Loading AI tools
ভারতের একটি হিন্দু মন্দির উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বদ্রীনাথ মন্দির হল ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের বদ্রীনাথ শহরে অবস্থিত একটি হিন্দু মন্দির। এই মন্দিরের অপর নাম বদ্রীনারায়ণ মন্দির। এটি হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর মন্দির। বদ্রীনাথ শহর ও বদ্রীনারায়ণ মন্দির ‘চারধাম’ ও ‘ছোটো চারধাম’ নামে পরিচিত তীর্থগুলির অন্যতম। বদ্রীনাথ মন্দির ‘দিব্য দেশম’ নামে পরিচিত ১০৮টি বৈষ্ণব তীর্থেরও একটি। প্রতি বছর এপ্রিল মাসের শেষভাগ থেকে নভেম্বর মাসের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ছয় মাস এই মন্দিরটি খোলা থাকে। শীতকালে হিমালয় অঞ্চলের তীব্র প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য ওই সময় এই মন্দির বন্ধ রাখা হয়। উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় গাড়ওয়াল পার্বত্য অঞ্চলে অলকানন্দা নদীর তীরে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩,১৩৩ মি (১০,২৭৯ ফু) উচ্চতায় এই মন্দিরটি অবস্থিত। বদ্রীনাথ ভারতের জনপ্রিয় তীর্থগুলির একটি। এখানে ২০১২ সালে ১,০৬০,০০০ জন তীর্থযাত্রী তীর্থ করতে আসেন।
বদ্রীনাথ মন্দির | |
---|---|
ধর্ম | |
অন্তর্ভুক্তি | হিন্দুধর্ম |
জেলা | চামোলি জেলা |
অবস্থান | |
অবস্থান | বদ্রীনাথ |
রাজ্য | উত্তরাখণ্ড |
দেশ | ভারত |
স্থাপত্য | |
সৃষ্টিকারী | আদি শঙ্কর |
এই মন্দিরের প্রধান দেবতা বিষ্ণু ‘বদ্রীনারায়ণ’ নামে পূজিত হন। বদ্রীনারায়ণের ১ মি (৩.৩ ফু) উচ্চতার বিগ্রহটি কষ্টিপাথরে নির্মিত। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, এটি বিষ্ণুর আটটি ‘স্বয়ং ব্যক্ত ক্ষেত্র’ স্বয়ং-নির্মিত বিগ্রহের একটি।[1]
বদ্রীনাথ মন্দিরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসবটি হল ‘মাতা মূর্তি কা মেলা’। গঙ্গার পৃথিবীতে অবতরণকে স্মরণ করে এই উৎসব পালন করা হয়। বদ্রীনাথ মন্দিরটি উত্তর ভারতে অবস্থিত হলেও এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত বা ‘রাওয়াল’রা দক্ষিণ ভারতের কেরল রাজ্যের নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীর মধ্যে থেকে নির্বাচিত হন। মন্দিরটি উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সরকার আইন নং ৩০/১৯৪৮ (আইন নং ১৬,১৯৩৯)-এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এই আইনটি পরে শ্রীবদ্রীনাথ ও শ্রীকেদারনাথ মন্দির আইন নামে পরিচিত হয়। বদ্রীনাথ ও কেদারনাথ মন্দির কমিটির সদস্যরা রাজ্য সরকারের প্রশাসকদের দ্বারা মনোনীত হন। এই বোর্ডে সতেরো জন সদস্য আছেন।
