Loading AI tools
আফগানিস্তানের একটি স্থান উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বামিয়ান উপত্যকার (পুস্তু/দারি: بامیان বা-মি-ইয়ান) অবস্থান আফগানিস্তানের একেবারে মধ্যভাগে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড়ে প্রায় ২৪০০ মিটার বা ৮০০০ ফিট উচ্চতায়।[2] ঐ একই নামে পরিচিত আফগান প্রদেশটিও এই উপত্যকার নামেই পরিচিত। বর্তমানে উপত্যকাটিতে মূলত হাজারা উপজাতির বাস। হাজারা উপজাতির বাসভূমি হজরজৎ'এর একেবারে কেন্দ্রস্থলে এর অবস্থান। বর্তমানে এই উপত্যকার অধিবাসীরা প্রায় সকলেই ইসলাম অনুরাগী হলেও ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, এই অঞ্চলে একসময় জরাথ্রুস্টবাদ ও বৌদ্ধধর্মের প্রবল প্রভাব ছিল। বিশেষ করে খ্রিস্টিয় তৃতীয় থেকে দশম শতক পর্যন্ত এই উপত্যকার পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য কৃত্রিম গুহা খনন করে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও ভিক্ষুরা এই উপত্যকায় বাস করতেন।[3] তাদের কেন্দ্র করেই এই সময়ে এই উপত্যকা ও তৎসন্নিহিত সমগ্র অঞ্চলেই বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। বৌদ্ধ সংস্কৃতির সাথে এই অঞ্চলে পারসিক ও খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দেআলেকজান্ডারের আক্রমণের পর থেকে গড়ে ওঠা গ্রিক সংস্কৃতি ও শিল্পরীতির সংমিশ্রণে এক নতুন ধরনের শিল্পরীতি গড়ে ওঠে[2][4], যা ইতিহাসে গান্ধার শিল্প নামে পরিচিত।[5] সমগ্র মধ্য এশিয়া ও উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় উপমহাদেশে এই শিল্পরীতি এই সময় প্রভূত প্রভাব বিস্তার করে। বামিয়ানে এই শিল্পরীতির অনুকরণেই পাহাড়ের গায়ে পাথর কুঁদে বিভিন্ন মুদ্রার অসংখ্য বুদ্ধমূর্তি খোদাই করা হয়। এদের মধ্যে খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে তৈরি দুটি বিশালাকার মূর্তি সবচেয়ে বিখ্যাত।[5] এগুলির দৌলতেই এই উপত্যকার ঐ অংশটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় স্থান পায়। কিন্তু আফগানিস্তানের তালিবান শাসকরা অ-ইসলামীয় বিবেচনায় ২০০১ সালের মার্চ মাসে ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো আফগান ইতিহাসের তথা বিশ্ব ঐতিহ্যের এই অনন্য নিদর্শন দুটিকে ধ্বংস করে।[2] বর্তমানে তালিবানরা সেদেশে ক্ষমতাচ্যূত হবার পর আন্তর্জাতিক উদ্যোগে এই মূর্তিদুটির পুনর্নির্মাণ, ঐতিহ্যবাহী সমগ্র পাথুরে দেওয়ালটি ও সাথে সাথে ঐ সমগ্র অঞ্চলটিরই ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলির সংরক্ষণের বিষয়ে সবিশেষ গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে।[6][7]
বামিয়ান بامیان | |
---|---|
আফগানিস্তানে অবস্থান | |
স্থানাঙ্ক: ৩৪°৪৯′ উত্তর ৬৭°৪৯′ পূর্ব | |
দেশ | Afghanistan |
প্রদেশ | বামিয়ান প্রদেশ |
উচ্চতা | ২,৫৫০ মিটার (৮,৩৭০ ফুট) |
জনসংখ্যা (২০১৩) | |
• মোট | ৮০,৯০০[1] |
সময় অঞ্চল | UTC+4:30 |
মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শনের প্রাচূর্যের কারণে এই অঞ্চলের পর্যটন শিল্প বিশেষভাবে বিকাশ লাভ করেছে। আফগানিস্তানে আগত ভ্রমণার্থীদের এক বড় অংশই তাই সাধারণভাবে এই উপত্যকা পর্যটন করে থাকেন।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড়ে প্রায় ২৪০০ মিটার উঁচু এই মনোরম সবুজ সমপ্রায় উপত্যকাটি আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে উত্তরপশ্চিম দিকে ২৩০ কিলোমিটার দূরে হিন্দুকুশ ও কো-ই-বাবা পর্বতশ্রেণির সংযোগস্থলে অবস্থিত। উত্তর ও দক্ষিণে তাই এই উপত্যকা হিন্দুকুশ ও কো-ই-বাবা পর্বতশ্রেণির প্রায় ১৫ হাজার ফিট উঁচু পর্বত দ্বারা ঘেরা। পূর্ব থেকে পশ্চিমে সামগ্রিকভাবে এর বিস্তৃতি ৪৮ কিলোমিটার বা ৩০ মাইল। কিন্তু প্রস্থে এর বিস্তৃতি উত্তর-দক্ষিণে সর্বোচ্চ ১৫ কিলোমিটার। কিন্তু এর নিচু সমপ্রায় অংশটি তুলনায় অনেক ছোট। এটি লম্বায় সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার ও চওড়ায় স্থানে স্থানে মাত্র ১-২ কিলোমিটার বিস্তৃত। সুন্দর এই উপত্যকাটির মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে একই নামের একটি নদী। উত্তর ও দক্ষিণ থেকে আরও কতগুলি ছোট ছোট নদী এসে এই নদীতে পড়েছে। এই উপত্যকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য হল প্রায় ১.৫ কিলোমিটার লম্বা একটি পাহাড়ের প্রায় খাড়া প্রাকৃতিক দেওয়াল। নদীটির উত্তর পাড়ে এর অবস্থান।[8][9] অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার, মঠ ও বৌদ্ধ শিল্পকর্মের প্রত্নতাত্ত্বিক অস্তিত্বর কারণে এই পর্বতগাত্রটি বর্তমানে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
