Loading AI tools
মুহাম্মদের সাহাবা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
জুবাইর ইবনুল আওয়াম (আরবি: الزبير بن العوام; ৫৯৪–৬৫৬) ইসলামের প্রথম যুগের একজন মুসলমান যিনি ইসলামের রাসুল মুহাম্মাদের একজন সাহাবী ছিলেন। তিনি আশারায়ে মুবাশশারার অন্তর্ভুক্ত, অর্থাৎ মুহাম্মাদ যে ১০জন সাহাবীকে তাদের জীবদ্দশায় বেহেশত লাভের সুসংবাদ দিয়েছেন তাদের মধ্যে তিনি একজন। মুহাম্মদ-এর মৃত্যুর পর তিনি সম্প্রদায়ের অন্যতম রাজনৈতিক ও সামরিক নেতা হয়ে ওঠেন।
হযরত জুবাইর ইবনুল আওয়াম | |
---|---|
জন্ম | ৫৯৪ |
মৃত্যু | ৬৫৬ (বয়স ৬১–৬২) |
অন্যান্য নাম | আবু আবদুল্লাহ জুবাইর ইবনুল আওয়াম ইবনে খুওয়াইলিদ ইবনে আসাদ ইবনে আব্দুলউজ্জা আল-কুরাইশি আল-আসাদী |
পিতা-মাতা |
|
সামরিক পরিষেবা | |
আনুগত্য | রাশিদুন খিলাফত |
সেবা/ | রাশিদুন সেনাবাহিনী |
কার্যকাল | ৬৩৬, ৬৪০–৬৪২ |
পদমর্যাদা | কমান্ডার |
নেতৃত্বসমূহ | মুসলিমদের মিশর বিজয়, প্রথম মুসলিম গৃহযুদ্ধ |
যুদ্ধ/সংগ্রাম | মুহাম্মাদ এর অধীনে যুদ্ধসমূহ:- |
জুবাইর ইবনুল আওয়ামের মূল নাম জুবাইর এবং ডাক নাম আবু আবদিল্লাহ। তার উপাধি ছিল হাওয়ারিয়্যু রাসূলিল্লাহ। যুবাইর হিজরতের ২৮ বছর পুর্বে ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।[1] তার পিতার নাম আওয়াম এবং মাতার নাম সাফিয়্যা বিনতে আবদুল মুত্তালিব। তার মা ছিলেন মুহাম্মদ-এর আপন ফুফু। সেই সুত্রে যুবাইর হলেন নবী মুহাম্মদ-এর ফুফাতো ভাই। অন্যদিকে আবু বকর সিদ্দিকের মেয়ে আসমাকে বিয়ে করার জন্য মুহাম্মাদ ছিলেন তার ভায়রা।[2] অর্থাৎ আসমা হলেন আয়িশা -এর বোন। শৈশব থেকেই তিনি কঠোর জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। যুবাইরের মা চাইতেন তার সন্তান যেন ছোট থেকেই দুঃসাহসী ও আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ছোটবেলায় যুবাইর কুস্তি খেলতেন।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে যুবাইর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার ইসলাম গ্রহণের পর গুজব ছড়ালো যে অমুসলিমরা নবী মুহাম্মদ কে বন্দী অথবা হত্যা করে ফেলেছে। এটা শুনে উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য যুবাইর সাথে সাথেই মুহাম্মদ-এর বাড়িতে যান। রাসুলের জীবনী লেখকদের মতে এটিই হলো প্রথম তলোয়ার, যা নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য একজন বালক উন্মুক্ত করেছিলো।
মক্কার অন্যান্য নও মুসলিমদের মত যুবাইর অনেক অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হন। তার চাচা সকল রকম চেষ্টা করেও তাকে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করাতে না পেরে দৈহিক নির্যাতন শুরু করেন। তাকে উত্তপ্ত পাথরের উপর চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে মারধর করা হতো। তাদের অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে তিনি একটা মুসলিম দলের সাথে হাবশায় চলে যান। কিছুদিন সেখানে অবস্থানের পর পুনরায় মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন। ঐ সময় নবী মুহাম্মদ মদীনায় হিজরত করলে তিনিও মদীনায় গমন করেন।
যুবাইর একজন সাহসী ও শক্তিমান যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কাফেরদের আক্রমণের মুখে যুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অনন্য। প্রতিটি যুদ্ধে তিনি অসীম সাহসিকতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
কথিত আছে যে, আল-জুবায়ের মুহাম্মদ এর সমস্ত সামরিক অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন, সাধারণত একটি স্বতন্ত্র হলুদ পাগড়ি পরিহিত থাকতেন।
তিনি বলেছেন:
"আল্লাহর কসম, আল্লাহর রসূল কোন অভিযান বা অভিযানে ভ্রমণ করেননি, শুধু যাতে আমি ছিলাম না। তিনি বলেছেন:"[3]
