Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
তানযিমাত (উসমানীয় তুর্কি ভাষায়: تنظيمات) অর্থ পুনর্গঠন। ১৮৩৯ সাল থেকে শুরু করে ১৮৭৬ সালের প্রথম সাংবিধানিক যুগের শুরু পর্যন্ত উসমানীয় সাম্রাজ্যের সংস্কারমূলক কাজগুলো সম্পাদনের সময়কে বোঝাতে তানযিমাত শব্দটি ব্যবহৃত হয়।[1] উসমানীয় সাম্রাজ্যকে আধুনিক করে তোলার প্রচেষ্টা, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও আগ্রাসী শক্তি থেকে সাম্রাজ্যের সীমানার সুরক্ষাসহ আরো অনেক কাজের জন্য এই সময়কালটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করছে। সংস্কার কর্মগুলো সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অটোমানিজমের বিস্তারে গুরুত্ব দেয়। উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনস্থ এলাকার মধ্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে থামাতে এই প্রচেষ্টা চালানো হয়। অধিক নাগরিক স্বাধীনতা ও সমানাধিকার দেয়ার মাধ্যমে অমুসলিম সম্প্রদায় ও তুর্কি ভিন্ন জাতিগুলোকে উসমানীয় সমাজের মূলধারায় আরো বেশি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সংস্কারগুলো উদ্যোগ নেয়।
সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ, প্রথম আবদুল মজিদ ও ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তার মনে এই সংস্কার আন্দোলনের ধারণা জন্মে। তারা অনুধাবন করেন যে প্রাচীন ধর্মীয় ও সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলো আধুনিক বিশ্বে সাম্রাজ্যের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। পোশাক পরিবর্তনের মত প্রতীকি পরিবর্তনগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজকীয় কর্মকর্তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করা। সফল ইউরোপীয় চর্চাগুলোকে আত্তীকরণ করা বেশ কিছু সংস্কারের উদ্দেশ্য ছিল। বাধ্যতামূলক সামরিকবাহিনীতে যোগদান, শিক্ষা, প্রতিষ্ঠান ও আইনি সংস্কার এবং দুর্নীতি নির্মূল করা ও সমকামিতাকে অপরাধ গণ্য না করা প্রভৃতি পরিবর্তন আনয়ন করা হয়। তানযিমাত অটোমানিজমের নীতিকে অনুসরণ করে।
এই নীতি উসমানীয় শাসনাধিন অঞ্চলের সকল জনগণ, মুসলিম, অমুসলিম; তুর্কি, গ্রিক; আর্মেনীয়, ইহুদি; কুর্দি, আরব সবার মধ্যে একতার বিষয়টি প্রাধান্য দেয়। এই উদ্দেশ্যে ধর্মনিরপেক্ষ আইনের সুবিধার্থে ইসলামী আইনকে সরিয়ে রাখা হয়। [2] ১৮৩৯ সালের রোজ চেম্বারের রাজকীয় ঘোষণায় মুসলিম ও অমুসলিম উসমানীয়দের জন্য আইনের দৃষ্টিতে সমানাধিকার ঘোষণার দ্বারা এই নীতি দাপ্তরিকভাবে ব্যবহার শুরু হয়।[3]
এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা চালুর উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্য ধীরপতন রোধ করা। সীমানা সংকুচিত হওয়া এবং ইউরোপীয় শক্তির তুলনায় দুর্বল হয়ে পড়া থেকে সাম্রাজ্যের পতন বোঝা যাচ্ছিল। মিল্লাত প্রথা বাতিল করার মাধ্যমে উসমানীয় সাম্রাজ্য এর সকল নাগরিকদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে আশাবাদী ছিল।
তানযিমাত সংস্কার সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদের সময় শুরু হয়। ১৮৩৯ সালের ৩ নভেম্বর সুলতান প্রথম আবদুল মজিদ গুলহানের রাজকীয় ফরমান নামক একটি রাজকীয় ফরমান ঘোষণা করেন। একে তানযিমাত ফরমানও বলা হয়। পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে আরো ফরমান ঘোষণা করা হয়।
