Loading AI tools
শিখ ধর্ম সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় গুরু উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
গুরু অঙ্গদ ছিলেন দ্বিতীয় শিখ গুরু। ১৫০৪ সালে পাঞ্জাবের মাত্তে দি সরাই গ্রামে (অধুনা ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের মুক্তসরের কাছে সরাই নাগা গ্রাম) এক হিন্দু খাতরি পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল। প্রথম জীবনে তার নাম ছিল ভাই লহনা।[২][৩] তার বাবা ফেরু মল ছিলেন ছোটো ব্যবসায়ী। শিখধর্ম গ্রহণের পূর্বে ভাই লহনা ছিলেন হিন্দু দেবী দুর্গার পূজারি ও ধর্মশিক্ষক।[৩][৪] গুরু নানকের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ভাই লহনা শিখধর্ম গ্রহণ করেন। এরপর বেশ কয়েক বছর তিনি নিরন্তর গুরু নানকের সেবা করেন এবং শিখধর্ম প্রচার করেন। গুরু নানকই ভাই লহনাকে "অঙ্গদ" ("আমার স্বকীয় অঙ্গ") নাম দেন[৫] এবং নিজের পুত্রদের পরিবর্তে তাকেই দ্বিতীয় শিখ গুরু নির্বাচিত করেন।[৩][৪][৬]
গুরু অঙ্গদ দেব | |
---|---|
ব্যক্তিগত তথ্য | |
জন্ম | ভাই লহনা ৩১ মার্চ ১৫০৪ |
মৃত্যু | ২৯ মার্চ ১৫৫২ ৪৭) | (বয়স
ধর্ম | শিখধর্ম |
দাম্পত্য সঙ্গী | মাতা খিবি |
সন্তান | বাবা দাসু, বাবা দাত্তু, বিবি আমরো ও বিবি আনোখি |
পিতামাতা | মাতা রামো ও বাবা ফেরু মল |
যে জন্য পরিচিত | গুরমুখী লিপির প্রামাণ্যকরণ |
ধর্মীয় জীবন | |
পূর্বসূরী | গুরু নানক |
উত্তরসূরী | গুরু অমর দাস |
১৫৩৯ সালে গুরু নানকের মৃত্যুর পর থেকে গুরু অঙ্গদ শিখ সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেন।[৭][৮] শিখ সমাজ তাকে স্মরণ করে গুরমুখী লিপির প্রামাণ্যকরণ ও প্রবর্তনের জন্য।[২][৪] গুরু নানক রচিত স্তোত্রগুলি সংকলনের পাশাপাশি তিনি নিজে ৬২টি (মতান্তরে ৬৩টি) স্তোত্র রচনা করেন।[৪] নিজের পুত্রদের পরিবর্তে তিনি শিষ্য অমর দাসকে তার উত্তরসূরি তথা তৃতীয় শিখ গুরু নির্বাচিত করেন।[৭][৮]
ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরপশ্চিম অঞ্চলে পাঞ্জাব অঞ্চলের মাত্তে দি সরাই গ্রামে (অধুনা ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের মুক্তসরের কাছে সরাই নাগা গ্রাম) এক হিন্দু পরিবারে গুরু অঙ্গদের জন্ম হয়। প্রথম জীবনে তার নাম ছিল ভাই লহনা। তিনি ছিলে ফেরু মল নামে এক সচ্ছল ছোটো ব্যবসায়ীর পুত্র। তার মায়ের নাম ছিল রামো।[৯] অন্যান্য সকল শিখ গুরুর মতো লহনাও ছিলেন খাতরি বর্ণভুক্ত।[১০]