প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বিষ্ণুপুরাণ ও স্কন্দপুরাণ-এ এই মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ-৯ম শতাব্দীতে আলোয়ার সন্তদের রচিত তামিল আনুশাসনিক ধর্মগ্রন্থ দিব্য প্রবন্ধ-তেও এই মন্দিরের ধর্মীয় মাহাত্ম্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
উত্তর ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের চামোলি জেলায় গাড়ওয়াল পার্বত্য অঞ্চলে অলকানন্দা নদীর তীরে বদ্রীনাথ মন্দিরটি অবস্থিত। এই পার্বত্য অঞ্চলটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩,১৩৩ মি (১০,২৭৯ ফু) উচ্চতায় অবস্থিত।[2][3] মন্দিরের উল্টোদিকে নর পর্বত অবস্থিত। অন্যদিকে নীলকণ্ঠ শৃঙ্গের পিছনে নারায়ণ পর্বত অবস্থিত।[4]
মন্দিরটি তিনটি পৃথক অংশে বিভক্ত: গর্ভগৃহ, দর্শন মণ্ডপ ও সভামণ্ডপ।[2][4][5] গর্ভগৃহের ছাদটি শঙ্কু-আকৃতিবিশিষ্ট। এটি প্রায় ১৫ মি (৪৯ ফু)। এর মাথায় সোনায় গিলটি করা ছাদযুক্ত একটি ছোটো গম্বুজ রয়েছে।[4][6] মন্দিরের সম্মুখভাগটি পাথরের তৈরি। এখানে খিলান-আকৃতির জানলা দেখা যায়। প্রধান প্রবেশপথটিও একটি সুউচ্চ খিলান-আকৃতির দরজা। একটি চওড়া সিঁড়ি বেয়ে এই দরজার কাছে পৌঁছাতে হয়। প্রধান প্রবেশদ্বার পার হলেই একটি বৃহদাকার ও স্তম্ভযুক্ত মণ্ডপে উপস্থিত হতে হয়। এটি পার হলেই মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে যাওয়া যায়। উক্ত মণ্ডপের স্তম্ভগুলি ও দেওয়ালগুলি সূক্ষ্ম কারুকার্যে চিত্রিত।[1]
গর্ভগৃহে বদ্রীনারায়ণের ১ মি (৩.৩ ফু) উচ্চতার শালিগ্রাম (কষ্টিপাথর) বিগ্রহটি একটি বদ্রী গাছের তলায় সোনার চাঁদোয়ার নিচে রাখা আছে। বদ্রীনারায়ণের মূর্তির উপরের দুই হাত উত্তোলিত অবস্থায় শঙ্খ (শাঁখ) ও চক্রধরে আছে এবং নিচের দুটি হাত যোগমুদ্রায় (পদ্মাসন) উপবিষ্ট মূর্তির কোলের উপর ন্যস্ত অবস্থায় রয়েছে।[2][5] গর্ভগৃহে বদ্রীনারায়ণ ছাড়াও সম্পদের দেবতা কুবের, দেবর্ষি নারদ, উদ্ধব, নর ও নারায়ণ ঋষির মূর্তি আছে। মন্দিরের চারপাশে পনেরোটি মূর্তি পূজা হয়। এর মধ্যে রয়েছে বিষ্ণুর পত্নী লক্ষ্মী, নারায়ণের বাহন গরুড় ও নবদুর্গার মূর্তি। এছাড়াও মন্দিরে লক্ষ্মীনৃসিংহ এবং আদি শঙ্কর (৭৮৮-৮২০ খ্রিষ্টাব্দ), বেদান্ত দেশিকা ও রামানুজের মন্দির আছে। মন্দিরের সকল মূর্তি কষ্টিপাথরে তৈরি।[1][2][4]
মন্দিরের ঠিক নিচে তপ্তকুণ্ড নামে একটি উষ্ণ গন্ধক প্রস্রবন রয়েছে। এটির ঔষধিগুণ আছে বলে মনে করা হয়। অনেক তীর্থযাত্রী মনে করেন, মন্দিরে যাওয়ার আগে এই কুণ্ডে স্নান করা আবশ্যক। এই প্রস্রবনের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ৫৫ °সে (১৩১ °ফা); অন্যদিকে প্রস্রবনের বাইরে এই অঞ্চলের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ১৭ °সে (৬৩ °ফা)-এর নিচে থাকে।[2] মন্দিরের দুটি পুকুরের নাম নারদ কুণ্ড ও সূর্যকুণ্ড।[7]
