বাংলা সালতানাত
মধ্যযুগের বাংলার একটি রাজ্য / From Wikipedia, the free encyclopedia
বাংলা সালতানাত, শাহি বাংলা বা সুলতানি বাংলা (ফার্সি: سلطنت بنگاله، شاهی بنگاله، سلطانی بنگاله, প্রতিবর্ণীকৃত: Salṭanat-e-Baṅgālah, Shāhī Baṅgālah, Sulṭānī Baṅgālah)[2] ছিল ১৪শ থেকে ১৬শ শতাব্দীর মাঝামাঝি বঙ্গ অঞ্চলে স্থিত একটি শেষ মধ্যযুগীয় সালতানাত।[3][4][5][6] বাংলা সালতানাতকে 'শাহী বাঙ্গালা' নামেও অভিহিত করা হতো। গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে এটি ছিল প্রভাবশালী শক্তি। সালতানাতের রাজ্য জুড়ে ছিল অসংখ্য টাকশাল। ভারতীয় উপমহাদেশে সামন্ত রাজ্য গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলা সালতানাত তাদের অঞ্চল বিস্তৃত করেছিল। দক্ষিণ-পশ্চিমে ওড়িশা, দক্ষিণ-পূর্বে আরাকান ও পূর্বে ত্রিপুরা পর্যন্ত তাদের প্রভাব ছিল।
বাংলা সালতানাত | |||||||||||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
১৩৫২–১৫৩৯ ১৫৫৪–১৫৭৬ | |||||||||||||||||
পতাকা | |||||||||||||||||
হোসেন শাহী শাসনামলে বাংলা সলতনতের ব্যাপ্তি | |||||||||||||||||
অবস্থা | সলতনত | ||||||||||||||||
রাজধানী | পাণ্ডুয়া (১৩৫২–১৩৯০) সোনারগাঁও[lower-alpha 1][1] (১৩৯০–১৪৬৬) গৌড় (১৪৬৬–১৫৬৫) তাণ্ডা (১৫৬৫–১৫৭৬) | ||||||||||||||||
প্রচলিত ভাষা | |||||||||||||||||
ধর্ম | |||||||||||||||||
সরকার | পূর্ণ রাজতন্ত্র | ||||||||||||||||
সুলতান | |||||||||||||||||
• ১৩৪২–১৩৫৮ (প্রথম) | শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ | ||||||||||||||||
• ১৫৭২–১৫৭৬ (শেষ) | দাউদ খান কররানী | ||||||||||||||||
ইতিহাস | |||||||||||||||||
• একত্রীকরণ | ১৩৫২ | ||||||||||||||||
১৩৫৩–১৩৫৯ | |||||||||||||||||
• রাজা গণেশের বিদ্রোহ | ১৪১৪ | ||||||||||||||||
১৪১৫–১৪২০ | |||||||||||||||||
১৪২৯–১৪৩০ | |||||||||||||||||
১৫১২–১৫১৬ | |||||||||||||||||
• সুরি আক্রমণ | ১৫৩৯ | ||||||||||||||||
• পুনঃপ্রতিষ্ঠা | ১৫৫৪ | ||||||||||||||||
১৫৭২–১৫৭৬ | |||||||||||||||||
• বারো ভূঁইয়ার প্রতিরোধ | ১৫৭৬–১৬১১ | ||||||||||||||||
১৫৭২ ১৫৭৬ | |||||||||||||||||
মুদ্রা | টঙ্কা | ||||||||||||||||
| |||||||||||||||||
বর্তমানে যার অংশ | বাংলাদেশ ভারত (পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, সিক্কিম, মিজোরাম) মিয়ানমার (আরাকান) নেপাল (মেচী অঞ্চল) |
হোসেন শাহী বংশের শাসনামলে বাংলা সালতানাত নিজের শক্তির শীর্ষে পৌঁছায়। সুলতানি আমলে নেপাল থেকে শুরু করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা (বর্তমানের আসাম) আর জৌনপুর ও বারাণসী পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল। বঙ্গসহ এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ বানিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে তখন বাংলা সুপরিচিত ছিল। সুরি সাম্রাজ্যের হস্তক্ষেপের পর থেকে ক্ষয়িষ্ণু হতে শুরু করে বাংলা সালতানাতের শক্তি। মুঘল বিজয় ও ভেঙে পড়ার মাধ্যমে অবশেষে সুলতানি শাসনের সমাপ্তি ঘটে। বাংলা সালতানাত ছিল একটি সুন্নি মুসলিম শাসিত রাজ্য যেখানে বাঙালি, তুর্কী-পারস্য, আফগান এবং আবিসিনিয়ান অভিজাত শ্রেণীর প্রভাব লক্ষ্য করা যেত। সর্বাধিক পরিচিত বংশগুলির মধ্যে ছিল ইলিয়াস শাহী, গণেশ বংশ এবং হোসেন শাহী বংশ। সালতানাতের আমলে ধর্মীয় বৈচিত্র্য ছিল অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অমুসলিম সম্প্রদায়গুলোও শান্তি-সহাবস্থানের অধিকারী ছিল। ফারসি ভাষা রাষ্ট্রীয়, কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হত। বাংলা ভাষা প্রথমবারের মতো সুলতান আমলেই দরবারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বাংলা সালতানাতের যেসব শহর টাকশালের কাজে ব্যবহৃত হত সেগুলোকে 'মিন্ট টাউন' বলা হতো। এখানেই ঐতিহাসিক 'টাকা'র প্রচলন ঘটে। মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের সৌন্দর্যে সজ্জিত ছিল এই শহরগুলো। ষোড়শ শতাব্দীতে, রাজধানী শহর গৌড় ছিল পৃথিবীর পঞ্চম জনবহুল নগরী। অর্থনৈতিক কেন্দ্র সোনারগাঁও, মসজিদের শহর বাগেরহাট এবং সমুদ্র বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র চট্টগ্রামও ছিল বাংলা সালতানাতের গুরুত্বপূর্ণ শহর। সামুদ্রিক ও স্থলপথের মাধ্যমে এশিয়া, আফ্রিকা, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং ইউরোপের সাথে বাংলা সালতানাত সুসম্পর্ক রাখত। উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে বঙ্গোপসাগরের তীরে বাংলা সালতানাত গড়ে ওঠে। সারা বিশ্ব থেকে তখন বণিক ও অভিবাসীরা বাংলায় আসত। মালদ্বীপ, চীন, মালেকা অঞ্চলের সাথেও বাঙালি জাহাজ ও ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক ছিল।
সমসাময়িক ইউরোপীয় এবং চৈনিক পরিব্রাজকদের বর্ণনায় বাংলাকে সম্পদশালী রাজ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রচুর পণ্য সম্ভার এবং বৈচিত্রের কারণে তখন বাংলাকে 'ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্রেষ্ঠ দেশ' হিসেবে বর্ণনা করা হতো। স্থাপত্য ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবেও বাংলা সালতানাত চিরস্মরণীয়। এসকল স্থাপত্যে বিদেশি প্রভাবের পাশাপাশি একটি স্বতন্ত্র বাঙালি রীতিও লক্ষণীয়। বাংলার ইতিহাসে স্বাধীন মুসলিম শাসিত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলা সালতানাত ছিল সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে প্রতিপত্তিশালী।