Loading AI tools
প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু দর্শন উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
সাংখ্য (সংস্কৃত: सांख्य, IAST: sāṅkhya) হল প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু দর্শনের আস্তিক শাখার ছয়টি দর্শনের মাঝে অন্যতম। বেদের প্রতি আস্থা থাকায় এই দর্শনটি আস্তিক্য দর্শন শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়। হিন্দু পৌরাণিক ঋষি কপিলকে এই দর্শন শাখার সমন্বায়ক বা প্রবর্তক মনে করা হয়। সাংখ্য দর্শন ভারতের প্রাচীনতম দর্শন শাখাগুলির একটি।[1] এই দর্শনকে ভারতীয় অন্যান্য দর্শন অপেক্ষা সর্বপ্রাচীন বলে মনে করা হয়।
গণনামূলক এ দর্শন কঠোরভাবে দ্বৈতবাদী।[2][3][4] এ দর্শনের মতে, জগৎ দু'টি সত্যের দ্বারা গঠিত; পুরুষ (সাক্ষ্য-চৈতন্য) ও প্রকৃতি (আদি-পদার্থ)।[5] এখানে পুরুষ হচ্ছে চৈতন্যময় সত্ত্বা যা পরম, স্বাধীন, মুক্ত এবং ইন্দ্রিয়ের উপলব্ধির বাইরে। যাকে যেকোনো অভিজ্ঞতা অথবা শব্দের দ্বারা বর্ণনা করা অসম্ভব।[6][7][8] আর প্রকৃতির সত্ত্বা হচ্ছে জড় রূপা। এটি নিষ্ক্রিয় বা অচেতন এবং সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ -এই ত্রিগুণের সাম্যবস্থা।[8][9]
প্রকৃতি পুরুষের সংস্পর্শে আসলে প্রকৃতিতে ত্রিগুণের এই ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়, এবং প্রকৃতির প্রকাশ পায় বা অস্তিত্বমান হয়। একে বলা হয় বিকৃতি। বিকৃতির ফলে সৃষ্টিতে আরও তেইশ তত্ত্বের বিকাশ লাভ করে।[8] প্রকৃতি, পুরুষ এবং তেইশ তত্ত্ব সহ মোট পঁচিশ তত্ত্ব হচ্ছে সাংখ্য দর্শনের প্রধান আলোচ্য বিষয়।
"জীব" হচ্ছে সেই অবস্থা, যেখানে পুরুষ প্রকৃতিতে আবদ্ধ হয়।[10] আর এই বন্ধনের অবসানকে বলা হয় মোক্ষ বা মুক্তি বা কৈবল্য অবস্থা।[11] মোক্ষলাভের পরে কী হয় তা এদের দার্শনিক চর্চায় ব্যাখ্যা করা হয় নি। এই দর্শনে ঈশ্বরের কথা উল্লেখ না করার কারণ হিসেবে বলা হয় মোক্ষলাভের পর ব্যক্তি ও পরম পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।[12]
সাংখ্য দর্শনকে আস্তিক এবং নাস্তিক উভয় দর্শন হিসেবে দেখা হয়, কারণ এই দর্শনের সাংখ্যপ্রবচন সূত্র ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্পষ্টভাবে নিশ্চিত করে না। যদিও অনেক পণ্ডিত ধারণাটিকে সঠিক বলে মনে করেন না। কারণ, এই দর্শনে "ঈশ্বর" বলতে “পুরুষ” বুঝানো হয় বলে তারা মনে করেন।[13]
সাংখ্য দর্শন জ্ঞান অর্জনের ছয়টি প্রামাণিক উপায়ের মাঝে তিনটিকে নির্ভরযোগ্য উপায় হিসেবে গ্রহণ করে। এই তিনটি প্রমাণ হচ্ছে, প্রত্যক্ষ প্রমাণ, অনুমান প্রমাণ এবং শব্দ প্রমাণ (আপ্তবচন)।[14][15][16]
“সাংখ্য” নামের উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কারও কারও মতে ‘সংখ্যা’ শব্দ থেকে ‘সাংখ্য’ শব্দের উৎপত্তি। কারণ এই দর্শনে তত্ত্বসমূহের সংখ্যা গণনার মাধ্যমে জ্ঞান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই দর্শনে মোট তত্ত্ব সংখ্যা হচ্ছে পঁচিশ।[17]
আবার অনেকে ধারণা করেন, সংখ্যাচার্য নামক জনৈক দার্শনিক ছিলেন সাংখ্যদর্শনের প্রবর্তক। তার নামানুসারে এই দর্শনের নাম ‘সাংখ্য’। কিন্তু এই অভিমতের সমর্থনে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। কপিলকেই সাংখ্য দর্শনের প্রবর্তক বলে বহু শাস্ত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, ‘সংখ্যা’ শব্দের অর্থ ‘সম্যক জ্ঞান’। ‘সং’ শব্দের অর্থ ‘সম্যক’ এবং ‘খ্যা’ শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’ বা বিবেক খ্যাতি। সুতরাং যে শাস্ত্র পাঠ করলে সম্যক্ জ্ঞান লাভ হয়, তাকেই ‘সাংখ্য’ বলে। একে আন্মীক্ষিকী বিদ্যাও বলা হয়।
