Loading AI tools
দশটি মুখ্য উপনিষদের একটি উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
কেন উপনিষদ্ (কেনোপনিষদ্) একটি বৈদিক সংস্কৃত ধর্মপুস্তক যেটিকে দশটি মুখ্য উপনিষদের অন্যতম একটি উপনিষদ বলে মানা হয়। এটি সামবেদের তলবকার ব্রাহ্মণ নবম অধ্যায়ে রয়েছে।[1][2] এটি তলবকার উপনিষদ্ নামেও পরিচিত। এটি হিন্দুধর্মের ১০৮টি উপনিষদের নামসংকলন মুক্তিকা উপনিষদে দ্বিতীয় উপনিষদ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে।
উপনিষদ্ হিন্দু ধর্মগ্রন্থ-সংক্রান্ত একটি ধারাবাহিকের অংশ |
ঋগ্বেদ |
---|
ঐতরেয় |
যজুর্বেদ |
বৃহদারণ্যক · ঈশ · তৈত্তিরীয় · কঠ |
সামবেদ |
ছান্দোগ্য · কেন |
অথর্ববেদ |
মুণ্ডক · মাণ্ডুক্য · প্রশ্ন |
অন্যান্য প্রধান উপনিষদ্ |
শ্বেতাশ্বেতর · কৌষীতকী · মৈত্রায়ণীয় |
কেন উপনিষদ্ সম্ভবতঃ খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে রচিত হয়। এটির প্রথম ১৩টি ছত্র ছন্দোবদ্ধ পদ্যে, পরের ১৫টি ছত্র গদ্যে এবং শেষের ৬টি ছত্র গদ্য রূপে রচিত উপসংহার। ধর্মতত্ত্ববিদ পল ডুসেন মনে করেন যে- গদ্যাংশটি প্রথমদিকের পদ্য অংশ থেকে অনেকখানি পুরানো এবং কেন উপনিষদ্ প্রাচীন গদ্যেরচিত উপনিষদের যুগের সাথে ছন্দোময় পদ্যেরচিত উপনিষদের রচনার সময়কালের একটি যোগসূত্র তৈরি করেছে।[2]
কেন উপনিষদ্ পরব্রহ্ম অর্থাৎ ব্রহ্মের সগুণ ও নির্গুণ স্বরূপের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বৈদিককালে প্রাকৃতিক শক্তিগুলোকেই দেবতা বলে ধরা হত। কেনোপনিষদে দেখানো হয়েছে যে- এই সকল দেবতাদের অস্তিত্বের পেছনে মূল হলেন ব্রহ্ম। এর ফলে এটিকে হিন্দুধর্মের বেদান্ত দর্শনের দ্বৈতবাদী ও অদ্বৈতবাদী উভয় সম্প্রদায়েরই মূল নীতিগ্রন্থ হিসেবে ধরা হয়। এছাড়াও কেনোপনিষদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো হল 'আধ্যাত্মিক পুরুষ', 'আত্মন্ বা আত্মার অস্তিত্ব', 'ব্রহ্মের প্রতি দেবতাদেরও ভক্তি' ইত্যাদি বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা।[1][2]
এই উপনিষদের প্রথম শব্দটি কেন (সংস্কৃত: केन) হওয়ায় এই উপনিষদের নাম কেনোপনিষদ্। বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে আক্ষরিকভাবে কেন শব্দটির অর্থ হতে পারে "কিসের দ্বারা, কার দ্বারা, কোথা থেকে, কী কারণে, কীভাবে" ইত্যাদি।[3] কেন শব্দটির "কার দ্বারা" অর্থটি কেনোপনিষদের অনুসন্ধিৎসু প্রথম শ্লোকেই বোঝানো হয়ে রয়েছে।
কেনেষিতম্ পততি প্রেষিতম্ মনঃ
কেনে প্রাণঃ প্রথমঃ প্রৈতি যুক্তঃ ।
কেনেষিতাম্ বাচমিমাম্ বদন্তি
চক্ষুঃ শ্রোত্রম্ ক উ দেবো যুনক্তি ॥ ১ ॥
বাংলায় এই পংক্তিটির অর্থ করলে দাঁড়ায়:-
কার ইচ্ছামাত্র পতিত হয় এই প্রেষিত মন?
