একটি সভ্যতা (ইংরেজি: Civilization) হল কোন জটিল সমাজব্যবস্থা যা নগরায়ন, সামাজিক স্তরবিন্যাস, প্রতীকী যোগাযোগ প্রণালী (উদাহরণস্বরূপ, লিখন পদ্ধতি), উপলব্ধ স্বতন্ত্র পরিচয় এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর নিয়ন্ত্রণের মত গুণাবলী দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।[1][2][3][4][5][6][7][8] সভ্যতাকে প্রায়শই আরও কিছু সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয় যেগুলোর উপর সভ্যতা নির্ভরশীল, আর সেগুলো হল কেন্দ্রীকরণ, মানুষ এবং অন্যান্য জীবের আবাসন, শ্রমের বিশেষায়িতকরণ, সাংস্কৃতিকভাবে সৃষ্ট উন্নয়ন আদর্শ, আধিপত্য স্থাপন, ভাস্কর্যের অনুরূপ স্থাপত্য, কর বা খাজনা আরোপ, কৃষির উপর সামাজিক নির্ভরশীলতা, এবং সম্প্রসারণের প্রবণতা।[2][3][5][7][8] সাংগঠনিক বসবাসের ক্রমোন্নত স্তর হল সভ্যতা। এর অর্থ হল এর নিজস্ব আইন, সংস্কৃতি এবং জীবনব্যবস্থা ও আত্মরক্ষার নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে। অধিকাংশ সভ্যতারই নিজস্ব কৃষিব্যবস্থা এবং রাজতন্ত্র বা নির্বাচন ব্যবস্থার ন্যায় সরকারপদ্ধতি রয়েছে। তারা একটি সাধারণ ভাষায় কথা বলে, এবং তাদের নিজস্ব ধর্ম ও শিক্ষাব্যবস্থাও থাকতে পারে। সুমেরীয় ও মিশরীয় থেকে শুরু করে সকল সভ্যতারই নিজস্ব লিখন পদ্ধতি ছিল। এই লিখন পদ্ধতির মাধ্যমে তারা তাদের জ্ঞান সংকলন ও সংরক্ষণ করত।

Thumb
প্রাচীন মিশর হল সভ্যতা হিসেবে বিবেচিত প্রাচীন সংস্কৃতির একটি আনুশাসনিক উদাহরণ।

রোমান সাম্রাজ্য হল বৃহৎ সভ্যতার একটি উদাহরণ। এটি রোম নগরী থেকে সরকারিভাবে পরিচালিত হতো। এই সাম্রাজ্য এককালে স্কটল্যান্ডের সীমান্ত থেকে উত্তর আফ্রিকা ও উত্তর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তাদের নিজস্ব ভাষা ছিল ল্যাটিন। রোমান সভ্যতা মোট ১০০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল, কিন্তু প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা টিকে ছিল তার থেকে বেশি দিন। রোমান এবং মিশরীয়গণ অ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাঁতে রোমানরা জয়ী হওয়ায় মিশর রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

ব্যুৎপত্তি ও ইতিহাস

সভ্যতার ইংরেজি শব্দ হল civilization যা ল্যাটিন শব্দ civis থেকে আগত যার অর্থ নগরে বসবাসরত কোন ব্যক্তি। এর কারণ হল, যখন কোন স্থানের মানুষ সভ্য হয়, তখন তারা কোন ছোট গোত্র বা যৌথ পরিবারের মত দলে নয় বরং নগরীর ন্যায় একটি বৃহৎ সুসংগঠিত আকারের দলে একত্রে বসবাস করে।

সভ্যতা বা civilization শব্দটি সর্বপ্রথম খুঁজে পাওয়া যায় নর্বার্ট ইলিয়াস এর দ্য সিভিলাইজিং প্রসেস (১৯৩৯) বইটিতে। বইটিতে মধ্যযুগীয় কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত সামাজিক রীতিনীতি বর্ণিত হয়েছে। আবার আলবার্ট স্কেইউটজার তাঁর বই দ্য ফিলোসফি অফ সিভিলাইজেশ্যন (১৯২৩) তে দুইটি মতামত দাগাঙ্কিত করেন। একটি মতামত অনুসারে জাগতিক সবকিছুর মূল পদার্থ দিয়ে গঠিত এবং আরেকটি মতামত হলো জাগতিক সবকিছু পদার্থ ও নিজস্ব ধর্ম দ্বারা তৈরি। তিনি বলেছিলেন পৃথিবীতে দুরবস্থা তখন থেকে শুরু হয় যখন মানবজাতি সভ্যতার সকল নৈতিক ধারণা ভুলে যাওয়া শুরু করে।[9]

