Loading AI tools
মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ-এর প্রথম স্ত্রী (৫৫৫—৬২০ খ্রিঃ) উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ ( আরবি: خَدِيجَة بِنْت خُوَيْلِد, প্রতিবর্ণীকৃত: খাদিজাতু বিনতে খুওয়াইলিদ ; আনু. ৫৫৫ – ৬২০) [3] ছিলেন ইসলামের নবী মোহাম্মাদ সা. এর প্রথম স্ত্রী[4] এবং প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তি। তিনি সাধারণত খাদিজা বা খাদিজাতুল কুবরা নামে পরিচিত। খাদিজা ছিলেন মক্কার কুরাইশ বংশের নেতা খুওয়ালিদ ইবনে আসাদের কন্যা এবং নিজ প্রচেষ্টায় সফল একজন ধনাঢ্য ও ব্যবসায়ী মহিলা। খাদিজাকে মুসলমানরা উম্মুল মুমিনিন (মুসলমানদের মাতা) বলে উল্লেখ করে থাকেন এবং তাঁর নামের শেষে সম্মান ও প্রার্থনা হিসেবে সালামুল্লাহি আলাইহা (سَلَامُ ٱللَّٰهِ عَلَيْهِ তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক) বলে থাকেন।
খাদিজা (সালামুল্লাহি আলাইহা) | |
---|---|
خديجة (سَلَامُ ٱللَّٰهِ عَلَيْهِ) | |
জন্ম | খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ ৫৫৫[1] খ্রিঃ অথবা ৫৬৭ খ্রিঃ |
মৃত্যু | ১০ রমজান (প্রাচীন আরবি বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী)[2] ২২ নভেম্বর[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ৬১৯ (বয়স ৬৩–৬৪) অথবা ৬১৯ (বয়স ৫১–৫২) মক্কা |
সমাধি | জান্নাতুল মুয়াল্লা, মক্কা |
অন্যান্য নাম | খাদিজাতুল কুবরা |
পরিচিতির কারণ | ইসলামের নবী মুহাম্মাদের প্রথম স্ত্রী, মুমিনদের মাতা |
উপাধি | উম্মাহাতুল মুমিনীন, আমিরাত-কুরাইশ, আল-তাহিরা |
দাম্পত্য সঙ্গী |
|
সন্তান | পুত্রগণ: ‘আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আতিক, হালাহ ইবনে আবি হালাহ, হিন্দ ইবনে আবি হালাহ, কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ, আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ কন্যাগণ: হিন্দা বিনতে ‘আতিক, জয়নব বিনতে আবি হালাহ, জয়নব বিনতে মুহাম্মাদ, রুকাইয়াহ বিনতে মুহাম্মাদ, উম্মে কুলসুম বিনতে মুহাম্মাদ, ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ |
পিতা-মাতা |
|
আত্মীয় | নাতিঃ হাসান ইবনে আলী, হোসাইন ইবনে আলী, আব্দুল্লাহ ইবনে উসমান নাতনিঃ উমামা বিনতে আবিল আস, জয়নব বিনতে আলী, উম্মে কুলসুম বিনতে আলী আসাদ বিন আল-উজ্জা (দাদা) হালা বিনতে খুওয়াইলিদ (বোন) ওয়ারাকা ইবনে নওফল (চাচাতো ভাই) |
পরিবার | আহল আল-বাইত (বিবাহের পর) |
তিনি ইসলামে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মহিলা ব্যক্তিত্ব এবং সকল মুসলিম খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতিমা, আসিয়া ও মরিয়ম বিনতে ইমরান এই চারজন নারীকে অত্যন্ত মর্যাদাবান, জান্নাতী রমণী হিসেবে সম্মান করে থাকেন। [5] মুহাম্মাদ সা. পঁচিশ বছর তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন এবং তার জীবদ্দশায় অন্যকোন স্ত্রী গ্রহণ করেননি।
