Loading AI tools
ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা সংগ্রামী, দার্শনিক, লেখক ও ইসলামি পণ্ডিত উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
হুসাইন আহমদ মাদানি (উর্দু: حسین احمد مدنی; ৬ অক্টোবর ১৮৭৯ — ৫ ডিসেম্বর ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ; ১৯ শাওয়াল ১২৯৬ — ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৩৭৭ হিজরি) ছিলেন উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর ভারতের অন্যতম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, সুফি, লেখক ও ইসলামি পণ্ডিত। তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, খিলাফত আন্দোলন এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন।[1] ১৯২০ সালে কংগ্রেস-খিলাফত জোট তৈরিতে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ভারতীয় উলামা ও কংগ্রেসের যৌথ আন্দোলনের পথটি তিনি তৈরী করে দিয়েছিলেন ১৯২০ – ১৯৩০ সাল জুড়ে তার বক্তৃতা ও পুস্তক প্রকাশের মাধ্যমে। তিনি ভারত ভাগ, দ্বিজাতি তত্ত্বের বিপক্ষে ছিলেন এবং সংযুক্ত ভারতের অভ্যন্তরে সম্মিলিত জাতীয়তাবাদের পক্ষে ছিলেন।[2][3][4] রাষ্ট্র গঠনের জন্য আঞ্চলিক ও ধর্মীয় পরিচয়ের ভূমিকা নিয়ে বিতর্কে পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেন।[5] তিনি জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের সভাপতি এবং দারুল উলুম দেওবন্দের সদরুল মুদাররিস ছিলেন। তার সময়কালে দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষাক্রম আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। তিনি দেওবন্দ আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবেও সমাদৃত। ইসলামি শাস্ত্রে তার পাণ্ডিত্য ও অবদানের জন্য তাকে শায়খুল ইসলাম উপাধি দ্বারা সম্বোধন করা হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য ১৯৫৪ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত করে।[6] ভারতের এই তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননায় যাদেরকে প্রথম ভূষিত করা হয়েছিল তিনি তাদের অন্যতম। ২০১২ সালের ২৯ আগস্ট ভারতীয় ডাক বিভাগ তার সম্মানে একটি স্মারক ডাকটিকিট বের করেছে।
হুসাইন আহমদ মাদানি | |
---|---|
حسین احمد مدنی | |
৫ম সদরুল মুদাররিস, দারুল উলুম দেওবন্দ | |
কাজের মেয়াদ ১৯২৭ – ২৫ আগস্ট ১৯৫৭ | |
পূর্বসূরী | আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি |
উত্তরসূরী |
|
৩য় সভাপতি, জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ | |
কাজের মেয়াদ ১৯৩৮ – ১৯৫৭ | |
পূর্বসূরী | কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি |
উত্তরসূরী | আহমদ সাইদ দেহলভী |
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | বাঙ্গারমৌ, উন্নাও জেলা, উত্তরপ্রদেশ, ভারত | ৬ অক্টোবর ১৮৭৯
মৃত্যু | ৫ ডিসেম্বর ১৯৫৭ ৭৮) দেওবন্দ, সাহারানপুর জেলা, উত্তরপ্রদেশ, ভারত | (বয়স
সমাধিস্থল | মাজারে কাসেমি |
জাতীয়তা |
|
রাজনৈতিক দল | জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ |
অন্যান্য রাজনৈতিক দল | |
দাম্পত্য সঙ্গী | ৪ |
সন্তান | ১৩; আসআদ মাদানি ও আরশাদ মাদানি সহ |
প্রাক্তন শিক্ষার্থী | দারুল উলুম দেওবন্দ |
পুরস্কার | পদ্মভূষণ (১৯৫৪) |
স্বাক্ষর | |
ওয়েবসাইট | madani.org |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
পিতামাতা |
|
আখ্যা | সুন্নি |
বংশ | সৈয়দ |
ব্যবহারশাস্ত্র | হানাফি |
আন্দোলন | দেওবন্দি |
প্রধান আগ্রহ | |
উল্লেখযোগ্য ধারণা | সম্মিলিত জাতীয়তাবাদ |
উল্লেখযোগ্য কাজ |
|
তরিকা | চিশতিয়া, কাদেরিয়া, নকশবন্দিয়া, মুজাদ্দিদিয়া |
অন্য নাম | চেরাগে মুহাম্মদ (স.) |
আত্মীয় |
|
ঊর্ধ্বতন পদ | |
এর শিষ্য | |
শিষ্য | |
যার দ্বারা প্রভাবিত | |
যাদের প্রভাবিত করেন | |
তিনি ১৮৭৯ সালে ভারতের উত্তরপ্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর ১৮৯২ সালে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। মাহমুদ হাসান দেওবন্দির তত্ত্বাবধানে তিনি ইসলামি শিক্ষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। দেওবন্দে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করে ১৮৯৯ সালে তিনি মদিনা চলে যান এবং মসজিদে নববীতে অবৈতনিক শিক্ষকতা শুরু করেন। মসজিদে নববীতে তিনি ১৮ বছর শিক্ষকতা করেছেন যার কারণে তাকে ‘শায়খুল হারাম’ বলা হয়। ১৯১৫ সালে মাহমুদ হাসান দেওবন্দি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে মদিনায় আগমন করলে তিনিও তার সাথে যোগ দেন। ১৯১৬ সালে মক্কার শরিফ হুসাইন বিন আলির বিদ্রোহের কারণে হেজাজের নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশদের হাতে চলে গেলে দেওবন্দি গ্রেফতার হয়ে মাল্টায় নির্বাসিত হন। দেওবন্দির বার্ধক্যের কথা চিন্তা করে মাদানি তার