Loading AI tools
এই নিবন্ধটি বামিয়ানের জোড়া বুদ্ধমূর্তি সম্পর্কিত। উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি (ফার্সি: بتهاى بامیان) ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তিগুলির মধ্যে অন্যতম। ২০০১ সালের মার্চ মাসে তালিবানদের হাতে ধ্বংস হবার আগে পর্যন্ত ষষ্ঠ শতাব্দীতে তৈরি[1] প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো এই ঐতিহাসিক মূর্তিদুটি মধ্য আফগানিস্তানের বামিয়ান উপত্যকায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫০০ মিটার বা ৮২০০ ফিট উচ্চতায় একটি পর্বতগাত্রে খোদাই করা অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল। বড় মূর্তিটির উচ্চতা ছিল ৫৫ মিটার আর ছোটটির উচ্চতা ছিল ৩৫ মিটার।[1][2] এছাড়াও ঐ অঞ্চলের পর্বতগাত্রে আরও অনেক অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট বুদ্ধমূর্তিও খোদাই দেখতে পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের মতে খ্রিস্টিয় ৩য় থেকে ১০ম শতক পর্যন্ত এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত যে বিশেষ ধরনের শিল্পকলা বিকাশ লাভ করেছিল, এগুলি সেই গান্ধার শিল্পেরই উৎকৃষ্ট নিদর্শন।[3] ইউনেস্কো এই মূর্তিগুলিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু তালিবান নেতা মোল্লা মুহম্মদ ওমরের নির্দেশে ২০০১ সালের মার্চ মাসে বড় মূর্তিদুটিকে পাহাড়ের গায়ে ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করা হয়। বর্তমানে জাপান, সুইৎজারল্যান্ড, প্রভৃতি বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক উদ্যোগে মূর্তিদুটিকে পুনরায় তৈরি ও পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।[1][4][5]
ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান | |
---|---|
মানদণ্ড | সাংস্কৃতিক: ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ, ৬ষ্ঠ |
সূত্র | ২০৮ |
তালিকাভুক্তকরণ | ২০০৩ (২৭তম সভা) |
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে ২৩০ কিলোমিটার বা ১৪০ মাইল উত্তরপূর্বে অবস্থিত জনবিরল বামিয়ান বর্তমানে ঐ একই নামে পরিচিত আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের একটি মাত্র। এটি দেশের কেন্দ্রভাগে অবস্থিত। হিন্দুকুশ পর্বতশ্রেণির একেবারে কাছে অবস্থিত বলে পার্বত্য ভূমিরূপ এই অঞ্চলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পর্বতে ঘেরা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮০০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত এই সবুজ প্রায় সমতল উপত্যকাটি[6] আদতে বহু আগে তিনটি স্তরে পুরু পলি পড়ে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এর আপাত সমতল ভূমিরূপ মাঝেমাঝেই হঠাৎ উঠে আসা খাড়া পর্বতের দেওয়াল দ্বারা বিচ্ছিন্ন। ভূতাত্ত্বিকদের মতে সুদীর্ঘকাল যাবৎ নদীর ক্ষয়কার্য, পলিসঞ্চয় ও হিমবাহজনিত ক্ষয় ও সঞ্চয়ের ফলে এইরূপ ভূমিরূপ সৃষ্টি হয়েছে।[7]
মূল বামিয়ান উপত্যকাটি এই সমপ্রায় উচ্চভূমির উত্তরদিকে মুখ করে অবস্থিত। পশ্চিম থেকে পূর্বে এর বিস্তৃতি প্রায় ৩০ মাইল বা ৪৮ কিলোমিটার। উত্তর ও দক্ষিণে এই উপত্যকা হিন্দুকুশ ও কো-ই-বাবা পর্বতশ্রেণির প্রায় ১৫ হাজার ফিট উঁচু পর্বত দ্বারা ঘেরা। কিন্তু পাশাপাশি আরও দুটি উপত্যকা ফোলাদি উপত্যকা ও কাকরাক উপত্যকার সাথে এই উপত্যকা সরাসরি যুক্ত। সুন্দর এই উপত্যকাটির মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে একই নামের একটি নদী। এই নদীর উত্তর পাড়েই দেখতে পাওয়া যায় বামিয়ান উপত্যকার সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য, প্রায় ১.৫ কিলোমিটার লম্বা একটি পর্বতের প্রায় খাড়া প্রাকৃতিক দেওয়াল।[6][7] অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার, মঠ ও বৌদ্ধ শিল্পকর্মের প্রত্নতাত্ত্বিক অস্তিত্বর কারণে এই পর্বতগাত্রটি বর্তমানে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
