Loading AI tools
করোনাভাইরাস অতিমারি উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
কোভিড-১৯-এর বৈশ্বিক মহামারী বলতে করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯ (কোভিড-১৯)-এর বিশ্বব্যাপী প্রাদুর্ভাব ও দ্রুত বিস্তারের চলমান ঘটনাটিকে নির্দেশ করা হয়েছে। এই রোগটি একটি বিশেষ ভাইরাসের কারণে সংঘটিত হয়, যার নাম গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রীয় রোগলক্ষণসমষ্টি সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস ২ (সার্স-কোভি-২ ভাইরাস)।[5] রোগটির প্রাদুর্ভাব প্রথমে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের হুপেই প্রদেশের উহান নগরীতে চিহ্নিত করা হয়। চীনা প্রশাসন প্রথমে উহান নগরী ও পরবর্তীতে উহানকে পরিবেষ্টনকারী হুপেই প্রদেশের অন্যান্য নগরীতে জরুরি অবরুদ্ধকরণ জারি করলেও রোগটির বিস্তার বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়, এবং এটি দ্রুত চীনের অন্যত্র এবং পরবর্তীতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটিকে ২০২০ সালের ১১ই মার্চ তারিখে একটি বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।[6] সার্স-কোভি-২ ভাইরাসের একাধিক প্রকারণের উদ্ভব হয়েছে এবং বিশ্বের বহুসংখ্যক দেশে এই প্রকারণগুলি আধিপত্য বিস্তার করেছে; এদের মধ্যে আলফা, বিটা ও ডেলটা প্রকারণগুলির প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। ২০২১ সালের ২৬শে অক্টোবর পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের সর্বত্র ২৪ কোটি ৪৭ লক্ষেরও অধিক ব্যক্তি করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯-এ আক্রান্ত হওয়া ও তাদের মধ্যে প্রায় ৪৯ লক্ষ ব্যক্তির মৃত্যু হওয়ার ঘটনা নিশ্চিত করা হয়েছে, ফলে এটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মরণঘাতী একটি বৈশ্বিক মহামারীতে পরিণত হয়েছে।
কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক মহামারী | |
---|---|
রোগ | করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯ (কোভিড-১৯) |
ভাইরাসের প্রজাতি | গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রীয় রোগলক্ষণসমষ্টি সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস ২ (SARS-CoV-2) |
প্রথম সংক্রমণের ঘটনা | ১লা ডিসেম্বর ২০১৯[1][2](৪ বছর, ৯ মাস ও ২ সপ্তাহ) |
উৎপত্তি | উহান নগরী, হুপেই প্রদেশ, চীন[3] |
নিশ্চিত আক্রান্ত | ৬১,২৫,২৬,৯৪৮[4] |
মৃত্যু | ৬৫,২৮,১০৫[4] |
অঞ্চল | ১৯০[4] |
ব্যক্তিভেদে করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯-এর লক্ষণ-উপসর্গগুলি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। কোনও কোনও ব্যক্তি কোনও লক্ষণ-উপসর্গই অনুভব করে না, আবার অন্য কোনও কোনও ব্যক্তির জন্য এগুলি মারাত্মক রূপ ধারণ করে। বৃদ্ধ রোগী ও বয়স নির্বিশেষে যেসব রোগী অন্য এক বা একাধিক দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতায় ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে রোগটির গুরুতর আকার ধারণ করার সম্ভাবনা বেশি। করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯-এ আক্রান্ত ব্যক্তি কাশি বা হাঁচি দেওয়ার ফলে বাতাসে নিক্ষিপ্ত বহু লক্ষ অতিক্ষুদ্র শ্লেষ্মাকণা বাতাসে ভাসতে শুরু করলে নিকটবর্তী অপর কোনও ব্যক্তি সেই ভাইরাসযুক্ত বাতাস শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করলে তার দেহেও ভাইরাসটি সংক্রমিত হতে পারে।[7][8][9][10] সাধারণ শ্বাস-প্রশ্বাসের কারণেও অত্যন্ত স্বল্প পরিমাণ ভাইরাস কণা বাতাসে ভাসতে পারে। এছাড়া ভাইরাস কণা টেবিলে বা অন্য কোনও পৃষ্ঠে হাঁচি-কাশির মাধ্যমে কিংবা ভাইরাসযুক্ত হাত দিয়ে স্পর্শের মাধ্যমে পৃষ্ঠের উপাদানভেদে কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিন লেগে থাকতে পারে, যেই পৃষ্ঠ আরেকজন ব্যক্তি স্পর্শ করে তারপরে নাকে, মুখে বা চোখে হাত দিলে ঐ ব্যক্তির শ্লৈষ্মিক ঝিল্লির মধ্য দিয়ে ভাইরাস দেহে প্রবেশ করতে পারে, তবে এভাবে সংবহনের ঘটনা বিরল।[9] সাধারণত নিকটবর্তী ব্যক্তিদের কাছেই ভাইরাসটি ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি, তবে ভবন বা কক্ষের অভ্যন্তরে এবং নিম্নমানের বায়ুচলাচল ব্যবস্থাবিশিষ্ট স্থানে ভাইরাসটি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী দূরে ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে।
একবার সংক্রমিত হবার পরে প্রায় ২০ দিন ভাইরাসটির এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির দেহে সংবাহিত হবার সম্ভাবনা থাকে। যখন কোনও রোগটির লক্ষণ-উপসর্গ প্রকাশ করা আরম্ভ করে, তখনই রোগীটি সবচেয়ে বেশি সংক্রামক থাকেন, তবে লক্ষণ-উপসর্গ দেখা দেবার আগেও রোগটি সংবাহিত হওয়া সম্ভব।[11] ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হবার সময় থেকে লক্ষণ-উপসর্গ প্রকাশ পাবার গড় সময় সাধারণত পাঁচ দিন, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুই থেকে ১৪ দিন বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে।[10][12] ব্যাধিটির সাধারণ লক্ষণ-উপসর্গগুলি হল জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট।[10][12] ব্যাধিটি জটিল রূপ ধারণ করলে প্রথমে ফুসফুস প্রদাহ (নিউমোনিয়া) হতে পারে এবং আরও গুরুতর রূপ ধারণ করলে তীব্র শ্বাসকষ্টমূলক রোগলক্ষণসমষ্টি প্রকাশ পেতে পারে, যাতে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে সেরে ওঠার পরেও কোনও কোনও রোগী কোভিড-১৯ পরবর্তী দীর্ঘকাল ধরে রক্তসংবহনজনিত স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে (হৃদরোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, ইত্যাদি) থাকতে পারেন।
