Loading AI tools
দক্ষিণ ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও সঙ্গীত তত্ত্ব উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
কর্নাটকী সঙ্গীত, যেটি দক্ষিণ ভারতীয় ভাষায় কর্ণাটক সংগীত বা কর্ণাটক সংগীতম নামেও পরিচিত, সেটি হল সাধারণভাবে দক্ষিণ ভারতের আধুনিক ভারতীয় রাজ্য কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কেরালা ও তামিলনাড়ু এবং শ্রীলঙ্কার সাথে যুক্ত সঙ্গীতের একটি পদ্ধতি।[১][২] এটি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের দুটি প্রধান উপধারার মধ্যে একটি যা প্রাচীন হিন্দুধর্ম বিজ্ঞান ও ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত হয়েছে, বিশেষ করে সামবেদ থেকেই এর উৎপত্তি।[৩] অন্য উপধারাটি হল হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীত, যেটি উত্তর ভারত থেকে আবির্ভূত হয়েছিল একটি স্বতন্ত্র রূপে, পারসিক বা ইসলামিক প্রভাবের কারণে। কর্নাটকী সঙ্গীতে প্রধানত জোর দেওয়া হয় কণ্ঠ সঙ্গীতের উপর; অধিকাংশ রচনাই লেখা হয় গেয়ে শোনানোর জন্য, এবং এমনকি কোন বাদ্যযন্ত্রে বাজানো হলেও, সেগুলিকে গায়কি (গায়ন) শৈলীতেই পরিবেশন করা হয়।
যদিও শৈলীগত পার্থক্য আছে, তবুও শ্রুতি (বাদ্যযন্ত্রের আপেক্ষিক স্বনকম্পাঙ্ক), স্বর (একটি সুরের সাঙ্গীতিক শব্দ), রাগ (রীতি বা স্বরসংক্রান্ত সূত্র) এবং তালের (ছন্দের চক্র) মৌলিক উপাদানগুলি কর্নাটকী এবং হিন্দুস্তানি উভয় সঙ্গীতেই তাৎক্ষণিক উদ্ভাবন এবং সংযুক্তির ভিত্তি তৈরি করে। যদিও তাৎক্ষণিক উদ্ভাবন এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তবুও বলা যায় কর্নাটকী সঙ্গীত মূলত সংযুক্তির মাধ্যমে গাওয়া হয়, বিশেষ করে কৃতি (বা কীর্তনম) - এটি এমন একটি রূপ যা ১৪তম এবং ২০তম শতকের মধ্যে পুরন্দর দাস এবং কর্নাটকী সঙ্গীতের ত্রিমূর্তির (ত্যাগরাজ, মুথুস্বামী দীক্ষিত এবং শ্যামা শাস্ত্রী) মতো সুরকারদের দ্বারা বিকশিত হয়েছিল। কর্নাটকী সঙ্গীত সাধারণত সংযুক্তির মাধ্যমে শেখা এবং শেখানো হয়। কর্নাটকী সঙ্গীতের বিবর্তনে প্রধান অবদান তেলুগু ভাষার[৪] কারণ বেশিরভাগ রচনাই আছে তেলুগু বা সংস্কৃত ভাষায়, এবং কিছু আছে তামিল ভাষায়।[৫]
কর্নাটকী সঙ্গীত সাধারণত সঙ্গীতজ্ঞদের একটি ছোট দল দ্বারা সঞ্চালিত হয়, যার মধ্যে থাকে একজন প্রধান শিল্পী (সাধারণত একজন কণ্ঠশিল্পী), একজন সুরের সঙ্গী (সাধারণত একটি বেহালা), একটি ছন্দের সঙ্গত (সাধারণত একটি মৃদঙ্গ), এবং একটি তানপুরা। তানপুরাটি পুরো পরিবেশন জুড়ে সুর সঙ্গত হিসাবে কাজ করে। পরিবেশনায় ব্যবহৃত অন্যান্য সাধারণ যন্ত্রগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে ঘটম, কাঞ্জিরা, মোরসিং, বেণু বাঁশি, বীণা এবং গোট্টুবাদ্যম। সর্বাধিক কর্নাটকী সঙ্গীতজ্ঞ দেখতে পাওয়া যায় চেন্নাই শহরে।[৬] সারা ভারতে এবং বিদেশে বিভিন্ন কর্নাটকী সঙ্গীত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যার মধ্যে মাদ্রাজ মিউজিক সিজন বিশ্বের বৃহত্তম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়।[৭][৮]
ভারতের সংস্কৃতির সমস্ত শিল্প রূপের মতোই, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকেও একটি ঐশ্বরিক শিল্প রূপ বলে বিশ্বাস করা হয়, যা দেব এবং দেবী (হিন্দু দেবতা ও দেবী) থেকে উদ্ভূত হয়েছে,[৯][১০] এবং নাদ ব্রাহ্মণের প্রতীকী হিসাবে পূজিত।[১১] প্রাচীন শাস্ত্রগুলি থেকে প্রাণী ও পাখির শব্দের সাথে স্বর বা ধ্বনির উৎসের সংযোগের এবং পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধির গভীর অনুভূতির মাধ্যমে এই শব্দগুলিকে অনুকরণ করার জন্য মানুষের প্রচেষ্টার বর্ণনা পাওয়া যায়। সামবেদ, যাকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভিত্তি স্থাপন করেছে বলে মনে করা হয়, সেখানে ঋগ্বেদের স্তোত্র রয়েছে, এবং সেগুলি সঙ্গীতের সুরে বাঁধা হয়েছে। এগুলি বৈদিক যজ্ঞের সময়কালে তিন থেকে সাতটি ধ্বনি ব্যবহার করে গাওয়া হত।