সাথে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেন। প্রথমবারের বন্দি জীবনে তিনি দেওবন্দির সান্নিধ্যে থেকে তার চিন্তাধারা ও রাজনীতি গভীরভাবে আত্মস্থ করেন এবং আধ্যাত্মিক সাধনায় উন্নতি করেন। ১৯২০ সালে মুক্তি লাভের পর তিনি দেওবন্দির সাথে ভারতে চলে আসেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেস ও খিলাফত আন্দোলনে যোগ দেন। এর ছয় মাস পর দেওবন্দি মৃত্যুবরণ করলে তিনি দেওবন্দির উত্তরসূরির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, এ কারণে তাকে ‘জানাশীনে শায়খুল হিন্দ’ বলা হয়। ১৯২০ সালে কলকাতায় আবুল কালাম আজাদ নতুন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করলে দেওবন্দির নির্দেশে তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং এখান থেকেই তার পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়। ১৯২১ সালের জুলাই মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় খেলাফত সম্মেলনে তিনি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকরি করা হারাম ঘোষণা করেন। ফতোয়াটি একইসাথে মুদ্রিত হয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলে তিনি দ্বিতীয়বারের মত গ্রেফতার হন এবং দুই বছর পর ১৯২৩ সালে মুক্তি পান। এরপর তিনি সিলেটে চলে এসে শিক্ষাদীক্ষায় নিয়োজিত হন। তিন বছর পর ১৯২৭ সালে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে চলে যান এবং সদরুল মুদাররিসের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালে পূর্ণ স্বরাজের দাবি উত্থাপিত হলে তিনি এতে সমর্থন করেন। দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৩২ সালে পুনরায় আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে কংগ্রেস ও জমিয়ত বেআইনি ঘোষিত হয়। তাই জমিয়ত কার্যনির্বাহী পরিষদ বাতিল করে একটি ‘অ্যাকশন কমিটি’ গঠন করে যেখানে তিনি তৃতীয় সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন। একারণে ১৯৩২ সালে তিনি তৃতীয়বারের মত গ্রেফতার হন। ১৯৩৬ সালের নির্বাচন উপলক্ষে তার সাথে মুসলিম লীগের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার সাথে বৈঠকের পর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য জমিয়তের ২০ জন সহ মোট ৫৮ জন নিয়ে মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করেন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে মুসলিম লীগ ভালো ফলাফল করলেও সারাদেশে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ফলে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে উভয় দলের দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে চলে যায়। মুসলিম লীগও জাতীয়তাবাদী আদর্শ থেকে সরে গিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনের দিকে ধাবিত হতে থাকে। এ কারণে তার সাথে মুসলিম লীগের দূরত্ব সৃষ্টি হলে তিনি পার্লামেন্টারি বোর্ড থেকে ইস্তফা দেন এবং অখণ্ড ভারতের পক্ষে জোরালো সমর্থন জ্ঞাপন করেন। তিনি ভারত বিভাজনকে ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্র মনে করতেন। এরূপ পরিস্থিতিতে মুসলিম লীগ সমর্থিত পত্রিকাগুলোর বিরূপ প্রচারণার কারণে তাকে কাফের ফতোয়াও দেওয়া হয়। এসময় আল্লামা ইকবাল তাকে বিদ্রূপ করে কবিতা প্রকাশ করলে একটি বিতর্কের সূত্রপাত হয়, ইতিহাসে যা মাদানি–ইকবাল বিতর্ক নামে পরিচিত।[7] নানামুখী সমালোচনার জবাবে ১৯৩৮ সালে তিনি তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ সম্মিলিত জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম প্রকাশ করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের তৃতীয় সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ব্রিটিশদের সাহায্য করা হারাম ঘোষণা করে তিনি চতুর্থবারের মত গ্রেফতার হন এবং ২ বছর ২ মাস পর ১৯৪৪ সালে মুক্তি পান। ১৯৪৫ সালের নির্বাচনে মুসলিম জাতীয়তাবাদী দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে তাকে সভাপতি করে ‘মুসলিম পার্লামেন্টারি বোর্ড’ গঠন করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। নির্বাচন-উত্তর ব্রিটিশ মন্ত্রী মিশনের সাথে স্বাধীনতার রূপরেখা ও পদ্ধতি আলােচনায় জমিয়তের পক্ষ থেকে ‘মাদানি ফর্মুলা’ পেশ করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনের পর তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি ও রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির কাছ থেকে চার তরিকার খেলাফত পেয়েছিলেন। তার লক্ষাধিক মুরিদ ছিল, তন্মধ্যে ১৬৭ জনকে তিনি নিজের খলিফা বা উত্তরসূরি মনোনীত করেছিলেন। তিনি নকশে হায়াত, হামারা হিন্দুস্তান আওর উসকে ফাজায়েল, আশ শিহাবুস সাকিব সহ বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৯৫৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাকে মাজারে কাসেমিতে দাফন করা হয়। ২০১৯ সালে সিলেটে তার স্মৃতি বিজড়িত স্থানে মাদানি চত্বর নির্মিত হয়েছে।