২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত রোগটির চিকিৎসার জন্য কোনও ভাইরাস-নিরোধক ঔষধ কর্তৃপক্ষের সমর্থন বা অনুমোদন লাভ করেনি। হাসপাতালে রোগটির গুরুতর পর্যায়ের চিকিৎসাতে মূলত উপসর্গসমূহের উপশম করা হয় এবং সহায়ক চিকিৎসা প্রদান করা হয়, যাতে রোগী নিজে থেকেই ধীরে ধীরে সেরে উঠতে পারে। ২০২০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে বিভিন্ন দেশে বেশ কিছু টিকা উদ্ভাবিত হয় এবং ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম চলমান আছে। টিকা নেবার পাশাপাশি রোগটি প্রতিরোধের জন্য সার্বজনিক স্থানগুলিতে নাকে-মুখ আবরণকারী ডাক্তারি মুখোশ বা স্বাস্থ্য মুখোশ পরিধান করা, অন্য ব্যক্তিদের সাথে সামাজিক তথা দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখা, ভবনগুলির অভ্যন্তরে উন্নত বায়ুচলাচল ও বায়ু পরিস্রাবক ব্যবস্থা ব্যবহার করা, হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় শিষ্টাচার মেনে চলা, হাত ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করা, পৃষ্ঠতল সংক্রমণ নিবারণ করা, রোগীকে পর্যবেক্ষণে রাখা এবং সম্ভাব্য সংক্রমিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আত্ম-পৃথকীকরণ (সঙ্গনিরোধ) করার পরামর্শ দেওয়া হয়।[9][10][13] বিশ্বব্যাপী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষগুলি রোগটির বিস্তার প্রতিরোধের প্রচেষ্টায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, সঙ্গনিরোধ (কোয়ারেন্টিন), অবরুদ্ধকরণ (লকডাউন), সান্ধ্য আইন (কারফিউ) জারি, অনুষ্ঠান পিছিয়ে দেওয়া বা বাতিল করা এবং বিভিন্ন ব্যবসাবাণিজ্য ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা, বাধ্যতামূলক কোভিড-১৯ রোগনির্ণয় পরীক্ষার বিধিবিধান, সংক্রামক ব্যক্তি অনুসন্ধান, ইত্যাদি পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করেছে। বিমানবন্দর ও রেলস্টেশনগুলিতে উপসর্গ ও দেহে ভাইরাসের উপস্থিতি পরীক্ষার ব্যবস্থা,[14] ব্যাপকভাবে আক্রান্ত অঞ্চলে ভ্রমণের ব্যাপারে সতর্কতামূলক বার্তা, ইত্যাদি পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছে।[15][16][17][18][19] বিশ্বের প্রায় ১১৫টি দেশে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে জাতীয় কিংবা স্থানীয় পর্যায়ে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, ফলে প্রায় ১২০ কোটি ছাত্রছাত্রীর জীবনে এর প্রভাব পড়েছে।[20]
এই বৈশ্বিক মহামারীর কারণে সারা বিশ্বের আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়েছে।[21] বহু ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে বা রহিত করা হয়েছে।[22] অনেক দেশে দ্রব্যের (যেমন খাদ্য বা ঔষধ) জোগানের স্বল্পতার ব্যাপারে ব্যাপক ভীতি থেকে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের কেনাকাটার আধিক্যের সৃষ্টি হয়েছে।[23][24] ভাইরাসটিকে নিয়ে ভুল বা মিথ্যা তথ্য ও ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্ব আন্তর্জাল বা ইন্টারনেটে, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছে।[25][26] এছাড়া চীন, পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জাতিবিদ্বেষ ও বিদেশীভীতি বৃদ্ধি পেয়েছে।[27] কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় উন্নত ও অনুন্নত দেশগুলির মধ্যে বৈষম্য এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে গৃহীত বিধিনিষেধ ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্যে দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়েছে।
যেহেতু ২০২১ সালের আগে করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯-এর কোনও টিকা সুলভ হবার সম্ভাবনা কম,[29] সেহেতু এই রোগের বৈশ্বিক মহামারী আয়ত্তে রাখার একটি অন্যতম চাবিকাঠি হলো মহামারীর শীর্ষ (অর্থাৎ এক দিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণের সংখ্যা) কমিয়ে আনা, যাকে "মহামারী বক্ররেখার সমতলকরণ" নাম দেওয়া হয়েছে; এজন্য নতুন সংক্রমণের হার হ্রাস করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।[30] ভাইরাস সংক্রমণের হার কমাতে পারলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলির ধারণক্ষমতার উপর মাত্রাতিরিক্ত চাপের ঝুঁকি হ্রাস করা যায়, ফলে বর্তমান রোগীদের উন্নততর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়, মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার অভাবজনিত কারণে মৃত্যু হ্রাস বা রোধ করা যায়, এবং এর পাশাপাশি টিকা বা নিরাময়ী ঔষধ উদ্ভাবনের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় যাবৎ ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা আয়ত্তে রাখা যায়।[30] এ জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি, পরীক্ষণ, অন্তরণ, সঙ্গনিরোধ এবং অবরুদ্ধকরণের মতো পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
