Loading AI tools
উত্তর আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলের একটি প্রাচীন সভ্যতা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
মিশরীয় সভ্যতা উত্তর আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলের একটি প্রাচীন সভ্যতা। নীল নদের নিম্নভূমি অঞ্চলে এই সভ্যতা গড়ে ওঠে। বর্তমানে অঞ্চলটি মিশর রাষ্ট্রের অধিগত। খ্রিষ্টপূর্ব ৩১৫০ অব্দ নাগাদ[1] প্রথম ফারাওয়ের অধীনে উচ্চ ও নিম্ন মিশরের রাজনৈতিক একীকরণের মাধ্যমে এই সভ্যতা এক সুসংহত রূপ লাভ করে। এরপর তিন সহস্রাব্দ কাল ধরে চলে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার বিকাশপর্ব।[2] প্রাচীন মিশরের ইতিহাস একাধিক স্থায়ী রাজ্য-এর ইতিহাসের একটি সুশৃঙ্খলিত ধারা। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার পর্ব দেখা দিয়েছিল। এই পর্বগুলি অন্তর্বর্তী পর্ব নামে পরিচিত। নতুন রাজ্যের সময়কাল এই সভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশপর্ব। এর পরই ধীরে ধীরে মিশরীয় সভ্যতার পতন আরম্ভ হয়। প্রাচীন মিশরের ইতিহাসের শেষ পর্বে একাধিক বৈদেশিক শক্তি মিশর অধিকার করে নেয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩১ অব্দে আদি রোমান সাম্রাজ্য মিশর অধিকার করে এই দেশকে একটি রোমান প্রদেশে পরিণত করলে ফারাওদের শাসন আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়।[3]
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার সাফল্যের আংশিক উৎস নিহিত রয়েছে নীল নদ উপত্যকার পরিস্থিতির সঙ্গে এই সভ্যতার মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার মধ্যে। সুপরিচিত বন্যা ও উর্বর উপত্যকার নিয়ন্ত্রিত সেচব্যবস্থার ফলস্রুতি ছিল উদ্বৃত্ত ফসল। যা থেকে এই অঞ্চলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। এই সম্পদের সাহায্যেই প্রশাসনের সহায়তায় উপত্যকা ও পার্শ্ববর্তী মরু অঞ্চলে খনিজ পদার্থের উত্তোলন শুরু হয়, একটি স্বাধীন লিখন পদ্ধতির আদি বিকাশ সম্ভব হয়, স্থাপনা ও কৃষিজ পণ্যের সুসংহত ব্যবহার শুরু হয়, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং সামরিক বাহিনী বহিঃশত্রুদের পরাজিত করে মিশরীয় প্রাধান্য স্থাপন করে। এই সকল কার্যে প্রেরণা জোগানো ও একে সুসংহতরূপে সাধন করা ছিল উচ্চবিত্ত লিপিকার, ধর্মনেতা ও ফারাওদের অধীনস্থ প্রশাসকবৃন্দের আমলাতন্ত্রের নিদর্শন। এঁরা সমগ্র মিশরের জনগণকে একটি বহুব্যাপী ধর্মবিশ্বাসের বন্ধনে আবদ্ধ করে তাদের সহযোগিতা ও একতাকে সুনিশ্চিত করেছিলেন।[4][5]
প্রাচীন মিশরীয়দের নানান কৃতিত্বগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য খনি থেকে অট্টালিকাদি নির্মাণের জন্য পাথর খনন, সমীক্ষণ ও নির্মাণ কৌশলের দক্ষতা। এরই ফলস্রুতি ঐতিহাসিক মিশরীয় পিরামিডসমূহ, মন্দির, ওবেলিস্কসমূহ, মিশরীয় গণিত ব্যবস্থা, একটি ব্যবহারিক ও কার্যকরী চিকিৎসা ব্যবস্থা, সেচব্যবস্থা ও কৃষি উৎপাদন কৌশল, প্রথম জাহাজ নির্মাণ,[6] মিশরীয় চীনামাটি ও কাঁচশিল্পবিদ্যা, একটি নতুন ধারার সাহিত্য এবং বিশ্বের ইতিহাসের প্রাচীনতম শান্তিচুক্তি ( হিট্টাইটদের সাথে)।[7] প্রাচীন মিশর এক দীর্ঘস্থায়ী উত্তরাধিকারকে পিছনে ফেলে যায়। প্রাচীন মিশরের শিল্পকলা ও সাহিত্যের ব্যাপক অনুকৃতি লক্ষিত হয়। বিশ্বের দূরতম প্রান্তে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এর পুরাকীর্তিগুলি। শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রাচীন মিশরের পুরাকীর্তিগুলির ধ্বংসাবশেষ পর্যটক ও লেখকদের কল্পনাশক্তিকে অনুপ্রাণীত করেছে। আধুনিক যুগের প্রথম ভাগে পুরাকীর্তি ও খননকার্যের প্রতি নতুন করে মানুষের আগ্রহ জেগে উঠলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মিশরের সভ্যতা সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু হয়। এর ফলে মিশরীয় সভ্যতার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারগুলি মিশর ও বিশ্ববাসীর সম্মুখে নতুন রূপে উপস্থাপিত হয়।[8]
সুপ্রাচীনকাল থেকেই নীল নদ মিশরের জীবনযাত্রায় মূল ভূমিকা পালন করছে।[9] নীল নদের উর্বর প্লাবন সমভূমি এই অঞ্চলের অধিবাসীদের স্থায়ী কৃষি অর্থনীতি ও একটি জটিল ও কেন্দ্রীভূত সমাজ গঠনে সাহায্য করে যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি মাইলফলক রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।[10] আধুনিক শিকারি-সংগ্রাহক মানুষেরা মধ্য প্লেইস্টোসিন যুগের শেষ ভাগে অর্থাৎ বারো লক্ষ বছর আগে এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিল। পরবর্তী প্যালিওলিথিক যুগ থেকেই উত্তর আফ্রিকার শুষ্ক জলবায়ু আরও উষ্ণ ও শুষ্ক হতে শুরু করে। এর ফলে এই অঞ্চলের মানুষেরা নীল নদ উপত্যকায় ঘন জনবসতি গড়ে তুলতে বাধ্য হয়।
প্রাকসম্রাজ্য এবং আদি সম্রাজ্যের কালে মিশরের জলবায়ু বর্তমানের চেয়ে কম শুষ্ক ছিল। মিশরের বড় অংশ ছিল সাভানা এবং এসকল এলাকায় ক্ষুরযুক্ত পশুপালের বিচরণ ছিল। উদ্ভিদ এবং প্রাণীতে নীল অঞ্চল সমৃদ্ধ ছিল এবং বিপুল পরিমাণ জলজ পাখিও এখানে পাওয়া যেত। এই পরিবেশে শিকারী প্রাণীদের জীবনযাপন ছিল সাধারণ এবং অনেক প্রাণী এই সময়ে পোষ মানানো হয়েছে ।[11]
৫৫০০ খ্রিষ্টপূর্বব্দের মধ্যেই নীলনদ উপত্যকার ছোট ছোট গোত্র বিকশিত হয়ে উন্নত সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। তাদের মাঝে পশুপালন এবং কৃষিকাজে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ লক্ষ করা যায়। তাদের মৃৎশিল্প এবং বিভিন্ন ব্যক্তিগত জিনিস যেমন চিরুনি,ব্রেসলেট এবং বিড ছিল তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই সকল আদি সংস্কৃতির মাঝে উচ্চ মিশরে সবচেয়ে বড় ছিল বাদারি। তাদের উৎপত্তি সম্ভবত লিবিয় মরুভূমিতে। উন্নত সিরামিক সামগ্রী, পাথরের হাতিয়ার এবং তামার ব্যবহারের জন্য তারা সবচেয়ে বেশি জ্ঞাত।[12]