তিনি ১৮৭৯ সালের ৬ অক্টোবর (১২৯৬ হিজরির ১৯ শাওয়াল) ভারতের উত্তরপ্রদেশের উন্নাও জেলার বাঙ্গারমৌ মৌজায় জন্মগ্রহণ করেন। ভাইদের সাথে নামের ধারাবাহিকতা মিলিয়ে তার নাম রাখা হয় হুসাইন আহমদ। জন্ম সাল স্মরণ রাখার জন্য সংখ্যামান অনুযায়ী তার অপর নাম রাখা হয়েছিল “চেরাগ মুহাম্মদ”।[lower-alpha 1][9] উল্লেখ পাওয়া যায় যে, এই নামটিও তিনি কখনো কখনো ব্যবহার করতেন।[10]
তার পিতার নাম সৈয়দ হাবিবুল্লাহ এবং মাতার নাম নুরুন্নিসা।[11] তারা শাহ ফজলুর রহমান গঞ্জে মুরাদাবাদীর মুরিদ ছিলেন। তার পিতা উর্দু, ফার্সি ও হিন্দি ভাষার পণ্ডিত ছিলেন এবং এলাহদাদপুরের নিকটস্থ একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন।
বংশগতভাবে পিতা ও মাতা উভয়ের দিক থেকেই তিনি মুহাম্মদ (স.)-এর বংশধর।[12] পঞ্চম পূর্বপুরুষ শাহ মুদনে গিয়ে উভয়ের বংশধারা মিলিত হয়।[13]হোসাইন ইবনে আলী ছিলেন তার ৩৩ তম পূর্বপুরুষ। সৈয়দ মুহাম্মদ মাদানি ছিলেন ২৭ তম পূর্বপুরুষ।[lower-alpha 2]
প্রথম স্ত্রীর সাথে সংসারে তার দু'জন কন্যা ছিল। স্ত্রী, কন্যাদের মৃত্যুর পর তিনি মোরাদাবাদের হাকিম গোলাম আহমদের জ্যেষ্ঠ কন্যাকে দ্বিতীয় বিবাহ করেন। এই সংসারে তিনি দুই পুত্রের জনক হন।[15] মাদানি মাল্টায় কারাবন্দি থাকা অবস্থায় স্ত্রী, পুত্রদের মৃত্যু ঘটে।[15]
এরপর তিনি হাকিম গোলাম আহমদের দ্বিতীয় কন্যাকে বিয়ে করেন। তৃতীয় বিবাহের এ সংসারে তিনি দুই সন্তানের জনক হন। আসআদ মাদানি এবং মাজেদা। মাজেদা শৈশবেই মারা যান এবং ১৯৩৬ সালের ৫ নভেম্বর তার এই স্ত্রী মারা যান। তাকে মাজারে কাসেমিতে সমাহিত করা হয়।[15] এসময় আসআদ মাদানির বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর।
পরবর্তীতে চাচাত ভাই বশিরুদ্দিনের মেয়ের সাথে তার চতুর্থ বিবাহের প্রস্তাব করা হয়। বয়সের বড় ব্যবধানের কারনে তিনি প্রথমে এ বিয়েতে সম্মত ছিলেন না। এই সংসারে তিনি দুই পুত্র ও পাঁচ মেয়ের জনক হন। দুই পুত্রের নাম আরশাদ মাদানি ও আসজাদ মাদানি। পাঁচ কন্যার নাম রাইহানা, সাফওয়ানা, রুখসানা, ইমরানা এবং ফারহানা। তার স্ত্রী ২০১২ সালের ৫ জুলাই ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[15]
১৮৮৩ সালে ৪ বছর বয়সে বাড়ির মক্তবে মায়ের কাছে তার শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। বছরখানেক পর তাকে স্কুলে ভর্তি করানো হয় যেখানে তার পিতা শিক্ষকতা করতেন। ১৮৯২ পর্যন্ত স্কুলে লেখাপড়া করার পর তাকে দারুল উলুম দেওবন্দ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৮৯৮ সালে দারুল উলুম দেওবন্দে তার অধ্যয়ন সমাপ্ত হয়। তখন তার বয়স হয়েছিল ১৯ বছর। বাড়ির মক্তবে ও স্কুলে ৮ বছর আর দেওবন্দ মাদ্রাসায় ৭ বছর মোট ১৫ বছর ছিল তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের ব্যাপ্তি। তবে ১৯০৮ সালে মদিনা থেকে ফিরে এক বছর মাহমুদ হাসান দেওবন্দির নিকট পুনরায় হাদিস অধ্যয়ন করেন। সে হিসেবে তার অধ্যয়নকাল ১৬ বছর।[16]
মায়ের কাছে তিনি কুরআনের প্রথম ৫ পারা পড়েন। তারপর পিতার উপর তার শিক্ষার দায়িত্ব অর্পিত হয়। তার পিতা এলাহদাদপুরের নিকটস্থ একটি স্কুলে চাকরি করতেন। তিনি পিতার কাছে সকালে ধর্মীয় শিক্ষা এবং ১০টা থেকে ৪টা পর্যন্ত স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। তৎকালে স্কুলের সর্বোচ্চ শ্রেণীকে প্রথম শ্রেণী এবং সর্বনিম্ন শ্রেণীকে অষ্টম শ্রেণী বলা হত। মাদানি অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন এবং মাতৃভাষা উর্দু, ইতিহাস, ভূগোল, বীজগণিত, পাটিগণিত ইত্যাদি শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন। কিন্তু স্কুল শিক্ষা তার পছন্দ না হওয়ায় স্কুলের শিক্ষাজীবন সমাপ্তির এক বছর পূর্বে তাকে দারুল উলুম দেওবন্দে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।[17]
১৮৯২ সালে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন।[18] তখন দেওবন্দ মাদ্রাসার সদরুল মুদাররিস (প্রধান অধ্যাপক) ছিলেন মাহমুদ হাসান দেওবন্দি, মুহতামিম (মহাপরিচালক) সৈয়দ মুহাম্মদ আবেদ ও পৃষ্ঠপোষক রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি। প্রধানত মাহমুদ হাসান দেওবন্দি তার শিক্ষার কাজে তত্ত্বাবধান করতেন। তার বড় ভাই ছিদ্দিক আহমদ মাহমুদ হাসান দেওবন্দির খাদেম হওয়ার সুবাদে প্রথমদিন থেকেই তিনি দেওবন্দির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। মিজান[lower-alpha 3] ও গুলিস্তা[lower-alpha 4] থেকে তার অধ্যয়ন শুরু হয়। পাঠ উদ্বোধনের জন্য তাকে মাহমুদ হাসান দেওবন্দির কাছে নেওয়া হলে সেখানে খলিল আহমদ সাহারানপুরি উপস্থিত ছিলেন এবং দেওবন্দির অনুরোধে সাহারানপুরি তার পাঠ উদ্বোধন করেন।[19]
