হাত হল প্রাইমেট (শ্রেষ্ঠ বর্গভুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী)দের অগ্রবাহু বা অগ্রপদের শেষে অবস্থিত একটি প্রিহেনসিল বা একাধিক আঙুলযুক্ত উপাঙ্গ। এই প্রাইমেটদের মধ্যে আছে মানুষ, শিম্পাঞ্জি, বানর, এবং লেমুর। আরও কয়েকটি মেরুদণ্ডী প্রাণী, যেমন কোয়ালাদের, (যাদের প্রতিটি "হাত" য়ে দুটি বিপরীতমুখী বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ রয়েছে এবং মানুষের আঙুলের ছাপ এর অনুরূপ আঙুলের ছাপ রয়েছে) সম্মুখ প্রত্যঙ্গে থাবার পরিবর্তে যা রয়েছে তাকে "হাত" বলা হয়। বলা হয় র্যাকুনদের সাধারণত "হাত" রয়েছে, যদিও তাদের বিপরীতমুখী বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ নেই।
সুন্দর হাত দু’খানিতে চুড়ী পরাইতে গিয়া চুড়ীওয়ালা যেন কেমন হইয়া গেল। চোখ ভরিয়া হাত দু’খানিই দেখিতেছিল— মুুখের দিকে তাকাইবার অবসর ঘটে নাই।
তোমাকে কেহ যদি লাঠি দিয়া মারিতে আইসে, তবে তুমি কি কর? দৌড়াইয়া পালাও। আততায়ীর হাত এড়াইবার ইহাই সর্বোৎকৃষ্ট উপায় বলিয়া আমরা মনে করি। কিন্তু অনেক জানোয়ার ইহা অপেক্ষা অন্যরূপ উপায় অবলম্বন করে।
উটপক্ষীকে কুকরেরা তাড়া করিলে যখন সে মনে করে যে আর ইহাদের হাত এড়ানো গেল না তখন মাথাটি বালির নীচে গুঁজিয়া রাখে। অবশ্য ইহাতে বিপরীত ফলই ঘটিয়া থাকে, কিন্তু উটপক্ষী প্রথমে মনে করে যে বড়ই নিরাপদ হইয়াছে।
একপ্রকারের ফড়িং আছে, তাহারা পাখা দুটি একত্র করিলে দেখিতে ঠিক গাছের পাতার মতন হয়। তখন আর তাহাদিগকে সহজে চিনিতে পারা যায় না। এইরূপে তাহারা ফড়িংখাদক পাখিদের হাত হইতে রক্ষা পায়।
শম্বুকজাতীয় অনেকপ্রকার জলজীব আছে, তাহার যখন দেখে যে শত্রুর হাত হইতে বাঁচিবার আর অন্য উপায় নাই, তখন একপ্রকার কালো জিনিস পেটের ভিতর হইতে বাহির করিয়া দেয়। ইহাতে জলটা অনেক দূর পর্যন্ত এত কালো হইয়া যায় যে, আর তাহার ভিতর দিয়া কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না। এই অবসরে সে পলাইয়া কোনো নিরাপদ স্থানে যায়।
কচ্ছপগুলির কাণ্ড-কারখানা সকলেই দেখিয়াছ, সুতরাং তাহার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলার আবশ্যক দেখি না। একপ্রকারের কচ্ছপ আবার শুধু গলাটি আর হাত-পাগুলি ভিতরে লইয়া গিয়াই সন্তুষ্ট হয় না। তাহার শরীরের আবরণটা কবাটের মতো হইয়া সেই হাত-পাগুলিকে ঢাকিয়া রাখে।
বনলতা সেন,নগ্ন নির্জন হাত,জীবনানন্দ দাশ ,কলকাতা,২০১৭ খ্রিস্টাব্দ (১৪২৪ বঙ্গাব্দ),পৃষ্ঠা ২০
•
আপনি এসে ধরলে হাত
এবার আমায় কে আর হারায়
দিনকে দেব করেই রাত
বিষাদ ভয়ের জন্ম যে হায়!
