Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
আব্দুল বাসিত মোহাম্মাদ আব্দুল কারিম বা রামজি আহমেদ ইউসুফ হলেন একজন মার্কিন ও ইসরায়েল বিদ্বেষী পাকিস্তানি সাজাপ্রাপ্ত আসামি, যিনি ১৯৯৩ সালে নিউইয়র্ক অবস্থিত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বোমা হামলা এবং ফিলিপাইন এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে বোমা হামলার অন্যতম প্রধান অপরাধী ছিলেন। ১৯৯৫ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদের একটি গেস্ট হাউসে পুতুলে বোমা রাখার চেষ্টা করার সময় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক তিনি গ্রেপ্তার হন এবং [3][4][5] পরবর্তীতে তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
রামজি আহমদ ইউসুফ رمزي احمد يوسف | |
---|---|
জন্ম | ২০ মে, ১৯৬৭ বা ২৭ এপ্রিল, ১৯৬৮[1] (বয়স, ৫৪–৫৫) |
অবস্থা | কারারুদ্ধ,সুপার ম্যাক্স কারাগার,ফ্লোরেন্স, কলোরাডো,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র |
নাগরিকত্ব | পাকিস্তানি[2] |
সন্তান | ২ |
পিতা-মাতা | মোহাম্মাদ আব্দুল কারিম |
আত্মীয় | খালিদ শেখ মোহাম্মাদ (মামা) |
উদ্দিষ্ট তারিখ | ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫ (ইসলামাবাদ,পাকিস্তান) |
কারারুদ্ধ | সুপার ম্যাক্স কারাগার,কলোরাডো,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র |
নিউইয়র্কের একটি কোর্টে হামলার অপর দুই আসামীসহ তার বিচার করা হয়েছিল এবং বোজিঙ্কা চক্রান্তে পরিকল্পনা করার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল।[6] ১৯৯৩ সালের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বোমা হামলা এবং বোজিঙ্কা চক্রান্তে অংশ নেওয়ার কারণে তিনি দুটি যাবজ্জীবন সাজা এবং ২৪০ বছরের সাজা পেয়েছিলেন। বর্তমান রামজি ইউসুফ কলোরাডোর ফ্লোরেন্সের কাছে অবস্থিত সুপারম্যাক্স কারাগারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন।[7] [8]
রামজী ইউসুফ নামটি একটি উপনাম। [9] তার আসল নাম আবদুল বাসিত মাহমুদ আবদুল করিম। [10] তিনি ইরাক, কুয়েত বা সংযুক্ত আরব আমিরাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তার বাবা-মা উভয়ই পাকিস্তানি। তার পিতা মোহাম্মদ আব্দুল করিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের অধিবাসী এবং তার মা আল কায়েদার নেতা খালিদ শেখ মোহাম্মদের বোন বলে মনে করা হয়।
১৯৮০- এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তার পরিবার মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাকিস্তানে ফিরে এলে ইউসুফকে শিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়। ১৯৮৬ সালে তিনি ওয়েলসের সোয়ানসি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। সেখানে তিনি বৈদ্যুতিক প্রকৌশলে চার বছর অধ্যয়ন করার পরে স্নাতক হন।[11] তিনি নিজের ইংরেজি উন্নত করার জন্য অক্সফোর্ড কলেজ অফ ফার্দারে অধ্যয়ন করেছিলেন। ইউসুফ পড়াশোনা শেষ করে যুক্তরাজ্য ছেড়ে পাকিস্তানে ফিরে আসেন। ১৯৯২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে তিনি পেশোয়ারের একটি একটি জিহাদি গোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ শিবিরে বোমা তৈরি শেখা শুরু করেন।[12][13]
