Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ইসলামি জ্যোতির্বিদ্যা গঠিত হয় ইসলামি বিশ্বে সৃষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত অগ্রগতি নিয়ে, বিশেষত ইসলামি স্বর্ণযুগে (৯-১৩শ শতাব্দীতে),[1] এবং বেশিরভাগই লেখা হয় আরবি ভাষায়। এসব অগ্রগতির বেশিরভাগ সঙ্ঘটিত হয় মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, আল-আন্ডালুস, এবং উত্তর আফ্রিকায়, এবং পরবর্তীতে দূর প্রাচ্য এবং ভারতে। এর বহিরাগত দ্রব্য এবং সেসব দ্রব্যের বিসদৃশ উপাদানের সংমিশ্রনে ইসলামি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটি বিজ্ঞান সৃষ্টি করে, যা ঘনিষ্ঠভাবে অন্যান্য ইসলামি বিজ্ঞানের জন্মের সাথে সমান্তরাল। এসবের অন্তর্ভুক্ত হয় বিশেষত গ্রিক, সাসানীয়, এবং ভারতীয় রচনাসমূহ, যেগুলো অনুবাদ হয়েছিল এবং ভিত্তিস্বরূপ হয়েছিল।[2]
মধ্যযুগের গোড়ার দিকে জ্ঞানহ্রাসের পর ইসলামি জ্যোতির্বিজ্ঞান বাইজেন্টাইন[3] এবং ইউরোপীয়[4] জ্যোতির্বিজ্ঞানকে পুনর্জীবিত করতে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে বারো শতকে আরবি রচনাগুলো ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করার মাধ্যমে। ইসলামি জ্যোতির্বিজ্ঞানের চীনা জ্যোতির্বিজ্ঞান[5] এবং মালিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপরও প্রভাব ছিল।[6][7]
আকাশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণের তারকা , যেমন আল্ডেবারান, অল্টেয়ার এবং ডিনেব, জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষা যেমন এলিডাড, আজিমুথ এবং নাদির, এখনও তাদের আরবি নামে উল্লেখিত হয়।[8][9] বর্তমানে ইসলামিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাহিত্যের এক বিশাল সংকলন বিদ্যমান আছে, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রায় ১০,০০০ সংখ্যার পাণ্ডুলিপি, যাদের বেশির ভাগই পঠিত বা তালিকাভুক্ত হয়নি। তারপরও, জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইসলামি সক্রিয়তার এক ন্যায্য নির্ভুল চিত্র পুনর্নির্মিত করা যায়।[10]
আহমেদ দাল্লাল উল্লেখ করেন যে, ব্যাবিলনিয়ান, গ্রিক এবং ভারতীয়রা, যারা গাণিতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান অধ্যয়নের বিশদ পদ্ধতি উন্নয়ন করেছিলেন, তাদের চেয়ে ভিন্নভাবে প্রাক-ইসলাম আরবেরা পুরোপুরি অভিজ্ঞতালব্ধ পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করতেন। এই পর্যবেক্ষণগুলো নির্দিষ্ট নক্ষত্রের উদয় এবং অস্ত উপর ভিত্তি করত, এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের এই ক্ষেত্রটি আনওয়া নামে পরিচিত ছিল। আরবদের দ্বারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর আনওয়া বিকশিত হতে লাগল, যেখানে ইসলামি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ পর্যবেক্ষণের সাথে গাণিতিক পদ্ধতি যোগ করলেন।[11] ডেভিড কিং-এর মতে, ইসলামের উত্থানের পর, কিবলা এবং নামাজের সময় নির্ধারণ করার বাধ্যকতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জ্যোতির্বিজ্ঞানে অগ্রগতিতে অনুপ্রাণিত করে।[12]