বর্তমানে এই অঞ্চলে মূলত হাজারা উপজাতির বাস। কিন্তু এই অঞ্চলের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। চীন থেকে রোমান সাম্রাজ্য, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় বিস্তৃত ঐতিহাসিক রেশম পথের একেবারে উপরে অবস্থিত হওয়ায় এই অঞ্চল বহু সংস্কৃতির মিলনস্থল ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। ফলে ইতিহাসের এক সুদীর্ঘ সময় ধরে এই অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে ব্যাকট্রিয় গ্রিক ও কুষাণ আমলে এবং তারপরেও প্রায় ১০০০ বছর ব্যাপী এই অঞ্চল বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চার একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।[8] রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক বিকাশ ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির একত্র মেলবন্ধন সবসময়েই শিল্পের বিকাশের পক্ষে অনুকূল। তারউপর এই অঞ্চলের সাথে বিখ্যাত রেশম পথের নৈকট্যর ফলে শিল্পের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের জোগানও ছিল যথেষ্ট। এই সব কিছু মিলিয়েই এই অঞ্চলে গ্রিক, পারসিক ও বৌদ্ধধর্ম প্রভাবিত ভারতীয় শিল্পকলার মিশ্রণে এক বিশেষ ধরনের শিল্পকলার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। ইতিহাসে এই শিল্পকলা গান্ধার শিল্প নামে বিখ্যাত। সমগ্র মধ্য এশিয়া ও উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় উপমহাদেশে এই শিল্পরীতি প্রভূত প্রভাব বিস্তার করে। বামিয়ানে এই শিল্পরীতির অনুকরণেই পাহাড়ের গায়ে পাথর কুঁদে বিভিন্ন মুদ্রার অসংখ্য বুদ্ধমূর্তি খোদাই করা হয়। এদের মধ্যে খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে তৈরি বিশালাকার মূর্তিদুটিও অন্যতম।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ, পঞ্চম ও চতুর্থ শতকে এই অঞ্চল হাখমানেশি সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের অভিযানে হাখমানেশি সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে এই অঞ্চলেও গ্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর সেনাপতি সেলুকাসের নেতৃত্বে এখানে ব্যাকট্রিয় গ্রিক শাসন শুরু হয়। কিন্তু হিন্দুকুশের দক্ষিণের এই অংশটি পরবর্তী কালে ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মগধের মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সাথে সেলুকাসের কন্যার বিবাহের যৌতুক হিসেবে মৌর্য সাম্রাজ্যের হাতে হস্তান্তরিত হয়। গ্রিক ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক স্ত্রাবোর (৬৪ খ্রিঃ পূঃ - ২৪ খ্রিস্টাব্দ) ভাষায় আলেকজাণ্ডার এই অঞ্চল আর্যদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে সেখানে নিজস্ব উপনিবেশ গড়ে তোলেন, কিন্তু সেলুকাস নিকাটর তা ৫০০ হাতির বিনিময়ে বিবাহের যৌতুক হিসেবে স্যান্ড্রোকোটাসকে (চন্দ্রগুপ্তকে) দান করে দেন।[9] মৌর্য শাসনকালেই এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির এই চর্চা পরবর্তী কুষাণ যুগে ও তারপরেও ভালোভাবেই জারি থাকে। বাস্তবিক, বিভিন্ন ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায় যে সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের প্রবেশের আগে পর্যন্ত এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