কোনো ঐতিহাসিক নথিতে বদ্রীনাথ মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে বৈদিক ধর্মগ্রন্থগুলিতে এই মন্দিরের প্রধান দেবতা বদ্রীনাথের উল্লেখ পাওয়া যায়। তার থেকে অনুমান করা হয় যে বৈদিক যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০-৫০০ অব্দ) এই মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল।[4] কয়েকটি উপাখ্যান অনুসারে, এই মন্দিরটি খ্রিস্টীয় ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত একটি বৌদ্ধ ধর্মক্ষেত্র ছিল। ৯ম শতাব্দীতে আদি শঙ্কর এটিকে একটি হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত করেন।[5][8] এই মন্দিরের স্থাপত্য বৌদ্ধ বিহারগুলির স্থাপত্যের অনুরূপ। মন্দিরের সুচিত্রিত প্রবেশদ্বারটিও বৌদ্ধ মন্দিরের একটি বৈশিষ্ট্য। তা দেখেই কেউ কেউ এই মত প্রকাশ করেছেন।[1] অন্য মতে, ৯ম শতাব্দীতে আদি শঙ্করই প্রথম বদ্রীনাথকে একটি তীর্থস্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, ৮১৪ থেকে ৮২০ সাল পর্যন্ত ছয় বছর তিনি এই অঞ্চলে বাস করেছিলেন। বছরে ছয় মাস তিনি বদ্রীনাথে ও বাকি ছয়মাস কেদারনাথে থাকতেন। হিন্দুরা আরও মনে করে যে, বদ্রীনাথের মূর্তিটি তিনিই অলকানন্দা নদী থেকে উদ্ধার করে তপ্তকুণ্ড উষ্ণ প্রস্রবণের কাছে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন।[6][9] প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে, পারমার রাজা কনক পালের সাহায্যে আদি শঙ্কর এই অঞ্চলের সকল বৌদ্ধদের বিতাড়িত করেছিলেন। রাজার বংশধরেরা বংশানুক্রমে এই মন্দিরের দেখাশোনা করতেন এবং মন্দিরের খরচ নির্বাহের জন্য কয়েকটি গ্রাম দান করেছিলেন। মন্দিরের পথের গ্রামগুলি থেকে যে আয় হত তা দিয়ে তীর্থযাত্রীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হত। পারমার শাসকদের ‘বোলন্দা বদ্রীনাথ’ (অর্থাৎ, ‘কথা-বলা বদ্রীনাথ’) উপাধি দেওয়া হয়েছিল। তাদের অন্যান্য উপাধি ছিল ‘শ্রী ১০৮ বাসদ্রীশ্চর্যাপরায়ণ গড়ার্জ মহীমহেন্দ্র’, ‘ধর্মবিভব’ ও ‘ধর্মরক্ষক শিগমণি’।[10]
বদ্রীনাথের সিংহাসনটি প্রধান দেবতার নামাঙ্কিত। ভক্তেরা মন্দিরে যাওয়ার আগে রাজার কাছে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতেন। ১৯শ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত এই প্রথা চালু ছিল।[10] ১৬শ শতাব্দীতে গাড়ওয়ালের রাজা বদ্রীনাথের মূর্তিটি বর্তমান মন্দিরে সরিয়ে আনেন।[6] গাড়ওয়াল রাজ্য দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেলে বদ্রীনাথ মন্দির ব্রিটিশদের অধীনে আসে। তবে গাড়ওয়ালের রাজা মন্দিরের ম্যানেজমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান রয়ে যান।[10]