ভূতাত্ত্বিক মতে আদতে মহাদেশীয় প্লেট বা টেকটনিক উত্থানের ফলে উচ্চভূমিরূপে বামিয়ান উপত্যকার সৃষ্টি। এর দক্ষিণে কো-ই-বাবা পর্বতশ্রেণির উচ্চতা ৫১৩৫ মিটার ও উত্তরে হিন্দুকুশের উচ্চতা ৪৪০০ মিটার। এই উপত্যকা বাস্তবে এই দুই পর্বতমালার মধ্যবর্তী সঙ্কীর্ণ কিন্তু লম্বা এক ভূখণ্ড বরাবর মহাদেশীয় চ্যূতির (হিরাট চ্যূতি) ফলে গড়ে ওঠা পরপর কতগুলি উপত্যকার মধ্যেই একটি। এর পূর্ব দিকের গুরবাঁদ উপত্যকা ও পশ্চিমের ইয়াকোলাং উপত্যকাও আসলে এই একই চ্যূতিরই বিস্তৃতির ফলে গড়ে উঠেছে।[9] পরবর্তীকালে তিনটি স্তরে পুরু পলি পড়ে এর আপাত সমতল ভূমিরূপ তৈরি হয়েছিল। এর মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরটি গঠিত হয়েছিল ইয়োসিন যুগে (আজ থেকে ৫ কোটি ৬০ লক্ষ - ৩ কোটি ৪০ লক্ষ বছর আগে) ক্ষয়জনিত কার্যের ফলে। মূলত চূনাপাথরে তৈরি এই স্তরটি গড়ে প্রায় ৫০ মিটার পুরু। আফগানিস্তানের উচ্চতর অঞ্চলগুলি হতে হিমবাহজনিত ক্ষয়ের ফলে এই স্তর গড়ে ওঠে। দ্বিতীয় স্তরটি মূলত বেলেপাথরের। এটি গড়ে প্রায় ১০০০ মিটার পুরু। অলিগোসিন যুগে (৩ কোটি ৪০ লক্ষ - ২ কোটি ৩০ লক্ষ বছর আগে) এই স্তরটি গঠিত হয়েছিল। আর সর্বোচ্চ স্তরটি নদীর ক্ষয়কার্যজনিত পলিসঞ্চয় ও আগ্নেয়গিরির লাভা সঞ্চিত হয়ে গড়ে ওঠে। এই স্তরটি মোটামুটি ৭০ মিটার পুরু। অর্থাৎ ভূতাত্ত্বিকদের মতে সুদীর্ঘকাল যাবৎ নদীর ক্ষয়কার্য, পলিসঞ্চয়, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ও হিমবাহজনিত ক্ষয় ও সঞ্চয়ের ফলে এইরূপ ভূমিরূপ সৃষ্টি হয়েছে।[9][10] এর নিচু আপাত সমতল অংশটি বহু বছরব্যাপী চারিদিকের উঁচু পাহাড় থেকে এই অঞ্চলের দীর্ঘ শীতকালে নেমে আসা বরফে মাসের পর মাস চাপা পড়ে থেকে এইরকম সমপ্রায় রূপ অর্জন করেছে।[9] কিন্তু এই আপাত সমতল ভূমিরূপ মাঝেমাঝেই হঠাৎ উঠে আসা খাড়া পর্বতের দেওয়াল দ্বারা বিচ্ছিন্ন।
মূল নিবন্ধ - বামিয়ান শহর
বামিয়ানের ঐতিহ্যবাহী পর্বতগাত্রটি থেকে একটু দূরেই ঐ একই নামের একটি ছোট শহর অবস্থিত। উপত্যকায় এটিই একমাত্র শহর। ছোট্ট এই শহরটিতে ১৯৭৯ সালেও লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ৭৩৫৫ জন। এত ছোট হওয়া সত্ত্বেও ১৯৬৪ সালে নতুন তৈরি জনবিরল প্রদেশটির প্রধান কেন্দ্র হিসেবে এই শহরটিকেই নির্বাচন করা হয়। এরপর থেকেই এই শহরটি প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে দ্রুত বেড়ে উঠতে শুরু করে। এছাড়া এই শহরেই উপত্যকার মূল বাজারটিও অবস্থিত। ব্যস্ত এই বাজারটিতে ১৯৭৯ সালে ৩০০-৪০০টি দোকান ছিল। তখন সপ্তাহে দু'দিন - সোমবার ও বৃহস্পতিবার, এই বাজার বসত। ঐ দু'দিন সারা উপত্যকা থেকে এখানে মানুষের সমাগম ঘটত।[11] শহরটি একটিমাত্র মূল রাস্তার দু'পাশে গড়ে ওঠে। তবে এই গড়ে ওঠার নির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনার কোনও ছাপ এর চেহারার মধ্যে পাওয়া যায় না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শহরটির নাগরিক পরিষেবা খুব উন্নত মানের নয়। বিদ্যুৎ, জ্বালানী গ্যাস ও জলের জোগান যথেষ্ট অনিয়মিত। যাতায়াতের সুবিধা বর্তমানে আগের চেয়ে অনেক উন্নত, তবে প্রয়োজনের তুলনায় এখনও তা যথেষ্টই কম ও অপ্রতুল। শহরের নিকটে একটি ছোট বিমানবন্দর আছে বটে, কিন্তু তার রানওয়ে বাঁধানো নয়। সেখানে অনিয়মিত কিছু বিমান ওঠানামা করে। ২০১৩ সালের হিসেবেও সমগ্র উপত্যকাটির জনসংখ্যা মাত্র ৮০,৯০০ জন।[1]
এই উপত্যকার মূল অধিবাসী হাজারা উপজাতির মানুষদের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হল এই শহর।
