সামাজিক লিঙ্গ পরিচয়
From Wikipedia, the free encyclopedia
সামাজিক লিঙ্গ পরিচয় শব্দ দ্বারা একজন মানুষের সামাজিক লিঙ্গ (জেন্ডার) সম্পর্কে নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে বোঝানো হয়।[1] এই শব্দজোড়া দিয়ে সবসময়ই যে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত সামাজিক লিঙ্গ পরিচয়কে বোঝায়, তা কিন্তু নয়।[2] অনেক সময়ই সামাজিক লিঙ্গ পরিচয় ব্যক্তির নিজস্ব সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে যে তিনি কোন সামাজিক লিঙ্গ পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সব সমাজেই সামাজিক লিঙ্গভিত্তিক শ্রেণীতালিকা রয়েছে, যা দিয়ে সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সাথে একজন ব্যক্তির সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠে।[3] তবে বেশিরভাগ সমাজে শুধুমাত্র নারী ও পুরুষের ভিত্তিতে সামাজিক লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যাবলীর পার্থক্য রয়েছে।[4] জৈবিক লিঙ্গ পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে যেকোন সামাজিক লিঙ্গের মানুষের সমভাবে পুরুষত্ব এবং নারীত্ব প্রকাশকেই জেন্ডার বাইনারি অনুপ্রাণিত করে।[5] প্রতিটি সমাজেই, কিছু ব্যক্তি থাকে যারা তাদের জৈবিক লিঙ্গ পরিচয়ের সাথে সম্পর্কিত সামাজিক বৈশিষ্ট্যাবলির সবগুলি বা কিয়দংশ প্রকাশ করে না।[6] এদের মাঝে কেউ কেউ রূপান্তরিত সামাজিক লিঙ্গ অথবা সামাজিক লিঙ্গগতভাবে কুইয়ার (সমাজনির্ধারিত মান-বহির্ভূত সংখ্যালঘু সামাজিক লিঙ্গ)। আবার কেউ কেউ তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে পরিচিত।
সামাজিক লিঙ্গ পরিচয়ের প্রাথমিক কাঠামো ৩ বছর বয়সে গড়ে উঠে।[7][8] এরপর এর পরিবর্তন হওয়া সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। এমনকি পরবর্তীতে জোর করে পরিবর্তন আনার চেষ্টা সামাজিক লিঙ্গগত অস্থিতিশীলতার (জেন্ডার ডিস্ফোরিয়া) তৈরি করতে পারে। জৈবিক এবং সামাজিক উভয়ের প্রভাবেই এই সামাজিক লিঙ্গ পরিচয় গড়ে তুলে।
বাচ্চাদের ভাষা বুঝতে পারার অসুবিধার কারণে শুধুমাত্র ধারণার ভিত্তিতে সামাজিক লিঙ্গ পরিচয় আসলে ঠিক কোন সময়ে গড়ে উঠে তা নিয়ে একাধিক তত্ত্ব রয়েছে। বলা বাহুল্য, এসব তত্ত্ব সরাসরি কোনও প্রমাণের ভিত্তিতে গড়ে উঠেনি।[9] জন মানি বলেন বাচ্চারা ১৮ মাস থেকে দুই বছর বয়েসেই নির্দিষ্ট সামাজিক লিঙ্গের প্রতি সংবেদনশীল ও আকর্ষণবোধ করা শুরু করে। অন্যদিকে লরেন্স কোলবার্গ দাবী করেন তিন বছর বয়সের আগে সামাজিক লিঙ্গ পরিচয় গড়ে উঠে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানা হয় তিন বছর বয়স হতে হতে সামাজিক লিঙ্গ পরিচয়ের প্রধান ভিত্তি দাঁড় হয়।.[10] এই বয়সে এসে বাচ্চারা নিজেদের সামাজিক লিঙ্গ সম্পর্কে বক্তব্য প্রদানে সক্ষম হয় এবং সামাজিকভাবে স্বীকৃত ও তাদের সামাজিক লিঙ্গের জন্য প্রযোজ্য খেলনার প্রতি আগ্রহী হয়। যেমন মেয়েশিশুরা পুতুল এবং আঁকাআঁকির দিকে ঝুঁকে এবং ছেলেশিশুদের আগ্রহ থাকে ঘরবাড়ি বানানো খেলনা বা যন্ত্রপাতির উপর।[11] যদিও এই বয়সে এসে শিশুরা সামাজিক লিঙ্গের গুরুত্ব সম্পূর্ণভাবে অনুধাবন করতে পারে না। তিন বছর বয়সের পর এই সামাজিক লিঙ্গ পরিচয়ের পরিবর্তন আনা সহজসাধ্য নয় বরং ক্ষেত্রবিশেষে জোর প্রয়োগে তা জটিলতা তৈরি করতে সক্ষম।[12] চার থেকে ছয় বছর বয়সে বাচ্চাদের সামাজিক লিঙ্গ পরিচয়ের অন্যান্য দিকও সুগঠিত হয়।[13] যা প্রাপ্তঃবয়স্ক হওয়ার আগ অব্দি বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত চলে।.