বদর যুদ্ধ ২ হিজরির ১৭ রমজান (১৭ মার্চ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ) মদিনার মুসলিম ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে সংঘটিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে এটি প্রথম প্রধান যুদ্ধ। এতে জয়ের ফলে মুসলিমদের প্রতিপত্তি পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি লাভ করে। বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর তুলনায় অমুসলিম বাহিনীর সেনা সংখ্যা ছিলো বহুগুণ বেশি। বদর যুদ্ধে একজন অমুসলিম সৈন্য পাহাড়ের টিলায় দাঁড়িয়ে তাকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহবান জানালে তিনি সাথে সাথে তাকে জাপ্টে ধরেন এবং গড়িয়ে নিচে পড়তে থাকেন। নবী মুহাম্মদ বলেন, তাদের মধ্যে যে আগে ভূমিতে পড়বে সে নিহত হবে। সত্যিই তাই হলো। যুবাইর তাকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করেন। এরপর তিনি উবাইদা ইবনে সাইদের মুখোমুখি হলেন।[4] তার আপাদ-মস্তক শক্ত বর্ম দ্বারা আবৃত ছিলো। যুবাইর তার চোখ বরাবর তীর নিক্ষেপ করলেন এবং অমুসলিম সৈন্যকে হত্যা করলেন। স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে তীরটি মুহাম্মদ নিজের কাছে রেখে দিলেন। মুহাম্মদ-এর মৃত্যুর পর তীরটি বিভিন্ন খলিফার কাছে সংরক্ষিত ছিলো। তৃতীয় খলিফা উসমানের মৃত্যুর পর আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর তীরটি গ্রহণ করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তার কাছেই তীরটি ছিলো।
বদর যুদ্ধে যুবাইর এত সাংঘাতিকভাবে যুদ্ধ করেছিলেন যে তার তলোয়ার ভোঁতা হয়ে গিয়েছিলো। আঘাতে আঘাতে তার পুরো শরীর বিক্ষত হয়ে গিয়েছিলো। একটি ক্ষত এতই বড় হয়েছিলো যে তা সারাজীবন গর্তের মত হয়েছিলো। যুবাইরের পুত্র উরওয়া বলেন, “আমরা সেই গর্তে আংগুলি ঢুকিয়ে খেলা করতাম।” বদর যুদ্ধে যুবাইর হলুদ রঙের পাগড়ী পরেছিলেন। এটা দেখে মুহাম্মাদ বলেন যে আজ ফেরশতারা এই পোশাকে এসে যুদ্ধ করেছে।[5]
উহুদের যুদ্ধ ৩ হিজরির ৭ শাওয়াল (২৩ মার্চ ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ) উহুদ পর্বতের সংলগ্ন স্থানে সংঘটিত হয়। মদিনার মুসলিম ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এই দুই পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন যথাক্রমে মুহাম্মাদ ও আবু সুফিয়ান। উহুদের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো। তখন ১৪ জন সাহাবী মানব প্রাচীর তৈরী করে মুহাম্মাদ-কে রক্ষা করেন। যুবাইর এই ১৪ জনের একজন ছিলেন।
খাইবারের যুদ্ধ ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন আরবের মদিনা নগরী থেকে ১৫০ কিলোমিটার (৯৩ মাইল) দুরে অবস্থিত খায়বার নামক মরুভূমিতে বসবাসরত ইহুদিগণের সাথে মুসলিমগণের সঙ্ঘটিত একটি যুদ্ধ। যুদ্ধে ইহুদি নেতা মুরাহহিব নিহত হলে তার ভাই অসীম বলবান ইয়াসির যুদ্ধের ময়দানে আসে এবং দ্বন্দযুদ্ধের আহবান জানায়। ইয়াসি বিশালাকার দেহের অধিকারী ছিলেন। যুবাইর তার দ্বন্দযুদ্ধের আহবান স্বীকার করলেন এবং যুদ্ধ শুরু করলেন। এতে যুবাইরের মা ভয় পেয়ে গেলেন এবং মুহাম্মদ-কে বললেন আজই কি তার সন্তানের মৃত্যু হবে। মুহাম্মদ তাকে অভয় দিয়ে বললেন আজ যুবাইর বিজয়ী হবে। অবশেষে তুমুল যুদ্ধের পর যুবাইর ইয়াসিরকে হত্যা করলেন।
নবী মুহাম্মাদ،৬৩০ খ্রিস্টীয় অব্দে বিনা রক্তপাতে মক্কা নগরী দখল করেন। ইতিহাসে এই ঘটনা মক্কা বিজয় নামে খ্যাত। খাইবার বিজয়ের পর মক্কা বিজয়ের প্রস্তুতি চলছিলো। এইসময় হাতিম বিন আবী বালতায়া মুসলিমদের সব খবর চিঠি লিখে শত্রুবাহিনীকে জানাতে মক্কায় একজন মহিলাকে প্রেরণ করলেন। এই ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে উক্ত মহিলাকে আটক করতে যে দলটি পাঠানো হয়েছিলো যুবাইর ছিলেন সেই দলের একজন সদস্য।
