Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
শিল্প, ইতিহাস, সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক গবেষণায় প্রাচ্যতত্ত্ব হলো প্রাচ্য বা পূর্ব বিশ্বের বিভিন্ন দিকের অনুকরণ বা চিত্রায়ন। এই কাজগুলো সাধারণত পশ্চিমা বিশ্বের নকশাকার, লেখক ও শিল্পীরা করে থাকেন। প্রাচ্যকেন্দ্রিক চিত্রকর্ম বিশেষত মধ্য প্রাচ্যকে কেন্দ্র করে অঙ্কিত চিত্রকর্ম উনিশ শতকের একাডেমিক শিল্পের অন্যতম বিশেষত্ব ছিলো। পশ্চিমা সাহিত্যেও প্রাচ্যকেন্দ্রিক বিষয়গুলিতে একই রকম আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়।
১৯৭৮ সালে এডওয়ার্ড সাঈদের ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বা ‘প্রাচ্যতত্ত্ব’ নামে বইটি প্রকাশের পর থেকে একাডেমিক বিষয় হিসেবে প্রাচ্যতত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা শুরু হয়। এর পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার সমাজগুলোর প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের নেতিবাচক মনোভাবকে বোঝাতে ‘প্রাচ্যতত্ত্ব’ শব্দটির বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। সাঈদের মতে, পশ্চিমা বিশ্ব এই সমাজগুলিকে স্থিতিশীল এবং অনুন্নত হিসাবে উপস্থাপন করার ফলে প্রাচ্য সংস্কৃতির প্রতি এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে যা সমীক্ষা ও চিত্রায়নের মাধ্যমে সাম্রাজ্য শক্তির সেবায় কাজে লাগানো যেতে পারে। সাঈদের মতে, কল্পিত এই তত্ত্বানুসারে পশ্চিমা সমাজকে একটা বিকশিত, যৌক্তিক, নমনীয় এবং উন্নত সমাজ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।[1]
প্রাচ্যতত্ত্ব বলতে প্রাচ্য অর্থাৎ পাশ্চাত্যের বিপরীত সাংস্কৃতিক জগতকে বোঝায়। ইংরেজি ওরিয়েন্ট শব্দটি ফরাসি ভাষা থেকে ইংরেজি ভাষায় প্রবেশ করেছে। ফরাসি ওরিয়েন্স মূল শব্দটি আবার ল্যাটিন ওরিয়েন্স শব্দটির সমার্থক যা বিশ্বের পূর্ব অংশকে ইঙ্গিত করে যেখানে সূর্যের উদয় হয়। পরিভাষাটি অবশ্য সময়ের পরিক্রমায় ভৌগোলিক পরিভাষা রূপেও ব্যবহৃত হচ্ছে। "প্রাচ্য" শব্দটি দ্বারা মূলত ভূমধ্যসাগর এবং দক্ষিণ ইউরোপের পূর্বের দেশগুলিকে বোঝায়। ভূতুড়ে নগরী(১৯৫২)নামের বইয়ে আনিউরিন বেভেন প্রসারিত অর্থে প্রাচ্য বলতে পূর্ব এশিয়াকেও বুঝিয়েছেন যা "পশ্চিমা প্রভাবের অধীনে প্রাচ্যের জাগরণকে" ইঙ্গিত করে। এডওয়ার্ড সাঈদের মতে, প্রাচ্যতত্ত্ব "কেবল ঔপনিবেশিক সময়ে নয়, বর্তমান সময়েও পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক আধিপত্য বিস্তারে সহায়তা করছে।"[2]
শিল্প ইতিহাসে প্রাচ্যতত্ত্ব শব্দটি দ্বারা পশ্চিমা শিল্পীদের শিল্পকর্মকে বোঝায় যারা উনিশ শতকে পশ্চিম এশিয়ায় ভ্রমণ করে প্রাচ্যকেন্দ্রিক বিষয়গুলোতে স্বল্প কিছু জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। সেই সময়টাতে এইসব শিল্পী এবং পণ্ডিতদের ‘প্রাচ্যবিদ’ হিসাবে বর্ণনা করা শুরু হয়। এই রীতি বিশেষভাবে চালু হয় ফ্রান্সে যেখানে বর্জনার্থে "প্রাচ্যবিদ" শব্দটির ব্যবহার শিল্প সমালোচক জুল-এন্টো কাস্টাগনারির হাত ধরে জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রতিনিধিত্বমূলক শিল্পশৈলীর ক্ষেত্রে এ জাতীয় সামাজিক অবজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ১৮৯৩ সালে ফ্রেঞ্চ সোসাইটি অব ওরিয়েন্টালিস্ট পেইন্টার্স প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জ্যান-লোন গুরমে এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।