হোক নবী -য়ের ভালোবাসা পাওয়া ও তাকে মানসিক প্রশান্তি প্রদান,সকল ক্ষেত্রে সঠিক পরামর্শ,সম্পদ অর্থবৃত্ত ও সময় দিয়ে ইসলামের খেতমদ ও নবী -য়ের সহযোগীতা অথবা ৭ জন সন্তান জন্মদান করে নবী )-য়ের বংশধরদের পৃথিবীতে আনা সকল ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সর্বগুনে গুনান্বিত সর্বশ্রেষ্ঠ নারী ও নবী সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী।যেমনটা পরবর্তীকালে আর অন্য কোন স্ত্রীর ক্ষেত্রে দেখা যায় না।খাদিজা -য়ের প্রতি নবী -য়ের ভালোবাসা ছিল এমন যে খাদিজার ইন্তেকালের বহু বহু বছর পর পর্যন্ত নবী উনার কথা বার বার স্বরণ করতেন।এমনকি বাড়িতে ভালো খাদ্য রান্না হলে নবী তা খাদিজা -য়ের বান্ধুবীদের বাড়িতে পাঠাতেন।নবী -য়ের অগাধ ভালোবাসায় উনার বাকি স্ত্রীরা প্রায়ই অভিযোগ করলে তিনি তাদেরকে খাদিজার বিশেষত্ব ও সকলের উপর তার শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলে থামিয়ে দিতেন।
হস্তী বর্ষের ১৫ বছর পূর্বে আনু. ৫৫৫ খৃষ্টাব্দে হযরত খাদিজা মক্কার কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কুনিয়াত উম্মে হিন্দ ও লকব ছিল ত্বাহেরাহ। খাদিজার পিতা খুওয়ালিদ ইবনে আসাদ ছিলেন একজন বণিক[6][7] ও নেতা। কিছু সূত্র অনুসারে, তিনি ফিজার যুদ্ধে আনুমানিক ৫৮৫ সালে মারা যান। কিন্তু অন্যদের মতে, খাদিজা যখন ৫৯৫ সালে মুহাম্মাদকে বিয়ে করেন তখনও তিনি জীবিত ছিলেন।[8][9]উম্মে হাবিব বিনতে আসাদ নামে খুওয়াইলিদের একজন বোন ছিল।[10]
খাদিজার মা ফাতিমা বিনতে জাইদাহ, যিনি আনুমানিক ৫৭৫ সালে মারা যান,[11]তিনি ছিলেন কুরাইশের আমির ইবনে লুয়াই গোত্রের সন্তান[12] এবং মুহাম্মাদের মায়ের তৃতীয় চাচাতো বোন ছিলেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
খাদিজা খুব সফল একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। ইবন সা'দ তার ব্যবসা সম্পর্কে বলেছেন, কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা যখন গ্রীষ্মকালীন সিরিয়া যাত্রা বা ইয়েমেনে শীতকালীন যাত্রা শুরু করার জন্য পণ্য-সামগ্রী জড়ো করত, তখন খাদিজার একার পণ্য-কাফেলা কুরাইশদের অন্য সকলের বাণিজ্য-কাফেলার সমান হত। ইবনে সা'দের এ মন্তব্য দ্বারা খাদিজার ব্যবসায়ের পরিধি উপলব্ধি করা যায়[13] খাদিজার সাথে যুক্ত সম্মানসূচক উপাধির মধ্যে ছিল, "আমিরাত-কুরাইশ" (কুরাইশের রাজকুমারী), "খাদিজা আল-কুবরা" (মহান খাদিজা)।[14] কথিত আছে যে তিনি দরিদ্রদের খাওয়াতেন এবং বস্ত্র বিতরণ করতেন, তার আত্মীয়দের আর্থিকভাবে সহায়তা করতেন।[14] খাদিজা সম্পর্কে বলা হয় যে ইসলাম আর্বিভাবের পূর্বেও তিনি প্রতিমা পূজা বিশ্বাস করতেন না, যা প্রাক-ইসলামি আরব সংস্কৃতির জন্য খুব সাধারণ ছিল।[15]
নারী হওয়ার কারণে খাদিজা বিদেশে বা অন্য শহরে ব্যবসা পরিচালনার জন্য নিয়মিত সফর করতে পারতেন না বলে ব্যবস্থাপকের মাধ্যমে এ সমস্ত কাজ করাতেন। কিন্তু সেই ব্যবস্থাপকের গতিবিধি এবং তার বিশ্বস্ততা যাচাইয়ের জন্য কাফেলার সঙ্গে তার নিজস্ব বিশ্বস্ত প্রতিনিধি প্রেরণ করতেন। ব্যবস্থাপকের ভালো-মন্দ যাচাই করার জন্য এটা ছিল তার স্বতন্ত্র একটি ব্যবসায়িক কৌশল।