কার দ্বারা মুখ্য প্রাণ হয় স্বকর্মে প্রযুক্ত?
এই বাণী লোকে বলে থাকে কার ইচ্ছায়?
কোন সেই প্রসিদ্ধ দেবতা চক্ষু কর্ণকে করে নিযুক্ত?
কেন উপনিষদ্ সামবেদের তলবকার ব্রাহ্মণের অংশ, যার কারণে বেশ কিছু প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতীয় গ্রন্থে এটিকে তলবকার উপনিষদ্ নামেও উল্লেখ করা হয়েছে।[2][4] কেন উপনিষদ্-কে একপদে সন্ধিবদ্ধ করে কেনোপনিষদ্ (সংস্কৃত: केनोपनिषद्) নামেও অভিহিত হয়।
অন্যান্য বৈদিক গ্রন্থের মত কেনোপনিষদের কালানুক্রমও এখনও পর্যন্ত অস্পষ্ট ও বিশিষ্ট পণ্ডিতদের মধ্যে এ নিয়ে মতভেদ আছে।[5] সমস্ত অভিমতই অত্যল্প ও অপর্যাপ্ত প্রমাণ আর মূলতঃ ভাষারূপের প্রাচীনত্ব, শৈলী ও অন্য কোনো গ্রন্থের সাথে ভাব বা বাক্যের পুনরাবৃত্তির বিশ্লেষণ এবং কোন দর্শনের প্রভাব অন্য কোন দর্শনের উপর পড়ে এটার একটা অনিশ্চিত অনুমানের উপর ভিত্তি করে প্রদত্ত।[5][6]
ফিলিপ্স এর মতে- কেনোপনিষদ্ রচিত হয় বৃহদারণ্যক, ছান্দোগ্য, ঈশ, তৈত্তিরীয় ও ঐতরেয় (খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর আগে) উপনিষদগুলোর পরে, কিন্তু কঠ, মুণ্ডক, প্রশ্ন, মাণ্ডুক্য, শ্বেতাশ্বতর ও মৈত্রায়ণীয় (মৈত্রী) উপনিষদগুলোর আগে, এমন কি সবচেয়ে পুরাতন বৌদ্ধ ও জৈন সুত্রগুলোরও আগে।[5]
রানাডের[7] অভিমতও অনেকটা ফিলিপ্সের মতই, তবে তিনি কেনোপনিষদকে পুরাতন উপনিষদ সমূহের তৃতীয় বর্গে রেখেছেন। পল ডুসেন কেনোপনিষদকে গদ্য রচনাকালের সাথে কল্পনাময় সৃজনশীল ছন্দোময় পদ্য রচনাকালের সন্ধিক্ষণে রচিত বলে মনে করেন।[8] উইন্টার্নিটজ্ এটিকে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মীয় সাহিত্যের পূর্বে রচিত হিসেবে ধরেন।
সম্ভবতঃ খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যাংশ সময়ে এটি লিখিত রূপ পায়। কেনোপনিষদের অধিকাংশ বিষয়বস্তুই পাঠ্যটির অনেকখানি পূর্বে উদ্ভূত। উদাহরণস্বরূপ, কেনোপনিষদের ২য় শ্লোকের মূল ভাবটিই প্রাচীনতম উপনিষদ বৃহদারণ্যকের ৪র্থ অধ্যায় - ৪র্থ স্তবকে এবং দ্বিতীয় প্রাচীনতম উপনিষদ ছান্দোগ্যের ৮ম অধ্যায় - ১২শ স্তবকে রয়েছে।[9]
কেন উপনিষদের মুখ্যতঃ তিনটি অংশ:- প্রথমাংশে ১৩টি ছন্দোবদ্ধ ছত্র, দ্বিতীয় অংশে ১৫টি অনুচ্ছেদ এবং শেষাংশে সমাপ্তিসূচক ৬টি অনুচ্ছেদ। কেনোপনিষদকে চারটি 'খণ্ডে' বিভক্ত করা আছে। প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে যথাক্রমে আছে ৮টি ও ৫টি পংক্তি। তৃতীয় খণ্ডে রয়েছে ১২টি শ্লোক এবং চতুর্থ খণ্ডে রয়েছে বাকি ৯টি শ্লোক (৩টি মূল শ্লোক, ৬টি সমাপ্তিসূচক শ্লোক)।[2][4]