বাদারিদের পরে আসে আমরতিয় (নাকাদা ১) এবং গেরজেহ (নাকাদা ২)[13] যারা আরো কিছু প্রাযুক্তিক উন্নতি সাধন করে। নাকাদা ১ এর সময় থেকেই মিশরীয়রা ইথিওপিয়া থেকে অবসিডিয়ান আমদানি করে তা দিয়ে ব্লেড বানাতে শুরু করে[14] । নাকাদা ২ সময়ে নিকটপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া যায়[15]। মাত্র এক হাজার বছর সময়েই নাকাদা সংস্কৃতি ছোট ছোট কিছু কৃষি সম্প্রদায় থেকে এক শক্তিশালী সভ্যতায় পরিণত হয় যে এর নেতারা নীল অঞ্চলের সম্পদ এবং মানুষদের পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সমর্থ হয়।[16] নাকাদা ৩ এর নেতারা প্রথম নেখেন বা হায়ারকানপলিসে এবং পরবর্তীতে আবিদোসে শক্তিশালী কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে তাদের প্রভাব নীলনদ বরাবর উত্তর মিশরে বিস্তৃত করে।[17] তারা দক্ষিণে নুবিয়া, পশ্চিমে লিবিয় মরুভূমির মরূদ্যানগুলি এবং পূর্বে পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও নিকটপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করত। রাজকীয় নুবিয় সমাধির বিভিন্ন হস্তশিল্পে মিশরীয় রাজতন্ত্রের বিভিন্ন চিহ্ণ যেমন সাদা মুকুট এবং শকুন এর সবচেয়ে প্রাচীণ নিদর্শন পাওয়া যায়।[18][19]
নাকাদা সংস্কৃতি বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত ব্যবহার সমগ্রী তৈরি করত যেমন চিরুনি, ছোট ভাস্কর্য, ছবি অঙ্কিত মৃৎপাত্র, উচ্চ মানের নকশাকৃত পাথরের পাত্র, স্বর্ণ, ল্যাপিস, আইভোরির অলংকার। তারা একধরনের সিরামিক গ্লেজ তৈরি করে যা ফাইয়েন্স নামে পরিচিত যা পাত্র, ছোট মূর্তি, এমুলেট অলংকৃত করতে এমনকি রোমান যুগেও ব্যবহৃত হত।[20] নাকাদা সংস্কৃতির শেষের দিকে চিহ্ণলিপি ব্যবহার শুরু করে যা অবশেষে প্রাচীন মিশরীয় ভাষার লিখনপদ্ধতি হায়ারোগ্লিফের জন্ম দেয়।[21]
প্রাচীন সুমেরিয়-আক্কাদিয় এবং প্রাচীন এলামিয় সভ্যতার প্রায় সমসাময়িক ছিল এইযুগ। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মিশরীয় পুরোহিত মানেথো তার সময় পর্যন্ত মিশরের ফারাওদের ত্রিশটি রাজবংশে ভাগ করেন যা এখনো স্বীকৃত।[22] তিনি তার ইতিহাস সূচনা করেন মেনি নামের একজন রাজাকে দিয়ে যার ব্যাপারে বিশ্বাস করা হত যে তিনি উচ্চ এবং নিম্ন মিশরকে প্রায় ৩১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে একত্রিত করেন।[23] তবে মেনির ব্যাপারে সমসাময়িক কোন রেকর্ড পাওয়া যায় না। অনেক পণ্ডিত মেনিকে প্রকৃতপক্ষে ফারাও নারমার মনে করেন।[24]
আদি রাজবংশীয় যুগে প্রথম ফারাওরা মেমফিসে রাজধানী স্থাপন করে নিম্ন মিশরের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করেন। এর ফলে তাদের পক্ষে উর্বর নীল বদ্বীপের শ্রমশক্তি এবং কৃষিশক্তির এবং একই সাথে লেভান্টের বাণিজ্যপথগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। তাদের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা ও ধনসম্পদের পরিচয় পাওয়া যায় তাদের বিশদ মাসতাবা সমাধি এবং আবিদোসের সমাধিমন্দিরগুলিতে যেখানে ফারাওদের মৃত্যুর পর তাদের অর্চনা করা হত।[25] এইসকল ফারাওদের তৈরী রাজতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান যা ভূমি, শ্রম এবং সম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার টিকে থাকা এবং বিকাশে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।[26]
মূল নিবন্ধ - প্রাচীন রাজত্ব
সুপ্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই যুগে কৃষি উৎপাদন আগের চেয়ে বৃদ্ধি পায়। এর ফলশ্রুতিতে কলা, স্থাপত্য এবং প্রযুক্তিতে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়।[27] প্রাচীন মিশরের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলোর মাঝে গিজা পিরামিড ও স্ফিংসের মূর্তি এই সময়ে নির্মাণ হয়। উজিরের নির্দেশনায় রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা কর আদায় করতেন, ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সেচকাজ সমন্বিত করতেন, বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পে কৃষকদের নিযুক্ত করতেন এবং একটি বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন।[28]
কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিকাশের সাথে একটি শিক্ষিত লিপিকার ও কর্মকর্তা শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এই শ্রেণীর লোকদের তাদের কাজের বিনিময়ে ফারাওয়ের পক্ষ হতে জমিদারি দেওয়া হত। ফারাওরা তাদের মৃত্যুর পর তাদের সমাধি অর্চনা করার জন্যও ভূমিদান করত। এমনকি স্থানীয় মন্দিরেও তারা ভূমিদান করত। বিশ্বাস করা হয় যে পাঁচ শতক ধরে চলা এই রীতির প্রভাবে ক্রমান্বয়ে ফারাওদের অর্থনৈতিক শক্তি দুর্বল হয়ে যায় এবং একটি বড় কেন্দ্রীয় প্রশাসন চালাবার ক্ষমতা তাদের লোপ পায়। ফারাওদের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে স্থানীয় প্রশাসকেরা ফারাওয়ের প্রাধান্য অস্বীকার করতে থাকে। এর সাথে খ্রীষ্টপূর্ব ২২০০ থেকে ২১৫০ সাল পর্যন্ত তীব্র খরার,[29] কারণে মিশরের প্রাচীন রাজবংশের অবসান হয় এবং মিশর ১৪০ বছরের দুর্ভিক্ষ এবং যুদ্ধবিগ্রহে পতিত হয় যাকে বলা হয় প্রথম অন্তর্বর্তী যুগ।[30]
মূল নিবন্ধ - প্রথম অন্তর্বর্তী যুগ
মিশরের কেন্দ্রীয় সরকারের পতনের পর প্রশাসনের পক্ষে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রাদেশিক গভর্নরেরা দুর্যোগের সময় ফারাওয়ের সাহায্য পেতে ব্যর্থ হয়। একই সাথে খাদ্যাভাব এবং রাজনৈতিক সংঘাত দুর্ভিক্ষ এবং ছোটখাট গৃহযুদ্ধের দিকে দেশকে ঠেলে দেয়। কিন্তু বিভিন্ন সমস্যার পরেও স্থানীয় নেতারা ফারাওয়ের থেকে অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ করার কারণে প্রদেশগুলোতে এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতির সূচনা করে। নিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে ফিরে পাবার পর প্রদেশগুলি অর্থনৈতিকভাবেও ধনী হয় যার প্রমাণ সমাজের সব শ্রেণীর মাঝে বড় এবং উন্নত সমাধিস্থানের মাঝে।[31] এই সময়ে সৃজনশীলতার ব্যাপক প্রসার ঘটে। ইতিপূর্বে যেসকল সাংস্কৃতিক মোটিফ রাজকীয়তায় সীমাবদ্ধ ছিল প্রদেশের কারিগররা এ সময় তাকে গ্রহণ করেন এবং নিজেদের মত পরিবর্তন সাধন করেন। লিপিকারগণ নতুন ধরনের সাহিত্যশৈলীর বিকাশ ঘটান যার মধ্যে এই যুগের আশাবাদ এবং মৌলিকতা ফুটে উঠে।[32]
