কালনা
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি শহর উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি শহর উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
কালনা পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি পৌর অঞ্চল তথা জেলার কালনা মহকুমার সদর। ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত এই শহরটি অম্বিকা কালনা নামে জনপ্রিয়। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে এই স্থানটি উল্লিখিত হয়েছে আম্বুয়া বা অম্বুয়া মুলুক নামে। স্থানীয় দেবী অম্বিকার নামানুসারেই শহরের এই নামকরণ। জেলাসদর বর্ধমান শহরের থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কালনায় একাধিক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কালনার রাজবাড়ি, প্রতাপেশ্বর মন্দির, কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির, লালজি মন্দির ও ১০৮ শিবমন্দির। ঐশ্বর্যপূর্ণ পোড়ামাটির মন্দির দ্বারা সমৃদ্ধ অম্বিকা কালনাকে আসলে “মন্দিরের শহর” বলা হয়।[১][২]
কালনা মন্দিরের শহর | |
---|---|
শহর | |
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান | |
স্থানাঙ্ক: ২৩.২২° উত্তর ৮৮.১৭° পূর্ব | |
রাষ্ট্র | ভারত |
রাজ্য | পশ্চিমবঙ্গ |
জেলা | পূর্ব বর্ধমান জেলা |
সরকার | |
• বিধায়ক | দেবপ্রসাদ বাগ (পল্টু) (TMC) |
আয়তন | |
• শহর | ৬.৯ বর্গকিমি (২.৭ বর্গমাইল) |
উচ্চতা | ১১ মিটার (৩৬ ফুট) |
জনসংখ্যা (২০১১) | |
• শহর | ৫৬,৭২২ |
• জনঘনত্ব | ৮,১৫৩/বর্গকিমি (২১,১২০/বর্গমাইল) |
• মহানগর | ৫৯,৯৫৬ |
ভাষা | |
• দাপ্তরিক | বাংলা |
সময় অঞ্চল | আইএসটি (ইউটিসি+৫:৩০) |
পিন | ৭১৩৪০৯ |
টেলিফোন কোড | +৯১(মোবাইল) ০৩৪৫৪(ল্যান্ডলাইন) |
লিঙ্গ অনুপাত | ৯৬১ ♂/♀ |
সাক্ষরতা | ৭৭% |
ওয়েবসাইট | bardhaman |
যে অক্ষ ও দ্রাঘিমাংশে কালনা শহর অবস্থিত তা হল :[৩]। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই অঞ্চলের গড় উচ্চতা ১১ মিটার বা ৩৬ ফুট।
রেল ও সড়কপথে কালনায় যাবার সুব্যবস্থা আছে। রেলপথে হাওড়া থেকে কাটোয়া পর্যন্ত প্রসারিত একটি লুপ লাইনের দ্বারা কালনা সংযুক্ত। হাওড়া থেকে ৮১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত অম্বিকা কালনা স্টেশনটি এই শহরের প্রধান রেলওয়ে স্টেশন। বেশ কয়েকটি লোকাল ও এক্সপ্রেস ট্রেন অম্বিকা কালনার উপর দিয়ে যায় এবং সেগুলির প্রায় প্রতিটিই এই স্টেশনে থামে। সড়ক পথে ব্যান্ডেল, পাণ্ডুয়া, বৈঁচি, মেমারি ও বর্ধমান থেকে এই শহরে যাওয়া যায়। কালনার শহরের পাশ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ৬ নম্বর রাজ্য মহাসড়ক চলেগেছে।
বর্ধমান জেলার অংশ কালনা শহরটি নদিয়া ও হুগলি জেলার সীমানার খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। বিখ্যাত তীর্থস্থান নবদ্বীপ ও মায়াপুর কালনার খুব কাছেই অবস্থিত।
ভাগীরথী, অজয় ও দামোদর নদের মধ্যবর্তী কৃষিসমৃদ্ধ পলল সমভূমিতে কালনার অবস্থান।[৪] এই অঞ্চলের তাপমাত্রা শীতকালে ১৭°-১৮° ও গ্রীষ্মকালে ৩০°-৩২°-এর কাছাকাছি থাকে।[৫]
২০০১ সালের জনগণনা অনুসারে, কালনার জনসংখ্যা ৫২,১৩৬। এর মধ্যে পুরুষ ৫১% ও মহিলা ৪৯%। কালনার সার্বিক সাক্ষরতার হার ৭৭% ; যা জাতীয় গড় ৫৯.৫%-এর চেয়ে অনেকটাই বেশি। পুরুষ সাক্ষরতার হার ৮২% ও মহিলা সাক্ষরতা ৭২%। কালনার জনসংখ্যার ৯%-এর বয়স ৬ বছরের নিচে। পঞ্চাশের দশকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের জনস্রোত এই অঞ্চলের জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করেছিল। [৬]