আমেরিকার নিউইয়র্কে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বোমা হামলা ছিল একটি সন্ত্রাসী হামলা, যা ১৯৯৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী ঘটেছিল। হামলাকারী ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টাওয়ার ওয়ানের নীচে ৬৮০ কেজি ওজনের একটি হাইড্রোজেন গাড়ি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোর মাধ্যমে হামলার সূত্রপাত করেছিল। [14] হামলাকারী গাড়িবোমার সাহায্যে টাওয়ার ওয়ান ও টাওয়ার টু উভয়কে ধাক্কা দিয়ে ধসিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু এটি করতে সে ব্যর্থ হয়।[15][16]তবে হামলায় ছয়জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ১০৪২ জন আহত হয়।[17]
বোমা হামলার পর রামজি ইউসুফ নিজের উদ্দেশ্য প্রকাশ করে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন:
আমরা মুক্তিবাহিনীর পঞ্চম ব্যাটালিয়ন।উল্লেখিত ভবনে বিস্ফোরণের জন্য আমরা নিজেদের দায় ঘোষণা করছি।সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র ইজরাইল এবং এই অঞ্চলের বাকি স্বৈরশাসক দেশগুলিতে মার্কিন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সহায়তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে এই হামলা করা হয়েছে।
- আমাদের দাবিগুলো হলঃ
- ১. ইসরায়েলকে সমস্ত সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সাহায্য বন্ধ করতে হবে।
- ২.ইসরায়েলের সাথে সকল কূটনৈতিক সম্পর্ক বন্ধ করতে হবে।
- ৩.মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করতে হবে।
আমাদের দাবি পূরণ না হলে আমাদের সমস্ত কার্যকরী সেনাবাহিনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ও বাইরে সামরিক এবং বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে আমাদের মিশনগুলি চালিয়ে যাবে। আপনার নিজস্ব তথ্যের জন্য বলছি যে, আমাদের সেনাবাহিনী এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত এবং এতে শতাধিক আত্মঘাতী সৈন্য রয়েছে। ইসরায়েল যে সন্ত্রাসবাদ অনুশীলন করে (যা আমেরিকা সমর্থিত) তারও একই রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। কিছু দেশ তাদের নিজেদের জনগণের বিরুদ্ধে যে স্বৈরাচার ও সন্ত্রাসবাদ (আমেরিকা সমর্থিত) চালায় তাদেরও এমন হামলার মুখোমুখি হতে হবে।
মার্কিন জনগণকে অবশ্যই জানতে হবে যে, তাদের যে সকল বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে,তারা সে সকল মানুষের চেয়ে কোনো অংশে উত্তম নয়,যারা মার্কিন অস্ত্র ও সমর্থনে নিহত হচ্ছে।
আমেরিকীয় জনগণ তাদের সরকারের ক্রিয়াকলাপের জন্য দায়ী এবং তাদের সরকার অন্যান্য লোকদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অপরাধ করছে সে সম্পর্কে তাদের অবশ্যই প্রশ্ন তুলতে হবে। না হলে তারা (মার্কিন জনগণ) আমাদের ক্রিয়াকলাপগুলির লক্ষ্য হবে, যা তাদের ধ্বংস করতে পারে। [18]
১৯৯২ সালের ১ সেপ্টেম্বর ইউসুফ একটি বিতর্কিত ইরাকি পাসপোর্ট নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেন।[19] তার সঙ্গী আহমেদ আজাজ একাধিক অভিবাসন নথি বহন করেছিল, যার মধ্যে একটি জাল সুয়েডীয় পাসপোর্ট ছিল। ইউসুফের প্রবেশের সুবিধার্থে একটি স্মোকস্ক্রিন প্রদান করা হয়। আজজকে তখন ঘটনাস্থলেই গ্রেফতার করা হয় এবং অভিবাসন কর্মকর্তারা তার লাগেজে বোমার ম্যানুয়াল, আত্মঘাতী গাড়ি বোমারুদের ভিডিও টেপ এবং একটি প্রতারণার শীট খুঁজে পান।