[3] ব্রিটেনে অবশ্য ‘প্রাচ্যবিদ’ শব্দটি দ্বারা একজন ‘শিল্পী’কেই বোঝানো হচ্ছিল।[4] ফরাসী ওরিয়েন্টালিস্ট পেইন্টারস সোসাইটি গঠনের ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে শিল্পচর্চাকারীদের চেতনায় একটা পরিবর্তন সূচিত হয়, যেহেতু শিল্পীরা এখন নিজেদের একটা পৃথক শিল্প আন্দোলনের অংশ হিসাবে দেখতে পাচ্ছিলেন। একটা শিল্প আন্দোলন হিসাবে প্রাচ্য চিত্রকলাকে সাধারণত ঊনিশ শতকের একাডেমিক শিল্পের অনেকগুলি শাখার একটা বলে বিবেচনা করা হয়; তবে প্রাচ্যকেন্দ্রিক শিল্পকর্মের বিভিন্ন শৈলীর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। শিল্প ইতিহাসবিদরা এমন দুটি বড় ধরনের প্রাচ্যশিল্পকে শনাক্ত করেন: এর মধ্যে আছেন বাস্তববাদীরা যারা তাদের পর্যবেক্ষণগুলি সাবধানতার সাথে চিত্রায়ন করেছেন এবং আরেক দল যারা স্টুডিওর বাইরে না গিয়েই প্রাচ্যের নানা দৃশ্যের কল্পনা চিত্রায়ন করেছেন।[5] ফরাসি চিত্রশিল্পীদের যেমন ইউগেন ডেলাক্রিক্স (১৭৯৮-১৮৬৩) এবং জ্যান-লিয়ন গারমেকে (১৮২৪-১৯৯৪) প্রাচ্যতাত্ত্বিক আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[6]
আঠারো এবং উনিশ শতকে প্রাচ্যবিদ বলতে এমন এক পণ্ডিতকে বোঝানো হতো যিনি পূর্ব বিশ্বের ভাষা ও সাহিত্য বিশেষভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন। এ ধরনের পণ্ডিতদের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্রিটিশ আধিকারিকরা ছিলেন যারা আরব বিশ্ব ও ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ইসলামী সংস্কৃতিকে ইউরোপের সংস্কৃতির সমান হিসাবে অধ্যয়ন করা উচিত বলে মত দিয়েছিলেন।[7] এমন মত দেওয়া পণ্ডিতদের মধ্যে ছিলেন ভাষাতাত্ত্বিক উইলিয়াম জোনস যার ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার উপর গবেষণা আধুনিক ভাষাতত্ত্বের জন্ম দিয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ১৮২০ সাল অবধি ভারতীয়দের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার কৌশল হিসাবে প্রাচ্যতত্ত্বের এই রূপটি সমর্থন করেছিলো, যখন থমাস ব্যাবিংটন ম্যাকুলের এবং জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো "ইংরেজরা" ইংরেজি মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার বিস্তারের দিকে মনোযোগ দেওয়া শুরু করে।[8] অধিকন্তু, ঊনিশ ও বিশ শতকে ব্রিটিশ এবং জার্মান পণ্ডিতদের মধ্যে ইহুদি ও ইহুদি ধর্মকেন্দ্রিক অধ্যয়ন জনপ্রিয়তা অর্জন করে।[9] একাডেমিক ক্ষেত্রে প্রাচ্যতাত্ত্বিক অধ্যয়ন যা নিকট ও দূর প্রাচ্যের সংস্কৃতিগুলিকে উপলব্ধি করেছিল পরবর্তীতে এশীয় গবেষণা এবং মধ্য প্রাচ্য অধ্যয়নের ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠেছে।
