এর্নেস্তো চে গেভারা (স্পেনীয়: tʃe geˈβaɾa চে গেবারা) (১৪ জুন,[1] ১৯২৮ – ৯ অক্টোবর, ১৯৬৭) ছিলেন একজন আর্জেন্টিনীয় মার্কসবাদী, বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তার প্রকৃত নাম ছিল এর্নেস্তো গেভারা দে লা সের্না (স্পেনীয়: Ernesto Guevara de la Serna)। তবে তিনি সারা বিশ্ব লা চে বা কেবলমাত্র চে নামেই পরিচিত। মৃত্যুর পর তার শৈল্পিক মুখচিত্রটি একটি সর্বজনীন প্রতিসাংস্কৃতিক প্রতীক এবং এক জনপ্রিয় সংস্কৃতির বিশ্বপ্রতীকে পরিণত হয়।[4]

দ্রুত তথ্য চে গেভারা, জন্ম ...
চে গেভারা
Thumb
"গেরিইয়েরো এরোইকো"
চে গেভারা লা কব্রে মেমোরিয়াল সার্ভিসে। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী আলবের্তো কোর্দার তোলা ছবি ৫ মার্চ, ১৯৬০
জন্ম
এর্নেস্তো গেভারা

(১৯২৮-০৬-১৪)১৪ জুন ১৯২৮[1]
মৃত্যুঅক্টোবর ৯, ১৯৬৭(1967-10-09) (বয়স ৩৯)
মৃত্যুর কারণসারসংক্ষেপ মৃত্যুদন্ড
সমাধিচে গেভারা স্মৃতিসৌধ
সান্তা ক্লারা, কিউবা
পেশাচিকিৎসক, লেখক, গেরিলা, সরকারি অফিসিয়াল
প্রতিষ্ঠানছাব্বিশে জুলাই আন্দোলন, ইউনাইটেড পার্টি অফ দ্য কিউবান সোশ্যালিস্ট রেভোলিউশন[2] ন্যাশানাল লিবারেশন আর্মি (বলিভিয়া)
দাম্পত্য সঙ্গীহিলডা গাডি (১৯৫৫-১৯৫৯)
আলেইডা মার্চ (১৯৫৯-১৯৬৭, তার মৃত্যু পর্যন্ত)
সন্তানইলদা (১৯৫৬-১৯৯৫), আলেইদা (জন্ম ১৯৬০), কামিলো (জন্ম ১৯৬২), সেলিয়া (জন্ম ১৯৬৩), এর্নেস্তো (জন্ম ১৯৬৫)
পিতা-মাতাএর্নেস্তো গেভারা লিঞ্চ[3]
সেলিয়া ডে লা সার্না[3]
স্বাক্ষর
Thumb
বন্ধ

তরুণ বয়সে ডাক্তারি ছাত্র হিসেবে চে সমগ্র লাতিন আমেরিকা ভ্রমণ করেছিলেন। এই সময় এই সব অঞ্চলের সর্বব্যাপী দারিদ্র্য তার মনে গভীর রেখাপাত করে।[5] এই ভ্রমণকালে তার অর্জিত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে এই অঞ্চলে বদ্ধমূল অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বাভাবিক কারণ হল একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদসাম্রাজ্যবাদ; এবং এর একমাত্র সমাধান হল বিশ্ব বিপ্লব[6] এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে চে রাষ্ট্রপতি জাকোবো আরবেনজ গুজমানের নেতৃত্বাধীন গুয়াতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালে সিআইএ-এর ষড়যন্ত্রে গুজমানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে চে-র বৈপ্লবিক আদর্শ চেতনা বদ্ধমূল হয়। পরবর্তীকালে মেক্সিকো সিটিতে বসবাসের সময় তার সঙ্গে রাউলফিদেল কাস্ত্রোর আলাপ হয়। চে তাদের ছাব্বিশে জুলাই আন্দোলনে যোগ দেন। মার্কিন-মদতপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলগেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাত করার জন্য গ্রানমায় চড়ে সমুদ্রপথে কিউবায় প্রবেশ করেন।[7] অনতিবিলম্বেই চে বিপ্লবী সংঘের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড পদে তার পদোন্নতি হয় এবং বাতিস্তা সরকারকে উত্খাত করার লক্ষ্যে দুই বছর ধরে চলা গেরিলা সংগ্রামের সাফল্যের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।[8]