[20][21] সেই ঘটনায় ইউসুফকে ৭২ ঘন্টা ধরে আটকে রাখা হয়েছিল এবং বারবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল, কিন্তু সে কিছু স্বীকার করেনি। তারপর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনকারী ইউসুফকে ১৯৯২ সালের নভেম্বরে শুনানির তারিখ দেওয়া হয়েছিল।[13] তিনি জার্সি সিটি পুলিশকে বলেন যে, তিনি আব্দুল বাসিত মাহমুদ আব্দুল করিম এবং কুয়েতে জন্মগ্রহণকারী একজন পাকিস্তানি নাগরিক। তিনি নিজের পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেছেন। তারপর ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর নিউইয়র্কে অবস্থিত পাকিস্তানি কনস্যুলেট আব্দুল বাসিত মাহমুদ আব্দুল করিমকে একটি অস্থায়ী পাসপোর্ট জারি করে।[13]
ইউসুফ নিউইয়র্ক এবং নিউ জার্সিতে কিছুদিন ঘুরে বেড়ান। সেই সময়ে সে সেলফোনের মাধ্যমে আবদুর রহমান নামে একজনকে কল করেন।৩ ডিসেম্বর থেকে ২৭ ডিসেম্বরের মধ্যে তিনি পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নম্বরে কল করেন। আজাজ সেই ম্যানুয়াল ও টেপগুলি পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। যা ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) নিউ ইয়র্ক অফিসে রয়ে গিয়েছিল এবং বিচারক রীনা রাগি ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে তা প্রকাশ করার আদেশ দেন। [22]
মোহাম্মদ সালামেহ ও মাহমুদ আবুহালিমার সহায়তায় ইউসুফ জার্সি সিটিতে তার পামরাপো অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে ১,৫০০ পা (৬৮০ কেজি) ইউরিয়া নাইট্রেট-জ্বালানি তেল সংগ্রহ করা শুরু করেন। ১৯৯২ সালের শেষের দিকে এবং ১৯৯৩ সালের প্রথম দিকে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার সময় ইউসুফ তার হাসপাতালের কক্ষ থেকে রাসায়নিকের অর্ডার দিয়েছিলেন।[22] ২০০২ সালে একটি সাক্ষাৎকারে হামলার সহ-ষড়যন্ত্রকারী আব্দুর রহমান ইয়াসিন বলেছিলেন যে, ইউসুফ মূলত নিউইয়র্ক সিটিতে ইহুদিদের আশেপাশে বোমা ফেলতে চেয়েছিলেন। ইয়াসিন আরো বলেছিলেন যে, ক্রাউন হাইটস এবং উইলিয়ামসবার্গ ভ্রমণের পরে ইউসুফ তার মন পরিবর্তন করেছিলেন। ইয়াসিন অভিযোগ করেছেন যে, ইউসুফ পাকিস্তানের পেশোয়ারে একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ পেয়েছিল।[12]
ইউসুফ একটি রাইডার ভ্যান ভাড়া নেন এবং ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে সেটিতে শক্তিশালী বিস্ফোরক বোঝাই করেন। তিনি ভ্যানের পিছনে চারটি কার্ডবোর্ডের বক্স লোড করেন। প্রতিটি বক্সে কাগজের ব্যাগ, সংবাদপত্র, ইউরিয়া এবং নাইট্রিক অ্যাসিডের মিশ্রণ ছিল এবং এসবের পাশে তিনি সংকুচিত হাইড্রোজেনের তিনটি লাল ধাতব সিলিন্ডার রাখেন। ভ্যানের মাঝখানে নাইট্রোগ্লিসারিনের চারটি বড় পাত্র লোড করা হয়েছিল, যার প্রতিটিতে অ্যাটলাস রকমাস্টার ব্লাস্টিং ক্যাপ সংযুক্ত ছিল। [4] ভ্যানটি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের গ্যারেজে চালিয়ে নেওয়া হয়েছিল এবং সেখানেই এটি বিস্ফোরিত হয়। এরপর পাকিস্তানি পাসপোর্ট ব্যবহার করে কয়েক ঘন্টা পরে ইউসুফ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পালিয়ে যান। ধারণা করা হয় যে, তিনি প্রথম ইরাক এবং পরে সেখান থেকে পাকিস্তানে পালিয়ে যান। [23] বোমা হামলার ফলস্বরূপ এফবিআই ইউসুফকে ১৯৯৩ সালের ২১ এপ্রিল দশটি মোস্ট ওয়ান্টেড পলাতক তালিকায় ৪৩৬তম ব্যক্তি হিসাবে যুক্ত করে।[23]
