Loading AI tools
উইকিমিডিয়ার তালিকা নিবন্ধ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বৌদ্ধ ধর্ম সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ টীকাসমূহ তুলে ধরা হল।
ত্রিপিটক হচ্ছে বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ। এটি পালি ভাষায় রচিত। গৌতম বুদ্ধের সময়ে তখনকার জম্বুদীপ এখনকার ভারতবর্ষ নামে পরিচিত। সে সময়ে পালি ভাষাপ্রচলিত ছিল এবং লোকজন যাতে তার কথাগুলো সহজে বুঝতে পারে সেজন্য গৌতম বুদ্ধ পালি ভাষায় সবকিছু প্রচার করেছিলেন। ত্রিপিটককে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-
এই ৩টি পিটকে সংরক্ষিত রয়েছে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধের মুখনিঃসৃত বাণী।
বৌদ্ধ ধর্মে অনন্ত সময় বুঝাতে কল্প শব্দ ব্যবহার হয়। সূর্য থেকে এক একটি গ্রহের দূরত্ব প্রকাশ করতে বিজ্ঞানীরা/জ্যোতির্বিজ্ঞানে আলোকবর্ষ/পারসেক শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। ঠিক সেরকম বৌদ্ধ ধর্মে উর্ধ্বলোক, অপায় এবং পৃথিবীর তথ্য রহস্যের অনন্ত সময়কে কল্প শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এ সময়ের পরিমাণ এতো বেশি যে এটাকে কল্পনা/ধারণার মাধ্যমে প্রকাশ করতে হয়। তাই বলা হচ্ছে কল্পনার বিষয় বলেই একে কল্প বলে। যা অনাদি-অনন্তকালের একটি পরিধি, যা অদ্ভুত কাল্পনিক উপমা দ্বারা বুঝানো হয় এবং যা এ ধরনের উপমা ছাড়া অন্য কোন সংখ্যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ধারণায় অনা অসম্ভব তাই হচ্ছে কল্প। সাধারণভাবে চার প্রকার কল্প পাওয়া যায় যেগুলোর সময় গাণিতিক সংখ্যা দিয়ে আধুনিক ভাবধারায় ও আনুমানিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
একত্রিশ লোকভূমির পরনির্মিত বসবত্তি স্বর্গের আয়ুষ্কাল মানুষের গণনায় ৯২১ কোটি ৬০ লক্ষ বছর। এরপরে তিনটি ব্রহ্মলোকের নাম ও আয়ুস্কাল হলো যথাক্রমে-
এখানে তিনটি রূপ ব্রহ্মলোকের আয়ুষ্কাল প্রকাশ করবার সময় কল্প দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। এর আগে পরনির্মিত বসবত্তি স্বর্গের আয়ুষ্কাল লেখা হয়েছে কোটি বছর শব্দ দিয়ে। উপরের চার প্রকার কল্পের সময় নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয় এ কারণে যে, সাধারণ কল্পের বয়স এক কোটির বেশি এবং ছোট কল্পের বয়স ১৬ কোটির বেশি। এই এক কোটি এবং ষোল কোটি সময়কে কল্পের আওতায় ধরা হয়েছে এবং নাম দেওয়া হয়েছে সাধারণ কল্প এবং ছোট কল্প। কিন্তু পরনির্মিত বসবত্তি স্বর্গের আয়ুষ্কাল প্রকাশ করা হয়েছে কোটি বছর শব্দ দিয়ে। এখানে ৯২১ কোটি বছর সাধারণ কল্প ও ছোট কল্পের সময়ের চেয়ে বেশি হওয়া সত্ত্বেও কল্প শব্দ ব্যবহার করা হয়নি।
বুদ্ধ উৎপত্তি দুর্লভ, বুদ্ধ কল্পে জন্ম নেওয়া দুর্লভ, মানুষ হয়ে জন্ম লাভ করাও দুর্লভ। বুদ্ধ উৎপত্তির নিয়ম অনুসারে পৃথিবীর সময়কে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১- শূন্য কল্প, ২- অশূন্য কল্প। যে কল্পে বুদ্ধগণ জন্মগ্রহণ করেন না সে সময়কে শূন্য বা অবুদ্ধ কল্প বলে। যে কল্পে বুদ্ধগণ উৎপন্ন হন সে সময়কে অশূন্য বা বুদ্ধ কল্প বলে। শূন্য কল্প যেমন একটি নিয়মে সৃষ্টি ও বিলয় হবে ঠিক তদনরূপভাবে অশূন্য কল্প ও ঐ একই নিয়মে সৃষ্টি ও বিলয় হবে। পৃথিবী সৃষ্টি হলেই যে বুদ্ধ উৎপন্ন হবেন তা নয়। এমন সময়ও আসে, পৃথিবী সৃষ্টি হলো;মানুষ-প্রাণী-প্রকৃতি ইত্যাদি সব কিছু আছে কিন্তু বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করলেন না। বুদ্ধ যদি জন্মগ্রহণ না করেন নির্বাণ ধর্ম কি তা জানা যায়না। নির্বাণ ধর্ম কি তা না জানলে সংঘ ও সৃষ্টি হবে না। কেউ মার্গ-ফল লাভ করবে না। তাই বুদ্ধশূন্য কল্পে জন্ম নেওয়া সময়কে অষ্ট অক্ষণের একটি অক্ষণ বলা হয়ে থাকে। অষ্ট অক্ষণগুলো হলো- প্রেতলোক, তীর্যকলোক, নরকলোক, অরূপ ব্রহ্মলোক, প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম বা বাস, পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বিকলতা, মিথ্যা দৃষ্টিসম্পন্ন মাতা-পিতার গর্ভে বা পরিবারে জন্ম নেয়া, বুদ্ধশূন্য কল্পে জন্ম নেওয়া। তবে, কিছু মানুষ এতো অধর্মের মাঝে ও ভালো কাজ করবে এবং এ ভালো কাজের সুফল স্বরূপ স্বর্গ ও রূপ ব্রহ্মলোক পর্যন্ত লাভ করবে। ঐ সমস্ত লোকে সুখ ভোগ করার পর আবার নিম্ন দিকে হয়ত অপায় কিংবা সংসারাবর্তনে আবর্তিত হবে। বৌদ্ধদের চাওয়া স্বর্গ ও রূপ ব্রহ্মলোক নয়। নির্বাণ হচ্ছে বৌদ্ধদের চরম লক্ষ্য। শুদ্ধবাস ব্রহ্মলোক যারা উৎপন্ন হন তারা ব্যতীত এর আগের স্তরে উৎপন্ন সত্ত্বগণ আয়ু ক্ষয়ে সেখান থেকে চ্যুত হয়ে নিম্নলোকে জন্ম গ্রহণ করেন। শুদ্ধবাস ব্রহ্মলোকর 'অবিহ' এর আগের স্তর হচ্ছে অসঞসত্ত। তাহলে বলা যায় অবুদ্ধ কল্পে মানুষ সর্বোচ্চ একত্রিশ লোকভূমির অসঞসত্ত পর্যন্ত লাভ করতে পারেন।
গৌতম সম্যকসম্বুদ্ধ নিবৃতি/প্রজ্ঞা লাভের জন্য চারি অসংখ্য এবং লক্ষের ও অধিক কল্প সময়কাল পারমী পূরণ করার সময় এগারো বার বুদ্ধ কল্পের দেখা পেয়েছিলেন। বর্তমান কল্পের নাম ভদ্র কল্প। ভদ্র কল্পের শেষ বুদ্ধ আর্য মৈত্রেয় সম্যকসম্বুদ্ধের(অনাগত)পরে আবার অবুদ্ধ বা শূন্য কল্প আসবে। সেই অবুদ্ধ বা শূন্য কল্প শেষে পৃথিবী ধংস হবে। আবার পৃথিবীতে উদ্ভিদ-প্রাণী ইত্যাদি বাস করার যোগ্য হবে। সেই সময় হবে বুদ্ধ কল্প এবং সেই বুদ্ধ কল্পের প্রথম কল্পের নাম হবে মণ্ডকল্প। অনাগত সেই বুদ্ধ কল্পের মণ্ডকল্পে রাম ও ধর্মরাজা নামে এই দুইজন ভিন্ন সময়ে বুদ্ধ হবেন। এখানে রাম বলতে দশরত জাতকের সেই রাম নয়। [৪৭৪/৪৬১ নম্বর জাতক অট্ঠকথা, পালি টেক্সট সোসাইটি, লন্ডন] এবং ধর্মরাজা হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের সময়কার কোশল রাজ প্রসেঞ্জিত। অবুদ্ধ কল্পকে কোন ভাগে ভাগ করা হয়নি। এটা একা একটি কল্প। সময় সীমা বুদ্ধ কল্পের যে কোন একটি কল্পের মতো হতে পারে বলে আমার মনে হয়। অপরদিকে বুদ্ধ কল্পকে আবার পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১- সার কলপ, ২- মণ্ড কল্প, ৩- বর কল্প, ৪- সারমণ্ড কল্প এবং ৫- ভদ্র কলপ। যে কল্পে একজন সম্যকসম্বুদ্ধ উৎপন্ন হন তাকে সার কলপ বলে। যে কল্পে দুইজন সম্যকসম্বুদ্ধ উৎপন্ন হন তাকে মণ্ড কলপ বলে। যে কল্পে তিনজন সম্যকসম্বুদ্ধ উৎপন্ন হন তাকে বর কলপ বলে। যে কল্পে চারজন সম্যকসম্বুদ্ধ উৎপন্ন হন তাকে সারমণ্ড কলপ বলে। যে কল্পে পাঁচজন সম্যকসম্বুদ্ধ উৎপন্ন হন তাকে ভদ্র কলপ বলে। বুঝার সুবিধার্থে এ পাঁচ কল্প ক্রমানুসারে লিপিবদ্ধ হলে ও পরে এতে একের পর দ্বিতীয় নম্বরটি অবশ্যই আসবে এ নিয়ম অনুসরণ করা হয় না। আমরা যে কল্পে অবস্থান করছি এই কল্পের নাম ভদ্র কল্প। উপরের নিয়ম অনুসারে এই ভদ্র কল্পের পর আবার সার কল্প আসার কথা। কিন্তু তা না হয়ে ভদ্র কল্পের পরে হবে অবুদ্ধ কল্প এবং এরপরে আসবে মণ্ড কল্প। এখানে সার কল্প যদি ও বা আগে আছে তথাপি সার কল্প আগে আসবে না। প্রতিটি কল্প সৃষ্টির সময় বজ্রাসনে পদ্ম ফুল ফুটবে। ভদ্র কল্প সৃষ্টির সময় বুদ্ধ গয়ার বজ্রাসনে পাঁচটি পদ্ম ফুল ফুটেছিল তাই এই ভদ্র কল্পে পাঁচ জন বুদ্ধ উৎপন্ন হবেন। ভদ্রকল্পের চারজন বুদ্ধ ইতোমধ্যে গত হয়ে গেছেন। ভদ্র কল্পের চতুর্থ নম্বর বুদ্ধ হচ্ছে গৌতম সম্যকসম্বুদ্ধ। আমরা এখন গৌতম সম্যকসম্বুদ্ধের শাসনে অবস্থান করছি। গৌতম বুদ্ধের শাসন একদিন ধংস হবে। এরপর আর্য মৈত্রেয় সম্যকসম্বুদ্ধের শাসন আসবে। সেটি ও ভদ্র কল্পের অন্তর্গত। যে কল্পে একের অধিক জন সম্যকসম্বুদ্ধ উৎপন্ন হন সে কল্পের মধ্যে শূন্য বা অবুদ্ধ কল্প মাঝখানে আসে না। যেমন এই ভদ্র কল্পের চতুর্থ নম্বর বুদ্ধের শাসন শেষ হওয়ার পর অবুদ্ধ কল্প আসবেনা। কেননা, এখনো এই ভদ্র কল্পে একজন বুদ্ধ উৎপন্ন হবার বাকী আছে। সুতরাং একটি কল্পের নির্ধারিত বুদ্ধগণ উৎপন্ন হয়ে গেলে মধ্যবর্তী সময়ে শূন্য কল্প আসলে ও আসতে পারে। অধিকন্তু, শূন্য কল্প যে আসবে তা ও নির্ধারিত নয় বলে আমার ধারণা। গৌতম বুদ্ধ পারমী পূরণ করার সময় এগারো বার বুদ্ধ কল্পে যে সকল বুদ্ধগণের সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন সেই সব কল্পের নাম সহ বুদ্ধের নাম এবং সময়ের তালিকা - ১- সারমণ্ড কল্পঃ তৃষ্ণাঙ্কর, মেধঙ্কর, শরণঙ্কর, দীপঙ্কর সময় - চার অসংখ্য ও এক লক্ষ কল্প আগে। ২- সার কল্পঃকৌণ্ডিণ্য সময় - তিন অসংখ্য ও এক লক্ষ কল্প আগে। ৩- সারমণ্ড কল্পঃ মঙ্গল, সুমন, রেবত, শোভিত। সময়- দুই অসংখ্য ও এক লক্ষ কল্প আগে। ৪- বর কল্পঃ অনোমদর্শী, পদুম, নারদ। সময় - এক অসংখ্য ও এক লক্ষ কল্প আগে। এখানে এক থেকে চার নম্বর পর্যন্ত চারি অসংখ্য চার লক্ষ কল্পের হিসাব পাওয়া যায়। যদি ও বা এখানে চার অসংখ্যেয় কল্প বলা হচ্ছে কিন্তু, হিসাব করলে ৪+৩+২+১=১০ অসংখ্যেয় কল্প এবং ১+১+১+১= ৪ লক্ষ কল্প হয়। এরপরে - ৫- সার কল্পঃ পদুমুত্তর। সময়- এক লক্ষ কল্প আগে। ৬- মণ্ড কল্পঃ সুমেধ, সুজাত। সময়- ত্রিশ হাজার কল্প আগে। ৭- বর কল্পঃ প্রিয়দর্শী, অর্থদর্শী, ধর্মদর্শী। সময়- আঠারোোো হাজার কল্প আগে। ৮- সার কল্পঃসিদ্ধার্থ সময়- চুরানব্বই কল্প আগে। ৯- মণ্ড কল্পঃ তিস্য, ফুশ্য সময়- বিরানব্বই কল্প আগে। ১০- সার কল্পঃ বিপশ্বী। সময়- একানব্বই কল্প আগে। ১১- মণ্ড কল্পঃ শিখী, বেশ্বভূ। সময়- একত্রিশ কল্প আগে। বর্তমানে ভদ্র কল্পঃ ককুসন্ধ, কোণাগমন, কশ্যপ বুদ্ধের সাক্ষাৎ লাভ করেন। পাঁচ থেকে এগারো নম্বর পর্যন্ত লক্ষের অধিক কল্পের সংখ্যা পাওয়া যায়। সুতারং প্রমাণিত হয় যে, গৌতম বুদ্ধ এগারো বার বুদ্ধ কল্পের সাক্ষাৎ লাভ করে চারি অসংখ্য এবং লক্ষের অধিক কল্প পার করেছেন পারমী পূরণ করার জন্য। এটা ও প্রমাণ মিলে যে, কল্পগুলা একটির পর অপরটি আসবে সে ধারাবাহিকতা অনুসরণ করেনা। গৌতম বুদ্ধ চারি অসংখ্য এবং লক্ষের অধিক কল্পে পারমী পূর্ণ করবার সময় কতবার অবুদ্ধ কল্পের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন সে বিষয়ে আমি পূর্ণ সিদ্ধান্তে যেতে না পারলে ও একটা ধারণা থেকে বলতে পারি যে, বুদ্ধ যেহেতু এগারো বার বুদ্ধ কল্পের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন সেহেতু সম্ভবত এগারো বার বা তার চাইতে কম অবুদ্ধ কল্পের সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়ঃ সারমণ্ড কল্পে- তৃষ্ণাঙ্কর, মেধঙ্কর, শরণঙ্কর, দীপঙ্কর বুদ্ধের পর অসংখ্য কল্প অবুদ্ধ কল্প আসে। সার কল্পে- কৌণ্ডিণ্য বুদ্ধের পর অবুদ্ধ কল্প আসে। সারমণ্ড কল্পে- মঙ্গল, সুমন, রেবত, শোভিত বুদ্ধের পর অবুদ্ধ কল্প আসে। বর কল্পে- অনোমদর্শী, পদুম, নারদ বুদ্ধের পর অবুদ্ধ কল্প আসে। এখান থেকে আমরা চারটি অবুদ্ধ কল্পের তথ্য পাই।
বিশুদ্ধি মার্গ বইয়ের বর্ণনানুসারে কল্পকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এরপরে আবার এই প্রধান চার প্রকার কল্পের মধ্যে আরো কয়েকটি কল্পের কথা বলা হয়েছে। সেই প্রধান চার প্রকার কল্পের নাম হচ্ছে - ১। আয়ু কল্প, ২। অন্তর কল্প, ৩। অসংখ্য কল্প এবং ৪। মহাকল্প। ১। আয়ুকল্পঃ জীবনকাল বা গড় আয়ু। একটি নির্দিষ্ট সময়ে মানুষ গড় আয়ু নিয়ে যতদিন বাঁচবে সেটিকে আয়ুকল্প বলা হয়। এ জীবনকাল কখনো এক অসংখ্য বছর আবার কখনো বা দশ বছর বয়স হয়। এসব নির্ভর করে মানুষের চারিত্রিক গুণাবলীর উপর। মানুষ যখন ধর্মীয় জীবন যাপন করবে তখন মানুষের গড় আয়ু হতে পারে আশি হাজার বছর[একটি বইয়ে চুরাশি হাজার বছর বলা হয়েছে]। আবার মানুষ যখন অধার্মিক হবে তখন মানুষের গড় আয়ু কমে গিয়ে চলে আসবে দশ বছরে। মানুষের গড় আয়ু যখন ৮০, ০০০ বছর হয় তখন আয়ু কল্প হয় অসংখ্য বছর। যেমন কয়েকজন বুদ্ধ কয়েক হাজার বছরেরো বেশি বছর বেঁচেছিলেন। মানুষের গড় আয়ু যখন ১, ০০০ বছর থাকে তখন আয়ু কল্প হয় দশ লক্ষ বছর। মানুষের গড় আয়ু যখন ১০০ বছর হয় তখন আয়ু কল্প হয় এক শতাব্দী। এই বুদ্ধ কল্পে গৌতম বুদ্ধের সময় মানুষের গড় আয়ু ছিল ১০০ বছর। তথাপি মানুষ কেউ কেউ ১০০ বছরেরো বেশি সময় পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। ২৫৫৮ বুদ্ধাব্দ বছর পরে অর্থাৎ ২০১৫ ইংরেজি সাল পর্যন্ত মানুষের গড় আয়ু এসে দাঁড়িয়েছে ৮০ বছরে। ২০ বছর কমে গেছে। এভাবে মানুষের গড় আয়ু আস্তে আস্তে কমতে থাকবে এবং এক সময় তা দশ বছরে এসে দাঁড়াবে। এবার গৌতম বুদ্ধের আয়ু বর্ধন নিয়ে একটি কথা বলা যাক, মার এসে বুদ্ধকে মহাপরিনির্বাপিত হতে প্রার্থনা করেন এবং বুদ্ধ তা অনুমোদন করেন। অনুমোদন করার পূর্বে বুদ্ধ তাঁর সেবক আনন্দ ভন্তেকে বলেছিলেন, বুদ্ধের চারি ঋদ্ধিপাদ ভাবিত ও বহুলীকৃত হয়েছে। বুদ্ধ চাইলে কল্প সময় বা এর চাইতে বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারেন। এখানে কল্প সময় বলতে আয়ু কল্পকে বুঝানো হয়েছে। যা বুদ্ধের সময় আয়ু কল্প ছিল ১০০ বছর। আর বুদ্ধ মহাপরিনির্বাপিত হয়েছেন ৮০ বছর বয়সে। তাহলে বুদ্ধ ১০০ বছর কিংবা তার চেয়ে কিছু বেশি বছর বেঁচে থাকতে পারতেন। কোনক্রমেই ১৫০ বছরের বেশি নয়। কেউ কেউ এ কল্প সময়কে অনন্ত সময় ভেবে ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন বুদ্ধ অনেক অনেক বছর বেঁচে থাকতেন যদি আনন্দ ভন্তে বুদ্ধকে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য প্রার্থনা করতেন। বুদ্ধের অনন্ত কাল বেঁচে থাকা কথাটি অযৌক্তিক। ২। অন্তর কল্পঃ মানুষের অধর্মময় জীবন যাপনের ফলে আশি হাজার বছর গড় আয়ু থেকে কমে গিয়ে দশ বছর হবে। আবার ধর্মময় জীবন যাপনের ফলে দশ বছর গড় আয়ু থেকে বেড়ে গিয়ে আশি হাজার বছর গড় আয়ু হবে। আয়ুর এ উত্তান পতনের হিসাবকে অন্তর কল্প বলে। বার্মার শ্রদ্ধেয় লেডী ছেয়াদ ভন্তে অন্তর কল্পের সময় সীমা সম্বন্ধে যে ধারণা দিয়েছেন তা এইরূপ - গঙ্গা নদীর তিন মাইল পর্যন্ত একটি সীমানা নির্ধারণ করে সেই তিন মাইলে যতগুলা বালি আছে তা গুণে বের করতে যতটুকু সময়ের দরকার হবে সেই সময়টুকু অন্তর কল্পের কাছাকাছি সময় বলে ধারণা করতে হবে। তথাপি বালি গণনা শেষ হবে কিন্তু, অন্তর কল্পের আয়ু শেষ হবে না। অন্তর কল্পের সময় সীমা সম্পর্কে জানতে সার সংগ্রহ ২য় খণ্ড ও বিশুদ্ধি মার্গ বই পড়তে পারেন। অন্তর কল্প ধংস হবে তিনভাবে। ক। শস্ত্রান্তর কল্পঃ একে অপরের সাথে যুদ্ধ-মারামারি-হানাহানির করে মানুষ মারা যাবে। খ। দুর্ভিক্ষান্তর কল্পঃ খাবারের অভাব দেখা দিবে। না খেয়ে মানুষ মারা যাবে। গ। রোগান্তর কল্পঃ মানুষের মাঝে কঠিন রোগ দেখা দিবে এবং মানুষ মার যাবে।
৩। অসংখ্য কল্পঃ বিশ অন্তর কল্পের সময় সমান এক অসংখ্য কল্প। বৌদ্ধ গবেষকগণ অসংখ্য কল্প বলতে বুঝিয়েছেন, যে সময় অসংখ্য সংখ্যা দিয়ে প্রকাশিত কিন্তু, গণনার কোন শব্দ নাই সেটিই অসংখ্য কল্প। এটি অনেক কোটি বছরের চাইতে ও বেশি। এক এর পিছনে একশত চল্লিশটা শূন্য বসালে যে সংখ্যাটি পাওয়া যায় তাই এক অসংখ্য কল্প। সংখ্যাটি হবে এরকম - ১০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০, ০০, ০০, ০০, ০০, ০০, ০০, ০০, ০০, ০০, ০০, ০০, ০০, ০০০। এ সংখ্যাটি কত হাজার কোটি হবে বের করা কষ্টকর হবে। এখানে আমার একটি মতামত তুলে ধরছি, বুদ্ধের সময়কালে মিলিয়ন, বিলিয়ন এবং ট্রিলিয়ন শব্দ ব্যবহার করা হত না বলে আমার মনে হয়। আমরা প্রায়শই বলতে শুনি বুদ্ধ বোধিসত্ত্ব অবস্থায় পারমী সম্ভার পূরণ করাবার সময় চার অসংখ্য কল্প ও লক্ষের অধিক কল্প পরিভ্রমণ করেছেন। চারি অসংখ্য কল্প এরকম চারটি অসংখ্য কল্পের সমন্বয়ে গঠিত। চারি অসংখ্য কল্প সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে উপরের গৌতম বুদ্ধের এগারো বার বুদ্ধ কল্প সাক্ষাৎ দেখুন। বুদ্ধত্ব লাভ করবার জন্য কত দীর্ঘ সময় পার করেছেন তা ভাবতে শরীর শিউরে উঠে।