প্রাচীন এই মন্দিরটিকে বহুবার মেরামত করতে হয়েছে। ১৭শ শতাব্দীতে গাড়ওয়ালের রাজারা মন্দিরটিকে প্রসারিত করেন। ১৮০৩ সালের হিমালয়ের ভূমিকম্পে মন্দিরটি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তারপর জয়পুরের রাজা এটিকে পুনর্নির্মাণ করেন।[1] ২০০৬ সালে রাজ্য সরকার বদ্রীনাথ-সংলগ্ন এলাকায় কোনো রকম নির্মাণকাজ আইনত নিষিদ্ধ করে দেয়।[11]
হিন্দু পুরাণ অনুসারে, এই স্থানে বিষ্ণু ধ্যানে বসেছিলেন। হিমালয়ের একটি অঞ্চলে মাংসভুক সন্ন্যাসী ও অসাধু লোকজন বাস করত। এই স্থানটি তার থেকে দূরে ছিল বলে বিষ্ণু ধ্যানের জন্য এই স্থানটিকে নির্বাচিত করেন। ধ্যানের সময় বিষ্ণু এখানকার দারুণ শীত সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তার স্ত্রী লক্ষ্মী একটি বদ্রী গাছের আকারে তাকে রক্ষা করেন। লক্ষ্মীর ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু এই অঞ্চলের নাম দেন বদরিকাশ্রম। আটকিনসনের মতে (১৯৭৯), এই অঞ্চলে এক সময় একটি বদ্রী গাছের জঙ্গল ছিল। কিন্তু সেই জঙ্গল আজ আর দেখা যায় না। এই মন্দিরের বদ্রীনাথ-রূপী বিষ্ণুর মূর্তিটি পদ্মাসনে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখা যায়। পুরাণ অনুসারে, এক ঋষি লক্ষ্মীকে বিষ্ণুর পাদসেবা করতে দেখেন। তাই দেখে তিনি বিষ্ণুকে তিরস্কার করেছিলেন। সেই জন্য বিষ্ণু বদ্রীনাথে এসে দীর্ঘ সময় পদ্মাসনে বসে তপস্যা করেছিলেন।[1][9]
বিষ্ণুপুরাণ-এ বদ্রীনাথের উৎপত্তি সম্পর্কে আরেকটি উপাখ্যান পাওয়া যায়। এই উপাখ্যান অনুসারে, ধর্মের দুই পুত্র ছিল – নর ও নারায়ণ। এঁরা হিমালয়ে পর্বতরূপ ধারণ করেছিলেন। তারা ধর্মপ্রচারে জন্য এই স্থানকে নির্বাচিত করেন এবং হিমালয়ের বিভিন্ন বৃহৎ উপত্যকাগুলিকে বিবাহ করেছিলেন। আশ্রম স্থাপনের জন্য উপযুক্ত জায়গার অনুসন্ধানে এসে তারা পঞ্চবদ্রীর অন্যান্য চার বদ্রীর সন্ধান পান। এগুলি হল: বৃধাবদ্রী, যোগবদ্রী, ধ্যানবদ্রী ও ভবিষবদ্রী। অবশেষে তারা অলকানন্দা নদী পেরিয়ে উষ্ণ ও শীতল প্রস্রবনের সন্ধান পান এবং এই স্থানটির নামকরণ করেন বদ্রীবিশাল।[9]