ফারাওয়ের আনুগত্য থেকে মুক্ত হয়ে স্থানীয় শাসকেরা রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং ভূমির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পরস্পরের সাথে দ্বন্দে লিপ্ত হয়। খ্রীষ্টপূর্ব ২১৬০ অব্দের মধ্যেই হেরক্লেওপোলিসের শাসকের উত্তরে নিম্ন মিশর এবং তাদের প্রতিপক্ষ থেবেসের ইন্তেফ পরিবার দক্ষিণে উচ্চ মিশর নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। ক্রমান্বয়ে ইন্তেফ পরিবার শক্তিশালী হতে থাকে উত্তরে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এতে দুই পক্ষের মাঝে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। ২০৫৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মেন্তুহোতেপ ২ এর নেতৃত্বে ইন্তেফ বাহিনী হেরক্লেওপোলিসের বাহিনীকে পরাজিত করে। এভাবে মেন্তুহোতেপ মিশরের দুই ভূমিকে একত্রিত করেন এবং এক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রেনেঁসার সূচনা করেন।[33]
মধ্যকালীন রাজ্যের ফারাওগণ দেশের সমৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন, ফলে সাহিত্য, কলা এবং বৃহৎ নির্মাণ প্রকল্পের পুনর্সূচনা হয়। মেন্তুহোতেপ ২ এবং তার এগারতম রাজবংশের ফারাওদের রাজধানী ছিল থেবেস। পরবর্তীতে দ্বাদশ রাজবংশের সূচনায় আমেনেমহাত রাজধানী সরিয়ে ইশতাওয়িতে সরিয়ে নিয়ে আসেন।[34] এখান থেকে ফারাওগণ দূরদর্শী ভূমি উদ্ধার এবং সেচকাজ শুরু করেন যার ফলে এই অঞ্চলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। উপরন্তু নুবিয়া অঞ্চলের স্বর্ণ এবং প্রস্তর খনি সমৃদ্ধ এলাকাও দখল করা হয়। একইসাথে পূর্ব বদ্বীপে "শাসকের-দেওয়াল" নামে প্রতিরক্ষামূলক দেওয়াল গড়া হয়।[35]
অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সুরক্ষা, কৃষি ও খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য, কলা এবং ধর্মের ব্যাপক উন্নতি সাধন করে। প্রাচীন রাজ্যের কালে দেবতাদের ব্যাপারে যে অভিজাত মনোভাব ছিল তার স্থলে ব্যক্তিগত ভক্তির প্রকাশ লক্ষ করা যায়। এযুগের বিশ্বাসে সকলের আত্মা রয়েছে এবং মৃত্যুর পর তারা সবাই দেবতাদের সাথে যোগ দিতে পারে।[36] এযুগের সাহিত্যে উঠে আসে জটিল থিম, লিখনশৈলীতে দেখা যায় আত্মবিশ্বাসী অলংকারপূর্ণ শৈলী।[32] এযুগের ভাস্কর্যে সূক্ষ ব্যাপারগুলি এমনভাবে ফুটে উঠেছে যা এর কৌশলগত পরিপূর্ণতাকে প্রকাশ করে।[37]
এযুগের শেষ বড় ফারাও আমেনেমহাত ৩ খনিজ উত্তোলন এবং নির্মাণকাজের শ্রমশক্তির যোগান দিতে নিকটপ্রাচ্যের সেমেটিকভাষী কানানীয়দের নীল বদ্বীপে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেন। এসকল উচ্চাভিলাষী নির্মাণকাজ ও খনিজ উত্তোলন এবং নীলনদের বন্যায় অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মধ্যম রাজ্যের পতনের সূচনা হয়। এই পতনের সময় কানানীয় বসতি স্থাপনকারীরা বদ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে থাকে এবং অবশেষে হিসকোস রূপে মিশরের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।[38]
১৭৮৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে হিসকোস নামের এক সেমিটিক কানানীয় সম্প্রদায় ফারাওয়ের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মিশরের ক্ষমতা নিয়ে নেয় এবং মিশরের কেন্দ্রীয় সরকারকে থেবেসে সরে যেতে বাধ্য করে। থেবেসে ফারাও এদের করদ রাজায় পরিণত হন।[39] তবে হিসকোসরা মিশরীয় সরকার পদ্ধতি বহাল রাখে এবং নিজেদের ফারাও বলে পরিচয় দেয় এবং মিশরীয় সমাজ-সংস্কৃতির একীভূত হয়। তারা মিশরে কয়েকটি নতুন যুদ্ধাস্ত্র যেমন ঘোড়ায় টানা রথ, কম্পোজিট ধনুক প্রচলন করে।[40]
থেবেসে সরে যাওয়ার পর থেবেসের ফারাওরা উত্তরে হিসকোস এবং দক্ষিণে হিসকোসদের নুবীয় মিত্র কুশীয় মাঝে আটকা পড়ে যায়। দীর্ঘদিন হিসকোসদের অধীন থাকার পর থেবেসীয়রা ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয় এবং অবশেষে হিসকোসদের বিরুদ্ধে সংঘাতে অবতীর্ণ হয়।[39] ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে চলা এই সংঘাত ১৫৫৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে শেষ হয়। ফারাও সেকেনেনরে তাও এবং কামোস দক্ষিণের নুবীয়দের পরাজিত করেন। কামোসের উত্তরাধিকারী আহমোস ১ উত্তরের হিসকোসদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সফল সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন যার ফলশ্রুতিতে হিসকোসরা মিশর থেকে সম্পূর্ণ বিতারিত হয়। আহমোস ১ একটি নতুন রাজবংশের পত্তন করেন। এর মাধ্যমে মিশরে নতুন রাজ্যের কাল শুরু হয়। মিশরের সীমানা বিস্তৃত করা এবং নিকট প্রাচ্যের উপর কর্তৃত্ব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা নতুন রাজ্যের ফারাওদের কাছে সামরিক শক্তি বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকারে পরিণত করে।[41]
নতুন রাজ্যের ফারাওগণ সীমন্ত সংরক্ষণ এবং প্রতিবেশী আসিরিয়া কানান এবং মিতানির সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে এক নজিরবিহীন সমৃদ্ধির যুগ প্রতিষ্ঠা করেন। থোথমোস ১ এবং তার নাতি থোথমোস ৩ মিশরের সম্রাজ্যকে পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে বিস্তৃত করেন। তাদের দুজনের মধ্যবর্তী সময়ে রাজত্ব করেন থোথমোস ১ এর কন্যা হাতশেপসুত। হাতশেপসুতের রাজত্বকাল ছিল শান্তিপূর্ণ এবং তিনি অনেকগুলো পুরোনো বাণিজ্যপথ চালু করেন যেগুলো হিসকোসদের সময় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। একইসাথে তার সময়ে অনেক নতুন অঞ্চলেও বাণিজ্যপথ গড়ে উঠে। ১৪২৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে যখন থোথমোস ৩ এর মৃত্যু হয় তখন মিশরীয় সম্রাজ্য উত্তর পশ্চিম সিরিয়ার নিয়া থেকে নুবিয়ায় নীলনদের চতুর্থ জলপ্রপাত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর ফলে ব্রোঞ্জ এবং কাঠের মত গুরুত্বপূর্ণ মালামাল মিশরে আমদনির পথ উন্মুক্ত হয়।[42]