হিন্দুকুশ পর্বতের দক্ষিণে বর্তমান বামিয়ান অঞ্চলে আরও আগেই বৌদ্ধধর্মের প্রচার শুরু হলেও, মূলত কুষাণ আমলেই এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব লক্ষ্যণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শতকের মধ্যে এই অঞ্চলে একের পর এক বৌদ্ধ স্তূপ, মন্দির ও মঠ গড়ে ওঠে। এগুলিকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে এই অঞ্চল বৌদ্ধ ধর্ম, দর্শন ও শিল্প চর্চার একটি প্রাণবন্ত কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়। বামিয়ানের পর্বতগাত্রে ছোট ছোট গুহা খনন করে এই সময় থেকেই বহু বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও ভিক্ষু থাকতে শুরু করেন। এই সব ছোট ছোট গুহাগুলি তাঁরা প্রায়শই নানারকম ধর্মীয় মূর্তি খোদাই করে বা রঙিন দেওয়ালচিত্র (ফ্রেস্কো) অঙ্কন করে সুসজ্জিত করে তুলেছিলেন।
খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতক থেকেই বিভিন্ন চীনা গ্রন্থে বারবার বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন চর্চার একটি বড় কেন্দ্র হিসেবে বামিয়ানের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে এই উপত্যকা সেখানে কখনও ফান-ইয়ান, কখনও বা ফান-ইয়াং, আবার কখনও বা ফ্যাং-ইয়ান বা ফান-ইয়েন-না, প্রভৃতি কাছাকাছি, কিন্তু বিভিন্ন নামে উল্লিখিত হয়েছে।[10] উচ্চারণের সাদৃশ্য থেকেই বোঝা যায়, এগুলি সবই বামিয়ান নামটিরই চীনা অপভ্রংশ। এইসব লিপি বা গ্রন্থগুলি মূলত দুইরকমের। এর মধ্যে কতগুলি পশ্চিমী দেশগুলির সাথে যোগাযোগ সংক্রান্ত চীনা প্রশাসনিক দলিল আর অন্যগুলি বিভিন্ন চৈনিক পরিব্রাজকের বৃত্তান্ত।[10] স্বভাবতই এই দ্বিতীয় ধরনের গ্রন্থগুলিই এই উপত্যকা সম্বন্ধে সরাসরি অভিজ্ঞতার কারণে ঐতিহাসিক তথ্য সরবরাহের উৎস হিসেবে বেশি নির্ভরযোগ্য।
চৈনিক বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী ফা-হিয়েন (৩৩৭ খ্রিঃ - ৪২২ খ্রিঃ) ৪০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বামিয়ানে আসেন। সেইসময়ে এখানে রাজানুকুল্যে অনুষ্ঠিত একটি বৃহৎ বৌদ্ধ ধর্মসভার তিনি প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন। রাজার ব্যক্তিগত উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এই ধর্মসভায় হাজারেরও বেশি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী অংশ নিয়েছিলেন বলে তিনি জানিয়েছেন। বামিয়ানকে তিনি অত্যন্ত পবিত্র একটি বৌদ্ধ তীর্থস্থান বলেও উল্লেখ করেন। এখানে বুদ্ধদেবের একটি দাঁত স্মারক হিসেবে রক্ষিত আছে বলেও তাঁর বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি।[6][11]
বিখ্যাত চৈনিক বৌদ্ধ ভিক্ষু, পণ্ডিত, পর্যটক এবং অনুবাদক হিউয়েন সাঙ (৬০২ - ৬৬৪) ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল বামিয়ানে আসেন।[6][12] তিনি তাঁর বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনী দা তাং জিউ জিতে বামিয়ানকে বৌদ্ধ ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতি চর্চার একটি বিশাল কেন্দ্র হিসেবে বর্ণনা করেন। এখানকার অধিবাসীরা তাঁর বর্ণনায় অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। তিনি এখানে সে'সময় ২০টি বৌদ্ধ মঠে হাজারেরও বেশি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বাস করতেন বলে বর্ণনা করেছেন। বর্তমানে তালিবানদের হাতে ধ্বংস হওয়া মূর্তিদুটির উল্লেখও তাঁর বর্ণনায় পাওয়া যায়। রাজার প্রাসাদের উত্তরপূর্ব দিকে অবস্থিত পাথরে খোদাই করা (বড়) মূর্তিটির উচ্চতা তিনি ১৪০-১৫০ ফিট বলে উল্লেখ করেছেন। এটির বর্ণ তিনি স্বর্ণোজ্বল বলে জানান। ছোট মূর্তিটির উচ্চতা তাঁর মতে ছিল ১০০ ফিটের মতো। কিন্তু তিনি এটি পিতলে তৈরি বলে উল্লেখ করেছেন। উপত্যকার ৬০ মাইল দক্ষিণপূর্বে একটি মঠে রক্ষিত তিনটি মহামূল্যবান স্মারকের উল্লেখও তাঁর বিবরণে পাওয়া যায়, যার মধ্যে একটি ফা-হিয়েন উল্লিখিত বুদ্ধদেবের দাঁত। এছাড়াও তিনি একটি আরও বৃহৎ শায়িত মূর্তিরও উল্লেখ করেন, যেটির অস্তিত্ব এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।[12] পরবর্তীকালে কোরিয় সন্ন্যাসী হায়েচোর বিবরণেও (৭২৭ খ্রিঃ) ঐ তিনটি মহামূল্যবান স্মারকের উল্লেখ পাওয়া যায়।
