নিনজা
From Wikipedia, the free encyclopedia
প্রাচীন জাপানে বিভিন্ন শক্তিশালী সম্প্রদায়দের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার ঘটনা রয়েছে। যুদ্ধ করার জন্য তারা দিনের বেলা, যুদ্ধময়দান অথবা কোন খোলা জায়গা বেছে নিত।
বিশ্বকোষীয় পর্যায়ে যেতে এই নিবন্ধে আরো বেশি অন্য নিবন্ধের সাথে সংযোগ করা প্রয়োজন। |
কিন্তু এই সূর্যালোকের আড়ালেও, অন্ধকার জগতে আরো এক সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল, যারা কিনা তাদের প্রশিক্ষণকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল। এই প্রচুর দক্ষতাপূর্ণ গোপন সৈন্যদের "নিনজা" অথবা "শিনোবি" (Shinobi) বলা হয়ে থাকে, যার অর্থ হচ্ছে "এমন একজন, যে কিনা লুকিয়ে থাকে"।
কিন্তু, ১২শ শতাব্দী'তে নিনজা বলতে গুপ্তচর'কে বোঝানো হত, যারা কিনা বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষের বেশে গোপন ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানার চেষ্টা করত। তারা প্রায়ই কামার, পোশাক বিক্রেতা, কারিগর অথবা সন্ন্যাসীর রূপ নিয়ে থাকত। এদের অনেকেই এই কাজে এতটাই দক্ষ হয়ে উঠেছিল যে তারা অনেক বছর অথবা তাদের পুরো জীবনটাই গুপ্তচর হয়ে কাটিয়েছে অথচ আশেপাশের মানুষ সেটি জানতেও পারেনি।
একসময় জাপানে ষড়যন্ত্র বাড়তে থাকলে, ধীরে ধীরে নিনজা'র চাহিদাও বাড়তে থাকে এবং সেই সাথে আত্মরক্ষা এবং আক্রমণে নিনজারা অনুশীলন করা শুরু করে। তারা বিভিন্ন প্রকার মার্শাল আর্টস-এ বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠে।
তারা জুডো, জুজিস্টু, আকিদো, কারাতে এবং কুংফু'র সংমিশ্রণে 'তাইজুতসু' (Taijutsu) নামক একটি আর্টস তৈরী করে। এই আর্ট'সের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মারাত্মকভাবে আহত করে লড়াই থেকে সড়িয়ে ফেলা। কিন্তু এসবই নিনজা'দের জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই তারা বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রেও পারদর্শী হতে লাগল।
এইজন্যে, জাপানে বিভিন্ন দুর্গ (Castle) এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গা খুবি দক্ষ সামুরাই দিয়ে পাহাড়া দেওয়ানো হত। ফলে গুপ্তচরের কাজটি অনেকটাই কঠিন হয়ে যায় এবং অনেকসময় নিনজা'রা ধরা পড়ে গেলে তাদের মেরে ফেলা হত।
নিনজাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয় একেবারে ছোটবেলা থেকেই। বিভিন্ন ভাবে তাদের প্রশিক্ষিত করা হয়, একজন দক্ষতাসম্পন্ন নিনজা হওয়ার জন্য। এমনকি অনেক কঠিন পরিস্থিতিতে (পরিবেশে) টিকে থাকার জন্যও নিনজাদের প্রশিক্ষণ রয়েছে।