কেনোপনিষদের প্রথম দুটি খণ্ড পদ্য আকারে রচিত, এ অধ্যায় দুটি গুরু-শিষ্য কথোপকথন, আর শেষ দু'টি খণ্ড গদ্য আকারে রচিত, যদিও একটি ব্যতিক্রম রয়েছে। শেষ অধ্যায় দুটিতে একটি কাহিনীর মাধ্যমে উপদেশ প্রদান করা হয়েছে। ৯ম শ্লোকটি গদ্য আকারে রচিত এবং গঠনগতভাবে ব্যতিক্রম, যার ফলে অনেক পণ্ডিতের ধারণা এটি পরে যুক্ত হয়েছে অথবা আজকের উপনিষদটি মূল পাণ্ডুলিপির একটি অপেক্ষাকৃত নতুন সংস্করণ।[2] এছাড়া আরেকটি বিশেষত্ব হল কেনোপনিষদের ৩য় ছত্র, যেটিতে ৮টি পংক্তি (এখানে, লাইন) রয়েছে, যেখানে প্রথম দুটি খণ্ডে বাকি সবগুলো ছত্রেই ছন্দ মেনে ৪টি পংক্তি রয়েছে। এই ৩য় ছত্রটিকে সাধারণতঃ ৩(ক) ও ৩(খ) হিসেবে ভাগ করা হয়।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া কেনোপনিষদের পাণ্ডুলিপিগুলিতে কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন- দক্ষিণ ভারতীয় পাঠ্য অনুযায়ী এবং শংকরের ভাষ্য অনুযায়ী যে উপনিষদটি তলবকার ব্রাহ্মণের ৯ম অধ্যায়ে আছে।[10] সেটিই সামবেদের কয়েকটি অংশের বার্নেল পাণ্ডুলিপি[11] অনুসারে জৈমিনীয় ব্রাহ্মণের ১০ম অনুবাকের ৪র্থ অধ্যায়ে রয়েছে।[12]
কেনোপনিষদকে সামবেদের অংশ হিসেবেই মানা হয়ে থাকে, যদিও অথর্ববেদের পাণ্ডুলিপিতেও এটিকে পাওয়া যায়। দুটি সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য অতিসুক্ষ্ম এবং গঠনগত মাত্র - সামবেদে কেনোপনিষদ ৪টি খণ্ডে বিভক্ত। অন্যদিকে, অথর্ববেদে এরকম বিভাজন অনুপস্থিত।[13]
কেনোপনিষদের আরম্ভ হয় মানবপ্রকৃতি, তার উদ্ভব, সত্ত্বা এবং জ্ঞান ও পার্থিব অনুভূতির সাথে তার সম্পর্কের সম্বন্ধে প্রশ্ন করে।[9] এরপরই এখানে বলা হয় যে, জ্ঞান দুই রকমের - অভিজ্ঞতাগত আর ধারণাপ্রসূত। কেনোপনিষদ অনুসারে, যে জ্ঞান আমরা অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করি, সেটিকে আমরা শেখাতে পারি, বর্ণনা করতে পারি ও এর সম্বন্ধে আলোচনাও করতে পারি। কিন্তু ধারণাসঙ্গত স্বতঃসিদ্ধ জ্ঞানকে নিয়ে আমরা এসকল করতে পারি না। বিশুদ্ধ বিমূর্ত বিষয়গুলো কেবল অবগত ও জ্ঞাত হওয়া যায়। ৩য় ছত্রে উল্লেখ রয়েছে যে ব্রহ্ম-ই হল পরম সত্য।