ভাগবত পুরাণ, স্কন্দপুরাণ ও মহাভারত-এর মতো প্রাচীন গ্রন্থে বদ্রীনাথ মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়।[7] ভাগবত পুরাণ অনুসারে, “বদরিকাশ্রমে শ্রীভগবান (বিষ্ণু) নর ও নারায়ণ ঋষি রূপে অবতার গ্রহণ করেছিলেন। সকল জীবের কল্যাণের জন্য তাঁরা এখানে স্মরণাতীত কাল থেকে তপস্যা করেন।”[12] স্কন্দপুরাণ-র বলা হয়েছে, “স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল লোকে অনেক পবিত্র তীর্থ আছে। কিন্তু বদ্রীনাথের মতো পবিত্র তীর্থ কোথাও নেই।” পদ্মপুরাণ-এ বদ্রীনাথের আশেপাশের এলাকাটিকে আধ্যাত্মিক সম্পদে পরিপূর্ণ বলা হয়েছে।[6] মহাভারত-এ বলা হয়েছে, অন্যান্য তীর্থে মোক্ষ অর্জন করতে হলে ধর্মানুষ্ঠানের আয়োজন করতে হয়। কিন্তু বদ্রীনাথের কাছে এলেই ভক্ত মোক্ষ লাভ করতে পারেন।[7] মালায়িরা দিব্য প্রবন্ধম-এর ১১শ স্তোত্রে (বৈষ্ণব কবি পেরিয়াজোয়ার রচিত) এবং ১৩শ স্তোত্রে (তিরুমঙ্গই আলোয়ার]] রচিত) এই মন্দিরের গুণকীর্তন করা হয়েছে। উক্ত স্তোত্রগুলিতে এই মন্দিরকে বিষ্ণুর ১০৮টি দিব্যদেশমের অন্যতম বলা হয়েছে; যেখানে বিষ্ণু বদ্রীনাথ নামে পূজিত হন।[13]
বছর | জন. |
---|---|
১৯৯০ | ৩,৬২,৭৫৭ |
১৯৯৫ | ২,৭৫,৯০০ |
২০০০ | ৭,৩৫,২০০ |
২০০৫ | ৫,৬৬,৫২৪ |
২০১০ | ৯,২১,৯৫০ |
২০১২ | ১০,৬০,০০০ |
সূত্র: |
হিন্দুদের সকল সম্প্রদায়ের তীর্থযাত্রীরা বদ্রীনাথ মন্দিরে তীর্থ করতে আসেন।[15][16] কাশী মঠ,[17] জীয়ার মঠ (অন্ধ্র মঠ),[18] উডিপি পেজাভার,[19] ও মন্ত্রালয়ম শ্রীরাঘবেন্দ্র স্বামী মঠ[20] প্রভৃতি সকল প্রধান সন্ন্যাসী সংগঠনের শাখা ও ধর্মশালা এখানে অবস্থিত।
পঞ্চবদ্রী নামে পরিচিত পাঁচটি বিষ্ণু মন্দিরের একটি হল বদ্রীনাথ মন্দির।[21] পঞ্চবদ্রী হল: বদ্রীনাথের বিশালবদ্রী; পাণ্ডুকেশ্বরের যোগধ্যান বদ্রী, সুবেনে জ্যোতির্মঠ থেকে ১৭ কিমি (১০.৬ মা) দূরে অবস্থিত ভবিষ্যবদ্রী, জ্যোতির্মঠ থেকে ৭ কিমি (৪.৩ মা) দূরে অনিমঠে বৃধবদ্রী ও কর্ণপ্রয়াগ থেকে ১৭ কিমি (১০.৬ মা) দূরে আদি বদ্রী। বদ্রীনাথ মন্দির হিন্দুদের পবিত্রতম চারটি তীর্থ ‘চারধাম’-এর অন্যতম। চারধাম তীর্থগুলি হল রামেশ্বরম, বদ্রীনাথ, পুরী ও দ্বারকা।[22] যদিও এই মন্দিরের আদি ইতিহাস স্পষ্ট জানা যায় না, তবু অদ্বৈতবাদীরা আদি শঙ্করকে চারধামের প্রতিষ্ঠাতা মনে করেন।[23] আদি শঙ্কর ভারতের চার প্রান্তে চারটি মঠ স্থাপন করার সময় যে চারটি মন্দিরকে মঠের নিকটবর্তী মন্দির হিসেবে নির্বাচিত করেন সেগুলি হল: উত্তরে বদ্রীনাথে বদ্রীনাথ মন্দির, পূর্বে পুরীতে জগন্নাথ মন্দির, পশ্চিমে দ্বারকায় দ্বারকাধীশ মন্দির ও দক্ষিণে শৃঙ্গেরীতে সারদাপীঠ মন্দির।[22][23]
সম্প্রদায়গতভাবে চারধাম মন্দিরগুলি শৈব ও বৈষ্ণবদের মধ্যে বিভক্ত হলেও, সকল সম্প্রদায়ের হিন্দুরা চারধাম মন্দিরগুলিতে তীর্থ করতে আসেন।[24] হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত বদ্রীনাথ, কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রীকে বলা হয় ‘ছোটো চারধাম’।[23][25] ২০শ শতাব্দীতে মূল চারধাম থেকে এই তীর্থগুলিকে আলাদা করার জন্য ‘ছোটো’ শব্দটি যুক্ত হয়। আধুনিক কালে এই তীর্থগুলিতে তীর্থযাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াও এগুলিকে ‘হিমালয়ের চারধাম’ নামেও চিহ্নিত করার প্রবণতা দেখা গিয়েছে।[26]
