শাইখ সিরাজ (জন্ম: ৭ অক্টোবর ১৯৫৪) একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক, কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। শাইখ সিরাজ কৃষি সাংবাদিকতাসহ নানামুখী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনে জাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছেন। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে জনপ্রিয় কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান মাটি ও মানুষ ও নিজস্ব মালিকানাধীন বেসরকারি টিভি চ্যানেল চ্যানেল আইতে হৃদয়ে মাটি ও মানুষ নামক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন। কৃষিসাংবাদিকতায় অবদান রাখার জন্য ২০১৮ সালে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।
...আমি আরো চেয়েছিলাম- কৃষি শুধু ধান আর পাট নয়; পুকুরে মাছ চাষ, সবজি চাষ, হাঁস-মুরগি পালন- এসব কিছুই আসতে পারে কৃষির আওতায়। আর কৃষক মানে শুধু গ্রামের কৃষক নন, একজন শিক্ষিত শহুরে তরুণ, একজন গৃহিণীও হতে পারেন কৃষক।
মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠান সম্পর্কে, ২ মার্চ ২০১৪-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে, উদ্ধৃত: রাইজিং বিডি
খাদ্য নিরাপত্তা ইস্যুটা আমাদের দেশের জন্য অনেক বড় বিষয়। আমি মাঠে কাজ করি। আমি দেখি কিন্তু অর্থনীতির সঙ্গে আমার অঙ্ক মেলে না। আমি তো দেখি আমাদের এতো ফল-ফসল উৎপাদন হয়। আমাদের কোন ফসলের ঘাটতি নেই। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে রকমারি ফসলের যে বৈচিত্র্য এসেছে, এটা অভাবনীয়। তাহলে সমস্যাটা কোন জায়গায়। আমার কাছে বারবারই মনে হয়, আমরা পিছিয়ে আছি বিশেষ দু’টি বিষয়ে। আমরা প্রিজার্ভ করতে পারি না। আমাদের প্রিজার্ভেশনের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে, আরেকটি হচ্ছে ডিসট্রিবিউশন। ডিসট্রিবিউশনে অনেক ঝামেলা আছে আমাদের। এই দু’টি বিষয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া খুবই দরকার।
টেলিভিশন একটা জৌলুসের জায়গা। টেলিভিশন চকচক করতে হবে সবসময়। কিন্তু আমার কাছে মনে হলো যে মানুষগুলোর পেটে খাবার নেই, যার গেঞ্জিটা ছেঁড়া, সে মানুষটির কাছে যদি আমি প্রতিদিন একেক পোশাকে যাই তাহলে কি আমাকে আপন করে নেবে? সে কোনোদিনই আমাকে আপন ভাববে না। তাই ভাবলাম এমন একটি শার্ট পরা দরকার, যেটার দেখলেই তার কাছে আপন মনে হবে। সবুজ একজন কৃষকের আপন রঙ। যেহেতু আউটডোর অনুষ্ঠান, তাই ফরশাল শার্ট মানাবে না। তাই পাইলট শার্ট পরা শুরু করলাম। তাই সবাই বলেন, ‘ভাই, আপনার কি একটাই শার্ট?’ প্রথম দিকে কৃষককে বোঝানোর জন্য আমি বেশি কথা বলতাম, এখন কিন্তু তাদেরকেই স্ক্রিনে আসতে দিই বেশি। আমি থাকি নেপথ্যে। স্ক্রিনে আমার শার্টের শোল্ডার দেখলেও অনেকে বুঝে ফেলেন যে, এটা শাইখ সিরাজ।
সবসময় একই রঙের শার্ট পড়া নিয়ে, ২৭ নভেম্বর ২০১৮, উদ্ধৃত:ইউটিউব
ব্যবসায়ীরা মনে করেন, ব্যবসা মানে পোশাকশিল্প। যদি ব্যবসায়ীদের উদ্বুদ্ধ করা যেত, তাহলেই কৃষি সমস্যার সমাধান হতো। ব্যবসায়ীরা চান সঠিক পলিসি। আর সরকারের উচিত এই পলিসিটার নীতি নির্ধারণ করা।
২ মার্চ ২০১৪-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে, উদ্ধৃত: রাইজিং বিডি
যেটা সমস্যা সেটা হচ্ছে উৎপাদিত ফসল বা শাক-সবজির সংরক্ষণের বিষয়টি খুবই দুর্বল। উৎপাদিত শাক-সবজি যথাযথভাবে আমরা সংরক্ষণ করতে পারি না। এই অবকাঠামোটা এখনও আমাদের দেশে তৈরি হয় নি।
বলা চলে শতভাগ ভারসাম্যহীনতা বিরাজ করছে। কিন্তু কিছুই তো করার নেই। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের গাইড লাইন দেয়া হচ্ছে না। যেমন ধরুন এবার টমেটোর প্রয়োজন ৮০ লক্ষ টন। এরচেয়ে বেশি উৎপাদন করা যাবে না। কিন্তু একজন কৃষকের নিজস্ব অধিকার আছে সে টমোটোর চাষ করবে। তাকে তো নিষেধ করা যাবে না। আর যখনই কোনো সবজি বা ফসলের সরবরাহ বেড়ে যায় তখনই বাজারে তার দাম কমে যায়। তো এ বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে হয়তো আরো অনেক সময় লাগবে এ বিষয়ে একটি সন্তোষজনক জায়গায় পৌঁছতে। তবে আমি মনে করি বাংলাদেশে কৃষির একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। এদিকে সরকারের আরো বেশি নজর দেয়া দরকার। সরকার যদি বিষয়টি দেখভাল করে তাহলে শৃঙ্খলা আসবে অন্যথায় এভাবেই চলতে থাকবে- কখনও ফলন বেশি হবে কৃষক মূল্য পাবে না, পচে যাবে এবং নষ্ট হয়ে যাবে।