সেখানে যায়না চোখ
না যায় বাণী ও মন।
যেভাবে জানা যায় “ইহা এরূপ”।
তাও জানি না বুদ্ধিতে, না অপরের কাছে শুনে।
আমাদের জ্ঞাত পদার্থ হতেও ভিন্ন সেটি,
অজ্ঞাত হতেও ঊর্ধ্বে
এই শুনেছি পূর্ব-আচার্যদের নিকট
যারা আমাদের করিয়েছিলেন পরিচয়।— কেনোপনিষদ্, ১.৩(ক) ও ১.৩(খ)
৩য়-৮ম শ্লোকে 'চক্ষু তাঁকে দেখতে পায় না' ইত্যাদি দ্বারা ব্রহ্মকে অবিজ্ঞেয় বলে শ্রুতি নির্দেশ করেছেন। ব্রহ্ম ইন্দ্রিয়গোচর বিষয়ের অতীত, ইন্দ্রিয়ের অগোচর বিষয়েরও অতীত, সুতরাং তৎসম্বন্ধে উপদেশ অসম্ভব। যদি এইরূপই হল তাহলে পূর্বাচার্যগণ এইপ্রকার অবিজ্ঞেয় বিষয়ের উপদেশ দিলেন কীরূপে? যদিও তিনি ইন্দ্রিয়গোচর বা ইন্দ্রিয়ের গোচর বিষয়সমূহের মত নন, তথাপি তিনি সব বিষয়ের প্রেরকরূপে আমাদের জ্ঞানের বিষয়। অগ্নি প্রভৃতি যেসব দৃশ্যমান পদার্থসমূহের লোকে পূজা করে, সেসব কখনও ব্রহ্ম নয়। কিন্তু, এরা যাঁর প্রেরণায় স্ব স্ব কার্য নির্বাহ করে তিনি ব্রহ্ম।[14] ৪র্থ-৮ম ছত্রগুলিতে বোঝানো হয় যে ব্রহ্ম বাচ্যে অপরিস্ফুট, মনে অচিন্তনীয়, চক্ষে অদৃশ্য, কানে অশ্রুত ও প্রাণেরও অতীত। সে অনাদি, অনন্ত, বর্ণনাতীত সদা-সর্বত্র-বিদ্যমান সত্য। তারই শক্তিতে আমরা শুনি, দেখি, কথা বলি, আঘ্রাণ করি ও ভাবি। লোকে বাক্য দ্বারা, বুদ্ধি দ্বারা, চক্ষু দ্বারা, শ্রোত্রেন্দ্রিয় দ্বারা কিংবা প্রাণশক্তিতে ক্রিয়াশীল প্রকাশযোগ্য যে তত্ত্বকে উপাসনা করে তা ব্রহ্ম নয়।
উডবার্ন ধারণা করেন — কেনোপনিষদে ব্রহ্ম সম্পর্কে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, একইভাবে খ্রিস্টধর্মেও আস্থা-কে বর্ণনা করা আছে।[15] এর বিপরীত, শঙ্কর কেনোপনিষদের প্রথম খণ্ডটিকে সম্পূর্ণরূপে অদ্বৈতমতে ব্যাখ্যা করেন।[16]
কেনোপনিষদের ২য় খণ্ড আস্তিক্যবাদী গদ্য রূপে রচিত ৯ম শ্লোক দিয়ে শুরু হয়, যেখানে বলা হয়েছে- এই সমগ্র জগৎ ও দেবতাদের স্বরূপ জ্ঞানে ব্রহ্ম সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান লাভ হতে পারে না। কেননা সমগ্র জগৎ ও দেবতারা ব্রহ্মের ক্ষুদ্রাংশ মাত্র।[17] দশম থেকে ত্রয়োদশ শ্লোক আবার পদ্যে রচিত এবং প্রথম খণ্ডের মত ব্রহ্ম কী আর কী নয় এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের ব্যাখ্যায় প্রত্যাগমন করে।