ডোনাল্ড হিল (১৯৯৩) ইসলামি জ্যোতির্বিজ্ঞানকে তার ইতিহাসের স্পষ্ট পর্যায়কালের উপর নির্ভর করে চারটি ভাগে ভাগ করেন।
ইসলাম বিজয়ের পর, খেলাফতের শুরুর দিকে, মুসলমান বিদ্বানরা গ্রিসদেশীয় এবং ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান আত্মভূত করে নিতে লাগলেন আরবি অনুবাদের মাধ্যমে (কিছুক্ষেত্রে ফার্সির মাধ্যমে)।
সর্বপ্রথম যেসব জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত রচনা আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল সেগুলো ছিল ভারতীয়[13] এবং ফার্সি উদ্ভূত।[14] রচনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল জিজ আল-সিন্ধহিন্দ[n 1], ৮ম শতাব্দীর এক ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার রচনা যা মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম আল-ফাজারি এবং ইয়াকুব ইবনে তারিক অনুবাদ করেন ৭৭০ এর পরে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সহায়তায় যারা খলিফা আল-মনসুরের দরবারে এসেছিলেন ৭৭০ সালে।[13] আরেকটি অনূদিত রচনা হচ্ছে জিজ আল-শাহ, জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত সারণীর এক সংকলন (ভারতীয় স্থিতিমাপকের উপর ভিত্তি করে) দুই শতাব্দীর বেশি সময় ধরে সাশানিড ফার্সিতে রচিত। এই সময়ের রচনাসমূহের অংশবিশেষ ইঙ্গিত করে যে আরবদেশীয়রা সাইন অপেক্ষকটি গ্রহণ করেছিলেন (ভারত থেকে পাওয়া) গ্রিক ত্রিকোণমিতিতে ব্যবহৃত বৃত্তের পরিধির জ্যা'র বদলে।[11]
জ্ঞানের গৃহ ছিল আব্বাসিয় খলিফা আল-মামুনের আমলে ৯ম শতকের শুরুর দিকে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত একটি শিক্ষায়তন। এই সময় থেকে, টলেমীয় ব্যবস্থার স্বাধীন অনুসন্ধান সম্ভবপর হয়ে উঠে। দাল্লাল (২০১০) এর মতানুসারে, অপেক্ষকের ব্যবহার, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রথার উৎস এবং হিসাবপদ্ধতি টলেমীয় প্রথাকে "একেবারে প্রথম থেকে পর্যবেক্ষণীয় পরিশোধনের এবং গাণিতিক পুনর্গঠনের সম্ভাবনার জন্যে গ্রহণক্ষম" করে তোলে।[15] জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণা আব্বাসিয় খলিফা আল-মামুনের দ্বারা জ্ঞানের গৃহের মাধ্যমে অত্যন্ত সহায়তা পায়। এ ধরনের কাজের কেন্দ্র হয়ে উঠে বাগদাদ এবং দামেস্ক। খলিফারা এই কাজগুলো শুধুমাত্র আর্থিকভাবেই সহায়তা করেননি, বরং আনুষ্ঠানিক মর্যাদা দিয়ে কাজটিকে ভূষিত করেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে সর্বপ্রথম প্রধান মুসলিম রচনা ছিল ৮৩০ সালে আল-খোয়ারিজমি কর্তৃক রচিত জিজ আল-সিন্ধ। রচনাটি সূর্য, চাঁদ এবং