বিনাশ লয়ের কারখানায়
বিশাল মরুর ঈশান কোণে
তাহার রূপের রং ঘনায়।
কবর ভেঙ্গে আটখানা,
ধু ধু মরুর নিরস তরুর
বিরস-ভরা মাটখানা॥
সরলা বসু রায়, চিত্ত-প্রদীপ,ধরলে যখন আমার হা্ত,১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ),পৃষ্ঠা ২৯
ও পাড়ার নন্দ গোঁসাই, আমাদের নন্দ খুড়ো, স্বভাবেতে সরল সোজা অমায়িক শান্ত বুড়ো। ছিল না তার অসুখবিসুখ, ছিল সে যে মনের সুখে, দেখা যেত সদাই তারে হুঁকোহাতে হাস্যমুখে।হঠাৎ কি তার খেয়াল হল, চল্ল সে তার হাত দেখাতে— ফিরে এল শুকনো সরু, ঠকাঠক্ কাঁপছে দাঁতে! শুধালে সে কয় না কথা, আকাশেতে রয় সে চেয়ে, মাঝে মাঝে শিউরে ওঠে, পড়ে জল চক্ষু বেয়ে। শুনে লোকে দৌড়ে এল, ছুটে এলেন বদ্যিমশাই, সবাই বলে, ‘কাঁদছ কেন? কি হয়েছে নন্দ গোঁসাই?
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড),আবোল তাবোল,পৃষ্ঠা ৫৫
আমাদের দুটো করে হাত আছে, বানরের আছে চারটি। কিন্তু আমাদের কেউ হাতি বলে না, হাতি বলে, যার একটাও হাত নেই, তাকে। আমার অনেকগুলো দাঁত পড়ে গেছে, তবু যা আছে, হাতির ততগুলি নাই। কিন্তু আমি দন্তী হতে পারলাম না, দন্তী হল হাতি।
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র,বিবিধ প্রবন্্পৃষ্ঠা ৮৭৮
•
পৃথিবীর বাধা— এই দেহের ব্যাঘাতে
হৃদয়ে বেদনা জমে; স্বপনের হাতে
আমি তাই
আমারে তুলিয়া দিতে চাই।
যেই সব ছায়া এসে পড়ে
দিনের রাতের ঢেউয়ে— তাহাদের তরে
জেগে আছে আমার জীবন;
সব ছেড়ে আমাদের মন
ধরা দিতো যদি এই স্বপনের হাতে
পৃথিবীর রাত আর দিনের আঘাতে
বেদনা পেত না তবে কেউ আর—
থাকিত না হৃদয়ের জরা—
সবাই স্বপ্নের হাতে দিতো যদি ধরা।
জীবনানন্দ দাশ, জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা,স্বপ্নের হাতে, পৃষ্ঠা ৪৪
•
আসিল দিয়াড়ি হাতে রাজার ঝিয়ারি
খিড়কির আঙিনায়, নামটি পিয়ারী।
আমি শুধালেম তারে, এসেছ কী লাগি।
সে কহিল চুপে চুপে, কিছু নাহি মাগি।
আমি চাই ভালো ক’রে চিনে রাখে মোরে,
আমার এ-আলোটিতে মন লহ ভ’রে।
আমি যে তোমার দ্বারে করি আসা-যাওয়া,
তাই হেথা বকুলের বনে দেয় হাওয়া।
এক হাতে ওর কৃপাণ আছে, আর-এক হাতে হার।
ও যে ভেঙেছে তোর দ্বার॥
আসে নি ও ভিক্ষা নিতে, না না না— লড়াই করে নেবে জিতে
পরানটি তোমার॥
মরণেরই পথ দিয়ে ওই আসছে জীবন-মাঝে,
ও যে আসছে বীরের সাজে।
আধেক নিয়ে ফিরবে না রে, না না না— যা আছে সব একেবারে
করবে অধিকার॥
কিন্তু, এই সংকলন উপলক্ষ্যে একটি কথা বলবার সুযোগ পাব প্রত্যাশা করে এ কাজে হাত দিয়েছি। যারা আমার কবিতা প্রকাশ করেন অনেক দিন থেকে তাঁদের সম্বন্ধে এই অনুভব করছি যে, আমার অল্প বয়সের যেসকল রচনা স্খলিত পদে চলতে আরম্ভ করেছে মাত্র, যারা ঠিক কবিতার সীমার মধ্যে এসে পৌঁছয় নি, আমার গ্রন্থাবলীতে তাদের স্থান দেওয়া আমার প্রতি অবিচার।
সঞ্চয়িতা,রবীন্দ্রনাথ ঠাকু্র, ভূমিকা
•
প্রভু আজি তোমার দক্ষিণ হাত
রেখোনা ঢাকি!
