Loading AI tools
১৯ শতকে প্রতিষ্ঠিত ইব্রাহিমীয় একেশ্বরবাদী ধর্ম উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বাহাই ধর্ম বা বাহাই বিশ্বাস হচ্ছে বাহাউল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একেশ্বরবাদী একটি ধর্ম বা বিশ্বাস। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পারস্যে (বর্তমানে ইরান) এই ধর্মের উৎপত্তি। মূলত মানবজাতির আত্মিক ঐক্য হচ্ছে এই ধর্মের মূল ভিত্তি।[1] বিশ্বে বর্তমানে ২০০-এর বেশি দেশ ও অঞ্চলে এই ধর্মের আনুমানিক প্রায় ৬০ লক্ষ অনুসারী রয়েছে।[2][3]
বাহাই বিশ্বাস অনুসারে ধর্মীয় ইতিহাস স্বর্গীয় দূতদের ধারাবাহিক আগমণের মাধ্যমে ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়েছে। এইসব দূতদের প্রত্যেকে তাদের সময়কার মানুষদের সামর্থ্য ও সময় অনুসারে একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই সকল স্বর্গীয় দূতদের মাঝে আছেন ইব্রাহিম(আ.), গৌতম বুদ্ধ, যীশু, মুহাম্মাদ (সা.) ও অন্যান্যরা। সেই সাথে খুব সাম্প্রতিককালে বাব ও বাহাউল্লাহ। বাহাই ধর্ম মতে এসকল দূতগণ প্রত্যেকেই তাদের পরবর্তী দূত আসার ব্যাপারে, ও তাদেরকে অনুসরণ করতে বলে গেছেন। এবং বাহাউল্লাহ জীবন ও শিক্ষার মাধ্যমে দূতগণের এই ধারা ও পূববর্তী ধর্মগ্রন্থগুলোর অঙ্গীকার সম্পূর্ণ হয়েছে। মানবতা সমষ্টিগত বিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে ধরা হয়েছে, এবং বৈশ্বিক মাপকাঠিতে সার্বিকভাবে শান্তি, সুবিচার ও ঐক্য প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে বর্তমান সময়ের প্রয়োজনীয়তা।[4]
‘বাহাই’ (উচ্চারণ: bəˈhaɪ)[5] শব্দটি একটি বিশেষণ হিসেবে বাহাই বিশ্বাস বা ধর্মকে নির্দেশ করতে বা বাহাউল্লার অনুসারীদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এটি উদ্ভূত হয়েছে আরবি বাহা’ থেকে, যার অর্থ ‘মহিমা’ বা ‘উজ্জলদীপ্তি’।[6] ধর্মটিকে নির্দেশ করতে পূর্বে বাহাইজম বা বাহাইবাদ পরিভাষাটি ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে ধর্মটির সঠিক নাম বাহাই বিশ্বাস।[7][8]
বাহাই শিক্ষা ও মতবাদের ভিত্তি তিনটি মূল নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে ঈশ্বরের ঐক্য, ধর্মীয় ঐক্য, এবং মানবজাতির ঐক্য।[3] এসকল স্বীকার্য থেকে এই বিশ্বাসটি অর্জিত হয় যে, ঈশ্বর নির্দিষ্ট সময় পর পর তাঁর ইচ্ছা স্বর্গীয় দূতদের মাধ্যমে ব্যক্ত করেন। আর এসকল দূতগণের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবজাতির চরিত্র পরিবর্তন ও উন্নয়ন। এছাড়াও যাঁরা এতে সাড়া দিয়েছেন তাঁদের কল্যাণ, এবং নৈতিক ও আত্মিক গুণের বিকাশ। এর ফলে ধর্মের ধারণাটি পরিবর্তিত হয়ে একটি নিয়মতান্ত্রিক, একত্রীকৃত, ও বিকাশমান একটি মাধ্যমে পরিণত হয়েছে, যা যুগ থেকে যুগে পরিবর্তিত হয়।[9]
বাহাইদের ধর্মীয় পুস্তকে ঈশ্বর হচ্ছেন একক, ব্যক্তিগত, অগম্য, সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী, অক্ষয়, এবং অবিনশ্বর একটি স্বত্বা, যিনি বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডের সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা।[10][11] ঈশ্বরের ও মহাবিশ্বের উপস্থিতিকে চিরকালব্যাপী মনে করা হয়, যার কোনো সূচনা বা পরিণতি নেই।[12] যদিও সরাসরিভাবে ঈশ্বরকে অনুভব করা সম্ভব নয়, তবে তাঁকে তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে স্বজ্ঞা দ্বারা অনুভব করা সম্ভব। আর এজন্য ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য থাকা প্রয়োজন, যা প্রকাশ পায় দূতগণের পরিভাষায় ঈশ্বরের সুস্পষ্টকরণের মাধ্যমে।[10][13]
