিপুর রাজ মেইদিঙ্গু পামহেইবা, মণিপুরে হিন্দুধর্মের প্রবর্তন করেছিলেন, মৈতৈ লিপির ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেন এবং বাংলা লিপি গ্রহণ করেন। বর্তমানে বিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়গুলোতে বংলা লিপির পরিবর্তে ক্রমশ মৈতৈ লিপির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মৈতৈয়ের নিজস্ব লিপি সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে।
১৮শ শতাব্দীর শুরুতে মণিপুরের হিন্দু ধর্মে রূপান্তরিত রাজা পামহেইবা, বাঙালি হিন্দু ধর্মপ্রচারক শান্তিদাশ গোঁসাইয়ের প্ররোচনায় অনেক মৈতৈ নথি নষ্ট করে ফেলেন।
১৭০৯ সাল এবং ২০শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় অবধি মৈতৈ ভাষা লেখার জন্য বাংলা লিপি ব্যবহার করা হত। ১৯৪০ এবং ১৯৫০-এর দশকে মৈতৈ পন্ডিতরা প্রাচীন মৈতৈ (মণিপুরি) বর্ণমালাকে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রচার শুরু করেন।
১৯৭৬ সালে একটি লেখক সম্মেলনে, সব পণ্ডিতরা অবশেষে বর্ণমালার একটি নতুন সংস্করণ তৈরিতে সম্মত হন। এই বর্ণমালায় বেশকিছু অতিরিক্ত বর্ণ ছিল যেগুলোর দ্বারা প্রাচীন মৈতৈয়ে অনুপস্থিত কিন্তু আধুনিক মৈতৈয়ে উপস্থিত ধ্বনিগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। বর্তমান মৈতৈ বর্ণমালা প্রাচীন মৈতৈ লিপির পুনর্গঠিত রূপ। ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকে মণিপুরের বিদ্যালয়গুলোতে মৈতৈ বর্ণমালা শেখানো হয়ে আসছে।
মৈতৈ বর্ণমালা বাংলা বর্ণমালার মতই একটি আবুগিদা যেটিতে ব্যঞ্জনবর্ণগুলোতে একটি অন্তর্নিহিত স্বরধ্বনি আছে, মৈতৈয়ের ক্ষেত্রে যা হল/ə/(বাংলা "অ"-এর সমতুল্য ধ্বনি)। প্রত্যেকটি বর্ণ কে মানব দেহের কোন একটি অঙ্গের উপর রাখা হয়।
মণিপুরের মারিঙ নাগা জাতি এবং লিম্বু জাতির কিছু নথি আছে যা মৈতৈ লিপিতে লেখা হয়েছিল।
লাতিন বর্ণমালা
মৈতৈ লিপি ছাড়াও এখন মৈতৈ ভাষা লেখার জন্য লাতিন বর্ণমালা ব্যবহার হয়ে থাকে, বিশেষ করে ইন্টারনেটে। এছাড়াও শিক্ষা ক্ষেত্রেও বিভিন্ন গ্রন্থ লাতিন বর্ণমালায় মুদ্রিত হয়। যদিও এই বর্ণমালাতে সুরাঘাতগুলো চিহ্নিত করা হয় না, তবুও এই দ্ব্যর্থহীনভাবে মৈতৈ ভাষার ধ্বনিগুলোকে চিহ্নিত করা যায়। কেবল /ə/এবং/a/ধ্বনি দুটিই a দিয়ে লেখা হয়ে থাকে। আবার দ্ব্যর্থতা নিরসণের জন্য কখনও/ə/-কে aa দিয়েও চিহ্নিত করা হয়।
আধ্বব | লাতিন বর্ণমালা |
---|---|
/m/ | m |
/n/ | n |
/ŋ/ | ng |
/b/ | b |
/d/ | d |
/dʒ/ | j |
/ɡ/ | g |
/bʱ/ | bh |
/dʱ/ | dh |
/dʒʱ/ | jh |