এসেছি তোমারে, হে নাথ,
পরাতে রাখী।
যদি বাঁধি তোমার হাতে
পড়ব বাঁধা সবার সাথে,
যেখানে যে আছে, কেহই
রবে না বাকি!
আজ টেলিফোন বেজে উঠেছে আবার, বার-বার শুধু
নড়ে উঠছে রুমালসুদ্ধ তোমার ঐ বিদায়ী হাত
কম্বলের গভীরতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে দুটি
আলিঙ্গনাবদ্ধ নরনারী, তুমি
ঘনঘন রুমাল ওড়াচ্ছ, ঘনঘন টেলিফোন বেজে
উঠছে, শালিকের পালক থেকে
খসে পড়ছে রহস্যময় মেঘের প্রতিভা, তোমার
ঘরের প্রতিটি বারান্দায় ছিল
সপ্রতিভ ফেন্সিং, ঐখানে অপরাজিতা ফুল দিয়ে
তুমি তৈরি করেছিলে তোমার কর্ণাভরণ, সেই থেকে
রক্তের ভেতরে টের পাচ্ছি।
অধিদৈব ছায়া, কে যেন ফিসফিস করে বলছে:
তপোধীর ভট্টাচার্য, কবিতাসংগ্রহ,তুমি সেই পীড়িত কুসুম,তোমার ঐ বিদায়ী হাত,পৃষ্ঠা ২৬
•
কার হাতে যে ধরা দেব, প্রাণ,
তাই ভাবতে বেলা অবসান।
ডান দিকেতে তাকাই যখন বাঁয়ের লাগি কাঁদে রে মন—
বাঁয়ের লাগি ফিরলে তখন দক্ষিণেতে পড়ে টান।
“... সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”
“... যে রূপসীদের আমি আশিরিয়ায়, মিশরে, বিদিশায় মরে যেতে দেখেছি
কাল তারা অতিদূর আকাশের সীমানার কুয়াশায় কুয়াশায়
দীর্ঘ বর্শা হাতে ধরে
কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন —”
কার হাতে এই মালা তোমার পাঠালে
আজ ফাগুন-দিনের সকালে।
তার বর্ণে তোমার নামের রেখা গন্ধে তোমার ছন্দ লেখা,
সেই মালাটি বেঁধেছি মোর কপালে
আজ ফাগুন-দিনের সকালে।
গানটি তোমার চলে এল আকাশে
আজ ফাগুন-দিনের বাতাসে।
ওগো, আমার নামটি তোমার সুরে কেমন করে দিলে জুড়ে
কলকাতার রাস্তায় বিষম এক খেলা। বন্দুকের সঙ্গে শুধু হাতের লড়াই। আশ্চর্য! এমন এক সাংঘাতিক কাণ্ড তার মধ্যেও মজা পেয়েছে সুকান্ত। গোটা বইতে এমনি সব মিঠে রসে ভেজানো কড়া পাকের ছড়া। সুকান্তই নিজে তাই তার বইয়ের নাম দিয়েছিল 'মিঠেকড়া'।
মিঠেকড়া,ভূমিকা,সুকান্ত ভট্টাচার্য
•
আবার আমার হাতে বীণা দাও তুলি,
আবার আসুক ফিরে হারা গানগুলি।
সহসা কঠিন শীতে মানসের জলে
পদ্মবন মরে যায়, হংস দলে দলে