৫৯৫ সালে সিরিয়ায় বাণিজ্যিক কাফেলা প্রেরণের জন্য খাদিজার একজন সহকর্মীর প্রয়োজন ছিল। তিনি এ কাজের জন্য মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহকে বেছে নেন যেহেতু কুরাইশদের কাছে মুহাম্মাদ তখন "আল-আমিন" বা "বিশ্বাসী" উপাধি পেয়ে পরিচিত ছিলেন। খাদিজা লোক মারফত মুহাম্মাদের কাছে প্রস্তাব পাঠালেন, তিনি যদি ব্যবসায়ের দ্বায়িত্ব নিয়ে সিরিয়া যান, অন্যদের তুলনায় খাদিজা তাকে দ্বিগুণ মুনাফা দেবেন। মুহাম্মাদ রাজি হলেন। তার চাচা আবু তালিবের অনুমতি ক্রমে তাকে খাদিজার পণ্য-সামগ্রী ও এক বিশ্বস্ত দাস মাইসারা সহ সিরিয়ায় পাঠানো হয়।[16] [17]পথে এক গীর্জার পাশে একটি গাছের ছায়ায় মুহাম্মাদ বিশ্রামের জন্য বসলেন। গীর্জার পাদ্রী এগিয়ে গেলেন মাইসারার দিকে। জিজ্ঞেস করলেন, গাছের নিচে বিশ্রামরত লোকটি কে? মাইসারা বললেন, মক্কার হারাম-বাসী কুরাইশ গোত্রের একটি লোক। পাদ্রী বললেন, এখন এই গাছের নীচে যিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি একজন নবী ছাড়া আর কেউ নন। ঐতিহাসিকরা এই পাদ্রীর নাম 'নাসতুরা' বলে উল্লেখ করেছেন[18] তবে ইবনে হাজার আসকালানী এই পাদ্রীর নাম 'বুহাইরা' বলেছেন।[19] মুহাম্মাদ সিরিয়ার বাজারে পণ্যদ্রব্য বিক্রি করলেন এবং যা কেনার তা কিনলেন। তারপর মাইসারাহকে সঙ্গে করে মক্কার পথে রওয়ানা হলেন৷ পথে মাইসারাহ লক্ষ্য করলেন, মুহাম্মাদ তার উটের ওপর সওয়ার হয়ে চলেছেন আর আকাশে দুটো পাখি দুপুরের প্রছন্ড রোদ্রে তার ওপর ছায়া বিস্তার করে রেখেছে।[20] ফিরে আসার সময়, ব্যবসায় দ্বিগুণের কাছাকাছি লভ্যাংশ নিয়ে ফিরলেন মুহাম্মাদ। মাইসারাহ খাদিজার কাছে তার উচ্চকিত প্রশংসা করলেন এবং পাদ্রীর মন্তব্য ও সফরের ঘটনাবলী সবিস্তার বর্ণনা করলেন। [21] খাদিজা ছিলেন একজন বিচক্ষণ মহিলা। তাঁর ধন-সম্পদ, ভদ্রতা ও বুদ্ধিমত্তায় মক্কার সর্বস্তরের মানুষ মুগ্ধ ছিল। অনেক অভিজাত কুরাইশ যুবকই তাকে সহধর্মিণী হিসেবে লাভ করার প্রত্যাশী ছিল। তিনি তাদের সবাইকে প্রত্যাখ্যান করে মাইসারার মুখে মুহাম্মাদের উন্নত চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের প্রশংসা শুনে মুগ্ধ হয়ে যান এবং তার নিকট বিয়ের প্রস্তাব পাঠান।[22]
খাদিজা সর্বমোট তিনবার বিবাহ করেছিলেন। পিতা খুওয়াইলিদ তৎকালীন আরব সমাজের বিশিষ্ট তাওরাত ও ইঞ্জিল বিশেষজ্ঞ ওয়ারাকা ইবনে নওফলকে খাদিজার বর নির্বাচন করেছিলেন, কিন্তু কেন যে তা বাস্তবে রূপ লাভ করেনি সে সম্বন্ধে স্পষ্ট কিছু জানা যায় নি। শেষ পর্যন্ত আবু হালা ইবন জারারাহ আত-তামিমির সাথে তাঁর প্রথম বিয়ে হয়। ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বেই তার মৃত্যু হয়। আবু হালা ও খাদিজা দম্পতির ঘরে হালা ও হিন্দ নামে দুইজন পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। হিন্দ পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবী হয়েছিল। হালার কথা জানা যায়নি । হিন্দ বদর যুদ্ধে মতান্তরে উহুদ যুদ্ধে মুহাম্মাদের সাথে অংশগ্রহণ করেন। হযরত আলীর শাসনামলে উটের যুদ্ধ শুরু হলে তিনি হযরত আলীর পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করেন। সেই যুদ্ধে হিন্দ মারা যান।[23]