বাহাই ধর্ম বিশ্বের প্রায় সকল ধর্মের বৈধতায় বিশ্বাস করে, এবং সকল ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ও কেন্দ্রীয় ব্যক্তিবর্গ হচ্ছে ঈশ্বরের প্রতিনিধি। ধর্মীয় ইতিহাস হচ্ছে ধর্মগুলোর ধারাবাহিক বণ্টন। এখানে প্রত্যেকে ধর্মের প্রত্যেক প্রতিনিধি ঐ সময় ও স্থানের জন্য আরও ব্যাপক ও প্রাগ্রসর ধারণার প্রবর্তন করেন।[12] সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় সামাজিক শিক্ষাগুলো (যেমন: প্রার্থনার নিয়ম, মৃত্যুপরবর্তী নিয়মকানুন ইত্যাদি) বর্তমান বা পরবর্তী দূতের মাধ্যমে পরবর্তিত হতে পারে। এভাবে পরবর্তী সময় ও স্থানের জন্য প্রযোজ্য আরও সঠিক একটি নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য, সুনির্দিষ্ট কিছু সাধারণ নীতি (যেমন: প্রতিবেশীর প্রতি আচরণ, দাতব্য কর্মকাণ্ড ইত্যাদি) রয়েছে যেগুলো সর্বজনীন ও স্থায়ী। বাহাই বিশ্বাস অনুসারে সদা অগ্রসরমানতার এই প্রক্রিয়া কখনও শেষ হবে না, যদিও বিশ্বাস করা হয় এটি চক্রাকারে ফিরে আসে। এছাড়া বাহাইরা তাঁদের বর্তমান দূত বাহাউল্লাহ’র আবির্ভাবের ১০০০ বছরের মধ্যে ঈশ্বরের আর কোনো দূতের আবির্ভাবে বিশ্বাস করে না।[14][15]
বাহাই পুস্তক বলে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একটি ‘বিবেক’ বা ‘বিচাবুদ্ধিক্ষম সত্ত্বা’ রয়েছে, যা এই প্রজাতিকে ঈশ্বরকে চেনার এবং মানবতার সাথে এর স্রষ্টার সম্পর্ককে বোঝার একটি নিখুঁত সামর্থ্য প্রদান করেছে। প্রত্যেক মানুষের কিছু সুনির্দিষ্ট দায়িত্বও রয়েছে। যার মধ্যে আছে ঈশ্বর কর্তৃক প্রবর্তিত দূতগণের মাধ্যমে ঈশ্বরকে চেনা ও তাঁদের প্রদত্ত শিক্ষাকে গ্রহণ করা।[16] বাহাই পুস্তক অনুসারে, এই পরিচয় ও আনুগত্যের মাধ্যমে, এবং মানবতার জন্য কাজ করা ও নিয়মিত প্রার্থনার ফলে মানুষ ঈশ্বরের আরও নিকটবর্তী হতে থাকে। এটি বাহাই বিশ্বাসের একটি আধ্যাত্মিক লক্ষ্য। যখন কোনো মানুষ মৃত্যুবরণ করে, আত্মা পরবর্তী জগতে পদার্পণ করে। সেখানে কোনো আত্মার আত্মিক উন্নয়ন সম্ভব, যা নির্ভর করে পার্থিব জীবনের কৃত কর্মকাণ্ডের ওপর। পার্থিব জীবনের কর্মকাণ্ডকে ভিত্তি করেই পরবর্তী আধ্যাত্মিক জীবনের বিচার নির্ধারিত হয়। স্বর্গলোক ও মর্তলোককে আধ্যাত্মিকভাবে যথাক্রমে ঈশ্বরের নিকটবর্তী ও দূরবর্তী একটি অবস্থান হিসেবে ধরা হয়। এর মাধ্যমে পার্থিব ও পরবর্তী জীবনের মধ্যে সম্পর্ক সাধিত হয়। বাহাই বিশ্বাস অনুসারে মৃত্যুর পর কোনো পুরস্কার বা শাস্তি প্রদানের বিধান নেই।[17]
১৯২১ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত বাহাই ধর্মের প্রধান ধর্মীয় নেতা শোঘি এফেন্দি নিচে বর্ণিত সারসংক্ষেপটি লিখেছিলেন, যাকে বাহাউল্লাহর প্রবর্তিত অনুশাসনের পার্থক্যসূচক একটি নীতিমালা হিসেবে ধরা হয়। সেখানে তিনি বলেছিলেন, কিতাব-ই-আকদাসে প্রবর্তিত আইন ও বিধিমালা অনুসারে বাহাই ধর্মের মূল তত্ত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে:
The independent search after truth, unfettered by superstition or tradition; the oneness of the entire human race, the pivotal principle and fundamental doctrine of the Faith; the basic unity of all religions; the condemnation of all forms of prejudice, whether religious, racial, class or national; the harmony which must exist between religion and science; the equality of men and women, the two wings on which the bird of humankind is able to soar; the introduction of compulsory education; the adoption of a universal auxiliary language; the abolition of the extremes of wealth and poverty; the institution of a world tribunal for the adjudication of disputes between nations; the exaltation of work, performed in the spirit of service, to the rank of worship; the glorification of justice as the ruling principle in human society, and of religion as a bulwark for the protection of all peoples and nations; and the establishment of a permanent and universal peace as the supreme goal of all mankind—these stand out as the essential elements [which Bahá'u'lláh proclaimed].[18]
নিচের নীতিমালাগুলো বাহাই অনুশাসনের উল্লেখ করতে গিয়ে প্রায়ই ব্যবহৃত হয়। এগুলো এসেছে বাহাই ধর্মগুরু আবদুল-বাহা’র বক্তৃতা থেকে। ১৯১২ সালে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা সফরকালে তিনি এই নীতিমালাগুলোর উল্লেখ করেছিলেন।[19][20] এই তালিকাটি কোনো কর্তৃপক্ষীয় নীতিমালা হয়, এবং এধরনের আরও কিছু তালিকা প্রচলনও রয়েছে।[20][21][22]