নতুন রাজ্যের রাজার মিশরীয় দেবতা আমুনকে নিবেদন করে বিশাল বিশাল মন্দির নির্মাণ শুরু করেন। একই সাথে তাদের নিজের কীর্তির প্রচারের জন্য সৌধও নির্মাণ শুরু করেন। ফারাওদের মাঝে হাতশেপসুত ছিলেন অত্যন্ত সফল। তার সময়ে পুন্টের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তিনি দার-আল-বাহরিতে তার সমাধিমন্দির নির্মাণ করেন যা হাজার বছর পরের গ্রিক স্থাপত্যকেও হার মানায়। তবে তার পরে তার সৎপুত্র থোথমোস ৩ ক্ষমতায় আসার পর তার কীর্তিগুলি মুছে ফেলতে সচেষ্ট হন। তিনি এবং তার পুত্র আমেনহোতেপ ২ হাতশেসুতের বিভিন্ন কীর্তিকে নিজের বলে চালিয়ে দিতে চেষ্টা করেন।[43] এমনকি তারা শত বছরের অনেক প্রচলিত প্রথাও বন্ধ করার চেষ্টা করেন। অনেকে বলে থাকেন এটি ছিল মিশরে নারীদের ফারাও হওয়া থেকে বাধা দেওয়ার এবং তাদের ক্ষমতা হ্রাসের ব্যর্থ চেষ্টা। ১৩৫০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের দিকে আমেনহোতেপ ৪ ক্ষমতায় আসেন এবং কতগুলো অভূতপূর্ব এবং বৈপ্লবিক সংস্কার সাধনের করেন। তিনি নতুন নাম ধারণ করেন আখেনাতেন এবং পূর্ব প্রায় অজ্ঞাত সূর্য দেবতা আতেনকে সর্বোচ্চ দেবতায় পরিণত করেন। তিনি থেবেসের আমুন পূজারীদের যাদের তিনি দুর্নীতিবাজ মনে করতেন ক্ষমতা খর্ব করেন।.[44] আখেনাতেন তার রাজধানী সরিয়ে নতুন শহর আখেনাতেনে (বর্তমান আমারনা) নিয়ে যান। তিনি তার এই নতুন ধর্ম নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলেন যে নিকটপ্রাচ্যের রাজনীতির ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পরেন। তার মৃত্যুর পর আমুন পুরোহিতরা পুনরায় তাদের ক্ষমতা ফিরে পায়, রাজধানী থেবেসে ফিরে আসে এবং পরবর্তী ফারাওরা তার ধর্মীয় সংস্কারকে স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে সচেষ্ট হয়।[45] ১২৭৯ খ্রীস্টপূর্বাব্দের দিকে রামেসেস ২ যাকে মহান রামেসেসও বলা হয়, ক্ষমতায় আরোহণ করেন, তিনি নতুন নতুন মন্দির, ভাস্কর্য, অবেলিস্ক নির্মাণ করেন এবং মিশরের অন্য যেকোন ফারাওয়ের থেকে তার ঔরসে বেশি সন্তান জন্ম হয়।.[46] তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী সামরিক নেতা। তিনি হিট্টাইটদের বিরুদ্ধে কাদেশে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন। এ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত এক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় এবং রামেসেস ১২৫৮ খ্রীস্টপূর্বাব্দে শান্তিচুক্তি করেন।এই শান্তিচুক্তি ইতিহাসে জ্ঞাত প্রথম শান্তিচুক্তি।[47] হিট্টাইটদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে না পেরে মিশরীয়রা নিকট প্রাচ্য থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। তবে মিশরের ধনসম্পদের প্রাচুর্য তাকে বিভিন্ন শক্তির আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। এর মধ্যে ছিল পশ্চিমে লিবিয় বারবার এবং উত্তরে ঈজিয়ান অঞ্চলের গ্রীক, ফিনিসীয়, লুবিয়দের নিয়ে গঠিত এক শক্তিশালী সামুদ্রিক দস্যু বাহিনী। প্রাথমিকভাবে মিশরীয় সেনাবাহিনী এসকল আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হলেও ক্রমে মিশর কানানের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। বহিঃশত্রুর আক্রমণের সাথে সাথে অভ্যন্তরীন সমস্যা যেমন্ দুর্নীতি, গনবিক্ষোভ, সমাধি লুট মিশরের সমস্যাকে আরো গভীর করে। আমুনের পুরোহিতগণ বিশাল সম্পদ এবং ভূসম্পত্তির মালিক হয়। তাদের অত্যধিক ক্ষমতা মিশরকে খন্ডবিখন্ড করে ফেলে এবং মিশর তৃতীয় মাধ্যমিক কালে প্রবেশ করে।[48]
১০৭৮ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে রামেসেস ১১ এর মৃত্যুর পর তানিস নগরের শাসনকর্তা স্মেন্দেস উত্তর মিশরের উপর কর্তৃত্ব বিস্তার করেন। মিশরের দক্ষিণাংশের নিয়ন্ত্রণ ছিল থেবেসের দেবতা আমুনের পুরোহিতদের হাতে, তারা স্মেন্দেসকে নামেমাত্র স্বীকার করতেন।[49] এই সময় লিবিয়ার বারবার গোত্রের লোকেরা পশ্চিম বদ্বীপ এলাকায় বসতি স্থাপন করে এবং তাদের নেতারা ক্রমান্বয়ে স্বাধীন হতে থাকে। এদের মধ্যে শশেনক ১ ৯৪৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে বদ্বীপের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। এভাবে ২০০ বছর ব্যাপী শাসন করা বারবার বা বুবাসতীয় রাজবংশের সূচনা হয়। শশেনক দক্ষিণ মিশরের উপর কর্তৃত্ব বিস্তার করেন গুরত্বপূর্ণ পুরোহিত পদে তার পরিবারের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে।
খ্রীষ্টপূর্ব নয় শতকের মাঝামাঝি সময়ে মিশর পশ্চিম এশিয়ায় তার কর্তৃত্ব ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করে। ৮৫৩ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ফারাও ওসোরকোন ২ ইসরায়েল, হামাথ, ফিনিসিয়া/কানান, আরব, আরামীয় এবং নব্যহিট্টাইট সহ বিভিন্ন জাতির এক জোট নিয়ে আসিরিয় রাজা শালমানেসেরের বিরুদ্ধে কারকারে যুদ্ধে লিপ্ত হন। তবে এই জোট যুদ্ধে পরাজিত হয় এবং পশ্চিম এশিয়ায় আসিরিয় কর্তৃত্ব বজায় থাকে।
লিবিয় বারবারদের এই রাজবংশের প্রভাব হ্রাস পায় যখন তারেমুতে প্রতিদ্বন্দী রাজবংশের উত্থান ঘটে। একই সাথে দক্ষিণে কুশের নুবিয়দের প্রভাব বাড়তে থাকে।[50]
৭২৭ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে কুশীয় রাজা পিয়ে তার নুবিয়ার রাজ্ধানী নাপাতা থেকে এসে মিশর আক্রমণ করেন এবং সহজেই থেবেস এবং অবশেষে নীল বদ্বীপ দখল করেন।[51] পিয়ে পঁচিশতম রাজবংশের ফারাওদের জন্য উত্তর ও দক্ষিণ মিশরকে একত্রিত করার কাজের ভিত্তি স্থাপন করেন।[52] নীল উপত্যকায় তাদের সম্রাজ্য নতুন রাজ্যের সময়ের বিস্তৃতিতে পৌছায়।পঁচিশতম রাজবংশের সময় মিশরে এক রেনেঁসার সূচনা হয়। ধর্ম, শিল্প এবং স্থাপত্যের ক্ষেত্রে পূর্ব যুগের গৌরব ফিরে আসে।.[53] ফারাওদের মাঝে তাহারকা নীল উপত্যকার মেমফিস, কারণাক, কাওয়া, জেবেলে বারকাল প্রভৃতি এলাকায় মন্দির সংস্কার এবং নির্মাণ করেন।[54] মধ্যম রাজ্যের পরে এই প্রথম নীল উপত্যকায় বৃহৎ মত্রায় পিরামিড নির্মাণ শুরু হয়।[55][56][57]