মার্টিন ও রুবল সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকে তিনটি ধাপে সাজিয়েছেন।
- (১) কোলের বাচ্চারা এবং স্কুলে ভর্তির আগেই বাচ্চারা সাধারণত সামাজিকভাবে প্রতিটি সামাজিক লিঙ্গের বৈশিষ্টাবলি ও বিভিন্ন চরিত্রায়নের ব্যাপারে শিক্ষা পায়;
- (২) বয়স ৫-৭ এর মাঝে নিজেদের মাঝে স্বীয় সামাজিক লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে একটি শক্ত ধারণা গড়ে উঠে;
- (৩) একটা সময়ে পূর্বে গড়ে ওঠা "শক্ত ধারণা" সামাজিক লিঙ্গ অনুযায়ী সামাজিকভাবে প্রচলিত ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং একটি আপাত সুস্থিতি লাভ করে।[14]
বারবারা নিউম্যান চারটি ধাপ উল্লেখ করেন,
- (১) সামাজিক লিঙ্গের ধারণা বুঝতে পারা;
- (২) আদর্শ ও গতানুগতিকভাবে প্রচলিত সামাজিক লিঙ্গভিত্তিক আচরণ শেখা;
- (৩) পিতামাতার সাথে নিজের সামাজিক লিঙ্গ পরিচয় নিশ্চিত করা, এবং
- (৪) সামাজিক লিঙ্গগত পছন্দ গড়ে ওঠা।.[15]
যদিও সামাজিক লিঙ্গ পরিচয় উঠার ব্যাপারটা সঠিকভাবে বোঝা যায়নি তবে এর গঠনে একাধিক প্রভাবক কাজ করে বলে একাধিক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ করে, সামাজিকীকরণ বনাম জীববিজ্ঞানীয় কারণ এই দুইয়ের মাঝে কোনটা তীব্রভাবে কাজ করে এ নিয়ে মনোবিজ্ঞানে বিতর্ক রয়েছে। আর এই বিতর্ককে প্রকৃতি বনাম প্রতিপালন বলে অবহিত করা হয়। যদিও দুইটি কারণই প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। জৈবিক কারণের মধ্যে, ভ্রূণীয় দশা ও এর পরবর্তী সময়ের হরমোন মাত্রা কাজ করে।[16] অন্যদিকে বংশাণুর গঠন সামাজিক লিঙ্গ পরিচয় প্রভাবিত করলেও এটাই সামাজিক লিঙ্গ পরিচয় গঠনের প্রধান কারণ নয়।[17][18][19]
পরিবার, সংবাদমাধ্যম ও সামাজিকভাবে সামাজিক লিঙ্গভিত্তিক আচরণ ও চরিত্রায়ন শিশুর সামাজিক লিঙ্গ পরিচয় গড়ে উঠতে বড় প্রভাব ফেলে।[20] শিশুরা যে সমাজে বড় হয়, সেই সমাজে যদি নির্দিষ্ট সামাজিক লিঙ্গের মানুষের নির্দিষ্ট কিছু আচরণগত গতানুগতিক স্বভাব থাকে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুরা সেই আচরণ নিজেদের মাঝে ধারণ করে বড় হয়। [21] অবচেতন মনে ভাষা শেখার সময়ই শিশুরা পুরুষবাচক ও নারীবাচক শব্দাবলি আলাদা করে বুঝতে পারে যা তাদের আচরণে প্রভাব ফেলে।[22] সামাজিক লিঙ্গভিত্তিক আচরণ দেখে তা নকল করার মাধ্যমে এবং আচরণের উপর নির্ভর করে তাঁরা পুরষ্কৃত বা তিরষ্কৃত হয় কিনা এগুলোর ভিত্তিতেও শিশুদের মাঝে নিজস্ব সামাজিক লিঙ্গ পরিচয় গড়ে উঠে বলে "সামাজিক শিক্ষা তত্ত্ব" দাবী করে। [23] সামাজিক লিঙ্গ পরিচয় নিজস্ব আকার পায় শিশুদের চারিদিকে থাকা মানুষের আচরণের মাধ্যমে, কেননা শিশুরা বড় হয় অনুকরণ করেই। [24]
