Loading AI tools
ইসলামের তৃতীয় মূল স্তম্ভ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
রোযা বা রোজা (ফার্সি روزہ রুজ়ে), সাউম বা সাওম (আরবি صوم স্বাউম্, অর্থঃ সংযম), বা সিয়াম হলো ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল ভিত্তির তৃতীয়। সুবহে সাদেক বা ভোরের সূক্ষ আলো থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার,পাপাচার, কামাচার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ-বিলাস থেকেও বিরত থাকার নাম রোযা। ইসলামী বিধান অনুসারে, প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্য রমযান মাসের প্রতি দিন রোজা রাখা ফরজ, (فرض ফ্যর্দ্ব্) যার অর্থ অবশ্য পালনীয়।
কিছু মুসলিম আলেম মূল ইসলামী আরবী শব্দ "সাওম" বা সিয়াম (صوم)-এর ব্যবহারকে অধিক উৎসাহিত করে থাকেন, যুক্তি হিসেবে তারা বলেন, সাওম শব্দটি কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে, তাই শব্দটি বলার সময় প্রতি হরফে দশ নেকি করে তিন হরফে মোট ৩০ নেকি সাওয়াব পাওয়া যাবে, যা রোজা বা অন্যান্য অ-কুরআনীয় প্রতিশব্দ উচ্চারণে পাওয়া যাবে না। কুরআনীয় শব্দ বলায় প্রতি হরফে দশ নেকির ক্ষেত্রে তারা ইসলামী নবী মুহাম্মদের উক্ত হাদীসটি পেশ করেন,
রাসূল (সা.) বলেছেন,
مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لَا أَقُولُ الم حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ
‘আল্লাহ তাআলার কিতাবের একটি হরফ যে ব্যক্তি পাঠ করবে তার জন্য এর সওয়াব আছে। আর সওয়াব হয় তার দশ গুণ হিসেবে। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ, বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ।’
— [সুনানে তিরমিযি, হাদিস: ২৯১০]
মূল কুরআনীয় ইসলামী আরবিতে ইসলামী উপবাসের নাম সাওম, বহুবচনে সিয়াম, যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে সংযম বা আত্মনিয়ন্ত্রণ বা বিরত থাকা। রোজা শব্দটি ফারসি শব্দ, যা এসেছে আদি-ইরানীয় ধাতুমূল রোওচাকাহ থেকে, যার অর্থ উপবাস, যা আবার এসেছে ইন্দো-ইরানীয় ধাতুমূল রোচস (रोचस्) থেকে,[5] যার অর্থ দিন বা আলো। ফারসি ভাষায় সিয়ামের প্রতিশব্দ হিসেবে রোজা ব্যবহৃত হয়, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ভাষার মত কালক্রমে বাংলা ভাষাতেও শত শত বছর আগে থেকে এখন পর্যন্ত সাওম বা সিয়াম নামক ইসলামী উপবাস বোঝানোর জন্য সমধিকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার,কামাচার, পাপাচার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ-বিলাস ও অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত থাকার নাম সাওম বা রোজা।
কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে,
"হে যারা ঈমান এনেছ তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা তাক্ওয়া অবলম্বন করতে পার"। (সূরা বাকারা: ১৮৩)[6]
হযরত আদম যখন নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর তাওবাহ করেছিলেন তখন ৩০ দিন পর্যন্ত তার তাওবাহ কবুল হয়নি। ৩০ দিন পর তার তাওবাহ কবুল হয়। তারপর তার সন্তানদের উপরে ৩০টি রোযা ফরয করে দেয়া হয়।[7]।
