জাফরুল্লাহ চৌধুরী (২৭ ডিসেম্বর ১৯৪১-১১ এপ্রিল ২০২৩) একজন বাংলাদেশি চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য সক্রিয়তাবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং মুক্তিযোদ্ধা। তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামক স্বাস্থ্য বিষয়ক এনজিওর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮২ সালে প্রবর্তিত বাংলাদেশের ‘জাতীয় ঔষধ নীতি’ ঘোষণার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
…আমি সব রকম লাক্সারি করেছি। আমি যখন বিলেতে (লন্ডন) ছিলাম, আমার প্রাইভেট পাইলটসের লাইসেন্স ছিল। প্লেন চালানোর লাইসেন্স ছিল আমার। আমার লাইসেন্স ছিল।… প্রিন্স চার্লসের স্যুট বানাত যে দর্জি, সে দর্জি আমার স্যুটও বানাত। আমি কখনও বানানো স্যুট পরি নাই। সে দরজায় এসেছে, আমার মেজার করেছে। সে নিয়ে এসে… লন্ডনের খুবই দামি এলাকা, সেই দর্জি এসে আমার মাপজোক নিয়ে গেছে…। এসব এখন যখন আমি দেখি, এটা একটা ছেলেমানুষি ছিল। হোয়াট অ্যা ওয়েস্ট অফ মানি! এই টাকা দিয়ে আমি কতজনের উপকার করতে পারতাম!
রাস্তায় পোস্টার থাকুক আর না থাকুক, জনগণের মার্কাতেই জনগণ ভোট দেবে। আর সেই মার্কাটা হচ্ছে ধানের শীষ। ধানের শীষ এখন আর বিএনপির মার্কা নয়, এটা জাতির মার্কা, ধানের শীষ গণতন্ত্রের মার্কা। মুক্তিযুদ্ধকালীন যেমন জয় বাংলা ছিল আমাদের স্লোগান, তেমনি ধানের শীষ জাতির আকাক্সক্ষার প্রতীক, পরিবর্তনের মার্কায় পরিণত হয়েছে।
২৩ ডিসেম্বর ২০১৮-এর জাতীয় প্রেস ক্লাবের একটি আলোচনা সভায়, উদ্ধৃত: যুগান্তর
মানুষ যে একটা মানুষকে এত ভালোবাসতে পারে, বুঝতে পারিনি। যুদ্ধের পরে এই দেখলাম, একাত্তরের যুদ্ধে পেয়েছিলাম ভালোবাসা, আর এখন পাচ্ছি।
২৫ জুন ২০২০-এ গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের গেরিলা কমান্ডার মেজর এ টি এম হায়দার বীর উত্তম মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায়, উদ্ধৃত: বণিক বার্তা
পৃথিবীতে দুটি জালিম সরকার আছে। একটি হলো নেতানিয়াহুর ইসরায়েল, অন্যটি নরেন্দ্র মোদির ভারত। তাই যখন নরেন্দ্র মোদি এসেছে তখন ছাত্ররা প্রতিবাদ করে ন্যায্য কাজ করেছে। আটক ৫৪ জনসহ ছাত্ররাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তারাই উন্নত ভবিষ্যৎ দেখাতে পারে।
৩১ মে ২০২১-এ শাহবাগে একটি সমাবেশে, উদ্ধৃত: জাগো নিউজ
পরিবর্তন। আমাদের পরিবর্তন দরকার, যেন সবাই ভালো থাকি। জনকল্যাণকর বাংলাদেশ, যেটি পৃথিবীর আদর্শ হবে। আমরা পৃথিবীর সবার কাছে আদর্শ হবো। এখন তো পুঁজিপতিরা আমাদের পিঠ থাপড়ায়। আমাদের ভুল কাজে প্রবাহিত করে। আমাদের তা পরিবর্তন করতে হবে। তরুণরা সে পরিবর্তন আনবে।
আমরা যারা যুদ্ধ করেছি একবার, একাত্তরে আট-নয় মাস; কিন্তু বীরাঙ্গনা যারা আছেন তারা যুদ্ধ করেছেন বারবার। একাত্তরে যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধের পর যুদ্ধ করেছেন, এখনো যুদ্ধ করে যাচ্ছেন।
২৮ ডিসেম্বর ২০২১-এ ধানমন্ডিতে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে, উদ্ধৃত: যুগান্তর
আপনারা অনেকেই জানেন না যে ইয়াবা একটা ওষুধ। আপনি যদি ইয়াবা পেতে চান তবে অবশ্যই ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন লাগবে। প্রেসক্রিপশন নিয়ে ইয়াবা আনা হলে এর দাম ৩ থেকে ৫ টাকা হতো। দেশে রাজশাহীতে এক সময় গাঁজা চাষ হতো। হাঁপানির শেষ চিকিৎসা গাঁজা দিয়ে হয়। এ ছাড়া মানুষ সবচেয়ে বেশি আসক্ত হচ্ছে সিগারেটে। মাদকাশক্তির শুরুই হয় সিগারেট দিয়ে। অথচ এটা নিয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই।
২৭ জানুয়ারি ২০২২-এ সুনামগঞ্জে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে, উদ্ধৃত: সাম্প্রতিক দেশকাল
পৃথিবীর কোনো বিশেষজ্ঞ ধারণা করতে পারেননি শ্রীলঙ্কার জনগণ যে তুষের আগুনে জ্বলছিল, তা বিস্ফোরণে পরিণত হবে। শ্রীলঙ্কার জাতীয় বীর, আজ জাতীয় ভিলেনে পরিণত হয়েছে।
১৩ মে ২০২২-এ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত এক সমাবেশে, উদ্ধৃত: এনটিভি