কিউবার বিপ্লবের পর চে নতুন সরকারে একাধিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বিপ্লবী আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্তদের আপিল পুনর্বিবেচনা ও তোপচিদল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড প্রদান,[9] শিল্পোদ্যোগ মন্ত্রী হিসেবে খামার সংস্কার আইন প্রবর্তন, কিউবার জাতীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর ইনস্ট্রাকশনাল ডিরেক্টরের ভূমিকা পালন, এবং কিউবান সমাজতন্ত্রের প্রচারে বিশ্বপর্যটন। এই পদাধিকারের কল্যাণে তিনি মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদানের সুযোগ পান; ফলত এই বাহিনী পিগস উপসাগর আক্রমণ করে তা পুনর্দখলে সক্ষম হয়।[10] কিউবায় সোভিয়েত পরমাণু ব্যালিস্টিক মিসাইল আনার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।[11] চে ছিলেন এক বিশিষ্ট লেখক ও ডায়েরি-লেখক। গেরিলা যুদ্ধের উপর তিনি একটি প্রভাবশালী ম্যানুয়েল রচনা করেন। তরুণ বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকায় মোটরসাইকেলে ভ্রমণের স্মৃতিকথাটিও তার অত্যন্ত জনপ্রিয় রচনা। বৃহত্তর বিপ্লবে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৬৫ সালে কিউবা ত্যাগ করেন। প্রথমে কঙ্গো-কিনসহাসায় তার বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর তিনি বলিভিয়ায় বিপ্লবে অংশ নেন। এখানেই সিআইএ-মদতপুষ্ট বলিভীয় সেনাদের হাতে বন্দী ও নিহত হন চে।[12]

চে গেভারা একাধারে ইতিহাসের এক নন্দিত ও নিন্দিত চরিত্র। বিভিন্ন জীবনী, স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ, তথ্যচিত্র, গান ও চলচ্চিত্রে তার চরিত্রের নানা দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। টাইম পত্রিকার বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির তালিকায় তার নাম প্রকাশিত হয়।[13] আবার গেরিইয়েরো এরোইকো নামে আলবের্তো কোর্দার তোলা চে-র বিখ্যাত আলোকচিত্রটিকে "বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ আলোকচিত্র" হিসেবে ঘোষিত।[14]

জীবনের শুরু

Thumb
সালে কিশোর বয়সে গেভারা (বামে) তার পরিবারের সাথে। বাম থেকে ডানে: মা, বোন, রবার্তো, হুয়ান মার্টিন, বাবা এবং মারিয়া।

১৯২৮ সালের ১৪জুন এর্নেস্তো গেভারা রোসারিও, আর্জেন্টিনায় জন্ম গ্রহণ করেন। পরিবারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বয়োজ্যেষ্ঠ। ছোটবেলা থেকেই তার চরিত্রে অস্থির চপলতা দেখে তার বাবা বুঝতে পেরেছিলেন যে আইরিশ বিদ্রোহের রক্ত তার এই ছেলের ধমনীতে বহমান। খুব শৈশব থেকেই সমাজের বঞ্চিত, অসহায়, দরিদ্রদের প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ তার ভেতর তৈরি হতে থাকে। একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে খুব অল্প বয়সেই তিনি রাজনীতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান লাভ করেন। তার বাবা ছিলেন স্পেনের গৃহযুদ্ধে প্রজাতন্ত্রবাদীদের একজন গোড়া সমর্থক, সেই সংঘর্ষের সৈনিকদের তিনি প্রায়ই বাড়িতে থাকতে দিতেন।