সেই সময়ে জ্ঞাত পাঁচটি গ্রহের চলনের সারণী সংবলিত ছিল। এই রচনাটি তাৎপর্যপূর্ণ যেহেতু তা ইসলামিক বিজ্ঞানে টলেমীয় ধারণাসমূহ অন্তর্ভুক্ত করে। এই রচনাটি ইসলামিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে এক সন্ধিক্ষণও চিহ্নিত করে। এযাবতকাল, মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এক প্রাথমিক গবেষণার পথ অবলম্বন করেছিলেন এই ক্ষেত্রে, অন্যদের রচনাসমূহ অনুবাদ করে এবং ইতিমধ্যেই আবিষ্কৃত জ্ঞানার্জন করে। আল-খোয়ারিজমি র রচনা অধ্য্যয়ন এবং হিসেবনিকেশের অপ্রথাগত পদ্ধতির প্রারম্ভ সুচনা নির্দেশ করে।[16]
৮৫০ সালে, আল-ফারগানি রচনা করেন কিতাব ফি জাওয়ানি, (অর্থাৎ "তারকা বিজ্ঞানের এক সারমর্ম")। বইটি প্রাথমিকভাবে টলেমীয় মহাবিশ্ববিবরনের একটি সারাংশ উপস্থাপন করে। যাইহোক, পূর্বের আরবদেশীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আবিস্কারের উপর নির্ভর করে তা টলেমীকেও সংশোধন করে। আল-ফারগানি সূর্যের পরিক্রমণের বক্রতার, চাঁদ এবং সূর্যের পৃথিবী থেকে দূরবর্তী বিন্দুর অয়নচলনের, এবং পৃথিবীর পরিধির পুনঃপরিক্ষিত মান দেন। বইটি মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পরে, এমনকি ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদও হয়।[17]
জ্যোতির্বিজ্ঞানের সেই যুগ যখন এক স্বতন্ত্র ইসলামি ব্যবস্থা বিকশিত হয়। যুগটি শুরু হয় যখন মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা টলেমীর জ্যোতির্বিজ্ঞানের ব্যবস্থার কাঠামোকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। এইসব সমালোচনা, তৎসত্ত্বেও, ভূকেন্দ্রিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত থাকল এবং টলেমীর জ্যোতির্বিজ্ঞানসংক্রান্ত উদাহরণ অনুসরণ করল; একজন ঐতিহাসিক তাদের রচনাকে বর্ণনা করেছেন এভাবে "এক সংস্কারক প্রকল্প টলেমীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানকে দৃঢ় করতে চায় তার নিজের তত্ত্বের সাথে একই সারিতে এনে।"[18]
১০২৫ এবং ১০২৮ সালের মধ্যে, ইবনে আল-হাইথেম তার আল-শুকুক আলা বাতলামিয়ুস (অর্থাৎ "টলেমীর উপর সন্দেহ) রচনা করেন। ভূকেন্দ্রিক আদর্শের ভৌত বাস্তবতা বজায় রেখে, তিনি টলেমীয় আদর্শের উপাদানগুলোর সমালোচনা করেন। অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী এই কাজে উপস্থিত চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করলেন, অর্থাৎ এইসব কষ্টকর কাজের সমাধানে বিকল্প আদর্শের সম্প্রসারিত করা। ১০৭০ সালে, আবু উবায়াদ আল-জুযজানি তারিক আল-আফলাক প্রকাশ করেন। তার রচনায়, তিনি টলেমীয় আদর্শের তথাকথিত "ইকুয়েন্ট" সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করেন। আল-জুযজানি সমস্যাটির একটি সমাধানও প্রস্তাব করেন। আল-আন্দালুসে, অজ্ঞাতনামা রচনা আল-ইস্তিড্র্যাক আলা বাটলামিয়ুস (অর্থাৎ “টলেমী সংক্রান্ত