‘ওরিয়েন্টালিজম’ (১৯৭৮) নামক বইটিতে সংস্কৃতি সমালোচক এডওয়ার্ড সাঈদ পরিভাষাটিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তার মতে, প্রাচ্যতত্ত্ব হল প্রাচ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পশ্চিমা ঐতিহ্যের এমন এক কুসংস্কারযুক্ত একাডেমিক ও শৈল্পিক কিন্তু বহিরাগত-ব্যাখ্যা-যা আঠারো ও ঊনিশ শতকের ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ থেকে উদ্ভূত সাংস্কৃতিক মনোভাবের দ্বারা প্রভাবিত।[10] প্রাচ্যতত্ত্বের প্রতিপাদ্যটি আন্তোনিও গ্রামসির সাংস্কৃতিক আধিপত্যের তত্ত্ব এবং মিশেল ফুকোর জ্ঞান/শক্তি সম্পর্কের তত্ত্বায়নকে পশ্চিমা জ্ঞানবাদী ঐতিহ্যের সমালোচনা করার জন্য এগিয়ে নিয়ে যায়। সাঈদ সেইসব সমকালীন পণ্ডিতদের সমালোচনা করেছেন যারা আরব-ইসলামী সংস্কৃতিকে বোঝার জন্য বাইরের লোকের ব্যাখ্যাকে স্থিরীকৃত করে ফেলেছেন। এর মধ্যে বার্নার্ড লুইস এবং ফুয়াদ আজামির মতো পণ্ডিতের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[11][12]
তার বিশ্লেষণগুলি অবশ্য ইউরোপীয় সাহিত্যে বিশেষত ফরাসী সাহিত্যে প্রাচ্যতত্ত্ব সম্পর্কিত ধারনাগুলোর উপর আলোকপাত করে। দৃশ্যশিল্প কিংবা প্রাচ্যকেন্দ্রিক চিত্রকর্মগুলো তার সমালোচনার আওতাভুক্ত নয়। এই বিষয়ে শিল্প ইতিহাসবিদ লিন্ডা নোচলিন সাইদের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ পদ্ধতিগুলি "অসম ফলাফল সহ" প্রয়োগ করেছিলেন। ২০১০ সালে ইবনে ওয়ারাক জিন-লিয়ন গারুমের ‘সাপুড়ে’ চিত্রকর্মটি নিয়ে নোচলিনের সমালোচনাকে খণ্ডন করার এবং সাধারণভাবে প্রাচ্যকেন্দ্রিক চিত্রকর্মের সাফাই গেয়ে ‘লিন্ডা নোচলিন এবং কাল্পনিক প্রাচ্য’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন।
একাডেমিক জগতে ওরিয়েন্টালিজম (১৯৭৮) বইটি শীঘ্রই উত্তর-ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের ক্ষেত্রে একটা মূল পাঠ্য হিসেবে পরিগণিত হয়। তদুপরি, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নাগরিকত্ব ধারণাটির বিশ্লেষণে প্রাচ্যতত্ত্ব নাগরিকত্বের ধারণাটিকে জ্ঞানতত্ত্বের একটি সমস্যা হিসাবে উপস্থাপন করেছে। কারণ নাগরিকত্ব ধারণাটির উদ্ভব পশ্চিমা বিশ্বের একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে। এ কারণে নাগরিকত্বকে সংজ্ঞায়িত করার সমস্যাটি সঙ্কটকালীন ইউরোপের ধারণাটিকে নতুন রূপ প্রদান করে।[13]
এ ছাড়াও, সাঈদের মতে, প্রাচ্যতত্ত্ব, ‘প্রতিনিধিত্বের ধারণা হিসাবে একটি তাত্ত্বিক ধারণা: যা প্রাচ্যের এমন একটি পর্যায়কে ইঙ্গিত করে যেখানে পুরো প্রাচ্য একটা ধারণার জগতে সীমাবদ্ধ। এই ধারণাটি পশ্চিমাদের কাছে প্রাচ্যকে ‘কম ভীতিকর’ হিসেবে উপস্থাপন করতে সহায়তা করে বলে সাঈদ মত দিয়েছেন। পশ্চিমা বিশ্বের এ ধরনের চিন্তাভাবনাই উপনিবেশবাদের মূল কারণ বলে তিনি মনে করতেন। অধিকন্তু, ‘সাম্রাজ্য: সংক্ষিপ্ত পরিচিতি’ (২০০০), নামক বইয়ে স্টিফেন হো বলেছেন যে পশ্চিমা দেশগুলি এবং তাদের সাম্রাজ্য অনুন্নত দেশগুলির শোষণ এবং এক দেশ থেকে অন্য দেশে অবৈধভাবে সম্পদ ও শ্রম আহরণের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।[14] ইসলামী বিশ্বেও প্রাচ্যতত্ত্ব বিষয়ে এক ধরনের সমালোচনামূলক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অনুমান করা হয় যে ২০০২ সালে একমাত্র সৌদি আরবেই প্রাচ্যতত্ত্বের সমালোচনায় স্থানীয় বা বিদেশী পণ্ডিতদের দ্বারা প্রায় ২০০টি বই এবং ২০০০ এরও বেশি নিবন্ধ লেখা হয়।[15]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.