[18] দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শ্লোকগুলোতে আত্মপ্রতীতির অবস্থার, অর্থাৎ মোক্ষের, বর্ণনা দেওয়া হয়, এবং বলা হয় যে, যারা বোধিপ্রাপ্ত (আত্মজাগরিত) হন, তারা অন্তরের শক্তি লাভ করে, সমস্ত জীব-জগতের মধ্যে আধ্যাত্মিক একত্ব অনুভব করেন এবং অমৃতত্ব লাভ করে।[3][18][19] চার্লস জনস্টন এই আধ্যাত্মিক স্থিতিকেই "স্পিরিচ্যুয়াল ম্যান" বা "অধ্যাত্মপুরুষ" বলে অভিহিত করেন।[20]
যার অন্তরে এটি জেগে ওঠে, সে একে চেনে,
এই জ্ঞানের দ্বারা সে অমৃতলাভ করে।
আত্মবোধের দ্বারা সে শক্তি পায়,
ব্রহ্মবোধের দ্বারা সে পায় অমরত্ব।
যদি কেউ এটিকে এখানে বোঝে, তবে সত্য আছে,
যদি কেউ না বোঝে, তবে আছে তার অনিষ্ট;
পণ্ডিতরা সেটিকে সকল জীবে চেনেন
আর পৃথিবী ত্যাগ করার পশ্চাৎ অমর হয়ে থাকেন।— কেনোপনিষদ্, ২য় খণ্ড, ১২-১৩ ছত্র
কেনোপনিষদের তৃতীয় খণ্ডটি একটি কল্পকাহিনী, যা প্রথম দুইটি কাব্যিক খণ্ড থেকে আলাদা গদ্যে রচিত। পল ডুসেনের মতে কাহিনীটি একটি রূপক।[21] ধর্মতত্ত্ববিদ চার্লস জনস্টন মনে করেন— রূপকটি সরল ভাষাশৈলীতে রচিত সংস্কৃত গদ্যসাহিত্যের একটি অসাধারণ নমুনা আর উপনিষদসমূহের সবচেয়ে নিগূঢ় অংশগুলোর একটি।[22]
একবার দেবাসুর যুদ্ধে দেবতাদের গৌরব বাড়ানোর জন্য অসুরদের পরাজিত করেন।[23][24] ব্রহ্মের জয়লাভে দেবতারা পুলকিত হয়ে পড়েন। তারা বলেন "এই জয় সত্যই আমাদের, এই গৌরব শুধুই আমাদের"। ব্রহ্ম এটি লক্ষ্য করলেন। তিনি নিজেকে দেবতাদের সম্মুখে জ্যোতির্ময় যক্ষরূপে প্রকাশ করলেন। দেবতারা তাঁকে চিনতে পারলেন না। তাঁরা বললেন, "কে এই জ্যোতির্ময় ব্যক্তি?" দেবতারা অগ্নিকে এই আশ্চর্য ব্যক্তির পরিচয় জেনে আসতে পাঠালেন।
অগ্নি ব্রহ্মের সম্মুখে উপস্থিত হলে, ব্রহ্ম প্রশ্ন করলেন, "কে তুমি?" অগ্নি উত্তর দিলো, "আমি অগ্নি, আমি জাতবেদা (সর্বজ্ঞ)" ব্রহ্ম বললেন- "তবে, তোমার বিশেষ শক্তি কী?" অগ্নি প্রত্যুত্তরে বললেন, "আমি এই বিশ্বের সবকিছুই ভস্ম করে ফেলতে পারি।" তখন ব্রহ্ম তাঁর সামনে একটি তৃণ রেখে বললেন, "তবে এটিকে ভস্ম কর।" অগ্নি সর্ব ক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা করেও সেটিকে দগ্ধ করতে পারলেন না। তিনি ফিরে গিয়ে দেবতাদের বললেন, "আমি সেই আশ্চর্য ব্যক্তিকে চিনে আসতে পারলাম না।" দেবতারা তখন বায়ুকে বললেন "হে বায়ু, দেখে এসো, কে এই আশ্চর্য ব্যক্তি।"