এই উপত্যকার ঐতিহাসিক সমৃদ্ধির মূল কারণ ছিল ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথ রেশম পথের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশে এর অবস্থান। কিন্তু সেই রেশম পথ ধরে বাণিজ্য আজ প্রায় সম্পূর্ণ স্তব্ধ। তারউপর ১৯৬৪ সালে সালং সুড়ঙ্গ পথের নির্মাণ সম্পূর্ণ হবার সাথে সাথে হিন্দুকুশ পর্বতের দুই পাশের মধ্যে বাণিজ্যও বামিয়ান উপত্যকা ছেড়ে সেই নতুন পথে প্রবাহিত হওয়ায়[11] বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে বামিয়ান উপত্যকা আজ তার কয়েক হাজার বছরের গুরুত্ব প্রায় সম্পূর্ণ হারিয়েছে। পাশাপাশি বিগত কয়েক দশক ধরে ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহর ফলে গোটা দেশের সাথে এই অঞ্চলের অর্থনীতিও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আজ তাই এলাকার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর।
এই অঞ্চলের জমি অনুর্বর, বৃষ্টিপাত কম, সেচের ব্যবস্থাও নিতান্তই অপ্রতুল। ফলে খুব ভালো কৃষি এই অঞ্চলে হওয়া সম্ভব না। তবে গম ও যব হল এই উপত্যকার মূল কৃষিজ ফসল। এছাড়া ডিম, আলু, শুকনো দই ও পপলার কাঠ এই অঞ্চল থেকে কাবুলের বাজারে কিছু পরিমাণে রপ্তানী করা হয়।[11] কিন্তু দারিদ্র সাধারণভাবে এই অঞ্চলের মানুষের নিত্য সঙ্গী। চরম আবহাওয়ার কারণে যখন ফসলের ফলন যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়, গরীব অধিবাসীদের প্রায়শই পোষ্য প্রাণী ও অন্যান্য জিনিস বেচে খাবার সংগ্রহের তাগিদে নিচে গজনি ও ময়দান প্রদেশে নেমে আসতে হয়।
তবে এখানে পর্যটন শিল্পের বিকাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও দীর্ঘদিনের সমৃদ্ধ ইতিহাসের নানা নিদর্শন এখানের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ। ২০০১ সালে তালিবানদের হাতে ধ্বংস হওয়া প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো বুদ্ধমূর্তিদুটির খালি কুলুঙ্গি, অসংখ্য কৃত্রিম গুহা ও বৌদ্ধ মঠের ধ্বংসাবশেষসহ পাহাড়ের অতি বিখ্যাত প্রাকৃতিক দেওয়ালটি ছাড়াও এই অঞ্চলে আরও অনেক আকর্ষণীয় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। উদাহরণস্বরূপ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ১২২১ সালে চেঙ্গিজ খানের হাতে ধ্বংস হওয়া মধ্যযুগের শহর শহর-ই-ঘলঘোলার ('দীর্ঘশ্বাসের শহর') ধ্বংসাবশেষ বা ১৯৯০'এর দশকে খুঁজে পাওয়া প্রাচীন ব্যাকট্রিয় গ্রিক শৈলীতে তৈরি অ্যাক্রোপলিসটির ধ্বংসাবশেষের কথা।[12] ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ পার্শ্ববর্তী আরও দুটি উপত্যকা ফোলাদি উপত্যকা ও কাকরাক উপত্যকাও এই উপত্যকার সাথে সরাসরি যুক্ত। এই কারণেই হয়তো বর্তমানে আফগানিস্তানে আগত পর্যটকদের এক বড় অংশই বামিয়ানকে ছুঁয়ে যান।
এই উপত্যকা যে প্রদেশে অবস্থিত, মধ্য আফগানিস্তানের সেই বামিয়ান প্রদেশের নব্বই শতাংশ অংশই পার্বত্য অঞ্চল। এমনকী বামিয়ান উপত্যকাও চারিদিক থেকে, বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণে তুষারাচ্ছাদিত পর্বতশিখর দিয়ে ঘেরা। তাই এই উপত্যকার জলবায়ু মূলত চরমপন্থী। সুদীর্ঘ শীতকালে তীব্র শুকনো ঠাণ্ডা এই অঞ্চলের জলবায়ুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই সময়ে এই অঞ্চলে দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা -৩ থেকে -২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়। আবার গরমকালও যথেষ্ট উষ্ণ ও শুষ্ক। শীতকালে কখনও কখনও তুষারপাতও ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হয় নামমাত্র। মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে অপেক্ষাকৃত বেশি বৃষ্টিপাত হয়। নিচের সারণীতে এই অঞ্চলের বার্ষিক জলবায়ুর প্রকৃতি চিহ্নিত হয়েছে।
বামিয়ান-এর আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য | |||||||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
মাস | জানু | ফেব্রু | মার্চ | এপ্রিল | মে | জুন | জুলাই | আগস্ট | সেপ্টে | অক্টো | নভে | ডিসে | বছর |
সর্বোচ্চ রেকর্ড °সে (°ফা) | ১২.০ (৫৩.৬) |
১২.৫ (৫৪.৫) |
২০.৬ (৬৯.১) |
২৮.৭ (৮৩.৭) |
২৯.৪ (৮৪.৯) |
৩১.২ (৮৮.২) |
৩৩.২ (৯১.৮) |
৩২.২ (৯০.০) |
৩১.৪ (৮৮.৫) |
২৬.২ (৭৯.২) |
২০.৬ (৬৯.১) |
১৩.০ (৫৫.৪) |
৩৩.২ (৯১.৮) |
সর্বোচ্চ গড় °সে (°ফা) | ১.০ (৩৩.৮) |
২.০ (৩৫.৬) |
৭.৯ (৪৬.২) |
১৫.৬ (৬০.১) |
১৯.৯ (৬৭.৮) |
২৪.১ (৭৫.৪) |
২৬.৩ (৭৯.৩) |
২৬.১ (৭৯.০) |