তবে অন্য একটি বর্ণনা মতে, প্রথম স্বামীর ঘরে খাদিজার তিনটি সন্তান জন্মলাভ করে। দুই ছেলে— হিন্দ ও হারিস এবং এক কন্যা যয়নাব। হারিসকে এক কাফির কাবা ঘরের রুকনে ইয়ামনীর কাছে হত্যা করে ফেলে।[24]
প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর আতিক বিন আবিদ আল-মাখযুমির সাথে খাদিজার দ্বিতীয় বিয়ে হয়।[25] তবে কা'তাদা এবং ইবনে ইসহাকের মতে তার প্রথম স্বামী আতিক এবং দ্বিতীয় স্বামী আবু হালা। ইবন ইসহাকের এই মত ইউনুস ইবন বুকাইরের বর্ণনায় পাওয়া যায়।[26] অবশ্য প্রথমোক্ত মতটিই অধিক গ্রহণযোগ্য। ইবনে হাজারের বর্ণনায় জানা যায় ইবনে আবদুল বারসহ আরো অনেক বিশেষজ্ঞই প্রথম মতটি ব্যক্ত করেছেন।[27]
দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে খাদিজার 'হিন্দা নাম্নী' নামে একজন কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তার কুনিয়াত ছিলো 'উম্মু মুহাম্মাদ'। হিন্দা পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।[28] খাদিজার দ্বিতীয় স্বামীও মারা যায়।
ইবনে শাহরাশুব তার 'আল-শাফি' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, খাদিজা যখন মুহাম্মাদকে বিয়ে করেছিলেন তখন তিনি কুমারী ছিলেন। (শায়েখ আল-তুসি তার আল-তালকিসে একই রকম বর্ণনা করেছেন)[29] তাদের মতে, হেজাজের তৎকালীন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবং খাদিজার যে বংশীয় উচ্চ অবস্থান ও মর্যাদা ছিল তা থেকে ধারণা করা যায় যে, তিনি বনু তামিম ও বনু মাখজুমের (দুটি নিম্ন বংশ) পুরুষদের বিয়ে করবেন এটা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব।[30]
কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে, খাদিজা দুটি দত্তক সন্তান লালন-পালন করতেন। যারা ছিল খাদিজার বোন হালার সন্তান। হালার স্বামীর মৃত্যুর পর খাদিজা হালার সন্তানদের দেখাশোনা করেছেন।[31]
পরপর দুইজন স্বামীর মৃত্যুর পর, খাদিজা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর বিয়ে করবেন না। তিনি ছিলেন ধনী, প্রভাবশালী এবং একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। সে যুগের অনেক নামী ও সম্ভ্রান্ত পুরুষ তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন - তিনি সাড়া দেননি। কিন্তু মুহাম্মাদের সাথে পরিচয় হবার পর সেই মানুষটির মধ্যে খাদিজা এমন কিছু অসামান্য গুণাবলী দেখেছিলেন - যা বিয়ে সম্পর্কে তার মনোভাব বদলে দেয়। খাদিজা নিজেই মুহাম্মাদকে পছন্দ করে নেন এবং বিয়ের প্রস্তাব দেন।
তাদের এই বিয়েতে সাফিয়্যার অনেক ভূমিকা ছিল। সাফিয়্যা ছিলেন মুহাম্মাদের আপন ফুফু এবং হামযার আপন বোন। অন্যদিকে, সফিয়্যা ছিলেন খাদিজার ছোট ভাই আওয়ামের স্ত্রী বা প্রখ্যাত সাহাবী যুবাইরের মা। খাদিজা ইতোমধ্যেই ছোট ভাই-বউ সাফিয়্যার কাছে আল-আমীন মুহাম্মাদের সম্পর্কে বহু প্রশংসা শুনেছেন যা খাদিজার মুহাম্মাদের প্রতি মুগ্ধতায় একটা ভূমিকা রেখেছিল।[32]