১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানে ফিরে আসার পর ইউসুফ আত্মগোপন করেন। সে বছর গ্রীষ্মে তিনি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকে হত্যার করার একটি চুক্তি নিয়েছিলেন, যা সিপাহ-ই-সাহাবার সদস্যদের মাধ্যমে করানো হয়েছিল। ভুট্টোর বাসভবনের বাইরে ইউসুফ এবং আবদুল হাকিম মুরাদকে পুলিশ বাধা দিলে তার চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। ইউসুফ বোমা বিস্ফোরণ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ডিভাইসটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করার সময় এটি বিস্ফোরিত হয়। তদন্তের সময় তিনি পালিয়ে আত্মগোপনে চলে যান।[24]
ইরানের একটি শিয়া মাজারে বোমা হামলার পর ইউসুফ শীঘ্রই বোজিঙ্কা চক্রান্তের পরিকল্পনা শুরু করেন। এতে পোপ জন পল দ্বিতীয়কে হত্যা করার পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং এর জন্য তিনি ফিলিপাইন সফর করেন। তিনি ব্যাংকক থেকে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স এবং ডেল্টা এয়ার লাইনসের বেশ কয়েকটি ফ্লাইটে বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করেন। এই চক্রান্তে তিনি নিজের মামা খালিদ শেখ মোহাম্মদের সাথে কাজ করেছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়।[25]
১৯৯৪ সালের ১১ ডিসেম্বর ইউসুফ ম্যানিলা থেকে জাপানের টোকিও গামী ফিলিপাইন এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৪৩৪-তে চড়ে হামলার পরিকল্পনা করতে থাকেন। ফ্লাইটে তার পরিচয় ছিল আরমাল্ডো ফোরলানি নামে একজন ইতালীয় ব্যক্তি হিসেবে। তিনি নিপুণ জালিয়াতি করে সেই পরিচয়ে নিজের জন্য একটি জাল ইতালীয় পাসপোর্ট তৈরি করতে সক্ষম হন। ফ্লাইটের একজন ক্রু পরে তদন্তকারীদের বলেছিলেন যে, ইউসুফ বিমানে সংক্ষিপ্ত সময়ে বেশ কয়েকবার আসন পরিবর্তন করেছিলেন।[26]
ইউসুফ শৌচাগারে একটি বোমা প্রস্তুত করে এবং চার ঘন্টা পরে বিস্ফোরণের টাইমার সেট করে ফিউজলেজের ডানদিকে K26 সিটের নিচে লাইফ ভেস্টের থলিতে রাখেন। [25] তখন ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট মারিয়া ডেলাক্রুজ লক্ষ্য করেন যে, ইউসুফ ম্যানিলা থেকে সেবু বিমান চলাকালীন সিট বদলাতে থাকেন, কিন্তু সেবুতে যুক্ত হওয়া নতুন কেবিন ক্রুকে তার আচরণ সম্পর্কে তিনি সতর্ক করেননি। [26] ইউসুফ এবং অন্যান্য ২৫ জন যাত্রী সেবুতে বিমান থেকে নেমে যান। তখম বিমানটিতে ২৫৬ জন যাত্রী এবং একজন নতুন কেবিন ক্রু টোকিওতে ভ্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। বিমানবন্দরে জ্যামের কারণে সেবু থেকে বিমানটি ছাড়তে ৩৮ মিনিট বিলম্ব হয়। সাড়ে ৮টার মধ্যে যাত্রীরা সবাই উঠেছিলেন এবং প্রায় এর দুই ঘণ্টা আগে বোমাটি বসানো হয়েছিল। ৮ টা বেজে ৩৮ মিনিটে PAL 434 টেকঅফের জন্য প্রস্তুত হয়।[26]