পিয়ে আসিরিয়া প্রভাবিত নিকট প্রাচ্যে মিশরের প্রভাব বিস্তারে ব্যর্থ চেষ্ট করেন। ৭২০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে তিনি ফিলিস্তিয়া এবং গাজায় আসিরিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সাহয্যে সৈন্য প্রেরণ করেন। কিন্তু সার্গন ২ এর হাতে পিয়ে পরাজিত হন এবং এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। ৭১১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে আশদোদের ইসরায়েলীয়দের বিদ্রোহে পিয়ে সাহয্য করেন কিন্তু সারগন ২ এর কাছে আবার পরাজিত হন। এরপর নিকট প্রাচ্য থেকে পিয়ে সরে যেতে বাধ্য হন।[58]
খ্রীষ্টপূর্ব দশম শতক থেকে আসিরিয়া দক্ষিণ লেভান্টের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য যুদ্ধ শুরু করে। সেসময় দক্ষিণ লেভান্টের শহর এবং রাজ্যগুলি আসিরিয়ার শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায়ই মিশরের কাছে সাহায্য চেত। পিয়ের উত্তরসূরি তাহারকা প্রাথমিকভাবে নিকট প্রাচ্যে সাফল্য লাভ করেন। যখন আসিরিয় রাজা সেন্নাকেরিব জেরুসালেম অবরোধ করেন তখন তাহারকা জুদীয় রাজা হেজেকিয়াহকে সাহায্য করেন। আসিরিয় বাহিনী অবশেষে তাদের অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়। বাইবেলে এর উল্লেখ রয়েছে।এর কারণ সম্পর্কে পণ্ডিতগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন। হেনরি অবিনের মতে মিশরীয় বাহিনীই আসিরিয়দের থেকে জেরুসালেমেকে রক্ষা করে এবং সেন্নাকেরিবের জীবদ্দশায় জেরুসালেম পুনরাক্রমন থেকে বিরত রাখে।[59] কেউ কেউ বলেন এর মূল কারণ ছিল রোগব্যাধি।তবে সেন্নাকেরিবের বিবরণীতে দাবি করা হয় যে জুদাহ এর পর তাদের করদ রাজ্যে পরিণত হয়।[60]
সেন্নকেরিবের উত্তরসূরি এশারহাদ্দন মিশর অভিযান করেন।৬৭৪ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে তাহারকা এশারহাদ্দনকে পরাজিত করেন।[61] কিন্তু ৬৭১ খ্রীষ্টপূরর্বাব্দে এশারহাদ্দন মিশরের কুশীয় ফারাওদের নুবিয়ায় বিতারিত করে তার অনুগত মিশরীয়দের ক্ষমতায় বসায়। কিন্তু দুই বছর পর তাহারকা আক্রমণ করে মেমফিস পর্যন্ত দখল করে নেন। এশারহাদ্দন তাহারকাকে দমন করার জন্য আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে পরেন এবং তার রাজধানী নিনেভে মারা যান। তার উত্তরসূরি আশুরবানিপাল তাহারকাকে দমন করার জন্য একটি ছোট কিন্তু উচ্চ প্রশিক্ষিত বাহিনী প্রেরণ করেন। এই বাহিনী তাহারকাকে মেমফিসে পরাজিত করে এবং নুবিয়ায় বিতারিত করে। তাহারকা দুই বছর পর নুবিয়ায় মারা যান।
তার উত্তরসূরি তানুতামুন মিশর পুনর্দখলের ব্যর্থ চেষ্টা করেন। তিনি আশুরবানিপালের বসানো পাপেট শাসক নেকো পরাজিত করেন, এমনকি থেবেসও দখল করেন। এরপর আসিরিয়রা তার বিরুদ্ধে দক্ষিণে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে।তানুতামুন পরাজিত হন এবং নুবিয়ায় পালিয়ে যান। আসিরিয়রা থেবেসে এমন লুটপাট চালায় যে থেবেস তা থেকে আর ফিরে আসতে পারেনি। আশুরবানিপাল সামতিক নামের এক স্থানীয় শাসককে মিশরের শাসক নিযুক্ত করেন।[62]
স্থায়ী দখলদারীত্বের পরিবর্তে আসিরীয়রা স্থানীয় সামন্ত রাজাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে যায়। এসকল রাজা সৈতে নামে পরিচিত হয়।৬৫৬ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যেই সৈতে রাজা সামতিক ১ মিসরকে আসিরিয়ার অধীনতা থেকে মুক্ত করেন।এ সময় আসিরিয়া এলামের সাথে বড় ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত ছিল এবং খুব অল্প সংখ্যক সৈন্য মিশরে বিদ্যমান ছিল। সামতিক ১ একাজে গ্রীক এবং লিডিয় ভাড়াটে সৈনিকদের সাহায্য নেন যাদের নিয়ে পরবর্তীতে মিশরের প্রথম নৌবাহিনী গড়ে উঠে।তবে সামতিক এবং তার উত্তরসূরিগণ আসিরিয়ার সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট হন। সামতিকের রাজত্বকালে গ্রীকদের সাথে মিশরের সম্পর্ক দৃঢ় হয়। মিশরে গ্রীক প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং নৌক্রটিস নীল বদ্বীপের গ্রীকদের আবাসভূমিতে পরিণত হয়।
৬০৯ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে নেকো ২ আসিরিয়ার সাহায্যার্থে ব্যবিলনীয়, ক্যালডীয়, মেডীয় এবং সিথীয়দের সাথে এক যুদ্ধে লিপ্ত হন। আসিরিয়া এক নৃশংস গৃহযুদ্ধের পর এই জোটবদ্ধ শক্তির হাতে অসহায় হয়ে পড়েছিল।তবে নেকোর এই অভিযান উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়।কিন্তু মিশরীয় সৈন্যবাহিনী পৌছানোর আগেই নিনেভের পতন হয় আসিরিয় রাজা সিন-শার-ইসকুনের মৃত্যু হয়।তবে নেকোর সৈন্যবাহিনী সহজেই ইসরায়েলি রাজা জোসিয়াহর সৈন্যবাহিনীকে পরাজিত করেন। নেকো এবং আসিরিয় রাজা আশুর-উবালিত ২ এর সৈন্যবাহিনী ৬০৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে সিরিয়ার কারকেমিশে পরাজিত হয়। মিশরীয় সৈন্যবাহিনী আরো কয়েকে দশক সেখানে অবস্থান করে লেভান্টের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্যাবিলনীয়দের সাথে সংঘাতে লিপ্ত থাকে। অবশেষে নেবুচাদনেজার ২ তাদের মিশরে বিতারণ করেন এবং ৫৬৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিশর আক্রমণ করেন।[60]
সৈতে রাজাদের অধীনে মিশরে স্বল্প সময়ের জন্য শিল্প এবং অর্থনীতি উজ্জীবিত হয়।কিন্তু ৫২৫ খ্রীষ্টপূর্বব্দে পারস্যরাজ কামবোস ২ মিশর অভিযান শুরু করেন এবং ফারাও সামতিক ৩ কে পেলুসিয়ামের যুদ্ধে বন্দি করেন।পরবর্তীতে কামবোস ফারাও উপাধি ধারণ করেন কিন্তু তিনি মিশর শাসন করতেন পারস্য থেকে। ফলে মিশর পারসিক আখেমেনীয় সম্রাজ্যের একটি প্রদেশে/সত্রপিতে পরিণত হয়।[63] মিশর সাইপ্রাস ও ফিনিসিয়া (বর্তমান লেবানন) মিলে ছিল হাখমানেশী সম্রাজ্যের ষষ্ঠ সত্রপি।৪০২ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মিশরে পারসিক শাসনের অবসান ঘটে।৩৮০-৩৪৩ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মিশরের শেষ রাজবংশ মিশর শাসন করে। মিশরের শেষ রাজা নেকতানেবোর মৃত্যুতে এই রাজবংশের অবসান হয়। এর পরে আর মিশরের স্থানীয়দের হাতে ক্ষমতা ফিরে আসেনি। ৩৪৩-৩৩২ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মিশরে পারসিক শাসন চলে। অনেকে একে মিশরের একত্রিশতম রাজবংশ বলে থাকেন।৩৩২ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে পারসিক শাসক মাজাকেস ম্যসিডোনিয় বিজেতা আলেক্সান্দারের হাতে বিনা যুদ্ধে মিশর সমর্পন করেন।[64]