বক্ররেখা সমতলকরণের পাশাপাশি সমান্তরালভাবে আরেকটি প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়, যাকে "সরলরেখার উত্তোলন" নাম দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ হল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা।[32] এ জন্য চিকিৎসা সরঞ্জাম-সামগ্রী ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য কর্মচারীর সংখ্যা বৃদ্ধি, দূর-চিকিৎসা প্রদান, গৃহসেবা, এবং জনসাধারণকে স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান অন্তর্ভুক্ত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে করোনাভাইরাস মহামারীর বিস্তার রোধের সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হল সংক্রামিত ব্যক্তিদের দ্রুত শনাক্ত করা ও সম্প্রদায় থেকে তাদেরকে অন্তরিত (বিচ্ছিন্ন) করা। এ কারণে যতদ্রুত সম্ভব একটি ব্যাপক ও নিবিড় পরীক্ষণ কর্মসূচি সম্পাদন করা অত্যাবশ্যক। এজন্য পরীক্ষণ সরঞ্জাম উৎপাদনকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলিকে উৎপাদনের পরিমাণ বহুগুণে বাড়াতে হবে যেন বিশ্বের সিংহভাগ দেশে ঐসব সরঞ্জামের যে তীব্র ঘাটতি আছে, তা পূরণ করা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদ্রোস আদহানোম গেব্রিয়েসুস বলেন যে "সকল দেশের প্রতি আমরা একটিমাত্র সরল বার্তা জ্ঞাপন করছি - পরীক্ষা করুন, পরীক্ষা করুন, পরীক্ষা করুন।" তাঁর মতে "সকল দেশের সকল সন্দেহজনক [করোনাভাইরাসঘটিত] রোগ সংক্রমণ-ঘটনা পরীক্ষা করার সামর্থ্য থাকা উচিত। চোখে পট্টি বেঁধে অন্ধের মতো এই রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়।" পরীক্ষণ ছাড়া সংক্রমিত ব্যক্তিদেরকে অন্তরণ বা বিচ্ছিন্নকরণ করা এবং এর সাহায্যে সংক্রমণের শৃঙ্খল ভঙ্গ করা সম্ভব নয়। পরীক্ষণ, শনাক্তকরণ ও অন্তরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাস মহামারীর বিস্তার রোধে সফলতার দেখা পাওয়া গেছে।[33]
তবে অনেক দেশেই সীমিতভাবে কেবলমাত্র সন্দেহজনক ক্ষেত্রে বিদেশফেরত, বৃদ্ধ বা রোগগ্রস্ত ব্যক্তিদের পরীক্ষণ করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে এবং যেসব ব্যক্তিদের মৃদু উপসর্গ আছে বা কোনই উপসর্গ নেই, তাদেরকে পরীক্ষণে অংশগ্রহণ করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এর একটি কারণ হল বেশিরভাগ দেশেই ব্যাপক সংখ্যায় পরীক্ষণ করার সামর্থ্য অর্জন করেনি। দক্ষিণ কোরিয়া এক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম, কেননা তারা বর্তমান করোনাভাইরাস মহামারীর অনেক আগে থেকেই বেশ কয়েক বছর ধরে সাবধানতাবশত পরীক্ষণ সরঞ্জাম উৎপাদন ও গুদামজাত করে রেখেছিল (এর আগে সেখানে মার্স নামের ভাইরাসের আক্রমণ হয়েছিল বলে)।
যেসমস্ত ব্যক্তির দেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে, তাদেরকে কোনও হাসপাতালে বা স্থাস্থ্যকেন্দ্রের বিশেষ বিভাগে আলাদা বা অন্তরণ (আইসোলেশন) করে রাখা হয়, যাতে তারা সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাইরাস ছড়াতে না পারে। অন্তরণ সম্পূর্ণ সফল হতে হলে কোনও সম্প্রদায়ের সবাইকে জোর করে সম্ভব হলে একাধিকবার পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হয়। যদি ব্যক্তিদের উপরে স্বেচ্ছায় পরীক্ষা জন্য এগিয়ে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়, তাহলে অন্তরণ পদক্ষেপটি সাধারণত সফল হয় না। ইতালির ভেনেতো অঞ্চলের কিছু ছোট শহরে (কয়েক হাজার বাসিন্দাবিশিষ্ট) অন্তরণ পদক্ষেপটি সফল হয়েছে।
যেসমস্ত ব্যক্তির দেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পরীক্ষা করা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি, কিন্তু যাদের মধ্যে করোনাভাইরাস ব্যাধির একাধিক উপসর্গ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, তাদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বিশেষ ভবনে বা নিজ বাসভবনে সঙ্গনিরোধ (কোয়ারেন্টিন) অবস্থায় থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এখানে স্মরণীয় যে, দেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি স্বল্প খরচে ও দ্রুত পরীক্ষা করার ব্যবস্থা বিশ্বের সিংহভাগ দেশেই এখনও সুলভ নয়। এছাড়া নিরব বাহকদের কাছ থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি বলে কেবল বিদেশফেরত বা করোনা-আক্রান্ত এলাকায় ভ্রমণজনিত কারণে ঝুঁকিপূর্ণ করোনাভাইরাসবাহী ব্যক্তির স্বেচ্ছায় বা আরোপিত সঙ্গনিরোধের ব্যবস্থা এককভাবে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে আদৌ যথেষ্ট কার্যকর কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।
যখন অন্তরণ ও সঙ্গনিরোধের ব্যবস্থাগুলি ব্যর্থ হয়, তখন সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চল বা সমগ্র দেশের উপর অবরুদ্ধকরণ (লকডাউন) ব্যবস্থা জারি ও বলবৎ করতে পারে। এক্ষেত্রে লোকদের বাসগৃহ থেকে বের হওয়া, পরিবহন ব্যবহার করা, কর্মস্থলে গমন করা, জনসমাগম হয় এমন স্থলে গমন করা, অত্যাবশ্যক নয় এমন সমস্ত কর্মকাণ্ড নির্বাহ করা, ইত্যাদির উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। বিশ্বের অনেক দেশে যেমন, চীন, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, ইত্যাদিতে সমগ্র দেশজুড়ে বা নির্দিষ্ট অঞ্চলে অবরুদ্ধকরণের পদক্ষেপটি কার্যকর করা হয়েছে, তবে ততদিনে ঐসব দেশের বহু হাজার লোকের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রামিত হয়ে গিয়েছিল এবং অবরুদ্ধকরণের আগেই কয়েক শত রোগীর মৃত্যু হয়েছিল।