হাপানিতে সারা জীবন ভোগা সত্ত্বেও তিনি দারুন মল্যবিদ ছিলেন। তার খেলধুলার পছন্দ তালিকায় ছিল সাঁতার, ফুটবল,গলফ, শুটিং। চে গেভারা সাইক্লিংয়ের একজন অক্লান্ত খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি রাগবি ইউনিয়নের একজন অতি আগ্রহী সদস্য ছিলেন এবং বুয়েনস এয়ারস বিশ্ববিদ্যালয় রাগবি দলের হয়ে খেলেছেনও। রাগবি খেলার ক্ষিপ্রতার জন্য তাকে "ফিউজার" ("fuser") নামে ডাকা হত। তার বিদ্যালয়ের সহপাঠীরা তাকে ডাকত চানচো (pig) বলে, কারণ তিনি অনিয়মিত স্নান করতেন এবং সপ্তাহে একবার মাত্র পোশাক পাল্টাতেন।

১২ বছর বয়সে দাবা খেলা শেখেন তার বাবার কাছে এবং স্থানীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করেন। বয়সন্ধি থেকে শুরু করে সারাটা জীবন তিনি কবিতার প্রতি আসক্ত ছিলেন বিশেষ করে পাবলো নেরুদা, জন কিটস, এন্টনিও মারকাদো, ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা, গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল এবং ওয়াল্ট হুইটম্যান, তিনি ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন। তিনি স্মৃতি থেকে আবৃতি করতে পারতেন রুডিয়ার্ড কিপলিং-এর "if-" কবিতা এবং জোসে হার্নান্দেজ-এর "Martin Fierro" কবিতা। গুয়েভারা পরিবারে ছিল ৩০০০০এরও বেশি বই যা গুয়েভারাকে করে তোলে একজন জ্ঞানপিপাসু ও অক্লান্ত পাঠক। যার মধ্যে কার্ল মার্ক্স, উইলিয়াম ফক্‌নার, এমিলিও সলগারির বই। পাশাপাশি জওহরলাল নেহেরু, আলবেয়ার কামু, লেনিন, রবার্ট ফ্রস্ট-এর বইও তিনি পড়তেন।

মোটর সাইকেল অভিযান

চে গেভারা ১৯৪৮ সালে বুয়েনোস আইরেস বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা বিষয়ে লেখাপড়ার জন্য ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে লেখাপড়ায় এক বছর বিরতি দিয়ে আলবের্তো গ্রানাদো নমক এক বন্ধুকে সাথে করে মোটর সাইকেলে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পেরুর সান পুয়েবলোর কুষ্ঠ রোগীদের জন্য বিশেষ বসতিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কয়েক সপ্তাহ কাজ করা। মাচু পিকচুতে যাওয়ার পথে তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র কৃষকদের চরম দারিদ্র্য দেখে মর্মাহত হন| এ কৃষকরা ধনি মহাজনদের অধীনে থেকে ছোট ছোট জমিতে কাজ করত| তার ভ্রমণের পরবর্তী সময়ে তিনি কুষ্ঠরোগীদের বসতিতে বসবাসকারী মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ব ও সহচার্য দেখে অভিভূত হন| এই অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর দিনলিপি (The Motorcycle Diaries) তিনি লিখেছেন, ‘মানব সত্তার ঐক্য ও সংহতির সর্বোচ্চ রূপটি এ সকল একাকী ও বেপরোয়া মানুষদের মাঝে জেগে উঠেছে’। তার এই দিনলিপি নিউয়র্ক টাইমস-এর "বেস্ট সেলার" (সর্বাধিক বিক্রীত) তালিকায় স্থান পায় এবং পরে একই নামে (The Motorcycle Diaries) চলচ্চিত্র বের হয়, যা পুরস্কৃত হয়েছিল।