প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষ শনিবারে দেবী ভবানীর মন্দিরে বিশেষ পূজা আয়োজিত হয়। এই প্রথাটিকে জনপ্রিয়তা দিয়েছিলেন ভবা পাগলা নামক জনৈক সাধু। দেবী ভবানী মন্দিরের কাছেই শ্রীগৌরাঙ্গ মন্দির। এখানে রক্ষিত আছে চৈতন্যদেবের পাণ্ডুলিপি ও ব্যবহৃত সামগ্রী। আর একটি দ্রষ্টব্য স্থান হল সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। এটিই দেবী অম্বিকার মন্দির, যাঁর নামে কালনা শহর অম্বিকা কালনা নামে পরিচিত।
কালনা শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন আকর্ষণ হল ১০৮ শিবমন্দির। ১৮০৯ সালে মহারাজ তেজচন্দ্র বাহাদুর এই ইঁটের তৈরি আটচালা মন্দিরগুলি নির্মাণ করেন। মন্দিরগুলি দুটি বৃত্তের আকারে বিন্যস্ত। একটি বৃত্তে ৭৪টি ও অপর বৃত্তে ৩৪টি মন্দির অবস্থান করছে। প্রথমোক্ত বৃত্তের মন্দিরগুলিতে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গগুলি শ্বেত অথবা কষ্টিপাথরে ; কিন্তু শেষোক্ত বৃত্তের মন্দিরগুলিতে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গগুলি কেবলমাত্র শ্বেত পাথরেই নির্মিত। মন্দিরের সুপরিকল্পিত নকশার কারণে সবকটি শিবলিঙ্গই মন্দির-চত্বরের কেন্দ্র থেকে দেখা যায়। সম্ভবত জপমালার প্রতীক হিসেবে মন্দিরগুলি উপস্থাপিত হয়েছে।
১৭৫১-৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত ২৫টি চূড়বিশিষ্ট কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির কালনার অপর জনপ্রিয় দ্রষ্টব্য। এই জমকালো ইঁটের তৈরি পঞ্চ-বিংশতি রত্ন মন্দিরটির সামনে সংলগ্ন রয়েছে অপূর্ব অলঙ্করণে সমৃদ্ধ ত্রিখিলান প্রবেশ পথ বিশিষ্ট ঢালা ছাদের প্রলম্বিত বারান্দা। মন্দিরের গা অলঙ্কৃত মহাকাব্য ও পুরাণের বিভিন্ন দৃশ্যসম্বলিত পোড়ামাটির ফলকে সমৃদ্ধ। এছাড়াও ১৭৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ২৫টি চূড়াবিশিষ্ট অপর মন্দির লালজি মন্দির এবং ১৮৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত রেখ দেউলের নিদর্শন প্রতাপেশ্বর মন্দিরও উল্লেখযোগ্য।
মাইজির বাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৫২ সালে। এই বাড়িতেই প্রতিষ্ঠিত শ্যামচাঁদ রাধারানি মন্দির। এ বাড়ির ঐতিহ্য তিনশো বছরেরও বেশি পুরনো। আজও দোল পূর্ণিমা, রথযাত্রা, ঝুলন পূর্ণিমা, অন্নকূট ও রাস বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় পালিত হয় এখানে। এই উপলক্ষে এখানে উপস্থিতও হন বর্ণ, ধর্ম, জাতি নির্বিশেষে সমাজের সকল স্তরের মানুষ।
প্রজাপতি বাড়িও বিশেষ পরিচিত। এই দর্শনীয় বিরাট বাড়িটির বৈশিষ্ট্য একটি বিরাটাকার প্রজাপতি প্রতীক। অপূর্ব বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৪৭ সালে এই বাড়িতে কালীপূজার সূচনা করেন।
প্রাকার বেষ্টিত প্রাঙ্গনে ১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত এই পঞ্চবিংশতি-রত্ন লালজি মন্দির সম শ্রেণীভুক্ত মন্দিরগুলির মধ্যে প্রাচীনতম। মন্দিরের সামনে রয়েছে একটি নাটমণ্ডপ এবং আর একটি পর্বতাকৃতি মন্দির যা গিরিগোবর্ধন নামে পরিচিত। মূল মন্দিরটি পোড়ামাটির অলঙ্করণে মণ্ডিত। এই ছবিতে কিছু পোড়ামাটির কাজের নমুনা দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে উঁচু ভিত্তির উপর উত্থিত এক খিলান প্রবেশ পথ ও ঈষৎ বক্র শিখর সমন্বিত প্রতাপেশ্বর মন্দিরটি ঊনবিংশ শতকের রেখ দেউলের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। মন্দিরের গায়ে রয়েছে পোড়ামাটির জমকালো অলঙ্করণ। মন্দিরের কাছেই রয়েছে একটি ছাদবিহীন রাসমঞ্চ।