৪। মহাকল্পঃ মহাকল্পকে চারভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলো হলো - ক। সংবর্ত বা সংবর্তন কল্প, খ। সংবর্ত স্থায়ী বা সংবর্তন স্থায়ী কল্প, গ। বিবর্ত বা বিবর্তন কল্প এবং ঘ। বিবর্ত স্থায়ী বা বিবর্তন স্থায়ী কল্প। ক। সংবর্ত কল্পঃ পৃথিবী ধংসের আরম্ভ থেকে ধংস পর্যন্ত। খ। সংবর্ত স্থায়ী কল্পঃ পৃথিবী ধংস হওয়ার পর অগণিত অগণিত সময় অতিবাহিত হবার পর পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ার আগ পর্যন্ত। গ। বিবর্ত কল্পঃ পৃথিবী সৃষ্টি হবার আরম্ভ থেকে পৃথিবী সৃষ্টি এবং পৃথিবীতে মানুষ ইত্যাদি বাস হবার উপযোগী হওয়া পর্যন্ত। ঘ। বিবর্ত স্থায়ী কল্পঃ পৃথিবী পরিপূর্ণভাবে সৃষ্টি হবার পর অনেক অনেক বছর মানুষ ইত্যাদি বাস করার পর ধংস শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত। এ চারটি কল্পের প্রতিটি কল্পের সময়সীমা সমান।
পৃথিবী তিনটি উপাদান দ্বারা ধংস হবে। ১। আগুন, ২। পানি এবং ৩। বায়ু। শুধু পৃথিবী না এক চক্রবালের অধ ও উর্ধ্বলোকের কিছু ভূমি ও ধংস হবে। যেমনঃআগুণের দ্বারা পৃথিবী ধংস হলে রূপ ব্রহ্মলোকের আভস্সরের নিন্মভাগ পর্যন্ত ধংস হয়। জলের দ্বারা পৃথিবী ধংস হলে রূপ ব্রহ্মলোকের সুভকিণ্হের নিন্মভাগ পর্যন্ত ধংস হয় এবং বায়ুর দ্বারা পৃথিবী ধংস হলে রূপ ব্রহ্মলোকের বেহপ্ফলের নিন্মভাগ পর্যন্ত ধংস হয়।
আমরা জেনেছি যে, কল্প প্রধানত চার প্রকার। ১- আয়ু কল্প, ২-অন্তর কল্প, ৩-অসংখ্য কল্প এবং ৪-মহাকল্প। এখন আমাদের জানা দরকার এ চার প্রকার কল্পের মধ্যে আমরা কোন কল্পে অবস্থান করছি? ধারণা করছি আমরা এখন অন্তর কল্পে অবস্থান করছি। আগের আলোচনায় আমরা জেনেছি যে, অন্তরকল্পে মানুষের গড় আয়ু আশি হাজার বছর থেকে কমে গিয়ে দশ বছর গড় আয়ু হবে আবার দশ বছর থেকে বেড়ে গিয়ে আশি হাজার বছর গড় আয়ু হবে। এ অন্তর কল্পে মানুষের গড় আয়ু দশ বছর থেকে বেড়ে গিয়ে আশি হাজার বছর হয়েছিল এবং যখন আবার মানুষের আয়ু কমতে শুরু করেছিল সেই সময় ককুসন্ধ বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন। উনি বেঁচেছিলেন চল্লিশ হাজার বছর। ককুসন্ধ বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের দীর্ঘ সময় পর আবার মানুষের মাঝে হানাহানি-দুর্ভিক্ষ-কঠিন রোগ দেখা দিল। মানুষের আয়ু কমতে কমতে দশ বছর গড় আয়ুতে চলে আসলো। এই সময় কিছু ধার্মিক নিজেদের নিরাপদে রক্ষার জন্য জঙ্গলে লুকিয়ে থাকল। সেই সব নিরাপদে অবস্থানকারী মানুষগণ ধর্মময় জীবন যাপন করে আস্তে আস্তে জনবসতি গড়ে তুললো। তাদের ধর্মময় জীবনাচরণের জন্য মানুষের গড় আয়ু আবার দশ বছর থেকে বেড়ে গিয়ে আশি হাজার বছর গড় আয়ু হল। আবার অধার্মিকতার জন্য মানুষের গড় আয়ু কমতে থাকলো। গড় আয়ু কমার এ পর্যায়ে কোণাগমন বুদ্ধের আবির্ভাব হয়। উনার আয়ু ছিল ত্রিশ হাজার বছর। কোণাগমন বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের দীর্ঘ সময় পর আবারো মানুষ অধার্মিক হলো। গড় আয়ু কমে এসে দাঁড়ালো দশ বছরে। কিছু ধার্মিক নিজেদের নিরাপদে রক্ষার জন্য জঙ্গলে লুকিয়ে থাকল। সেই সব নিরাপদে অবস্থানকারী ধার্মিক মানুষদের সৎ জীবনাচরণের জন্য গড় আয়ু বাড়লো। আবার অসৎ জীবনাচরণের জন্য আয়ু কমতে থাকল। আয়ু কমার এ পর্যায়ে আবির্ভাব হলো কশ্যপ বুদ্ধ। উনি বিশ বছর বেঁচেছিলেন। কশ্যপ বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের দীর্ঘ সময় পর আবারো মানুষ অধার্মিক হলো। গড় আয়ু কমে এসে দাঁড়ালো দশ বছরে। কিছু ধার্মিক নিজেদের নিরাপদে রক্ষার জন্য জঙ্গলে লুকিয়ে থাকল। সেই সব নিরাপদে অবস্থানকারী ধার্মিক মানুষদের সৎ জীবনাচরণের জন্য গড় আয়ু বাড়লো। আবার অসৎ জীবনাচরণের জন্য আয়ু কমতে থাকল। মানুষের গড় আয়ু কমতে কমতে যখন একশত বছর হয় তখন এ ধরাধামে জন্ম নেন গৌতম সম্যকসম্বুদ্ধ। আমরা এখন গৌতম বুদ্ধের শাসনে অবস্থান করছি। আমরা নিজেরাই দেখতে পাচ্ছি যে মানুষের মাঝে অধার্মিকতা বেড়ে চলেছে। যার ফলে মানুষের গড় আয়ু আস্তে আস্তে কমছে। এভাবে কমতে কমতে মানুষের গড় আয়ু দশ বছরে আসবে। দশ বছর গড় আয়ু সম্পন্ন মানুষগণ পাঁচ বছর বয়সে বিয়ে করে সংসার করবে। তাদের চিত্ত মৃত্যু ভয়ে ভীত থাকলে ও পর তারা কাম রিপুতে লিপ্ত হয়ে মারামারি-ব্যাবিচার-অবিচার করবে। আত্মীয়-স্বজন কেউ কাউকে তেমন সম্মান করবে না। এতো কষ্টের মাঝে ও কিছু মানুষ ধর্মময় জীবন যাপন করবে। তারাই নিজেদের শীল, সমাধি, প্রজ্ঞাকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য অধার্মিক জন-মানবহীন স্থানে লুকিয়ে নিজেদের রক্ষা করবে। আমরা কোশল রাজার ষোল স্বপ্নগুলা পড়লে এর সত্যতা নির্ণয় করতে পারি। ত্রিরত্ন যখন উপযুক্ত সম্মান পাবেনা তখন পঞ্চ অন্তধানের সাথে গৌতম বুদ্ধের শাসন ধংস হবে। যে ধার্মিক মানুষগুলা লুকিয়ে থাকবেন তাদের সুশীল জীবন যাপনের জন্য আবার মানুষের গড় আয়ু বাড়তে থাকবে। এ সময়ে আমাদের ভদ্র কল্পের শেষ বুদ্ধ আর্য মৈত্রেয় বুদ্ধ আসবেন। উনার আয়ুষ্কাল হবে আশি হাজার বছর। আর্য মৈত্রেয় বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর আস্তে আস্তে মানুষের গড় আয়ু কমবে। এরপর আর আয়ু বাড়বে না। এভাবে অন্তর কল্পের সাথে ভদ্র কল্পের সমাপ্তি হবে। আনন্দজ্যোতিঃ ভন্তের মতে, অন্তর কল্পের সময় হয় অবুদ্ধ কল্প। তিনি আরো উল্লেখ করেছেন যে-আয়ুকল্প, অন্তরকল্প, অসংখ্যকল্প এবং মহা কল্পের মতো ভদ্রকল্প একটি কল্প। ভদ্রকল্প প্রধান চারটি কল্পের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়।
গৌতম বুদ্ধের শাসন ধংস হবার পর পৃথিবী কি ধংস হবে?যদি ধংস হয় মহাকাশ্যপ ভন্তে কোথায় থাকবেন? মহাকাশ্যপ ভন্তে ছিলেন বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর সংঘ প্রধান। এ ছাড়া ও অনেক অনেক গুণে গুণান্বিত একজন ভন্তে। একসময় বুদ্ধ এবং মহাকাশ্যপ ভন্তে একে অপরের চীবর বিনিময়/দান করেছিলেন। মহাকাশ্যপ ভন্তে বুদ্ধের কাছ থেকে চীবর লাভ করে সেটি শ্রদ্ধা সহকারে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন এবং অধিষ্ঠান করেছিলেন এ চীবরখানা অনাগত আর্য মৈত্রেয় বুদ্ধকে দান করবেন। সে কারণে মহাকশ্যপ ভন্তে এখন পৃথিবীতে জীবন্ত অরহত হয়ে বেঁচে আছেন। ভন্তের জীবনী পড়তে শ্রদ্ধেয় প্রমথ বড়ুয়ার লেখা মহাকাশ্যপ বই পড়তে পারেন। আমরা যদি অন্তর কল্পের গড় আয়ু হ্রাস-বৃদ্ধি সম্পর্কে পড়ি তাহলে জানতে পারি কিছু ধার্মিক মানুষ নিজেদের নিরাপদে রক্ষা করবেন এবং তাদের থেকে আবার পৃথিবীতে জনসংখ্যা বাড়বে। এ কথা থেকে বুঝতে পারি যে, এক সময়ে বুদ্ধের শাসন শেষ হবে কিন্তু, পৃথিবী ধংস হবে না। মানুষ তখনো বেঁচে থাকবে। তাহলে বলা যায়, তাদের মতোন মহাকাশ্যপ ভন্তে এ পৃথিবীতে জীবন্ত অবস্থায় বেঁচে থাকবেন। আবার যদি মনে করি গৌতম বুদ্ধের শাসন ধংস হবার পর পৃথিবী ও ধংস হবে তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ায় এ রকম - পৃথিবী ধংসের ব্যাপারে সার সংগ্রহ দ্বিতীয় খণ্ডে দেখি- পৃথিবীতে এমনভাবে আগুন জ্বলবে কোন উদ্ভিদ-প্রাণী ইত্যাদি আর জীবন্ত থাকতে পারবেনা। পৃথিবীর এ রকম উত্তপ্ত অবস্থায় মহাকাশ্যপ ভন্তে এ পৃথিবীতে থাকতে পারবেন না বলে আমার মনে হয়। পৃথিবী ও চক্রবাল ধংসের বর্ণনায় বলা হয়েছে- আগুন, জল, বায়ু দ্বারা পৃথিবী যখন ধংস হবে তখন প্রাণী সমূহ অপরপর্যায় বেদনীয় কর্মের কারণে উর্ধ্বলোকে জন্ম নেবে[সারসংগ্রহ ২য় খণ্ড ৩০৪ পৃষ্টা]। হয়ত মহাকাশ্যপ ভন্তে সে সময়ে শুদ্ধবাস ব্রহ্মলোকে অবস্থান করবেন এবং সেখান থেকে পৃথিবীতে এসে আর্য মৈত্রেয় বুদ্ধকে চীবরখানা দান করবেন। সারসংরহ ২য় খণ্ডের ৩০৬ পৃষ্টায় লেখা হয়েছে যে, কল্প বিনাশের সময় যে সকল প্রাণী আভস্বর ব্রহ্মলোকে জন্ম নিয়েছিলেন তারাই আয়ু/পুণ্য ক্ষয়ে সে লোক থেকে চ্যুত হয়ে দিব্য জ্যোতিঃ দেহধারী হয়ে অযোনি সম্ভবারূপে এ পৃথিবীতে জন্ম নেন। তাদের পরম্পরায় আমাদের এ মানব জাতি। সে যাই হোক-আমাদের এ কথা মেনে নিতে হবে যে;মহাকাশ্যপ, উপগুপ্ত ভন্তে এখনো জীবন্ত অবস্থায় পৃথিবীতে অবস্থান করছেন। দেখা যাক উপর্যুক্ত বিষয়ে পূজনীয় সংঘরাজ জ্যোতিঃপাল মহাথেরো ভন্তের লিখিত পুগ্গল পঞ্ঞাত্তি বইয়ে কি লেখা আছে। ভন্তে বুঝাতে চেয়েছেন, বুদ্ধগণ সংবর্ত, সংবর্ত স্থায়ী, বিবর্ত কল্পে জন্মগ্রহণ করেন না। বিবর্ত স্থায়ী কল্পে জন্ম গ্রহণ করেন। আমরা এখন সংবর্ত কল্পে অবস্থান করছি। এ কথার সূত্র ধরে যে সব প্রাসঙ্গিক কথা আসে সেগুলো হলোঃ ১। সংবর্ত কল্পের শেষের দিকে পৃথিবী ধংস হবে। যেহেতু আমরা সংবর্ত কল্পে আছি। ২। বর্তমানে আছে বোধিবৃক্ষ(অশ্বত্থ বৃক্ষ)। নতুন পৃথিবী সৃষ্টি হলে সেই বজ্রাসনে সময়ে নতুন বোধিবৃক্ষে(নাগেশ্বর বৃক্ষ) জন্ম নেবে। সাথে জন্ম নিবে কল্পতরু বৃক্ষ। ৩। যেহেতু পৃথিবী ধংস হবে সেহেতু সংবর্ত স্থায়ী, বিবর্তন কল্পের পরে বিবর্তন স্থায়ী কল্প আসবে এবং সে কল্পে আর্য মৈত্রেয় বুদ্ধ হবেন। কেননা আমরা জেনেছি বুদ্ধগণ বিবর্তন স্থায়ী কল্পে জন্ম নেন। ৪। বর্তমানকালের বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষকগণ বলছেন যে, পৃথিবীর বয়স ৪৫৪ কোটি বছর। বৌদ্ধ ধর্মের আলোকে বিবর্তনের কথা মেনে নিলে পৃথিবীর বয়স ৪৫৪ কোটি বছরের চাইতে ও বেশি হয়। বৌদ্ধ ধর্মে পৃথিবীর এ সৃষ্টির সময়কে বিবর্তন কল্প বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিবর্তন কল্পের পর বিবর্তন স্থায়ী কল্প এবং এরপর সংবর্ত কল্পে আমরা আছি। তিনটা কল্পের আয়ু সমান। এটি হিসাব করলে ৪৫৪ কোটি বছর থেকে অনেক বেশি হবে। তাহলে বলতে হয়, গৌতম বুদ্ধের শাসন ধংসের পর পৃথিবী ধংস হবে। অন্তর কল্পে মানুষের আয়ু কমার সময় ধার্মিক সে সব মানুষদের বংশ পরম্পরায় আমাদের এই বর্তমান মানব সমাজ এ ধারণা ও ভুল। পূজনীয় সংঘরাজ জ্যোতিঃপাল মহাথেরো ভন্তের আলোচনার আলোকে বলা যায় আমরা মহাকল্পের মধ্যে অবস্থান করছি। একজন ভন্তে বুদ্ধকে প্রার্থনা করে জানতে চেয়েছিলেন-বুদ্ধ ভগবান, কত সময় লাগে এ পৃথিবী সৃষ্টি হতে আর কত সময় লাগে এ পৃথিবী ধংস হতে?বুদ্ধ বলেন, অনেক সময়। একশত বছর-এক হাজার বছর-এক কোটি বছর কিংবা এর চাইতে অনেক অনেক বছর সংখ্যা দিয়ে এটি ব্যাখ্যা করা যাবে না। এতোই অনন্ত সময় নিয়ে পৃথিবী সৃষ্টি ও ধংস হয়।
কল্প ধংসের সময় অধোলোক, মর্ত্যালোক এবং উর্ধ্বলোকের সত্ত্বদের কি গতি হবে? দেবতারা ধ্যানলব্ধ জ্ঞানে দেখতে পাবেন যে শত সহস্র বছর পরে কল্প বিনাশ হবে। তাই দেবতাদের প্রেরিত দূত পৃথিবীতে এসে মানুষ বেশে রক্তবর্ণ কাপড় পড়ে আলুলায়িত চুলে ক্রন্দনরত অবস্থায় ঘোষণা করে বেড়াবেন যে, আজ থেকে শত সহস্র বছর পর এ পৃথিবী ধংস হবে। কাজেই আপনারা ধর্মময় জীবন পালন করুন। সে থেকে মানুষের মনে ধর্ম সংবেগ উৎপন্ন হবে। ধর্মীয় জীবন আচরণের মাধ্যমে কর্মানুসারে গতি প্রাপ্ত হবে। এছাড়া ও বুদ্ধের সকল অস্থিধাতু বুদ্ধগয়ার বজ্রাসনে এসে বুদ্ধরূপ ধারণ করে যখন দেশনা করবেন তখন অনেক অনেক সত্ত্বের সুগতি লাভ হবে। বলা হয়েছে, পৃথিবী ধংসের সময় অপায়লোক পুড়বে-এ পৃথিবী আগুনে পুড়বে এবং স্বর্গের পরেও কিছু লোক পুড়বে। কোন প্রাণী থাকবে না। এসব প্রাণী সমূহ শুদ্ধবাস ব্রহ্মলোকে জন্ম নেবে। এ কথার রেশ ধরে যে প্রশ্নটা এসে যায়- কল্প ধংসের আগে যাদের গতি অপায় হবে তারা অপায়ের কোটি কোটি বছর কষ্ট ভোগ না করে এতো সহজে শুদ্ধবাস ব্রহ্মলোকে উপনীত হবে?এতে করে এটা প্রমাণ হয়না যে তারা অকুশল কর্ম করে পার পেয়ে গেলো?আবার যদি স্বর্গলোকের সত্ত্বদের আয়ুর কথা চিন্তা করি। পৃথিবী ধংসের আগে যারা অনেক অনেক কষ্ট করে ধর্ম আচরণ করে স্বর্গে উৎপন্ন হলো তারা ও স্বর্গের স্বর্গীয় সুখ ভোগ করতে পারবেনা। তাদের গতি হবে আরো অধিক সুখময় ব্রহ্মলোকে। পৃথিবী ও চক্রবালের কিছু লোক ধংসের সময় কুশল কর্মকারী যেমন ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হলো তেমনি অকুশল কর্মকারী ও ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হলো। এটা কেমন কথা – কুশল অকুশলের তফাৎ থাকলো কই? বৌদ্ধ ধর্ম বলে চক্রবালের সকলেই প্রজ্ঞা সুখ লাভ করুক। এ কথা মেনে নিলে পৃথিবী ও চক্রবালের ধংসের শেষের অবস্থায় আমাদের কুশল-অকুশলের বৈষম্যে ভুলে যেতে হবে।
কল্প নিয়ে দেওয়া দুইটি উদাহরণ পড়া যাক- ১। হে ভিক্খুগণ, যেমন দৈর্ঘে্য যোজন, প্রস্তে যোজন, উচ্চতায় যোজন অছিদ্র, বিবরশূন্য, ঘন মহাশিলাময় পর্বত কোন পুরুষ শত বৎসর গতে কাশিক বস্ত্র দ্বারা এক এক বার পরিমার্জন করে। হে ভিক্খুগণ, এই উপক্রম দ্বারা সেই মহাশিলাময় পর্বত ও শীঘ্র ক্ষয় ও পর্য্যাবসন প্রাপ্ত হইয়া যায়;কিন্তু কল্প ক্ষয় হয়না। ২। লোহা দিয়ে বানানো একটি প্রাচীর। যার আয়তন দৈর্ঘ্য, প্রস্ত ও উচ্চতায় এক যোজন। সেই এক যোজন পরিমাণ প্রাচীরের শস্য দিয়ে পূর্ণ। কোন এক ব্যক্তি প্রতি একশত বছর পর পর প্রাচীরের স্থান থেকে একটি শস্য নিবে। এভাবে একশত বছর পর পর একটি একটি করে শস্য নিতে নিতে এক সময় শস্য শেষ হয়ে জাবে, তথাপি কল্পের সময় শেষ হবে না। [ এক যোজন সমান ৬ থেকে ৮ মাইল। বেশির ভাগ সময় ৭ মাইল ধরা হয়। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের দিন সুভদ্র বুদ্ধের কাছে এসে জানতে চাইলেন, পৃথিবী কে সৃষ্টি করলো, পৃথিবী নশ্বর নাকি অবিনশ্বর ইত্যাদি। এ বিষয়ে বুদ্ধ বলেন, সুভদ্র এটি ভাবার সময় এখন নয়। আমি যা বলছি তা মনোযোগ দিয়ে শুন, সেটা নিয়ে ভাবনা কর। এরপর বুদ্ধ সুভদ্রকে বলে দিলেন কীভাবে অরহত হতে হয়। এই সুভদ্রই ছিলেন বুদ্ধের অন্তিম শিষ্য। বুদ্ধ এক সময় দেশনায় বলেন, পৃথিবীতে চার প্রকার অচিন্তনীয় বিষয় আছে যা ধারণার অতীত। এ চারটি বিষয় হচ্ছে - বুদ্ধ বিষয় অচিন্তনীয়, ধ্যানীর ধ্যান বিষয় অচিন্তনীয়, কর্ম বিপাক অচিন্তনীয় এবং লোক চিন্তা বা পৃথিবী সৃষ্টি-ধংস তথ্য বিষয় অচিন্তনীয়। এ সমস্ত অচিন্তনীয় বিষয়ে চিন্তা করে সাধারণ মানুষ কোন সমাধানে পৌঁছাতে সক্ষম নন।
সময় বা কালের আদিও নাই, অন্তও নাই। এই অনাদি অনন্তকালের আবর্তে মহাজাগতিক প্রক্রিয়া চক্রাকারে পুনঃ পুনঃ চলেই যাচ্ছে। মহাজাগতিক প্রক্রিয়ায় চক্রাকারে জগতের সততই আবর্তন বিবর্তন হচ্ছে। বৌদ্ধ সাহিত্য মতে জগত্ অনিত্য। এই অনিত্য জগতের সৃষ্টি ও বিলয় কালের পরিমাপে কল্প এককরূপে গৃহীত হয়েছে। ইংরেজিতে কল্পকে Cyclic Unit on a Cosmic Scale বলে অভিহিত করা যেতে পারে। মহাবংশ গ্রন্থে লিখিত আছে-অনন্ত কল্প, অসংখ্যেয় কল্প ও মহাকল্প এই তিন প্রকার কল্প। সত্ত্ব রোগ ও দুর্ভিক্ষের কারণে জগৎ বিনষ্ট এবং পুনঃ সৃষ্টি হতে যে সময় অতিবাহিত হয় তাকে আমরা অন্তর কল্প নামে অভিহিত করতে পারি। জগৎ বিবর্তনের প্রথম পর্যায়ে সত্ত্বদের বয়স অসংখ্য বত্সর থাকে। লোভ দ্বেষ ও মোহের বশবর্তী হয় বলে সত্ত্বের বয়স ক্রমে দশ বত্সরে পৌঁছে। এইরূপ সময়ের সীমাকে সত্ত্ব অন্তর কল্প বলা হয়। রোগ ও দুর্ভিক্ষের জন্য কল্প ধ্বংস হলে রোগ অন্তর ও দুর্ভিক্ষ অন্তর কল্প বলা হয়। বিশ অন্তর কল্পে এক অসংখ্যেয় কল্প। চার অসংখ্যেয় কল্পে এক মহাকল্প। সাধারণত আমরা কল্প বলতে এক মহাকল্পকে বুঝি। বিসুদ্ধি মগগ, অগগঞঞসুত্ত অর্থ কথা, সারত্ত সংগ্রহ, সারথু দীপনী, অভিধর্মথু বিভাবনী টীকা, লোকপ্পত্তি ও লোক দীপক সার প্রভৃতি গ্রন্থে এক মহাকল্পে চার অসংখ্যেয় আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যথা- (১)সংবর্ত কল্প (২)সংবর্ত স্থায়ী কল্প (৩)বিবর্ত কল্প ও (৪)বিবর্ত স্থায়ী কল্প। অঙ্গুত্তর নিকায়েও এইরূপ উল্লেখ আছে। অগ্নি জল ও বায়ু দ্বারা জগৎ বিনষ্ট হয়। সাতবার অগ্নি দ্বারা পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার পর অষ্টমবারে জলের দ্বারা ধ্বংস হয়। (অগ্নিদ্বারা ৮ বার X জলের দ্বারা ৮ বার)= এই প্রকার ৬৪ বার ধ্বংস হওয়ার পর একবার বায়ুর দ্বারা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে থাকে। অগ্নির দ্বারা আভাস্বর ব্রক্ষলোকের নিম্নভাগ, জলের দ্বারা শুভাকীর্ণ ব্রক্ষলোকের নিম্নভাগ এবং বায়ুর দ্বারা বেহপফল ব্রক্ষলোকের নিম্নভাগ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে থাকে।