ভারতের চার প্রান্তে অবস্থিত চারধাম মন্দিরগুলিতে জীবনে অন্তত একবার তীর্থ করতে যাওয়া হিন্দুরা পবিত্র কর্তব্য মনে করেন।[27] প্রথাগতভাবে, এই তীর্থযাত্রা পূর্বদিকে পূরী থেকে শুরু হয় হয় এবং রামেশ্বর ও দ্বারকা হয়ে বদ্রীনাথে পৌঁছায়।[27]
বদ্রীনাথ মন্দিরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসবটি হল ‘মাতা মূর্তি কা মেলা’। গঙ্গার পৃথিবীর অবতরণকে উপলক্ষ করে এই উৎসব আয়োজিত হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, বদ্রীনাথের মা গঙ্গাকে পৃথিবীর জনসাধারণের কল্যাণের জন্য বারোটি শাখায় ভাগ করে দিয়েছিলেন। তারই সম্মানে এই উৎসব পালিত হয়। যে স্থানে এই নদী প্রবাহিত হয়েছিল, তাই পবিত্র বদ্রীনাথ ভূমি নামে পরিচিত হয়।[28]
জুন মাসে বদ্রীনাথ ও কেদারনাথ মন্দিরে বদ্রী কেদার উৎসব আয়োজিত হয়। আটদিন-ব্যাপী এই উৎসবে সাদা দেশের শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন।[28]
বদ্রীনাথ মন্দিরের নিত্যপূজার অঙ্গ প্রতিদিন সকালে মহাভিষেক, অভিষেক, গীতা পাঠ ও ভগবদ্পূজা। সান্ধ্যপূজার অঙ্গ গীতগোবিন্দ ও আরতি। অষ্টোত্তরম্ ও সহস্রনাম প্রভৃতি বৈদিক শাস্ত্র পাঠও সকল অনুষ্ঠানের অঙ্গ। আরতির পর বদ্রীনাথের মূর্তি থেকে সকল অলংকার সরিয়ে নিয়ে চন্দন লেপন করা হয়। পরদিন নির্মাল্য দর্শন অনুষ্ঠানের সময় সেই চন্দন ভক্তদের দেওয়া হয় প্রসাদ হিসেবে। সকল অনুষ্ঠানই ভক্তদের সামনে পালিত হয়। উল্লেখ্য, কোনো কোনো হিন্দু মন্দিরে এই প্রথা নেই। সেখানে কিছু কিছু অনুষ্ঠান লোকচক্ষুর অন্তরালে পালিত হয়।[4] সাধারণত মিষ্টি ও শুকনো পাতা ভক্তদের প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয়। ২০০৬ সালের মে মাস থেকে পঞ্চামৃত প্রসাদ দেওয়ার প্রথা চালু হয়েছে। এই প্রসাদ স্থানীয়ভাবে তৈরি হয় ও স্থানীয় বাঁশের ঝুড়িতে করে দেওয়া শুরু হয়।[29]
অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বিজয়াদশমীর পর শীতকালের জন্য মন্দির বন্ধ হয়ে যায়।[30] মন্দির বন্ধ হওয়ার দিন একটি ‘অখণ্ড জ্যোতি’ নামে একটি ঘৃতপ্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, যেটি ছয় মাস টানা জ্বলে।[31] সেই দিন ভক্ত ও মন্দিরের আধিকারিকদের সামনে প্রধান পুরোহিত বিশেষ পূজা করেন।[32] বদ্রীনাথের মূর্তিটিকে কাল্পনিকভাবে মন্দির থেকে ৪০ মা (৬৪ কিমি) দূরে জ্যোতির্মঠের নৃসিংহ মন্দিরে স্থানান্তরিত করা হয়।[33] এপ্রিল মাসে বসন্তপঞ্চমী তিথিতে মন্দিরটি আবার খুলে দেওয়া হয়।[30] তীর্থযাত্রীরা মন্দির খোলার দিন মন্দিরে উপস্থিত হন অখণ্ড জ্যোতি প্রদীপটিকে দেখার জন্য।[31]