খিস্টিয় সপ্তম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এই অঞ্চলে ইসলামের আগমণ ঘটলেও আরও অন্তত দু'শো বছর এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের ও সংস্কৃতির চর্চা বজায় ছিল। ৭২৭ খ্রিস্টাব্দে কোরিয় সন্নাসী হায়েচো উপত্যকার উত্তরে ও দক্ষিণে আরব সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও বামিয়ানকে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী বৌদ্ধ রাজ্য বলে উল্লেখ করেন।[6][10] যতদূর সম্ভব এই সময় মুসলিম শাসনের অধীনেই একটি করদ রাজ্য হিসেবে বামিয়ান তার আপাত স্বাধীনতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। নবম শতকে পারস্যের সাফারিদ রাজবংশের শাসনকালে এই অঞ্চল সম্পূর্ণভাবে মুসলমানদের অধিকারে চলে গেলে খ্রিস্টিয় দশম শতক নাগাদ এই অঞ্চলের সম্পূর্ণ ইসলামীকরণ ঘটে ও বৌদ্ধধর্মের প্রভাব অবলুপ্ত হয়।
১২২১ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিস খানের আবির্ভাবে বামিয়ান অঞ্চলে প্রচণ্ড ধ্বংসলীলা চালান,[13][14] কিন্তু চেঙ্গিস খান বুদ্ধমূর্তি দুটিকে রেহাই দেন। পরবর্তীকালে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব ভারী কামানের সাহায্যে মূর্তি দুটিকে ধ্বংসের চেষ্টা করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পারস্যের শাসক নাদের আফশার মূর্তিদুটিকে লক্ষ্য করে কামান দাগেন।[15] শিয়া ধর্মাবলম্বী হাজারা বিদ্রোহ দমনের সময় আফগান রাজা আব্দুর রহমান খান মূর্তির মুখমণ্ডল নষ্ট করে দেন।[16] ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দুরেঊ নামক এক ফরাসি এই মূর্তির আলোকচিত্র তোলেন।[17]
বামিয়ান উপত্যকা তালিবানদের দখলে আসার আগেই ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে আব্দুল ওয়াহেদ নামক ঐ অঞ্চলের একজন তালিবান কমাণ্ডার বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি দুটিকে ধ্বংসের ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই অঞ্চলের কর্তৃত্ব নেওয়ার পরেই, তিনি মূর্তিদুটির মাথায় ফুটো করে বিস্ফোরক ঢুকিয়ে দেন। কিন্তু মোল্লা মুহাম্মাদ ওমর এবং স্থানীয় প্রশাসকের হস্তক্ষেপে সেই সময় মূর্তিদুটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেলেও এই সময় মূর্তি দুটির মাথায় চাকা পোড়ানো হয়।[18] ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে মোল্লা মুহাম্মাদ ওমর মূর্তি দুটির রক্ষণাবেক্ষণের পক্ষে ফতোয়া জারি করেন। এই মূর্তিদুটি থেকে আফগানিস্তানে আগত আন্তর্জাতিক পর্যটকদের নিকট হতে আয়ের উৎসের সম্ভাবনা থাকায় তিনি মূর্তি দুটিকে ধ্বংস না করে রক্ষা করার কথা বলেন।[19] ২০০০ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে স্থানীয় তালিবান প্রশাসকেরা মূর্তিদুটির রক্ষণাবেক্ষণে জাতিসংঘের সহায়তা পার্থনা করেন।[18]
কিন্তু আফগানিস্তানের কট্টরপন্থী মৌলবীরা আফগান সমাজের অ-ইসলামী অংশগুলির বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেন। তালিবানরা শীঘ্রই শরিয়তের পরিপন্থী সমস্ত ধরনের চিত্র, সঙ্গীত, ক্রীড়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।[20] তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী কদরতুল্লা জামাল সংবাদময়াধ্যমকে জানান যে, সমগ্র আফগানিস্তানের চারশত জন মৌলবী মূর্তি দুটিকে ইসলামের পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেন। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে মোল্লা মুহাম্মাদ ওমরের আদেশে মূর্তিদুটিকে ধ্বংসের আদেশ দেওয়া হয়।[n 1]