এই গুরুত্বপূর্ণ দলিলে সুলতান বলেন যে “তিনি নতুন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রদেশগুলোতে উত্তম প্রশাসনের সুফল বয়ে আনতে চান”। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল:[4]
রোজ চেম্বারের ঘোষণা ছিল তানযিমাত যুগের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। সুলতান প্রথম আবদুল মজিদের অধীনস্থ সরকারের অধীনে এই সংস্কার সম্পাদিত হয়। এই ঘোষণা ট্যাক্স ফার্মিং প্রথা অবলুপ্ত করে। এর পরিবর্তে আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বেতনভোগী কর সংগ্রাহক নিযুক্ত করা হয়। এটি তানযিমাত সংস্কারের কেন্দ্রীকরণ প্রভাবকে প্রতিফলিত করে। অধিকন্তু রোজ চেম্বার ঘোষণার দ্বারা প্রত্যেক জেলার জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে সামরিক প্রশিক্ষণ চালু করা হয়। এতে মুসলিম, অমুসলিম প্রত্যেক প্রজার জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। এটি কুল প্রথার অবসান ঘটায় যাতে শাসকদের কর্মচারীদের শাসকের ইচ্ছায় মৃত্যুদন্ড পেতে হত বা তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হত।
রোজ চেম্বারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা হল এতে সবার জন্য আইনের শাসনের কথা বলা হয়, এমনকি অমুসলিমকেও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাম্রাজ্যের অমুসলিমদের ভেতর বিভিন্ন অসন্তোষ ছিল। তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মত আচরণ করা হত এবং তারা দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের কারণে শোষিত হত। এই সংস্কারগুলো উসমানীয় নাগরিকদের জন্য আইনি ও সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। সংস্কারের ফলে মিল্লাত প্রথা নির্মূল হয়। মিল্লাত প্রথার ফলে ধর্মের ভিত্তিতে সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করে। এই সম্প্রদায়গুলো স্বশাসিত ছিল। মুসলিমরা শরীয়াহ, খ্রিষ্টানরা ক্যানন ও ইহুদিরা হালাকা আইন অনুযায়ী চলত। তাই জনগণ নিজের গোষ্ঠী অনুযায়ী সুযোগসুবিধা লাভ করত। ধারা মতে এই প্রথা বাতিল করা হয় এবং একই আইনে বসবাসকারী জনগণের সমাজ সৃষ্টি করে।
নতুন সংস্কারগুলো উসমানীয় সাম্রাজ্যের জনজীবনে প্রায় সম্পূর্ণ পুনর্গঠনের ডাক দেয়। প্রত্যেক প্রদেশকে এমনভাবে গঠন করা হয় যাতে গভর্নরদের একটি উপদেষ্টা পরিষদ এবং নির্দিষ্ট দায়িত্ব থাকে, যাতে প্রদেশের এলাকা উত্তমরূপে তত্ত্বাবধান করা যায়। নতুন সংস্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ট্রেজারি বন্ড প্রভৃতি চালুর মাধ্যমে আধুনিক অর্থনৈতিক পদ্ধতি চালুর ব্যাপারে জোর দেয়। তাছাড়া, সংস্কারের অংশ হিসেবে যোগাযোগ ও পরিবহনের উন্নতির জন্য রাস্তা, খাল ও রেলপথ নির্মাণ করা হয়।
রোজ চেম্বার ঘোষণায় পাশ্চাত্যকরণের দিকে ঝোকার প্রবণতা পাওয়া যায়। এতে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়। ইউরোপকে উসমানীয় সাম্রাজ্যের বাইরে রাখা পাশ্চাত্য মূল্যবোধগুলোর দিকে ঝোকার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল।
সংস্কারের প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে ইতিবাচক ছিল না। বলকান অঞ্চলের খ্রিষ্টানরা এই সংস্কারকে প্রত্যাখ্যান করে কারণ তারা স্বায়ত্তশাসন চাইছিল যা কেন্দ্রীয় শক্তির অধীনে অর্জন করা দুঃসাধ্য ছিল। মূলত এই উদ্যোগ কিছু প্রদেশকে বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনে প্রলুব্ধ করে। রোজ চেম্বার ঘোষণা ও তানযিমাত সমাজের জন্য শক্ত দিক নির্দেশনা প্রদান করলেও এটি সংবিধান ছিল না। এটি সুলতানের কতৃত্বকে প্রতিস্থাপিত করতে পারেনি।