ভারতীয় দর্শনের মধ্যে সাংখ্যদর্শনকেই সর্বপ্রাচীন বলে ধারণা করা হয়। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে এবং উপনিষদে সাংখ্যদর্শনের চিন্তাধারার বীজ খুঁজে পাওয়া যায়। অধ্যাপক গার্বের মতে- খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতেই সাংখ্য মতের উৎপত্তি।
অবশ্য সাংখ্য দর্শনের আদি গ্রন্থগুলো এখন লুপ্তপ্রায়।[18] ‘সমাসসূত্রম্’ ও ‘সূত্রষড়াধ্যায়ী’ - এই গ্রন্থদুটি সাংখ্যদর্শনের মূল গ্রন্থ যা বর্তমানে লুপ্ত। সাংখ্য দর্শনের উপর বর্তমান উপলব্ধ গ্রন্থগুলো আধুনিক বলে অনেকে মনে করেন।
ধ্রুপদি সাংখ্য দর্শনের যে প্রাচীনতম প্রামাণ্য গ্রন্থটি এখনও পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে, সেটি হল ঈশ্বরকৃষ্ণের[19] সাংখ্যকারিকা (২০০ খ্রিষ্টাব্দ[20] বা ৩৫০-৪৫০ খ্রিষ্টাব্দ[19])। ঈশ্বরকৃষ্ণ তার কারিকায় কপিল থেকে শুরু করে আসুরি ও পঞ্চশিখ হয়ে তার নিজের নাম পর্যন্ত একটি গুরু-শিষ্য পরম্পরার উল্লেখ করেছেন। এই গ্রন্থে পঞ্চশিখ রচিত সাংখ্য দর্শনের একটি প্রাচীনতর শাস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায় - ষষ্টিতন্ত্র। এই গ্রন্থটি বর্তমানে উপলব্ধ নয়।[19] সাংখ্যকারিকার ৭২ সূত্রে সাংখ্য কারিকাকে ষষ্টিতন্ত্রের সংক্ষিপ্তসার বলে এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
সাংখ্যকারিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ভাষ্যটি অদ্বৈত বেদান্ত প্রবক্তা গৌড়পাদের রচিত বলে প্রচলিত বিশ্বাস। ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক রিচার্ড কিং-এর মতে, গৌড়পাদ সম্ভবত দুটি আলাদা দর্শন শাখার উপর গ্রন্থ রচনা করেননি। সাংখ্যকারিকার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভাষ্য হল যুক্তিদীপিকা (খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দী) ও বাচস্পতি মিশ্রের সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী (খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী)।[21]
কপিল প্রণিত ‘তত্ত্বসমাস’ গ্রন্থটি সাংখ্যর্শনের উপর রচিত প্রথম গ্রন্থ বলে মনে করা হয়। এতো মোট তেইশটি সূত্র আছে, যার মাধ্যমে সাংখ্যদর্শনের সমস্ত তত্ত্ব অত্যন্ত সংক্ষেপে সুসজ্জিত করা হয়েছে। গ্রন্থটি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হওয়ায় কপিলদেব ‘সাংখ্যপ্রবচন সূত্র’ নামে ৪৫৮ সূত্রের একটি বিস্তৃত ব্যাখ্যা গ্রন্থ রচনা করেন, এরূপ শোনা যায়। তবে গার্বে মনে করেন, এটি খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে রচিত। এই গ্রন্থটি মধ্যযুগে সাংখ্য দর্শনের প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি করে।
সাংখ্যকারিকার পর এটিই সাংখ্য দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।[22] অনিরুদ্ধ (সাংখ্যপ্রবচন সূত্রবৃত্তি, খ্রিস্টীয় ১৫শ শতাব্দী), বিজ্ঞানভিক্ষু (সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য, খ্রিস্টীয় ১৬শ শতাব্দী), মহাদেব (বৃত্তিসার, খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দী) ও নাগেশ (লঘুসাংখ্যসূত্রবৃত্তি) এই গ্রন্থের ভাষ্য রচনা করেছিলেন।[23] ভারতীয় দর্শন বিশেষজ্ঞ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের মতে, প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্র চরক সংহিতা বইতে প্রাচীন সাংখ্য শাখার কিছু মতামত লিপিবদ্ধ আছে।[24]
"সাংখ্য" শব্দটির অর্থ "অভিজ্ঞতা-প্রসূত" বা "সংখ্যা-সম্বন্ধীয়"।[17] খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম দিকে এই শব্দটি সাধারণ ক্ষেত্রে "দার্শনিক জ্ঞান" এবং পারিভাষিক অর্থে 'সাংখ্য দর্শন' বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হত।[25]