দুপুর ১১ টা ৪৩ মিনিটে বোমাটি বিস্ফোরিত হয় এবং তখন বিমানটি টোকিও থেকে প্রায় দেড় ঘন্টা দূরে ছিল। বিমানটি তখন ৩৩,০০০ ফুট (১০,০০০ মি) উপরে জাপানি দ্বীপ মিনামি ডাইটোর উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল।[26] বিস্ফোরণে ২৪ বছর বয়সী হারুকি ইকেগামি নামে একজন জাপানি ব্যবসায়ীর আসনটি ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল৷ বোমাটি তার সিটের নিচেই রাখা হয়েছিল। ইকেগামির সামনে ও পিছনের সিটে বসা দশজন যাত্রীও আহত হয়ছিলেন। তবে বিমানটি একটি মারাত্মক অগ্নিবিস্ফোরণ থেকে রক্ষা পায়। কারণ বোমাটি যেখানে বসানো হয়, সেটি কেন্দ্রীয় জ্বালানী ট্যাঙ্ক থেকে দুই সারি দূরে ছিল। ককপিটে ক্রু ইঞ্জিনের থ্রোটল সেটিংস পরিবর্তন করে প্লেনের গতি এবং দিক পরিবর্তন করতে চেষ্টা করতে থাকেন। অবশেষে ক্যাপ্টেন এডুয়ার্ডো রেয়েস ওকিনাওয়ার নাহা বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করতে সক্ষম হন এবং ২৭২ যাত্রী ও ২০ জন ক্রু প্রাণো বেঁচে যান।[26]
ইউসুফ তারপর ম্যানিলায় ফিরে এসে কমপক্ষে এক ডজন বোমা প্রস্তুত করতে শুরু করেন। কিন্তু তার পরিকল্পিত আক্রমণের কয়েক সপ্তাহ আগে তার ম্যানিলার অ্যাপার্টমেন্টে আগুন ধরে যা। ফলে তিনি সবকিছু ফেলে ঘর থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। হঠাৎ আগুন লেগে যাওয়া অ্যাপার্টমেন্টের কর্মীদের সন্দেহজনক করে তোলে এবং শীঘ্রই আইডা ফারিসকালের নেতৃত্বে একদল পুলিশ অ্যাপার্টমেন্টে অভিযান চালিয়ে চক্রান্ত উন্মোচন করে। ম্যানিলার অন্য একটি অ্যাপার্টমেন্টে পুলিশের অভিযানে সংশ্লিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যে, আবদুল মুরাদ, খালিদ শেখ মোহাম্মদ এবং ইউসুফ সিআইএ সদর দফতরে একটি বিমান দিয়ে হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন। তথ্যটি ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাছে পাঠানো হয়েছিল এবং তারা বিমান সংস্থাগুলিকে সতর্ক করেছিল। [27]
আন্তর্জাতিক অভিযান সত্ত্বেও ইউসুফ ম্যানিলা থেকে পাকিস্তানে পালিয়ে যান।এরপর তিনি পাকিস্তান থেকে থাইল্যান্ডে যান এবং সেখানে একজন দক্ষিণ আফ্রিকীয় সহযোগী ইস্তাইক পার্কারের সাথে দেখা করেন। ইউসুফ পার্কারকে বোমা ভর্তি দুটি স্যুটকেস পৃথক দুটি বিমানে রাখতে বলেন; একটি ডেল্টা এয়ার লাইন্সের ফ্লাইটে, অপরটি ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে। বোমা দুটি নিয়ে পার্কার বিমানবন্দরে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছিল, কিন্তু স্যুটকেস নিয়ে এয়ারলাইন্সের কাছে যেতে খুব ভয় পেয়েছিল বলে জানা যায়। অবশেষে পার্কার ইউসুফের হোটেলে ফিরে আসে এবং মিথ্যা বলে যে, এয়ারলাইন কার্গো সেকশনের কর্মীরা পাসপোর্ট এবং আঙ্গুলের ছাপ চেয়েছিল, তাই সে তা করতে পারেনি। এভাবে পরিকল্পনাটি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়।
তারপর ইউসুফ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গামী একটি বিমানে বোমাটি পাততে কাতারে তার একজন বন্ধুকে ফোন করেন। তিনি তাকে স্যুটকেসগুলি লন্ডনে নিয়ে যেতে বলেন এবং পরিকল্পনা ছিল যে, বোমাটি মাঝপথে বিস্ফোরিত হবে। ইউসুফ তার বন্ধুর সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করেন, যাতে সন্দেহ ছাড়া স্যুটকেসগুলি বিমানে লোড করা হয়। সাইমন রিভের বই দ্য নিউ জ্যাক্যালস অনুসারে, এই বন্ধুর নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে তার বাবা একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও কাতার প্রতিষ্ঠার নেতৃস্থানীয় সদস্য বলে জানা যায়। সে সময় ইউসুফের মামা খালিদ শেখ মোহাম্মদ কাতারের একজন মন্ত্রিসভার কর্মকর্তার অতিথি হিসাবে সেখানে ছিলেন। যাহোক, তখন একটি সমস্যা হয়েছিল, তাই স্যুটকেস বিমানে লোড করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউসুফ ও পার্কার পাকিস্তানে ফিরে আসেন।[4]
