সিলেটের মরমী সঙ্গীত
সঙ্গীত ধারা / From Wikipedia, the free encyclopedia
সিলেটের মরমী সঙ্গীত বা মরমীবাদী গান শাহ জালাল এবং শ্রীচৈতন্যের প্রভাবের ফসল যা স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে মিশে তৈরি হয়েছিল।[1] এটি বাংলা সাহিত্যেরও প্রাচীন লোক ঐতিহ্যের অনবদ্য ফসল হিসেবে পরিগণিত হ্য়। মারেফতি বা ফকিরালী গানের পোশাকী নাম "মরমী সাহিত্য"। প্রাচীন লোকসাহিত্য বা লোকঐতিহ্যের একাংশের রুপান্তর মরমী সাহিত্য। উল্লেখ্য যে, মরমী সঙ্গীত ও বাউল গানকে যদিও বর্তমানকালে এক করে ভাবা হয়, কিন্তু এর ইতিহাস সন্ধানি সৈয়দ মোস্তফা কামাল ও অন্যান্যদের কাছে এর ভাবধারায় ভিন্নতা রয়েছে বলে অভিমত পাওয়া যায়।[2][3] কারণ হিসেবে বলা হয়, মরমী সঙ্গীত হচ্ছে সুফীবাদের বহিঃপ্রকাশ। যা মূলত তাওহিদ (স্রষ্টার একত্ববাদ) রিসালতের (পয়গাম্বরের কাহিনী) উপর ভিত্তি করে রচিত এবং বাউল মতবাদ হচ্ছে স্রষ্টাই জীব জীবই স্রষ্টা ইত্যাদি বিষয়ের উপর প্রতিষ্টিত। তাই একে ভারতীয় বেদান্তের অদ্বৈত্যবাদ দ্বারা প্রভাম্বিত বলে ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী ধারণা করেন।[3] অন্যদিকে বাংলাদেশে সূফীবাদের আগনম কাল তুর্কি বিজয়ের বহু পূর্বে ছিল বলে হিজরি তৃতীয় শতাব্দির বিখ্যাত আরব পর্যটক সোলায়মান ছয়রাফীর ভ্রমণ কাহিনী থেকে জানা যায়। এ দিক দিয়ে ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী থেকে পাওয়া যায়, মূল আরবীয় সুফীবাদ-ই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে ছিল। খ্রিস্টিয় দশম শতাব্দির পর আরবীয় সুফীবাদ যখন গ্রিক দর্শনে প্রভাম্বিত হয় তখন থেকে এটিতে স্রষ্টার একত্ববাদের সাথে জীববাদ ইত্যাদির অনুপ্রবেশ ঘটে এবং তুর্কি বিজয়ের মধ্যদিয়ে ভারতে প্রবেশ করে রাজশক্তির হাতে লালিত পালিত হয়ে বৈদান্তিক সাহিত্যের শব্দমালা মিশ্রিত হয়। যার ফলে বৌদ্ধদের কাছে প্রসংশিত হয় এবং বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণবাদ থেকে মুক্তির পথ পেয়ে ইলামের আর্দশ গ্রহণ করে।[3] বাংলাদেশে সুফিদের আগমনের পথ ছিল চট্টগ্রামের বিখ্যাত বন্দর । এর মধ্য দিয়ে সুফিরা বাংলায় আসেন এবং চট্টগ্রাম সহ সিলেটে আস্তানা গড়ে বসবাস করেন। হিজরি সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে সিলেট বিজয়ের মধ্যদিয়ে সর্বোপরি সুফিরা এখানে এসে বসবাস করেন। যার ফলে এ অঞ্চল সুফিবাদের রাজধানীতে পরিণত হয়। পরবর্তিতে এখান থেকে সুফি মতবাদ বিস্পরিত হয় সারা বাংলেদেশে । সে কারণে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সিলেটাঞ্চলের মরমী গীতিকার প্রকারভেদ ভিন্ন বলে অনুমিত। তাই এগুলোকে এ অঞ্চলে সিলেটের মরমী সাহিত্য বলে আখ্যায়িত করা হয়। ইতিহাস অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, মধ্যযুগের শুরু থেকে সিলেট অঞ্চলে জন্ম হয়েছে প্রখ্যাত, অজ্ঞাত অনেক মরমী সাধকদের। যারা হৃদয় বীণার তারের সুরে ছন্দে রচনা করেছেন ঈশ্বর প্রেম সহ সৃষ্টির উপর অসংখ্য গীত। মানুষের জীবন-জীবিকা, আচার-আচরণ ও সুখ-দুঃখ নিয়ে রচিত এক কালের লোকসাহিত্য ঈশ্বর প্রেম, সৃষ্টি তত্ব জীবে-জীবে প্রেম ইত্যাদির মৌল্যবোধে সৃষ্টি হয়েছে মরমী সাহিত্যের।