মক্কা বিজয়ের দিন মুহাম্মদ মুসলিম বাহিনীকে ছোট ছোট অনেক দলে ভাগ করেন। সর্বশেষ ও ক্ষুদ্র দলে ছিলেন মুহাম্মদ নিজে। সেই দলের পতাকাবাহী ছিলেন যুবাইর। মক্কা বিজয়ের পর মুহাম্মদ নিজ হাতে যুবাইরের মুখের ধুলোবালি ঝেড়ে দিয়েছিলেন।
ইয়ারমুকের যুদ্ধ ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে রাশিদুন খিলাফত ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের মধ্যে সংঘটিত হয়। ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে ইয়ারমুক নদীর তীরে ছয় দিনব্যপী এই যুদ্ধ সংঘটিত হযয়েছিল। বর্তমানে এই নদী সিরিয়া, জর্ডান ও ফিলিস্তিনের মধ্য দিয়ে প্রবহমান এবং তা গ্যালিলি সাগরের পূর্বেদিকে অবস্থিত। এই যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়ের ফলে সিরিয়ায় বাইজেন্টাইন শাসনের অবসান ঘটে। এই যুদ্ধে যুবাইর রোমান বাহিনীর মধ্যভাগে আক্রমণ করেন এবং সৈন্যদের ব্যুহ ভেদ করে অপর প্রান্তে চলে যান। কিন্তু অন্যান্য সহযোদ্ধারা তাকে অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয় ও তিনি মারাত্মক ভাবে আহত হন। তবে তার দুঃসাহসী আক্রমণের ফলে রোমানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।
তিনি অকুতোভয় চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। ইসলামের প্রসারের জন্য তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা ও নিবেদিতপ্রাণ। বিভিন্ন জিহাদে তার সাহসী ভূমিকার জন্য তিনি প্রশংসা লাভ করেছেন। তার মনে আল্লাহ-ভীতি ছিল সুগভীর। তিনি কুরআন-এর বাণী ও রাসুল-এর আদর্শ আনুগত্যের সঙ্গে অনুসরণ করতেন। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন দয়ালু ও আদর্শবান। মানুষের সঙ্গে তার ব্যবহার ছিলো নম্র ও সুন্দর। সমসাময়িক সমাজে তার মর্যাদা ছিল উচ্চ।
তিনি ব্যবসায় করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ব্যবসায়ক্রমে তিনি প্রভূত ধন-সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। কিন্তু ইসলামের আদর্শানুসারে তিনি সকল কিছু দরিদ্র মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করে দিয়েছিলেন। তার কাছে ঋণ চেয়ে কাউকে শূন্য হাতে ফিরতে হতো না। মুজাহিদদের তিনি অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে সহায়তা করতেন।
ধনাঢ্য হয়েও তিনি অতি সাধারণভাবে জীবনযাপন করতেন। খুবই সাধারণ কাপড়চোপড় পরিধান করতেন।
তিনি সকলের আস্থাভাজন ছিলেন। মুসলমানরা তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র তার কাছে জিম্মা রাখতো।
জুবাইর ইবনুল আওয়াম ইসলামের রাসুল মুহাম্মাদ প্রিয় পাত্র ছিলেন। মুহাম্মাদ তাকে মুরীদ (হাওয়ারি) হিসেবে গণ্য করতেন। তিনি অকুতোভয়ে জিহাদে অংশ গ্রহণ করেছেন। বিদায় হজ্জ্বের সময় তিনি মুহাম্মদ-এর সফরসঙ্গী ছিলেন। তিনি আশারায়ে মুবাশশারারএকজন। (Tirmidhi, Hadith 3747)[6][7]
যুবাইর ৬২ বছরের বিশাল এক কর্মময় জীবন লাভ করেছিলেন। চতুর্থ খলিফা আলী -এর শাসনামলে মক্কায় চলে যান এবং আয়িশার -এর সাথে যোগ দেন। ৩৬ হিজরী সালে আলী ও আয়িশা নেতৃত্বে মুসলিমদের দুইটি দলের মধ্যে উটের যুদ্ধ শুরুর উপক্রম হলে যুবাইর আয়িশা -এর দলে যোগ দেন। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে তার চিন্তায় আমূল পরিবর্তন আসে। তিনি মুসলিমদের অন্তদ্বর্ন্দ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যুদ্ধ পরিত্যাগ করেন। এই সময় আহনাফ বিন কায়েসের আদেশে আমর ইবন জারমুয তাকে অনুসরণ করেন এবং পথিমধ্যে যোহরের নামাজে সিজদারত অবস্থায় যুবাইরকে শহীদ করে।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.