নির্বাণের স্রোতে পতিত হওয়া। সৎকায়দৃষ্টি, বিচিকিৎসা এবং শীলব্রত পরামর্শ এই তিন বন্ধন ছিন্ন করতে পারলে নির্বাণের স্রোতে পতিত হওয়া যায়। এই স্রোতে পতিত হলে এই জন্মে অর্হৎ হতে না পারলে সাত জন্মের মধ্যে অর্হৎ হয়ে নির্বাণ সাক্ষাৎ করবেন।
একবার মাত্র পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করেন। প্রতিঘ সংযোজন আংশিক জয় করতে পারলে সকৃ্তাগামী স্তরে উপনীত হওয়া যায়। যদি তিনি এই জন্মে অর্হৎ হতে না পারেন, তা’হলে অনধিক মাত্র একবার জন্ম গ্রহণ করলেই অর্হৎ হবেন।
(অন্+আগমিন্)অনাগামী অর্থ যিনি আর (সংসারে) আগমন করবেন না। কামরাগ ও প্রতিঘ সংযোজন সম্পূর্ণভাবে জয় করতে পারলে অনাগামী স্তরে উপনীত হওয়া যায়। অনাগামীকে আর মনুষ্যলোকে বা দেবলোকে কোথাও পুনর্বার জন্মগ্রহণ করতে হয় না। দেহ ত্যাগের পর তিনি শুদ্ধাবাস দেবলোকে অবস্থান করেন এবং সেখানেই নির্বাণ লাভ করেন।
অরহতি অর্থ যোগ্য হওয়া, উপযুক্ত হওয়া নির্বাণ সাক্ষাৎ যোগ্য। নির্বাণ সাক্ষাৎ করার উপযুক্ত ব্যক্তি। অগ্র দক্ষিণার্হ বলে অর্হৎ অর্থাৎ চীবর, পিন্ডপাত শয্যাসনাদি ভৈষজ প্রত্যয় দানের ও গ্রহণের অরহতি উপযুক্ত বলে অর্হৎ। ভগবান বুদ্ধকে নিম্নলিখিত কারণে অর্হৎ বলা হয়। (১)বুদ্ধ ক্লেশ অরি হতে দূরে স্থিত। (২)মার্গ জ্ঞান দ্বারা সমস্ত অরিকে হনন করেছেন। (৩)সংসার চক্রের আর সমূহ ছেদন করেছেন ও প্রত্যয়র্হ বা গোপনে কোন পাপ করেন না বলে অর্হৎ। অর্হৎগণ ‘খীনা জাতি বাসিতং ব্রক্ষচরিয়ং কতং করণীয়ং নাপরং ইথুত্তায়’ অর্থাৎ জন্ম ক্ষীণ করেছেন, বিশুদ্ধ জীবন চর্য্যা করেন, করণীয় কর্ম সম্পাদন করেন এবং এই জন্মের পর আর পুনর্জন্ম নাই।
নি উপসর্গের সাথে বাণ পদের সমন্বয়ে নির্বাণ শব্দটি গঠিত হয়েছে। নি শব্দের অর্থ না এবং বাণ শব্দের অর্থ তৃষ্ণা। অথাত্ নিবার্ণ শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় যে তৃষ্ণা না বা তৃষ্ণা ক্ষয়। গৌতম বুদ্ধের দিয়ে যাওয়া আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ এবং চতুরার্য সত্য সঠিকভাবে মেনে চললে নিবার্ণ লাভ বা তৃষ্ণা ক্ষয় করা সম্ভব।
বুদ্ধত্ব লাভের জন্য বোধিসত্ত্বগণকে জন্মজন্মান্তরে দশ পারমী পূর্ণ করতে হয়। দশ পারমী হল-দান, শীল, নৈষ্কম্য, ক্ষান্তি, বীর্য, সত্য, অধিস্থান, মৈত্রী, উপেক্ষা ও প্রজ্ঞা।
সম্যক সম্বুদ্ধের অনুপস্থিতিতে একমাত্র বুদ্ধ নিজের প্রচেষ্টায় চতুরার্য সত্য জ্ঞাত হয়ে তৃষ্ণা ক্ষয় সাধন করতে পারেন। পচ্চেক বুদ্ধ হওয়ার জন্য দুই অসংখ্যেয় কালসহ লক্ষাধিক পারমীপূর্ণ করতে হয়। তাঁরা চতুরার্য সত্য নিজে বুঝতে সক্ষম। কিন্তু অপরের নিকট দেশনা করতে সমর্থ নহেন। পচ্চেক বুদ্ধগণ গন্ধমাদন পর্বতে ‘মঞ্জু সক’ বৃক্ষমূলে ‘অজ্জোপোসথো’ বলে উপসোথ কর্ম করে থাকেন।
আর্য সত্য চার প্রকার। যথা- (১)দুঃখ আর্য সত্য, (২)দুঃখ সমুদয় আর্য সত্য, (৩)দুঃখ নিরোধ আর্য সত্য এবং (৪)দুঃখ গামিনী প্রতিপদা আর্য সত্য। জন্ম দুঃখ, জরা দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মরণ দুঃখ, অপ্রিয় সংযোগ দুঃখ, প্রিয় বিয়োগ দুঃখ, ইচ্ছিত বিষয়ের অলাভ দুঃখ ও সংক্ষেপে পঞ্চোপাদান স্কন্ধই দুঃখ। ইহাকে দুঃখ আর্য সত্য বলে। কামতৃষ্ণা, ভবতৃষ্ণা, বিভবতৃষ্ণা প্রভৃতি তৃষ্ণাত্রয় পুনৎপাদনশীলা, নন্দিরাগ সংযুক্তা এবং উক্ত বিষয়ে অভিনন্দিনী। তাই ইহাকে দুঃখ সমুদয় সত্য বলা হয়। তৃষ্ণার অশেষ রুপে বিরাগ, নিরোধ, ত্যাগ, নিক্ষেপ, মুক্তি, অনালয়ই দুঃখ নিরোধ আর্য সত্য। দুঃখ নিরোধ গামিনী প্রতিপদা আর্য সত্য হল আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। যথা-সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্মান্ত, সম্যক আজীব, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। পূর্বে অনশ্রুত ধর্ম তথাগত অভিসম্বোধি জ্ঞানে জ্ঞাত হয়েছেন, যাহা চক্ষু করণীয়, জ্ঞান করণীয় এবং যাহা উপ্শম অভিজ্ঞা, সম্বোধি ও নির্বাণের অভিমুখে সংবর্তিত করে। তাই বুদ্ধ বলেছেন-“চতুসচ্চ বিনিমুত্তো ধম্মো নাম নখি”। চতুরার্য সত্য ব্যতীত কোন ধর্ম হতে পারে না।
কুমার সিদ্ধার্থ একদিন নগর ভ্রমণে বের হয়ে চারিনিমিত্ত দেখেছিলেন এবং সেই রাতেই তিনি গৃহত্যাগ করেছিলেন। চারিনিমিত্ত হল-বৃদ্ধ, রোগী, মৃতদেহ ও সন্ন্যাসী।
গৌতম বুদ্ধ গৃহীদের জন্য পঞ্চশীল দিয়ে গেছেন। এগুলো হল- ১. প্রাণীহত্যা না করা। ২.অপরের জিনিস চুরি না করা। ৩.ব্যভিচার না করা। ৪.মিথ্যা কথা না বলা এবং ৫.সুরা বা মদ্যপান না করা। পঞ্চশীল ঠিকমত পালন করতে পারলে এ জন্মে মার্গফল লাভ করতে না পারলেও পরবর্তী যে কোন এক জন্মে নিবার্ণলাভ করা সম্ভব।
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নিত্য ব্যবহার্য বস্তু। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সংসার ত্যাগ পর আট প্রকার ব্যবহার্য বস্তু রাখার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এই প্রকার বস্তু (১) সংঘাটি (২) জলছাঁকুনী (৩)অর্ন্তবাস (৪) ভিক্ষাপাত্র (৫) ক্ষুর (৬) সুচ-সুতা (৭) উত্তরাসঙ্গ ও (৮) কটিবন্ধনী। এই অষ্টপরিষ্কার দানের ফলে বুদ্ধের সময় ভিক্ষু হলে ‘এস ভিক্ষু’ বলার সাথে সাথে ভিক্ষু অষ্টপরিষ্কার প্রাপ্ত হন।
“মেত্তেয়্যো উত্তমো রামো পসেনো কোসলো ভিভু, দীঘসোনি চ চঙ্কী চ সুল ভো তো দেয়্য ব্রাহ্মণো। নালগিরি পারিলেয়্য বোধিসত্ত্বা ইমে দসা, অনুক্কমেন সম্বোধিং পাপুনিস্সতি অনাগতে”। বাংলাঃ মৈত্রেয়, উত্তম রাম, কোশলরাজ প্রসেনজিত, অভিভূ, দীর্ঘশোনি, চঙ্কী, শুভ, ব্রাহ্মণ তোদেয়্য, না্লগিরি এবং পারিলেয়্য এই দশ বোধিসত্ত্ব অনাগতে অনুক্রমে সম্বোধি প্রাপ্ত হবেন। ব্রিটিশ যাদুঘরে একটা সম্পূর্ণ পত্রে পান্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। উহা নিম্নরুপ- ইমাস্মিং ভদ্দকপ্পে মেত্তেয়্যো বোধিসত্তো সব্বঞ্ঞূতং পাপুনিসসতি। দুতিয়কপ্পো সূঞঞো হোতি। ততিয়কপ্পে রামো বোধিসত্তো সব্বঞঞূতং পাপুনিসসতি, সেসানি পঞঞাসকপ্পানি। এতস্মিং অন্তরে যথারুপং অঞঞূতরো বোধিসত্তো সব্বঞঞূতং পাপুনিসসতি। ইদানি পন মেত্তেয়্যো চ রামো প সেনো চ বিভূতি চ চত্তারো বোধিসত্তা তুসিত ভবনে বসন্তি। সূভূতো চ নালগিরি চ পারিলেয়্য চ তয়ো বোধিসত্তা তাবতিংস ভবনে বসন্তি। উত্তরো চ দীঘো চ চঙ্কী চ তয়ো বোধিসত্তা ইদানীং পঠরিয়া পব্বজিতা হোন্তি ভিকখু। দসবোধিসত্তাবিধি। বাংলাঃ এই ভদ্রকল্পে মৈত্রেয় বোধিসত্ত্ব সর্বজ্ঞতা প্রাপ্ত হবেন। দ্বিতীয় কল্প শুন্য কল্প হবে। তৃতীয় কল্পে বোধিসত্ত্ব রাম সর্বজ্ঞতা জ্ঞান প্রাপ্ত হবেন। পরে পঞ্চাশ কল্প বাকী থাকবে। এই সময়ে যথাসময়ে অন্যান্য বোধিসত্ত্বগণ সর্বজ্ঞতা জ্ঞান প্রাপ্ত হবেন। বর্তমানে মৈত্রেয়, রাম, প্রসেনজিত এবং বিভূতি প্রভৃতি বোধিসত্ত্বগণ তুষিত দেবলোকে অবস্থান করতেছেন। সুভূতি, নালগিরি এবং পারিলেয়্য প্রভৃতি তিন বোধিসত্ত্ব তাবতিংস দেবলোকে অবস্থান করতেছেন। উত্তর, দীর্ঘ এবং চঙ্কী প্রভৃতি তিন জন বোধিসত্ত্ব বর্তমানে জগতে ভিক্ষু হিসেবে আছেন। ইহা দশবোধিসত্ত্বের ইতিহাস। সোতথুকী নামক গ্রন্থে দশ বোধিসত্ত্ব উৎপত্তির সহিত আর দুই লাইন গাথা পাওয়া গেছে। তা হল- দসুত্তরা পঞ্চসতা বোধিসত্তা সমূহতা, দসা অনুক্কমা চেব অবসেসা নানুক্কমা। বাংলাঃ মোট পাঁচশত দশজন বোধিসত্ত্ব নির্ধারিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দশজন অনুক্রমে বুদ্ধ হবেন। অন্য পাঁচশত বোধিসত্ত্বের ক্রম এখন ও নির্ধারিত হয় নাই।
