Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বোমাং সার্কেল (বা বোমাং চক্র; বর্মী: ဗိုလ်မင်းထောင်) বর্তমানে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি নিয়মতান্ত্রিক সার্কেলের অন্যতম। সম্পূর্ণ বান্দরবান জেলা এই সার্কেলের আওতাভুক্ত। বোমাং রাজপরিবারের সদস্যরা মারমা সম্প্রদায়ভুক্ত এবং তারা রাগ্রাইসা নামে পরিচিত।[1] বোমাং সার্কেলের অধিকাংশ বাসিন্দা ষোড়শ ও অষ্টাদশ শতকের মধ্যে ম্রাউক উ রাজ্য বা আরাকান (অধুনা মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য) থেকে বিতাড়িত হয়ে দক্ষিণে বসতি স্থাপন করে, যেখানে পালংসা (ဖလံသား) নামে পরিচিত অন্য মারমা প্রধান সার্কেলের বাসিন্দারা (মং সার্কেল) উত্তর-পশ্চিমে বসতি স্থাপন করে।[1] প্রায় ১৭৬৪ বর্গমাইল এলাকার বান্দরবানের ৯৫টি মৌজা (সকল মৌজা), রাঙামাটির রাজস্থলি ও কাপ্তাই উপজেলার ১৪টি মৌজা (মোট ১০৯টি) নিয়ে গঠিত বোমাং সার্কেল। চিটাগাং হিল ট্রাক্টস রেগুলেসন ১৯০০ বা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধিমালা, ১৯০০ হল সার্কেলত্রয়ের আইনি ভিত্তি।
বোমাং সার্কেল একজন বংশানুক্রমিক প্রধান বা সার্কেল চীফ বা গোত্রপতি দ্বারা শাসিত যিনি আনুষ্ঠানিকভাবে জনসাধারণ কর্তৃক "রাজা" নামে আখ্যায়িত হন। বোমাং রাজা মৌজার হেডম্যানদের এবং কারবারি বা গ্রাম প্রধানদের নিয়োগ করেন এবং তারা ঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে কি না তার তদারকি করেন। তিনিই সর্বেসর্বা অর্থাৎ যেকোনো সময় কোনোরকম অনিয়ম দেখলে কারবারিদের অপসারণ (পদত্যাগ) করতে পারেন। বোমাং সার্কেলে বর্তমানে ১০৯টি মৌজা রয়েছে।[2][3] বর্তমান বোমাং সার্কেল চীফ হলেন উ চ প্রু চৌধুরী (ချောဖြူ), যিনি পেশায় একজন কৃষি প্রকৌশলী।[4] বোমাং রাজা প্রতিবছর তিনদিন ব্যাপি উৎসব রাজপুণ্যাহয় নেতৃত্ব দান করেন, যেটা ১৮৭৫ সাল থেকে হয়ে আসছে।[5][6][7] তিনি পদাধিকার বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পরিষদ এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য।[8]
বোমাংরা নিজেদের টেগু সাম্রাজ্যের তাবিনসেওয়াথি ও ন্যানডা বায়েং বংশধর দাবি করে। প্রাচীনকালে শ্যামদেশ বা থাইল্যান্ড শ্বেতহস্তীর জন্য বিখ্যাত ছিল। আর এই শ্বেতহস্তী ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ রাজাদের কাছে অতি পবিত্র। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, তথাগত বুদ্ধ এক জন্মে শ্বেতহস্তীরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পেগুর তেলেইং রাজা ন্যানডা বায়েং (১৫৮১-১৫৯৯ খ্রি.) শ্যাম রাজ্য আক্রমণ করে রাজধানী আইয়োথিয়া ধ্বংস করেন এবং শ্যাম রাজ্যের শ্বেতহস্তী চারটি ও রাজকুমারীকে পেগুতে নিয়ে আসেন। রাজকুমারীকে পেগুরাজ বিয়ে করেন। আরাকানরাজ মিন রাজাগ্রী (১৫৯৩-১৬১২ খ্রি.) পেগুরাজের শ্বেতহস্তীর লোভে ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি মহাপিন্নাক্যকে পেগু অভিযানে প্রেরণ করেন। আরাকানি বাহিনী পেগুর পতন ঘটিয়ে শ্বেতহস্তী চারটি ও পেগুরাজকন্যা সিনডোনং, রাজপুত্র মং চ প্যাই ও কয়েক হাজার তেলেইং সৈন্য বন্দী করে আরাকানে নিয়ে আসেন। আরাকানরাজ পেগুরাজকন্যাকে বিয়ে করেন। আরাকান রাজা মিন রাজাগ্রীর মৃত্যুর পর তার পুত্র মিনখা মৌং (১৬১২-১৬২২ খ্রি.) আরাকানের রাজা হন। তার রাজত্বকালে পূর্ববঙ্গের (চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল) বেশ কিছু অঞ্চল আরাকানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন এই অঞ্চলের সমুদ্র ও নদী উপকূলবর্তী এলাকায় পর্তুগীজ দস্যুদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পায়।