জিমার-এর[26][note 1] রুসার[28] মতে, সাংখ্য দর্শন অবৈদিক উৎস থেকে উদ্ভূত হয়েছে:
শিব-শক্তি/আকাশ-পৃথিবীর গ্রাম্য ধর্মতত্ত্ব এবং যোগ (ধ্যান) ঐতিহ্যের উৎস সম্ভবত বেদে নেই। ধ্রুপদি সাংখ্য যে বেদ-সহ রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তাতেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। সাংখ্য বেদ সম্পর্কে নীরব। বেদের রক্ষক (ব্রাহ্মণ সমাজ), সমগ্র জাতিভেদ ব্যবস্থা, বৈদিক দেবদেবীদের সম্পর্কে সাংখ্য নীরব। প্রাচীন বৈদিক ধর্মে যে পশুবলি প্রথা প্রচলিত ছিল, তার বিরুদ্ধেও সাংখ্য যৎসামান্য সরব। কিন্তু সাংখ্য দর্শনের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে আমরা যে প্রথম তথ্যসূত্রগুলি পাই সে সবই বৈদিক সংস্কৃতির অংশ। তাই আমরা মনে করতেই পারি যে এগুলির মধ্যে সাংখ্য দর্শনের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ দেখতে পাই না। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে ধীরে ধীরে এই দর্শন গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। সেই ধীরে ধীরে গ্রহণীয় হয়ে ওঠার সময় এর যে বিকাশ ঘটেছিল; তারই কিছু কিছু নিদর্শন আমরা দেখি।[28]
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে[29] বিভিন্ন সূত্র থেকে উৎসারিত হয়ে সাংখ্য দর্শনের একটি পৃথক শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।[29] এই যুগে রচিত দর্শন গ্রন্থ কঠ উপনিষদ্, শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদ্ ও ভগবদ্গীতায় সাংখ্য পরিভাষা ও ধারণার স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।[30] কঠ উপনিষদের মতে, পুরুষ হলেন আত্মা। উপনিষদের অন্যত্র পুরুষের বুড়ো আঙুলের থেকেও ছোটো বলা হয়েছে।[31]
শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদে প্রথম সাংখ্য ও যোগ শব্দদুটি একসঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে।[30] ভগবদ্গীতায় সাংখ্যকে জ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।[32] তিন গুণের উল্লেখ ভগবদ্গীতাতেও পাওয়া যায়। যদিও ধ্রুপদি সাংখ্য দর্শনে তারা ঠিক সেই অর্থে উল্লিখিত হয়নি।[33] ভগবদ্গীতায় সাংখ্য দর্শনে ভক্তিবাদী শাখাগুলির ভক্তিবাদের সঙ্গে বেদান্তের নির্বিশেষ ব্রহ্মের সংযোগ স্থাপিত হয়েছে।[19]
রুসার মতে, ২০০০ বছর আগে, "সাংখ্য হিন্দু সমাজের একটি প্রতিনিধিত্বমূলক দর্শনশাখায় পরিণত হয়েছিল।"[28] এই শাখা হিন্দুধর্মের সব সম্প্রদায়ের সব ধর্মগ্রন্থকেই প্রভাবিত করেছিল।[28]
ধ্রুপদি সাংখ্য দর্শনগ্রন্থ সাংখ্যকারিকায় উল্লিখিত ও সংকলিত ধারণাগুলি বেদ, উপনিষদ্ ও ভগবদ্গীতাতেও দেখা যায়।[29][34] দ্বৈতবাদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে সংকলিত ঋগ্বেদে।[35] ঋগ্বেদের ইন্দ্র-বৃত্র উপাখ্যানে এই দ্বৈতবাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। দসর্পদানব বৃত্র সৃষ্টিশক্তিকে বদ্ধ করে রেখেছিল। দেবতাদের রাজা ইন্দ্র সেই শক্তিকে মুক্ত করার জন্য বৃত্রকে হত্যা করেন। ভারতীয় ধর্ম ও দর্শন বিশেষজ্ঞ গেরাল্ড জেমস লারসন মনে করেন এই উপাখ্যানে দ্বিমুখী দ্বৈতবাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন,
একদিকে আছে শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলার দ্বৈতবাদ। অন্যদিকে আছে সেই শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলার উপর ইন্দ্রের শক্তির দ্বৈতবাদ।[36]
ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তে সৎ ও অসতের মধ্যে যে দ্বৈতবাদ আরোপ করা হয়েছে, তা অনেকটা সাংখ্যের ব্যক্ত-অব্যক্ত দ্বৈতবাদের অনুরূপ। পুরুষসূক্ত সম্ভবত সাংখ্য দর্শন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রচিত হয়েছিল।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এর মধ্যে পুরুষের প্রথম ধারণাটি দেখা যায় - যেখানে পুরুষ এক বিশ্বজনীন সত্ত্বা এবং যার থেকে বিশ্বের উৎপত্তি।[37] অথর্ববেদের একাধিক স্তোত্রে পুরুষের উল্লেখ পাওয়া যায়।[38] সাংখ্য দর্শনের বুদ্ধি বা মহতের ধারণাটি ঋগ্বেদ ও শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদে উল্লিখিত হিরণ্যগর্ভ ধারণার অনুরূপ।[39]
এই (জগতের) সৃষ্টিকালে শুধু আত্মাই ছিলেন ব্যক্তির আকারে। চারিদিকে তাকিয়ে তিনি আত্মাকে ছাড়া কিছুই দেখলেন না। তিনি প্রথম যে কথাটি বললেন, তা হল 'আমি আছি' (অহং অস্মি)।
—বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ১।৪।১[40]
প্রাচীনতম মুখ্য উপনিষদগুলিতে (রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ৯০০-৬০০ অব্দ) ধ্রুপদি সাংখ্য দর্শনের কিছু কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়।[29] সাংখ্য দর্শনের অহংকার ধারণার প্রতিধ্বনি শোনা যায় বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ও ছান্দোগ্য উপনিষদের অহংকার ধারণায়। সৎকার্যবাদ বা সাংখ্য কারণতত্ত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় ষষ্ঠ অধ্যায়ের শ্লোকে যেখানে সৎ-স্বরূপের প্রাধান্য কথিত হয়েছে এবং তা থেকে সৃষ্টির বিবরণ দেওয়া হয়েছে। সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিন গুণের প্রভাবের যে উল্লেখ ছান্দোগ্য ও শ্বেতাশ্বেতরে পাওয়া যায়, তাও সাংখ্য প্রভাবিত।[41] উপনিষদের দুই ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য ও উদ্দালক আরুণি শুদ্ধচৈতন্যকে মানুষের গভীরতম সারবস্তু বলে উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত এর থেকেই সাংখ্যের পুরুষ ধারণার উৎপত্তি। সাংখ্যের তত্ত্বগণনার উল্লেখ পাওয়া যায় তৈত্তিরীয় উপনিষদ্, ঐতরেয় উপনিষদ্ ও বৃহদারণ্যক উপনিষদের যাজ্ঞবল্ক্য-মৈত্রেয়ী সংলাপে।[42]
তিনি সকল চিরন্তনের মধ্যে চিরন্তন, সকল বুদ্ধির বুদ্ধি, তিনি বহুর মধ্যে এক, যিনি ইচ্ছা পূর্ণ করেন। সেই কারণ, যা বিভাজন ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে পুরোপরি বোঝা যায় (সাংখ্যোধিগম্যম্) - যিনি সকল শৃঙ্খলমুক্ত ঈশ্বর।
—শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদ্ চার। ১৩[43]
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে উত্তর ভারতে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের উদ্ভব হয়। সম্ভবত এই দুই ধর্মমত ও সাংখ্য দর্শনের আদি উপশাখাগুলি পরস্পরকে প্রভাবিত করেছিল। বৌদ্ধধর্ম ও সাংখ্যের মধ্যে সাদৃশ্য দেখা যায় উভয় মতে দুঃখের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপের বিষয়ে। যদিও বৌদ্ধধর্মে যেমন দুঃখবাদ একটি কেন্দ্রীয় ধারণা, সাংখ্যে তা নয়। তাই মনে করা হয়, সাংখ্য দুঃখবাদ গ্রহণ করেছে বৌদ্ধধর্ম থেকে। অন্যদিকে জৈন ধর্মমতের জীবাত্মার বহুত্ববাদ সম্ভবত সাংখ্যের বহুবিধ পুরুষ ধারণাকে প্রভাবিত করেছিল। যদিও ভারততত্ত্ববিদ হারমান জাকোবি বলেছেন, সাংখ্য বহু পুরুষের ধারণা জৈনধর্মের জীব ধারণা থেকে উৎসারিত এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ নেই। সম্ভবত বৈদিক ও অবৈদিক বহু প্রাচীন দর্শনের জীব ধারণা দ্বারা সাংখ্য প্রভাবিত হয়েছিল।[44]