'Civility' (আভিধানিক অর্থ নাগরিতা) এর মত শব্দের উদ্ভব হয় ষোল শতকের মাঝামাঝি সময়ে। গুণবাচক বিশেষ্য 'civilization' যার অর্থ 'সভ্য অবস্থা', ১৭৬০ সালে ফরাসি ভাষা থেকে আগত হয়। ১৭৫৭ সালে ফ্রান্সে সর্বপ্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন ফরাসি অর্থনীতিবিদ ভিক্টর দ্য রিকুয়েটি। অন্যদিকে ইংরেজি ভাষায় সর্বপ্রথম শব্দটি ব্যবহার করেন অ্যাডাম ফারগুসন। তিনি ১৭৬৭ সালে এসেয় অন দ্য হিস্টোরি অফ সিভিল সোসাইটি বইতে উল্লেখ করেন "Not only the individual advances from infancy to manhood but the species itself from rudeness to civilisation।" [10]বাক্যটি মূলত ছিল অভদ্রতা (Barbarism) ও রূঢ়তার বিরোধীতা করার জন্য।

১৭০০ সালের শেষ দিকে ও ১৮০০ সালের শুরুর দিকে ফরাসি বিপ্লব এর সময় সিভিলাইজেশন শব্দটি একবচন হিসেবে ব্যবহৃত হতো, বহুবচন হিসেবে না। অর্থাৎ, সমগ্র মানবজাতিকে এক ধরে সেটির উন্নয়ন বিবেচনা করা হতো। এখনো ফ্রান্সে এই ধারণাই বিদ্যমান। ১৯ শতকে কখনো কখনো সিভিলাইজেশন শব্দটি গণনাবাচক বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল কিন্তু ২০ শতকে এটি সাধারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং কখনো কখনো সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে এক ধরা হয়েছিল।[11] (সভ্যতা বা culture গণনাবাচক বিশেষ্য নয় কিন্তু নৃতাত্ত্বিক ধারণা অনুসারে পরবর্তীতে একে গণনাবাচক বানানো হয়)।[12]

১৮ শতকের দিকেও সভ্যতাকে উন্নয়ন হিসেবে গণ্য করা হতো না। জেনেভা এর দার্শনিক জিন জ্যাক্স রোজিয়াওয়ের বই ইমাইল, অর অন এডুকেশনতে সাংস্কৃতি ও সভ্যতার একটি ঐতিহাসিক পার্থক্য উল্লেখিত রয়েছে। তাঁর মতে, সভ্যতা বিষয়টি সামাজিকভাবে পরিচালিত এবং মানুষের আচার-আচরণের সাথে পুরোপুরি সদৃশ নয় এবং মানুষের পরিপূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব সঠিকভাবে প্রাকৃতিক ঐক্যের মাধ্যমে। এর ফলে একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। (সর্বপ্রথম জার্মানিতে)।এর পেছনে ভূমিকা রাখেন জার্মান দার্শনিক জোহান গটফ্রাইড হার্ডার, ফ্রেডরিক নিয়েশ এবং ড্যানিশ দার্শনিক কিয়েরকেগার্ড। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী সংস্কৃতি একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, যার সাথে মনস্তাত্তিক কোনো কিছুর মিল থাকে না। সভ্যতা যদিও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার কিন্তু এটির সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে পদার্থগত উন্নয়নের মাধ্যমে। তবে পদার্থগত উন্নয়নের ফলে সমাজে প্রতারণা, ভন্ডামি, বিদ্বেষ ও অর্থলিপ্সা বেড়ে যায় যার ফলে সমাজে ক্ষতিসাধন হয়।[13] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এর সময় জার্মান-আমেরিকান রাজনৈতিক দার্শনিক লিও স্ট্রস জার্মানি থেকে পালিয়ে আমেরিকা গিয়ে ব্যাখা দেন যে গটফ্রাইড হার্ডারদের বক্তব্যে যা উঠে এসেছে তা জার্মান নাৎসিবাদ, সামরিকতানাস্তিক্যবাদ এর মূল কারণ।[14]

বৈশিষ্ট্য

অস্ট্রেলিয়ান সমাজবিজ্ঞানী ভিয়ার গর্ডন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন যা সভ্যতাকে সমাজ হতে পৃথক করে।[15] সভ্যতাকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করা হয় জীবিকা নির্বাহের উপায়, জীবন ধারণের পদ্ধতি, স্থায়ীভাবে বসবাস কিংবা অভিবাস, সরকারের ধরন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সমাজের বিভিন্ন স্তর, শিক্ষার হার ও বিভিন্ন সংস্কৃতিগত বিষয়ের উপর ভিত্তি করে। কানাডিয়ান সাংবাদিক এন্ড্রু নিকিফরিউক যুক্তি দেন যে, সভ্যতা মানুষের পেশি শক্তির উপর নির্ভরশীল। দাসদের পেশি শক্তি গ্রহণ করে এটি ফসল ফলায়, কাপড় বোনে ও শহর তৈরি করে।" এছাড়াও দাসপ্রথাকে প্রাক-আধুনিক সভ্যতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[16]