ইয়ালার স্ত্রী ও খাদিজার বান্ধবী 'নাফিসা বিনতে মানিয়্যা' বিবাহের ব্যাপারে উভয়ের মধ্যে মধ্যস্থতা করেছেন। তিনিই সর্বপ্রথম খাদিজার হয়েমুহাম্মাদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান। এরপর দুই পক্ষের সম্মতিতে তাদের বিয়ে হয়।[33]
তাদের বিয়েতে আবু তালিব, হামযাহ সহ অনেক বিশিষ্ট কুরাইশ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। সকলের সামনে বিয়ের খুৎবা প্রদান করেন আবু তালিব। আরবী গদ্যসাহিত্যে এই খুৎবা এখনো বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বিয়ের মোহরানা ছিলো ৫০০ স্বর্ন মুদ্রা।[34] খাদিজা নিজেই দুই পক্ষের খরচাদি বহন করেন। তিনি দুই উকিয়া সোনা ও রুপা মুহাম্মাদ কে দেন , যেন তা দিয়ে উভয়ের পোশাক ও ওয়ালীমার (বৌভাত অনুষ্ঠান) আয়োজন করতে পারেন।[35] এ বিয়ে হয়েছিল মুহাম্মাদ(সা:) নবুয়ত প্রাপ্তির ১৫ বছর পূর্বে। বিয়ের সময় মুহাম্মাদের বয়স ছিলো ২৩ অথবা ২৫ বছর এবং খাদিজার বয়স ছিলো ৪০ বছর।[36][37][38][39][40][41][42][43] কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, বিয়ের সময় খাদিজার বয়স ছিলো ২৮ অথবা ৩০ বছর।[44][45] তবে প্রথম মতটিই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য। বিয়ের পর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সংসারে এসে নিজেকে পূর্ণভাবে সঁপে দিয়েছিলেন খাদিজা (রা.)। ব্যবসার সব দায়িত্ব এবং সব ধনসম্পদ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে অর্পণ করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ–তায়ালা আমাকে খাদিজার চেয়ে উত্তম বিকল্প দান করেননি।’ (সীরাত বিশ্বকোষ, ২/১৩৮)[46]
মুহাম্মদের ঘরে খাদিজার ৬ জন অথবা ৮ জন সন্তান জন্মগ্রহণ করে[47](সন্তানদের সংখ্যা নিয়ে ঐতিহাসিকদের ভেতর মতপার্থক্য রয়েছে। আত-তাবারির মতে ৮ জন; প্রথম দিকের ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাকের মতে ৭ জন। তবে অধিকাংশ জীবনিকার ৬ জন সন্তান বর্ণনা করেছে এবং এটাই প্রসিদ্ধ)[48] তাদের প্রথম সন্তান কাসিম। অল্প বয়সে কাসিম মক্কায় মৃত্যুবরণ করে। এই সন্তানের নাম অনুযায়ীমুহাম্মাদের নাম হয় আবুল কাসিম(অর্থাৎ, কাসেমের বাবা)।েরপর জন্ম হয় যয়নব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম এবং ফাতিমা। শেষ সন্তান আব্দুল্লাহ জন্মগ্রহণ করে ইসলাম ধর্ম আগমনের পর। তাই তার উপাধি হয় "তাইয়্যেব(পুণ্যবান) ও তাহির(পবিত্র)"। আব্দুল্লাহও অল্প বয়সে মারা যান। খাদিজা উকবার দাসী সালামাকে সন্তানদের দেখাশোনা করার জন্য নিয়োগ দিয়েছিলেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এরা ছাড়াও খাদিজার ঘরে আরো দু'জন সন্তান বেড়ে উঠেছিল। এদের একজন আলী ইবনে আবি তালিব, যে ছিল মুহাম্মাদের চাচা আবু তালিবের সন্তান এবং অন্যজন যায়েদ ইবনে হারেসা, সে ছিল খাদিজার কৃতদাস যাকে পরবর্তীতে মুহাম্মাদ মুক্ত করে দেন এবং নিজের পালক পুত্র হিসেবে বড় করেন[49]