অনুচিন্তন”), টলেমীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিরোধিতার এক তালিকা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পরবর্তী মধ্যযুগের উল্লেখযোগ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে ছিলেন [[মু’আয়াদ আল-দিন আল-‘উরদি] (১৩৪৭ নাগাদ), নাসির আল-দিন আল-তুসি (১২০১-৭৪), কুতুব আল-দিন আল শিরাজি (১৩১১ নাগাদ), সাদর আল-শারিয়া আল-বুখারি (১৩৪৭ নাগাদ), ইবনে আল-শাতির (১৩৭৫ নাগাদ), এবং আলি আল-কুশজি (১৪৭৪ নাগাদ)।[19]
পঞ্চদশ শতাব্দীতে, তিমুরিয় শাসক সমারকন্দের উলাঘ বেগ তার দরবারকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতার এক কেন্দ্রে পরিণত করেন। তিনি নিজে তার যৌবনে তা নিয়ে অধয়ন করেছিলেন, এবং ১৪২০ সালে একটি মানমন্দির প্রতিষ্ঠার আদেশ দেন, যা এক প্রস্থ নতুন জ্যোতির্বিজ্ঞানসংক্রান্ত সারণী তৈরি করে, সাথে সাথে অন্যান্য বৈজ্ঞানিক এবং গাণিতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।[20]
চৈনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে ইসলামি প্রভাব সর্বপ্রথম লিপিবদ্ধ হয় সং রাজবংশের সময়ে যখন মা ইজ নামের একজন হুই মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী এক সপ্তাহে সাতদিনের ধারণা প্রবর্তন করেন এবং অন্যান্য অবদান রাখেন।[21]
মঙ্গোল সাম্রাজ্য এবং পরবর্তী ইউয়ান রাজবংশের সময় চীনে ইসলামি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নিয়ে আসা হয়েছিল বর্ষপঞ্জিকা তৈরিতে এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে।[22][23] ১২১০ সালে চৈনিক পণ্ডিত ইয়েহ-লু চু’সাই চেঙ্গিস খানের সঙ্গী হন পারস্য গমনে এবং মঙ্গোল সাম্রাজ্যে ব্যবহারের জন্যে তাদের দিনপঞ্জিকা নিয়ে অধ্যয়ন করেন।[23] কুবলা খান বেইজিংয়ে ইরানিদের নিয়ে আসেন একটি মানমন্দির এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত বিদ্যার্জনের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার জন্যে।[22]
মারাগেহ মানমন্দিরে বেশ কয়েকজন চৈনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী কাজ করেছিলেন, ১২৫৯ সালে পারস্যের হুলাগু খানের পৃষ্ঠপোষকতায় নাসির আল-দিন আল-তুসি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।[24] এসব চৈনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একজন ছিলেন ফু মেংচি, অথবা ফু মেজহাই।[25] ১২৬৭ তে, ফার্সি জ্যোতির্বিজ্ঞানী জামাল আদ-দিন, যিনি আগে মারাগা মানন্দিরে কাজ করতেন, কুবলাই খানকে সাতটি ফার্সি জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত যন্ত্রসমূহ উপহার দেন, যেগুলোর অন্তর্ভুক্ত ছিল একটি ভূগোলক এবং একটি আরমিলেয়ারি গোলক,[26] সেই সাথে একটি জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত পঞ্জিকা, যা পরবর্তীতে চীনে ওয়ানিয়ান লি নামে পরিচিত হয় (“দশ হাজার বছরের বর্ষপঞ্জি” অথবা “চিরকালের বর্ষপঞ্জি)। চায়নায় তিনি “ঝামালুদিং” নামে পরিচিত ছিলেন, যেখানে, ১২৭১ সালে, তিনি খান দ্বারা বেইজিং-এ ইসলামিক মানমন্দিরের প্রথম পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান,[24] ইসলামিক জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত বিভাগ নামে পরিচিত, যা চার শতাব্দী ধরে চৈনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত বিভাগের পাশাপাশি কাজ করেছিল। ইসলামিক জ্যোতির্বিজ্ঞান চীনে ভাল সুখ্যাতি অর্জন করে তার গ্রহসংক্রান্ত অক্ষাংশের তত্ত্বের কারণে, সেই সময়ে চৈনিক জ্যোতির্বিদ্যায় যার অস্তিত্ব ছিল না, এবং গ্রহণ সম্পর্কে তার নির্ভুল গণনার কারণে।[5]
তার কিছুদিন পরেই বিখ্যাত চৈনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী গুয়ো শাউজিং কর্তৃক গঠিত কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি মারাগেহ’তে তৈরি যন্ত্রপাতির ধরনের অনুরূপ।[24] বিশেষত, “সহজতর যন্ত্র” (জিয়ানি) এবং গাওচেং জ্যোতির্বিজ্ঞান মানমন্দিরের বিশাল গ্নমন ইসলামিক প্রভাবের সাক্ষ্য বহন করে।[5] ১৮২১ সালে শাউশি বর্ষপঞ্জি তৈরি করার সময়, গোলকাকার ত্রিকোণমিতি নিয়ে রচনায় সম্ভবত কিছুটা প্রভাবিত হয়েছিল ইসলামিক গণিত দ্বারা, যা কুবলার দরবারে সমাদরে গৃহীত হয়েছিল।[27] এইসব সম্ভাব্য প্রভাব অন্তর্ভুক্ত করে নিরক্ষসংক্রান্ত এবং গ্রহণের স্থানাঙ্ক রুপান্তরের একটি ছদ্ম-জ্যামিতিক ব্যবস্থা, মূলগত স্থিতিমাপে দশমিকের প্রণালীবদ্ধ ব্যবহার, এবং গ্রহসমূহের চলনের অনিয়মিত হিসেবে ঘনের ক্ষেপকের প্রয়োগ।[5]
মিং রাজবংশের (১৩২৮-১৩৯৮) সম্রাট হংয়ু (রাজত্ব ১৩৬৮-১৩৯৮), তার শাসনের প্রথম বছরে (১৩৬৮), সাবেক মঙ্গোলীয় ইয়ুয়ানদের বেইজিং-এর জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানসমূহের হান এবং ও-হান জ্যোতির্বিদ্যা বিশেষজ্ঞদের বাধ্যতামূলকভাবে নিয়োগ করেন নানজিং সদ্য প্রতিষ্ঠিত জাতীয় মানমন্দিরের কর্মকর্তা হতে।
সেই বছর, মিং সরকার প্রথমবারের মত জ্যোতির্বিজ্ঞান কর্মকর্তাদের ঊর্ধ্ব রাজধানী ইয়ুয়ান থেকে দক্ষিণে আসার নির্দেশ জারি করে। তাদের সংখ্যা ছিল চৌদ্দ। পর্যবেক্ষণ এবং হিসেব পদ্ধতিতে নির্ভুলতা নিশ্চিত করতে, হংয়ু সম্রাট সমান্তরাল বর্ষপঞ্জি ব্যবস্থা, হান এবং হুই অবলম্বন জোরদার করলেন। পরবর্তী বছরগুলোতে, মিং দরবার সাম্রাজ্যিক মানমন্দিরে বেশ কয়েকজন হুই জ্যোতির্বিদদের উঁচু পদে নিয়োগ দিলেন। তারা ইসলামিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর প্রচুর বই লিখলেন এবং ইসলামি ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতিও প্রস্তুত করলেন।
দুটো গুরুত্মপূর্ণ রচনা চাইনিজ ভাষায় অনুবাদের কাজ সম্পন্ন হয় ১৩৮৩ সালেঃ জিজ (১৩৬৬) এবং আল-মাদখাল ফি সিন’আত আহকাম আল-নুজুম, জ্যোতিষবিদ্যার পরিচিতি (১০০৪)।