২০২০ তে ভারতীয় ডাকবিভাগ ওডিশা, ছত্তিশগড়, উত্তরপ্রদেশ ও বাঁকুড়ার সেরা সাতটি টেরাকোটা মন্দির বেছে নিয়েছিল, যার মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল এই লালজি মন্দিরও।[৭]
১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত কালনা কলেজ এই অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ এই কলেজটি ন্যাক-এর বিচারে বি++ কলেজের মর্যাদাপ্রাপ্ত। এছাড়াও কালনায় বিভিন্ন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুল আছে। এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য স্কুলগুলি হল :
বর্ধমান জেলার কালনা ও নদিয়া জেলার শান্তিপুর সুদূর অতীতকাল থেকেই হস্তচালিত তাঁত-ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। সেই কারণেই দেশভাগের পর ঢাকা থেকে অনেক দক্ষ তাঁতশিল্পী এই অঞ্চলে চলে এসে বসতি স্থাপন করেন। সরকারি উৎসাহ ও অর্থসাহায্যে তারা তাদের বংশগত পেশার পুনরুজ্জীবন ঘটান এবং এই অঞ্চলের অসামান্য তাঁত শিল্পেরও নবজন্ম ঘটে। শান্তিপুর, ফুলিয়া, সমুদ্রগড়, ধাত্রীগ্রাম ও অম্বিকা কালনায় আজও অপূর্ব নকশা ও রঙের সূক্ষ্ম মসৃণ টেক্সটাইল ও শাড়ি উৎপাদিত হয়ে চলেছে। কালনার খ্যাতি টাঙ্গাইল ও জামদানি শাড়ির জন্য। সমবায় ও বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে উৎপন্ন দ্রব্য বাজারে পাঠানো হয়। রক্ষাবন্ধনী ও বিন্দি কালনায় উৎপাদিত হয়। এই শিল্প এই অঞ্চলের একপ্রকার কুটির শিল্প। অনেক মানুষ, বিশেষত মহিলারা এই শিল্পের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে জীবিকা নির্বাহ করেন।[৮]
সিপিআই(এম) প্রার্থী অঞ্জলি মন্ডল ২০০৬ সালে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেসের আশিষ চক্রবর্তীকে পরাস্ত করে কালনা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জয়লাভ করেন। এর আগে সিপিআই(এম)-এর অঞ্জু কর ২০০১, ১৯৯৬, ১৯৯১, ১৯৮৭ ও ১৯৮২ সালে এই আসনে জয়লাভ করেছিলেন। এই নির্বাচনগুলিতে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীরা ছিলেন তৃণমূলের শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায় (২০০১), কংগ্রেসের লক্ষণকুমার রায় (১৯৯৬), কংগ্রেসের ধীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় (১৯৯১ ও ১৯৮৭) ও কংগ্রেসের সুধীর ঘোষ (১৯৮২)। ১৯৭৭ সালে সিপিআই(এম)-এর গুরুপ্রসাদ সিংহরায় জেএনপি-র দেবেন্দ্রবিজয় ঘোষকে পরাস্ত করে আসনটি দখল করেছিলেন।[৯]
১৯৭২ সালে কংগ্রেসের নুরুল ইসলাম মোল্লা এই আসনটিতে জয়লাভ করেন।[১০] সিপিআই(এম)-এর হরেকৃষ্ণ কোঙার এই আসনটি জিতেছিলেন ১৯৭১,[১১] ১৯৬৯,[১২] ১৯৬৭,[১৩] ও ১৯৬২ সালে (সিপিআই প্রার্থী হিসেবে) [১৪]। ১৯৫৭ ও ১৯৫১ সালে এটি ছিল দুই সদস্যবিশিষ্ট আসন। ১৯৫৭ সালে সিপিআই-এর হরেকৃষ্ণ কোঙার ও জমাদার মাঝি এই আসন থেকে জয়লাভ করেন।[১৫] ১৯৫১ সালে জিতেছিলেন কংগ্রেসের বৈদ্যনাথ সাঁওতাল ও রাসবিহারী।[১৬]
কাটোয়া বিধানসভা কেন্দ্রটি কাটোয়া লোকসভা কেন্দ্রের একটি অংশ।[১৭]
কালনা মহকুমায় চিকিৎসার প্রধান কেন্দ্র কালনা মহকুমা হাসপাতাল। হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালে। এসটিকেকে রোডের ধারে ১৩.৫৩ একর জমির উপর অবস্থিত এই হাসপাতালে মোট ৭০০টি বেড আছে। এবং তার সাথেই সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল আছে। এছাড়াও কলনাতে অনেক নর্সিংহোম রয়েছে। বর্ধমান জেলার যে সকল অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক দূষণ পাওয়া গেছে কালনা তার মধ্যে অন্যতম।[১৮]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.