সভ্যতা সবসময়ই কৃষির উপরে নির্ভরশীল ছিল। তবে ধারণা করা হয় পেরুতে প্রাচীন সভ্যতা গড়ে ওঠে সমুদ্র ও এর বিভিন্ন উপাদানকে কেন্দ্র করে।[17][18] সাধারণত দানাশস্য খামার কোনো এলাকার মানুষকে খাদ্য সংরক্ষণ করতে সাহায্য করে এবং এর ফলে খাদ্যের যোগান সহজ হয়। বিশেষত, কৃত্তিমভাবে নিষেক প্রক্রিয়া, সেচ ও ফসল নির্বাচন ইত্যাদি প্রক্রিয়ার দরুন খাদ্য উৎপাদনে সময় ও শ্রম কম দরকার পড়ে। কিন্তু হর্টিকালচারের ফলে খাদ্য উৎপাদন করা গেলেও এতে শ্রম বেশি লাগার কারণে খুব কম সভ্যতাই হর্টিকালচারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।[19] দানা শস্যের সংরক্ষণ ব্যাপারটিকে বিশেষত গুরুত্বসহকারে দেখা হতো কারণ এগুলো দীর্ঘ সময় নীরোগ থাকতে সক্ষম। উদ্বৃত্ত শস্য দরিদ্রদের ভেতরে বিলিয়ে দেওয়া ও অন্যান্য মানবিক কাজে ব্যয় করা সভ্যতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কিছু প্রাচীন সভ্য জাতিসমূহ উদ্বৃত্ত শস্য সৈন্য, কারিগর, ধর্মযাজক ও অন্যান্য উঁচু বর্গের পেশার লোকেদের জন্য নির্ধারিত রাখতো। তবে ধারণা করা হয় যে মেসোলিথিয় সময়কালে নাটুফিয়ান সংস্কৃতির উদ্ভবের সময়ে প্যাসিফিক নর্থওয়েস্টের কিছু শিকারী উদ্বৃত্ত খাদ্যগ্রহণের অনুমতি পেয়েছিল। উল্লেখ্য যে, মেসোথিলিয়া একটি প্রত্নতাত্ত্বিক যুগ এবং নাটুফিয়ান সংস্কৃতিকালের উদ্ভব হয় প্রায় ১১৫০০ বছর থেকে ১৫০০০ বছর আগের কোনো এক সময়ে। যা হোক, বহুল সামাজিক সংস্থা, শস্য সংরক্ষণ ও শ্রম বন্টনের ফলে উদ্ভিদ ও পশুপাখির গৃহায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।[20]

সভ্যতা সমাজের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত। কখনো কখনো সভ্যতা শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়ে "শহরে বসবাস" অর্থে।[21] কৃষক-সমাজ ব্যতীত অন্যান্য বর্গের মানুষদের ভেতরে শহরে বসবাস ও বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রবণতা দেখা যায়।

সভ্যতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো জটিল রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যা রাষ্ট্র গঠন করে।[22] রাষ্ট্রের কয়েকটি সামাজিক শ্রেণির দেখা পাওয়া যায়।[23] যেমনঃ শাসক শ্রেণি, যারা রাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থার সাথে সরাসরি জড়িত ও রাষ্ট্র শাসনে ভূমিকা রাখে। নৃতাত্ত্বিক মর্টন ফ্রাইডইলম্যান সার্ভিস মানব সমাজ ও সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সামাজিক বৈষম্যের ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ করেছেন। উক্ত শ্রেণিবিভাগ ৪টি ক্যাটাগরি নিয়ে তৈরি।[24]

১. শিকারী সমাজঃ পশু পাখি হত্যা ও শাক সবজির উপর নির্ভরশীল সমাজ। এরা সকলেই সমতাবাদী।

২. উদ্যান-পালনভিত্তিক (Horticultural) সমাজঃ এই সমাজ দুই শ্রেণির লোক নিয়ে গঠিত। সমাজ প্রধান ও সাধারণ ব্যক্তি।

৩. চিফডোমঃ এ ধরনের সমাজ রাজা, প্রজা, মন্ত্রী, দাস এদের সমন্বয়ে গঠিত হয়

৪. সভ্যতা : যা জটিল সামাজিক অনুক্রম ও পূর্নাঙ্গ ও প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে গঠিত। সামাজিক অনুক্রম বলতে বোঝায় রাষ্ট্রে বসবাসরত নাগরিকদের জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদির ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ।[25]

আরও দেখুন

গ্রন্থপঞ্জি

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Wikiwand in your browser!

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.

Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.