সবমিলিয়ে তানযিমাতের প্রভাব সুদূরপ্রসারী ছিল। তানযিমাত যুগে প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলোতে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ও তুর্কি প্রজাতন্ত্রসহ বলকান অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার অনেক প্রগতিশীল নেতারা শিক্ষালাভ করেন। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সময় বৃহৎ শক্তিগুলোর সাথে আলোচনার কারণে প্রক্রিয়াটি শেষপর্যন্ত অপূর্ণ থেকে যায়। উসমানীয়রা আইনের অধীনে প্রত্যেক নাগরিকদের জন্য সমান সুযোগ দিতে চাইলেও ১৮৫৬ সালের সনদের অংশ হিসেবে ইউরোপীয় শক্তিগুলো সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জাতিগোষ্টীগুলোর জন্য উসমানীয়দের থেকে ভিন্নতর কিন্তু শক্তিশালী অবস্থান দাবি করে। এর ফলে খ্রিষ্টান মধ্যবিত্ত শ্রেণী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শক্তিশালী হয়ে উঠে।
অপরপক্ষে মুসলিমরা এই সুযোগগুলোথেকে বঞ্চিত হয়। এতে পাশ্চাত্যবিরোধী মনোভাব জেগে উঠে।
১৮৭৬ সালে উসমানীয় সংবিধান প্রণয়নের ফলে সংস্কারকাজ বন্ধ হয়ে যায়। সংবিধানে সুলতানের একচ্ছত্র ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিস্তারিত প্রথম সাংবিধানিক যুগ নিবন্ধে আছে। সুলতান ২য় আবদুল হামিদ সংবিধানে স্বাক্ষর করলেও দ্রুত এর বিপক্ষে চলে যান।
এসময় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন করা হয়। পরিবর্তিত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে প্রচলিত আইনগুলো সংস্কার করা হয়। আধুনিক শিক্ষা, পোশাক, স্থাপত্য, শিল্প এবং আধুনিক জীবনযাত্রাকে উৎসাহ দেয়া হয়।
ধর্মীয় স্বাধীনতা-১৮৫৬ সালের সংস্কার ঘোষণায় অমুসলিমদের মর্যাদা সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়। কাউকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা এবং ইসলাম ত্যাগের জন্য মৃত্যুদন্ড দেয়াকে অবৈধ করা হয়।
মূলত অমুসলিমদের উপর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে চাপ ছিল এবং ইসলাম ত্যাগের কারণে মৃত্যুদন্ড হওয়ার ভয় রয়ে গিয়েছিল। ফলে প্রথম দিকে তানযিমাত স্বাধীনভাবে নিজ ধর্মচর্চার অধিকার দিতে ব্যর্থ হয়। উসমানীয় অভিজাতদের জন্য 'ধর্মীয় স্বাধীনতা' বলতে বোঝাতো তাদের নিজেদের ধর্মকে রক্ষা করার স্বাধীনতা”।[7]
উসমানীয় ভূমি আইন, ১৮৫৮ অনুযায়ী ভূমির মালিকানার কাঠামো পরিবর্তনের ফলে রাশিয়ান ইহুদীরা ফিলিস্তিনে জমি কেনার অনুমতি পায় যা প্রথম এলিয়ার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে তাদের পুনর্বাসনে সক্ষম করে তোলে। কর ব্যবস্থাকে সুসংহত করার জন্য আরব ফিলিস্তিনিদেরকে অন্যান্যস্থানের মত জমির নিবন্ধন করতে বলা হয়। যেহেতু অধিকাংশ কৃষকই অশিক্ষিত ও কর দিতে অনিচ্ছুক ছিল, স্থানীয় মুখতাররা নিজেদের নামে জমির নিবন্ধন করে ফেলে। এভাবে পরবর্তীতে তারা জমির মালিকানা দাবি করে এবং স্থানীয় কৃষকদের থেকে তাদের জমি ছিনিয়ে নিয়ে নতুন ইহুদি অভিবাসীদেরকে দেয়। এই অভিবাসীরা স্থায়ীভাবে সিরিয়া ও তুরস্কে বসতি স্থাপন করে।[8]
আর্মেনিয়ায় ১৮৬৩ সালে উসমানীয় সরকার কর্তৃক আর্মেনীয় জাতীয় সংবিধান অনুমোদিত হয়। ১৫০টি অনুচ্ছেদ সংবলিত ছিল এই সংবিধান আর্মেনীয় বুদ্ধিজীবিদের দ্বারা তৈরী হয় এবং উসমানীয় মিল্লাত প্রথার অধীনে আর্মেনীয় প্যাট্রিয়াক ও নবগঠিত আর্মেনীয় জাতীয় সভার ক্ষমতাকে সংজ্ঞায়িত করে।[9]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.