বাহাইদের প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যান অনুসারে ১৯৮৬ সালে বিশ্বে বাহাই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা ছিলো ৪০ লক্ষ ৭৪ হাজার, এবং বৃদ্ধির হার ছিলো ৪.৪%।[24] বাহাই সূত্রমতে ১৯৯১ পর্যন্ত সারা বিশ্বে বাহাই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫০ লক্ষেরও বেশি।[25] ওয়ার্ল্ড ক্রিশ্চিয়ান এনসাইক্লোপিডিয়া, ২০০১ সালের এক জরিপে (পৃ. ৪) প্রকাশ করে যে, ২০০০ সালে বিশ্বে বাহাই অনুসারীর ছিলো সংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ ১০ হাজার, এবং ২১৮টি দেশে এদের অনুসারী রয়েছে।
বাহাই ধর্মের উৎপত্তিস্থল পারস্য ও উসমানীয় সাম্রাজ্য পেরিয়ে, বিশ শতকের দিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ, ও উত্তর আমেরিকায় কিছু সংখ্যক ধর্মান্তরিত বাহাইয়ের অস্তিত্ব ছিলো। কিন্তু ১৯৫০ থেকে ১৯৬০-এর দশকের মধ্যে বাহাই গোষ্ঠীর বড় ধরনের ধর্মীয় প্রচারণার ফলে বিশ্বের প্রায় সকল দেশে ও অঞ্চলে এই ধর্মের অনুসারীরা ছড়িয়ে পড়েন। ১৯৯০-এর দশকে বাহাইরা নিজেদের মধ্যে একতা বাড়ানোর লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিকভাবে বড় ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করে। ফলশ্রুতিতে ২১ শতকের গোড়ার দিকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে বড় অঙ্কের মানুষ এ ধর্ম গ্রহণ করে। বর্তমানে বাহাই ধর্ম ইরানের সর্ববৃহৎ সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়।[26]
দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যালামনাক অ্যান্ড বুক অফ ফ্যাক্টস ২০০৪ অনুসারে:
The majority of Bahá'ís live in Asia (3.6 million), Africa (1.8 million), and Latin America (900,000). According to some estimates, the largest Bahá'í community in the world is in India, with 2.2 million Bahá'ís, next is Iran, with 350,000, and the US, with 150,000. Aside from these countries, numbers vary greatly. Currently, no country has a Bahá'í majority.[27]
দ্য ব্রিটানিকা বুক অফ দ্য ইয়ার (১৯৯২-বর্তমান) বইটি ২০০২ সালে দেশের উপস্থিতির সংখ্যাকে ভিত্তি করে ধর্মের বর্ধনশীলতার একটি হার প্রকাশ করেছে। এই জরিপ অনুসারে বাহাই ধর্ম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বর্ধনশীল স্বাধীন ধর্ম। ব্রিটানিকা দাবি করেছে বিশ্বের ২৪৭টি দেশ ও স্থানে এই ধর্মের অস্তিত্ব আছে। সেই সাথে বিশ্বে প্রায় ২,১০০ জাতিগত, বর্ণভিত্তিক, ও উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই ধর্মের অনুসারী রয়েছে। এছাড়াও বিশ্বের প্রায় ৮০০টি ভাষাভাষীর মানুষের মধ্যে এই ধর্মের অস্তিত্ব বিদ্যমান, এবং সবমিলিয়ে বিশ্বব্যাপী এই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ।[28]
২০০৭ সালে এফপি ম্যাগাজিনের এক জরিপ অনুসারে বিশ্বে বাহাই ধর্মের অনুসারী বৃদ্ধির হার ১.৭%।[29]
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে বাহাইরা বারবার হয়রানি ও নানাবিধ প্রতিকূলতার শিকার হয়ে আসছে।, কারণ মুসলিম ধর্মীয় নেতারা বাহাই ধর্মকে একটি স্বাধীন ধর্ম হিসেবে মানেন না। বাহাইদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় মাপের হয়রানিগুলো সংগঠিত হয়েছে ধর্মটির উৎসভূমি ইরানে। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৮ সালের মধে সেখানে ২০০ জনেরও বেশি বাহাইকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।[26] এছাড়া বাহাইদের ধর্মীয় অধিকার আরও অনেক দেশেই বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মাঝে চালিত হয়। এসকল দেশের মধ্যে আছে আফগানিস্তান,[30] আলজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া,[31][32] ইরাক,[33] মরক্কো,[34] এবং সাহারা-নিম্ন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ।[35]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.