চুলামনি চৈত্য গৌতম বুদ্ধের কেশধাতু দিয়ে তৈরি এবং তাবতিংস স্বর্গে প্রতিনিয়ত দেব ব্রক্ষা দ্বারা পূজিত হচ্ছে। গৃহত্যাগের পর যখন সিদ্ধার্থ তার লম্বা চুল কেটে আকাশের দিকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন ঠিক তখনি তাবতিংস স্বর্গের দেবরাজ ইন্দ্র সে চুল নিয়ে যান এবং তৈরি করেন চুলামনি চৈত্য।
১। সুপ্রতিষ্ঠিত পাদ, (সুপ্পতিটঠিত পাদো) ২। পাদতলের নিম্নদেশে সর্বাকার পরিপূর্ণ নেমি ও নাভিসহ সহস্র অরযুক্ত চক্র বিদ্যমান(হেটঠা পাদতলেসু চক্কানি জাতানি সহস্রারানি সনেমিকানিস সর্ব্বাবাকার পরিপূরানি) ৩। আয়ত পাঞ্চি বা পরিপূর্ণ পায়ের মুড়ি(আয়রতপনিহ) ৪। দীর্ঘ অঙ্গুলি(দীর্ঘঙ্গুলি) ৫। ব্রক্ষ ঋজু শরীর(ব্রক্ষজ্জুগতো) ৬। সপ্ত উন্নত স্থান-দুই হস্ত, দুই পাদ, দুই অংস, স্কন্ধ ও এক গ্রীবা অংস কুট মাংস পূর্ণ উন্নত স্থান(সস্তুসসদো) ৭। মৃদু কোমল হস্ত ও পাদতলে, (মৃদুতলুনহথু পাদো) ৮। জালহস্ত পাদ(জাল হথু পাদো) ৯। পায়ের মধ্যবর্তী গুলফ(উসসঙ্খ পাদো) ১০। উর্দ্ধমুখী লোমের অগ্রভাগ(উদ্ধ গগলোমো) ১১। এণিমৃগঘসদৃশ জঙ্খা(এণিজংঘো) ১২। অতিশয় মসৃণ স্নিগ্ধ মুখাবয়ব(সুখমচ্ছাবি) ১৩। সুবর্ণ বর্ণ কাঞ্চন সদৃশ ত্বক(সুবন্নবন্নো) ১৪। গুহ্যেন্দ্রিয় কোবরক্ষিত(কোসোহিত বথু গুয়েহা) ১৫। নিগ্রোধ পরিমন্ডল অর্থাৎ বয়ঃ প্রমাণ ব্যাম, ব্যাম প্রমাণবয়ঃ(নিগ্রোধমন্ডলো) ১৬। দন্ডায়মান অবস্থায় উভয় হস্ত দ্বারা জানুদ্বয় স্পর্শ ও পরিমর্দন করতে সক্ষম(অননোমন্তো) ১৭। সিংহ পূর্বার্ধ কায়, (সীহ পূববদ্ধ কায়ো) ১৮। স্কন্ধ গহবর পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত, (চিতন্তরংসো) ১৯। সমবর্ত স্কন্ধ, (সমবত্তখন্দো) ২০। সুক্ষরস গ্রাহী জিহবা(রসগগসগগি্) ২১। গাঢ় নীল নেত্র(অভিনীলনেত্তো) ২২। গো-চক্ষু বিশিষ্ট(গোপখুমো) ২৩। উষ্ণীষ শীর্ষ(উনহীসসীসো) ২৪। প্রত্যেক লোমকূপে একলোম(একেকলোমো) ২৫। ভ্রুণযুগলের মধ্যে উণা(চক্রাকারে উর্দ্ধমূখী স্বর্ণবর্ণ একটা লোক)(উণ্না) ২৬। চল্লিশ দন্ড। (চত্তলীসদন্তো) ২৭। অবিবর দন্ত। (অবিরল দন্তো) ২৮। দীর্ঘ জিহবা। (পহূত জিহবা) ২৯। ব্রক্ষস্বর। (ব্রক্ষসস্রো) ৩০। সিংহহনু। (সীহ হনু) ৩১। সমদন্ত। (সমদন্তো) ৩২। শুভ্রদন্ত। (সুসুক্কদঠো)
বোধিসত্ত্বদের দশ পারমী, দশ উপপারমী ও দশ পরমার্থ পারমী পরিপূর্ণ করার কারণে তাঁরা ৩২ প্রকার মহাপুরুষ লক্ষণ এবং অশীতি প্রকার অনুব্যঞ্জন লক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে থাকে। অশীতি প্রকার অনুব্যঞ্জন লক্ষণগুলি নিম্ন রুপঃ ১। উন্নত নখ(তুঙ্গ নখা) ২। তাম্রবর্ণ নখ(তম্ব নখা) ৩। স্নিগ্ধ নখ(সিনিগ্ধ নখা) ৪। সুগঠিত আঙ্গুল (বটঠঙ্গুলি) ৫। চিত্রাঙ্গুল(চিত্তাঙ্গলি) ৬। অনুপূর্ব আঙ্গুল (অনুপূব্বাঙ্গলি) ৭। নির্গ্রন্থ শিরা (নিগগন্ত সিরা) ৮। গুপ্ত শিরা (গূঢ় সিরা) ৯। নিগুঢ় গুলফ (গূঢ় গুলফা) ১০। সবল গ্রন্থি (ঘণ সন্ধি) ১১। সম ও সমান পদ (অবিসম সমপাদা) ১২। পরিপূর্ণ পুরুষ লক্ষণ (পরিপূন্না ব্যঞ্জনহ) ১৩। সমরশ্মি সম্প্রসারণ (সমন্ত পভা) ১৪। মৃদুগাত্র (মদু গত্তো) ১৫। সুন্দর গাত্র (বিসদ গত্তো) ১৬। অলীন গাত্র (অদীন গত্তো) ১৭। অনুসন্ধি গাত্র (অনুসন্ধি গত্তো) ১৮। সুসংহত গাত্র (সুসমহ গত্তো) ১৯। সুবিভক্ত, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ (সুবিভত্তাঙ্গ প্রত্তোঙ্গো) ২০। নিখিল অবিকৃত শরীর (নিখিলা দুসট সরীরা) ২১। অতি সৌম্য গাত্র (ব্যপগততি্লকালক গত্তো) ২২। তুলাসদৃশ পদতল(তুল মদু পণয়হ) ২৩। গভীর হস্তরেখা (গম্ভীর পাণি লেখা) ২৪। অভঙ্গ হস্তরেখা (অভগণ পাণি লেখা) ২৫। অচ্ছিন্ন হস্তরেখা (অচ্ছিন্ন পাণি লেখা) ২৬। অনুপূর্ব হস্তরেখা (অনুপূব্বা পাণি লেখা) ২৭। বিম্বোষ্ঠ (বিম্বোটঠা) ২৮। সুবাসিত উচ্চারণ (নাভায়তননবচনা) ২৯। মৃদু, সরু লোহিত জিহবা (মদু তনু করত্ত জিবহা) ৩০। গজেন্দ্রয় সহিত অনুকরণীয় স্বর (গজগরজিতস্তনিত সসরা) ৩১। সু-উচ্চারিত স্বর (সুসসরবর গিরা) ৩২। মঞ্জুঘোষ (মঞ্জুঘোসা) ৩৩। গজেন্দ্র গতি (নাগবিক্কান্ত গামী) ৩৪। বৃষভ গতি (রসভবিক্কান্ত গামী) ৩৫। হংসরাজ গতি (হংস রিক্কান্তগামী) ৩৬। সিংহরাজগতি (সীহবিক্কান্তগামী) ৩৭। দক্ষিণাবর্ত গতি (অভিদকখিন গামী) ৩৮। সমস্ফীতউদসদ (উদসদসমা) ৩৯। সমস্ত প্রাসাদক (সমস্ত পাসদিকা) ৪০। পবিত্র আচার ব্যবহার (সুচি সমাচারা) ৪১। পরম পবিত্র বিশুদ্ধ লোম (পরম সুচি বিসুদ্ধ লোমা) ৪২। পরিমন্ডলাকার সমোজ্জল রশ্মি (বিতি মিরসমন্তপপভা) ৪৩। ঋজুগাত্র (উজুগত্তো) ৪৪। মৃদু গাত্র (মদুগত্তো) ৪৫। অনুপূর্ব গাত্র (অনুপূব্ব গত্তো) ৪৬। ধনু উদর(চাপোদরা) ৪৭। সুচারু রুপে বৃহতাকার গোল ভূঁড়ি (চারুকখাভগদনোদরা) ৪৮। গম্ভীর নাভী (গম্ভীর নাভী) ৪৯। অভঙ্গ নাভী (অভগণ নাভী) ৫০। অচ্ছিন্ন নাভী (অচ্ছিন্ননাভী) ৫১। দক্ষিণাবর্ত নাভী (অভিদ কখিনাবত্ত নাভী) ৫২। পরিণত জানুমন্ডল (পরিণত জানু মন্ডলা) ৫৩। সুগঠিত দন্ত (বট্টি দাঠা) ৫৪। তীক্ষ্ম দন্ত (তীণহ দাঠা) ৫৫। অভগ দন্ত (অভগণ দাঠা) ৫৬। অচ্ছিন্ন দন্ত (অচ্ছিন্ন দাঠা) ৫৭। সমদন্ত (অবিংস মদাঠা) ৫৮। উন্নত নাক (তুঙ্গ নাসা) ৫৯। অনতি-আয়তন নাক (নাত্তায়তন নাসা) ৬০। ভ্রমরকানো নয়ন (অসিত নয়না) ৬১। নীলশ্বেতকমল সদৃশ নয়নদ্বয় (অসিত সিত কমল দসস-নয়না) ৬২। কালভ্রু (অসিত ভ্রম) ৬৩। স্নিগ্ধভ্রু (সিনিগ্ধলোক ভম) ৬৪। আয়্তরুচির কর্ণ (অপরীত্ত কন্না) ৬৫। সমরুপ কর্ণ (অবিসম কন্না) ৬৬। ত্রুটিমুক্ত কর্ণ (ব্যপগতকন্না দোসা) ৬৭। অবিচলিত অবিকৃত সংযত ইন্দ্রিয় (অনুপহতা অনুপক্লিটঠ সন্তিন্দ্রিয়া) ৬৮। উত্তম সমানুপাতিক ললাট (উত্তমসেটঠ সংমিতমূখললাটা) ৬৯। কালকেশরাশি (অসিত কেসা) ৭০। সমকেশ (সহিত কেসা) ৭১। উজ্জ্বল কেশ (চিত্তকেসা) ৭২। জটাবিহীন কেশ (বিব্বত্ত কেসা) ৭৩। অভঙ্গ কেশ (অভগন কেসা) ৭৪। অচ্ছিন্ন কেশ (অচ্ছিন্ন কেসা) ৭৫। কোমল কেশ (অপরুস কেসা) ৭৬। স্নিগ্ধ কেশ (সিনিগ্ধ কেসা) ৭৭। সুরভিত কেশ (সুরভি কেসা) ৭৮। অগ্রকুঞ্চিত কেশ (বল্লিতাগগকেসা) ৭৯। সুগঠিত মস্তক (সুসিরসো) ৮০। স্বতিক, নন্দ্যাবর্ত মুক্তিক, লক্ষণযুক্ত কেশ (স্বস্তিক নন্দ্যাবত্ত-মুক্তিক সেসটঠ সন্নিকাসাকেসা)
(প্রতি-সম-ভিদ্ ধাতু নিষ্পন্ন) প্রতিসম্ভিদা অর্থ লোকোত্তর মার্গাদি বিষয়ে বিশেষ ব্যুৎপত্তি। বহু-শাস্ত্র অধ্যয়ন করলেও পৃথক জনের প্রতিসম্ভিদা প্রাপ্তি ঘটে না। যাঁরা আর্যশ্রাবক তাঁদের প্রতিসম্ভিদা লাভ অবশ্যাম্ভাবী। প্রতিসম্ভিদা জ্ঞান চার প্রকার। যথা-(১)অর্থ প্রতিসম্ভিদা (২) ধর্ম প্রতিসম্ভিদা (৩) বিরুক্তি প্রতিসম্ভিদা ও (৪) প্রতিভাণ প্রতিসম্ভিদা এই চার প্রকার প্রতিসম্ভিদা দুই কারণে ভিন্ন এবং পাঁচটি কারণে সুস্পষ্ট হয়ে থাকে। প্রতিসম্ভিদা শৈক্ষ্য এবং অশৈক্ষ্য ভূমি এই কারণে দুই ভাগে বিভক্ত। সারীপুত্র, মোগগল্লায়ণদি অশীতি মহাস্থবিরের অশৈক্ষ্যবশে প্রতিপন্ন আর আনন্দ স্থবির, চিত্ত গৃহপতি, ধার্মিক উপাসক, উপাল গৃহপতি, খূজ্জত্তরা উপাসিকাদের প্রতিসম্ভিদা শৈক্ষ্য ভূমি বশে প্রভিন্ন। অধিগম, পর্যপ্তি, শ্রবণ, জিজ্ঞাসা ও পূর্বযোগ-এই পাঁচটি কারণে প্রতিসম্ভিদা সুস্পষ্ট হয়ে থাকে। পাঁচ প্রকার অর্থ সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন প্রকার জ্ঞাত হওয়াকে অর্থ প্রতিসম্ভিদা বলে। চার প্রকার ধর্ম বিবিধ জানবার যে জ্ঞান, তাহা ধর্ম প্রতিসম্ভিদা। নিরুক্তি বা ব্যাকরণ হিসাবে ধর্ম জানবার যেই জ্ঞান, তাহা নিরুক্তি প্রতিসম্ভিদা। অর্থ, ধর্ম, নিরুক্তি এই তিনটা জ্ঞানের বিভিন্নতা জানবার একটা বিশিষ্ট জ্ঞানকে প্রতিভাণ প্রতিসম্ভিদা বলে। প্রতিভাণ প্রতিসম্ভিদা পূর্বোত্তম জ্ঞাত্রয় জানে বটে, কিন্তু তাদের কার্য সম্পাদন করতে পারে না।