মর্যাদাবাহী নেচার ও সায়েন্সসহ আরও কিছু গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশিত নির্ভরযোগ্য গবেষণার ফলাফলে দেখা গিয়েছে যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের একটি বিরাট অংশ (ক্ষেত্রভেদে প্রায় ৬০% বা তারও বেশি) কোনও উপসর্গই প্রকাশ করে না, এবং নিরবে ও নিজের অজান্তে রোগটি ছড়াতে থাকে। যেমন চীনে পরীক্ষা দ্বারা নিশ্চিত হওয়া করোনাভাইরাসবাহী প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ব্যক্তিই কোনও উপসর্গ প্রকাশ করেনি।[35] এছাড়া ইতালির ভেনেতো অঞ্চলের ভো শহরের সমস্ত অধিবাসীদের পরীক্ষা করে যে ৩% সংক্রমণের ঘটনা নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল, তাদের সিংহভাগই ছিল উপসর্গহীন নিরব বাহক।[36] এই সব নিরব সংক্রমণ-বাহকেরা প্রতিনিয়ত নিজের অজান্তেই করোনাভাইরাস তাদের সম্প্রদায়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, যা কিনা করোনাভাইরাস বিস্তারের অন্যতম প্রধান একটি নিয়ামক। এই তত্ত্বের স্বপক্ষে বিশ্বখ্যাত মর্যাদাবাহী সায়েন্স গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়েছে যে, চীনের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে যে সংক্রমণের ঘটনাগুলি হয়েছিল, তাদের ৮৬%-ই উপসর্গের অনুপস্থিতির কারণে নথিভুক্ত করা হয়নি। অথচ বিজ্ঞানীদের পরিসংখ্যানিক মডেলে বেরিয়ে এসেছে যে এই উপসর্গহীন বা মৃদু উপসর্গের নথি-বহির্ভূত ব্যক্তিরাই চীনের ৭৯% সংক্রমণের ঘটনার জন্য দায়ী।[37] যেসব ব্যক্তি উপসর্গহীন কিংবা বহুদিন যাবৎ ধীরে ধীরে মৃদু উপসর্গ প্রকাশ করেন, তাদের ঊর্ধ্ব শ্বাসপথে অর্থাৎ নাকে, মুখে ও গলায় অসংখ্য ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, এবং তারা খুব সহজেই অনিয়মিতভাবে ও কম সংখ্যায় হলেও হাঁচি-কাশি দিয়ে এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে নিজের অজান্তে আশেপাশে ভাইরাস ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এই গুরুতর ব্যাপারটি সরকার ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষের গুরুত্বের সাথে নেওয়া উচিত। গণমাধ্যমগুলিতে এই নিরব সংক্রমণ-বাহকদের ভূমিকা গুরুত্বের সাথে অবিরতভাবে প্রচার করা উচিত। প্রথমত বাইরের সমাজ ও গৃহের যেকোনও ব্যক্তির সাথে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা উচিত। দ্বিতীয়ত সংক্রমণ-বাহক অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যতদ্রুত সম্ভব সম্ভাব্য উপসর্গহীন সংক্রমণ-বাহকদের খুঁজে বের করে তাদের দেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পরীক্ষণের পর নিশ্চিত হলে সেই উপসর্গহীন ব্যক্তিকে সমাজ থেকে ২ থেকে ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত অন্তরিত বা বিচ্ছিন্ন করে রাখা --- এগুলি নিরব সংক্রমণ-বাহকদের প্রতিহত করার একটি উপায়।[38] কিছু কিছু ব্রিটিশ চিকিৎসকের মতে যদি কোনও উপসর্গহীন ব্যক্তির একাধিক দিন যাবৎ ঘ্রাণ ও স্বাদের ক্ষমতা হ্রাস পায় বা একেবারে লোপ পায়, তাহলে তার দেহে অজান্তে করোনাভাইরাস উপস্থিত থাকতে পারে এবং সম্ভবত ৩০% বা তারও বেশি উপসর্গহীন ব্যক্তি এরূপ ঘ্রাণশক্তি লোপ জাতীয় উপসর্গ প্রকাশ করতে পারে।[39][40]
২০২০ সালের শেষভাগে এসে একাধিক টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষসমূহের অনুমোদন লাভ করে। টিকা গ্রহণ করলে গুরুতর করোনাভাইরাস রোগ হওয়া এবং তা থেকে মৃত্যুর সম্ভাবনা বহুলাংশে হ্রাস পায় এবং ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়াও আংশিক রোধ হয়। ২০২১ সালে এসে অত্যন্ত সংক্রামক ডেলটা প্রকারণটির ক্ষেত্রেও টিকাগুলির গুরুতর রোগের বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা প্রদায়ক ক্ষমতা হ্রাস পায়নি, তবে এগুলির সংবহন তথা ছড়িয়ে পড়া রোধ করার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।
সমগ্র দেশব্যাপী সমস্ত জনগণকে পরীক্ষণের সুযোগসুবিধার অনুপস্থিতিতে জনসচেতনতা, অন্তরণ, সঙ্গনিরোধ এমনকি অবরুদ্ধকরণের পরেও উপসর্গহীন (Asymptomatic) ভাইরাসবাহক ব্যক্তিদের কারণে নিরবে বহু সংখ্যক সংক্রমণ হবার ভয়াবহ ঝুঁকি থেকে যায়। তাই ব্যাপক ও দ্রুত করোনাভাইরাস পরীক্ষণের ব্যবস্থা অলভ্য থাকলে উপসর্গ বা লক্ষণের প্রকাশ না পেলেও সবাইকে ঘরে বসে অবরুদ্ধ অবস্থাতে এবং সীমিত চলাচল ও সামাজিক আন্তঃক্রিয়া সম্পাদনের সময়েও সমাজের প্রতিটি মানুষের সাথে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাত ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করা, নাকে-মুখে-চোখে হাত না দেওয়া, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে জীবাণুমুক্ত করা, ইত্যাদি পদ্ধতিগুলি অত্যন্ত সাবধানতার সাথে মেনে চলতে হবে।
সমাজের সাধারণ ব্যক্তি পর্যায়ে করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯ (কোভিড-১৯) তথা করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয় বিষয়গুলি নিচে তুলে ধরা হল। করোনাভাইরাস মানুষ-থেকে-মানুষে প্রধানত দুই প্রক্রিয়াতে ছড়াতে পারে। সংক্রমণের প্রথম প্রক্রিয়াটি দুই ধাপে ঘটে। প্রথম ধাপ: করোনাভাইরাস-সংক্রমিত ব্যক্তি ঘরের বাইরে গিয়ে মুখ না ঢেকে হাঁচি-কাশি দিলে করোনাভাইরাস তার আশেপাশের (১-২ মিটার পরিধির মধ্যে) বাতাসে কয়েক ঘণ্টা ভাসমান থাকতে পারে। দ্বিতীয় ধাপ: সেই করোনাভাইরাস কণাযুক্ত বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করলে অন্য ব্যক্তিদের ফুসফুসেও শ্বাসনালি দিয়ে করোনাভাইরাস প্রবেশ করতে পারে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটিও কয়েক ধাপে ঘটে। প্রথম ধাপ: করোনাভাইরাস-সংক্রমিত ব্যক্তি যদি কাশি শিষ্টাচার না মানেন, তাহলে তার হাতে বা ব্যবহৃত বস্তুতে করোনাভাইরাস লেগে থাকবে। দ্বিতীয় ধাপ: এখন যদি উক্ত ব্যক্তি তার পরিবেশের কোথাও যেকোনও বস্তুর পৃষ্ঠতলে সেই করোনাভাইরাসযুক্ত হাত দিয়ে স্পর্শ করেন, তাহলে সেই পৃষ্ঠতলে করোনাভাইরাস পরবর্তী একাধিক দিন লেগে থাকতে পারে। তৃতীয় ধাপ: এখন যদি অন্য কোনও ব্যক্তি সেই করোনাভাইরাসযুক্ত পৃষ্ঠ হাত দিয়ে স্পর্শ করে, তাহলে ঐ নতুন ব্যক্তির হাতে করোনাভাইরাস লেগে যাবে। চতুর্থ ধাপ : হাতে লাগলেই করোনাভাইরাস দেহের ভেতরে বা ফুসফুসে সংক্রমিত হতে পারে না, তাই এখন নতুন ব্যক্তিটি যদি তার সদ্য-করোনাভাইরাসযুক্ত হাতটি দিয়ে নাকে, মুখে বা চোখে স্পর্শ করে, কেবল তখনই করোনাভাইরাস ঐসব এলাকার উন্মুক্ত শ্লেষ্মাঝিল্লী দিয়ে দেহের ভিতরে প্রবেশ করবে ও প্রথমে গলায় ও পরে ফুসফুসে বংশবিস্তার করা শুরু করবে। এজন্য উপরে লিখিত করোনাভাইরাস ছড়ানোর দুইটি প্রক্রিয়ার শুরুতেই এবং কিংবা ছড়ানোর প্রতিটি অন্তর্বতী ধাপেই যদি করোনাভাইরাসকে প্রতিহত করা যায়, তাহলে সফলভাবে এই ভাইরাস ও রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে করণীয় আচরণের ব্যাপারে নিচের পরামর্শগুলি অবশ্যপাঠ্য।
