ব্রিটিশ কর্তৃত্বের অধীনে ইরাক
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে ইরাক রাজতন্ত্র (আরবি: الانتداب البريطاني على العراق al-Intidāb al-Brīṭānī ‘Alá al-‘Irāq) যা ইরাক রাজতন্ত্র (ব্রিটিশ প্রশাসন) বা মেন্ডেটরি ইরাক বলে পরিচিত, ১৯২০ সালে প্রস্তাবিত মেসোপটেমিয়ায় ব্রিটিশ মেন্ডেটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘটার পর ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২২ সালে ইঙ্গ-ইরাকি চুক্তির মাধ্যমে তা কার্যকর হয়।
ইরাক রাজতন্ত্র (ব্রিটিশ প্রশাসন) الانتداب البريطاني على العراق | |||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
১৯২০–১৯৩২ | |||||||||
পতাকা | |||||||||
অবস্থা | ব্রিটিশ আশ্রিত রাজ্য | ||||||||
রাজধানী | বাগদাদ | ||||||||
প্রচলিত ভাষা | আরবি • কুর্দি আরামায়িক • ফারসি | ||||||||
ধর্ম | ইসলাম • খ্রিস্ট ইহুদি • ইয়াজিদি মান্দি | ||||||||
হাই কমিশনার | |||||||||
জাতীয় নেতা | |||||||||
ঐতিহাসিক যুগ | যুদ্ধ মধ্যবর্তী সময় | ||||||||
• সান রেমো সম্মেলন | ২৬ এপ্রিল ১৯২০ | ||||||||
১০ আগস্ট ১৯২০ | |||||||||
• প্রথম ফয়সালের অভিষেক | ১৯২১ | ||||||||
• ইঙ্গ-ইরাকি চুক্তি | ১৯৩০ | ||||||||
• স্বাধীনতা | ৩ অক্টোবর ১৯৩২ | ||||||||
আয়তন | |||||||||
১৯৩২ | ৪,৩৮,৩১৭ বর্গকিলোমিটার (১,৬৯,২৩৫ বর্গমাইল) | ||||||||
জনসংখ্যা | |||||||||
• ১৯৩২ | ৩৪,৪৯,০০০ | ||||||||
|
১৯২০ সালের মার্চে দামেস্কের সিরিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস ফয়সাল বিন হুসাইনকে সিরিয়ার বাদশাহ ঘোষণা করে। একই বছরের জুলাই মাসে ফরাসিরা তাকে উৎখাত করে। এরপর ফয়সালকে ব্রিটিশ অধিকৃত ইরাক অর্পণ করা হয়। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনী কিছু সামরিক নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রেখে দেয় এবং পুরো অঞ্চল ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত হয়।[১]
যুদ্ধপরবর্তী ইরাকের বেসামরিক প্রশাসন হাই কমিশনার স্যার পারসি কক্স ও তার ডেপুটি কর্নেল আর্নল্ড উইলসন পরিচালনা করতেন। নাজাফে একজন ব্রিটিশ অফিসার নিহত হওয়ার পর ব্রিটিশরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। জাতীয়তাবাদিদের মধ্যে ফুসে উঠতে থাকা ক্রোধ এসময় ব্রিটিশদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল। তারা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। এছাড়াও উত্তরের কুর্দিস্তান অঞ্চলে ব্রিটিশরা তখনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
১৯১৮ ও ১৯১৯ সালে ইরাকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশবিরোধী গুপ্তসংগঠন গঠিত হয়েছিল। লীগ অব দ্য ইসলামিক এওয়াকেনিং বা জমিয়ত আন নাহদা আল ইসলামিয়া নাজাফে সংগঠিত হয়। জনগণকে প্রতিরোধের জন্য সংগঠিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে মুসলিম ন্যাশনাল লীগ বা আল জামিয়া আল ওয়াতানিয়া আল ইসলামিয়া গঠিত হয়। ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারি বাগদাদে শিয়া বণিক, সুন্নি শিক্ষক, বেসামরিক সরকারি কর্মচারী, সুন্নি ও শিয়া উলামা এবং ইরাকি অফিসাররা গার্ডিয়ানস অব ইন্ডিপেনডেন্স বা হারাস আল ইসতিকলাল গঠন করে। কারবালা, নাজাফ, কুত ও হিল্লাহতে ইসতিকলালের সদস্য গোষ্ঠী ছিল।
কারবালার গ্র্যান্ড মুজতাহিদ ইমাম শিরাজি ও তার ছেলে মির্জা মুহাম্মদ রিজা বিদ্রোহ সংঘটনের সূচনা করেন। মুসলিমদের জন্য অমুসলিমদের শাসনে বসবাস করা বৈধ না মর্মে শিরাজি ফতোয়া প্রদান করেন এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। ১৯২০ সালের জুলাই মাসে মসুলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। বিদ্রোহ দক্ষিণে ফোরাত নদীর অববাহিকায় পৌছায়। দক্ষিণের গোত্রগুলো ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগঠিতভাবে কাজ করেনি ফলে তা বিদ্রোহের ফলাফলের উপর প্রভাব ফেলে। তিন মাস ধরে দেশ অস্থিতিশীল অবস্থায় ছিল। ভারত থেকে সেনা নিয়ে এসে ব্রিটিশরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