সারি বেঁধে উড়ে যায় সুদূর দক্ষিণে
জনহীন কাশফুল্ল নদীর পুলিনে;
আবার বসন্তে তারা ফিরে আসে যথা
বহি লয়ে আনন্দের কলমুখরতা—
গণনা কেহ না করে, রাত্রি আর দিন
আসে যায়, ফুটে ঝরে যুগযুগান্তরা।
বিলম্ব নাহিকো তব, নাহি তব ত্বরা—
প্রতীক্ষা করিতে জান। শত বর্ষ ধ’রে
একটি পুষ্পের কলি ফুটাবার তরে
চলে তব ধীর আয়োজন। কাল নাই
আমাদের হাতে; কাড়াকাড়ি করে তাই
সবে মিলে, দেরি কারো নাহি সহে কভু।
পৃথিবীর বাধা— এই দেহের ব্যাঘাতে
হৃদয়ে বেদনা জমে; স্বপনের হাতে
আমি তাই
আমারে তুলিয়া দিতে চাই।
যেই সব ছায়া এসে পড়ে
দিনের রাতের ঢেউয়ে— তাহাদের তরে
জেগে আছে আমার জীবন;
সব ছেড়ে আমাদের মন
ধরা দিতো যদি এই স্বপনের হাতে
পৃথিবীর রাত আর দিনের আঘাতে
বেদনা পেত না তবে কেউ আর—
থাকিত না হৃদয়ের জরা—
সবাই স্বপ্নের হাতে দিতো যদি ধরা।
একবার দেখে যাও ডাক্তারি কেরামৎ—
কাটা ছেঁড়া ভাঙা চেরা চট্পট্ মেরামৎ।
কয়েছেন গুরু মোর, “শোন শোন বৎস,
কাগজের রোগী কেটে আগে কর মক্স।”
উৎসাহে কি না হয়? কি না হয় চেষ্টায়?
অভ্যাসে চট্পট্ হাত পাকে শেষটায়।
খেটে খুটে জল হ’ল শরীরের রক্ত—
শিখে দেখি বিদ্যেটা নয় কিছু শক্ত।
কাটা ছেঁড়া ঠুক্ঠাক্, কত দেখ যন্ত্র,
ভেঙে চুরে জুড়ে দেই তারও জানি মন্ত্র।
চোখ বুজে চট্পট্ বড়-বড় মূর্তি,
যত কাটি ঘ্যাঁস্ ঘ্যাঁস্ তত বাড়ে ফূর্তি।
ঠ্যাং-কাটা গলা-কাটা কত কাটা হস্ত,
শিরিষের আঠা দিয়ে জুড়ে দেয় চোস্ত।
এইবারে বলি তাই, রোগী চাই জ্যান্ত—
ওরে ভোলা, গোটাছয় রোগী ধরে আন্ তো!
সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড),আবোল তাবোল,হাতুড়ে,পৃষ্ঠা ৩৫
•
ডান হাত হতে বাম হাতে লও,
বাম হাত হতে ডানে।
নিজখন তুমি নিজেই হরিয়া
কী যে কর কেবা জানে!
কোথা বসে আছ একেলা!
সব রবিশশী কুড়ায়ে লইয়া
তালে তালে কর এ খেলা।
খুলে দাও ক্ষণতরে,
ঢাকা দাও ক্ষণপরে-
মোরা কেঁদে ভাবি, আমারি কী ধন
কে লইল বুঝি হরে।
দেওয়া-নেওয়া তব সকলি সমান,
সে কথাটি কেবা জানে!
ডান হাত হতে বাম হাতে লও,
বাম হাত হতে ডানে।