১৩৮৪ সালে, বহু উদ্দেশ্যপূর্ণ ইসলামি যন্ত্র প্রস্তুতির নির্দেশাবলীর উপর ভিত্তি করে একটি চাইনিজ এস্টোলোব প্রস্তুত করা হল নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের জন্য । ১৩৮৫ সালে, উত্তরদিকের নানজিং-এ এক পাহাড়ে যন্ত্রটি স্থাপন করা হয়।
১৩৮৪ সালের দিকে, মিং রাজবংশের সময়, সম্রাট হংয়ু আদেশ করলেন চাইনিজ অনুবাদ এবং ইসলামি জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত সারণীসমূহের সংকলন করার, একটি কাজ যা পণ্ডিতগণ মাশায়িহেই, একজন মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী, এবং য়ু বোজং, একজন চাইনিজ বিদ্বান-কর্মকর্তা দ্বারা সম্পন্ন হয়েছিল। এইসব সারণী হুইহুই লিফা (বর্ষপঞ্জি-সংক্রান্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানের মুসলিম ব্যবস্থা) নাম্মে পরিচিতি লাভ করল, যা চীনে ১৮শ শতক পর্যন্ত[28] বেশ কয়েকবার প্রকাশিত হয়, যদিও কিং রাজবংশ ১৬৫৯ সালে চৈনিক-মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রথা আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যাগ করে।[29] মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইয়্যাং গুয়াংজিয়ান খ্রিস্টান ধর্মসঙ্ঘের সদস্যদের জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত বিজ্ঞানের প্রতি তার আক্রমণের জন্য পরিচিত ছিলেন।
জোসিওন যুগের গোড়ার দিকে, ইসলামি বর্ষপঞ্জি বিদ্যমান চৈনিক-নির্ভর বর্ষপঞ্জিসমূহের উপর তার উচ্চতর নির্ভুলতার কারণে বর্ষপঞ্জি সংস্কারের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। হুইহুই লিফার কোরিয়ান অনুবাদ, জামাল আদ-দীন (জ্যোতির্বিজ্ঞানী)-এর ইসলামি জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত রচনার সাথে চৈনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের সংমিশ্রনের এক পাঠ্য, ১৫ শতকে সেজোং-এর সময়ে জোসিওন রাজবংশে কোরিয়ায় পঠিত হয়। ১৯ শতকের গোড়ার আগ পর্যন্ত কোরিয়ায় চৈনিক-ইসলামি জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রথা টিকে থাকে।
ইসলামে প্রথম শৃঙ্খলাবদ্ধ পর্যবেক্ষণ আল-মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় ঘটার বিবরণ পাওয়া যায়। এখানে, এবং দামাস্ক থেকে বাগদাদ পর্যন্ত আরও অনেক ব্যক্তিগত মানমন্দিরে, মাধ্যাহ্নিক মাত্রা পরিমাপ করা হয়, সৌর স্থিতিমাপ স্থাপন করা হয়, এবং সূর্য, চাঁদ আর গ্রহসমূহের বিশদ পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করা হয়।