নূহ (আ.)-এর যুগেও রোজা ছিল। কারণ, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন:
হযরত নূহ (আ.) ১ লা শাওয়াল ও ১০ জিলহজ ছাড়া সারা বছর রোযা রাখতেন।
— ইবনে মাজাহ ১৭১৪ (সনদ দুর্বল)[8]
হযরত ইবরাহীমের যুগে ৩০টি রোজা ছিল বলে কেউ কেউ লিখেছেন।
হযরত দাউদ (আ.) এর যুগেও রোযার প্রচলন ছিল। হাদিসে বলা হয়েছে, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় রোযা হযরত দাউদ (আ.)-এর রোযা। তিনি একদিন রোযা রাখতেন এবং একদিন বিনা রোযায় থাকতেন।[9]
আরববাসীরাও ইসলামের পূর্বে রোযা সম্পর্কে কমবেশী ওয়াকিফহাল ছিল। মক্কার কুরাইশগণ অন্ধকার যুগে আশুরার (অর্থাৎ ১০ মুহররম) দিনে এ জন্য রোযা রাখতো যে, এই দিনে খানা কাবার ওপর নতুন গেলাফ চড়ানো হতো।[10][11] মদীনায় বসবাসকারী ইহুদীরাও পৃথকভাবে আশুরা উৎসব পালন করতো।[12] অর্থাৎ ইহুদীরা নিজেদের গণনানুসারে সপ্তম মাসের ১০ম দিনে রোযা রাখতো।[13]
রোজার কিছু মৌলিক আচার আছে। যা ফরজ বলে চিহ্নিত। সুস্থ-সবল প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমকে অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। কিন্তু শারীরিক অসমর্থতার কারণে সে এ দায়িত্ব থেকে আপাতভাবে মুক্তি পেতে পারে। এর প্রতিবিধানে রয়েছে কাজা ও কাফফারার বিধান। নিচে রোজার ফরজ ও শর্তগুলো দেওয়া হলো-
রোজার ৩ ফরজ :
রোজা রাখার ৪ শর্ত :
রোজা পাঁচ প্রকার।
১. ইচ্ছা করে বমি করা
২. বমির বেশির ভাগ মুখে আসার পর তা গিলে ফেলা
৩. মেয়েদের মাসিক ও সন্তান প্রসবের পর ঋতুস্রাব
৪. ইসলাম ত্যাগ করলে
৫. গ্লুকোজ বা শক্তিবর্ধক ইনজেকশন বা সেলাইন দিলে
৬. প্রস্রাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে ওষুধ বা অন্য কিছু শরীরে প্রবেশ করালে
৭. রোজাদারকে জোর করে কেউ কিছু খাওয়ালে
৮. ইফতারের সময় হয়েছে ভেবে সূর্যাস্তের আগে ইফতার করলে
৯. মুখ ভরে বমি করলে
১০. ভুলবশত কোনো কিছু খেয়ে, রোজা ভেঙে গেছে ভেবে ইচ্ছা করে আরও কিছু খেলে
১১. বৃষ্টির পানি মুখে পড়ার পর তা খেয়ে ফেললে
১২. কান বা নাক দিয়ে ওষুধ প্রবেশ করালে
১৩. জিহ্বা দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে ছোলা পরিমাণ কোনো কিছু বের করে খেয়ে ফেললে
১৪. অল্প বমি মুখে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে তা গিলে ফেললে
১৫. রোজা স্মরণ থাকা অবস্থায় অজুতে কুলি বা নাকে পানি দেয়ার সময় ভেতরে পানি চলে গেলে। (ফাতাওয়ায়ে শামি ও ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি)।
*বিনা ওজরে কোনো জিনিস মুখে দিয়ে চিবানো।
*গরমের কারণে বারবার কুলি করা।
*টুথ পাউডার, পেস্ট, কয়লা বা অন্য কোনো মাজন দ্বারা রোজার দিনে দাঁত পরিষ্কার করা।
*বিনা ওজরে জিহ্বা দ্বারা কোনো বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করা। তবে বদমেজাজি স্বামীর জন্য স্ত্রীর তরকারির স্বাদ গ্রহণ করার অনুমতি আছে।
*রোজাদার অবস্থায় কারও গিবত (পরচর্চা, পরনিন্দা) করা।
*মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।
*অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করা কিংবা পাঠ করা।
*ঝগড়া-বিবাদ করা।
বিনা কারণে রোজা ভঙ্গ করলে তাকে অবশ্যই কাজা-কাফফারা উভয়ই আদায় করা ওয়াজিব। যতটি রোজা ভঙ্গ হবে, ততটি রোজা আদায় করতে হবে। কাজা রোজা একটির পরিবর্তে একটি অর্থাৎ রোজার কাজা হিসেবে শুধু একটি রোজাই যথেষ্ট। কাফফারা আদায় করার তিনটি বিধান রয়েছে।
যেসব কারণে রমজান মাসে রোজা ভঙ্গ করা যাবে কিন্তু পরে কাজা করতে হয় তা হচ্ছে
যেসব কারণে শুধু কাজা আদায় করতে হয়
ওষুধ দিলে
ইসলামে মেরু অঞ্চলসমূহে রোজা রাখা সম্পর্কে সরাসরি কিছুই বলা হয় নি। তবে সৌদি আরব রাজ্যের উর্ধতন বিশেষজ্ঞ পরিষদের মতামত অনুযায়ী, দজ্জাল সম্পর্কে একটি হাদিস রয়েছে[15], যেখানে প্রমাণিত হয় যে প্রতি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রোজা এবং একই সঙ্গে নামাজ উপক্রম করতে হবে।[16]
এই সমস্যার কারণ হলো গ্রীষ্মকালে মেরু অক্ষাংশে নিশীথ সূর্য এবং শীতকালে মেরু নিশি দেখা যায়। এই প্রাকৃতিক ঘটনাটি সংঘটিত হয় কারণ গ্রীষ্মকালে পৃথিবীর অক্ষাংশ সূর্যের দিকে হেলে থাকে এবং শীতকালে সূর্য থেকে দূরে সরে যায়, এই কারণে মেরু অঞ্চলসমূহে প্রতি ছয়-মাস যাবৎ টানা সূর্যের আলো দেখা যায়। ইসলামের প্রাথমিক যুগের আদি মুসলমানরা মেরু অঞ্চলে বসবাস করতেন না, তারা উপক্রান্তীয় অঞ্চলে বসবাস করতেন যেখানে সূর্য দিনের বেলায় সরাসরি উপরিভাগে থাকে এবং রাতে অস্ত যায়। এজন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের এই ঘটনাগুলির অভিজ্ঞতা হয় নি।
রোজা রাখার উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা, পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং নিজেদের কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরহেজগারি বা তাকওয়া বৃদ্ধি করা।
কুরআনে বলা হয়েছে,
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো"।
— সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৩
আরও বলা হয়েছে,
"রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।"
— সূরা বাকারা: ১৮৫[17]
‘তাকওয়া’ শব্দটির মূল অর্থ ‘রক্ষা করা।’ এর অনুবাদ করা হয়েছে নানাভাবে। যেমন পরহেজগারি, আল্লাহর ভয়, দ্বীনদারি, সৎ কর্মশীলতা, সতর্কতা প্রভৃতি। রোজা ঢালের মতো কাজ করে, যা গোনাহের হাত থেকে বাঁচায়।[18]
রমজানের একটি বিশেষ ফজিলত বা মাহাত্ম্য হচ্ছে,এই পবিত্র রমজান মাসে আল কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। রমজান মাসের রোজা মানুষকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি দেয়,মানুষের কুপ্রবৃত্তি ধুয়ে মুছে দেয় এবং আত্মাকে দহন করে ঈমানের শাখা প্রশাখা সঞ্জিবীত করে। সর্বোপরি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। এই মর্মে মহানবী ইরশাদ করেছেন,
"রোজাদারের জন্য দুটি খুশি। একটি হলো তার ইফতারের সময়, আর অপরটি হলো আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।"
— (বুখারী ও মুসলিম)
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.