বায়ু ব্রহ্মের কাছে ছুটে গেলেন। ব্রহ্ম জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি কে?" বায়ু উত্তর দিলেন, "আমি বায়ু, আমি মাতরিশ্বন্ (যিনি আকাশলোকে বিচরণ করেন)[25]"। ব্রহ্ম বললেন- "তবে, তোমার বিশেষ শক্তি কী?" বায়ু বললেন, "আমি বিশ্বের যেকোনো বস্তু তুলতে ও উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারি।" ব্রহ্ম তখন তাঁর সামনে একটি তৃণ রেখে বললেন, "এটিকে তোলো, তবে।" বায়ু অনেক চেষ্টা করেও তৃণটিকে তুলতে পারলেন না। পরাজয় মেনে ফিরে গিয়ে তিনিও বাকি দেবতাদেরকে বললেন- "আমিও এই আশ্চর্য ব্যক্তির পরিচয় জানতে ব্যর্থ হলাম।" তখন সকল দেবতারা মিলে ইন্দ্রকে বললেন, "হে মঘবন্, তুমি গিয়ে জেনে এসো এই ব্যক্তিটি কে।" "তাই হোক", বললেন ইন্দ্র।
ইন্দ্র তাঁর দিকে ছুটে যেতেই ব্রহ্ম অন্তর্হিত হলেন; সেখানেই প্রকট হলেন এক দেবী। তিনি উমা। ইন্দ্র তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, "কে সেই আশ্চর্য ব্যক্তি?"
দেবী উমা বললেন, "তিনিই ব্রহ্ম; তিনিই যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন, যদিও এটিকে তোমরা নিজেদেরই কৃতিত্ব বলে মনে করছ।" তখন ইন্দ্র ব্রহ্মকে চিনতে পারলেন।
অতএব, ইন্দ্র, বায়ু ও অগ্নি সকল দেবের প্রধান। কারণ তাঁরা ব্রহ্মের সবচেয়ে নিকটে "পৌঁছাতে" ও সর্বপ্রথম "সাক্ষাৎ করতে" পেরেছিলেন। তাঁদেরকে সকল যাগযজ্ঞের শুরুতে পুজা করতে হয়। ইন্দ্র হলেন প্রধানতম, কারণ সকল দেবতাদের মাঝে তিনিই ব্রহ্মকে প্রথম "বুঝতে" পেরেছিলেন।
- কেনোপনিষদ্, ১৪-২৮ শ্লোক
হিন্দু ধর্মগুরু আদি শঙ্করাচার্যের মতই জনস্টনেরও ধারণা, এই আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ গল্পটির মধ্য দিয়ে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ব্যাখ্যা করা হয়েছে।[26] এই ব্রহ্ম, এতগুলো দেবতাদের মধ্যে এই তিনটি দেবতাকে নির্বাচন করা, এতজন দেবীর মাঝে উমাকে তুলে ধরা, ব্রহ্মের দর্শন না দিয়ে উমার ব্রহ্মবিদ্যা শেখানো[27], এমনকি ব্রহ্মকে "আশ্চর্য ব্যক্তি" বলে উল্লেখ করা[28] - সবকিছুই যেন উপনিষদের মূল ভাবটিকে তুলে ধরে। অগ্নি "সর্বত্র সকল জীবে উপস্থিত প্রাণাগ্নিস্বরূপ স্বাভাবিক সত্তা"-র প্রতীক। বায়ু হল শারীরিক সত্তাকে ঘিরে থাকা মহাশূন্যের স্বরূপ ও "সবকিছুর চিন্তাভাবনায় জড়িত মানসিক সত্তা"-র প্রতীক।