দশম শতাব্দীতে, বুওয়াহিদ রাজবংশ জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিস্তৃত কাজ সম্পন্নে উৎসাহ প্রদান করে, যেমন একটি বিশাল-পাল্লার যন্ত্র গঠন যা দ্বারা ৯৫০ সালে পর্যবেক্ষণ করা হয়। আমরা এ সম্পর্কে জানতে পারি জিজ-এ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের যেমন ইবনে আল-আলম দ্বারা লিপিবদ্ধ বিবরণী থেকে। মহান জ্যোতির্বিজ্ঞানী আবদ আল-রহমান আল সুফি রাজকুমার আদুদ ও-দৌলেহের পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন, যিনি টলেমীর তারার তালিকা শৃঙ্খলাবদ্ধ পুনঃনিরীক্ষণ করেন। শারাফ আল-দৌলাও বাগদাদে একই রকম মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এবং টলিডো এবং করডোবা’য় ইবনে ইউনুস এবং আল-জারকালের বর্ণনা তাদের সময়ে কৃত্রিম যন্ত্রের ব্যবহারের ইঙ্গিত করে।
তিনি ছিলেন [প্রথম মালিক শাহ]] যিনি সর্বপ্রথম বিশাল মানমন্দির স্থাপন করেন, সম্ভবত ইসফাহান-এ। সেটা এখানেই ছিল যেখানে ওমর খৈয়াম আরও অনেক সহকর্মীর সাথে একটি জিজ নির্মাণ করেন এবং ফার্সি সৌর বর্ষপঞ্জি ওরফে জালালি বর্ষপঞ্জি প্রস্তুত করেন। এই বর্ষপঞ্জির আধুনিক এক রুপ এখনও বর্তমানে ইরানে দাপ্তরিকভাবে ব্যবহার হয়।
সবচেয়ে প্রভাবশালী মানমন্দির যদিও স্থাপিত হয় হেলেগু খান দ্বারা ১৩শ শতকের সময়। এখানে, নাসির আল-দীন আল-তুসি মারাগায় এর প্রযুক্তিগত নির্মাণ তদারকি করেন। স্থাপনাটিতে ছিল হেলাগু খানের বিশ্রামাগার, সেই সাথে একটি গ্রন্থাগার এবং মসজিদ। সেইকালের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কয়েকজন সেখানে একত্র হতেন, এবং তাদের সহায়তায় টলেমীয় ব্যবস্থার গুরুত্মপূর্ণ অদলবদল উৎপন্ন হয় ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে।
১৪২০ সালে, রাজকুমার উলুগ বেগ, নিজে একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ, সমরকন্দে আরেকটি বিশাল মানমন্দির নির্মাণ করেন, যার ভগ্নাবশেষ ১৯০৮ সালে রাশিয়ান দল দ্বারা খনন করা হয়।
এবং অবশেষে, অটোম্যান ইস্তাম্বুলে ১৫৭৭ সালে তাকি আল-দীন মুহাম্মদ ইবনে মা’রুফ এক বিশাল মানমন্দির স্থাপন করেন, যা মারাগা এবং সমরকন্দের গুলোর মত বিশাল ছিল। মানমন্দিরটি যদিও ক্ষণস্থায়ী ছিল, মানমন্দিরের বিরোধীরা ছিল এবং নিয়তির পূর্বলক্ষণ প্রাদুর্ভূত হল এবং মানমন্দিরটি ১৫৮০ সালে ধ্বংস হয়ে যায়।[30] যদিও অটোম্যান পাদ্রীরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিজ্ঞানের বিরোধিতা করতেন না, মানমন্দিরটি প্রধানত জ্যোতির্বিদ্যার জন্যে ব্যবহৃত হচ্ছিল, যার বিরোধিতা তারা করেন, এবং সফলতার সাথে এর ধ্বংস অন্বেষণ করেন।[31]
মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দ্বারা ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিসমূহ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের উৎস দুটিঃ প্রথমত বর্তমানের ব্যক্তিগত এবং জাদুঘরে অবশিষ্ট সংগ্রহ থেকে, এবং দ্বিতীয়ত মধ্যযুগের সংরক্ষিত গ্রন্থ এবং পাণ্ডুলিপি। “স্বর্ণযুগের” মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাদের সময়ে্র আগে থেকে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিসমূহের প্রচুর উন্নতিসাধন করেন, যেমন নতুন পাল্লা বা বিবরণ যোগ।