১৫২০ সালের জানুয়ারি মাসে ষোলো বছর বয়সে মাতা খিবি নাম্নী এক খাতরি বালিকার সঙ্গে লহনা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। দাসু ও দাত্তু ছিলেন তাদের দুই পুত্র। দু’টি ভিন্ন মত অনুসারে, তিনি এক অথবা দুই কন্যার (আমরো ও আনোখি) জনক ছিলেন।[৯] বাবরের আক্রমণের ভয়ে ফেরু মল তাঁর সমগ্র পরিবার নিয়ে পৈত্রিক গ্রাম ত্যাগ করে চলে আসেন বিপাশা নদীর তীরে খাদুর সাহিব গ্রামে (অধুনা তরন তারন)।
শিখধর্ম গ্রহণের পূর্বে লহনা ছিলেন হিন্দু দেবী দুর্গার পূজারি ও ধর্মশিক্ষক।[৩][৪][৯] ত্রিশ বছর বয়সের আগেই ভাই লহনার সঙ্গে গুরু নানকের সাক্ষাৎ হয়। তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে কর্তারপুরে এসে ছয় (মতান্তরে সাত) বছর আন্তরিকভাবে গুরুর সেবা করে ভাই লহনা তাঁর বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠেন।[৯][১১]
গুরু নানক কেন নিজের পুত্রদের পরিবর্তে ভাই লহনাকে তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেন, সেই বিষয়ে একাধিক শিখ জনশ্রুত প্রচলিত রয়েছে। একটি জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, একবার একটি জলপাত্র কাদায় পড়ে গেলে গুরু নানক তাঁর পুত্রদের সেটি তুলে আনতে বলেন। তাঁর এক পুত্র সেটি নোংরা বলে তুলতে অস্বীকার করেন। অপর পুত্র সেটিকে ভৃত্যসুলভ কাজ বলে এড়িয়ে যান। তখন গুরু নানক ভাই লেহনাকে সেটি তুলতে বললে, তিনি সেটি কাদা থেকে তুলে ধুয়ে পরিষ্কার করে জল ভরে গুরু নানকের কাছে নিয়ে আসেন।[১২] তখন গুরু নানক তাঁকে স্পর্শ করে তাঁর নামকরণ করেন "অঙ্গদ" এবং ১৫৩৯ সালের ১৩ জুন নিজের উত্তরসূরি তথা দ্বিতীয় নানক হিসেবে তার নাম ঘোষণা করেন।[৯][১৩]
১৫৩৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর গুরু নানকের মৃত্যুর পর গুরু অঙ্গদ কর্তারপুর ত্যাগ করে খাদুর সাহিব গ্রামে (গোইন্দবোল সাহিবের নিকটে) গ্রামে চলে আসেন। গুরু নানকই তাকে কর্তারপুর ত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কারণ উত্তরাধিকার সূত্রে গুরু অঙ্গদের গুরগদ্দি (গুরুর আসন) ছিল বিতর্কিত। গুরু নানকের দুই পুত্র শ্রী চন্দ ও লখমী দাস ছিলেন গুরগদ্দির দাবিদার।[২] গুরুপদে নির্বাচিত হওয়ার পর একটি সময় পর্যন্ত খুব অল্প সংখ্যক শিখই তার নেতৃত্ব স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু গুরু অঙ্গদ বিতর্কের দিকে দৃষ্টিপাত না করে গুরু নানকের শিক্ষার দিকে মনোনিবেশ করেন এবং লঙ্গর প্রভৃতি সেবামূলক কাজের মাধ্যমে একটি সম্প্রদায় গড়ে তোলেন।[১৪]