মুহাম্মদ তৎকালীন আরবের সামাজিক অবক্ষয়, যুদ্ধ-বিগ্রহ, হিংসা, হানাহানি থেকে মানুষের মুক্তি কীভাবে হবে তা নিয়ে চিন্তা করতেন। ত্রিশ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর মুহাম্মাদ প্রায়ই মক্কার অদূরে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেন। কয়েকদিনের খাবার সঙ্গে নিয়ে সেখানে চলে যেতেন, একাধারে কয়েকদিন ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। খাবার শেষ হয়ে গেলে খাদিজার কাছে ফিরে আসতেন। খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আবার গুহায় ফিরে যেতেন। মাঝে মাঝে তার স্ত্রী খাদিজা তাকে খাবার দিয়ে আসতেন। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী এমনি একদিন ধ্যানের সময় ফেরেশতা জিবরাঈল তার কাছে আল্লাহপ্রেরিত বাণী নিয়ে আসেন এবং তাকে কিছু পঙ্ক্তি দিয়ে পড়তে বলেন। উত্তরে মুহাম্মাদ জানান যে তিনি পড়তে জানেন না, এতে জিবরাইল তাকে জড়িয়ে ধরে প্রবল চাপ প্রয়োগ করেন এবং আবার একই পঙ্ক্তি পড়তে বলেন। কিন্তু এবারও মুহাম্মাদ নিজের অপারগতার কথা প্রকাশ করেন। এভাবে তিনবার চাপ দেওয়ার পর মুহাম্মাদ পঙ্ক্তিটি পড়তে সমর্থ হন। মুসলিমদের ধারণা অনুযায়ী এটিই কুরআনের প্রথম আয়াত গুচ্ছ;
“ |
|
” |
সুরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত। বর্ণনায় আরও উল্লেখ আছে এ ঘটনার পর মুহাম্মাদ এতই ভীত হয়ে পড়েন যে কাঁপতে কাঁপতে নিজ গৃহে প্রবেশ করেই খাদিজাকে কম্বল দিয়ে নিজের গা জড়িয়ে দেওয়ার জন্য বলেন। বারবার বলতে থাকেন, "আমাকে আবৃত কর"। খাদিজা আবৃত করলেন। তাঁর ভয় দূরীভূত হলে তিনি খাদিজাকে পুরো ঘটনা খুলে বললেন এবং নিজের জীবনের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করলেন। খাদিজা বললেনঃ "না, তা কক্ষনো হতে পারে না। আল্লাহর কসম, তিনি আপনাকে লাঞ্চিত করবেন না। আপনি আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ়কারী, গরীব-দুঃখীর বোঝা-বহনকারী, অতিথিপরায়ণ ও মানুষের বিপদে সাহায্যকারী।"[50] খাদিজা মুহাম্মাদের সকল কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেন এবং তাকে নবী হিসেবে মেনে নেন। অতঃপর খাদিজা মুহাম্মাদকে সংগে করে তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন নওফলের কাছে যান। নওফল ছিলেন খৃষ্টান ধর্মের একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি হিব্রু ভাষায় ইনজীল কিতাব লিখতেন। তিনি বয়সের ভারে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েছিলেন৷ খাদিজা তাকে বললেন, "শুনুন তো আপনার ভাতিজা কি বলে।" নওফল জিজ্ঞেস করলেন, "ভাতিজা তোমার বিষয়টি কি?" মুহাম্মাদ তাকে পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন। শুনে ওয়ারাকা বললো, "এতো সেই 'নামুস' যাকে আল্লাহ মুসার নিকট পাঠিয়েছিল। আফসোস! সেদিন যদি আমি জীবিত ও সুস্থ থাকতাম, যেদিন তোমার কওম তোমাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে।" মুহাম্মাদ জিজ্ঞেস করলেন, এরা আমাকে দেশ থেকে বের করে দেবে? তিনি বললেন, "হ্যাঁ, অতীতে যিনিই তোমার মত কিছু নিয়ে এসেছেন তাঁর সঙ্গেই শত্রুতা করা হয়েছে। সেদিন যদি আমি বেঁচে থাকি, তবে তোমাকে সাহায্য করব।"