মিশরীয় সভ্যতার বিশতম রাজবংশের শেষ সম্রাট ছিলেন একাদশ রামসিস। তার সময়ে মিশরে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়।
তারপর ১০৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিশরের থিবস শহরের প্রধান ধর্মযাজক মিশরের সিংহাসন দখল করে নেয়।
৫২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পারস্য রাজশক্তি মিশর দখল করে এবং এর মধ্য দিয়ে মিশরীয় সভ্যতার অবসান ঘটে।
৩৩২ খ্রীস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার মিশর অধিকার করলে, মিশরে টলেমি নামক রাজ বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়৷ [65]
ফারাও ছিলেন দেশের সর্বময় রাজা এবং অন্তত তাত্ত্বিকভাবে দেশের সকল ভূমি এবং সম্পদের উপর কর্তৃত্বশালী। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীপ্রধান এবং সরকারপ্রধান এবং কার্যসম্পাদনে একদল আমলার উপর নির্ভর করতেন। প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করতেন উজীর, যিনি ছিলেন ফারাওয়ের প্রতিনিধি, তিনি ভূমি জরিপ কাজ, কোষাগার, নির্মাণ প্রকল্প, বিচার ব্যবস্থা এবং আর্কাইভের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতেন।[66] পুরো দেশ ৪২ টি নোমে (গ্রীক: Νομός, বিভাগ প্রাচীন মিশরীয়: সেপাত) বিভক্ত ছিল। প্রতিটি নোমের প্রশাসক নোমর্ক, তার কাজের জন্য উজীরের কাছে জবাবদিহি করত। মন্দিরগুলি ছিল প্রাচীন মিশরের অর্থনীতির মেরুদন্ড। মন্দিরগুলি শুধু প্রার্থনার স্থান হিসেবেই ভূমিকা পালন করত না, বরং একইসাথে রাষ্ট্রীয় সম্পদ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের কাজও করত।[67] প্রাচীন মিশরীয় দেবতা অর্থনীতি ছিল কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত। যদিও শেষ যুগের আগ পর্যন্ত মিশরে মুদ্রার প্রচলন হয়নি তবুও তাদের মাঝে এক ধরনের দ্রব্যবিনিময় ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।[68] এ ব্যবস্থায় প্রমাণ পরিমাণ খাদ্যশস্যের বস্তা এবং দেবেন (প্রায় ৯১ গ্রাম তামা বা রূপা) বিনিময়ের একক হিসেবে ব্যবহৃত হত।[69] শ্রমিকদের খাদ্যশস্যের মাধ্যমে পারিশ্রমিক দেওয়া হত। একজন সাধারণ শ্রমিক মাসে সাড়ে পাঁচ বস্তা (২০০ কেজি), তাদের তত্ত্বাবধায়ক সাড়ে সাত বস্তা (২৫০ কেজি) করে পেত।দ্রব্যমূল্যের দাম সারা দেশে নির্দিষ্ট করা ছিল। একটি জামা কিনতে ব্যয় হত ৫ দেবেন। একটি গরু কিনতে ব্যয় হত ১৪০ দেবেন।[69] খাদ্যশস্যের সাথেও দ্রব্য বিনিময় করা যেত,তবে বিনিময়মূল্য নির্ধারণ করা ছিল।[69] খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে বিদেশিদের দ্বারা মুদ্রার প্রচলন হয়। প্রথমে এগুলো ছিল দামি ধাতুর প্রমাণ পরিমাণ খন্ড, প্রকৃত মুদ্রা ছিল না। কিন্তু পরবর্তী শতকে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িরা ধাতব মুদ্রার উপর নির্ভর করতে শুরু করে।[70]
মিশরীয় সমাজ ছিল বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত এবং সামাজিক অবস্থান সবসময় স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা হত। কৃষকরা ছিল সমাজের সবচেয়ে বড় অংশ। কিন্তু তাদের উৎপাদিত ফসলের মালিক ছিল রাষ্ট্র, মন্দির অথবা কোন অভিজাত পরিবার যারা ঐ ভূমির মালিক। কৃষকদেরকে শ্রমকর দিতে হত এবং কর্ভী পদ্ধতির অধীনে সেচ এবং নির্মাণকাজে তাদের কাজ করতে হত।[71] কারিগর এবং শিল্পীদের সামজিক অবস্থান ছিল কৃষকদের উপরে, কিন্তু তারাও রাষ্ট্রের অধীন ছিল। তাদের কাজ করতে হত মন্দির সংলগ্ন দোকানে এবং তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হত রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। লিপিকার এবং কর্মকর্তারা ছিল মিশরের উচ্চশ্রেণি, তাদের সামাজিক স্তরের চিহ্ন ছিল ব্লীচ করা লিনেনের কাপড়। অভি[72] জাত সম্প্রদায়ের ঠিক নিচে ছিল পুরোহিত, বৈদ্য এবং প্রকৌশলিদের অবস্থান, যাদের কোন একটি বিষয়ে পারদর্শীতা ছিল। প্রাচীন মিশরে দাসপ্রথা জ্ঞাত ছিল, কিন্তু তার বিস্তার এবং ব্যাপকতা কেমন ছিল তা অস্পষ্ট।[73]
প্রাচীন মিশরীয়রা দাস ব্যতীত নারী-পুরুষ সমাজের সকল স্তরের মানুষকে আইনের দৃষ্টিতে সমান বিবেচনা করত, সমাজের সবচেয়ে নিম্ন স্তরের কৃষক উজীরের কাছে বিচার চাইতে পারত।[74] মিশরে দাসেরা ছিল শর্তাবদ্ধ কাজের লোকের মত, অর্থাৎ তারা নির্দিষ্ট সময় কাজ করে নিজেদের মুক্তি অর্জন করে নিতে পারত। একইসাথে দাসের বেচাকেনা করতে পারত এবং বৈদ্য দ্বারা চিকিৎসা করাতে পারত।[75]
নারী-পুরুষ উভয়ের সম্পত্তি অর্জন এবং ক্রয়বিক্রয়, চুক্তি করা, বিয়ে এবং ডিভোর্স, উত্তরাধিকার এবং আদালতে বিচার পাওয়ার অধিকার ছিল।বিবাহিতরা একত্রে সম্পদের মালিক হতে পারত। বিবাহ ভেঙে গেলে স্বামীর স্ত্রী ও সন্তান ভরণপোষণ দাবি করতে পারত। প্রাচীন গ্রীস, রোম এমনকি তুলনামূলক আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের নারীদের চেয়ে প্রাচীন মিশরের নারীদের ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি ছিল। হাতশেপসুত এবং ক্লিওপেট্রা ফারাও হয়েছিলেন এবং অন্যান্য অনেকে আমুনের ঐশ্বরিক স্ত্রী পদে থেকেও ক্ষমতাশালী হয়েছিলেন। এইসব স্বাধীনতা সত্ত্বেও মিশরীয় নারীরা প্রায় সময় প্রশাসনিক কাজে অংশ নিতেন না, মন্দিরে অপ্রধান দায়িত্ব পালন করতেন এবং পুরুষদের মত বেশি শিক্ষালাভ করতেন না।[74]