২২.৯ (৭৩.২) |
১৭.৪ (৬৩.৩) |
১১.০ (৫১.৮) |
৫.১ (৪১.২) |
১৪.৯ (৫৮.৯) |
দৈনিক গড় °সে (°ফা) | −৬.৪ (২০.৫) |
−৪.৮ (২৩.৪) |
১.৪ (৩৪.৫) |
৮.৬ (৪৭.৫) |
১২.৪ (৫৪.৩) |
১৬.৩ (৬১.৩) |
১৮.৪ (৬৫.১) |
১৭.৪ (৬৩.৩) |
১২.৮ (৫৫.০) |
৭.৮ (৪৬.০) |
১.৬ (৩৪.৯) |
−২.৮ (২৭.০) |
৬.৯ (৪৪.৪) |
সর্বনিম্ন গড় °সে (°ফা) | −১০.১ (১৩.৮) |
−৬.১ (২১.০) |
−৩.৮ (২৫.২) |
২.৯ (৩৭.২) |
৫.৭ (৪২.৩) |
৮.৫ (৪৭.৩) |
১০.০ (৫০.০) |
৮.৮ (৪৭.৮) |
৪.২ (৩৯.৬) |
০.০ (৩২.০) |
−৪.৯ (২৩.২) |
−৮.৬ (১৬.৫) |
০.৫ (৩৩.০) |
সর্বনিম্ন রেকর্ড °সে (°ফা) | −৩০.৫ (−২২.৯) |
−২৮.৪ (−১৯.১) |
−২১.২ (−৬.২) |
−৬.৫ (২০.৩) |
−২.৫ (২৭.৫) |
০.৬ (৩৩.১) |
৫.৪ (৪১.৭) |
৩.০ (৩৭.৪) |
−২.৬ (২৭.৩) |
−৭.৯ (১৭.৮) |
−১৪.৫ (৫.৯) |
−২৫ (−১৩) |
−৩০.৫ (−২২.৯) |
অধঃক্ষেপণের গড় মিমি (ইঞ্চি) | ৮.৩ (০.৩৩) |
১৫.৭ (০.৬২) |
২৭.৪ (১.০৮) |
২৯.৮ (১.১৭) |
২৬.০ (১.০২) |
৫.৭ (০.২২) |
১.০ (০.০৪) |
০.০ (০.০) |
৩.১ (০.১২) |
৪.২ (০.১৭) |
৭.৫ (০.৩০) |
৪.৩ (০.১৭) |
১৩৩ (৫.২৪) |
বৃষ্টিবহুল দিনগুলির গড় | ০ | ০ | ২ | ৭ | ৬ | ১ | ১ | ০ | ০ | ২ | ২ | ০ | ২১ |
তুষারময় দিনগুলির গড় | ৫ | ৭ | ৬ | ২ | ০ | ০ | ০ | ০ | ০ | ০ | ১ | ৩ | ২৪ |
আপেক্ষিক আদ্রতার গড় (%) | ৪৩ | ৫৪ | ৫২ | ৫২ | ৫২ | ৪৬ | ৪৫ | ৪৫ | ৪৩ | ৪৪ | ৪৮ | ৫২ | ৪৮ |
মাসিক সূর্যালোক ঘণ্টার গড় | ১৯৬.৭ | ১৭৪.৬ | ২১০.৭ | ২৩৯.৪ | — | ৩৫৬.৯ | ৩৭২.৯ | ৩৫৭.৮ | ৩২৫.৩ | ২৭৬.৭ | ২৪৫.৫ | ১৯৮.০ | — |
উৎস ১: Hong Kong Observatory[13] | |||||||||||||
উৎস ২: NOAA (1960-1983)[14] |
চীন, ভারতীয় উপমহাদেশ, প্রভৃতি প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যের রোম সাম্রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত প্রধান বাণিজ্যপথ রেশম পথের উপর অবস্থানের কারণে প্রাচীন যুগে বামিয়ান উপত্যকার অবস্থান ও কৌশলগত গুরুত্ব ছিল যথেষ্টই বেশি। তবে কখনোই এই উপত্যকা খুব ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ছিল না। মূলত পূর্ব থেকে পশ্চিমে বা তার উলটো পথে যাতায়াতের সময় বাণিজ্য ক্যারাভানগুলি এখানে সাধারণত বিশ্রামের উদ্দেশ্যে একদিনের বিরতি ঘটাত। এই বাণিজ্যপথের উপর নিয়ন্ত্রণ ও শুল্ক আদায়ের থেকেই এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি গড়ে ওঠে। তাছাড়া সে'সময় এই উপত্যকা কয়েক শতাব্দী ধরে বৌদ্ধ ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র হিসেবেও প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিল। পরবর্তীকালে ইসলামের আবির্ভাবের পরও এই উপত্যকা তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি প্রাথমিকভাবে ধরে রাখে ও কৌশলগত অবস্থান হিসেবেও তার গুরুত্ব বজায় থাকে। কিন্তু ১২২১ খ্রিষ্টাব্দে চেঙ্গিজ খানের আক্রমণে এই উপত্যকা এমনভাবে সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় যে বেশ কিছু দশক সময় লাগে সেখানে আবার নতুন করে জনবসতি গড়ে উঠতে।
যতদূর আমরা ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানতে পারি, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে বামিয়ান উপত্যকাসহ এই সমগ্র অঞ্চলটি পারস্যের হাখমানেশি সম্রাট প্রথম দারিয়ুসের শাসনাধীন ছিল। হাখমানেশি সাম্রাজ্যের দ্বাদশতম প্রদেশের দক্ষিণ সীমান্তে ছিল এই উপত্যকার অবস্থান।[15] ৩২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যতদূর সম্ভব আলেকজান্ডারও হিন্দুকুশ পার হয়ে তার অভিযানের সময় বামিয়ান উপত্যকায় এসেছিলেন বলে আন্দাজ করা হয়। তবে এ' সম্বন্ধে কোনও প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না।[15] পরবর্তীকালে ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ এই অঞ্চল হিন্দুকুশের দক্ষিণের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই মৌর্যদের হাতে হস্তান্তরিত হয়। খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে এই অঞ্চলে কুষাণ সাম্রাজ্য সাম্রাজ্য গড়ে উঠলে, তাদের হাত ধরেই বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে বামিয়ান উপত্যকার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। প্রথমে বাণিজ্যকেন্দ্র ও বাণিজ্যপথ মধ্যবর্তী আশ্রয় ও বিশ্রামস্থল ও পরে বৌদ্ধ ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতিচর্চাকেন্দ্র হিসেবে বামিয়ানের এই গুরুত্ব পরবর্তী সাসানিদ ও শ্বেতহূণদের রাজত্বকালেও বজায় থাকে ও বৃদ্ধি পায়।