১৯২০ সালের বিদ্রোহ সমসাময়িক ঘটনাকে প্রভাবিত করেছে। প্রথমবারের মত সুন্নি ও শিয়া, গোত্র ও শহর, একই উদ্দেশ্যে কাছাঁকাছি আসে। ইরাকে একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রধান দুটি বিষয়রে উপর নির্ভরশীল ছিল, প্রথমত, সুন্নি ও শিয়াদের নতুন রাজনীতিতে ঐক্যবদ্ধকরণ এবং বহুযুগ ধরে চলে আসা আন্তগোত্রীয় এবং গোত্র ও শহরের মধ্যকার হানাহানি বন্ধ করা। ১৯২০ সালের বিদ্রোহ এসব গোষ্ঠীকে কাছাঁকাছি আনে এবং তা ইরাকে জাতিরাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১৯২১ সালের কায়রো সম্মেলনে ব্রিটিশরা ইরাকি রাজনীতির রূপরেখা ঠিক করে যা ১৯৫৮ সালের বিপ্লবের আগ পর্যন্ত বজায় ছিল। ব্রিটিশরা মক্কার সাবেক শরিফ হুসাইন বিন আলির ছেলে ফয়সাল বিন হুসাইনকে ইরাকের প্রথম বাদশাহ হিসেবে অধিষ্ঠিত করে এবং ইরাকি সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা করে তবে এসিরিয়ান সেনাদেরকে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে রেখে দেয়া হয়। ব্রিটিশরা একটি নতুন চুক্তি প্রস্তাব করে। ব্রিটিশরা ফয়সালকে জাতীয়তাবাদি হিসেবে দেখার পাশাপাশি তাকে ব্রিটিশদের উপর নির্ভরশীল হিসেবেও বিবেচনা করত। ফয়সালের বংশলতিকা রাসুল মুহাম্মদ (সা) এর সাথে সম্পর্কিত ছিল। তার পূর্বপুরুষরা ১০ম শতাব্দী থেকে পবিত্র শহর মক্কা ও মদিনা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ভোগ করে আসছিলেন। একারণে তিনি ঐতিহ্যবাহী আরব মানোত্তীর্ণ হবেন বলে ব্রিটিশরা বিশ্বাস করত। তাছাড়া আরব বিদ্রোহের সময় তুর্কিদের বিরুদ্ধে ফয়সালের অংশগ্রহণের কারণে তিনি ইরাকি জাতীয়তাবাদিদের কাছে গ্রহণীয় হবেন বলে ব্রিটিশরা মনে করত। অতীবৃদ্ধ হওয়ার কারণে বাগদাদের নকিবকে বাদ দেয়া হয় এবং ফয়সালকে ইরাকের বাদশাহ হিসেবে বসানো হয়। সবদিক থেকে ফয়সাল ছিলেন ব্রিটিশদের জন্য সবচেয়ে যোগ্য পছন্দ।
১৯২২ সালের ইঙ্গ-ইরাকি চুক্তি বিষয়েও কায়রো সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়। জাতীয়তাবাদি এবং নাজাফ ও কারবালার ব্রিটিশবিরোধী মুজতাহিদরা ইরাকে ব্রিটিশ প্রভাব কমানোর জন্য ও চুক্তির সময়সীমা হ্রাস করার জন্য ফয়সালের উপর চাপ প্রয়োগ করছিলেন। রাজতন্ত্র ব্রিটিশদের উপর নির্ভরশীল বুঝতে পেরে এবং তার সিরিয়ার অভিজ্ঞতা পুনরায় ঘটতে দিতে না চাওয়ার কারণে ফয়সাল ব্রিটেনের সাথে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেন। চুক্তি প্রথমে বিশ বছর মেয়াদের হলেও পরে তা চার বছরে কমিয়ে আনা হয়। ১৯২৪ সালের জুন থেকে তা কার্যকর হয়, এতে বলা হয় যে ব্রিটিশ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় ও অর্থনৈতিক বিষয়ে বাদশাহ ব্রিটিশ পরামর্শ শ্রবণ করবেন এবং ব্রিটিশ অফিসাররা আঠারোটি ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন পদে উপদেষ্টা ও পরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ পাবেন। অন্যদিকে একটি অর্থনৈতিক চুক্তি অনুযায়ী ইরাককে ব্রিটিশ অফিসারদের খরচের অর্ধেক বহন করতে হত। চুক্তির আওতায় ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সহায়তা দেয়ার কথা বলা হয় যেমন সামরিক সহায়তা এবং লীগ অব নেশনসে ইরাকের দ্রুত সদস্যপদ। ফলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে কার্যকরীভাবে ইরাক ব্রিটিশদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। চুক্তি প্রতিহত করতে না পারার ফলে ফয়সাল বুঝতে পারেন যে ব্রিটিশরা তাদের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছে।