করোনাভাইরাস বায়ুবাহিত শ্লেষ্মাবিন্দুর মাধ্যমে ছড়ায় বলে নাক-মুখ ঢেকে রাখা স্বাস্থ্য-মুখোশ (মাস্ক) পরিধান করলে এর সংবহন প্রতিরোধ করা সম্ভব।
করোনাভাইরাস কোনও লক্ষণ-উপসর্গ ছাড়াই দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে যেকোনও ব্যক্তির দেহে তার অজান্তেই বিদ্যমান থাকতে পারে। এরকম করোনাভাইরাস বহনকারী ব্যক্তি যদি কোনও কারণে হাঁচি বা কাশি দেন, তাহলে তার আশেপাশের বাতাসে ৩ থেকে ৬ ফুট দূরত্বের মধ্যে করোনাভাইরাসবাহী জলীয় কণা বাতাসে ভাসতে শুরু করে এবং ঐ পরিধির মধ্যে অবস্থিত অন্য যেকোনও ব্যক্তির দেহে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে। এ কারণে জনসমাগম বেশি আছে, এরকম এলাকা অতি-আবশ্যক প্রয়োজন না হলে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে যাতে বাতাসে ভাসমান সম্ভাব্য করোনাভাইরাস কণা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ না করতে পারে।
পরিবেশে অবস্থিত বিভিন্ন বস্তুতে করোনাভাইরাস লেগে থাকতে পারে, তাই এগুলি কেউ হাত দিয়ে স্পর্শ করলে তার হাতেও করোনাভাইরাস লেগে যেতে পারে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে করোনাভাইরাস কাঠ, প্লাস্টিক বা ধাতুর তৈরী বস্তুর পৃষ্ঠে গড়ে চার থেকে পাঁচ দিন লেগে থাকতে পারে। মানুষকে জীবনযাপনের প্রয়োজনে এগুলিকে প্রতিনিয়তই হাত দিয়ে স্পর্শ করতে হয়। তাই এগুলি স্পর্শ করার পরে হাত ভাল করে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করা অত্যন্ত জরুরী। নিম্নলিখিত হাত স্পর্শ করার ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রগুলির ব্যাপারে বিশেষ নজর দিতে হবে।
উপর্যুক্ত ক্ষেত্রগুলিতে হাত দিয়ে স্পর্শের পরে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং যত ঘনঘন সম্ভব হাত ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। নিম্নলিখিত হাত ধোয়ার পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে:[41]
কখন হাত ধুতে হবে, তা জানার জন্য নিচের নির্দেশনাগুলি মনে রাখা জরুরি:
করোনাভাইরাস কেবলমাত্র নাক, মুখ, চোখের উন্মুক্ত শ্লেষ্মাঝিল্লী দিয়ে দেহে প্রবেশ করতে পারে। পরিবেশে উপস্থিত করোনাভাইরাস স্পর্শের মাধ্যমে হাতে লেগে থাকতে পারে। তাই আধোয়া জীবাণুযুক্ত হাতে কখনোই নাক, মুখ, চোখ স্পর্শ করা যাবে না। যদি একান্তই নাকে মুখে চোখে হাত দিতে হয়, তাহলে অবশ্যই হাত ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করে তা করতে হবে, কিংবা কাগজের রুমাল ব্যবহার করে নাক, মুখ ও চোখ স্পর্শ করতে হবে। এজন্য সবসময় হাতের কাছে সাবান-পানি বা অ্যালোকোহলভিত্তিক হস্ত জীবাণুমুক্তকারক কিংবা কাগজের রুমালের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়মটি মেনে চলা অনেকের জন্য কঠিন হতে পারে। নাক, মুখ ও চোখে হাত দেওয়া খুবই সাধারণ ও স্বাভাবিক একটি ঘটনা এবং বহুদিনের অভ্যাসের বশে প্রায় সবাই কারণে-অকারণে এ কাজটি করে থাকে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে মানুষ ঘণ্টায় ২০ বারেরও বেশি মুখের বিভিন্ন অংশে হাত দিয়ে স্পর্শ করে। কিন্তু নিজদেহে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হলে এই অভ্যাসের ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। অনেকে মানসিক চাপের কারণে, গভীর চিন্তা করার সময়, অন্য কোনও অজ্ঞাত মানসিক কারণে কিংবা চুলকানির জন্য নাকে, মুখে, চোখে হাত দিয়ে থাকেন। তাই প্রথমে প্রতিটি ব্যক্তিকে নিজেকে বেশ কিছু সময় ধরে নিয়মিত আত্ম-পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হবে কোন্ কোন্ সময়ে বা কারণে সে নিজের নাক, চোখ বা মুখে হাত দিচ্ছে। কারণগুলি চিহ্নিত করার পর এবং এগুলি সম্বন্ধে সচেতন হবার পরে একে একে এগুলিকে দূর করার চেষ্টা করতে হবে এবং নাকে,মুখে, চোখে হাত দেয়ার মাত্রা যথাসর্বোচ্চ সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে।
২০১৯ সালের শেষের দিকে উহান নগরীর হুয়ানান সামুদ্রিক খাদ্যের পাইকারি বাজারের দোকানদারদের মধ্যে প্রথম ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটে বলে ধারণা করা হয়।[48][49] বাজারটিতে সামুদ্রিক খাদ্যদ্রব্যের পাশাপাশি জীবন্ত বাদুড়, সাপ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী ও তাদের সদ্য জবাইকৃত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি হত। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয় যে হয়ত কোনও প্রাণীদেহ হতে করোনাভাইরাসটি বিবর্তিত হয়ে আরেকটি মধ্যবর্তী পোষক প্রাণীর মাধ্যমে মানবদেহে সংক্রমিত হয়েছে। চীনা সরকারি নথির বরাতে পাওয়া অন্য এক সূত্রমতে প্রথম আক্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন ৫৫ বছর বয়স্ক ব্যক্তি যিনি ১৭ নভেম্বর, ২০১৯ সালে আক্রান্ত হন।[50] পরের মাসের মধ্যে হুপেই প্রদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্তর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে উহানে অজানা কারণে আক্রান্ত নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে[51] পরের মাসের শুরুতেই এ সংক্রান্ত তদন্ত শুরু হয়।[52] চীনা বিজ্ঞানীরা ২০২০ সালের ৭ই জানুয়ারি তারিখে এটিকে একটি নতুন ধরনের করোনাভাইরাস হিসেবে ঘোষণা দেন এবং এর বংশাণুসমগ্র বা জিনোমের তথ্যগুলি বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীদের কাছে ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষদের কাছে বিতরণ করেন।