আরাকানরাজ মিনখা মৌং ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে তার সৎমামা ভূতপূর্ব তেলেইং রাজপুত্র মং চ প্যাইকে আরাকান অধিকৃত চট্টগ্রামের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে পাঠান। তিনি তার অনুগত তেলেইং বাহিনীসহ চট্টগ্রাম আগমন করেন এবং অল্পদিনের মধ্যে এখানকার পর্তুগীজ দৌরাত্ম্য দমন করে আরাকানরাজের প্রশংসাভাজন হন। আরাকানরাজ তাকে ‘বোমাং’ (সেনাপতি বা সেনানায়ক) উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। মং চ প্যাই ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দ অবধি আরাকান অধিকৃত চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন। মং চ প্যাইয়ের মৃত্যুর পর তাদের অনুগত তেলেইং বাহিনীসহ তার চার উত্তরপুরুষ মং গ্রুই ১৬৩০ থেকে ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দ, হেরী প্রু ১৬৬৫ থেকে ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দ, হেরী ঞো ১৬৮৭ থেকে ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দ এবং কং হ্লা প্রু ১৭২৭ থেকে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ অবধি বংশপরম্পরায় আরাকান অধিকৃত চট্টগ্রামের শাসনকর্তার দায়িত্ব পালন করেন এবং চট্টগ্রামে বসবাস করেন।
ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে মোগল শাসনের অবসান হয়েছে, প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন। কোম্পানি প্রথমে ঠিকাদারদের দ্বারা কং হ্লা প্রুর মাধ্যমে তেলেইং এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামে বসবাসকারী পাহাড়ী জনগোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করত। তবে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা প্রথম বোমাং কং হ্লা প্রুর সাথে কর আদায় সংক্রান্ত ব্যাপারে সরাসরি যোগাযোগ করেন। এর মাধ্যমেই মূলত সার্কল চিফ হিসেবে ইংরেজদের কাছ থেকে বোমাংদের স্বীকৃতি মিলে। এর পর থেকে ইংরেজদের সাথে বোমাং পরিবারের যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামে সার্কেলসমূহ গঠিত হলে কং হ্লা প্রু পরিবারের খেতাবের স্মারক হিসেবেই গঠিত হয় বোমাং সার্কেল। বর্তমানে বোমাং রাজার বাড়ি বান্দরবান শহরে। বলা চলে বোমাং রাজার বাড়িকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে অরণ্যময় শহর বান্দরবান। তবে বোমাং রাজপরিবার বান্দরবান আসার আগে নানাস্থানে বিভিন্ন সময় অবস্থান করেছে। চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়ার অন্তর্গত বাজালিয়া গ্রামের শঙ্খ নদীর খায়েরুজ্জামান চৌধুরী চরে কিছুকাল অবস্থান করে বোমাং রাজপরিবার। এই এলাকাটি এখনও বান্দরবানের মারমাদের কাছে ‘ইংরা হংপ্রা’ অর্থাৎ ‘প্রাচীন বসতি এলাকা’ হিসেবে পরিচিত। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, কং হ্লা প্রু ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে আরাকান থেকে চট্টগ্রামে ফিরে আসার পর এই রাজপরিবার তাদের অনুগত তেলেইং জনগোষ্ঠীকে নিয়ে রামু, ঈদগাঁও, মাতামুহুরী নদীর তীর, এমনকি মহেশখালীতেও বসবাস করেছেন। [9][10]