হে অর্জুন, শোক, মোহ ইত্যাদি সংসারের কারণ নাশ করে যে সাংখ্য নামক তত্ত্বজ্ঞান, তা তোমাকে দেওয়া হল। এখন কর্মযোগের কথা বলছি; শোনো। নিষ্কাম কর্মযোগ বিষয়ে এই জ্ঞান লাভ করলে তুমি কর্মের বাঁধন থেকে মুক্ত হবে।
—ভগবদ্গীতা ২।৩৯[45]
পাশ্চাত্য দর্শনে মনকে চৈতন্যময় সত্ত্বার সঙ্গে এক করে তার ভিত্তিতে মন-দেহ দ্বৈতবাদের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সাংখ্য দর্শনে অন্য এক ধরনের দ্বৈতবাদের উল্লেখ করা হয়েছে। এই মতবাদ সারবাদী দ্বৈতবাদের (substance dualism) সঙ্গে তুলনীয়। সাংখ্য দর্শনে চৈতন্য ও জড় জগতের মধ্যে একটি আধ্যাত্মিক সীমারেখা টানা হয়েছে এবং দেহ ও মনকে জড় জগতের অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে।[46][47]
সাংখ্য দর্শনে চৈতন্য ও জগতের মধ্যে দ্বৈতবাদের উপস্থাপনা করা হয়েছে দুটি "অক্ষয়, অবাঙমনসগোচর ও স্বতন্ত্র" সত্ত্বার মাধ্যমে। এদুটি হল পুরুষ ও প্রকৃতি। প্রকৃতি এক, কিন্তু পুরুষ অনেক বলে বর্ণিত হয়েছে। প্রকৃতি চৈতন্যবিহীন জড়, অব্যক্ত বা অপ্রকাশিত, উৎপত্তি কারণবিহীন, চিরসক্রিয়, বাক্য ও মনের অগোচর এবং চিরন্তন বা নিত্য। এই প্রকৃতি এককভাবে জাগতিক বস্তুর সর্বোচ্চ উৎস। সকল জাগতিক বস্তু প্রকৃতির মধ্যেই স্পষ্টভাবে ও আপেক্ষিকভাবে সমাহিত। পুরুষ হল চৈতন্যময় সত্ত্বা। পুরুষ পরোক্ষ "ভোক্তা" এবং প্রকৃতি হল "ভোগ্যা"। সাংখ্য দর্শনের মতে, পুরুষ জড় জগতের কারণ নয়। কারণ চৈতন্যময় সত্ত্বা কখনও চৈতন্যবিহীন জড় জগতে রূপান্তরিত হতে পারে না। এটি বহুত্ববাদী আধ্যাত্মিকতা, নাস্তিক বাস্তবতাবোধ ও কঠোর দ্বৈতবাদ।[48]
সাংখ্য দর্শনের প্রকৃতিতত্ত্ব সৎকার্যবাদ অর্থাৎ কার্যকারণবাদের উপর নির্ভরশীল। কারণ ব্যতিত কোনো কার্যই ঘটা সম্ভব নয়। কার্য উৎপন্ন হওয়ার পূর্বে কার্য তার উপাদান করণে অব্যক্ত বা প্রচ্ছন্ন অবস্থায় ‘সৎ’ বা বিদ্যমান থাকে। যেমন, মৃৎপাত্র মৃত্তিকার মধ্যে প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে, কুম্ভকার মৃৎপাত্রকে ব্যক্ত করেন। তখন মৃত্তিকা প্রকৃতই মৃৎপাত্রে পরিণত হয়। এই কার্যকারণ তত্ত্বকেই সৎকার্যবাদ বলা হয়।
এই সৎকার্যবাদের দুটি রূপ - পরিণামবাদ ও বিবর্তনবাদ। বিবর্তনবাদ অনুসারে কারণ বাস্তবিকই কার্যে পরিণত হয় না, কার্যরূপে প্রতিভাত হয়। যেমন, রজ্জুতে সর্পভ্রম হলে রজ্জু সর্পরূপে প্রতিভাত হয়, সর্পে পরিণত হয় না। অপরদিকে, পরিণামবাদ অনুসারে কারণ থেকে যখন কার্যের উৎপত্তি হয়, তখন কারণ প্রকৃতই কার্যে পরিণত হয়। সাংখ্যদার্শনিকেরা পরিণামবাদকে সমর্থন করে।
প্র+করোতি অর্থাৎ, এই বিশ্ব যার কৃতি তাই প্রকৃতি। প্রকৃতি জড় রূপা। একে জগৎ সৃষ্টির প্রথম এবং মূল উপাদান কারণ মনে করা হয় - পুরুষ ছাড়া সব কিছুই প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন। মন ও শক্তি সহ যা কিছু জাগতিক সব কিছুই প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত। এটিই জগতের প্রথম "তত্ত্ব"। তাই একে বলা বলে "প্রধান"। কিন্তু এটি চৈতন্যরহিত ও বুদ্ধিরহিত বলে একে বলা হয় "জড়"। এটি তিনটি গুণের বিশেষ অবস্থা। এগুলি হল:
সকল জাগতিক ঘটনাকে প্রকৃতির বিবর্তনের ক্রিয়া মনে করা হয়। প্রকৃতিই মূল তত্ত্ব। প্রকৃতির থেকেই যাবতীয় জাগতিক বস্তু সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যেক জীব পুরুষ ও প্রকৃতির মিশ্রণে গঠিত। জীবের আত্মা বা পুরুষ অসীম ও দেহের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। "সংসার" বা বন্ধন তখনই আসে যখন পুরুষ জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত না হয়ে নিজের আপেক্ষিক পরিচিতির অনুগামী হয় এবং অহংকারের সঙ্গে নিজেকে এক করে ফেলে। অহংকার হল প্রকৃতির একটি গুণ। জ্ঞানের মাধ্যমে আত্মা চৈতন্যময় পুরুষ ও চৈতন্যরহিত প্রকৃতির পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন হয়। তখনই সে মুক্ত হয়।