এই ভ্রমণ তাকে নিয়ে যায় আর্জেন্টিনা, চিলি, পেরু, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, পানামা ও মিয়ামির মধ্য দিয়ে বুয়েনোস আইরেসের দিকে| ভ্রমণের শেষ দিকে তিনি এই মত পোষণ করেন যে দক্ষিণ আমেরিকা আলাদা আলাদা দেশের সমষ্টি নয় বরং এক অভিন্ন অস্তিত্ব যার প্রয়োজন মহাদেশব্যাপী স্বাধীনতার জাগরণ ও স্বাধীনতার পরিকল্পনা। পরবর্তীতে তার নানা বিপ্লবী কর্মকান্ডে এই একক, সীমানাবিহীন আমেরিকার চেতনা ফিরে আসে বার বার।

গুয়াতেমালা, আরবানিজ এবং ইউনাইটেড ফ্রুট

Thumb
১৯৫৩ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে চে গেভারা আন্দোলন, যার মধ্যে ছিল গুয়াতেমালার উত্তরে ভ্রমণ।

১৯৫৩ সালের ৭ই জুলাই, চে আবারও বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস এবং সালভাডরের উদ্দেশ্যে বের হন। গুয়েতেমালা ছাড়ার আগে ১৯৫৩ সালের ১০ ডিসেম্বর কোস্তা রিকা থেকে তার খালাকে সব কিছুর বৃত্তান্ত দিয়েছিলেন। চিঠিতে তিনি ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির বিভিন্ন প্রদেশে ভ্রমণের কথা লিখেছিলেন। তিনি এভাবে তার সংরক্ষণশীল আত্মীয়দের আতঙ্কিত করতে চেয়েছিলেন।

মেক্সিকো শহর ও প্রস্তুতি

Thumb
চিচেন ইতজাতে হিল্ডা গাদেয়ার সাথে গেভারা,তাদের মধুচন্দ্রিমার পথে।

১৯৫৪ সালের শুরুর দিকে গেভারা মেক্সিকো নগরীতে পৌছান এবং সদর হাসপাতালে অতিপ্রতিক্রিয়া (অ্যালার্জি) বিভাগে চাকুরি করেন। পাশাপাশি ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভির্সিটি অব মেক্সিকোতে চিকিৎসা বিষয়ে প্রভাষক এবং লাতিনা সংবাদ সংস্থার চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালের জুন মাসে তার বন্ধু নিকো লোপেস রাউল কাস্ত্রোর সাথে তার পরিচয় করান এবং পরে তার বড় ভাই ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে পরিচিত হন। কাস্ত্রোর সাথে তার প্রথম সাক্ষাতে দীর্ঘ আলাপচারিতা হয় এবং চে বলেন যে কিউবার সমস্যা নিয়ে তিনি চিন্তিত। তারপর তিনি ছাব্বিশে জুলাই আন্দোলন দলের সদস্য হন। সেই সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন এই আগ্রাসি তৎপরতার আশু সমাপ্তি প্রয়োজন।

কিউবা বিপ্লব

Thumb
গেভারা, কিউবা, নভেম্বর ১৯৫৮

বিপ্লবের পরিকল্পনায় কাস্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ ছিল মেক্সিকো হতে কিউবায় আক্রমণ চালান। ১৯৫৬ সালের ২৫শে নভেম্বর তারা কিউবার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পৌছানোর সাথে সাথেই বাতিস্তার সেনাবাহীনী কর্তৃক আক্রান্ত হন। তার ৮২ জন সহচরী মারা যান অথবা কারাবন্দী হয়, মাত্র ২২জন এ যাত্রায় বেঁচে যায়। গেভারা লিখেছিলেন সেটা ছিল সেই রক্তক্ষয়ী মুখামুখি সংঘর্ষের সময় যখন তিনি তার চিকিৎসা সামগ্রীর সাথে একজন কমরেডের ফেলে যাওয়া এক বাক্স গোলাবারুদ নিয়েছিলেন, যা তাকে পরিশেষে চিকিৎসক থেকে বিপ্লবীতে পরিনত করে।