/ɡʱ/ | gh |
/p/ | p |
/t/ | t |
/tʃ/ | ch |
/k/ | k |
/ʔ/ | ’ |
/pʰ/ | ph (কদাচিৎ f) |
/tʰ/ | th |
/kʰ/ | kh |
/s/ | s বা sh |
/h/ | h |
/ɾ/ | r |
/l/ | l |
/w/ | w |
/j/ | y |
/ɐ/ | a |
/ɐj/ | ei |
/ɐw/ | ou |
/a/ | a বা aa |
/aj/ | ai |
/aw/ | ao |
/e/ | e |
/i/ | i (কদাচিৎ ee) |
/o/ | o |
/oj/ | oi |
/u/ | u (কদাচিৎ oo) |
/uj/ | ui |
ব্যাকরণ
সারাংশ
প্রসঙ্গ
বচন
বহুবচনের ক্ষেত্রে বিশেষ্য এবং সর্বনামের শেষে -খোই (পুরুষবাচক সর্বনাম এবং মনুষ্য নামবিশেষ্য) অথবা -সিং (বাকি ক্ষেত্রে) যোগ করা হয়। বাংলার মতই মৈতৈ ভাষায় বচন ক্রিয়ার উপর কোন প্রভাব ফেলে না। নিচে উদাহরণ দেওয়া হল:[১৮]
বিশেষ্য (মৈতৈ) | বিশেষ্য (বাংলা) | উদাহরণ (মৈতৈ) | উদাহরণ (বাংলা) |
---|---|---|---|
আংআং | বাচ্চা | আংআং কপ্পি | বাচ্চা কাঁদে। |
আংআংসিং | বাচ্চারা | আংআংসিং কপ্পি | বাচ্চারা কাঁদে। |
বিশেষণকে স্পষ্টরূপে চিহ্নিত করার জন্য প্রত্যয়ের পরিবর্তে পৃথক শব্দ ব্যবহার করা হয়।[১৮]
বিশেষণ (মৈতৈ) | বিশেষণ (বাংলা) | উদাহরণ (মৈতৈ) | উদাহরণ (বাংলা) |
---|---|---|---|
অমা | এক | মি অমা লাক্ই | একটি লোক আসে। |
খর | কিছু | মি খর লাক্ই | কিছু লোক আসে। |
ময়াম | অনেক, বহু | মি ময়াম লাক্ই | বহু লোক আসে। |
যৌগিক ক্রিয়া
ধাতুর সঙ্গে ভাবপ্রকারকে পরপ্রত্যয় হিসাবে যোগ হয়ে যৌগিক ক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এই পরপ্রত্যয়ের সংখ্যা বেশি হলেও নিচে দেওয়া দুটিই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়:[১৯]
পরপ্রত্যয় | বাংলা |
---|---|
-থোক- | বার করা/বেরানো |
-নিঙ- | চাওয়া/ইচ্ছা করা/আশা করা |
সার্বিকভাবে যৌগিক ক্রিয়ার রূপটি হল [ধাতু] + [প্রত্যয়] + [ভাবপ্রকার]:[১৯]
ভাষা | ধাতু | প্রত্যয় | ভাবপ্রকার | যৌগিক রূপ |
---|---|---|---|---|
মৈতৈ | তুম- | -থোক- | -লে | তুমথোকলে |
বাংলা | ঘুম | বার করা/বেরানো | পুরাঘটিত ভাব | ঘুমাতে শুরু করেছিল |
মৈতৈ | তুম- | -নিঙ- | -লে | তুমনিঙলে |
বাংলা | ঘুম | চাওয়া | পুরাঘটিত ভাব | ঘুম পেয়েছিল |
..
মনিপুরী সাহিত্য
আরও দেখুন
- ভারতের ভাষা
- ভারতে মাতৃভাষী বক্তার সংখ্যা অনুসারে ভাষাসমূহের তালিকা
- মণিপুরি কবিদের তালিকা
- মৈতৈ ভাষার জন্য সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার বিজয়ীদের তালিকা
- মৈতৈ মণিপুরী ভাষাভাষী অনুয়ায়ী ভারতের রাজ্যসমূহ
তথ্যসূত্র
গ্রন্থপঞ্জি
বহিঃসংযোগ
Wikiwand - on
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.