এই সময় অর্গানাইজেশন অব দ্য ইসলামিক কনফারেন্স নামক ইসলামী দেশগুলির সংগঠনে আফগানিস্তানের তালিবান শাসনের স্বীকৃতিপ্রদানকারী তিন রাষ্ট্র পাকিস্তান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সহ চুয়ান্নটি সদস্য দেশের প্রতিনিধিরা একটি সভার আয়োজন করে মূর্তিগুলির ধ্বংসের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়।[22] সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এই ধ্বংসকার্য্যকে বর্বরোচিত বলে আখ্যা দেয়।[23] যদিও ভারত আফগানিস্তানের তালিবান শাসনকে স্বীকৃতি দিত না, তবুও ধ্বংসের জন্য চিহ্নিত সমস্ত ভাস্কর্য্য ও স্থাপত্যকে সমগ্র মানবজাতির স্বার্থে ভারতে স্থানান্তরের আর্জি জানায়, কিন্তু তালিবানরা সেই অনুরোধ ফিরিয়ে দেন।[24] পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি পারভেজ মুশাররফ এই ধ্বংসকার্য্য রোধ করার জন্য মইনুদ্দিন হায়দারকে কাবুল পাঠান।[25]:১২০ তালিবান মন্ত্রী আব্দুল সালাম জাঈফের বক্তব্য অনুযায়ী, ইউনেস্কো তালিবান সরকারকে ৩৬টি পত্রের মাধ্যমে এই ধ্বংসকার্য্যের বিরোধিতা করে। চীন, জাপান ও শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধিরা এই মূর্তিগুলির সংরক্ষণের ব্যাপারে সোয়াল করেন। এমনকি জাপানীরা অর্থপ্রদান করে হলেও মূর্তিগুলিকে জাপানে স্থানান্তরের আর্জি জানায়।[25]:১২৭ কিন্তু, সমস্ত অনুরোধকে উপেক্ষা করে তালিবানের ধর্মমন্ত্রক এই ধ্বংসকার্য্যকে ইসলামী আইনানুগ বলে শীলমোহর দেয়[26] এবং নীতি মন্ত্রী আব্দুল ওয়ালি ধ্বংসকার্য্যটির অন্তিম আদেশ দেন।[25]:১২৬
২০০১ খ্রিস্টাব্দের ২রা মার্চ থেকে পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ ধরে বেশ কয়েক ধাপে মূর্তিগুলিকে ডায়নাইটে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করা হয়।[27] প্রথম কয়েক দিন, বিমান-বিধ্ববংসী কামান দিয়ে তোপ দেগে মূর্তিগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। এতদসত্ত্বেও মূর্তিগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত না হওয়ায় তালিবান তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী কদরতুল্লা জামাল হতাশা ব্যক্ত করেন।[n 2] পরে, তালিবানরা মূর্তিগুলির নিচে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন লাগিয়ে দেয়। সর্বশেষে পাহাড়ের গা বেয়ে মূর্তিগুলির মধ্যে ফুটো করে বিস্ফোরক লাগিয়ে দেওয়া হয়।[29] এছাড়া রকেট দিয়েও মূর্তিগুলির মাথার অংশ নষ্ট করা হয়।[30]
২০০১ খ্রিস্টাব্দের ৬ই মার্চ দ্য টাইমস পত্রিকায় মোল্লা মুহাম্মাদ ওমরের বক্তব্য ছাপা হয়, যেখানে তিনি বলেন যে, মূর্তির ধ্বংস সাধন করায় মুসলমানদের গর্বিত হওয়া উচিত, কারণ এতে আল্লাহ খুশি হয়েছেন।[n 3] ১৩ই মার্চ আফগান বিদেশ মন্ত্রী জাপানের মাইনিচি শিমবুন সংবাদমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, যে এই ধ্বংসকার্য্য ইসলামী আইনানুগ ও সম্পূর্ণ ধর্মীয় বিষয় এবং এর সাথে আফগানিস্তানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধের জন্য আন্তর্জাতিক চাপের প্রতিসোধের কোন সম্পর্ক নেই। ১৯শে মার্চ দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যে, তালিবান ধর্মীয় নেতারা বহু মাস ধরে এই ধ্বংসের ব্যাপারে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন, যে বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি নিরাকার ঈশ্বরের পরিপন্থী বলেই ধওংস করে দেওয়া উচিত।[32] আফগান রাষ্ট্রদূত সাঈদ রহমতুল্লাহ হশেমির বক্তব্য অনুযায়ী, শিশুদের খাবার সরবরাহের জন্য অর্থ প্রদানের বদলে যখন বিদেশীরা মূর্তিগুলি সংস্কারের জন্য অর্থ ব্যয়ের প্রস্তাব দেন, তখন তালিবানরা এই মূর্তিদুটির ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেন।[33]