সিয়েররা মস্ত্রা পর্বতমালায় বিদ্রোহীদের ছোট্ট একটা অংশ পুনরায় সংঘবদ্ধ হতে পেরেছিল। সেখানে তারা ২৬শে জুলাই আন্দোলনের গেরিলা এবং স্থানীয় লোকজনদের সহযোগিতা লাভ করেছিলেন। সিয়েরা থেকে দল উঠেয়ে দেবার সময় কাস্ত্রোর একটি সাক্ষাতকার নিউয়র্ক টাইমসে প্রকাশ করা হয়। যার আগে ১৯৫৭ পর্যন্ত সারা পৃথিবীর মানুষ জানত না তিনি বেঁচে আছেন কি না! সেই নিবন্ধে কাস্ত্রো ও বিপ্লবীদের কাল্পনিক ছবি ছিল। গেভারা সেই সাক্ষাতকারে উপস্থিত ছিলেন না কিন্তু কিছু দিন পর তিনি তাদের এই বিপ্লবে প্রচার মাধ্যমের গুরুত্ব বুঝতে পারেন। আত্মবিশ্বাসের সাথে সাথে রসদ সরবরাহ কমে এসেছিল পাশাপাশি ছিল প্রচণ্ড মশার উত্পাত তাই গেভারা সেই সময়টাকে যুদ্ধের সবচেয়ে ব্যাথার সময় বলে অবহিত করেছিলেন।

যুদ্ধচলাকালীন চে বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর অখণ্ড অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ফিদেল কাস্ত্রোকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, কূটনীতি এবং অধ্যবসায়ের কথা জানিয়ে ছিলেন। গেভারা গ্রেনেড তৈরির কারখানা, রুটি সেঁকানোর জন্য চুল্লি প্রস্তুত এবং নিরক্ষর সঙ্গীদের লেখাপড়ার জন্য পাঠশালা তৈরি করেন। তাছাড়াও তিনি একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, সামরিক প্রশিক্ষনের কর্মশালা আয়োজন এবং তথ্য সরবরাহের জন্য পত্রিকা প্রচার করতেন। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তিন বছর পর তাকে ’’কাস্ত্রোর মস্তিষ্ক’’’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। তার পর তিনি বিদ্রোহী বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে পদোন্নতি পান। গেভারা শৃঙ্খলার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন, কর্তব্যে অবহেলাকারীদের তিনি নির্দ্বিধায় গুলি করতেন। তার এই প্রচন্ড মানসিকতা তাকে তার ইউনিটে সবার চেয়ে ভয়ংকর করে তুলেছিল। তাই গেরিলা অভিযানের সময় গুপ্তঘাতকদের মৃত্যুদন্ড দেবার দায়িত্ব ছিল তার উপর। চে এমন কঠিন প্রশাসক হওয়া সত্ত্বেও সৈন্যদের শিক্ষক হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং কাজের ফাঁকে তাদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থাও করতেন।

কিউবায় মন্ত্রীত্ব

১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত চে কিউবার শিল্প বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। এসময় তিনি কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এসময় কিউবান নোটগুলোতে তার স্বাক্ষরে শুধু "চে" লেখা থাকতো। ১৯৬৫ সালে আলজিয়ার্স সফরকালে সোভিয়েত সরকারকে সাম্রাজ্যবাদের দোসর আখ্যা দেয়ার ফলে দেশে ফেরার সাথে সাথে তার মন্ত্রীত্ব বাতিল হয়। এরপর তিনি বিপ্লবের পথে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান।[15]

Thumb
তার ট্রেডমার্ক জলপাই-সবুজ রঙের সামরিক পোষাকে, ২ জুন ১৯৫৯
Thumb
সান্তা ক্লারার যুদ্ধের পরে, জানুয়ারি ১, ১৯৫৯।
Thumb
(ডান থেকে বামে) বিদ্রোহী নেতা ক্যামিলো সিয়েনফুয়েগোস, কিউবার রাষ্ট্রপতি মানুয়্যেল উরুতিয়া, এবং গেভারা (জানুয়ারি ১৯৫৯)