প্রথমদিকে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি সাড়ে সাতদিনে দ্বিগুণ হতে যেত।[53] জানুয়ারি, ২০২০ এর শুরু এবং মাঝামাঝি দিকে ভাইরাস অন্যান্য চীনা প্রদেশেও পৌঁছে যায়। চীনা নববর্ষের কারণে এবং উহান চলাচলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান হওয়ায় চীনের গুরুত্বপূর্ণ সকল স্থানে এ ভাইরাস পৌঁছে যায়।[54] ২০ জানুয়ারি একদিনে চীন ১৪০ নতুন আক্রান্তের ঘটনা রেকর্ড করে। এর মধ্যে একজন বেইজিংয়ের এবং অপরজন শেনঝেন প্রদেশের।[55] ২০ জানুয়ারির মধ্যে প্রায় ৬,১৭৪ জন নতুন আক্রান্তের ঘটনা রেকর্ড হয় বলে জানা যায়।[56]
৩০ জানুয়ারি ডব্লিউএইচও এই প্রাদুর্ভাবকে আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য উদ্বেগজনক জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে।[57] ২৪ ফেব্রুয়ারি এর পরিচালক টেড্রোস আধানম সতর্ক করেন এই বলে, এই ভাইরাস চীনের বাইরে আশঙ্কাজনকভাবে ক্রমবৃদ্ধিমান সংখ্যার কারণে বৈশ্বিক মহামারীতে পরিণত হতে পারে।[58]
১১ মার্চ ডব্লিউএইচও এই প্রাদুর্ভাব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সম্প্রদায়ে সঞ্চালন ঘটায় বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে।[6] ১৩ মার্চ ডব্লিউএইচও ইউরোপকে এই ভাইরাসের নতুন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করে। কারণ ইউরোপে চীন বাদে বিশ্বের অন্যান্য স্থানের চেয়ে অনেক বেশি আশঙ্কাজনক হারে এই রোগ ছড়ায়।[59] ১৬ মার্চ ২০২০ তারিখে চীনের মূল ভূখণ্ড বাদে সারা বিশ্বে আক্রান্তর সংখ্যা চীনকে ছাড়িয়ে যায়।[60] ১৯ মার্চ ২০২০-এর হিসাব অনুযায়ী[হালনাগাদ], ২৪১,০০০ জন আক্রান্তের ঘটনা বিশ্বজুড়ে নথিবদ্ধ হয়েছে।; ৯,৯০০০ এরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে; এবং ৮৮,০০০ জন সুস্থ হয়েছে।[61]
করোনাভাইরাস একই ধরনের অনেকগুলি ভাইরাসের একটি বৃহৎ পরিবার যা প্রাণী ও মানুষে সংক্রমিত হতে পারে। ২১শ শতকের আগ পর্যন্ত করোনাভাইরাসগুলি মানুষের দেহে সাধারণ সর্দি-কাশি ব্যতীত অন্য কোনও উপসর্গ বা রোগব্যাধি সৃষ্টি করত না। কিন্তু ২১শ শতকে এসে এ পর্যন্ত ৩টি নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের উদ্ভব হয়েছে (সার্স, মার্স ও উহান করোনাভাইরাস) যেগুলি মানব সম্প্রদায়ে ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে প্রাণঘাতী আকার ধারণ করার ঝুঁকি বহন করে।[62]
উহান করোনাভাইরাসটির বংশাণুসমগ্রের অনুক্রম (জিনোম সিকোয়েন্স) ও সার্স করোনাভাইরাসের বংশাণুসমগ্রের অনুক্রমের মধ্যে প্রায় ৭০% মিল পাওয়া গেছে। এর আগে ২০০২ সালেও চীনদেশেই একই ধরনের জীবন্ত প্রাণী বিক্রির বাজার থেকে ("গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রীয় রোগলক্ষণসমষ্টি সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস"; "Severe Acute Respiratory Syndrome-related Coronavirus", সংক্ষেপে SARS‐CoV) সার্স করোনাভাইরাসের সংক্রমণ, প্রাদুর্ভাব ও বিশ্বব্যাপী বিস্তার ঘটেছিল। বিশ্বের ৩০টি দেশে সার্স ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে, এতে ৮৪৩৭ জন ব্যক্তি নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত হয় এবং ৮১৩ জনের মৃত্যু হয়।[63] এর ১০ বছর পরে ২০১২ সালে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব থেকে মার্স (মধ্যপ্রাচ্যীয় শ্বাসযন্ত্রীয় রোগলক্ষণসমষ্টি সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস; "Middle Eastern Respiratory Syndrome-related Coronavirus", সংক্ষেপে MERS‐CoV) নামের আরেকটি বিপজ্জনক প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস উট থেকে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়েছিল। ভাইরাসটি ২৭টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে, এতে ২৪৯৪ জন নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত হয় এবং এদের মধ্যে ৮৫৮ জনের মৃত্যু হয়।[63]
অবস্থান | মামলা | মৃত্যু |
---|---|---|
বিশ্ব | ২৫৩,৩৯১,৩২৪ | ৫,১০৮,০০৮ |
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র | ৪৭,৮৩৪,৮১০ | ৭৮২,৯৩৩ |
ইউরোপীয় ইউনিয়ন | ৩৯,২৬৯,১৮৫ | ৭৮৭,৭৭২ |
ভারত | ৩৪,৪২৬,০৩৬ | ৪৬৩,২৪৫ |
ব্রাজিল | ২১,৯৪০,৯৫০ | ৬১০,৯৩৫ |
যুক্তরাজ্য | ৯,৪৮৭,৩০২ | ১৪২,৬৭৮ |
রাশিয়া | ৯,০৩১,৮৫১ | ২৫৪,১৬৭ |
তুরস্ক | ৮,৩৬৩,৯৫৯ | ৭৩,১২৭ |
ফ্রান্স | ||
ইরান | ||
আর্জেন্টিনা | ||
স্পেন | ||
কলম্বিয়া | ||
ইতালি | ৪,৮৪৩,৯৫৭ | ১৩২,৬৮৬ |
জার্মানি | ||
ইন্দোনেশিয়া | ||
মেক্সিকো | ||
পোল্যান্ড | ||
দক্ষিণ আফ্রিকা | ||
ইউক্রেন | ||
ফিলিপাইন | ||
মালয়েশিয়া | ||
পেরু | ||
নেদারল্যান্ডস | ||
ইরাক | ||
থাইল্যান্ড | ||
চেক প্রজাতন্ত্র | ||
জাপান | ||
কানাডা | ||
চিলি | ||
বাংলাদেশ | ১,৫৭২,১২৭ | ২৭,৯১২ |
রোমানিয়া | ||
ইসরায়েল | ||
বেলজিয়াম | ||
পাকিস্তান | ১,২৭৯,৩৭৩ | ২৮,৫৯৫ |
সুইডেন | ||
পর্তুগাল | ||
সার্বিয়া | ||
কাজাখস্তান | ||
মরক্কো | ||
কিউবা | ||
ভিয়েতনাম | ||
সুইজারল্যান্ড | ||
জর্ডান | ||
হাঙ্গেরি | ||
নেপাল | ||