১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ শের শাহ সুরির হাতে পরাজিত ও সিংহাসনচ্যূত মুঘল সম্রাট হুমায়ুন গুরু অঙ্গদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন।[১৫] শিখ সন্তজীবনী অনুযায়ী, হুমায়ুন যখন খাদুর সাহিবের গুরদ্বারা মাল আখারা সাহিবে উপস্থিত হন, গুরু অঙ্গদ তখন বসে সঙ্গতের স্তোত্রগান শুনছিলেন। সেই অবস্থায় উঠে দাঁড়িয়ে সম্রাটকে অভিবাদন জানানো তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ক্রুদ্ধ হুমায়ুন তৎক্ষণাৎ তরবারি বের করেন। সেই সময় গুরু অঙ্গদ তাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, সিংহাসন হারানোর সময় যুদ্ধ না করে সম্রাট পলায়ন করেছিলেন; আর এখন তিনি প্রার্থনারত ব্যক্তিতে আক্রমণে উদ্যত হয়েছেন।[১৬] এই ঘটনার এক শতাব্দীরও পরে লেখা শিখ গ্রন্থগুলিতে উল্লিখিত হয়েছে যে, গুরু অঙ্গদ সম্রাটকে আশীর্বাদ করেছিলেন এবং একদিন তিনি নিজের সিংহাসন ফিরে পাবেন বলে আশ্বাসও দেন।[১৪]
মৃত্যুর পূর্বে গুরু অঙ্গদ তার উত্তরাধিকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরু নানকেরই ঐতিহ্য অনুসরণ করেন। তিনি নিজের পুত্রের পরিবর্তে অমর দাসকে তার উত্তরাধিকার তথা তৃতীয় নানক নির্বাচিত করেন। শিখধর্ম গ্রহণের পূর্বে অমর দাস ছিলেন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত ধর্মপ্রাণ হিন্দু। হরিদ্বার সহ হিমালয়ের কুড়িটি তীর্থ তিনি পর্যটন করেছিলেন বলে জানা যায়। ১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দে এমনই এক তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে এক হিন্দু সাধুর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। সেই সাধু তাকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন তিনি গুরুর আশ্রয় নেননি। সাধুর কথায় অমর দাস গুরুর অনুসন্ধান শুরু করেন।[৭] তীর্থ থেকে ফেরার পথে অমর দাস বিবি আমরোকে গুরু নানক রচিত একটি স্তোত্র গাইতে শোনেন। বিবি আমরো ছিলেন গুরু নানকের কন্যা এবং এক হিন্দু পরিবারে বিবাহিতা।[১৭] তার কাছেই অমর দাস গুরু অঙ্গদের কথা শোনেন এবং তারই সহায়তায় সেই বছরই তিনি উপস্থিত হন গুরু অঙ্গদের কাছে। গুরু অঙ্গদ নিজে অমর দাসের থেকে বয়সে অনেক ছোটো হলেও অমর দাস তাকেই নিজের গুরুপদে বরণ করেন।[৭]
অমর দাস হয়ে ওঠেন গুরু অঙ্গদের একনিষ্ঠ ভক্ত ও সেবক। শিখ জনশ্রুতি অনুযায়ী, খুব ভোরে উঠে তিনি গুরুর স্নানের জল আনতেন, ঘর পরিষ্কার করতেন এবং গুরু ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য রান্না করতেন। তা সত্ত্বেও সকালে ও সন্ধ্যায় অনেকটা সময় ধ্যান ও প্রার্থনায় ব্যয়িত করতেন।[৭] ১৫৫২ খ্রিষ্টাব্দের নিজের একমাত্র জীবিত পুত্র শ্রী চন্দের পরিবর্তে উত্তরসূরি হিসাবে অমর দাসের নাম ঘোষণা করেন গুরু অঙ্গদ।[৮][১৭][১৮] ১৫৫২ সালের ২৯ মার্চ গুরু অঙ্গদের মৃত্যু হয়।[৯]