প্রতি+বেধ অর্থ ধর্মসমূহে লোকোত্তর জ্ঞান। চার আর্য মার্গ, চার আর্য মার্গফল ও নির্বাণ ধর্মকে প্রতিবেধ ধর্ম বলা হয়।
ত্রিপিটকের নবাঙ্গ ধর্ম শিক্ষাকে পরিয়ত্তি বলা হয়। তের প্রকার ধূতাঙ্গ, চৌদ্দ প্রকার খন্ধকব্রত, অশীতি প্রকার মহাব্রত, শী্ল, সমাধি ও বিদর্শন প্রভৃতি আচ্রণের বিধানবলীকে প্রতিপত্তি ধর্ম বলে।
যমক অর্থ দুই, প্রাতিহার্য ঋদ্ধি। যমক প্রাতিহার্য অর্থাৎ একই সঙ্গে দুই প্রতিচ্ছবি প্রর্বতন করা। কথিত আছে, বুদ্ধ অন্য তীর্থিয়দের সন্দেহ দূরীকরণের জন্য শ্রাবস্তীতে যমক প্রাতিহার্য প্রদর্শন করেছেন। দুই বিপরীত দৃশ্যকে এক সঙ্গে প্রদর্শন করা। যেমন-একই স্রোতে অগ্নি ও জল বাহির হওয়া।
দেবলোকের ৪র্থ ভূমি। এখানকার সত্ত্বগণের আয়ু ৫৭ কোটি ৬০ লক্ষ বৎসর। সন্ত্তষিত নামক দেবপুত্র এই দেবলোকের অধিপতি। বোধিসত্ত্বগণ এবং তাঁদের মাতাপিতা প্রভৃতি এই মহাপূণ্যবানগণ এই দেবভূমিতে উৎপন্ন হয়ে থাকেন। এখানে দ্বিহেতুক, ত্রিহেতুক পৃথগজন ও কোন কোন স্রোতাপত্তি ও সকৃদাগামী ব্যক্তিগণ উৎপন্ন হয়ে থাকেন।
আমাদের শরীরের দুই বাহু ও দুই জানু এবং মস্তক অবনত করে যে প্রণাম বা বন্দনা করা হয়। উহা পঞ্চাঙ্গ বন্দনা বলা হয়। এই খানে মুসলিমদের স্বলাত বা নামাজ এর মিল রয়েছে।
দেবগণের হর্ষাবিষাদ ধ্বনি। দশ সহস্র চক্রবালের মধ্যে কোন পরম হর্ষের বা বিষাদের সময় উপস্থিত হওয়ার কারণ দেবগণ জানতে পারেন। তারা এই সময়ে আগে উক্ত ঘটনা দশ সহস্র চক্রবালে ঘোষণা করে থাকে। এই ঘোষণাকে কোলাহল বলে। কোলাহল ৫ প্রকার। যথা-(১)কল্প কোলাহল শত সহস্র বৎসর পরে এই জগতের প্রলয় হবে বলে যে কোলাহল, তাহাকে কল্প কোলাহল বলে;(২)চক্রবর্তী রাজা কোলাহল-শত বৎস র পর জগতে চক্রবর্তী রাজার আবির্ভাব হলে যে কোলাহল, তাকে চক্রবর্তী কোলাহল বলে;(৩)বুদ্ধ কোলাহল-সহস্র বৎসর পর জগতে সম্যক সম্বুদ্ধের আর্বিভাব হবে কোলাহল;(৪)মঙ্গল কোলাহল-বার বৎসর পর সম্যক সম্বু্দ্ধ মঙ্গল ব্যাখ্যা করবেন বলে কোলাহল;(৫)মৌনব্রত কোলাহল-সাত বৎসর পর জনৈক ভিক্ষু ভগবান বুদ্ধের নিকট সাক্ষাত করে মৌনব্রত সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করবেন বলে কোলাহল।
মুন্ডিত মস্তক কাষায় বস্ত্রধারী দশ শিক্ষা পদ অনুশীনকারী প্রবজিতকে শ্রামণের ব্লা হয়। অন্যূন সাত বৎসর বয়স্ক ছেলেকে প্রবজ্যা বা দশ শীলে দীক্ষা দেয়া যেতে পারে। যতদিন পর্যন্ত তাঁকে উপসম্পদা দেওয়া না হয়, ততদিন তিনি শ্রামণের নামেই অভিহিত থাকবেন।
ছয়টি দেবলোকের ২য়টি হচ্ছে তাবতিংস স্বর্গ, দেবরাজ ইন্দ্র এই স্বর্গের অধিপতি। মনুষ্যগণনায় এখানকার দেবতাদের আয়ু ৩ কোটি ৬০ লক্ষ বৎসর। দ্বিহেতুক, ত্রিহেতুক পৃথকজন ও কোন কোন স্রোতাপন্ন ও সকৃতাগামী এই দেবলোকে উপনীত হয়ে থাকেন।
ইহা ৫ প্রকার। যথা-মাতৃ হত্যা, পিতৃ হত্যা, অর্হৎ হত্যা, বুদ্ধের শরীর হতে রক্তপাত ঘটানো এবং সঙ্ঘভেদ। এই সব কর্মের যে কোন কেহ যদি করে থাকে, সে এই জন্মে ক্ষীণাস্রব হয়ে মুক্ত হতে পারবে না।
তিন চক্রবাল পর্বতের মধ্যস্থলে ত্রিকোণাকৃতি ৬৮ হাজার যোজন বিস্তৃত নরককে লোকন্তরিক নরক বলে। এই নরক ঘন অন্ধকারে আবৃত। নিম্নদেশ তীব্র ক্ষার জলে পূর্ণ। এই নরকে উপর আচ্ছাদনহীন এবং তলদেশ বর্জিত। সুতরাং ইহার উপরে এর নিম্নে পৃথিবীর সন্ধারক শীতলতর তীব্র ক্ষারজল। এই নরকে সূর্যালোক না থাকাতে নারকীয় প্রাণীদের চক্ষু নাই। তাদের হাতে পায়ে সুতীক্ষ নখ আছে। নখ দিয়ে প্রাণী সকল চক্রবাল পৃষ্ঠে বাদুরের ন্যায় অবস্থান করে। নখ দিয়ে একে অপরকে আক্রমণ করে। যারা আনন্তরিক কর্ম করে, তারা এই নরক ভোগী হয়ে থাকেন।
১৬টি রুপ ব্রক্ষলোকের অসংজ্ঞ ১১তম ভূমি। বেহপ্ফল এবং অসংজ্ঞ এই দুই ব্রক্ষলোক ৪র্থ ধ্যান ভূমি নামে অভিহিত। যারা ৪র্থ ধ্যানে সংজ্ঞা বিরাগ ভাবনা করেন, তারা অসংজ্ঞ ব্রক্ষলোকে উৎপন্ন হবেন। এই ভূমি ব্রক্ষলোকবাসীদের আয়ু ৫০০ কল্প।
অরুপ ব্রক্ষলোক ৪টি। যথা -(১)আকাশানন্তায়তন, (২)বিজ্ঞানান্তায়ন, (৩)আকিষ্ণনায়তন, (৪)নৈবসংজ্ঞা-না-সংজ্ঞায়তন অরুপ ব্রক্ষলোক। অরুপ ধ্যানীগণ এইসব ভূমিতে উৎপন্ন হয়ে থাকেন। তাদের কর্ম ও পূণ্য ক্ষয়ে আবার পূর্নজন্ম গ্রহণ করতে হয়।
বৌদ্ধ সাহিত্যে উল্লিখিত সুমেরু পর্বতকে কেন্দ্র সপ্ত পর্বত ও সপ্ত সমুদ্র বেষ্টিত ১২ শত হাজার যোজন দৈর্ঘ্য এবং ৩৪ শত ৫০ যোজন প্রস্থ এলাকাকে এক চক্রবাল বলে। সুমেরু পর্বতের শিখরে যাম স্বর্গ অবস্থিত। সুমেরু পর্বত হতে পৃথিবী পর্যন্ত তাবতিংস ও চতুর্মহারাজিক স্বর্গ, অসুরভূমি সুমেরু পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত। এইরুপ অসংখ্য চক্রবাল আছে। বুদ্ধের আক্রা ভূমি দশ সহস্র চক্রবাল, বুদ্ধের আদেশ ভূমি লক্ষ কোটি চক্রবাল এবং বুদ্ধের বিষয় ভূমি অপরিমিত চক্রবাল(বিশ্ব ব্রক্ষাণ্ড)।
জগত সৃষ্টির প্রারম্ভে কল্পস্থায়ী স্বয়ং জাত সত্ত্বদের প্রার্থিত বিষয় প্রদানকারী কতগুলি বৃক্ষ উৎপন্ন হন। জম্বুদ্বীপে জম্বুতরু, অসুরদের চিত্ত পাটলী, গরুড়দের সিম্বলী বৃক্ষ, পূর্বাবিদেহে শিরীষ, অপর গোপনে কদম্ব এবং তাবতিংস লোকে পারিজাত বৃক্ষ। এই উত্তর কুরুর বৃক্ষের নাম কল্পতরু।
তুষিত পুরীতে বোধিসত্ত্বের জগতে আবির্ভাব হওয়ার সময় হলে তিনি পঞ্চবিলোকন করেন। যথা-(১)সময় (২) মহাদেশ (৩)জনপদ (৪)পরিবার বা গোত্র (৫) মাতার আয়ুষ্কাল।
পূর্বনিবাস অনুস্মৃতি, পরচিত্ত বিভাজন ও আস্রবক্ষয় জ্ঞান এই তিন বিষয়কে ত্রিবিদ্যা বলা হয়। অর্থাৎ প্রাপ্ত ব্যক্তিগণ ত্রিবিদ্যায় পারদর্শী হন।
বুদ্ধগণ মহাকরুণাবশে জগতে অবস্থান করে দিনের কর্তব্য শেষ করেন। ভোরে কোন স্বত্ত্বের প্রতি ধর্মদানে ধর্মচক্ষু উৎপাদন দেখা, প্রাতঃকালীন কৃত্য, পিন্ডাচরণ, দিবা ধ্যান সমাধি ও ধর্মালোচনা, রাত্রির প্রথম যামে ধ্যান, দ্বিতীয় যামে শয্যা গ্রহণ এবং শেষ যামে দেবতাদের সাথে কথোপকথন।
মহাকল্পের এক চতুর্থাংশ। সৃষ্টির আরম্ভ হতে সম্পূর্ণ সৃষ্টি হওয়ার সময়কে সংবর্ত বলে। সংবর্তের বিপরীতে বিবর্ত। সৃষ্টির ধ্বংসের সময়।
বুদ্ধের শরীর হতে নির্গত ছয় রশ্মি। যথা-নীল, পীত, লোহিত, শ্বেত, হলুদ ও মিশ্রিত রশ্মি। বিভিন্ন বুদ্ধের ষড়রশ্মির বিস্তার বিভিন্ন প্রকার। গৌতম বুদ্ধের ষড়রশ্মি ব্যাম প্রমাণ।
বৌদ্ধ সাহিত্যে পৃথিবীকে চার মহাদ্বীপে ভাগ করা হয়েছে। যথা-(১)উত্তরে উত্তর কুরু (২)পূর্বে পূর্ব কুরু (৩)দক্ষিণে জম্বুদ্বীপ ও (৪) পশ্চিমে অপর গোয়ান। জম্বুদ্বীপ দৈর্ঘ্য প্রস্থে ১০২ হাজার যোজন বিস্তৃত এবং আকৃতি গোশটকের মত। এই মহাদ্বীপে জম্বু বৃক্ষ আছে বলে জম্বুদ্বীপ নামে অভিহিত করা হয়েছে।
পৃথিবীর উত্তরে অবস্থিত মহাদ্বীপের নাম উত্তর কুরু। ইহা ৮ হাজার যোজন বিস্তৃত এবং ইহা পীঠাকৃতি। এখানে কল্পবৃক্ষ হতে ইচ্ছানুযায়ী পোশাক পরিচ্ছেদ ও অলংকারাদি পাওয়া যায়।
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ব্যবহার্য কাপড়। যথা-(১)সঙ্ঘাটি (২) উত্তরাসঙ্ঘ ও (৩)অন্তর্বাস।
বুদ্ধগণ প্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন করেন। সেই সময়ে অসংখ্য সত্ত্বগণ ধর্মচক্ষু উৎপাদন করতে পারেন। এই সময় অভিসময় নামে অভিহিত।