আন্তর্জাতিক কূটনীতি

১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে গেভারা বিশ্বের বিপ্লবীদের কূটনীতিক হিসেবে পরিচিতি পান। তাই তিনি কিউবার প্রতিনিধি হয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদান করার জন্য নিউ ইয়র্ক শহরে যান। ১১ ডিসেম্বার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ১৯তম অধিবেশনে আবেগ অভিভূত বক্তৃতায় তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জাতিগত বৈষম্যের কঠোরনীতি দমনে জাতিসংঘের দুর্বলতার কথা বলেন।এটাকে বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘের কোন পদক্ষেপ আছে কি না জানতে চেয়ে প্রশ্ন তোলেন। গুয়েভারা তখন নিগ্র জনগণের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কঠোর নিন্দা জ্ঞাপন করেন। ক্রোধান্বিত গুয়েভারা ‘সেকেন্ড ডিক্লেরেশন অব হাভানা’ নামক একটি আবেগপূর্ণ ঘোষণার উল্লেখ করে তার বক্তৃতা শেষ করেন।[16] তিনি বলেন যে তার এই ঘোষণার জন্ম হয়েছে ক্ষুধার্ত জনগণ, ভূমিহীন কৃষক, বঞ্চিত শ্রমিক ও প্রগতিশীল মানুষের দ্বারা। বক্তব্যের শেষ করতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, সারা বিশ্বের শোষিত জনগোষ্ঠীর একমাত্র চিত্কার এখন,

হয় স্বদেশ অথবা মৃত্যু।[16]

কঙ্গো

১৯৬৫ সালে গেভারা আফ্রিকায় যাবার সিদ্ধান্ত নেন এবং কঙ্গোতে চলমান যুদ্ধে তার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান কাজে লাগাবার প্রস্তাব দেন। আলজেরিয়ার রাষ্ট্রপতি আহমেদ বিন বেল্লার মতে, গুয়েভারা আফ্রিকাকে রাজতন্ত্রের দুর্বল ঘাঁটি ভেবেছিলেন। তাই সেখানে বিপ্লবের প্রচুর সম্ভাবনা তিনি দেখেছিলেন। মিশরের রাষ্ট্রপতি জামাল আব্দেল নাসের, ১৯৫৯ সালের সাক্ষাতের পর যার সাথে চে এর ভ্রাতৃত্বপুর্ণ সম্পর্ক ছিল। তিনি কঙ্গো আক্রমণের পরিকল্পনাকে বোকামি হিসেবে দেখেছিলেন। এই সতর্কতা সত্ত্বেও গেভারা মার্কসবাদীদের সহায়তায় আক্রমণ চালিয়ে যাবার জন্য তৈরি হন। ১৯৬৫ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি, তার সেকেন্ড কমান্ড ভিক্টর বার্ক এবং ১২ জন সহচরী নিয়ে কঙ্গোয় পৌছান। তার কিছু দিনের মধ্যে প্রায় ১০০ জন আফ্রো-কিউবান তাদের সাথে যোগ দেন।এখানে তিনি কঙ্গোর গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়া লুমুম্বা ব্যাটেলিয়ন সংগঠনের দায়িত্ব নেন।[15]

বলিভিয়া

গেভারা অবস্থান সম্পর্কে তখন লোকজন জানত না।১৯৬৬ সালের শেষের দিকে অথবা ১৯৬৭ এর শুরুর দিকে জমবিক স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিনিধির সাথে ডার এস্ সালাম নামক স্থানে দেখা হয়। সেখানে গেভারা তাদের বিপ্লবী কর্মকান্ডে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে হাভানায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে পদযাত্রায় এক মন্ত্রী বলেন যে চে লাতিন আমেরিকার কোন জায়গায় বিপ্লব চালিয়ে যাচ্ছেন। তার পর প্রমাণিত হয় যে তিনি বলিভিয়ায় গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। কাস্ত্রোর আদেশে তিনি মন্টেন ড্রাই ফরেষ্ট নামক দুর্গম এলাকায় প্রশিক্ষন চালান যেখানে বলিভিয়ার স্থানীয় সমাজতান্ত্রিকরা তাকে সাহায্য করেছিল।