আইনি ব্যবস্থার প্রধান ছিলেন ফারাও, তার দায়িত্ব ছিল আইন তৈরি করা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, প্রাচীন মিশরীয়রা এই ধারনাকে বলত মা'ত। যদিও প্রাচীন মিশরীয়দের কোন বিধিবদ্ধ আইনের সন্ধান পাওয়া যায় না, তবে আদালতের নথি থেকে বোঝা যায় যে মিশরীয় আইন ভাল মন্দের সাধারণ ধারণার উপর গড়ে উঠেছিল, যেখানে কতগুলো আইনের কঠোর অনুসরণের চেয়ে দ্বন্দ্ব নিরসন এবং সম্মতিতে পৌছানোকে অধিক গুরত্ব দেওয়া হত। নতুন রাজ্যের সময় স্থানীয় বয়স্কদের নিয়ে গঠিত কাউন্সিল যার নাম ছিল কেনবেত ছোটোখাটো ব্যাপার মীমংসা করত। গুরুতর ব্যাপার যেমন হত্যা, বড় ভূমি বিনিময় এবং সমাধি লুটের ক্ষেত্রে মহাকেনবেতের কাছে উপস্থাপন করা হত, যার সভাপতিত্ব করতেন উজীর কিংবা ফারাও। বাদি এবং বিবাদি নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করত এবং সত্য বলার শপথ করত। কোন কোন ক্ষেত্রে রাষ্ট্র প্রসিকিউটর এবং বিচারকের উভয় ভূমিকাই পালন করত, এবং স্বীকারোক্তি কিংবা সহযোগীদের নাম আদায়ের জন্য অত্যাচার করতে পারত। ছোট কিংবা বড় যে অপরাধের জন্যই মামলা হোক না কেন, আদালতের লিপিকারেরা অভিযোগ, সাক্ষী এবং রায় ভবিষ্যতের জন্য নজীর হিসাবে নথিবদ্ধ করে রাখত।
প্রাচীন মিশরের কিছু ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য মিশরীয় সভ্যতার সাফল্যে অবদান রেখেছে। তার সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ হল নীল নদের বাৎসরিক বন্যা যা নীল নদের পার্শ্ববর্তী মাটিকে করে তোলে উর্বর। এর ফলে প্রাচীন মিশরীয়রা প্রচুর পরিমাণে খাদ্য উৎপাদন করতে পেরেছিল এবং সাহিত্য, কলা, প্রযুক্তির পেছনে সময় সম্পদ ব্যয় করার সুযোগ পেয়েছিল।
প্রাচীন মিশরের কৃষিকাজ নীলনদের উপর গভীরভাবে নির্ভরশীল ছিল। প্র্রাচীন মিশরীয়রা তিনটি ঋতু চিহ্নিত করেছিল, আখেত (বন্যাঋতু) পেরেত (রোপনঋতু) এবং শেমু (ফসল কাটার ঋতু)। বন্যাঋতুর সময়কাল ছিল জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস। এই সময়ের বন্যায় নদীর পাড়ে উর্বর পলিমাটি জমত। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছিল ফসল উৎপাদনকাল। কৃষকেরা জমিতে লাঙ্গল দিত এবং বীজ বপন করত। খালের মাধ্যমে জমিতে সেচ দেওয়া হত। মিশরে অল্পই বৃষ্টি হত, তাই কৃষকরা ছিল নীল নদের উপর নির্ভরশীল। মার্চ হতে মে মাস পর্যন্ত কাস্তে দিয়ে ফসল কাটা হত এবং মাড়াই করে শস্যদানা আলাদা করা হত। এরপর শস্যদানা ঝেড়ে তুষ আলাদা করা হত। তুষমুক্ত শস্যদানা থেকে গুঁড়া করে ময়দা বানানো হত কিংবা বিয়ার তৈরি করা হত কিংবা ভবিষ্যতের জন্য জমা রাখা হত।
মিশরীয়রা এমার গম, বার্লি এবং আরো কিছু শস্য উৎপাদন করত। এগুলো রুটি এবং বিয়ার, মিশরীয়দের প্রধান দুইটি খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হত। শণগাছ, যা ফুল দেওয়ার পূর্বে উৎপাটন করা হত, তন্তুর জন্য চাষ করা হত। এই তন্তু থেকে লিনেন এবং কাপড় তৈরি করা হত। নীলনদের তীরে জন্মানো প্যাপিরাস কাগজ উৎপাদনে ব্যবহৃত হত।বাসস্থানের নিকটে উচ্চস্থানে ফল এবং সবজির বাগান করা হত। এই সকল বাগানে হাতে সেচ করা হত। ফল এবং সবজির মাঝে ছিল পেঁয়াজ, রসুন, লেটুস, ডাল, তরমুজ, স্কোয়াশ এবং অন্যান্য ফসল। একইসাথে আঙুর চাষ করা হত যা থেকে মদ তৈরি করা হত।
প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত জাগতিক শৃঙ্খলার জন্য মানুষ এবং পশুপাখির মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকা প্রয়োজন, তাই মানুষ, পশু এবং গাছপালাকে একের বিভিন্ন অংশ বিবেচনা করা হত। তাই বন্য এবং পোষা পশু মিশরীয়দের জন্য ছিল আধ্যাত্মিকতা এবং সঙ্গের গুরত্বপূর্ণ উৎস। পশুসম্পদের উপর কর আদায় করা হত এবং মন্দির ও জমিদারির জন্য তার পশুপালের আকার ছিল তার মর্যাদা ও প্রতিপত্তির পরিচায়ক। গবাদিপশুর সাথে সাথে মিশরীয়রা ভেড়া, ছাগল ও শুকরও পালন করত।হাঁস এবং কবুতর জালে বন্দি করে পালা হত। নীল নদে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। প্রাচীন রাজ্যের সময় থেকেই মৌমাছি চাষ করা হত এবং মধু ও মোমের যোগান দিত।
প্রাচীন মিশরীয়রা গাধা এবং ষাঁড় ভারবাহী পশু হিসেবে ব্যবহার করত। এদেরকে জমিতে লাঙ্গল দেওয়া এবং জমিতে বীজ ভালভাবে বপন করার কাজে ব্যবহার করা হত। মোটতাজা ষাঁড় বলি দেওয়া ছিল ধর্মীয় আচারের গুরত্বপূর্ণ অংশ।দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী যুগে হিসকোসদের দ্বারা ঘোড়ার প্রচলন হয়। নতুন রাজ্যের সময় উটের ব্যবহার জানা থাকলেও, শেষ যুগের আগে ভার বহনের কাজে উটের প্রচলন ছিল না। শেষ যুগের দিকে হাতি ব্যবহারের লক্ষণ পাওয়া যায়, কিন্তু চারণভূমির অভাবে এই ব্যবহার অচল হয়ে পড়ে। কুকুর, বিড়াল এবং বানর ছিল সাধারণ পোষা প্রাণী। সিংহ ইত্যাদি প্রাণী, যা আফ্রিকার গভীর থেকে নিয়ে আসা হত, তা সাধারণত রাজপরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রাকরাজবংশীয় এবং শেষ যুগে দেবতাদের প্রাণীরূপে পূজা করার ব্যাপক চল ছিল, যেমন বিড়ালরূপ দেবী বাসতেত এবং ইবিসরূপ দেবতা থোথ, এইসব প্রাণী বলি দেওয়ার জন্য বড় বড় খামারে পালা হত।
নির্মাণকাজে ব্যবহার্য পাথর, অলঙ্কারের পাথর, তামা, সীসা এবং দামি পাথরে মিশর সমৃদ্ধ। মিশরের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য তাদের ইমারত, ভাস্কর্য, হাতিয়ার এবং অলঙ্কার তৈরিতে সহায়ক হয়। ওয়াদি নাত্রুনের লবণ মমি তৈরিতে ব্যবহৃত হত, সেখান থেকে জিপসামও পাওয়া যেত যা প্লাস্টার করার কাজে ব্যবহৃত হত। দূরবর্তী পূর্ব মরুভূমি এবং সিনাইয়ের বসবাসের অযোগ্য ওয়াদিতে খনিজ পদার্থ পাওয়া গিয়েছিল। এসকল এলাকা থেকে খনিজ উত্তোলনে প্রয়োজন হত রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বিশাল অভিযান। নুবিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছিল সোনার খনি এবং প্রথম মানচিত্রের একটি ছিল এখানকার একটি সোনার খনির। ওয়াদি হাম্মামাত ছিল গ্রানাইট, সোনা গ্রেওয়াকের সুপরিচিত উৎস। চকমকি পাথর ছিল প্রথম সংগৃহীত খনিজ পদার্থ যা হাতিয়ার তৈরীতে ব্যবহৃত হত, চকমকি পাথরের তৈরি কুঠার হল নীলনদ উপত্যকায় মানববসতির প্রথম নিদর্শন। চকমকি পাথরের খণ্ডে আঘাত করে ধারালো ক্ষুর এবং তীরের ফলা তৈরি করা হত, এমনকি তামার ব্যবহার শুরু হওয়ার পরেও এর চল ছিল। খনিজ পদার্থ যেমন গন্ধক রূপচর্চার কাজে ব্যবহারে মিশরীয়রাই ছিল প্রথম।