দেওবন্দে তার অধ্যয়নকাল ছিল সাড়ে ছয় থেকে সাত বছর। এই সময়ে তিনি দারসে নিজামির অন্তর্ভুক্ত ১৭টি বিষয়ের ৬৭টি কিতাব অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন। ১১ জন শিক্ষকমণ্ডলীর মধ্যে মাহমুদ হাসান দেওবন্দির কাছে তিনি সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ২৪টি কিতাব পড়েছেন। তন্মধ্যে ১০টি শ্রেণিকক্ষে এবং ১৪টি ব্যক্তিগতভাবে। মাহমুদ হাসান দেওবন্দির এই অতিরিক্ত যত্নের কারণে মাদানি দেওবন্দের শিক্ষাকোর্স স্বল্প সময়ে সমাপ্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।[20][lower-alpha 5]
তিনি যে বছর দেওবন্দে ভর্তি হন সেটি ছিল দেওবন্দের ২৭তম শিক্ষাবর্ষ। তখন পর্যন্ত সেখানে মাতবাখ বিভাগ (খাবারঘর) চালু করা সম্ভব হয়নি। ছাত্রদের খাওয়া-দাওয়া কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে ও স্থানীয়দের সহযোগিতার ভিত্তিতে হত। সে অনুসারে মাদানির আহারের ব্যবস্থা হয় মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবির পুত্র হাফেজ মুহাম্মদ আহমদের গৃহে।[22]
শিক্ষা জীবনের প্রথম দিকে মানতেক (যুক্তিবিদ্যা) ও ফলসাফা (গ্রীক দর্শন) অধ্যয়নের প্রতি তার ঝোঁক ছিল। পরবর্তীতে তিনি আরবি সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন এবং মাকামাতে হারীরী, দিওয়ানে মুতান্নবি, সাবআ মুআল্লাকা সহ প্রভৃতি গ্রন্থ আয়ত্ত করেন। হাদিসের অধ্যয়ন শুরু হলে তিনি হাদিস নিয়েই আগ্রহী হয়ে পড়েন।[23]
দেওবন্দ মাদ্রাসায় সদরা কিতাবের পরীক্ষায় পরীক্ষক আব্দুল আলী তাকে মোট নাম্বার ৫০ এর মধ্যে ৭৫ নাম্বার প্রদান করেন, যা ছিল দারুল উলুম দেওবন্দের ইতিহাসে বিরল।[24] শিক্ষাজীবনে উবাইদুল্লাহ সিন্ধি, সৈয়দ ফখরুদ্দিন আহমদ, মানাজির আহসান গিলানি তার সহপাঠী ছিলেন।[25]
১৮৯৮ সালে তার শিক্ষাকোর্স সমাপ্ত হয়। ১৯১০ সালে দস্তারবন্দী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি দস্তারে ফজিলত তথা পাগড়ী লাভ করেন। প্রথমে পাগড়ী দেওয়া হয় আনোয়ার শাহ কাশ্মীরিকে। তারপর পান মাদানি। সবাইকে একটি করে পাগড়ী দেওয়া হলেও মাদানিকে তিনটি পাগড়ী দেওয়া হয়।[26]
শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর পিতামাতার সাথে তিনি মদিনা চলে যান। তখন তার বয়স ১৯। পরিবারের মধ্যে শুধুমাত্র তার পিতা হিজরতের নিয়ত করেছিলেন। মাদানি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না, তিনি আরও একবছর দেওবন্দ মাদ্রাসায় হাদিস অধ্যয়ন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পিতার অনড় সিদ্ধান্তের কারণে নিজ ইচ্ছা ত্যাগ করেন।[27]
তিনি ১৯১৬ পর্যন্ত মদিনায় ছিলেন। মাঝখানে তিনবার ভারতে এসেছিলেন।[28] ১৯০০ সালে তার পীর রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির তলবের কারণে প্রথমবার ভারতে আসেন এবং দুই বছর গাঙ্গুহির সান্নিধ্যে থাকার পর ১৯০২ সালে মদিনায় চলে যান। ১৯০৮ সালে তার স্ত্রীবিয়োগের কারণে দ্বিতীয়বার ভারতে আসেন এবং তিন বছর ভারতে অবস্থান করেন। তন্মধ্যে প্রথম বছর মাহমুদ হাসান দেওবন্দির কাছে হাদিস অধ্যয়ন করেন এবং তার তত্ত্বাবধানে দ্বিতীয় বিবাহের কাজ সমাপ্ত করেন। দ্বিতীয় বছর দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষক নিযুক্ত হন। তৃতীয় বছর দস্তারবন্দী সম্মেলনের কার্যক্রম শেষ করে ১৯১১ সালে মদিনা চলে যান। ১৯১২ সালে তৃতীয়বারের মতো ভারতে এসেছিলেন এবং চার মাস অবস্থান করেছিলেন।[29]
পিতার নেতৃত্বে পরিবারের ১২ সদস্যকে নিয়ে তিনি ১৮৯৯ সালে মদিনায় পৌঁছেন। মদিনায় পৌঁছে তিনি মসজিদে নববীতে অবৈতনিক শিক্ষকতা আরম্ভ করেন। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে পাশাপাশি তিনি এবং তার ভাইয়েরা মিলে মদিনার বাবুর রহমত ও বাবুস সালামের মধ্যবর্তী স্থানে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ব্যবসায় শুরু করেন।[30] শিক্ষকতার অবসরে তিনি নিজ দোকানে সময় দিতেন। ক্ষুদ্র ব্যবসা দিয়ে বড় পরিবারের ভরণপোষণ না হওয়ায় পাশাপাশি খেজুরের ব্যবসায় শুরু করেন। তাতেও সফল না হওয়ায় তিনি মদিনার সরকারি গ্রন্থাগার কুতুবখানা মাহমুদিয়া ও কুতুবখানা শায়খুল ইসলামে পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে গ্রন্থ নকলের কাজ শুরু করেন।[31]
১৯০২ সালে তিনি মদিনায় মুহাম্মদ খাজা কর্তৃক নবপ্রতিষ্ঠিত শামসিয়্যাবাগ মাদ্রাসায় মাসিক ২৫ টাকা বেতনে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। গ্রন্থ নকল বাদ দিয়ে মাদ্রাসার চাকুরি ও মসজিদে নববীতে বিনা বেতনে শিক্ষাদান চালিয়ে যান। মসজিদে নববীতে শিক্ষাদানের কয়েক মাসের মধ্যে চারদিকে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং বহু শিক্ষার্থী জড়ো হয়। এই অবস্থা প্রত্যক্ষ করে মুহাম্মদ খাজা শিক্ষার্থীদের মসজিদে নববীর পরিবর্তে তৎপ্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় শিক্ষাদানের নির্দেশ দেন। মসজিদে নববীর বরকত লাভের আশায় এবং শিক্ষার্থীদের অসম্মতির কারণে মাদানি ওই নির্দেশ পালন করতে পারেন নি। খাজা তাতে অসন্তুষ্ট হলে তিনি মাদ্রাসার চাকুরি ছেড়ে দেন এবং মসজিদে নববীতে বিনা বেতনে শিক্ষকতা চালিয়ে যান।[32][33]
