ভাটি অঞ্চল
From Wikipedia, the free encyclopedia
ভাটি অঞ্চল-যেখানে ছয় মাস পানি আর বাকি ছয় মাস শুকনো মৌসুম। বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-এই সাতটি জেলার ৪০টি উপজেলা জুড়ে ভাটি অঞ্চল বিস্তৃত। পুরো অঞ্চলে সুতোর মতো জড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য হাওর-খাল-বিল-নদী-নালা। প্রকৃতি যেন তার অপার সৌন্দর্যে এ অঞ্চলকে অপরূপ করে সাজিয়ে রেখেছে। প্রকৃতির মতোই উদার ও প্রাণবন্ত এখানকার বাসিন্দারাও। ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের কারণেই বোধহয় হাওরবেষ্টিত জনপদের জীবনাচরণ ও সংস্কৃতি অত্যন্ত বিচিত্র, বর্ণিল, সমৃদ্ধ ও প্রাণবান।
![]() | এই নিবন্ধ বা অনুচ্ছেদটি পড়তে একটি বিশ্বকোষীয় ভুক্তির চেয়ে গল্পই বেশি মনে হয়। |
ভাটি অঞ্চলের আশি ভাগ মানুষের পেশা কৃষিকাজ কিংবা মৎস্যশিকার। সঙ্গত কারণেই দিনে হাড়ভাঙা পরিশ্রম এঁদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। কিন্তু সেই পরিশ্রমী মানুষদের কাছে দিনের সূর্য ডোবার মুহূর্তটুকু যেন নতুন আমেজে হাজির হয়। দিনমান কাজ শেষে বাড়ি ফিরে সেই মানুষেরা অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠেন। গ্রামে গ্রামে বসে বিচিত্র সব গানের আসর, উৎসবের রং ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। একই অঞ্চল হওয়ার সুবাদে এখানকার প্রায় আড়াই কোটি মানুষের গানের ভুবনও প্রায় অভিন্ন। যেহেতু আমি ভাটি অঞ্চলের মানুষ, তাই এখানকার আচার-অনুষ্ঠানের অনেক কিছুই আমার নখদর্পণে।
ছোটোবেলা থেকেই নানা উৎসব-পার্বণ উপলক্ষ করে মেতে ওঠা হাওরবাসীর নির্মোহ আনন্দ-উচ্ছ্বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছি। তাই আমি ভালো করেই জানি-বর্ষায় হাওরের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে বুক চিতিয়ে চলা ভাটির মানুষের কণ্ঠে গান অনেকটা আপনা-আপনিই ধ্বনিত হয়। শুকনো মৌসুমে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ধানখেতে ভোরের আলোয় স্নাত কৃষক মনের আনন্দে আপন খেয়ালে সুর ভাঁজেন। পুরো অঞ্চল জুড়ে যাত্রাগান, পালাগান, বাউলগান, কীর্তন, গাজীরগান, ভাটিয়ালি, ধামাইলগান, মালসিগান, বারোমাসি, সূর্যব্রতের গানসহ কত ধরনের গানের প্রচলন রয়েছে।
হাওরের বিচিত্র সব গানের ধারার পাশাপাশি গ্রামীণ চিরায়ত সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ নৌকাবাইচ, কুস্তি-খেইড়কেন্দ্রিকও অসংখ্য গান রচিত হয়েছে। এছাড়া মহররম উৎসব, দোলউৎসব, শ্যামাপূজাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে এখনও মূল আকর্ষণ গান। এসব উৎসবে শেষপর্যন্ত গানই প্রধান হয়ে ওঠে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীতে কৃষি উৎপাদনের সময় নানামুখী লোকাচারেও গানের ব্যবহার রয়েছে। হালচাষ, বীজ রোপন, ফসল কাটা থেকে ঘরে তোলা পর্যন্ত নানা রকমের উৎসবের আয়োজন করা হয়, এতে আনুষঙ্গিক লোকাচার হিসেবে গান ও মন্ত্র পরিবেশিত হয়। অবশ্য গ্রামীণ লোকাচারের এ ধারাগুলো এখনও নির্দিষ্ট দিন-ক্ষণ মেনে কৃষকেরা পালন করে থাকেন।
বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে আমাদের না-দেখা অতীতের গল্প শুনি। কেমন করে একেকটা গান জন্ম নেয় সে গল্পও শুনি। ভাটির মানুষের জীবন বড় অদ্ভুত। বৈশাখের শেষ সময়ে কিংবা জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরুতে পানি এসে ডুবিয়ে দেয় পুরো ভাটি অঞ্চল। আষাঢ় ও শ্রাবণের অবিশ্রান্ত বর্ষণে মাঠ-ঘাট ভেসে যায়। বাড়ির উঠোনজুড়ে জল থিকথিকে কাদায় ভরে ওঠে। কিছুদিনের মধ্যে সেই বর্ষণ থেমে গেলে মানুষ মেতে ওঠে নানান আনন্দ-আয়োজনে। জাতপাত, বৈষম্য আর ভেদাভেদ ভুলে সেই আনন্দযজ্ঞে গা ভাসান ভাটির সকল মানুষ।
হেমন্তে যে-বছর ফসল ভালো জন্মায়, সে বছর খুব ঘটা করে উৎসব হয়। বাড়িতে বাড়িতে চলে বিয়ের আয়োজন। সে আয়োজনে নেচে-গেয়ে নারীরা মুখরিত করে তোলে পুরো গ্রাম। ধামাইলগানের সুরের ঢেউ হাওরের লিলুয়া বাতাসে যেন আচড়ে পড়ে। প্রখ্যাত লোকগীতিকার রাধারমণ, প্রতাপরঞ্জন তালুকদারদের লেখা কত কত ধামাইলগান ফেরি করে বেড়ান গ্রামীণ নারীরা। এক গ্রামের ডাকসাইটে শিল্পীর ডাক পড়ে আরেক গ্রামে। গানের প্রতি নিখাদ ভালোবাসার এ বড় অদ্ভুত সম্মিলন।