কীভাবে দ্রুত গাছে বা দেওয়াল বেয়ে উঠতে হয়, কীভাবে ক্ষুধা ও ঘুম থেকে বিরত থাকা যায়, নিঃশব্দে হাটাচলা করা, পানির নিচে অনেকক্ষণ থাকা, ইত্যাদি বিষয়ও আয়ত্ত করতে হয়।
নিনজাদের নিজস্ব আচার-আচরণের একটি ঐতিহ্য ছিল। যা দিয়ে তারা জীবন ও মৃত্যুর সম্মুখীন হত। আর এই আচার-আচরণের সম্পর্কে নিনজাদের "বানসেনসুকাই" (BanSenShukai) নামক একটি ডক্যুমেন্ট বা স্ক্রল ছিল।
এছাড়াও, নিনজাদের মধ্যে প্রকৃতির উপাদানগুলোকে ইঙ্গিত করার একটি মাধ্যম আছে। যা দিয়ে নিনজারা আগুন, বরফ, পানি, মাটি, বজ্রপাত, বাতাস ইত্যাদি উপাদানকে ইশারা করত, এবং এটি "কুজি-কিরি" (Kuji-Kiri) নামে পরিচিত। আর এই সবই নিনজাদের আত্মবিশ্বাস ও শত্রুদের বিভ্রান্ত করতে সাহায্য করত।
নিনজা'দের অস্ত্রের বেশিরভাগই ঘরে বা ছোট জায়গায় (রুম বা করিডর) ব্যবহার করা হত।
সুরিকান এবং কুনাই (Shurikan & Kunai)
শুরিকান স্টার আকৃতির ব্লেড, এবং কুনাই একধরনের জাপানিজ ছুরি। কিন্তু নিনজারা এটি মেরে ফেলার জন্য নয়, বরং শত্রুকে মারামারি থেকে বিরত রাখার জন্য অথবা সাবধান করে দেওয়ার জন্য ছুড়ে দিত।
কিন্তু অনেকসময় আত্মরক্ষার জন্য তারা এটি শত্রুর শরীরে আঘাত করত। এমনকি কখনো কখনো এসব অস্ত্রে বিষ মেশানোর ঘটনাও রয়েছে।
মাকাবিশি (Makabishi)
এটি ছোট লোহার কাটা বলা যেতে পারে। সামুরাইরা যখন নিনজাদের তাড়া করত, তখন এই অস্ত্র বেশ কাজে দিত। বিশেষ করে অন্ধকারে এটি তেমন দৃশ্যমান হত না, তাই একবার পায়ে লাগলে এটি মারাত্মকভাবে আহত করতে সক্ষম।
টেকো-কাগি (Tekko-Kagi)
মুখোমুখি আক্রমণে টেকো-কাগি বেশ কাজের ছিল। এর লোহার নখগুলো হালকা আঁচড়েই জখম করতে পারত।
কুসারিগামা (Kusarigama)
একটি কাস্তে'র সাথে শেকল যুক্ত করে, শেষ প্রান্তে ছোট করে লোহা অথবা পাথরের একটি ভর দেওয়া হয়। এটি ব্যবহার করা অনেকটাই কঠিন। তবে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে, এর থেকে অনেক ভাল ফলাফল পাওয়া সম্ভব। বিশেষ করে শেকলের একটি কৌশল আছে, যা দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকে সহজেই আহত করা যায়।
নিনজা-টো সোর্ড (Ninja-to sword)
বলতে গেলে বেশিরভাগ নিনজারাই লাকি'জ এশেজ অথবা কাটানা সোর্ড (তরবারি) পছন্দ করে। এগুলো প্রচুর ধারালো ছিল এবং নিনজারা যথাসময়ে তা ব্যবহার করত।
এছাড়াও নিনজারা বিশেষ ধরনের বোম দিয়ে ধোয়া তৈরী করে শত্রুদের থেকে পালিয়ে আসতে পারত।
১৪শ শতাব্দীতে নিনজারা একটি গুরুতর হুমকি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল। তখন তাদের অর্থের বিনিময়ে ভাড়া করা যেত। তারা তখন অনেক সামুরাই, জ্ঞানী ব্যক্তি ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছিল।