[51] এ ঘটনার অল্প কিছুদিন পর ওয়ারাকার মৃত্যু হয়। এভাবে খাদিজা হয়ে যান ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি।
ইসলাম ধর্মের সূচনা-লগ্নে মুহাম্মাদকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছিলেন খাদিজা। ইসলাম গ্রহণের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল পঞ্চান্ন বছর। তাঁর ইসলাম গ্রহণের প্রভাব তাঁর পিতৃকুলের লোকদের ওপরও পড়েছিল। ইসলাম আবির্ভাবের সময় পিতৃকুল বনু আসাদ ইবনে আব্দিল উযযার পনের জন বিখ্যাত ব্যক্তি জীবিত ছিল, তাদের দশজনই ইসলাম গ্রহণ করে। অন্য পাঁচজন কাফির অবস্থায় বদর যুদ্ধে নিহত হয়।[52][53]
খাদিজা ইসলাম প্রচারের জন্য মুহাম্মাদকে তাঁর সব সম্পদ দিয়ে দেন। খাদিজার সমস্ত সম্পদ মুহাম্মাদ দান করে দিতে থাকেন। এতে খাদিজা তাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে প্রচন্ড অর্থকষ্ট শুরু হয়, অনাহারে খোলা মাঠে দিন কাটাতে হয়। নবুওয়তের সপ্তম বছরে মক্কার কুরাইশরা মুহাম্মাদের গোত্র বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করে। তাদের সবাইকে "শিয়াবে আবু তালেব" নামক স্থানে বন্দী করা হয় । অন্যান্য মুসলিমদের সাথে খাদিজাও সেখানে ছিলেন। প্রায় ৩ বছর তারা সেখানে বন্দি ছিলেন। তখন গাছের পাতা খেয়েও দিন কাটাতে হয়েছে তাদের।[54] খাদিজা তখন কুরাইশদের ওপর নিজের প্রভাব খাটিয়ে খাদ্যের ব্যবস্থা করে দিতেন মুসলিমদের। তার তিন ভাতিজা- হাকিম বিন হিযাম, আবুল বুখতারি ও যায়মা ইবনুল আসওয়াদ, তারা সবাই ছিলেন কুরাইশ নেতা। এই ৩ ভাতিজার মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে খাদ্য সরবরাহ করতেন খাদিজা এবং শিয়াবে আবু তালিব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এই তিন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে কাজে লাগিয়ে বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবকে সহযোগিতা করেছিলেন তিনি। [55]
মুহাম্মাদের জন্য খাদিজা ছিল এক বড় আশ্রয়। পঁচিশ বছর পর্যন্ত তিনি মুহাম্মাদের জীবনসঙ্গিনী ছিলেন। এ সুদীর্ঘ সময়ে দুঃখে-কষ্টে, বিপদ-আপদে এবং ইসলাম প্রচারে খাদিজা ছিল তার সবচেয়ে কাছের মানুষ। মুশরিকদের প্রত্যাখ্যান ও অবিশ্বাসের কারণে মুহাম্মাদ যে ব্যথা অনুভব করতেন, খাদিজার কাছে এলে তা দূর হয়ে যেত। কারণ, তিনি তাকে সান্তনা দিতেন, সাহস ও উৎসাহ যোগাতেন। মুহাম্মাদের সব কথাই তিনি বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করতেন৷ মুশরিকদের সব অমার্জিত আচরণ তিনি তার কাছে অত্যন্ত হালকা ও তুচ্ছভাবে তুলে ধরতেন। মুহাম্মাদ পরবর্তী জীবনে তাঁর সম্পর্কে বলতেনঃ
“ |
|
” |
