Loading AI tools
বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তসীমান্ত নদী উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
কর্ণফুলি নদী (মিজো ভাষায় খাওৎলাং তুইপুই যার অর্থ "পশ্চিম নদী"[1] এবং চাকমা ভাষায় বোরগাং, যার অর্থ "বড় নদী") চট্টগ্রামের ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী। এটি বাংলাদেশ-ভারতের একটি সর্পিলাকার আন্তঃসীমান্ত নদী।[2] এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে প্রবাহিত ৬৬৭-মিটার (২,১৮৮ ফু) প্রশস্ত একটি নদী। ভারতের মিজোরামের মমিত জেলার শৈতা গ্রাম থেকে উদ্ভূত ২৭০ কিলোমিটার (১৭০ মা) নদীটি দক্ষিণ-পশ্চিমে চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম শহর হয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়েছে। পদ্মার পর এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে দ্রুত প্রবাহিত নদী। এটি "মিজোরামের সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের জল নিষ্কাশন ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে"।[3] ১৯৬০ সালে কাপ্তাই উপজেলার কর্ণফুলীতে একটি পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হয়েছিল। এই নদীর মোহনায় বাংলাদেশের বৃহত্তম এবং ব্যস্ততম সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দর অবস্থিত। এর প্রধান উপনদীগুলির মধ্যে রয়েছে কাওরপুই বা থেগা, তুইচাং, ফায়ারুয়াং, হালদা (বোয়ালখালী), কাসালং এবং সাহনী। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক কর্ণফুলী নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর হলো পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের নদী নং ০৩।[4]
চট্টগ্রামের ইতিহাসে আরব ব্যবসায়ী ও বণিকদের উপস্থিতির কারণে চট্টগ্রামের অনেক এলাকায় আরবি বংশোদ্ভূত নাম রয়েছে। কর্ণফুল থেকে এই নদীর নাম এসেছে বলে মনে করা হয়। আরবিতে যার অর্থ লবঙ্গ এবং এটি এমন একটি ঘটনাকে নির্দেশ করে যেখানে লবঙ্গ ভরা একটি আরব জাহাজ এই নদীতে ডুবে যায়।[5]
কর্ণফুলি নদীর নামের উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন কাহিনী প্রচলিত আছে। কথিত আছে যে, আরাকানের এক রাজকন্যা চট্টগ্রামের এক পাহাড়ি রাজপুত্রের প্রেমে পড়েন। এক জ্যোৎস্নাস্নাত রাতে তারা দুইজন এই নদীতে নৌভ্রমণ উপভোগ করছিলেন। নদীর পানিতে চাঁদের প্রতিফলন দেখার সময় রাজকন্যার কানে গোঁজা একটি ফুল পানিতে পড়ে যায়। ফুলটি হারিয়ে কাতর রাজকন্যা সেটা উদ্ধারের জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু প্রবল স্রোতে রাজকন্যা ভেসে যান, তার আর খোঁজ পাওয়া যায় নি। রাজপুত্র রাজকন্যাকে বাঁচাতে পানিতে লাফ দেন, কিন্তু সফল হন নি। রাজকন্যার শোকে রাজপুত্র পানিতে ডুবে আত্মাহুতি দেন। এই করুণ কাহিনী থেকেই নদীটির নাম হয় কর্ণফুলী। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'কর্ণফুলী' কাব্য হতে নামকরণের এ ঘটনা সম্পর্কে আরো স্পষ্ট হওয়া যায়। যেথায় তিনি লিখেছেন,
“ | ওগো ও কর্ণফুলী তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কানফুল খুলি |
” |