প্রধান বা মূল প্রকৃতি হতে ২৩টি উপাদান গঠিত। এর মধ্যে রয়েছে বুদ্ধি বা মহৎ, অহংকার ও মন। বুদ্ধি, মন ও অহংকার হচ্ছে জড় প্রকৃতি হতে সৃষ্টি বিকৃতি। চিন্তাশক্তি ও মানসিক সংযমের মাধ্যমে পুরুষ বিবেক জ্ঞান লাভ করে। সাংখ্যে চৈতন্যকে আলোর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এই আলোয় মনে যে সব "আকৃতি"গুলি ধরা পড়ে সেগুলি আলোকিত হয়। তাই শুদ্ধ চৈতন্যের আলোতে উজ্জ্বল আকৃতিগুলি মনে ধরা পড়লে তবেই চিন্তাধারাগুলি চৈতন্যময় হয়ে ওঠে।[51] অহংকার একটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্ত্বা। এটি সকল মানসিক অভিজ্ঞতাকে গ্রাস করে এবং তার মাধ্যমে মন ও বুদ্ধিকে গ্রাস করে তাদের ক্রিয়াশীলতার স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়।[52] কিন্তু চৈতন্য নিজে চৈতন্যের দ্বারা প্রভাবিত চিন্তাধারাগুলি থেকে পৃথক থাকে।[51]
জাগতিক ক্ষেত্রে মনকে অন্তর্ভুক্ত করে সাংখ্য কার্টেসিয়ান দ্বৈতবাদের একটি ভ্রান্তিকে এড়িয়ে গিয়েছে। জাগতিক বিবর্তন নিয়মের লঙ্ঘন সম্পর্কে কোনো ভুল এখানে করা হয়নি। কারণ, মন যেহেতু জাগতিক বস্তু থেকে উৎপন্ন, মানসিক ঘটনাবলিরও কাম্য ক্রিয়া এখানে স্বীকৃত হয়েছে; যার দ্বারা মন দৈহিক গতির সূচনা করতে পারে।[53]
পুরুষ হলেন শুদ্ধচৈতন্য। এটি সর্বোচ্চ, স্বাধীন, মুক্ত, বাক্য ও মনের অগোচর। তাকে অন্য কিছুর দ্বারা জানা যায় না। পুরুষ মন ও ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভূত হয় না এবং যাকে শব্দ ও ব্যাখ্যা দ্বারা বোঝানো যায় না। পুরুষ শুদ্ধ এবং মূল চৈতন্য। পুরুষের সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই। তবে পুরুষকে বহুবিধ বলা হয়, যা অদ্বৈত বেদান্ত বা পূর্ব মীমাংসা মতে মানা হয়নি।[54]
প্রকৃতি মহৎ বা বুদ্ধিতত্ত্ব অহংকার তত্ত্ব পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় পঞ্চ তন্মাত্র পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় পঞ্চ স্থুলভূত মন (উভয় ইন্দ্রিয়)
সাংখ্য দর্শনে বিবর্তনের ধারণাটি প্রকৃতি ও পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক-নির্ভর। তিন গুণ যতক্ষণ সমতাবিধান করে আছে, ততক্ষণ প্রকৃতি অব্যক্ত। প্রকৃতি চৈতন্যময় পুরুষের সংস্পর্শে এলে এই তিন গুণের মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাব ঘটে। যার ফলে অব্যক্ত প্রকৃতির থেকে ব্যক্ত জগতের বিবর্তন ঘটে।[55] এই বিবর্তন তত্ত্ব বোঝাতে চুম্বকের আকর্ষণে লোহার সঞ্চরণের উদাহরণ দেওয়া হয়।[56]
প্রকৃতির কয়েকটি বিবর্তিত রূপ আরও বিবর্তনের জন্ম দেয়। যেমন বুদ্ধি নিজে প্রকৃতি থেকে উৎসারিত হয় আবার বুদ্ধির থেকে অহংকারের জন্ম হয়। অন্যদিকে, পঞ্চতত্ত্বের মতো বিবর্তিত রূপগুলির থেকে কোনো কিছুর সৃষ্টি হয় না।[57] একটি তত্ত্বের বিবর্তিত রূপ অন্য একটি তত্ত্বের বিবর্তনের কারণ হিসেবেও দেখা দেয়। তাই বলা যায়, পঞ্চতত্ত্ব সবকটি জীবিত সত্ত্বার জাগতিক কারণ। কিন্তু তারা বিবর্তিত বস্তুর বিবর্তিত রূপ নয়। কারণ জীবিত সত্ত্বাগুলি পঞ্চতত্ত্বের থেকে সারগতভাবে পৃথক নয়।[58]