সন্নিপাদ অর্থ ধর্ম সম্মেলন। প্রত্যেক বুদ্ধের সময় সন্নিপাদ হয়ে থাকে। বিনা আমন্ত্রণে বুদ্ধ ধর্মালোচনায় সমবেত অর্হৎ নিয়ে যে ধর্ম সম্মেলন হয়ে থাকে তাকে সন্নিপাদ বলে।
প্রাতিমোক্ষ অর্থ কুশল কর্মের আদি মুখ অর্থাৎ কুশল সম্পাদনের প্রাথমিক বিনয় বিধান। বৌদ্ধ ধর্মে ভিক্ষুদের জন্য বুদ্ধ নির্দেশিত শীল সমূহকে প্রাতিমোক্ষ শীল বলে। ভিক্ষুদের জন্য ২২৭ টা এবং ভিক্ষুণীদের জন্য ৩৩৪ টা প্রাতিমোক্ষ সংবরণশীল আছে।
যে ভিক্ষু ছয় প্রকার উর্ধ ভাগীয় আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী তাকে ষড়াভিজ্ঞ বলা হয়। ষড়াভিজ্ঞ হচ্ছে-ঋদ্ধিবিধা, দিব্যশ্রোত্র, দিব্যচক্ষু, পরচিত্তবিভাজনন, পূর্বানিবাসানুস্মৃতি ও আসবক্ষয় জ্ঞান।
প্রবারণা অর্থ বরণকরা, অভীষ্ট দান, কাম্য দান, নিবারণ, মানা, নিষেধ। বিনয় বিধানে প্রবারণা অর্থ ত্রুটি নৈতিক স্খলন নির্দেশ করবার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ। বুদ্ধ ভিক্ষুদের নির্দেশ দিয়েছেন যে বর্ষাবাসী ভিক্ষুগণ দৃষ্ট, শ্রুত অথবা ত্রুটি বিষয়ে প্রবারণা করতে হবে। ভিক্ষুদের মধ্যে পরষ্পরের অপরাধ হতে নিষ্কৃতির উপায় হচ্ছে প্রবারণা।
বুদ্ধোৎপত্তি অনুসারে কল্প দুই প্রকার। যথা- (১)শূণ্য এবং (২)অশূণ্য কল্প। শূন্য কল্পে সম্যক সম্বুদ্ধ, পচ্চেক বুদ্ধ এবং চক্রবর্তী রাজার আবির্ভাব হয় না বলেই শুন্য কল্প। অশূণ্য কল্প ৫ প্রকার। যথা- (১)সার কল্প, (২)মন্ড কল্প, (৩)বর কল্প, (৪)সারমন্ডকল্প, (৫)ভদ্রকল্প। জগৎ বিবর্তনের প্রারম্ভে অশূণ্য কল্পে যতজন সম্যক সম্বুদ্ধ জগতে উৎপন্ন হবেন বুদ্ধগণের সম্বোধি লাভের স্থানে ততটি পদ্ম প্রস্ফুটিত হয়। শুদ্ধাবাস ব্রক্ষলোকবাসী ব্রক্ষাগণ উক্ত পদ্ম আহরণ করে ব্রক্ষপুরে রেখে দেন। জগতে সম্যক সম্বুদ্ধ উৎপন্ন হলে তারা বুদ্ধকে এই পদ্ম দিয়ে পূজা করে থাকেন।
সম্যক সম্বুদ্ধ হতে বর প্রাপ্তির পর বোধিসত্ত্বগণ নিজের অন্তর্দৃষ্টিতে দশ পারমী, দশ উপপারমী এবং দশ পরমার্থ পারমীর স্বরুপ উদ্ঘাটন করে পারমী পরিপূর্ণ করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকেন। এই সময়ে বোধিসত্ত্বগণ আঠারোো প্রকার অভব্য বা অশুভ অবস্থা (অটঠারস অবব টঠানানি) হতে নিষ্কৃতি পেয়ে থাকেন। যথাঃ-(১)তিনি জন্মান্ধ, বধির, উন্মাদ, জড়(এল মুগ) অথবা বর্বররুপে জন্মগ্রহণ করেন না। (২)তিনি কখনও ক্রীতদাস-ক্রীতদাসীর পুত্ররুপে জন্মগ্রহণ করেন না। (৩)তিনি কখনও মিথ্যাদৃষ্টিসম্পন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন না। (৪)তিনি কখনও লিঙ্গ পরিবর্তন করেন না অর্থাৎ সব সময় পুরুষ হিসাবে জন্মগ্রহণ করেন। (৫)তিনি পাঁচ প্রকার আনন্তরিক কর্মের (১৯) কোনটা কখনও করেন না। (৬)তিনি কখনও কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হন না। (৭-৮)যদি তিনি প্রাণী হিসাবে জন্মগ্রহণ করেন, তার শরীর তিতির পক্ষী হতে ক্ষুদ্র হয় না এবং হস্তী হতে বৃহৎশরীরধারী হন না। (৯)তিনি ক্ষুৎপিপাসিক প্রেতলোকে কখনও জন্মগ্রহণ করেন না। (১০)তিনি নিধমামতৃষ্ণিক (নিজের আগুনে নিজে প্রজ্জলিত) প্রেতলোকে কখনও জন্মগ্রহণ করেন না। (১১)তিনি কখনও কালগঞ্জ নামক অসুরলোকে জন্মগ্রহণ করেন না। (১২)তিনি কখনও অবীচি নরকে জন্মগ্রহণ করেন না। (১৩)তিনি কখনও লোকান্তরিক (২০) নরকে জন্মগ্রহণ করেন না। (১৪)তিনি কামাবচরে মারলোকে জন্মগ্রহণ করেন না। (১৫)তিনি রুপাবচরে অসংজ্ঞ (২১) ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেন না। (১৬)তিনি শুদ্ধাবাস ব্রক্ষলোকে জন্মগ্রহণ করেন না। (১৭)তিনি অরুপ ব্রক্ষলোকে (২২) জন্মগ্রহণ করেন না। (১৮)তিনি এক চক্রবাল (২৩) হতে অন্য চক্রবালে জন্মগ্রহণ করেন না। বোধিসত্ত্বরুপে সম্যক সম্বুদ্ধ হতে বর প্রাপ্তির পর যে সকল বুদ্ধ জগতে উৎপত্তি হন, সেই সকল বুদ্ধ হতে তিনি ভবিষ্যৎ বুদ্ধ হওয়ার ঘোষণা পেয়ে থাকেন। এই ঘোষণাকে ব্যাকরণ বলে। ত্রিশটি পারমী পূর্ণ করার পর বোধিসত্ত্বগণ মহৎ পাঁচ ত্যাগ (মহাপরিচ্চাগা-স্ত্রীদান, পুত্রদান, রাজ্যদান, আপন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান এবং আপন জীবন দান) তিন চরিত্র (তয়া চরিয়া-ঞাতথুচরিয়া, লোকথু চরিয়া ও বুদ্ধিযা চরিয়া) এবং সপ্ত মহাদান (বেসসান্তর রাজার মত দান) করে মহাপৃথিবীকে সপ্তবার কম্পিত করে থাকেন। উপরিউক্ত সকল প্রকার বুদ্ধ করণীয় ধর্ম পরিপূর্ণভাবে সম্পাদন করে বোধিসত্ত্ব তুষিত স্বর্গে অবস্থান করেন। এখানে দেবগণের আয়ুষ্কাল ৫৭ কোটি ৬০ লক্ষ বছর। কিন্তু বোধিসত্ত্বগণ তার পূর্বে তাঁদের আয়ুষ্কাল পরিসমাপ্তি করেন।
(১)অন্তিম জন্মে বোধিসত্ত্বগণ স্মৃতিমান হয়ে মাতৃগর্ভে প্রবেশ করেন। (২)মাতৃগর্ভে বুদ্ধাসনে উপবেশন করে বহির্মূখী হয়ে অবলোকন করে থাকেন। (৩)বোধিসত্ত্বের মাতার দন্ডায়মান অবস্থায় সন্তান প্রসব হয়ে থাকে। (৪)বোধিসত্ত্বগণের জন্ম অরণ্যে হয়ে থাকে। (৫)সদ্যোজাত বোধিসত্ত্ব সমপাদোপারি স্থিত হন এবং উত্তরাভিমূখী হয়ে সপ্ত পদ গমন করেন। তারপর সর্ব দিকে দৃষ্টিপাত পূর্বক এই মহত্ব ব্যঞ্জন বাক্য উচ্চারণ করেন-“এই পৃথিবীতে আমি অগ্র, আমি জ্যেষ্ঠ, আমি শ্রেষ্ঠ, ইহাই আমার শেষ জন্ম, আর আমার পুনঃজন্ম নাই”। (৬)তিনি বৃদ্ধ, রোগী, মৃতদেহ এবং প্রবজ্জিত প্র্রভৃতি চার নিমিত্ত (২৬) দর্শনে উৎকন্ঠিত হয়ে পুত্র লাভের পর মহাভিনিষ্ক্রমণ বা গৃহত্যাগ করেন। (৭)তিনি প্রবজ্যার কমপক্ষে সপ্তাহ ধরে তপশ্চর্যা করেন। (৮)বোধিসত্ত্বগণ বুদ্ধত্ব লাভের দিনে পায়সান্ন ভোজন করে থাকেন। (৯)তিনি কুশাসনে বসে সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভ করেন। (১০)বোধিসত্ত্বগণ বুদ্ধত্ব লাভের জন্য আনাপন স্মৃতি ভাবনা করেন। (১১)বোধিসত্ত্বগণ বজ্রাসনে মার সৈন্যদের পরাজয় করে থাকেন। (১২)তিনি বোধিমন্ডপে ত্রিবিদ্যাদি (২৭) অসাধারণ জ্ঞান অর্জন করে থাকেন। (১৩)সম্বোধি লাভ করে তিনি বোধিবৃক্ষের অদূরে সাত সপ্তাহ যাপন করেন। (১৪)ধর্ম প্রচারের প্রতি অনীহা দেখে মহাব্রক্ষা কর্তৃক ধর্ম প্রচারের জন্য প্রার্থনা। (১৫)তিনি ঋষিপত্তন মৃগদায়ে ধর্মচক্র প্রবর্তন করে থাকেন। (১৬)বুদ্ধ মাঘী পূর্ণিমায় বিপুল ভিক্ষু সংঘসহ প্রাতিমোক্ষ আবৃতি করেন। (১৭)বুদ্ধ জেতবনে দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেন। (১৮)শ্রাবস্তীর নগরদ্বারে বুদ্ধ যমক প্রাতিহার্য প্রদর্শন করেন। (১৯)বুদ্ধ তার মাতাকে সম্মুখে রেখে তাবতিংস স্বর্গে দেবতার নিকট অভিধর্ম দেশনা করেন। (২০)বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গে অভিধর্ম দেশনা করে সাংকাশ্য নগরদ্বারে অবতরণ করেন। (২১)বুদ্ধগণ সতত ফল সমাপত্তি লাভ করে থাকেন। (২২)বুদ্ধগণ সমাপত্তিতে স্থিত থেকে বিনয়ন যোগ্য ব্যক্তিকে অবলোকন করেন। (২৩)বুদ্ধগণ কারণ দর্শন করে ধর্মদেশনা করেন। (২৪)তারা প্রয়োজনবোধে জাতকের কথা উত্থাপন করেন। (২৫)বুদ্ধগণ জ্ঞাতিদের সমাগনে বুদ্ধবংশ দেশনা করেন। (২৬)বুদ্ধগণ আগন্তুক ভিক্ষুগণের সহিত কুশলাদি জিজ্ঞাসা করেন। (২৭)বুদ্ধগণ বর্ষাবাসের পর যাদের দ্বারা নিমন্ত্রিত তাদের সহিত কথা বলে অন্যত্র গমন করেন। (২৮)প্রত্যহ দিবসের পূর্বাহ্নে ও অপরাহ্নে এবং রাত্রির প্রথম যাম, মধ্যম যাম ও শেষ যামের বুদ্ধকৃত্য (২৮)সম্পাদন ক রেন। (২৯)বুদ্ধগণ পরিনির্বাণের পূর্বে মাংস রস গ্রহণ করেন। (৩০)বুদ্ধগণ চব্বিশ কোটি লক্ষ সমাপত্তি সমাপ্ন করে নির্বাণ লাভ করেন।
(১)বুদ্ধের উদ্দেশ্য আনীত অথবা সঞ্চিত চতুর্প্রত্যয়ের কেহ অন্তরায় করতে পারে না। (২)বুদ্ধের পরমায়ুর অন্তরায় করতে পারে না। (৩)বুদ্ধের বত্রিশ মহাপুরুষ লক্ষণ ও অশীতি অনুব্যঞ্জণের (২৯) কেহ অন্তরায় করতে পারে না। (৪)বুদ্ধের রশ্মি বিস্তারের কেহ অন্তরায় করতে পারে না।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.