বাংলাদেশের দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ স্বাস্থ্যব্যবস্থার নাজুক পরিস্থিতি। এখানে ওষুধের দাম বৃদ্ধি ও চিকিৎসকের অবহেলায় মানুষ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি না হলে বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমবে না।
৫ জুন ২০২২-এ যশোর জেলায় গণস্বাস্থ্য লেবুতলা হাসপাতালের জন্য নির্ধারিত জায়গা পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে, উদ্ধৃত: প্রথম আলো
পদ্মার পাড়ে ১০ লাখ লোক জমায়েত করে অর্থ অপচয় না করে সিলেট অঞ্চলের বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে। এতে ওই অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয় রোধ করা যাবে।
২২ জুন ২০২২-এ একটি আলোচনা সভায় পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে, উদ্ধৃত: ইনকিলাব
ইতিহাসে অনেক কিছু দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। এবার পদ্মা সেতুর উদ্বোধন দেখলাম।
২৫ জুন ২০২২-এ পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে মাওয়া প্রান্তে আয়োজিত সুধী সমাবেশে অংশ নেওয়ার সময় সাংবাদিকদের নিকট, উদ্ধৃত: এনটিভি
আজ গণতন্ত্রের জন্য আমাদের কথা বলতে হবে। সাংবাদিকদের লিখতে হবে। যতই অসুবিধা হোক, যতই সাংবাদিকদের ওপর অত্যাচার হোক, লিখে যেতে হবে।
৬ জুলাই ২০২২-এ ধানমন্ডিতে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে এক অনুষ্ঠানে, উদ্ধৃত: প্রথম আলো
কোনো সজ্জন মুসলমান, প্রকৃত মুসলমান কারো বাড়িতে আগুন দিতে পারে না, ইসলামিক নাম থাকলেই মুসলমান হওয়া যায় না। মুসলমান যদি সজ্জন না হয়, তবে সে মানুষেরও অধম।
১৭ জুলাই ২০২২-এ নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়ার সাহাপাড়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি, দোকান ও মন্দির পরিদর্শনকালে, উদ্ধৃত: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমরা কেঁদেছিলাম; আওয়ামী লীগ খুশি হয়েছিল। আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছিলেন, 'জালেমের হাত থেকে দেশ রক্ষা পেয়েছে।' তারাই তো দেশকে উল্টো পথে নিয়ে গিয়েছে।
১৭ আগস্ট ২০২২-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে, উদ্ধৃত: সমকাল
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির মতো লড়াকু দল আছে বলেই এখনও আশা আছে, ভরসা আছে। তাদের জানবাজি লড়াইয়ের মাধ্যমে দুঃসময়কে আমরা অতিক্রম করব। সমাজতন্ত্র ছাড়া দেশ ও জনগণের মুক্তি নেই। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এ সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবে।
৬ জানুয়ারি ২০২৩ সালে বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির দশম কংগ্রেসের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে, উদ্ধৃত: সমকাল
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজনও বিজ্ঞান পড়েনি। মন্ত্রীও বিজ্ঞান বোঝেন না, সচিবও কোনো দিন বিজ্ঞান পড়েছেন কিনা জানি না। এজন্য দ্বিগুণ দামে ভ্যাকসিন কেনায় তাদের উৎসাহ। প্লেনের ভাড়া ছাড়াই প্রায় ১৪ ডলার দিয়ে তারা ভ্যাকসিন ক্রয় করেছেন।
আর্জেস গ্রেনেড কোত্থেকে আসছে? দেখেন আর্জেস গ্রেনেড, আমি জানিনা সময়টা মিলে কিনা। আমাদের বর্তমান চীফ অব আর্মি আজিজ সাহেব চট্টগ্রামের কমান্ডেন্ট ছিলেন, জিওসি ছিলেন, তাঁর ওখান থেকে একটা ব্যাপক সংখ্যক অ্যাঁ..এ.. সমরাস্ত্র গোলাগুলি চুরি হয়ে গেছিল, হারিয়ে গেছিল, বিক্রি হয়ে গেছিল। এবং এজন্য একটা কোর্ট মার্শালও হয়েছিল। আজিজের নামে, জেনারেল আজিজের নামে কোর্ট মার্শালও হয়েছিল।
৯ অক্টোবর ২০১৮-এ আয়োজিত একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে, উদ্ধৃত: বিবিসি বাংলা
অসত্য বক্তব্য, যার জন্য তিনি পরবর্তীতে দুঃখ প্রকাশ করেন।