পালি ও সংস্কৃত গ্রন্থে প্রাপ্ত বৌদ্ধ উপকথা অনুযায়ী বুদ্ধদেবের জীবনকালেই (৪৮০(!)- ৪০০ (!) খ্রিস্টপূর্বাব্দ)[16] বর্তমান আফগানিস্তানে বৌদ্ধধর্মের প্রচার শুরু হয়। বুদ্ধদেবের প্রথমদিকের দুই গৃহী শিষ্য তপস্সু ও ভল্লিক ছিলেন নাকি এই অঞ্চলের থেকেই আসা বণিক। এই দুই বণিক নাকি বুদ্ধকে পূজার জন্য বুদ্ধের চুল ও নখ সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাদের নিজ শহর অসিতঞ্চন নগরে সেই চুল ও নখ ধাতুকে পবিত্র জ্ঞানে সংরক্ষণ করে চৈত্য নির্মাণ করেছিলেন।[3] যাইহোক, যা নিশ্চিতরূপে জানা যায়, মৌর্য সম্রাট অশোকের আমলে (রাজত্বকাল ২৬৯/২৬৮-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) অনুষ্ঠিত তৃতীয় বৌদ্ধসঙ্গীতি বা বৌদ্ধ মহাসভার পর ২৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মহারতি থেরকে এই অঞ্চলে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়। তার হাত ধরেই এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার শুরু হয়। এর মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই হিন্দুকুশের উত্তরে ব্যাকট্রিয় গ্রিক রাজারা নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই অঞ্চলও ফলে তাদের হাতে চলে যায়। [17] কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার চলতেই থাকে। কুষাণ আমলে (খ্রিস্টিয় প্রথম-তৃতীয় শতক) এর গতি বৃদ্ধি পায় ও সমগ্র অঞ্চলেই বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব পরিলক্ষিত হতে শুরু করে। দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত রেশম পথের দুই ধারে হিন্দুকুশ পর্বতের উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিকেই বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য বৌদ্ধ স্তূপ, মঠ, চৈত্য ও ভিক্ষুসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়।[17] এগুলির মধ্যে বামিয়ান ছিল সর্বাপেক্ষা বড় ও গুরুত্বপূর্ণ।
তবে বামিয়ানে ঠিক কবে বৌদ্ধধর্মের প্রচার শুরু হয়, নির্দিষ্ট করে তা বলা সম্ভব নয়। তবে দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই যে এই উপত্যকায় বৌদ্ধ ধর্মচর্চার প্রভূত বিস্তার ঘটে সে বিষয়টি বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ও বিশ্লেষণ থেকে এখন অনেকটাই নিশ্চিত।[17][18] ধারণা করা হয় যে, রেশম পথ বরাবর ভ্রমণকালে সে' সময় বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু স্বার্থবাহ বা এখনকার ভাষায় ব্যবসায়ীদের সাথেই নিরাপত্তা ও পথের নানা সুবিধার খাতিরে যাতায়াত করতেন। তারা বর্ষাবাস (বৌদ্ধ ভিক্ষুদের তিনমাসের বর্ষাব্রত) পালনের জন্য প্রায়শই এখানে থেকে যেতেন। এইসব ভিক্ষুরা সার্থবাহদের কাছ থেকে ভ্রমণকালে চতুর্প্রত্যয়ের (অন্ন, বস্ত্র, শয়নাসন ও ওষুধ) আশ্রয় পেতেন। এইভাবেই ধীরে ধীরে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা, মূলত লোকত্তরবাদী ভিক্ষুরা এই উপত্যকাতে স্থায়ী আবাসস্থল গড়ে তুলতে শুরু করে।[3] চতুর্থ শতাব্দীর শেষ থেকে আমরা বিভিন্ন লিখিত গ্রন্থ ও লিপিতে 'বামিয়ান' নামটি প্রথম দেখতে পেতে শুরু করি।[17][19]
ইতোমধ্যেই বামিয়ান উপত্যকার দক্ষিণে কান্দাহার অঞ্চলে গ্রিক, পারসিক ও বৌদ্ধ শিল্পকলার সংমিশ্রণে নতুন ধরনের মিশ্র শিল্পরীতি, গান্ধার শিল্পের উদ্ধ্বব ঘটেছিল। গুপ্তযুগে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতেও এই শিল্পরীতি প্রভূত প্রভাব বিস্তার করে। বামিয়ানেও এই শিল্পরীতির যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এখানে রেশম পথ ধরে বাণিজ্যের মাধ্যমে আরও নানা অঞ্চলের প্রভাব এসে পড়ায় এই শিল্পরীতিও আরও বিকশিত হয়ে ওঠে। সেই হিসেবে বামিয়ানের শিল্প ও ভাস্কর্যকে গান্ধার শিল্পের প্রভাবাধীন হয়েও অনেকটাই সতন্ত্র বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন।[15]