ব্রিটিশ শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চাকমা সার্কেল, বোমাং সার্কেল ও মং সার্কেল নামে তিনটি সার্কেলে প্রশাসনিকভাবে বিভাজিত ছিল যেগুলো চাকমা ও মারমা সম্প্রদায় হতে আসা বংশানুক্রমিক সার্কেল প্রধান বা গোত্রপতিদের দ্বারা শাসিত হতো।[11][12] ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের রাজস্ব ও প্রশাসনিক দায়িত্বের বোঝা লাঘবের উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধিমালা, ১৯০০ অনুসারে অত্র অঞ্চলের ভূমি প্রশাসন, কর আদায় ও সামাজিক বিরোধ মীমাংসার দায়িত্ব সার্কেল চীফ বা গোত্রপতিদের উপর অর্পিত হয়েছে।[12][13] ১৯০১ সালে বোমাং সার্কেল ২,০৬৪ বর্গমাইল (৫,৩৫০ কিমি২) পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।[14] এই প্রশাসনিক কাঠামো ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বজায় ছিল, তার পর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে সার্কেলগুলোর বিশেষ মর্যাদা বিলুপ্ত করা হয় এবং স্থানীয় সরকারকে সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে নিয়ে আসা হয়।[15]
বোমাং সার্কেল চীফ ঐতিহ্য অনুসারে "রাজা" হিসেবেও পরিচিত হন। অন্যান্য রাজবংশে রাজপুত্রের রাজপদে অভিষিক্ত হওয়ার নীতি রয়েছে। কিন্তু বোমাং বংশে রাজপুত্র নন, রাজবংশের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য বোমাং রাজবংশের রাজপদের উত্তরাধিকারী হয়ে থাকেন। ষষ্ঠ বোমাং রাজা থেকে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য রাজপদের অধিকারী হওয়ার ঐতিহ্য প্রবর্তিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫৯ সালে ১৪তম বোমাং রাজা মং শৈ প্রু চৌধুরীর ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম হয়েছিল, তিনি অং শৈ প্রু চৌধুরীকে অতিক্রম করে রাজা হয়েছিলেন। শেষোক্ত ব্যক্তি ১৯৯৮ সালের ১৯ নভেম্বর তিনি ১৫ তম বোমাং রাজা অভিষিক্ত হন।[16]
১৮৭৫ সাল থেকে বোমাং সার্কেলের জুমচাষীদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে। সাধারণত প্রতি বছর ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে উৎসবটি হয়। নিজ নিজ এলাকায় সামাজিক বিচার-আচার এবং প্রথাগত বিভিন্ন বিষয়ে নেতৃত্ব দেন। তাছাড়া জুম চাষীদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের পর নিজেদের নির্ধারিত অংশ রেখে বাকিটা সরকারের রাজস্ব তহবিলে জমা দেন তাঁরা। এই খাজনা আদায়ের অনুষ্ঠানটির নামই রাজপুণ্যাহ। রাজপুণ্যাহে আদায় করা খাজনার শতকরা ৪২ রাজা, ৩৭ হেডম্যান এবং ২১ ভাগ সরকারি কোষাগারে জমা হয়ে থাকে।[17]
কালক্রমে রাঙামাটির চাকমা সার্কেল এবং খাগড়াছড়ির মং সার্কেলের রাজপুন্যাহ জৌলুস হারালেও বান্দরবানের বোমাং সার্কেলে এটি এখনো মহাধুমধামে পালিত হয়। রাজপুন্যাহ উপলক্ষে স্থানীয় রাজবাড়ি মাঠে লোকজ মেলার আয়োজন করা হয়। সেখানে যোগ দেন জেলার দূর-দূরান্ত থেকে আসা হাজার হাজার পাহাড়ি-বাঙালি নাগরিক।খাজনা আদায় উৎসবে দুর দুরান্ত থেকে আসা হেডম্যান, কারবারী এবং প্রজা সাধারন রাজারহাতে রাজস্ব প্রদানের পাশা পাশি ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় মদ, মোরগ, কবুতর, বিনি চাউল,দুধ,দইসহ বিভিন্ন উপঢোকন তোলে দেবেন। সাধারণত ৩দিন ব্যাপী রাজপুন্যাহকে কেন্দ্র করে রাজার মাঠসহ তার আশে পাশের এলাকায় মেলা বসে। মেলায় দোকান ও ষ্টলের পাশাপাশি যাত্রা গান,বিচিত্রা অনুষ্টান, সার্কাস,পুতুল নাচ,হাউজি খেলা ও মৃত্যুকুপসহ নানা খেলাধুলা ও অনুষ্টানের আয়োজন করা হয়েছে।
বর্তমানে এই উৎসব বান্দরবানের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও পর্যটনের অন্যতম ব্র্যান্ডিং এ পরিণত হয়েছে।এছাড়াও বোমাং রাজার ঐতিহ্যবাহী রাজপুণ্যাহ উৎসব দেখতে দেশী-বিদেশী পর্যটকসহ হাজার হাজার দর্শকের সমাগম ঘটে।[18]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.