গণমাধ্যম শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়। এর মাধ্যমে ক্ষুধা-দারিদ্র্য যেমন দূর করা যায়, একইভাবে সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা যায়। গণমাধ্যমের এই শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।
এখন কৃষক অনেক সচেতন। বিশেষ করে বীজের কারণেই কৃষক অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। কারণ সে মৌসুমের শুরুতে সবজি বাজারজাত করার জন্য একই ফসলের খেত থেকে কয়েকবার উৎপাদন করছে। আগে দেখা যেত কৃষক মাত্র দুটো ফসল তুলছে । এখন তিনটে ফসল তো দেশের সব জায়গায় উৎপাদন করছে কৃষকরা । আবার কোনো কোনো জেলায় ৪ টা ফসলও তারা উৎপাদন করছে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তি তাকে সহযোগিতা করেছে একইসাথে নিজস্ব বুদ্ধিমত্তাও কাজে লাগিয়েছে। ফলে সে লাভবান হচ্ছে।
যেখানে বিদেশি কোনো পণ্যের মূল্যের চেয়ে দেশীয় একই পণ্যের মূল্য কম হতে পারে। অথচ আমার দেশে ওই পণ্যের মূল্য বিদেশিটার চেয়ে বেশি। এটা পলিসি হতে পারে না। সাধারণ মানুষ তো কম দামেরটাই কিনবেন। পলিসি এমন হতে হবে, যেন দেশি পণ্যটাই কেনেন দেশের মানুষ।
২ মার্চ ২০১৪-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে, উদ্ধৃত: রাইজিং বিডি
কৃষকের চোখ-কান খোলা। আগে যে জমিতে ধান চাষ করতেন এখন সেই জমিতেই তারা লাউ চাষ করেন, শাকসবজি চাষ করেন। এখন প্রশ্ন হলো- কেন করছেন? কারণ, কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য পান না। এজন্য যেটাতে লাভ হচ্ছে, সেই ফসলটা উৎপাদন করছেন কৃষক।
২ মার্চ ২০১৪-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে, উদ্ধৃত: রাইজিং বিডি
রাষ্ট্র কৃষকের ধানের সঠিক মূল্য নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই কৃষক অন্য ফসল আবাদ করছেন।
২ মার্চ ২০১৪-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে, উদ্ধৃত: রাইজিং বিডি
টেলিভিশন মাধ্যমে পৃথিবীতে বহু খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। তারা কেউ উপস্থাপক, কেউ সংবাদ বিশ্লেষক, কেউ সংবাদ পাঠক বা কেউ অন্য কোনো ক্ষেত্রে নিজেদের বিশেষ পরিচয়-বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। সেভাবে পরিচিতি পেয়েছেন। শাইখ সিরাজের বিশেষ বৈশিষ্ট্য তাঁর ট্রেডমার্ক কৃষিবিষয়ক হলেও, তিনি দশভুজা।
রাশেদ খান মেনন, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩-এ প্রকাশিত নিবন্ধে, উদ্ধৃত: দৈনিক সমকাল
একজন মা তাঁর গর্ভে সন্তান ধারণের সময় সেই সন্তানটি কেমন হবে, তা যেমন আগেই বোঝার কথা নয়, ঠিক তেমনি দুর্লভ প্রাণী এই শাইখ সিরাজ সম্পর্কেও কেউই তা জানেন না । বহুরূপী এই প্রাণিটির চরিত্র শান্তিপ্রিয় কোন মানুষের সাথেই মেলে না । অথচ সর্বস্তরের মানুষ জানেন, কতোইনা গুণাবলীর আধিকারী এই প্রাণিটি। যা সম্পূর্ণ মিথ্যে, কৃত্রিম,নাটকীয় এবং ভণ্ডামীতে ভরপুর।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিবর্তনের একটি বিশেষ মুহূর্তে তাঁর আবির্ভাব। দেশজ আয়ে কৃষি খাতের অবদান যখন কমে আসছে, এমন একটি সময়ে এই খাতের অপার সম্ভাবনাকে তিনি জাতির সামনে নবরূপে উন্মোচন করেছেন। কৃষির বহুমুখীকরণ, অপ্রচলিত পণ্যকে জনপ্রিয়করণ, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, বৈশ্বিক অভিজ্ঞতাকে দেশে আত্তীকরণ, নগরজীবনের সঙ্গে প্রকৃতির সহযোগ সাধনসহ আরও বহু বিষয়ে জ্ঞানের সম্প্রসারণ ও সামাজিক সচেতনতার জন্য তিনি পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত হবেন।