উপত্যকার উত্তরপ্রান্তে অবস্থিত পাহাড়ের প্রাকৃতিক দেওয়ালটিতে পরস্পর থেকে প্রায় ৪০০০ ফিট দূরত্বে তালিবানদের হাতে অধুনা ধ্বংস হওয়া যে দুটি বেলেপাথরের দৈত্যাকার বুদ্ধমূর্তির জন্য এই উপত্যকার আজ এত খ্যাতি, সে দুটি তৈরি হয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে।[20] এই মূর্তিদুটিকে ঘিরে পাহাড়ের গায়ে রীতিমতো জালের মতো পরস্পর সংযুক্ত গুহা ও সুড়ঙ্গের অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া গেছে। এগুলির মধ্যে অনেকগুলি বসবাসের জন্য, আবার অনেকগুলি উপাসনার জন্য ব্যবহৃত হত। বামিয়ানের ঐ পাহাড়ের গায়ে খনন করা এইধরনের প্রায় ১০০০টি কৃত্রিম গুহা খুঁজে পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে অনেকগুলিরই দেওয়াল ও ছাদ রঙীন চিত্র (ফ্রেস্কো) বা পাথর খোদাই করা নানা ভাস্কর্য দ্বারা অলঙ্কৃত।[10] প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে আন্দাজ করা হয় এইসব গুহাগুলির বেশিরভাগই ৪৫০ থেকে ৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে খনন করা হয়েছিল।[21] প্রত্নতাত্ত্বিক পরীক্ষায় আরও প্রমাণিত হয়েছে, এইসব গুহাগাত্রে পাওয়া দেওয়ালচিত্রগুলির মধ্যে অন্তত কয়েকটি আঁকতে তেলরঙ বা রেজিনভিত্তিক রঙ ব্যবহার করা হয়েছিল। ৭ম শতাব্দীতে আঁকা এই ছবিগুলিই বর্তমানে তেলরঙে আঁকা প্রাচীনতম আবিস্কৃত ছবি।[22] অবশ্য মধ্যযুগীয় এক ঐতিহাসিক, যিনি সম্ভবত বামিয়ানে গিয়েছিলেন ও সেখানকার বিভিন্ন বিষয়ে সুন্দর নির্ভরযোগ্য নানা তথ্য আমাদের সরবরাহ করেছেন, তার বিবরণে পাওয়া যায় বামিয়ানে এইধরনের গুহার সংখ্যা প্রায় ১২০০০। অবশ্যই শুধুমাত্র বামিয়ান উপত্যকাকে হিসেবের মধ্যে ধরলে এই সংখ্যাটি খুবই বেশি, কিন্তু আশেপাশের ৫০ কিলোমিটার ব্যাসের একটি অঞ্চলকে এই হিসেবে নিলে দেখা যায় সংখ্যাটি মোটামুটি মিলে যায়।[10]
বিখ্যাত চৈনিক পণ্ডিত ও পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ (৬০২ খ্রিঃ - ৬৬৪ খ্রিঃ) ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে বামিয়ান উপত্যকায় আসেন ও এখানে প্রায় দিন পনেরো অতিবাহিত করেন।[8][23] তার বিবরণে আমরা এই উপত্যকার দৈত্যাকার বুদ্ধমূর্তিদুটির উল্লেখ যেমন পাই, এই উপত্যকার বৌদ্ধ মন্দির ও চৈত্যগুলির অবস্থান সম্পর্কেও একটা সুন্দর ধারণা সেখান থেকে আমরা পেয়ে থাকি। তার দেওয়া বিবরণ থেকে আমরা আরও জানতে পারি, বামিয়ানের বৌদ্ধমঠগুলিতে মূলত লোকত্তরবাদী বৌদ্ধ ধর্ম চর্চার সে' সময় বিশেষ প্রাধান্য ছিল।[23] প্রায় একশ বছর বাদে কোরিয় সন্ন্যাসী হায়েচোও বামিয়ানকে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে উল্লেখ করেন। যদিও তার বিবরণে আমরা এই উপত্যকার উত্তরে ও দক্ষিণে আরবী সেনাবাহিনীর উপস্থিতির কথাও জানতে পারি।[19]
হায়েচোর বিবরণে উপত্যকার উত্তরে ও দক্ষিণে আরবী সেনাবাহিনীর উপস্থিতির উল্লেখ থেকে দুটি সম্ভাবনা আন্দাজ করা যায়। হায়েচো যদিও তখনও বামিয়ানকে স্বাধীন বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু বাস্তবে হয়তো বামিয়ান তখনই ছিল মুসলমান শাসকদের অধীন একটি আপাত স্বাধীন কিন্তু করদ রাজ্য। অথবা, হায়েচোর বিবরণের কিছুদিনের মধ্যেই তার স্বাধীনতা চলে যায় ও বামিয়ানের রাজা আগ্রাসী মুসলমান বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। অধ্যাপক কোসাকু মায়েদা এই দ্বিতীয় সম্ভাবনার পক্ষেই মত প্রকাশ করেন। তার মতে দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুরের আমলেই (৭৫৪ - ৭৭৫ খ্রিঃ) এই ঘটনা ঘটেছিল।[24] তবে রাজনৈতিকভাবে ইসলামি রাজত্বের অধীনতা স্বীকার করে নিলেও বামিয়ানে ইসলামের প্রসার অন্তত প্রথম কয়েক শতক খুবই ধীর লয়ে ঘটেছিল। সেখানে বরং তখনও পর্যন্ত মূলত বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবই বজায় থাকে।[19] শেষপর্যন্ত খ্রিস্টিয় প্রথম সহস্রাব্দের একেবারে শেষদিকে গজনির সুলতান মামুদের আমলে (৯৯৭ - ১০৩০ খ্রিঃ) এই উপত্যকার পুরোপুরি ইসলামীকরণ সম্পূর্ণ হয়।[19][24] সে' সময় বামিয়ান শহরটি উপত্যকার উত্তর-পশ্চিমে বুদ্ধমূর্তি খোদাই করা বামিয়ানের পর্বতগাত্রর পাদদেশ থেকে বেশ কিছুটা দক্ষিণপূর্বে সরিয়ে আনা হয়।[19] উপত্যকায় এখনও দেখতে পাওয়া কটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ বস্তুত এই যুগের। ঘুরিদের রাজত্বকালে ১১৫৫ - ১২১২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬০ বছর বামিয়ান একটি বেশ বড় রাজ্যের রাজধানীতে পর্যবাসিত হয়। এই রাজ্যের উত্তরসীমা উত্তরে আমু দরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।[19]