হিন্দুরা যে সব মন্দিরে তাদের পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে পারলৌকিক ক্রিয়া সারেন, বদ্রীনাথ মন্দির সেগুলির অন্যতম।[34] ভক্তেরা গর্ভগৃহে বদ্রীনাথের মূর্তিটি পূজা করেন এবং অলকানন্দা নদীতে স্নান করেন। লোক বিশ্বাস অনুসারে, মন্দিরের পুকুরগুলিতে স্নান করলে পাপ দূর হয়।[35]
বদ্রীনাথ মন্দিরটি উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সরকার আইন নং ৩০/১৯৪৮ (আইন নং ১৬,১৯৩৯)-এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এই আইনটি পরে শ্রীবদ্রীনাথ ও শ্রীকেদারনাথ মন্দির আইন নামে পরিচিত হয়। রাজ্য সরকার উভয় মন্দির পরিচালনার জন্য একটি কমিটি নিয়োগ করে। ২০০২ সালে এই আইনটি সংশোধিত হয়। তখন এই কমিটিতে সরকারি আধিকারিক ও একজন উপপ্রধান সহ কিছু অতিরিক্ত সদস্য যুক্ত হন।[36] বোর্ডের সদস্য সংখ্যা ১৭: তিন জন উত্তরাখণ্ড বিধানসভা থেকে নির্বাচিত হন, গাড়ওয়া, তেহরি, চামোলি ও উত্তরকাশীর জেলা পরিষদ থেকে একজন করে সদস্য এবং রাজ্য সরকার মনোনীত দশ জন সদস্য এই বোর্ডে আছেন।[37]
মন্দিরের নথি অনুসারে, অধুনা কেরল অঞ্চলের নাম্বুদিরি সম্প্রদায়ভুক্ত শৈব দণ্ডী সন্ন্যাসীরা ছিলেন এই মন্দিরের পুরোহিত। ১৭৭৬ সালে সর্বশেষ সন্ন্যাসী নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে, রাজা কেরলের গৃহস্থ নাম্বুদিরিদের পুরোহিত হওয়ার জন্য আহ্বান করেন। সেই থেকে এই গৃহস্থ নাম্বুদিরিরাই বদ্রীনাথ মন্দিরের পূজারী।[33][38] ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত মন্দিরে ভক্তদের সমস্ত দান রাওয়াল অর্থাৎ প্রধান পুরোহিতের কাছে চলে যেত। কিন্তু ১৯৩৯ সালে রাওয়ালের অধিকার শুধুমাত্র ধর্মীয় ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়।[33] মন্দির প্রশাসনের কাজে নিযুক্ত মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক রাজ্য সরকারের সকল নির্দেশ পালন করেন। একন উপ মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক, দুজন ওএসডি, একজন কার্যনির্বাহী আধিকারিক, একজন কোষাধ্যক্ষ, একজন মন্দির আধিকারিক এবং একজন প্রচার আধিকারিক মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিককে সহায়তা করেন।[39]