ডেভিড রেইমার "প্রকৃতি বনাম প্রতিপালন" এর একটি পরিচিত উদাহরণ- যা "জন/জোয়ান" নামে পরিচিত। ছোটকালে রেইমার ভিন্ন ধরনের অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। তিনি তার পুরুষ জননাঙ্গ হারান। মনোবিজ্ঞানী জন মানি তার মা-বাবাকে বোঝান তাঁরা যেন রেইমারকে মেয়ে হিসেবে বড় করে তোলে। রেইমার সবসময় মেয়েদের জামাকাপড় পড়েছেন, মেয়েদের খেলনা তার চারিদিকে সবসময় থাকলেও তিনি কখনই নিজেকে একজন মেয়ে হিসেবে মনে করেন নি। তের বছর বয়সে তিনি আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত হলে তাকে জানানো হয় যে তিনি পুরুষ জননাঙ্গ সমেত একজন ছেলে হিসেবে জন্ম নিয়েছিলেন। তিনি একটি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পুরুষ জননাঙ্গ ফিরে পান।[25] এই ঘটনা জন মানির তত্ত্ব "সামাজিক লিঙ্গ পরিচয় কিংবা যৌন অভিমুখিতা জীববিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়" তত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণ করে।[26]
একাধিক জৈব কারণ (বায়োলজিকাল ফ্যাক্টর) অনুসারে, জন্মের আগেই, বংশাণু (জিন) ও হরমোন সামাজিক লিঙ্গ পরিচয়ের উপর প্রভাব ফেলে।.[27] জৈবরাসায়নিক তত্ত্ব মতে, সামাজিকতার চেয়ে এই ধরনের প্রভাব দ্বারাই মানুষের লিঙ্গ পরিচয় বেশি প্রভাবিত হয়।
হরমোনজনিত প্রভাব বেশ জটিল। ভ্রুণের ক্রমবিকাশের খুব প্রাথমিক ধাপে সামাজিক লিঙ্গ নির্ধারণকারী হরমোন তৈরি হয় [28] এবং এই হরমোনের মাত্রা কোন কারণে বদলে গেলে বহির্বৈশিষ্ট্যতেও (ফিনোটাইপেও) এর প্রভাব পড়ে। এতে প্রকৃতিগতভাবে নির্দিষ্ট এক সামাজিক লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করার যে প্রবণতা কাজ করার কথা, তা বিঘ্নিত হয় অথবা বাহ্যিক যৌনাঙ্গের গঠন প্রভাবিত হয়। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন][29]
নারী ও পুরুষের সক্ষমতা, স্মৃতি এবং আগ্রাসন প্রবণতা হরমোন দ্বারা সম্ভবত প্রভাবিত হয়। জন্মের আগেই হরমোনের প্রভাব পরবর্তী জীবনে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস থেকে হরমোন নির্গত হওয়াকে প্রভাবিত করে। "নারীর যৌন হরমোন একটি মাসিক চক্রের মধ্য দিয়ে যায় যা পুরুষের ক্ষেত্রে হয় না।"[30]