১২২১ খ্রিষ্টাব্দে মোঙ্গল সম্রাট চেঙ্গিজ খান বামিয়ান আক্রমণ করলে এই উপত্যকায় ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দিনগুলি আমরা প্রত্যক্ষ করি।[25] খরেজম সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী ও সদ্য শাসক সুলতান জালাল উদ-দীন মিংবুরনুকে (রাজত্বকাল ১২২০-১২৩১ খ্রিঃ) ধাওয়া করে মোঙ্গল বাহিনী এই উপত্যকায় প্রবেশ করে।[26] কিন্তু এই উপত্যকায় অবরোধ চলাকালীন অবরুদ্ধ দুর্গ থেকে ছোঁড়া একটি তীরে চেঙ্গিজ খানের দ্বিতীয় পুত্র চাঘতাই খানের ছেলে, অর্থাৎ চেঙ্গিজ খানের নাতি মুতুকান'এর মৃত্যু ঘটলে প্রতিশোধস্পৃহায় চেঙ্গিজ খানের নির্দেশে সমগ্র উপত্যকা জুড়ে অভূতপূর্ব ধ্বংসলীলা চালানো হয়। বিজিত শহর ও উপত্যকায় যাতে একটিও মানুষ বেঁচে থাকতে না পারে, তা নিশ্চিত করা হয়। ধ্বংসের তাণ্ডব থেকে এমনকী আশেপাশের অঞ্চলগুলোও রেহাই পায়নি। সমগ্র উপত্যকাতে এমনভাবে ধ্বংসকাণ্ড ও নির্বিচার হত্যালীলা চালানো হয় যে, মৃতদের স্মরণে লোকের মুখে মুখে বামিয়ান শহরের নামই হয়ে যায় দীর্ঘশ্বাসের শহর (শহর-ই-ঘলঘোলা)।[25][26] বর্তমান বামিয়ান শহরের একেবারে পাশেই ত্রয়োদশ শতাব্দীর এই শহরের ধ্বংসাবশেষ আজও দেখতে পাওয়া যায়। শহর থেকে দশ মাইল দক্ষিণে একটি উঁচু স্থানে শহর-ই-জোহাক'এ উপত্যকা রক্ষার জন্য মূল দুর্গটি অবস্থিত ছিল। ১২২১ খ্রিষ্টাব্দের অবরোধের সময় এখানে প্রায় ৩০০০ লোক ছিল। এটিও সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। এই ভয়াবহ ধ্বংসলীলার পর বেশ কিছু দশক উপত্যকায় আর কোনও জনবসতি গড়ে ওঠেনি। এমনকী এই ঘটনার চল্লিশ বছর পর যখন ঐতিহাসিক জোভাইনি তার ইতিহাস লিখছেন, তখনও পর্যন্ত এই উপত্যকা ছিল জনশূন্য।[11] তবে চেঙ্গিজ খান এখানকার বৌদ্ধ নিদর্শনগুলির কোনও ক্ষতিসাধন করেননি।
এই উপত্যকায় বর্তমানে বসবাসকারী হাজারা জাতির উদ্ভব সম্পর্কে একটি প্রচলিত ধারণা হল, চেঙ্গিজ খান এই উপত্যকার তৎকালীন জনসংখ্যাকে সম্পূর্ণ হত্যা করার পর এই জনশূন্য উপত্যকাকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে একটি মোঙ্গল বাহিনীকে এই উপত্যকায় রেখে যান। এই মোঙ্গল সৈন্যরা ও তাদের দাসীরাই হল বর্তমান হাজারাদের পূর্বসুরী। তাদের 'হাজারা' নামটিও ধারণা করা হয় এসেছে পার্শী শব্দ 'ইয়েক হেজার' (এক হাজার) থেকে। মোঙ্গল সৈন্যদের একেকটি দলে ১০০০ সৈন্য থাকত বলেই হয়তো এই নাম।[27]
এতবড় আঘাতের পরেও বামিয়ানে আবার কয়েকদশক পরে বসতি স্থাপিত হয়। তৈমুর বংশীয়দের শাসনকালে (১৩৭০ - ১৫০৭ খ্রিঃ) আমরা জানতে পারি উপত্যকায় আবার একটি শহর গড়ে উঠেছে। বাবরনামাতেও একাধিকবার একটি সুন্দর স্থান ও জেলার প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে এই উপত্যকা ও শহরের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে ততদিনে প্রাচীন রেশম পথ ধরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমে আসায় বামিয়ান শহর ও উপত্যকার পক্ষে আগেকার সমৃদ্ধি ফিরে পাওয়া আর সম্ভব ছিল না। ফলে একটি ছোট আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবেই এরপর থেকে এই শহর অবস্থান করতে থাকে।[11]
সপ্তদশ শতকের মুঘল নথিতে, বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের সময় আমরা আবার বামিয়ানের উল্লেখ দেখতে পাই। সে' সময় ৫৫ মিটার উঁচু বড় বুদ্ধমূর্তিটিকে লক্ষ্য করে মুঘল গোলন্দাজরা কামান দাগা অভ্যেস করত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নাদির শাহের সেনারাও মূর্তিদুটিকে একইভাবে কামান দাগা অভ্যেসের চাঁদমারি হিসেবে ব্যবহার করত বলেও জানতে পারা যায়।[19][28] এর ফলে মূর্তিদুটির শিল্পসৌকর্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয় বলে পরবর্তীকালের পর্যটকদের বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি। পূর্বের শিল্পীত সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তাদের অনেকের কাছেই মূর্তিদুটি অনাকর্ষণীয় ও ছাঁদবিহীন বলে মনে হতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকের ইংরেজ পর্যটক ও লেখন রবার্ট বায়রনের বর্ণনা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৩৩ সালে তিনি তার দ্য রোড টু অক্সিয়ানা গ্রন্থে লিখেছেন -