[26] এবং বজ্র, আলোক ও দীপ্তির দ্বারা রূপায়িত ইন্দ্র হলেন " কার্যকারণসম্বন্ধ-অভিহিত নিত্যসচেতন সত্তা, যা সত্যের মঙ্গলালোকে অসত্য থেকে সত্যের জ্ঞানকে পৃথক করে ও আপন করে"। এই ব্রহ্মই হল আত্মন্; এটি অনাদি ও অনন্ত।[28] সুরাসুর যুদ্ধ হল ভালো এবং মন্দের মধ্যে যুদ্ধের প্রতীকীরূপ। দেবতারাই হলেন মানুষের অনুভূতিগত ও বুদ্ধিগত ক্ষমতার রূপক, যেখানে যুদ্ধটি মানবজীবনের বিভিন্ন দুঃসময়ের প্রতীক।[29] একত্রভাবে কেনোপনিষদের এই রূপককাহিনীটি বোঝায় যে, কোনো বস্তুগত কর্ম, যেমন কোনো বস্তুকে পুড়িয়ে ফেলা বা এখান থেকে ওখানে নিয়ে যাওয়া, কখনই আমাদেরকে "বিষয়টির বাস্তব সত্তা, সেই আশ্চর্য ব্রহ্ম"-কে জানার দিকে পথনির্দেশ করে না। রূপকের দ্বারা উপনিষদ্ মনে করিয়ে দেয় যে মন্দের উপর ভালোর জয় অভিব্যক্ত ব্যক্তির জয় নয়, তার অন্তরে উপস্থিত মঙ্গলময় চিরন্তন আত্মব্রহ্মের জয়।[26]
কেনোপনিষদের উপসংহার পাঠ্যের শেষ ছয়টি শ্লোকের দ্বারা গঠিত। এটি ব্রহ্মের অবিনশ্বরত্বের বর্ণনা দেয় এবং ব্রহ্মজ্ঞানলাভকে মানবজীবনের পরম ভাবাবেগ মিশ্রিত মুহূর্তের সাথে তুলনা করে, যেরকম ভাব বাদলঘন আকাশে অকস্মাৎ বজ্রের ঝলকানি দেখলে অথবা ছোটবেলার কোনো স্মৃতি হঠাৎ মনে পড়লে আমাদের প্রাণে আনন্দ সঞ্চালিত হয় তেমন।[21] কেনোপনিষদ্ অনুসারে, আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও আত্মসচেতনতা লাভের লক্ষ্য অপূর্ব, যেটি খেয়াল করা যায় সকল জীবের অন্তরে ব্রহ্মের উপস্থিতিকে দেখার "তীব্র আকাঙ্ক্ষা"-র দ্বারা।[21] আত্মব্রহ্মের জ্ঞানই হল তদ্বনম্ (অতীন্দ্রিয় সুখ, অর্থাৎ পরমানন্দ)।[30]
কেনোপনিষদের শেষ শ্লোকগুলোতে নৈতিক জীবনকেই আত্মজ্ঞান ও ব্রহ্মজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
তসৈ তপো দমঃ কর্মেতি প্রতিষ্ঠা বেদাঃ সর্বাঙ্গানি সত্যমায়তনম্।।
তপঃ, দমঃ ও কর্মই হল এর চরণ, বেদসমূহই হল এর হস্ত, সত্যই হল এর বাসস্থান।
- কেনোপনিষদ্, ৩৩ শ্লোক
আদি শঙ্করাচার্য কেনোপনিষদের উপর দুটি ভাষ্য রচনা করেছেন। একটির নাম কেনোপনিষদ্ পদভাষ্য এবং অন্যটির নাম কেনোপনিষদ্ বাক্যভাষ্য।[31][32] কেনোপনিষদের তৃতীয় খণ্ডের আলোচনায় তিনি আত্ম-ব্রহ্মের সাথে ঈশ্বর-পরমেশ্বরকে সমান করেন।[33] এই সমত্বই শঙ্করের বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ভাষ্যের ৩-৭-৩ ও ৪-৪-১৫ পংক্তিতে, ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ভাষ্যের ১-১-১ ও ৫-১৮-১ পংক্তিতে, এবং কঠ উপনিষদ্ ভাষ্যের ১১-২-১৩ শ্লোকে অভিব্যক্ত হয়েছে।[33]