১৯২২ সালের ১ অক্টোবর ব্রিটিশ বিমানবাহিনী রয়েল এয়ার ফোর্স ইরাক কমান্ড গঠন করে এবং ইরাকে সকল ব্রিটিশ বাহিনীর উপর তাকে নিয়ন্ত্রণভার দেয়া হয়।[২]
অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মত ইরাকেও সামরিক প্রতিষ্ঠান অন্যান্য দুর্বল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার চেয়ে বেশি সংগঠিত ছিল। একারণে রাজতান্ত্রিক যুগে ইরাকের রাজনীতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠলে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও নতুন সামরিক বাহিনীর অফিসাররা ছিলেন সুন্নি এবং তারা পূর্বে উসমানীয়দের অধীনে কাজ করেছেন এবং নিম্নপদস্থ অফিসাররা ছিলেন শিয়া গোত্রীয় সদস্যদের নিয়ে গঠিত। ফলে সেনাবাহিনীতে সুন্নি প্রাধান্য বজায় ছিল।
১৯৩০ সালে নতুন ইঙ্গ-ইরাকি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, বৈদেশিক নীতি বিষয়ক সকল ব্যাপারে পূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদানের কথা বলা হয় এবং যুদ্ধের সময় পারস্পরিক সহায়তার কথা বলা হয়। বসরা ও আল হাবানিয়াহর কাছের বিমানঘাটি ব্যবহারের জন্য ব্রিটেনকে অণুমতি দেয়া হয় এবং দেশব্যপী সেনা চলাচলের পথ খোলা রাখা হয়। পঁচিশ বছর মেয়াদি এই চুক্তি ইরাকের লীগ অব নেশনসের যোগ দেয়ার পর কার্যকর হওয়ার কথা ছিল।
ইঙ্গ-ইরাকি চুক্তি স্বাক্ষর ও মসুল প্রশ্নের সমাধান হওয়ার পর ইরাকের রাজনীতি নতুন দিকে মোড় নেয়। সুন্নি ও শিয়াদের গোত্রীয় জমিদার শেখরা ক্ষমতার জন্য শহুরে সুন্নি পরিবার এবং উসমানীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনা অফিসার ও আমলাদের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। ইরাকে নতুন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক অবস্থা বিদেশিদের তৈরী এবং পূর্বে ইরাকে গণতন্ত্রের ধারণা ছিল না বলে বাগদাদের রাজনীতিবিদরা ন্যায়সঙ্গত বিবেচিত হননি। একারণে সংবিধান ও নির্বাচিত গণপরিষদ থাকলেও রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ হন। ব্যাপক ভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অণুপস্থিতির ফলে প্রথমদিককার জাতীয়তাবাদি আন্দোলন ইরাকের বৈচিত্রময় সামাজিক কাঠামোয় সুবিধা করতে পারেনি।
১৯৩২ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে ইরাক পরিচালিত হয়।[৩]
১৯৩২ সালের ৩ অক্টোবর ইরাক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ইরাক হাশিমি রাজবংশ কর্তৃক শাসিত হয়।
উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের আগ পর্যন্ত ব্রিটিশরা টার্কিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানি (টিপিসি) নিয়ন্ত্রণ করত। ১৯১৬ সালের ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে স্বাক্ষরিত সাইকস-পিকট চুক্তির মাধ্যমে মসুল ফরাসিদের প্রভাবে আসে। ১৯১৯ সালে ফরাসিরা লং-বেরেঞ্জার চুক্তির আওতায় মসুল থেকে দাবি সরিয়ে নেয়। এই চুক্তি ক্ষতিপূরণ হিসেবে টার্কিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানির ২৫% শেয়ার ফরাসিদের দেয়া হয়।
১৯২৩ সালের শুরুতে ব্রিটিশ ও ইরাকিরা তেল নিয়ে আলোচনা শুরু করে। সবশেষে চুক্তি নিয়ে জাতীয়তাবাদিদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া থাকলে ইরাকি আলোচকরা চুক্তি মেনে নেয়। মসুলের ইস্যুতে লীগ অব নেশনসে শীঘ্রই ভোট হওয়ার কথা ছিল। ইরাকিদের আশঙ্কা ছিল যে ব্রিটিশ সমর্থন ছাড়া তুরস্কের কাছে মসুল হারাতে হবে। ১৯২৫ সালের মার্চে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যাতে ইরাকের কোনো দাবিকেই আমলে নেয়া হয়নি। এরপর টিপিসির নাম বদলে ইরাক পেট্রোলিয়াম কোম্পানি রাখা হয় এবং ৭৫ বছরের জন্য পূর্ণ তেল আহরণ মঞ্জুর করা হয়।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.