অস্ট্রিয়া | ||
সংযুক্ত আরব আমিরাত | ||
তিউনিসিয়া | ||
গ্রিস | ||
জর্জিয়া (দ্ব্যর্থতা নিরসন) | ||
লেবানন | ||
গুয়াতেমালা | ||
বেলারুশ | ||
বুলগেরিয়া | ||
কোস্টা রিকা | ||
সৌদি আরব | ||
শ্রীলঙ্কা | ||
ইকুয়েডর | ||
আজারবাইজান | ||
বলিভিয়া | ||
মিয়ানমার | ||
পানামা | ||
প্যারাগুয়ে | ||
ফিলিস্তিন | ||
শ্লোভাকিয়া | ||
ক্রোয়েশিয়া | ||
প্রজাতন্ত্রী আয়ারল্যান্ড | ||
কুয়েত | ||
ভেনিজুয়েলা | ||
উরুগুয়ে | ||
লিথুয়ানিয়া | ||
ডেনমার্ক | ||
ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র | ||
হন্ডুরাস | ||
ইথিওপিয়া | ||
লিবিয়া | ||
দক্ষিণ কোরিয়া | ||
মঙ্গোলিয়া | ||
মলদোভা | ||
মিশর | ||
শ্লোভেনিয়া | ||
ওমান | ||
আর্মেনিয়া | ||
বাহরিন | ||
কেনিয়া | ||
বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা | ||
কাতার | ||
নাইজেরিয়া | ||
জাম্বিয়া | ||
আলজেরিয়া | ||
নরওয়ে | ||
উত্তর ম্যাসেডোনিয়া | ||
ল্যাটভিয়া | ||
বতসোয়ানা | ||
উজবেকিস্তান | ||
কিরঘিজস্তান | ||
আলবানিয়া | ||
এস্তোনিয়া | ||
সিঙ্গাপুর | ||
কসোভো | ||
আফগানিস্তান | ||
অস্ট্রেলিয়া | ||
ফিনল্যান্ড | ||
মোজাম্বিক | ||
মন্টেনিগ্রো | ||
জিম্বাবোয়ে | ||
ঘানা | ||
নামিবিয়া | ||
উগান্ডা | ||
সাইপ্রাসের | ||
কম্বোডিয়া | ||
এল সালভাদর | ||
ক্যামেরুন | ||
রুয়ান্ডা | ||
চীন | ||
জামাইকা | ||
মালদ্বীপ | ||
লুক্সেমবুর্গ | ||
সেনেগাল | ||
অ্যাঙ্গোলা | ||
মালাউই | ||
আইভরি কোস্ট | ||
কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র | ||
ত্রিনিদাদ ও টোবাগো | ||
ফিজি | ||
সুরিনাম | ||
ইস্তেনী | ||
মাদাগাস্কার | ||
সিরিয়া | ||
সুদান | ||
কেপ ভার্দে | ||
মাল্টা | ||
মৌরিতানিয়া | ||
গায়ানা | ||
গ্যাবন | ||
লাওস | ||
গিনি | ||
পাপুয়া নিউ গিনি | ||
তানজানিয়া | ||
টোগো | ||
বেলিজ | ||
বেরিন | ||
হাইতি | ||
বাহামা | ||
সেশেলস | ||
লেসোথো | ||
সোমালিয়া | ||
বুরুন্ডি | ||
পূর্ব তিমুর | ||
তাজিকিস্তান | ||
মরিশাস | ||
কঙ্গো প্রজাতন্ত্র | ||
তাইওয়ান | ||
নিকারাগুয়া | ||
মালি | ||
অ্যান্ডোরা | ||
বুরকিনা ফাসো | ||
বার্বাডোস | ||
জিবুতি | ||
নিরক্ষীয় গিনি | ||
আইসল্যান্ড | ||
সেন্ট লুসিয়া | ||
হংকং | ||
দক্ষিণ সুদান | ||
ব্রুনেই | ||
মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র | ||
গাম্বিয়া | ||
ইয়েমেন | ||
ইরিত্রিয়া | ||
সিয়েরা লিওন | ||
নাইজার | ||
গিনি-বিসাউ | ||
লাইবেরিয়া | ||
গ্রেনাডা | ||
নিউজিল্যান্ড | ||
সান মারিনো | ||
চাদ | ||
সেন্ট ভিনসেন্ট এবং গ্রেনাডাইনস | ||
ডোমিনিকা | ||
কোমোরোস | ||
অ্যান্টিগুয়া এবং বারবুডা | ||
সাও টোম এবং প্রিন্সিপ | ||
লিচেনস্টাইন | ||
মোনাকো | ||
সেন্ট কিটস এবং নেভিস | ||
ভুটান | ||
ভ্যাটিকান সিটি | ||
সলোমন দ্বীপপুঞ্জ | ||
প্যালেস | ||
ভানুয়াটু | ||
মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ | ||
সামোয়া | ||
কিরিবাটি | ||
মাইক্রোনেসিয়ার ফেডারেটেড স্টেটস |
পলিমারেজ শৃঙ্খল বিক্রিয়া পরীক্ষার (পিসিআর টেস্ট) মাধ্যমে উপর্যুক্ত বাজারের সাথে সরাসরি জড়িত অনেক ব্যক্তির দেহে এবং বাজারের সাথে জড়িত নয়, এমন ব্যক্তিদের দেহেও ভাইরাসটির সংক্রমণ হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ হতে পারে, এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে।[71] তবে এই নতুন ভাইরাসটি সার্স ভাইরাসের সমপর্যায়ের মারাত্মক কি না, তা এখনও পরিষ্কার নয়।[72][73][74][75]
এই ভাইরাসের সংক্রমণে জ্বর (৮৩%-৯৩% রোগীর ক্ষেত্রে), শুকনো কাশি (৭৬%-৮২% রোগীর ক্ষেত্রে), অবসাদ বা পেশীতে ব্যথা (১১%-৪৪% রোগীর ক্ষেত্রে), এবং পরবর্তীতে শ্বাসকষ্ট ও শ্বাসনালির রোগ (যেমন- ক্লোমনালীর প্রদাহ তথা ব্রঙ্কাইটিস এবং নিউমোনিয়া) হয়।[76] কদাচিৎ মাথাব্যথা, তলপেটে ব্যথা, উদরাময় (ডায়রিয়া) বা কফসহ কাশি হতে পারে। রোগীদের রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেছে এই ভাইরাসের কারণে তাদের শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা হ্রাস পায়। এছাড়া যকৃৎ ও বৃক্কের (কিডনি) ক্ষতি হয়। সাধারণত এক সপ্তাহের আগ পর্যন্ত উপসর্গগুলি ডাক্তার দেখানোর মত জটিল রূপ ধারণ করে না। কিন্তু ২য় সপ্তাহে এসে ব্যক্তিভেদে অবস্থার দ্রুত ও গুরুতর অবনতি ঘটতে পারে। যেমন ফুসফুসের ক্ষতিবৃদ্ধির সাথে সাথে ধমনীর রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা (হাইপক্সেমিয়া) দেখা দেয় এবং রোগীকে অক্সিজেন চিকিৎসা দিতে হয়। এছাড়া তীব্র শ্বাসকষ্টমূলক রোগলক্ষণসমষ্টি (অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম) পরিলক্ষিত হয়। ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ রোগীকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (intensive care unit বা ICU) রেখে যান্ত্রিকভাবে শ্বাসগ্রহণ করাতে হয় এবং কখনও কখনও কৃত্রিম ফুসফুসের ভেতরে রক্ত পরিচালনার মাধ্যমে রক্তে অক্সিজেন যোগ করতে হয়। এছাড়া ফুসফুসের ব্যাপক ক্ষতি হবার কারণে ব্যাকটেরিয়াঘটিত ২য় একটি নিউমোনিয়া হবার বড় সম্ভাবনা থাকে এবং নিবিড় পরিচর্যাধীন রোগীদের ১০% ক্ষেত্রে এটি হয়।[62]
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের আক্রমণের মত উপসর্গ হলেও ফ্লুয়ের ঔষধে কোনও কাজ হয় না। এ পর্যন্ত রোগটির জন্য কোনও ঔষধ বা টিকা উদ্ভাবিত হয়নি। হাসপাতালে নিবিড় চিকিৎসা ছাড়া রোগ থেকে সেরে ওঠার উপায় নেই। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আগে থেকেই কম, তাদের নিউমোনিয়া হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সাধারণত বৃদ্ধদের মধ্যে ভাইরাসটির ক্ষতিকর প্রভাব বেশি দেখা গেছে। ইনলফ্লুয়েঞ্জাতে সংক্রমণ-পরবর্তী মৃত্যুর হার (যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ০.১%) করোনাভাইরাসের মৃত্যুর হার অপেক্ষা কম (৩-৪%)।[76]