গ্রেফতার ও মৃত্যুদণ্ড

Thumb
ফরাসি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জঁ-পল সার্ত্র্‌ এবং সিমোন দ্য বোভোয়ার সাথে সাক্ষাত্ করেন মার্চ ১৯৬০ সালে। স্প্যানিশ ছাড়াও, গেভারার ফরাসী ভাষায় প্রফুল্ল ছিল।[17]

বলিভিয়ার সেনাবাহিনীর ভাষ্যমতে তারা গুয়েভারাকে ৭ অক্টোবর গ্রেফতার করে এবং তার মৃত্যু হয় ৯ অক্টোবর ১৯৬৭ সাল বেলা ১.১০ টায়। মৃত্যুর এ সময়কাল এবং ধরন নিয়ে মতভেদ এবং রহস্য এখনো আছে।[18] ধারণা করা হয় ১৯৬৭ সালের এই দিনটিতে লা হিগুয়েরা নামক স্থানে নিরস্ত্র অবস্থায় নয়টি গুলি করে হত্যা করা হয় বন্দী চে গেভারাকে। পরে বলিভিয়ার সেনাবাহিনী ঘোষণা করে যে বন্দী অবস্থায় নয়টি গুলি চালিয়ে সেই আর্জেন্টাইন ‘সন্ত্রাসবাদী’কে মেরে ফেলতে পেরেছে এক মদ্যপ সৈনিক। তবে আরেকটি মতামত হচ্ছে এই দিন যুদ্ধে বন্দী হলেও তাকে এবং তার সহযোদ্ধাদের হত্যা করা হয় কিছুদিন পর। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন প্রতিবেদনে পরবর্তীতে এইসব দাবির সপক্ষে কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়।[18]

এ সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা সে সময় লিখেছিল,

‘একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি রূপকথাও চিরতরে বিশ্রামে চলে গেল।’[19]

পরে ১৯৯৭ সালে ভ্যালেগ্রান্দের একটি গণ-কবরে চে ও তার সহযোদ্ধাদের দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়।[20]

চে গেভারা লেখনী

চে গেভারা কিউবান ভাষায় লিখেছেন প্রায় ৭০টি নিবন্ধ, ধারণা করা হয় ছদ্মনামে কিংবা নামহীন অবস্থায় লিখেছেন ২৫টি। এছাড়া তিনি লিখে দিয়েছেন পাঁচটি বইয়ের ভূমিকা। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত ভাষণ আর সাক্ষাৎকার দিয়েছেন প্রায় ২৫০-এর কাছাকাছি। বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে লেখা তার অসংখ্য চিঠির মধ্যে সংগৃহিত আছে ৭০টির মতো। তার লেখালেখি নিয়ে এখন পর্যন্ত বের হয়েছে নয় খণ্ড রচনাবলি।

নির্মিত চলচ্চিত্র

২০০৮ সালের ৪ ডিসেম্বরে মায়ামি বিচে আর্ট ব্যাসল চলচ্চিত্র উত্সবে চে পার্ট ওয়ান চলচ্চিত্রের প্রথম প্রদর্শনী হয়। একই সঙ্গে জীবনী,নাটক, ইতিহাস এবং যুদ্ধনির্ভর এ চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ২৪ জানুয়ারি ২০০৯-এ আমেরিকাতে। স্টিভেন সোডারবার্গ পরিচালিত এ মুভিটিতে অভিনয় করেন চে এর ভূমিকায় ছিলেন বেনেসিও ডেল টরো। এ পর্যন্ত ছবিটি বিভিন্ন চলচ্চিত্র উত্সবে তিনটি পুরস্কার ও আটটি মনোনয়ন পেয়েছে। ২০০৯ এর ফেব্রুয়ারি তে চে চলচ্চিত্রের সিকুয়েল চে পার্ট টু মুক্তি পায়।[21]

ঘটনাপঞ্জি

পাদটীকা

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Wikiwand in your browser!

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.

Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.