আনন্দজ্ঞানও কেন উপনিষদের উপর একটি টীকা রচনা করেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশ পর্যন্ত শঙ্কর ও আনন্দজ্ঞানের টীকা দুটোকেই কেনোপনিষদের অস্তিত্বের একমাত্র উৎস বলে গণ্য করা হত, কারণ দারা শিকোর দ্বারা ফারসি অনুবাদের পরে উপনিষদটির মূল পাণ্ডুলিপি নষ্ট হয়ে যায় বলেই ধারণা করা হয়েছিল।[10] ১৮৭৮ সালের পরে অবশ্য এই ধারণা বদলে যায়, যখন সংস্কৃতভাষাতত্ত্ববিদ আর্থার কোক বার্নেল কেনোপনিষদের একটি পাণ্ডুলিপি পান আর পরবর্তীকালে তা প্রকাশ করেন।[10] ফরাসী পণ্ডিত অঙ্কাতিল-দ্যু-পেরন ফারসী পাঠ্যটির ল্যাটিন সংস্করণ "কিন্" নামে প্রকাশ করেন, যেখানে উইন্ডিচমন ও অন্যরা কেনোপনিষদের জার্মান অনুবাদ প্রকাশ করেন।[10] কোলব্রুক, পলে, ওয়েবার, রোয়ার ও গফ প্রমুখ বিশেষজ্ঞ কেনোপনিষদ নিয়ে সচরাচর আলোচনা করতেন।[10]
জর্জ হাস মনে করেন- হিন্দু ধর্মীয় বাণীর অমূল্য রত্নসম্ভারের সম্পর্কে জানতে অন্যান্য উপনিষদ্ ও শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সাথে কেনোপনিষদ্ অধ্যয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।[34]
এডওয়ার্ড ওয়াশবার্ন হপকিন্স বলেন- কেনোপনিষদের শেষ অংশে প্রবচনাত্মক ''তপো ধর্মঃ কর্মঃ'' বাক্যাংশটি প্রমাণ করে যে যোগশাস্ত্রের নীতিগত মতাদর্শে হিন্দুদের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য কেনোপনিষদ্ রচনার কালেই উপস্থিত ছিল।[35] একইভাবে, শ্রীমালি অন্যান্য সংস্কৃত রচনার সাথে কেনোপনিষদের উদাহরণ দিয়ে উল্লেখ করেন যে বিদ্যালাভের আকিতি ও প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাপদ্ধতি খ্রিস্টপূর্ব ১ম সহস্রাব্দেই বহুল প্রচলিত ছিল, যেমন দেখা যায় এটির প্রথম খণ্ডের প্রশ্নোত্তর পদ্ধতিতে।[36]
ফ্রেড ডালমেয়র মনে করেন- কেনোপনিষদের প্রারম্ভিক পংক্তিগুলোর দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে হিন্দু ধর্মতত্ত্বের মূল বিষয় হল আত্মব্রহ্ম -
সর্বম্ ব্রহ্মৌপনিষদম্।।
ব্রহ্মকে নিয়েই সমগ্র উপনিষদ্ রচিত।
- কেনোপনিষদ্ প্রারম্ভে
ডেভিড স্টোল কেনোপনিষদের সূচনাত্মক শ্লোকগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৯০ সনে "সোনাটা ফর ট্যু পিয়ানোস্" রচনা করেন।[37]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.