বদ্রীনাথ মন্দিরটি উত্তর ভারতের অবস্থিত হলেও, এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত বা রাওয়ালরা সাধারণত দক্ষিণ ভারতের কেরল রাজ্যের নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীর মধ্যে থেকে নির্বাচিত হন। লোক বিশ্বাস অনুসারে, এই প্রথা চালু করেছিলেন দক্ষিণ ভারতীয় দার্শনিক আদি শঙ্কর। উত্তরাখণ্ড সরকার (উত্তরাখণ্ড রাজ্য সৃষ্টির আগে উত্তরপ্রদেশ সরকার) কেরল সরকারের কাছ থেকে রাওয়ালকে চেয়ে নেয়। প্রার্থীকে সংস্কৃত ভাষায় আচার্য, স্নাতক, মন্ত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞ ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত হতে হয়। গাড়ওয়ালের প্রাক্তন রাজা তথা বদ্রীনাথের নামসর্বস্ব শাসক কেরল সরকার কর্তৃক প্রেরিত প্রার্থীদের নির্বাচিত করেন। এরপর একটি তিলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাওয়াল নিযুক্ত হন এবং এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি মন্দিরে পূজার্চনা করেন। গাড়ওয়াল রাইফেলস এবং উত্তরাখণ্ড ও উত্তরপ্রদেশ সরকার কর্তৃক রাওয়াল ‘হাই হোলিনেস’ মর্যাদা পেয়ে থাকেন। নেপালের রাজারাও রাওয়ালকে বিশেষ সম্মান করেন। নভেম্বরের পর রাওয়াল যোশীমঠে থাকেন বা কেরলে তার নিজের গ্রামে ফিরে যান। প্রতিদিন ভোর চারটের সময় অভিষেক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাওয়াল পূজা শুরু করেন। বামন দ্বাদশী পর্যন্ত তিনি নদী পার হন না এবং ব্রহ্মচর্য পালন করেন। রাওয়ালকে সাহায্য করেন গাড়ওয়ালি ডিমরি পণ্ডিতরা (ডিমার গ্রামের বাসিন্দা), নায়েব রাওয়াল, ধর্মাধিকারি, বেদপাঠী (পুরোহিত গোষ্ঠী), পাণ্ডা সমাধিনী, ভাণ্ডারি, রাসোইয়া (পাচক), ভক্তিগীতি গায়ক, দেবাশ্রমের কেরানি, জল ভরিয়া (জলের রক্ষক) ও মন্দিরের প্রহরীরা। উত্তর ভারতের অল্প মন্দিরে প্রধানত দাক্ষিণাত্যে প্রচলিত শ্রৌত তন্ত্রবিধি পালন করা হয়। বদ্রীনাথ এই সব মন্দিরের অন্যতম।[34][40][41]
২০১২ সালে মন্দির কর্তৃপক্ষ দর্শনার্থীদের জন্য টোকেন ব্যবস্থা চালু করে। দর্শনের সময়-জ্ঞাপক এই টোকেনগুলি ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের তিনটি স্টল থেকে পাওয়া যায়। প্রত্যেক ভক্ত ১০-২০ সেকেন্ড বদ্রীনাথকে দর্শন করার জন্য সময় পান। পরিচয়ের প্রমাণ দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়।[42] হৃষিকেশ থেকে এই মন্দিরের দূরত্ব ২৯৮ কিমি (১৮৫ মা)। পথে দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ, নন্দপ্রয়াগ, যোশীমঠ, বিষ্ণুপ্রয়াগ ও দেবদর্শিণী হয়ে হৃষীকেশ থেকে বদ্রীনাথ আসতে হয়। কেদারনাথ থেকে ২৪৩ কিমি (১৫১ মা)* দীর্ঘ রুদ্রপ্রয়াগের পথ ধরে বা ২৩০ কিমি (১৪০ মা)* দীর্ঘ উক্তিনাথ ও গোপেশ্বরের পথ ধরে বদ্রীনাথ আসা যায়।[4]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.