পরবর্তীতে ভোপালের নবাব সুলতান জাহান বেগম মদিনার কিছু সংখ্যক আলেমদের জন্য মাসিক বৃত্তি মঞ্জুর করেন। তন্মধ্যে মাদানি ও তার অপর দুই ভাই প্রত্যেকে মাসিক ১০ টাকা মোট ৩০ টাকা ভাতা পেতেন। বণ্টনের দায়িত্ব ছিল মদিনার শেখ হাসান আব্দুল জাওওয়াদের উপর। জাওওয়াদ উর্দু না জানায় মাদানির উপর তার সহযোগিতার দায়িত্ব অর্পিত হয় এবং এজন্য তিনি অতিরিক্ত ১৫ টাকা বেতন পেতেন। মসজিদে নববীতে শুক্রবার ও মঙ্গলবার ছুটি থাকত; এই ছুটির দিনে তিনি জাওওয়াদের কাজে সহযোগিতা করতেন। একবার বাহাওয়ালপুরের নবাব মদিনায় জিয়ারতে আসলে মাদানির জন্য বার্ষিক ১২০ টাকা ভাতা মঞ্জুর করে যান। ফলে মাদানি পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরে আসে এবং সকলেই শিক্ষাদান ও ধর্মপালনে পূর্ণ মনোনিবেশের সুযোগ পান। মদিনাবাসীদের প্রতি ভিনদেশীয় মুসলিম সরকারগুলোর এ ধরনের ভাতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুকাল পর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। বিদ্রোহী গভর্নর শরিফ হুসাইনের হাতে মদিনার কর্তৃত্ব চলে গেলে সর্বপ্রকারের ভাতা বন্ধ হয়ে যায়।[34]
মদিনায় আগমনের প্রথম বছর মাদানি-পরিবার হরমে নববীর অন্তর্গত বাবুন নিসার নিকটে একটি কাঁচা বাড়ি ভাড়া নেন। বাড়িটি ছোট হওয়ায় পরবর্তী বছর হাররাতুল আগাদাত মহল্লার একটি বড় বাড়িতে বার্ষিক ১২০ টাকা ভাড়ায় চলে যান।[35] কিন্তু পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে এই ভাড়া দিতে অসমর্থ হওয়ায় তারা নগরের বাইরে অবস্থিত শহরতলিতে চলে যেতে বাধ্য হন। সেখানে আলবাব আলমজীদীর নিকটে নির্মাণ-অসম্পূর্ণ একটি বাড়িতে চলে যান। অর্থাভাবে বাড়িটির নির্মাণকাজ বন্ধ ছিল এবং পুনরায় নির্মাণ কাজ আরম্ভ না হওয়া পর্যন্ত তারা এই বাড়িতে থাকার সুযোগ পান যার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন মুহাম্মদ খাজা।[36] এ সময় শহরের বাইরে মদিনার অদূরে একটি পরিত্যক্ত জমি বিক্রি করা হবে বলে জানা যায় যেটি ইসলামের নবীর হুজুরার খাস খাদেমদের জন্য ওয়াকফকৃত সম্পত্তি। এ ধরনের সম্পত্তি পরিত্যক্ত হলে স্থানীয় কাজীর অনুমোদনক্রমে পত্তন নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। মাদানির পিতা সেখানে প্রয়োজনানুসারে কিছু জায়গা পত্তন নিয়ে রেখেছিলেন। শিক্ষকতা সংক্রান্ত কারণে মুহাম্মদ খাজা মাদানির উপর অসন্তুষ্ট হলে তাদের বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দেন। এ কারণে তারা পত্তন নেয়া জায়গায় একটি মাটির বাড়ি বানানোর কাজ শুরু করেন। প্রায় ২২ দিন পর তাদের বাড়ি নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই তারা খাজার বাড়ি ছেড়ে দেন।
পরবর্তীতে বাড়িটি পাকা হয়ে গেলে মাদানির পিতা বাড়িটি সন্তানদের জন্য ওয়াকফ করে দেন যাতে সন্তানদের কেউ বাড়ি বিক্রি করে মদিনা ত্যাগ করতে না পারে। এই বাড়িকে কেন্দ্র করে ৩০ সহস্রাধিক লোকের বসতি গড়ে ওঠে। শরিফ হুসাইনের বিদ্রোহের পর (১৯১৬) অরাজকতা শুরু হলে অনেকে নগরের ভিতরে চলে আসেন। সে সময় মাদানিও নিজ পরিবার নিয়ে বাবুন নিসার একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস শুরু করেন।[37]
১৮৯৮ সালে দারুল উলুম দেওবন্দে শিক্ষা সম্পন্ন করেই তিনি তাসাউফের প্রতি মনোযোগী হন। ঐ বছর শা'বান মাসে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে তিনি রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন। গাঙ্গুহি সাধারণত যাচাই ব্যতীত কাউকে মুরিদ না করলেও তাকে মুরিদ হিসেবে গ্রহণ করেন কিন্তু তাকে কোন সবক দেন নি। তিনি মাদানিকে মক্কায়য পৌঁছে ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কির কাছে প্রথম সবক নেওয়ার নির্দেশ দেন।[38] সেমতে আড়াই মাস পরে জ্বিলকদের শেষদিকে মক্কায় পৌঁছে তিনি মুহাজিরে মক্কির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ও আধ্যাত্মিক সাধনা শুরু করেন। মুহাজিরে মক্কি তাকে কয়েক দিন পর্যন্ত তাসাউফের শিক্ষা দেন।[39]
৬ মাসের মাথায় মুহাজিরে মক্কি মৃত্যুবরণ করলে পরবর্তীতে মদিনা থেকে গাঙ্গুহির কাছে পত্র আদান-প্রদানের মাধ্যমে তিনি আধ্যাত্মিক সাধনা অব্যাহত রাখেন। ১৯০০ সালে গাঙ্গুহির এক চিঠির মাধ্যমে তিনি ভারতে আসার নির্দেশ পান। সে মোতাবেক পরবর্তী বছর তিনি ভারতে গাঙ্গুহির সান্নিধ্যে চলে আসেন। গাঙ্গুহির সান্নিধ্যে আড়াই মাস ব্যাপৃত থাকার পর তাঁর খেলাফত প্রাপ্ত হন। তখন তার বয়স হয়েছিল মাত্র ২২।[40][41]
তার বাবার ইচ্ছে ছিল তাকে ফজলুর রহমান গঞ্জে মুরাদাবাদীর কাছে বায়আত করাবেন।[42] কিন্তু ইতঃপূর্বে গঞ্জে মুরাদাবাদীর মৃত্যু হওয়ায় মাদানি তার শিক্ষক মাহমুদ হাসান দেওবন্দির কাছে বায়আত হওয়ার আশা ব্যক্ত করেন।[39] দেওবন্দিকে এটি অভিহিত করা হলে তিনি মাদানিকে রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির কাছে পাঠিয়ে দেন। গাঙ্গুহি মাহমুদ হাসান দেওবন্দিরও পীর ছিলেন।