সাধারণত আকাশসংক্রান্ত গোলকসমূহ জ্যোতির্বিজ্ঞানে সমস্যাসমূহ সমাধানে ব্যবহৃত হত। বর্তমানে, এমন ১২৬টি যন্ত্র পুরো পৃথিবীতে অবশিষ্ট আছে, সবচেয়ে পুরনোটি ১১দশ শতাব্দী থেকে। সূর্যের উচ্চতা, অথবা তারকারাজির সঠিক উদয় বা বিনতি এসব দ্বারা হিসেব করা যায় পর্যবেক্ষকের অবস্থান গোলকের চরম বলয়ে প্রবেশ করে।
একটি আরমিলেয়ারি গোলকের প্রয়োগও একই রকম। প্রাচীন কোন ইসলামি আরমিলেয়ারি গোলক বিদ্যমান নেই, কিন্তু “বলয়যুক্ত যন্ত্রের” উপরে বেশ কিছু গ্রন্থ লেখা হয়েছিল। এই প্রসঙ্গেও একটি ইসলামি উন্নয়ন আছে, গোলাকার এস্ট্রোলোব, যার মাত্র একটি সম্পূর্ণ যন্ত্র, ১৪দশ শতাব্দীর, বিদ্যমান আছে।
তামার এস্ট্রোলোবসমূহ ছিল একটি গ্রীক আবিষ্কার। এস্ট্রোলোব প্রস্তুতকারী প্রথম ইসলামি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হচ্ছেন মুহগামাদ আল-ফাজারি (৮ম শতাব্দীর শেষে)। স্বর্ণযুগে ইসলামি বিশ্বে এস্ট্রোলোব জনপ্রিয় ছিল, প্রধানত কিবলা খোঁজার সহায়ক হিসেবে। সবচেয়ে প্রাচীন জ্ঞাত উদাহরণ হল ৯২৭/৮ (হিজরি পরবর্তী ৩১৫)।
যন্ত্রগুলো ব্যবহৃত হত সূর্য এবং স্থায়ী তারাগুলোর উদয়ের সময় জানার জন্য। আন্দালুসিয়ার আল-জারকালি এ ধরনের এক যন্ত্র তৈরি করেন যা, তার পূর্বসূরিদের বিসদৃশ, পর্যবেক্ষকের অক্ষাংশের উপর নির্ভর করত না, এবং যে কোন স্থানে ব্যবহার করা যেত। ইউরোপে যন্ত্রটি সাফিয়া নামে পরিচিতি লাভ করে।
মুসলমানরা সূর্যঘড়ির তত্ত্ব এবং গঠনে বেশ কিছু গুরুত্মপূর্ণ উন্নয়নসাধন করে, যা তারা তাদের ভারতীয় এবং গ্রীক পূর্বসূরিদের কাছ থেকে পায়। এইসব যন্ত্রের জন্যে খোয়ারিজমি সারণী তৈরি করেন যা নির্দিষ্ট হিসেবের জন্য প্রয়োজনীয় সময় যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়ে আনে।
সূর্যঘড়ি প্রায়ই মসজিদে স্থাপন করা হত নামাজের সময় নির্ধারণের জন্যে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় উদাহরণগুলোর একটি প্রস্তুত হয় ১৪দশ শতাব্দীতে দামেস্কের উমাইয়াদ মসজিদের মুয়াক্কিত (সময় নির্ধারণকারী), ইবনে আল-শাতির।
কয়েক প্রকার কোয়ারডেন্ট মুসলিম কর্তৃক উদ্ভাবিত হয়। তাদের মধ্যে ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের গণনায় ব্যবহৃত সাইন কোয়াড্রেন্ট এবং প্রতি ঘণ্টার কোয়াড্রেন্টের বিভিন্ন প্রকার, সময় নির্ধারণের জন্য ব্যবহৃত (বিশেষ করে নামাজের সময়) সূর্য বা তারা পর্যবেক্ষণ করে। নবম শতাব্দীর বাগদাদ ছিল কোয়াড্রেন্টের উন্নয়নের এক কেন্দ্র।[33]
ইকুয়েটরিয়াম হচ্ছে আল-আন্দালুসের এক ইসলামি উদ্ভাবন। সবচেয়ে প্রাচীন জ্ঞাতটি সম্ভবত প্রস্তুত হয় ১০১৫ সালের দিকে। এটি চাঁদ, সূর্য, এবং গ্রহসমূহ খোঁজার একটি যান্ত্রিক কল, গণনা ছাড়া আকাশের গড়নের গড় এবং রীতিবিরুদ্ধ অবস্থানের প্রতিরুপ একটি জ্যামিতিক আদর্শ ব্যবহার করে।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.