প্রকৃতির প্রথম বিবর্তিত রূপটি হল বুদ্ধি। একে বলে মহৎ। এর থেকে অহংকার বা আত্ম-চৈতন্যের উৎপত্তি হন। অহংকারের উৎপত্তি গুণগুলির প্রভাবে হয়। সত্ত্বগুণের প্রভাবে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের বিবর্তন ঘটে। রজঃগুণের প্রভাবে পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়ের বিকাশ ঘটে। তমোগুণের প্রভাবে পঞ্চ সূক্ষ্মেন্দ্রিয়ের বিকাশ ঘটে। পঞ্চ সূক্ষ্মেন্দ্রিয়ের থেকে পঞ্চতত্ত্বের ইয়ৎপত্তি হয়। রজঃগুণ থেকে কর্মের উৎপত্তি।[59] পুরুষ শুদ্ধচৈতন্য। তা সর্বোচ্চ, চিরন্তন এবং অপরিবর্তনশীল। এটি বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় না, এর বিবর্তনও দেখা যায় না।[58]
সাংখ্য দর্শনে বিবর্তনকে নির্দিষ্ট কারণে সংগঠিত বলে মনে করা হয়। প্রকৃতির বিবর্তনের দুই প্রধান কারণ হল পুরুষের আনন্দ ও মুক্তি।[60] প্রকৃতির বিবর্তিত ২৩টি রূপ হল:[61]
আদি তত্ত্ব | প্রকৃতি | মূল বিবর্তিত রূপ |
---|---|---|
অভ্যন্তরীণ | বুদ্ধি, অহংকার ও মন | পুনঃবিবর্তিত রূপ |
বাহ্যিক | পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় | বিবর্তিত রূপ |
সূক্ষ্মতত্ত্ব | শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ | পুনঃবিবর্তিত রূপ |
মহাভূত | আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও পৃথিবী | বিবর্তিত রূপ |
মোক্ষই পরম কল্যাণকর। দুঃখের চিরনিবৃত্তি হলেই মোক্ষ লাভ হয়... শুদ্ধ ও সহজ চৈতন্যের জ্ঞান হলে মোক্ষ লাভ হয়।
—সাংখ্যকারিকা এক।৩[62]
ভারতীয় দর্শনের অন্যান্য প্রধান শাখাগুলির মতো সাংখ্য দর্শনেই মানুষের অস্তিত্বকে একটি গভীর দুঃখময় অবস্থা মনে করা হয়। অজ্ঞান বা অবিদ্যা হল দুঃখ ও সংসার নামক বন্ধনের প্রধান কারণ। বিবেক জ্ঞান (প্রকৃতি ও পুরুষের যথার্থ জ্ঞান)-এর সাহায্যে এই দুঃখময় অবস্থা পার হওয়া যায় বলে, সাংখ্য দর্শন মনে করে। এই জ্ঞান প্রকৃতি (ব্যক্ত-অব্যক্ত) ও পুরুষের (জ্ঞান) মধ্যে ভেদ স্থাপন করে মোক্ষলাভে সাহায্য করে।[63]
চিরন্তন শুদ্ধ চৈতন্য পুরুষ অজ্ঞানতায় আচ্ছন্ন হয়ে নিজেকে প্রকৃতির পরিণাম বুদ্ধি বা অহংকারের সঙ্গে নিজেকে এক করে দেখে। এর ফলে নিরন্তর জন্মান্তর ও দুঃখ ভোগ করতে হয়। কিন্তু যে মুহুর্তে পুরুষ ও প্রকৃতি পৃথক জ্ঞান হয়, সেই মুহুর্তে আত্মা জন্মান্তরের হাত থেকে মুক্ত হয়ে কৈবল্য বা মুক্তি প্রাপ্ত হয়।[64] সাংখ্যের অন্যান্য শাখায় বলা হয়, বেদে উল্লিখিত ধ্যান ও অন্যান্য যোগ পদ্ধতির মাধ্যমে আত্মাকে উন্নত করে মোক্ষ লাভ করা যায়।
সাংখ্য “প্রত্যক্ষ” বা “দৃষ্টম্” (প্রত্যক্ষ অনুভূতি); “অনুমান” এবং “শব্দ” বা “আপ্তবচন”(ঋষি বা শাস্ত্রবাক্য)-কে “প্রমাণ” বা যথার্থ জ্ঞান অর্জনের উপায় বলে মনে করে।[63] এই তিনিটি প্রমাণের উপায় দ্বারা ২৫টি তত্ত্বের সমাধান করা হয়েছে।
সাংখ্য দর্শনে উচ্চতর সত্ত্বা বা পরিণত সত্ত্বার কথা থাকলেও এই দর্শন ঈশ্বর-ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে। ধ্রুপদি সাংখ্য দর্শন আধ্যাত্মিক স্তরে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে। সাংখ্য দর্শন মতে, সদা-পরিবর্তনশীল জগৎ অপরিবর্তনশীল ঈশ্বর দ্বারা সৃষ্ট হতে পারে না। এই ঈশ্বর শুধুমাত্র পরিস্থিতির প্রয়োজনে সৃষ্ট একটি প্রয়োজনীয় অতিন্দ্রীয় সত্ত্বা।[65] সাংখ্য সূত্রগুলিতে পুরুষের থেকে পৃথক কোনো ঈশ্বরের আলাদা ভূমিকার উল্লেখ নেই। এই ধরনের পৃথক ঈশ্বর সাংখ্য দর্শনের মতে অচিন্তনীয় এবং কোনো কোনো ভাষ্যে খুব সাধারণভাবে উল্লিখিত।
সিনহার মতে, চিরন্তন, অনাদি ও স্রষ্টা ঈশ্বরের বিপক্ষে সাংখ্য দার্শনিকেরা নিম্নলিখিত যুক্তিগুলি দিয়েছেন:[66]
সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী গ্রন্থে কারিকা ৫৭ শ্লোকের ভাষ্যে বলা হয়েছে যে, নিঁখুত ঈশ্বর (নিজের জন্য) জগৎ সৃষ্টি করতে পারেন না এবং ঈশ্বরের উদ্দেশ্য (অপরের প্রতি) দয়া হলে সাংখ্য দর্শনের প্রশ্ন হল অস্তিত্বহীনের যেখানে দুঃখ নেই সেখানে অস্তিত্ববানকে ডাকার কী প্রয়োজন?