তিনি আজীবন শিক্ষকতা করেছেন। তার শিক্ষকতার সূচনা হয় মসজিদে নববীতে।[1] দেওবন্দ থেকে বিদায়ের মুহূর্তে মাহমুদ হাসান দেওবন্দি তাকে শিক্ষকতা অব্যাহত রাখার উপদেশ দেন। মদিনায় ১৮ বছর অবস্থানকালের মধ্যে মাদানি তিনবার ভারতে এসেছিলেন। সে হিসেবে মদিনায় তার শিক্ষকতাকাল ১৩ বছর ৯ মাস।
১৮৯৯ সালের মুহররম মাসে কয়েকজন ভারতীয় ও আরাবিয় ছাত্র নিয়ে আরবি ব্যাকরণ ও অন্যান্য প্রাথমিক পর্যায়ের কিতাব পড়ানো আরম্ভ করেন। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে দোকান পরিচালনা ও গ্রন্থ নকলের কাজ করার কারণে শিক্ষকতায় অপর্যাপ্ত সময় দেওয়া সম্ভব হয়নি।
ভারত থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে ১৯০২ সালে দ্বিতীয় বারের মতো মসজিদে নববীতে শিক্ষকতা আরম্ভ করেন। এ সময়ে মদিনায় শামসিয়্যাবাদ ওরফে তূতিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক পদে চাকুরি নেওয়ার পর অবসর সময়ে নিজের পূর্বেকার অবৈতনিক শিক্ষকতাও চালু করেন। পরবর্তীতে তাকে শুধু মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করার আদেশ দেওয়া হলে তার পক্ষে এই আদেশ মানা সম্ভব হয়নি। অবশেষে মাদ্রাসার চাকরি ছেড়ে দিয়ে মসজিদে নববীতে অবৈতনিক শিক্ষকতার কাজে পূর্ণ মনোনিবেশ করেন।[43]
মদিনায় মালিকি ও শাফিঈ ফিকহের প্রচলন ছিল। বিপরীতে ভারতে হানাফি ফিকহের প্রচলন ছিল। মাদানি ভারতে লেখাপড়া করার কারণে মালিকি ও শাফিঈ ফিকহের কিছু কিতাব তার অপঠিত ছিল। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি এগুলো আয়ত্তের পিছনে সময় দিতেন। তাতে তাসাউফের সবকগুলো তার পক্ষে আদায় করা সম্ভব হতো না। বিষয়টি গাঙ্গুহিকে চিঠি মারফত জানালে উত্তরে তিনি শিক্ষকতা অব্যাহত রাখার উপদেশ দেন।[44]
দ্বিতীয়বারের মতো মসজিদে নববীতে শিক্ষকতা শুরু করার পর তার সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সময়ে কিছু লোক তার বিরোধিতা শুরু করেন। তৎকালে ওয়াহাবি মতবাদীদের অনেকেই ঘৃণার চোখে দেখত। মাদানির বিরোধিতাকারীরা তাকে ওয়াহাবি মতবাদের প্রচারক হিসেবে প্রচারণা করা শুরু করে। এক পর্যায়ে বিষয়টি মদিনার গভর্নর উসমান পাশাকেও জানানো হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তার উপর উত্থাপিত অভিযোগসমূহ মিথ্যা প্রমাণিত হয় এবং তার জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পায়। এভাবে ৭ বছর অধ্যাপনার পর তিনি আবার ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন।[45]
১৯১১ সালে ভারত থেকে মদিনায় আগমন করে করে তৃতীয়বারের মতো তিনি মসজিদে নববীতে শিক্ষকতা আরম্ভ করেন। মসজিদে নববীতে অনেক ক্লাস চালু থাকলেও তার ক্লাসে ছাত্রসংখ্যা সবচেয়ে বেশি হতো। ছাত্রদের পাশাপাশি মদিনার ওলামা, কাজী, মুফতি, শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা ও আমলাগণের অনেকে উপস্থিত থাকতেন।[46]
শিক্ষাদানে তিনি মাহমুদ হাসান দেওবন্দির অনুসরণ করতেন। আলজেরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত আব্দুল হামিদ ইবনে বাদিস ও তার সহযোগী মুহাম্মদ বশির ইব্রাহিমী হিজরত করে মদিনায় চলে আসেন এবং মাদানির ক্লাসে যোগ দেন। তিনি তাদেরকে কিছুদিন নিজের সঙ্গে রাখেন। তাদেরকে তিনি মাহমুদ হাসান দেওবন্দির রাজনৈতিক চিন্তাধারার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন এবং সংগ্রামের জন্য পুনরায় আলজেরিয়ায় পাঠিয়ে দেন।[47]
১৯১৩ সালে ভারতে গিয়ে কয়েক মাস অবস্থান করে আবার মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯১৫ সালের শেষদিকে মাহমুদ হাসান দেওবন্দি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মসূচিতে মদিনায় আগমন করলে মাদানি প্রত্যক্ষ জিহাদ ও রাজনীতিতে যোগ দেন।[48] পরবর্তী বছর (১৯১৬) ইংরেজ সরকারের সহযোগী তুর্কি বিদ্রোহী গভর্নর শরিফ হুসাইন কর্তৃক বন্দি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি মসজিদে নববীতে হাদিসের অধ্যাপনা অব্যাহত রেখেছিলেন।
মদিনায় অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকতা করার কারণে তার ছাত্রদের নিয়মতান্ত্রিক কোন তালিকা পাওয়া যায় না। যে ক'জনের নাম পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে: প্রসিদ্ধ কবি আব্দুল হক মাদানি, মদিনার সরকারি উচ্চ পরিষদের সদস্য আব্দুল হাকিম আল কুর্দি, নায়েবে কাজী ও মুফতি আহমদ আল বাসাতি, পৌরসভার চেয়ারম্যান মাহমুদ আব্দুল জাওওয়াদ প্রমুখ।[47]
১৯১৫ সালে মাহমুদ হাসান দেওবন্দি মদিনায় আসলে মাদানি তার সাথে আন্দোলনে যোগ দেন। তখন তার বয়স ৩৬। এরপর এক বছরের মাথায় মদিনায় তার প্রথম কারাবরণ শুরু হয়। ১৯১৬ সালের সফর মাসে তিনি দেওবন্দির সাথে মাল্টায় নির্বাসিত হন। ৩ বছর ৭ মাস মাল্টায় নির্বাসনে থাকার পর ১৯২০ সালের রোজার মাসে মুক্তি পান।[49]