[১০] যজুর্বেদ, যা প্রধানত আহুতিদানের সূত্র নিয়ে গঠিত, সেখানে কণ্ঠ্য আবৃত্তির অনুষঙ্গ হিসেবে বীণার উল্লেখ পাওয়া যায়।[১২] বহু প্রাচীন গ্রন্থে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উল্লেখ পাওয়া যায়, এগুলির মধ্যে আছে কিছু ভারতীয় মহাকাব্য, যেমন রামায়ণ এবং মহাভারত। যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিতে সংস্কৃত ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে वीणावादन तत्त्वज्ञः श्रुतीजातिविशारदः ताळज्ञश्चाप्रयासेन मोक्षमार्गं नियच्छति ( বীণাবাদন তত্ত্বজ্ঞঃ শ্রুতিজাতিবিশারদঃ তালজ্ঞশ্চাপ্রয়াসেন মোক্ষমার্গং নিয়চ্ছতি, "যিনি বীণাতে পারদর্শী, যিনি শ্রুতি জ্ঞান রাখেন এবং যিনি তালে পারদর্শী, তিনি নিঃসন্দেহে মুক্তি (মোক্ষ) লাভ করবেন।")।[১৩] কর্নাটকী সঙ্গীত আজকালকার মতই সঙ্গীতের ধারণার (স্বর, রাগ, এবং তাল সহ) উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল যেগুলি বেশ কিছু প্রাচীন রচনা, বিশেষ করে ভরতের নাট্য শাস্ত্র এবং ইলাঙ্গো আদিগালের সিলাপ্পাদিকারম গ্রন্থে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে।।[১৪]
১২ শতকের পর থেকে উত্তর ভারতে পারসিক ও ইসলামীয় প্রভাবের কারণে, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত দুটি স্বতন্ত্র শৈলীতে বিভক্ত হতে শুরু করে - হিন্দুস্তানি সঙ্গীত এবং কর্নাটকী সঙ্গীত।[৬] ভাষ্য এবং অন্যান্য কাজ, যেমন শারঙ্গদেবের সঙ্গীত রত্নাকর, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পাওয়া বাদ্যযন্ত্রের ধারণাগুলিকে আরও বিস্তৃত করেছে।[১৫] ১৬ এবং ১৭ শতকের মধ্যে, কর্নাটকী এবং হিন্দুস্তানি সঙ্গীতের মধ্যে একটি স্পষ্ট প্রভেদ ছিল;[১৬] কর্নাটকী সঙ্গীত তুলনামূলকভাবে ফার্সি ও আরবি প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। যে সময়ে বিজয়নগর সাম্রাজ্য তার সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছিল, সেই সময়েই বিজয়নগরে কর্নাটকী সঙ্গীতের বিকাশ ঘটেছিল।[১৭] কর্নাটকী সঙ্গীতের "পিতা (পিতামহ) হিসাবে পরিচিত" পুরন্দর দাস, কর্নাটকী সঙ্গীত শিক্ষাদানের জন্য সাধারণভাবে ব্যবহৃত পদ্ধতির প্রণয়ন করেছিলেন।[১০][১৮] ভেঙ্কটমাখিন তাঁর সংস্কৃত রচনা চতুর্দন্ডী প্রকাশিকায় (১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ) রাগ শ্রেণিবিভাগের মেলকর্তা পদ্ধতির সূত্র উদ্ভাবন ও রচনা করেছেন।[১৬] বর্তমান ব্যবস্থায় প্রচলিত সম্পূর্ণ রাগ পরিকল্পনায় মেলকর্তা পদ্ধতিকে প্রসারিত করার জন্য গোবিন্দাচার্য পরিচিত হয়ে আছেন।
১৮ এবং ১৯ শতকে, কর্নাটকী সঙ্গীত প্রধানত মহীশূর ও ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যের স্থানীয় রাজাদের এবং তাঞ্জোরের মারাঠা শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল।[১৯] মহীশূর এবং ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যের রাজপরিবারের কিছু সদস্য স্বয়ং স্বনামধন্য সুরকার ছিলেন এবং বীণা, রুদ্রবীণা, বেহালা, ঘটম, বাঁশি, মৃদঙ্গ, নাগস্বর এবং স্বরভাতের মতো বাদ্যযন্ত্র বাজানোতে পারদর্শী ছিলেন।[২০] বিখ্যাত দরবারের সঙ্গীতজ্ঞ, যাঁরা সঙ্গীতে দক্ষ ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন বীণে শেষান্না (১৮৫২-১৯২৬)[২১] এবং বীণে সুবান্না (১৮৬১-১৯৩৯)।[২২]
১৯ শতকের শেষের দিকে, চেন্নাই শহর (তখন মাদ্রাজ নামে পরিচিত) কর্নাটকী সঙ্গীতের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত হয়েছিল।[২৩] ১৯৪৭ সালে পূর্ববর্তী দেশীয় রাজ্যগুলির অবিলুপ্তি এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমাপ্তির সাথে সাথে, কর্নাটকী সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষকতায় আমূল পরিবর্তন হয়ে এটি জনসাধারণের জন্য শিল্পে পরিণত হয়েছিল, সভা নামে পরিচিত বেসরকারী প্রতিষ্ঠান দ্বারা সংগঠিত টিকিটযুক্ত পরিবেশনা শুরু হয়েছিল।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.