অনেকসময় তারা দুর্গের বাহির থেকে আচমকা আক্রমণ করত অথবা লুকিয়ে ভেতরে গিয়ে খাবারে বিষ অথবা ঔষধ মিশিয়ে দিয়ে আসত।
জাপানে মেয়ে নিনজাদেরও অবস্থান ছিল, এবং তাদের "কুনোইচি" (Kunoichi) বলা হত। তারা গৃহিণী, অথবা অন্যান্য বেশে দুর্গে প্রবেশ করে তাদের লক্ষ্যের খুব কাছাকাছি চলে যেত।
১৬শ শতাব্দীতে নিনজা পরিবাররা বিভিন্ন বংশে বিভক্ত হয়া শুরু করে। তবে সবথেকে শক্তিশালী বংশের মধ্যে ছিল "ইগা-রিয়্যু" এবং "কোগা-রিয়্যু"।
ইগা নিনজাদের প্রদেশ একটি পাহাড়ে ঘেরা গ্রামে অবস্থিত হয়, এবং অন্যদিকে কোগা নিনজাদের বাসস্থান হয় নদীর অথবা ঝর্ণার পাশে। বিভিন্ন অঞ্চলভেদে নিনজাদের অবস্থান, এই দুই নিনজা পরিবারকে নিজস্ব একটি পদ্ধতি তৈরী করতে শেখায়।
আর এভাবেই কিছু নিনজারা তাদের দক্ষতা ও পদ্ধতি দিয়ে ঐতিহাসিক যোদ্ধা হয়ে উঠে। যার মধ্যে একজন হচ্ছে "হাতোরি হানজো" (Hattori Hanzo)
তার জন্ম হয় ইগা গ্রামে এবং তাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী তাকে ছোটবেলা থেকেই নিনজা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি একজন সামুরাই হিসেবে স্বীকৃতি পান। তিনি স্পিয়ার অথবা বর্শা'তে খুব দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। যুদ্ধময়দানে তার সাহসিকতা ও বর্বরতা তাকে জাপানের ইতিহাসে অমর করে রাখে।
নিনজা হাতোরি'র সবথেকে বড় অবদান ছিল - একবার তিনি একটি ক্যাসেল থেকে একজন মহিলা ও তার সন্তানকে খুবি সাহসিকতার সাথে শত্রুপক্ষের থেকে উদ্ধার করেছিলেন।
প্রাচীন জাপানের ঐতিহ্যের অন্যতম জৌলুশ ছিল এই নিনজারা। ইতিহাসে নিনজাদের আলাদা সম্মানের চোখে দেখা হত। জাপানে বহু গল্প, কমিক, কার্টুন, বই, সিনেমা, গেম তৈরি হয়েছে এই নিনজাদের উপর ভিত্তি করে। নিনজাদের ব্যাপারে বহির্বিশ্বের আগ্রহ এখনও কমে যায় নি। আজও পর্যটকরা জাপানে গেলে তাদের অন্যতম আগ্রহের বিষয় থাকে নিনজাদের পার্ফরমেন্স দেখা।
আজ এই যুগে সবথেকে পুরোনো গোষ্ঠীর একজন নিনজা হলেন "কাওয়াকামি জিনিচি" (Kawakami Jinichi)। বলা হয়ে থাকে যে তিনিই জাপানের শেষ নিনজা এবং এটা আসলেই সত্য!
(তার বয়স বর্তমানে ৭০+)
কিন্তু তিনি বর্তমান সময়ের অন্যান্য নিনজাদের মতই নিনজা প্রশিক্ষণকে কাউকে না শেখানোর চিন্তা করেছেন। তিনি নিনজা গোপনীয়তাকে তার সাথেই রাখতে চান। তিনি বর্তমানে জাপানের টোকিও'র পাশেই নিনজাদের একটি যাদুঘরে সম্মানিত পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত আছেন। প্রতিবছর অনেক পর্যটক সেখানে ঘুরতে যায়।
তার মতে এই আধুনিক যুগে নিনজাদের কোনও প্রয়োজন নেই।