[3] এ পৃথিবী নশ্বর বা অনিত্য, এখানের বাসিন্দাদের মিলে মিশে একে অন্যের সাথে জীবনজ্ঞাপন করা নামটিই হচ্ছে প্রেম। প্রেমকে জাগ্রত করে মানুষের হৃদয়ে স্থায়ীত্ব করাটাই হচ্ছে মরমী মতবাদের মূল লক্ষ্য। এ বিষয়ে মধ্য যুগের কবি আলাওল তার পদ্মাবতী কাব্যে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেনঃ
ত্রিভূবনে যাহা দেখি প্রেম হুনতে (হতে) বশ
যার হূদে জন্মিলেক প্রেমের অঙ্কুর
মুক্তি পাইল সে প্রেমের ঠাকুর[2]
সৈয়দ মোস্তফা কামালের মতে হৃদয়ের গভীর এশক, মোহব্বত বা প্রেমের আধ্যাত্মিক বাণী ও সুর লহরীই মরমী সঙ্গীত। ইসলামের দৃষ্টিতে মরমীবাদকে সুফী সাধনা বলা হয়েছে। মাওলানা রুমীর মতে এটি কোন পৃথক মতবাদ নয়। বরং ধর্মীয় চিন্তার একটি প্রকৃতগত পদ্ধতি বিশেষ। যা সৃষ্টি কর্তার কাছে মানবের আত্মসমর্তনেরই একটি ধারা বুঝায়। মরমী কবি তার অন্তরদৃষ্টি দিয়ে দেখা দুনিয়ার পার্থিব অপার্থিব বিষয় গুলোকে ছন্দে সুরে ব্যক্ত করে যে বাণী মানুষের কাছে পৌছায়, এটিই মরমী সাহিত্য।[2] ডঃ মুমিনুল হক বঙ্গে সুফীবাদ গ্রন্থে বলেছেন; আরবদেশ সুফিবাদের জন্ম দিলেও পারস্য এর লালন পালন করেছে । সূফীবাদ আরবদেশ ছেড়ে যতই পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়েছে ততই পূর্বদেশীয় ভাবধারার সম্মিলন ঘটতে থাকে। অধ্যাপক আসদ্দর আলীর মতে শ্যামল বাংলায় এর বিকাশ কাল ছিল সপ্তম হিজরির প্রমথ পাদে। সুফি আউলিয়াগণ দ্বারা এর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে। শাহজালাল (আওলিয়া) সহ ৩৬০ ষাট আউলিয়ার ভূমি সাবেক সিলেট জেলা বর্তমান সিলেট বিভাগই এর বিকাশ স্থল। এজন্য সিলেটকে বলা হয় বাংলার আধ্যাত্মিক রাজধানী। যুগ যুগান্তর ধরে সুফি, ফকির, পীর ও আউলিয়ার ক্রমধারায় সিলেটে জন্ম হয়েছে বেশুমার ভাবুক, কবি ও সাধকদের । যারা সুর মুর্ছনার মধ্য দিয়ে মানুষকে দেখিয়েছে পরমাত্মাকে পাওয়ার পথ।[4] সংগীত এবং মরমী কবিদের জন্য সিলেট অঞ্চল পরিচিত।[5] রাধারমণ দত্ত, শাহ আবদুল করিম, শীতলংশাহ, দ্বীন ভবানন্দ, হাসন রাজা, আরকুম শাহ, দূর্বিন শাহ প্রমুখ রচিত মরমী গানগুলি সিলেটিদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় যা সিলেটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসমূহে উপস্থাপিত হয়।[6][7] হাসন রাজার মরমী ও আধ্যাত্মিক গান, লোকে বলে বলে রে/ ঘর বারী বালানাই আমার; সোনা বন্ধে আমারে দিওয়ানা করিলো; আঁখি মুদিয়া দেখো রূপ; নেশা লাগিলো রেহ/ বাঁকা দুই নয়নে নেশা লেগিলো রে, সহ গানগুলো ঐতিহ্যবাহী সিলেটিতে রচিত হলেও সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে খ্যাতি পেয়েছে।[8][9][10] তিনি সিলেটি ভাষায় প্রায় এক হাজার মরমী সংগীত রচনা করেছেন, যা সমগ্র দেশজুড়ে বিখ্যাত।[11]