“ | বামিয়ানে বেশি দিন থাকার কোনও দরকার নেই। এখানে শিল্প আকর্ষণীয় নয় ... একটারও [বুদ্ধমূর্তি] কোনও শৈল্পিক মূল্য নেই। | ” |
[28] ১৮২০'র দশক থেকে আধুনিক বিদেশি পর্যটকরা বামিয়ানে আসতে শুরু করেন। ১৮২৩ সালে আসেন মুরক্রফট, ১৮৩২'এ চার্লস ম্যাসন, আলেকজাণ্ডার বার্নস ও মোহনলাল, ১৮৩৩'এ আসেন উড। এঁদের চোখ দিয়েই এই উপত্যকা ও তার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলি আধুনিক পৃথিবীর কাছে একরকম পুনরাবিস্কৃত হয়। তাদের বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি, বামিয়ান তখন একটি দেওয়ালে ঘেরা ছোট্ট শহর (এমনকী মোহনলাল তাকে নেহাত গ্রাম বলে উল্লেখ করেছেন)। শহরের অধিকাংশ বাড়িই দোতলা কিন্তু নিচু। বিশাল বুদ্ধমূর্তিদুটি খোদাই করা পাহাড়টির ঠিক গোড়ায় এর অবস্থান। শহরের অধিবাসীদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ পাহাড়ের গায়ে কাটা গুহাগুলিতেই বাস করে। তবে উপরের দিকে কাটা প্রাচীন গুহাগুলিকে বসবাসের উদ্দেশ্যে তখনও পুনর্দখল করা হয়নি।[19][28]
বিংশ শতাব্দীতে বামিয়ান উপত্যকার বুদ্ধমুর্তিদুটি, অসংখ্য কৃত্রিম গুহা ও বৌদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্যোগে খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের কাজ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত এখানের নানা গুহাগুলিতে বিভিন্ন যাযাবর জাতির কয়েক হাজার মানুষের বাসস্থান গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তারা প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের কাজে কোনও বাধা দেয়নি, বরং নানাভাবে সাহায্য করেছে। ১৯২০ সালে ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক আলফ্রে ফুশারের উদ্যোগে এই প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান তার প্রকৃত অর্থে শুরু হয়। এরপরে আঁদ্রে গোদার, মঁসিয়ে ও মাদাম আক্যাঁ, জ্যঁ কার্ল প্রমুখ প্রত্নতাত্ত্বিকরা একটি ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান দলের হয়ে এখানে এসে যে কাজ করেন, তা সংকলিত আকারে ১৯২৮ ও ১৯৩৩ সালে ৪টি খণ্ডে প্রকাশিত হলে বামিয়ান উপত্যকার সম্বন্ধে বহু অজানা তথ্য আমাদের গোচরে আসে।[10] পরবর্তীকালেও আন্তর্জাতিক স্তরের বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ববিদ এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের কাজ চালান। তবে আফগানিস্তানে বারে বারে গৃহযুদ্ধের ফলে এই অনুসন্ধানের কাজে বারে বারে নানা বাধা আসে। এমনকী এর ফলে ১৯৭৯ থেকে শুরু করে দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর কোনও অনুসন্ধানই তেমন চালানো সম্ভব হয়নি।[23] গৃহযুদ্ধের সময় বামিয়ানের কৌশলগত অবস্থান সবসময়েই খুব গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বারে বারে সেখানে সংঘর্ষ বাধে ও উপত্যকাটির হাতবদল ঘটে। এমনকী শতাব্দীর শেষের দিকে তালিবানরাও এই গুহাগুলিকে তাদের অস্ত্রভাণ্ডার মজুত করার স্থান হিসেবে ব্যবহার করেছিল। ২০০১ সালের মার্চ মাসে তারা ধর্মের ধুয়ো তুলে শেষপর্যন্ত দেড় হাজার বছরের পুরনো ঐতিহাসিক বুদ্ধমূর্তিদুটিকে ডিনামাইট ফাটিয়ে ধ্বংস করে।[2]
এই উপত্যকার ভেঙে ফেলা বিশাল দুই বুদ্ধমূর্তি, অসংখ্য কৃত্রিম গুহা, গুহাচিত্র, মঠ, চৈত্য, দুর্গের ধ্বংসাবশেষ, প্রভৃতির কারণে ২০০৩ সালে ইউনেস্কো থেকে উপত্যকার ওই ঐতিহাসিক সমগ্র পর্বতগাত্রটি ও তার নিকটস্থ অঞ্চলটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে। ঐ তালিকার ২০৮ নম্বর স্থানে বামিয়ান বিপদগ্রস্ত ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে এই সংক্রান্ত লাল তালিকায় স্থান পেয়েছে।[29][30]
এখানে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষিত বলে যেসব ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলি হল[30] -
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.