হাতিয়ার তৈরির কাজে মিশরীয়দের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ ধাতু ছিল তামা, মালাকাইট আকরিক যা সিনাইয়ে পাওয়া যেত তা থেকে তামা উৎপাদন করা হত। পাললিক শিলার মধ্য হতে সোনার খণ্ড সংগ্রহ করা হত। আবার কোয়ার্টজাইট গুঁড়া করেও তার মধ্য থেকে সোনা বের করা হত। শেষ যুগে উত্তর মিশরে পাওয়া লোহার খনি থেকে লোহা উৎপাদন করা হত। নির্মাণকাজে ব্যবহার্য উচ্চমানের পাথর মিশরে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত; নীল উপত্যকা থেকে চুনাপাথর, আসওয়ান থেকে গ্রানাইট, পূর্ব মরুভূমির মরুদ্যানগুলো থেকে থেকে ব্যাসাল্ট ও বেলেপাথর সংগ্রহ করা হত। অলংকারের পাথর যেমন এলাব্যাস্টার, গ্রেওয়াক এবং কারণেলিয়ান পূর্ব মরুভূমিতে প্রচুর পাওয়া যেত এবং প্রথম রাজবংশের আগে থেকেই সংগ্রহ করা হত। টলেমিয় এবং রোমান যুগে ওয়াদি সিকাইত থেকে চুনী এবং ওয়াদি এল-হুদি থেকে পান্না উত্তোলন করা হত।
প্রাকরাজবংশিয় যুগে নুবিয়ার সাথে সোনা এবং ধূপ সংগ্রহের জন্য নুবিয়ার সাথে বাণিজ্যসম্পর্ক স্থাপিত হয়। তাদের সাথে ফিলিস্তিন অঞ্চলেরও বাণিজ্য স্থাপিত হয়, প্রথম রাজবংশের যুগের ফারাওদের সমাধিতে ফিলিস্তিন অঞ্চলে পাওয়া তেলের পাত্রের মত পাওয়া যায়। প্রথম রাজবংশের কালের কিছু পূর্বে কানানে মিশরীয় একটি কলোনি ছিল। রাজা নারমার কানানে মিশরীয় মৃৎপাত্র তৈরি করাতেন এবং তা মিশরে আমদানি করাতেন। দ্বিতীয় রাজবংশের সময় জুবাইলের হতে কাঠ আমদানি করা হয় যা মিশরে পাওয়া যেত না। পঞ্চম রাজবংশের সময় থেকে পুন্ট থেকে সোনা, সুগন্ধী রেসিন, আবলুস, হাতির দাঁত এবং বন্য প্রাণী যেমন বানর ও বেবুন আম্দানি শুরু হয়। টিন এবং প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত তামার জন্য মিশর আনাতোলিয়ার উপর নির্ভরশীল ছিল, এ দুটো ধাতুই ব্রোঞ্জ তৈরির উপাদান। মিশরীয়রা লাপিস-ল্যাজুলির খুব সমাদর করত যা আসত সুদূর আফগানিস্তান হতে। ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের ক্রীট এবং গ্রীস হতে মিশরে জলপাই তেল এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি আসত। বিভিন্ন বিলাস সামগ্রীর বিনিময়ে মিশর থেকে প্রধানত খাদ্যশস্য, লিনেন, সোনা, প্যাপিরাস এবং কাচ ও পাথরের বিভিন্ন সামগ্রী।
প্রাচীন মিশরীয় ভাষা উত্তর অফ্রোএশিয়াটিক ভাষাপরিবারের অন্তর্ভুক্ত, বারবার এবং সেমিটিক ভাষাগুলির নিকট সম্পর্কিত। সুমেরিয় ভাষার পর এই ভাষার ইতিহাস সবচেয়ে দীর্ঘ; ৩২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ হতে মধ্যযুগ পর্যন্ত এ ভাষা লিখা হত, কথ্য হিসেবে তার চেয়ে দীর্ঘসময় এ ভাষা টিকে ছিল। প্রাচীন মিশরীয় ভাষাকে কয়েকটি পর্যায়কালে ভাগ করা যায়: প্রাচীন, মধ্য (ধ্রূপদী মিশরীয়), পরবর্তী, ডেমোটিক ও কপটিক। কপটিকের পূর্বে মিশরীয় লেখনে উপভাষাগত পার্থক্য দেখা যায় না, তবে ধারণা করা হয় প্রথমে মেমফিস ও পরে থেবেসের উপভাষাই মান ভাষা ছিল।
অন্যান্য আফ্রোএশিয়াটিক ভাষার মত প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় ২৫ টি ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল। এই ভাষায় তিনটি হ্রস্ব ও তিনটি দীর্ঘ স্বরবর্ণ ছিল, যা পরবর্তীতে নয়টি স্বরবর্ণে পরিণত হয়। মিশরীয় ভাষার একটি শব্দ অন্যান্য সেমিটিক ভাষার ন্যায় দুইটি বা তিনটি ব্যাঞ্জন বা অর্ধব্যাঞ্জন বর্ণ নিয়ে গঠিত প্রকৃতির সাথে উপসর্গ যোগে গঠিত হয়। উদাহরণত : তিন ব্যাঞ্জনের ধাতু S-Ḏ-M, এর সাধারণ ধাতুরূপ sḏm, অর্থ সে (পুরুষ) শোনে। কর্তা যদি বিশেষ্য হয় তবে কোন উপসর্গ যুক্ত হয় না যেমন sḏm ḥmt, মহিলাটি শোনে।
হায়ারোগ্লিফিক লিপি খ্রীষ্টপূর্ব ৩২০০ অব্দ হতে ব্যবহৃত হয় এবং এতে শত শত চিহ্ন রয়েছে। একটি চিহ্ন ধ্বনি, শব্দ কিংবা শুধুমাত্র নির্দেশক রূপে ব্যবহার হতে পারে এবং বিভিন্ন স্থানে একই চিহ্ন বিভিন্ন কিছু বোঝাতে পারে। হায়ারোগ্লিফিক লিপি ছিল এক ধরনের আনুষ্ঠানিক লিপি, প্রস্তর স্তম্ভ এবং সমাধিতে এই লিপি ব্যবহৃত হত, এই লিপি ছিল কলার পর্যায়ে, অত্যন্ত যত্নের সাথে তা লেখা হত। প্রতিদিনের লেখার জন্য লিপিকারেরা টানা হাতের লেখার এক লিপি ব্যবহার করত যাকে হায়ারেটিক লিপি বলা হয়, এতে লেখা ছিল দ্রুত ও সহজ। হায়ারোগ্লিফিক সারি কিংবা স্তম্ভ উভয়েই লেখা হলেও ( সাধরনত সারিতে ডান থেকে বামে লেখা হত), হায়ারেটিক লেখা হত সব সময় সারিতে ডান থেকে বামে। পরবর্তীতে একটি নতুন ধরনের লিপি, ডেমোটিক লিপি, প্রাধান্য লাভ করে; রোসেটা প্রস্তরফলকে গ্রীক ও হায়রোগ্লিফিকের সাথে এই লিপি ব্যবহৃত হয়।
প্রথম শতাব্দীর দিকে ডেমোটিকের পাশাপাশি কপ্টিক লিপির ব্যবহার শুরু হয়। কপ্টিক লিপি মূলত গ্রিক লিপি, যার সাথে ডেমোটিক লিপির কিছু চিহ্ন যোগ করা হয়। চতুর্থ শতব্দী পর্যন্ত হায়ারোগ্লিফ আনুষ্ঠানিক কাজে ব্যবহৃত হত, কিন্তু শেষ দিকে অতি অল্প সংখ্যক পুরোহিতই তা পড়তে পারতেন। স্থানীয় ধর্মের বিলোপের সাথে এই লিপির জ্ঞান প্রায় হারিয়ে যায়। বাইজানটাইন ও ইসলামি যুগে এই লিপি পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়। ১৮২২ সালে রোসেটা প্রস্তর আবিষ্কার এবং তার পর থোমাস ইয়ং ও জঁ ফ্রাঁসোয়া শাঁপোলিয়নের বহুবছর গবেষণার পর হায়ারোগ্লিফিক লিপির প্রায় সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়।
প্রাচীন মিশরের ধর্মীয় বিশ্বাস মিশরীয় পুরানে প্রতিফলিত হয়েছে। তিন হাজার বছরেরও কিছু বেশি সময় ধরে মিশরে পৌরানিক ধর্মীয় বিস্বাশ প্রচলিত ছিল। মিশরের সভ্যতা ও সংস্কৃতির পাশাপাশি তার পুরানও বিবর্তিত হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই পৌরানিক চরিত্রগুলোকে যুগ ভেদে বিভিন্ন ভূমিকায় দেখা যায়। পৌরানিক ধর্মে মূলতঃ বহু দেব-দেবীর অস্তিত্ব থাকলে, প্রাচীন সাম্রাজ্যের কালে আখেনআতেনের (৪র্থ আমেনহোতেপ) শাসনামলে কিছুকালের জন্য সূর্যদেব আতেনকে কেন্দ্র করে একেশ্বরবাদের চর্চা করতে দেখা যায়। কিন্তু আখেনআতেনের মৃত্যুর সাথে এই চর্চাও লোপ পায় এবং আগের বহু দেব-দেবী সংবলিত পৌরানিক ধর্ম ফিরে আসে।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.