পাকিস্তানে ফিরে এসে ইস্তাইক পার্কার গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ইউসুফের অবস্থান প্রকাশ করে দেয়। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৯৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ এজেন্টরা পাকিস্তানের ইসলামাবাদে সু-কাসা গেস্ট হাউসে অভিযান চালায় এবং পেশোয়ারে যাওয়ার প্রস্তুতিকালে ইউসুফকে আটক করে। [20] ইউসুফকে গ্রেফতার করার লক্ষ্যে তার অবস্থানের তথ্য দেওয়ার জন্য পুরস্কার ফর জাস্টিস প্রোগ্রামের অধীনে পার্কারকে $2 মিলিয়ন দেওয়া হয়ে।[3] [4] অভিযানের সময় এজেন্টরা ডেল্টা এবং ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটের সময়সূচী এবং শিশুদের খেলনাগুলিতে বোমার উপাদান খুঁজে পায়। [26] ইউসুফের আঙ্গুলে রাসায়নিক পোড়া ছিল। ইউসুফকে নিউইয়র্ক সিটির একটি ফেডারেল কারাগারে পাঠানো হয় এবং তার বিচার না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই রাখা হয়েছিল।
১৯৯৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ইউসুফ এবং দুই সহ-ষড়যন্ত্রকারীকে বোজিঙ্কা চক্রান্তে তাদের ভূমিকার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং মার্কিন জেলা আদালতের বিচারক কেভিন ডাফি কর্তৃক প্যারোল ছাড়াই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন । ১৯৯৭ সালের ১২ নভেম্বর ইউসুফকে ১৯৯৩ সালের বোমা হামলার মাস্টারমাইন্ডিংয়ের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয় [28] [29] এবং ১৯৯৮ সালের ৮ জানুয়ারী বিচারক ডাফি ইউসুফকে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বোমা হামলায় একটি "রাষ্ট্রদ্রোহী ষড়যন্ত্র" করার জন্য দোষী সাব্যস্ত করে ইউসুফকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এছাড়াও উভয় বোমা হামলার জন্য ২৪০ বছরের জেলও দেওয়া হয়। তিনি ইউসুফের সম্পূর্ণ সাজা নির্জন কারাগারে পরিবেশন করারও সুপারিশ করেন। [30]
১৯৯৮ সালে বিচারের সময় ইউসুফ বলেছিলেন:
তুমি (আমেরিকা) সরকারকে তাদের নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য করার জন্য যৌথ শাস্তি এবং নিরপরাধ মানুষ হত্যার কথাও বলছ; সরকারকে তার নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য করার জন্য কেউ যখন নিরপরাধ মানুষ বা বেসামরিক মানুষকে হত্যা করবে তখন তুমি একে সন্ত্রাসবাদ বলছ। ঠিক আছে, তুমিই যখন প্রথম এই সন্ত্রাসবাদ আবিষ্কার করেছ।
তুমি সেই প্রথম ব্যক্তি, যিনি নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছিলে এবং তুমিই প্রথম, যিনি মানবজাতির ইতিহাসে এই ধরনের সন্ত্রাসবাদের পরিচয় দিয়েছিলে, যখন তুমি একটি পারমাণবিক বোমা ফেলেছিলে। যা জাপানে কয়েক হাজার নারী ও শিশুকে হত্যা করেছিল। টোকিওতে আগুন বোমা হামলায় লক্ষাধিক মানুষ, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক। তুমি তাদের পুড়িয়ে হত্যা করেছিলে। তুমি তথাকথিত অরেঞ্জ এজেন্টের মতো রাসায়নিক দিয়ে ভিয়েতনামে বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছ। তুমি প্রতিটি যুদ্ধে বেসামরিক এবং নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছ। সৈন্য নয়, নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছ। তুমি এই শতাব্দীতে অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি যুদ্ধে গিয়েছিলে এবং তারপরেও নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করার কথা বলার স্নায়ু তোমার আছে।