মদিনায় তিনি মাহমুদ হাসান দেওবন্দির বিপ্লবের কাজে পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন। প্রথমদিকে গভর্নর বসরি পাশা কতিপয় মিথ্যা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দেওবন্দিকে সন্দেহের চোখে দেখত এবং কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করত। মাদানির প্রচেষ্টায় এই সমস্যার সমাধান হয় এবং কাজের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তুর্কি সরকারের যুদ্ধমন্ত্রী আনোয়ার পাশা ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সামরিক সর্বাধিনায়ক জামাল পাশা মদিনায় আগমন করলে তাদের সাথে তিনিই মাহমুদ হাসান দেওবন্দির একান্তে বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেন। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি উপলক্ষে মদিনায় আয়ােজিত মাশায়েখ সম্মেলনে তিনি মুসলিম বিশ্বের সমকালীন পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে জিহাদের গুরুত্ব সম্পর্কে বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি দেওবন্দির মক্কা ও তাইফ সফরে সঙ্গে ছিলেন। মক্কার বিদ্রোহী গভর্ণর শরিফ হুসাইনের বিদ্রোহের পর দেওবন্দি তাইফে অবরুদ্ধ হলে তারই প্রচেষ্টায় বেরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। তারপর ইংরেজদের সহযোগী শরিফ কর্তৃক দেওবন্দিকে গ্রেফতারের আদেশ জারী করা হলে তিনিই তাকে আত্মগোপনের ব্যবস্থা করে দেন। পুলিশ দেওবন্দিকে খুঁজে না পেয়ে মাদানিকে গ্রেফতার করে ও জেলে প্রেরণ করে।[50] এরই মধ্যে দেওবন্দিকেও গ্রেফতার করে জেদ্দায় প্রেরণ করা হয়। মাদানির উপর তখন পর্যন্ত ইংরেজ সরকারের বড় ধরনের কোন অভিযােগ না থাকায় মাদানি মুক্তি পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু দেওবন্দির বার্ধক্য ও কারাজীবনের দুঃখ-কষ্টের কথা চিন্তা করে তিনি মদিনায় ফিরে যান নি। তিনি কৌশলে কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করে দেওবন্দির সাথে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেন।[51]
১৯১৬ সালের সফর মাসে তাদেরকে মিশরের রাজধানী কায়রো প্রেরণ করা হয়। সেখান থেকে নীলনদের অপর তীরে অবস্থিত জীযার প্রাচীন জেলখানা আল মাকালুল আসওয়াদের সামরিক আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদ ও বিচার করা হয়।[52] আদালতে মাদানির জিজ্ঞাসাবাদ ২ দিন অব্যাহত ছিল। ইংরেজ গােয়েন্দা বিভাগ থেকে প্রেরিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ট্রাইবুনাল কর্মকর্তাদের ইচ্ছা ছিল তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদানের। এ লক্ষ্যে কারাগারে পূর্বেই তাদেরকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের সেলে পৃথক পৃথক ভাবে রাখা হয়। তাছাড়া উভয়ের মধ্যে কোন প্রকারের দেখা-সাক্ষাৎ ও কথা-বার্তার উপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।[52] এ প্রসঙ্গে মাদানি বলেন,
“ | মাল্টার জীবনে এটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে কষ্টকর মুহূর্ত। কারণ পারস্পরিক সাক্ষাৎ বন্ধ থাকায় কার উপর কখন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হচ্ছে তা জানারও সুযােগ ছিল না। | ” |
এক মাস পর সরকারের মনােভাব পরিবর্তিত হয়। গােয়েন্দা প্রতিবেদনের সমর্থনে পর্যাপ্ত প্রমাণ ও স্বীকারােক্তি উদ্ধারে ব্যর্থ হলে আদালত তাদেরকে দ্বীপান্তরের রায় দেয়। ১৯১৭ সালের রবিউস সানি মাসে তারা মাল্টা দ্বীপে প্রেরিত হন।[53] সেখানে তখন বিভিন্ন দেশীয় প্রায় ৩০০০ যুদ্ধবন্দী বিদ্যমান ছিল।
মাদানি আজীবন রাজনীতিতে মাহমুদ হাসান দেওবন্দির নীতি অনুসরণ করেছেন এবং ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। ১৯০৯ সালে প্রথমবার তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন যখন তিনি দ্বিতীয়বারের মতো মাহমুদ হাসান দেওবন্দির কাছে হাদিস অধ্যয়ন করছিলেন। ১৯১৫ সালের আগ পর্যন্ত তিনি দেওবন্দির ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে পারেননি কারণ তা গোপনে পরিচালিত হয়েছিল। ১৯১৫ সালের মুহররম মাসে দেওবন্দি মদিনায় পৌঁছে তাকে ও খলিল আহমদ সাহারানপুরিকে বিপ্লবের বিস্তারিত বিবরণ পেশ করলে উভয়ই তাতে সংযুক্ত হন।[54]
মদিনায় এই বৈঠকের পর মাদানির জীবনধারায় পরিবর্তন আসে। তিনি মদিনায় হাদিস অধ্যাপনার বদলে ইংরেজ বিরোধী জিহাদকে জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য স্থির করেন। মাহমুদ হাসান দেওবন্দির সাথে স্বেচ্ছায় কারাবরণের পর মুক্তি পেলে তিনি মদিনায় না গিয়ে দেওবন্দির সাথে ভারতে চলে আসেন। এর প্রায় ছয় মাস পর মাহমুদ হাসান দেওবন্দি মৃত্যুবরণ করেন। ফলে মাদানি তার উত্তরসূরির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।[55]