মুহাম্মদের সাথে বিয়ে হওয়ার ২৫ বছর পর নবুয়তের দশম বর্ষের রমজান মাসে ৬৫ বছর(মতান্তরে ৫২ বছর) বয়সে খাদিজা মক্কায় ইন্তেকাল করেন। তখনও ইসলাম ধর্মে মৃত ব্যক্তির জন্য জানাযার নামায পড়ার বিধান ছিলো না। তাই তাকে জানাযা ছাড়াই মক্কার কবরস্থান জান্নাতুল মুয়াল্লায় দাফন করা হয়। মুহাম্মাদ নিজেই তার লাশ কবরে নামান। সে সময় মুহাম্মাদের বয়স ছিল ৫০ বছর[57]
মুহাম্মাদ প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজার স্মৃতি তাঁর মৃত্যুর পরও ভোলেনি। খাদিজার মৃত্যুর পর বাড়িতে যখনই কোন পশু জবেহ হতো, তিনি তালাশ করে তাঁর বান্ধবীদের ঘরে ঘরে গোশত পাঠিয়ে দিতেন। আয়িশা বলেনঃ "যদিও আমি খাদিজাকে দেখিনি, তবুও তাঁর প্রতি আমার ঈর্ষা হতো। অন্য কারো বেলায় কিন্তু এমন হতো না। কারণ, আল্লাহর রাসুল সবসময় তাঁর কথা স্মরণ করতেন।" মাঝে মাঝে আয়িশা মুহাম্মাদকে রাগিয়ে তুলতেন। বলতেন, "আপনি একজন বৃদ্ধার কথা মনে করছেন যিনি মারা গেছেন। আল্লাহ তাঁর চেয়ে অনেক উত্তম স্ত্রী আপনাকে দান করেছেন।" জবাবে মুহাম্মাদ বললেন, "কক্ষনো না। সবাই যখন আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছিল, তখন সে আমাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে।" মুহাম্মাদ বলতেন, "আল্লাহ আমার অন্তরে খাদিজার জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন।" [58]
ইসলাম ধর্মে খাদিজার মর্যাদা অন্যান্য মহিলাদের চেয়ে অনেক উপরে। তিনি প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী ব্যক্তি।একটি হাদিসে মুহাম্মাদ বলেছেন, "পৃথিবীর বুকে সর্বোত্তম নারী মরিয়ম বিনতে ইমরান ও খাদিজা বিনতু খুওয়াইলিদ।"[59] খাদিজা ছিলেন মুহাম্মাদের সাথে প্রথম নামায আদায়কারী ব্যক্তি।[60]
আফীক আলা-কিন্দী নামক এক ব্যক্তি কিছু কেনাকাটার জন্য একবার মক্কায় এসেছিলেন। আব্বাসের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন তিনি। একদিন সকালে লক্ষ্য করলেন, এক যুবক কাবার কাছে এসে আসমানের দিকে তাকালো তারপর কিবলামুখী হয়ে দাঁড়ালো। একজন কিশোর এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর এলো এক মহিলা। তারা নামায শেষ করে চলে গেল। দৃশ্যটি দেখে আফীক আব্বাসকে বললেন, 'বড় রকমের একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে।' আব্বাস বললেন, 'হ্যাঁ, এ নওজোয়ান আমার ভাতিজা মুহাম্মাদ, কিশোরটি আমার আরেক ভাতিজা আলী এবং মহিলাটি মুহাম্মাদের স্ত্রী। আমার জানামতে দুনিয়ায় তারা তিনজনই মাত্র এই নতুন ধর্মের অনুসারী।[61] বুখারি শরিফে আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত আছে যে, ফেরেশতা জিবরাঈল একবার মুহাম্মাদকে বললেন, "হে আল্লাহর রাসুল! দেখুন খাদিজা আসছেন। তিনি আপনার নিকট আসলে আপনি তাঁকে আল্লাহর সালাম জানাবেন এবং তাকে মণি-মুত্তার তৈরী একটি বেহেশতী মহলের সুসংবাদ প্রদান করবেন। সেই মহলে কোন অযথা শোরগোল থাকবে না এবং ক্লান্তি ও অবসন্নতাও কাওকে গ্রাস করবে না।"[62]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.