শিখরা বিশ্বাস করেন যে, গুরু অঙ্গদই গুরমুখী লিপির প্রবর্তন করেন। এই লিপিটি ভারতে পাঞ্জাবি ভাষার প্রামাণ্য হরফ হিসাবে গৃহীত[১৯] (পাকিস্তানে নাস্তালিক নামে পরিচিত আরবি লিপিটি পাঞ্জাবি ভাষার প্রামাণ্য হরফ[২০])। শিখদের আদি ধর্মগ্রন্থ ও অধিকাংশ ঐতিহাসিক শিখ সাহিত্য গুরমুখী হরফে লিপিবদ্ধ।[১৯]
গুরু অঙ্গদ প্রবর্তিত লিপিটি ছিল উত্তর ভারতে পূর্বপ্রচলিত ইন্দো-ইউরোপীয় লিপিগুলিরই সংশোধিত একটি রূপ।[২১] সম্ভবত গুরু অঙ্গদ কর্তৃক গৃহীত হওয়ার আগেই এটির স্বতন্ত্র বিকাশ শুরু হয়েছিল। কোল ও সাম্ভি গুরু নানক রচিত একটি স্তোত্রকে এই লিপিমালার পূর্ব-অস্তিত্বের প্রমাণ বলে মনে করেন।[২২]
গুরু অঙ্গদ ৬২টি (মতান্তরে ৬৩টি) সলোক (গীতি) রচনা করেন। শিখদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ গুরু গ্রন্থ সাহিবের অন্তর্গত এই রচনাগুলি উক্ত গ্রন্থের প্রায় এক শতাংশ স্থান অধিকার করে রয়েছে।[২৩]
গুরু অঙ্গদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল প্রত্যেক শিখ ধর্মস্থানে লঙ্গর প্রথাটিকে প্রণালীবদ্ধকরণ। এই লঙ্গরগুলিতে স্থানীয় এবং দূরাগত সকল দর্শনার্থীদের একত্রে বসিয়ে বিনামূল্যে সাধারণ খাদ্য পরিবেশন করা হয়।[২][২৪] তাছাড়া তিনি শিখ সেবাদারদের (স্বেচ্ছাসেবক) আচরণবিধি ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতিও বিধিবদ্ধ করেন। এই সেবাদারদের কাজ ছিল পাকশালার কার্যপরিচালনা। গুরু অঙ্গদ তাদের সামনে এই পাকশালাকে বিশ্রামস্থল হিসাবে দেখার আদর্শ স্থাপন করেন এবং অতিথিপরায়ণতা ও সকল দর্শনার্থীর প্রতি নম্র আচরণের শিক্ষা দান করেন।[২]
গুরু নানক ধর্মপ্রচারের জন্য একাধিক কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। গুরু অঙ্গদ সেই সকল কেন্দ্র এবং অন্যান্য অনেক স্থান পরিদর্শন করেন। সেই সঙ্গে আরও কয়েকটি নতুন ধর্মপ্রচার কেন্দ্র স্থাপন করে তিনি শিখধর্মের ভিত্তি সুদৃঢ় করেন।[২]
গুরু অঙ্গদ ছিলেন শরীরচর্চার একজন উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক।[২৫] ব্যায়াম, যুদ্ধকৌশল ও মল্লযুদ্ধ শিক্ষার জন্য তিনি একাধিক মল্ল আখাড়া (মল্লযুদ্ধের আখড়া) চালু করেন। শরীরচর্চার পাশাপাশি এই সব আখড়ায় তামাক ও অন্যান্য মাদক দ্রব্য বর্জনের উপদেশ দানের মতো স্বাস্থ্যবিষয়ক আলোচনাও চলত।[২৬][২৭] প্রতিদিন ব্যায়াম করে ও অন্যান্য উপায়ে শরীর সুস্থসবল রাখার উপর গুরু অঙ্গদ বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন।[২৭]
গুরু অঙ্গদ অনেক গ্রামে এই জাতীয় আখড়া স্থাপন করেছিলেন। তার মধ্যে খান্দুরেই স্থাপন করেছিলেন একাধিক আখড়া।[২৮] সাধারণত দৈনিক প্রার্থনার পর মল্লযুদ্ধ অনুশীলন করা হত এবং খেলাধুলা ও হালকা কুস্তিও আখাড়াগুলিতে আয়োজিত হত।[২৯]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.