সাংখ্যপ্রবচন সূত্র গ্রন্থের ১।৯২ নং শ্লোকে স্পষ্ট বলা হয়েছে, "ঈশ্বরের অস্তিত্ব অপ্রমাণিত"। তাই সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের কোনো স্থান এই দর্শনে নেই। এই গ্রন্থের ভাষ্যকারেদের মতে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব যেহেতু প্রমাণিত হয় না, তাই তার অস্তিত্ব মানা যায় না।[66]
আধুনিক গবেষকদের অধিকাংশ মনে করেন, "নিরীশ্বর" সাংখ্যের সঙ্গে ঈশ্বরবাদ যুক্ত করে যোগ, পাশুপত ও ভাগবত দর্শনশাখাগুলি। সেই ঈশ্বরবাদী সাংখ্য দর্শনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় মহাভারত, পুরাণ ও ভগবদ্গীতায়।[67]
সাংখ্য দর্শনের তত্ত্ববিদ্যা ও জ্ঞানবাদের সঙ্গে ঈশ্বর ধারণা যুক্ত করে যোগ দর্শনের উৎপত্তি।[68] যদিও সাংখ্য ও যোগের প্রকৃত সম্পর্ক নিয়ে গবেষকদের মধ্যে দ্বিমত আছে। জেকব ভিলহেম হুয়ের ও জর্জ ফুয়েরস্টাইনের মতে, যোগ ব্যবস্থা ভারতীয় দর্শনের একাধিক শাখায় বিদ্যমান ছিল এবং ব্যাস প্রমুখ ভাষ্যকারেরা সাংখ্যের সঙ্গে এর যোগ কৃত্রিমভাবে স্থাপন করেছেন। জোহানেস ব্রোঙ্কহর্স্ট ও এরিক ফ্রুওয়ালনার মনে করেন, যোগ ও সাংখ্য দুটি পৃথক দার্শনিক শাখা ছিল না। এদের অস্তিত্ব একসঙ্গেই ছিল। ব্রোঙ্কহর্স্ট আরও বলেছেন যে, আদি শঙ্করের (খ্রিস্টীয় ৭৮৮-৮২০ অব্দ) ব্রহ্মসূত্রভাষ্য-এর আগে দর্শন হিসেবে যোগের পৃথক অস্তিত্ব ছিল না।[69][70]
তন্ত্রের বিভিন্ন দ্বৈতবাদী ধারা থেকে প্রমাণিত হয় তন্ত্রের উপর সাংখ্য দর্শনের বিরাট প্রভাব রয়েছে। শৈব সিদ্ধান্ত মত দার্শনিক ক্ষেত্রে সাংখ্যের অনুগামী; শুধু এতে একটি অতিরিক্ত অতিন্দ্রীয় আস্তিক্যবাদী সত্ত্বার উল্লেখ পাওয়া যায়।[71] ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক কান্ট এ. জেকবসন শ্রীবৈষ্ণব মতবাদের উপর সাংখ্যের প্রভাব দেখিয়েছেন। তার মতে, তান্ত্রিক মতবাদে সাংখ্যের অব্যক্ত দ্বৈতবাদের প্রভার রয়েছে। এবং এই দ্বৈতবাদই পুরুষ-নারী দ্বৈতবাদে বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর রূপ ধারণ করেছে।[72] দাশগুপ্তের মতে, তন্ত্রে শিবের উপরে দণ্ডায়মান কালীর মূর্তি সাংখ্যের ক্রিয়াশীল প্রকৃতি ও নিষ্ক্রীয় পুরুষের ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত। যদিও সাংখ্য ও তন্ত্রে মোক্ষের ধারণা নিয়ে মতভেদ দেখা যায়। তন্ত্র তত্ত্ববিদ্যাগত সত্ত্বার ক্ষেত্রে স্ত্রীপুরুষের মিলনের কথা বলে। সাংখ্য পরম লক্ষ্যের সাধনে জাগতিক ধারণা থেকে চৈতন্য বিলোপের কথা বলে।[73]
বাগচীর মতে, সাংখ্যকারিকা (কারিকা ৭০-এ) সাংখ্যকে একটি তন্ত্র বলা হয়েছে।[74] সাংখ্য দর্শন তন্ত্রের সাহিত্য ও সাধনার পদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান অনুপ্রেরণার কাজ করেছে।[75]
আকবরের রাজসভায় বিশিষ্ট দার্শনিক বিজয়সেন সুরির বিরুদ্ধে নাস্তিকতা প্রচারের অভিযোগ উঠলে তিনি বলেছিলেন, জৈনধর্ম নাস্তিকতাবাদী নয়, সাংখ্য দর্শনের মতো একটি দর্শন।[76]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.