উহান করোনাভাইরাসটি অপেক্ষাকৃত বড় আকারের; এর আকার প্রায় ১২৫ ন্যানোমিটার (অর্থাৎ ১ মিটারের প্রায় ১ কোটি ভাগের এক ভাগ)। আকারে বড় বলে এটি বাতাসে কয়েক ঘণ্টার বেশি ভাসন্ত অবস্থায় থাকতে পারে না এবং কয়েক ফুটের বেশি দূরত্বে গমন করতে পারে না। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মতো এটিও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংস্পর্শের মাধ্যমে এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তিতে ছড়াতে পারে। বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শের সময় মুখের হাঁচি, কাশি, লালা বা থুতু থেকে সরাসরি ভাইরাসটি এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তিতে সংক্রামিত হতে পারে। অন্যদিকে জনসাধারণ্য স্থানে কোনও আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি-কাশি দিলে বা ভাইরাসযুক্ত হাত দিয়ে ধরলে কাছাকাছি পৃষ্ঠতলে যেমন দরজার হাতলে, খাটের খুঁটিতে বা মুঠোফোনে ভাইরাস লেগে থাকতে পারে এবং সেখান থেকে পরোক্ষভাবে আরেকজন ব্যক্তির কাছে সেটি ছড়াতে পারে।[62]
এছাড়া উহান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার সময়ে যেমন ক্লোমনালীবীক্ষণ বা শ্বাসনালির চিকিৎসার সময়ে বাতাসে দেহ থেকে নিঃসৃত ভাইরাসবাহী তরলের বাতাসে ভাসমান কণাগুলি একাধিক চিকিৎসাকর্মীকে সংক্রামিত করতে পারে এবং সাবধানতা অবলম্বন না করলে হাসপাতালের সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। হাত পরিষ্কার রাখলে এবং বিশেষ পোশাক বা গাউন, হাতমোজা, মুখোশ ও চশমা পরিধান করলে বাতাসে ভাইরাসবাহী ভাসমান কণার বিস্তার কমানো সম্ভব। ভাইরাসটির সংক্রমণ ও লক্ষণ প্রকাশের অন্তর্বর্তী কাল (ইনকিউবেশন পিরিয়ড) এখনও নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও সংক্রমণের মোটামুটি ১ থেকে ১৪ দিনের মধ্যেই রোগের উপসর্গ দেখা যাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।[62]
২০২০ সালের ২৩শে জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উহান করোনাভাইরাসের বিস্তারকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি জরুরী অবস্থা হিসেবে ঘোষণা দেবার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়।[78][79] তবে তারা বলে যে তাদের জরুরী অবস্থা সমিতি প্রয়োজন হলে এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে পুনরায় খতিয়ে দেখতে পারে। এর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটির ব্যাপক বিস্তারের সম্ভাবনার ব্যাপারে সতর্ক করেছিল। সে সময় চীনা নববর্ষ উপলক্ষে চীনের পর্যটকদের গমনাগমনের শীর্ষ মৌসুমের কারণে ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে দুশ্চিন্তা ছিল।
২০১৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর তারিখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে প্রথম ভাইরাসটির সংক্রমণের কথা অবহিত করা হয়। ২৭শে জানুয়ারি ২০২০ তারিখ পর্যন্ত চীনে প্রায় ৪৫১৫ ব্যক্তির দেহে ভাইরাসটির উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৯৭৬ জনের অবস্থা গুরুতর।[80] ভাইরাসের কারণে ২০২০ সালের ৯ই জানুয়ারি প্রথম ব্যক্তিটি মারা যায়। ২৭-শে জানুয়ারি ২০২০ তারিখ পর্যন্ত ভাইরাসটির কারণে চীনে ১০১ জন ব্যক্তি মারা যায়।
ভাইরাসের বিস্তার রোধের উদ্দেশ্যে চীনের বহু শহরে নববর্ষ উৎসব বাতিল করে দেওয়া হয়, উৎসব-উদ্দীপনামূলক জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয় এবং পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় বেড়াবার স্থানগুলিও জনসাধারণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। চীনা সরকারের নির্দেশে উহান শহরে ও হুপেই প্রদেশের আরও ১৭টি শহরে অন্তর্গামী ও বহির্গামী সমস্ত গণপরিবহন সেবা স্থগিত করা হয়েছে। ফলে প্রায় ৫ কোটি চীনা অধিবাসী (উহান শহরের ১ কোটি ১০ লক্ষ অধিবাসীসহ) নিজ শহরে প্রায় অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছে। উহানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে।
২১শে মার্চ ২০২০ তারিখ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ১১ হাজারের কিছু বেশি লোকের করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯-এর কারণে মৃত্যু হয়েছে। এর ১ সপ্তাহ আগে মৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ হাজার ৪০০ জন। অর্থাৎ বিশ্বে গড়ে করোনাভাইরাসের কারণে প্রতি ৭ দিনে মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে।[81]
মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ হবার সময় দেশভেদে ভিন্ন। সাধারণত বিস্তারের শুরুর দিকে ২-৩ দিন পরপর মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়। পরবর্তীতে বিস্তার প্রতিরোধমূলক কর্মসূচী পালন করার ফলে মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ হবার সময় বাড়তে থাকে। যেমন চীনে মার্চের শেষ দিকে মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ হবার সময় ছিল ৩৫ দিন।[81]
|pmid=
এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)। পিএমসি PMC7270627 |pmc=
এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ=
(সাহায্য)Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.