একটি কাল্পনিক কাহিনিকে ভিত্তি করে ভারত রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছে। মহাভারত, রামায়ণ দুটোর মধ্যেই প্ররোচনা ও মিথ্যাচারের গল্পকাহিনি রয়েছে। তাদের গল্পকাহিনির ওপর ভিত্তি করেই ৫০০ বছরের পুরনো বাবরি মসজিদ ভেঙে সেখানে আজগুবি রাম মন্দির নির্মাণ করেছে ভারত। এটি ভারত জাতির জন্য একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। আমরা বাংলাদেশের মানুষ এর বিরুদ্ধে একটি কথাও বলিনি।
৯ আগস্ট ২০২০-এ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশের বক্তব্যে, উদ্ধৃত: কালের কণ্ঠ
ধর্মীয় উস্কানিমূলক আখ্যা দিয়ে এই বক্তব্যের জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
আপনি আব্দুল কাদের মোল্লাকে ‘কসাই’ কাদের নাম দিয়ে ফাঁসি দিয়েছেন। তিনি তো ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। উনি তো ছাত্রশিবিরও করেননি।
উনাকে তো আমরা স্বৈরাচার এরশাদের দোসর হিসেবে জানতাম। স্বৈরাচারের দোসর জানতাম। তিনি এখন বক্তব্য রাখেন, গণতন্ত্রের কথা বলেন। এরশাদের সাথে ওষুধ নীতি নিয়ে কি দহরম মহরম করেছেন তা মানুষের জানা আছে। আজকে জাতির বিবেক হয়েছেন, কে কি করবে না করবে কার কি করা উচিত সেটার মাত্রা ছাড়িয়ে ছবক দিচ্ছন উদ্দেশ্যে প্রণোদিতভাবে।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন ঠিকই, কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জাফরুল্লাহ চৌধুরী জাতির সামনে যে মিথ্যাচার করছেন তা দুঃখজনক। আমি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আমি মনে করছি জাফরুল্লাহ চৌধুরী উন্মাদের মত প্রলাপ করছেন।
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এর সাধারণ সম্পাদক দীপক শীল
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে আমার রাজনৈতিক দর্শনের মিল নেই। কিন্তু চেতনার মিল আছে। আমি উনাকে বঙ্গবন্ধুর মতোই ভালোবাসি। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দেশ মাতৃকার টানে সেদিন নিরাপদ জীবন রেখে অনিশ্চিত জীবনকে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি তখন ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে না তুললে, আহত মুক্তিযোদ্ধদের চিকিৎসা না দিলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা হয়তো আরও বেশি হতো। পক্ষাঘাতগ্রস্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেত।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তির যোদ্ধা। সব সময় সাহসী বিবেকের প্রতিধ্বনি করতেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ একটি সাহসী কণ্ঠ থেকে বঞ্চিত হবে। আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। তিনি জীবন থেকেও কর্মকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কর্মের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে বেঁচে থাকবেন।
অনেক মানুষ তাকে নিয়ে অনেক কথা বলেন। কিন্তু, তাদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে, পারলে একজন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী হয়ে দেখান, তার মতো কাজ করে দেখান। পারলে তার মতো করে নিঃস্বার্থভাবে নিজের জীবন দেশের মানুষের জন্য উৎসর্গ করে দেখান।
যে কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমাকে শুধু নয়, অনেককেই ফোন করে সাহস দিতেন, অনুপ্রাণিত করতেন। আমাদের যদি কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকতো তবুও তার কারণেই আমাদের যেতে হতো।
জাফরুল্লাহ মনে করতেন, আত্মবিশ্বাসী নারীরা লিঙ্গবাদের বেড়াজালের বাইরে মুক্ত পরিবেশে বড় কাজ করতে পারে। একজন বাস্তববাদী হিসেবে তিনি অনুধাবন করেছিলেন, স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্যারামেডিকরা সাইকেল চালালে তাঁরা আরও দ্রুততার সঙ্গে সেবাগ্রহীতার কাছে পৌঁছাতে পারবেন। ধর্মীয় রক্ষণশীলদের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বাংলাদেশে নারীদের সাইকেল চালানোর ব্যাপারে অগ্রগামী। ১৯৭৭ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এই আত্মবিশ্বাসী নারীরা সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ঢাকা পর্যন্ত ২৫ মাইল সাইকেল চালিয়েছিলেন।