জার্মানির সংস্কৃতিবিদ মাইকেল ফলসার তালিবান দ্বারা বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তির ধ্বংসসাধন সারা পৃথিবীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার লড়াইয়ের বিরুদ্ধে আঘাত বলে বর্ণনা করেন।[34] ইউনেস্কোর ডিরেক্টর জেনারেল কোইচিরো মাতসূরা এই ধ্বংসকার্য্যকে সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপরাধ বলে বর্ণনা করেন।[n 4]
সাম্প্রতিক গবেষণায় এদের মধ্যে অন্তত ১২টি গুহাচিত্রকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে, যেগুলি আঁকতে তেলরঙ বা রেজিন ভিত্তিক কোনও রঙ ব্যবহৃত হয়েছিল।[36] ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে, একটি আন্তর্জাতিক গবেষক দল দেওয়ালচিত্রগুলির ভেতর থেকে প্রাপ্ত কিছু খড়কুটোর বিকি্রণমাত্রা বিশ্লেষণ করে চিত্রগুলিকে পঞ্চম থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যে চিত্রায়িত হয়েছে বলে মত দেন।[37] সেই হিসেবে এগুলিই পৃথিবীতে প্রথম তেলরঙে আঁকা ছবি। ইউরোপে এর আগে এই ধরনের ছবির যে প্রাচীনতম নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গেছে, বয়সের হিসেবে এগুলি তার থেকে অন্তত একশ বছরেরও বেশি পুরনো।[37][38][39][40] ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের কয়েকজন গবেষক এই চিত্রগুলিকে বিশ্লেষণ করে[41] চিত্রগুলিতে সিঁদুর, সাদা সীসা ও পোস্ত্র তেল, প্রাকৃতিক রেজিন ও ডিম দ্বারা নির্মিত আঠারো সন্ধান পান।[37][42]
খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতক নাগাদ এই অঞ্চলে অন্তত কয়েক হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও ভিক্ষু বসবাস করতেন বলে মনে করা হয়। যে পর্বতগাত্রে বড় বুদ্ধমূর্তিদুটি খোদাই করা হয়েছিল, সেই পর্বতগাত্রেই ঐ মূর্তিদুটিকে কেন্দ্র করে রীতিমতো জালের মতো পরস্পর সংযুক্ত গুহা ও সুড়ঙ্গের অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া গেছে। এইসব গুহাগুলির খননকার্য লক্ষ্য করলে নির্মাতাদের ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রাযুক্তিক ও শৈল্পিক দক্ষতায় রীতিমতো বিস্মিত হতে হয়। গুহাগুলি খনন করার সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন জ্যামিতিক আকার অনুসরণ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে গুহাগুলির মেঝের গঠনের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করি বহু গুহাই কোনোটি আয়তাকার, কোনোটি বর্গাকার, আবার কোনোটি ষড়ভূজাকৃতি। কিন্তু গুহাগুলির ছাদের গঠন কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছোট ছোট গম্বুজাকার, আবার অনেকক্ষেত্রেই ম্যাসিডোনীয় শিল্পরীতি অনুসরণ করে লণ্ঠণাকৃতি। এই দ্বিতীয় ধরনের গুহাগুলির ছাদ ধরে রাখার জন্য যে বিভিন্ন প্রকারের খোদাই করা পাথরের বরগা বা বীম ব্যবহৃত হয়েছে, তার বক্রতা ও কারুকার্য সত্যিই লক্ষ্যণীয়। অবশ্য কালের প্রভাবে এখন এগুলির অনেকগুলিই যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে আয়তাকার মেঝে ও গম্বুজাকৃতি ছাদযুক্ত বেশ কয়েকটি গুহা পাওয়া গিয়েছে, যেগুলিকে দেখে পোড়া ইঁটে তৈরি মন্দির বা চৈত্যের কথা মনে পড়ে।[7] জাপানি এক প্রত্নতাত্ত্বিক দল এই অঞ্চলে মোট ৯০০টিরও বেশি এইরকম গুহার অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। অর্থাৎ এই সময়ে এই অঞ্চলে বসবাসকারী সন্ন্যাসী ও ভিক্ষুর পরিমাণ ছিল নিশ্চিতভাবেই অন্তত কয়েক হাজার।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.