আর এখন তোমরা নিরীহ মানুষ হত্যার নতুন উপায় উদ্ভাবন করেছ। তোমার তথাকথিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, যা শিশু এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের ছাড়া অন্য কাউকে হত্যা করে না। ইরাক ছাড়াও তুমি ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে কিউবা এবং অন্যান্য দেশের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছ। ... সরকার তার সারসংক্ষেপ এবং উদ্বোধনী বিবৃতিতে বলে যে, আমি একজন সন্ত্রাসী। হ্যাঁ, আমি একজন সন্ত্রাসী এবং আমি এটা নিয়ে গর্বিত। আমি সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করি, যতক্ষণ এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে।কারণ তুমি সন্ত্রাসীদের চেয়ে বেশি ভয়ংকর। তুমি সেই ব্যক্তি, যে সন্ত্রাসবাদ উদ্ভাবন করেছ এবং এটি প্রতিদিন ব্যবহার করছ। তোমরা মিথ্যাবাদী, কসাই ও ভণ্ড। [31]
ডাফি উত্তর দিয়েছেন:
রামজি ইউসুফ, তুমি নিজেকে ইসলামি জিহাদি দাবি কর। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বোমা দ্বারা নিহত বা ক্ষতিগ্রস্থ সমস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে, তুমি এমন একজনের নাম বলতে পারবে না, যিনি তোমার বা তোমার কারণের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু তুমি পাত্তা দাওনি।
রামজী ইউসুফ, তুমি ইসলামকে সমুন্নত রাখার উপযুক্ত নও। তোমাদের মাবুদ আল্লাহ নন... তোমরা মৃত্যু ও ধ্বংসের পূজা কর। তুমি যা কর, আল্লাহর জন্য কর না; তুমি এটি শুধুমাত্র নিজের অহংবোধের বাঁকানো অনুভূতিকে সন্তুষ্ট করার জন্য কর। তুমি অন্যদের বিশ্বাস করাতে চাও যে, তুমি একজন সৈনিক। কিন্তু সভ্যতার উপর যে আক্রমণের জন্য তুমি এখানে দোষী সাব্যস্ত হয়েছ, তা ছিল লুকোচুরি আক্রমণ যা সম্পূর্ণ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা এবং পঙ্গু করার চেষ্টা করেছিল...।
তুমি, রামজি ইউসুফ, ইসলামি জিহাদি হওয়ার ভান করে এই দেশে এসেছিলে, কিন্তু তুমি ইসলাম বা মুসলমানদের বিশ্বাসের জন্য সামান্য বা কিছুও পরোয়া করনি। তুমি আল্লাহর ইবাদত করেনি, বরং তুমি নিজেই মন্দ হয়ে গেছ। আমি অবশ্যই বলব যে, মন্দের প্রেরিত হিসাবে তুমি সবচেয়ে কার্যকরী হয়েছ। [31]
ইউসুফকে কলোরাডোর ফ্লোরেন্সে উচ্চ-নিরাপত্তাযুক্ত সুপারম্যাক্স কারাগারে রাখা হয়েছে। [32] ইউসুফ পাকিস্তানে বন্দী হওয়ার সময় যে হাতকড়া পরেছিলেন তা ওয়াশিংটন ডিসির এফবিআই মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। [33] তার ফেডারেল প্রিজনার নম্বর হল: ০৩৯১১–০০০। [32]
১৯৯৮ সালে ওসামা বিন লাদেন একটি সাক্ষাৎকারে বলেন যে, তিনি ইউসুফকে চেনেন না। তবে তিনি খালিদ শেখ মোহাম্মদকে চেনেন বলে দাবি করেন, যিনি ১১ সেপ্টেম্বরে মূল পরিকল্পনাকারী এবং ইউসেফের চাচা ছিলেন। ৯/১১ কমিশনের মতে শেখ মোহাম্মদ জিজ্ঞাসাবাদে বলেছিলেন যে, ইউসুফ আল-কায়েদার সদস্য ছিলেন না এবং ইউসুফ কখনই বিন লাদেনের সাথে দেখা করেননি।[34] কিছু লেখক অবশ্য ইউসুফ এবং বিন লাদেনের মধ্যে একটি শক্তিশালী সংযোগের কথা উল্লেখ করেছেন। [35]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.