এছাড়া মনে করা হয় আরবি শব্দ করণফোল থেকেও কর্ণফুলী নামটি এসেছে। চট্টগ্রামের বিজ্ঞমুসলমান পণ্ডিতগণের মতে, আরব বণিকেরা চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল থেকে লবঙ্গ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি করতো। আরবিতে লবঙ্গকে বলা হয় করণফোল। একদিন এই করণফোল বোঝাই জাহাজ নদীতে ডুবে যায়। এই ঘটনা থেকেই এই নদী করণফোল নামে পরিচিত হল। কিন্তু চট্টগ্রামবাসীর মুখে এই নাম পরিবর্তিত হয়ে কর্ণফুলী নামে পরিচিত হয়।[6]
মধ্যযুগীয় পুঁথিতে নদীটিকে কাঁইচা খাল লিখা হয়েছে, মার্মা উপজাতিদের কাছে নদীটির নাম কান্সা খিওং এবং মিজোরামে কর্ণফুলীর নাম খাওৎলাং তুইপুই।
কর্ণফুলী নদী ভারতের মিজোরাম প্রদেশের মমিত জেলার শৈতা গ্রাম (লুসাই পাহাড়) হতে শুরু হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার কাছে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। এই নদীর মোহনাতে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর অবস্থিত। এই নদীর দৈর্ঘ্য ৩২০ কিলোমিটার। রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলার থেগা নদীর মোহনা বা ঠেগামুখ হতে বড় হরিণার মুখ পর্যন্ত এই ৬ কিলোমিটার কর্ণফুলী ভারত বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণ করেছে। এই ছয় কিলোমিটার নদীর ডান পাশে ভারত এবং বাম পাশে বাংলাদেশ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে কর্ণফুলী নদীর তীরে চট্টগ্রাম অবস্থিত। শহরটি দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য সমুদ্রতীরবর্তী বন্দর নগরী এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার জনসংখ্যা প্রায় ৮.৯ মিলিয়নেরও বেশি।[7] বন্দরের পানির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে কর্ণফুলী নদীর পানি ব্যবহারের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি পানি শোধনাগার স্থাপন করেছে।[8] নদীটি চট্টগ্রাম শহরের পতেঙ্গাহয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়েছে।
তলবুং মিজোরামের লুংলেই জেলার কর্ণফুলির তীরে অবস্থিত। কর্ণফুলী মিজোরামকে বঙ্গোপসাগরের তীরে চট্টগ্রামের বন্দর নগরীর সাথে যুক্ত করেছে। ঔপনিবেশিক আমলে মিজোরামে পৌঁছানোর জন্য ব্রিটিশ সৈন্য ও ধর্মপ্রচারকরা এই পথ ব্যবহার করত। মোটরবোটে চট্টগ্রাম থেকে তলবুং পর্যন্ত পৌঁছাতে ৫ দিন সময় লাগত, প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরত্ব তারপর তারা আরও ৩৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে লুংলেই পৌঁছাতেন।[9]
১৮৮৩ সালে কর্ণফুলির মোহনায় সৃষ্টি হয় লুকিয়া চর। ১৮৭৭ সালে জুলদিয়া চ্যানেল। জুলদিয়া চ্যানেলটি আড়াই মাইল দীর্ঘ এবং দেড় মাইল প্রশস্ত। ১৯০১ সাল থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে পতেঙ্গা চ্যানেলটি জুলদিয়া চ্যানেল থেকে প্রায় দেড় হাজার ফুট পশ্চিমে সরে যায়। হালদা নদীর সাথে কর্ণফুলীর সংযোগ স্থলে আছে বিশাল চর। যা হালদা চর হিসাবে পরিচিত। নদীর প্রবাহের কিছু অংশ নাজিরচর ঘেঁষে, কিছু অংশ বালু চ্যানেলের মধ্যে দিয়ে এবং কিছু মুল স্রোত হিসেবে প্রবাহিত হচ্ছে। ১৯৩০ সালে কালুরঘাট রেলওয়ে সেতু নির্মাণের আগে নদীর মূল প্রবাহ প্রধানত কুলাগাঁও অভিমুখে বাম তীর ঘেষেই প্রবাহিত হত। কালুরঘাট সেতু হওয়ার পর সেতুর ডান দিকে আরও একটি প্রবাহের মুখ তৈরি হয়। ফলে নদীর মাঝ পথে সৃষ্টি হয় বিশাল একটি চর- যা কুলাগাঁও চর নামে পরিচিত।[10]
কর্ণফুলি নদীর উপর বাঁধ দিয়ে রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায় কাপ্তাই বাঁধ তৈরি করা হয় ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে। এই বাঁধে সঞ্চিত পানি ব্যবহার করে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়।
নদীটি বিপন্ন প্রজাতির গঙ্গা নদী শুশুকের আবাসস্থল।[11] আগে নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত, কিন্তু দূষণের কারণে নদী থেকে ইলিশ প্রায় হারিয়ে গেছে।[12]
১৯৩০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে কর্ণফুলী নদীর মোহনা হতে ৭/৮ মাইল উজানে কালুরঘাট নামক স্থানে কালুরঘাট রেল সেতু নির্মিত হয়। এটি কর্ণফুলী নদীর দ্বারা দ্বিখন্ডিত বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলাকে উত্তর ও দক্ষিণাংশে সংযুক্ত করে।
২০১১ সালে কর্ণফুলী নদীর উপর শাহ আমানত সেতু নির্মআন করা হয়। সেতুটি কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ের শিল্প এলাকায় শিল্পের বিকাশে সহায়ক হওয়ার পাশাপাশি, বান্দরবান এবং কক্সবাজারকে চট্টগ্রাম শহরের সাথে যুক্ত করে।[13]
২০২৩ সালের অক্টোবরে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দুই লেনের কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ করা হয়েছে, যেটি বাংলাদেশের প্রথম আন্ডারওয়াটার টানেল।[14] সুড়ঙ্গটি বাংলাদেশ নেভাল একাডেমির পাশ দিয়ে শুরু হয়ে নদীর দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা উপজেলার চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থানে নদীর দুই তীরের অঞ্চলকে যুক্ত করেছে। এই সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যুক্ত হয়।[15]
বাংলাদেশের অনেক নদীর মতো কর্ণফুলীও শিল্প ও কৃষি প্রবাহের কারণে ব্যাপকভাবে দূষিত। ফলে উপলব্ধ অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস এবং নদীর জলজ প্রাণীর ক্ষতি সাধিত হচ্ছে।[8] ২০১৫ সালে, তেলবাহী একটি ট্রেন নদীর একটি উপনদীতে বিধ্বস্ত হলে নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশের অবনতি ঘটায়।[16]
কবি ওহীদুল আলম ১৯৪৬ সালে কর্ণফুলীর মাঝি নামে একটি কাহিনী-কাব্য রচনা করেন। ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ ১৯৬২ সালে রচনা করেন তার উপন্যাস কর্ণফুলী। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় লিখেছেন,
“ | ওগো ও কর্ণফুলী তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কানফুল খুলি |
” |
এছাড়াও চট্টগ্রামী ভাষার গানে এবং লোক-সংস্কৃতিতে এই নদীর প্রভাব অনেক। চট্টগ্রামী ভাষার ক’টি জনপ্রিয় গান,
১. ছোড ছোড ঢেউ তুলি পানিত ছোড ছোড ঢেউ তুলি
লুসাই ফা-রত্তুন লামিয়ারে যারগই কর্ণফুলী’।
২. মৌসুমী এবং ফেরদৌস এর‘ওরে সাম্পানওয়ালা,,,তুই আমারে করলি দিওয়ানা যেটি তুমুল জনপ্রিয় একটি গান।।
৩.কিংবদন্তী চিত্রনায়িকা মৌসুমী অভিনীত কর্ণফুলী নদী নিয়ে আরো দুইটি গান সিনেমায় জনপ্রিয়।।ওরে কর্ণফুলী রে সাক্ষী রাখিলাম তোরে এবং কর্ণফুলী সম্পান ওয়ালা আমার মন কাড়িয়া নিলো।[17]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.