মিশরের আল আসওয়াদ জেলখানায় তাকে ও তার সহবন্দীদের প্রত্যেককেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থাকতে দেওয়া হয়েছিল।[56] তিনি মাল্টা গমনকালে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নিজ স্ত্রী, ১ কন্যা, ২ পুত্র ও পিতাকে রেখে যান। মা ইতােপূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। বন্দী জীবন শেষ করে ফিরে এসে পরিবারে তাদের কাউকে জীবিত পাননি।[57]
বন্দী জীবনে তিনি মাহমুদ হাসান দেওবন্দির দীর্ঘ সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তার সেবা করতেন।[58] এর মাধ্যমে তিনি দেওবন্দির চিন্তাধারা ও রাজনীতি গভীরভাবে আত্মস্থ করে নেন এবং আধ্যাত্মিক সাধনায় উন্নতি করেন। বন্দী শিবিরে সহস্রাধিক রাজদ্রোহীদের মধ্যে অর্ধেক ছিল জার্মান। অবশিষ্টরা ছিল অস্ট্রেলিয়ান, বুলগেরিয়, মিশরীয়, সিরিয় ও তুর্কি। মাল্টায় বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে অবস্থান করায় তিনি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও রাজনীতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা লাভ করেন। শৈশবে তিনি কুরআন হেফজ করার সুযােগ পান নি। মাল্টায় প্রথম বছরেই তিনি কুরআন হেফজ করেন এবং রমজানে মেহরাবে শােনান। এখানে তুর্কী বন্দীদের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে। তিনি তাদের ভাষা আয়ত্ত করেন।[59][60]
মাল্টায় মুসলিম কয়েদীদেরকে যন্ত্রের সাহায্যে বধকৃত জন্তুর গােশত খেতে দেওয়া হত। তিনি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং অকাট্য দলীলের দ্বারা এ পদ্ধতির যবাহকে ইসলামের দৃষ্টিতে অশুদ্ধ প্রমাণ করেন। তার প্রবল আপত্তির কারণে কর্তৃপক্ষ দাবী মেনে নেয়। মুসলিম কয়েদীদের কেউ মারা গেলে ইংরেজদের সরকারি নিয়মেই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করা হত। এখানেও তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে জেলের ভিতর আন্দোলন গড়ে তােলেন। কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে সেই দাবীও মেনে নেয়। ফলে তার সহকর্মী হাকিম নসরত হুসাইন মাল্টা মৃত্যুবরণ করলে ইসলামি পদ্ধতিতে তার গােসল, কাফন ও দাফনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছিল। তার উদ্যোগের দ্বারা মাল্টায় নামাযের সময় আযান ও জামাআতের ব্যবস্থা হয়। তারপর নামায শেষে যিকির, তালীম ও তালকীনের কাজও চলে। এভাবে বন্দীখানা একটি ধর্মীয় বিদ্যালয়ে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।[61]
মাহমুদ হাসান দেওবন্দি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বহু বছর পূর্বে রেশমি রুমাল আন্দোলনের গােপন তৎপরতা শুরু করেন। বৃটিশ কর্তৃপক্ষ এ আন্দোলনের সন্ধান পেতে বিলম্ব হয়। ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে বৃটিশ জোটভুক্ত মিত্রশক্তি এবং জার্মান জোটভুক্ত অক্ষশক্তির মধ্যে বিশ্বযুদ্ধ বাধে। ঐ বছর নভেম্বরে তুরস্ক জার্মানির পক্ষে যােগ দেয় এবং যুদ্ধ ইউরােপ থেকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।[62] ১৯১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে মিত্রশক্তির অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়লে বৃটিশ কর্তৃপক্ষ ভারতীয়দের কাছে সাহায্য চাই। কিন্তু এরপূর্বেই মাহমুদ হাসান দেওবন্দির নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতিপর্ব প্রায় সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। ঐ বছর শেষ দিকে গােয়েন্দা বিভাগ তার এই গােপন আন্দোলনের সন্ধান পায়। গােয়েন্দা বিভাগ রেশমি রুমালের সূত্র ধরে যাবতীয় তথ্য উদ্ধার করে। এ আন্দোলনের দ্বারা কোন বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বৃটিশের নির্দেশে মদিনা থেকে মাহমুদ হাসান দেওবন্দি ও হুসাইন আহমদ মাদানি সহ ৫ নেতাকে গ্রেফতার করা হয় এবং মাল্টায় নির্বাসিত করা হয়। ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। তখন অনেক রাজবন্দীকে ছেড়ে দেওয়া হলেও মাল্টার বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয়নি। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে হিন্দু-মুসলিমের এক যৌথ জনসভায় পাঞ্জাবের লেফটেন্যান্ট গভর্ণরের নির্দেশে জনসাধারণের উপর এলােপাতাড়ি গুলি চালিয়া গণহত্যা করা হয়েছিল। তাতে অনেক লােক হতাহত হয়।[63] রাওলাট আইনের বলে ভারতের অন্যান্য স্থানেও অনুরূপ ঘটনা সংগঠিত হয়। ফলে সারা উপমহাদেশে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এদিকে খিলাফত আন্দোলনের কারণে উপমহাদেশে বৃটিশের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ক্রমে বৃদ্ধি পায়। ১৯১৯ সালের ৬ ডিসেম্বর জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ অমৃতসর অধিবেশনে বৃটিশের বিরুদ্ধে অসহযােগের প্রস্তাব পাস করে। ঐ বছর খেলাফত কমিটির আমন্ত্রণ ক্রমে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীও খেলাফতে যােগ দেন। এভাবে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ, খেলাফত কমিটি ও জাতীয় কংগ্রেস মিলিতভাবে প্রতিবাদ শুরু করলে রাজনৈতিক জটিলতা বৃদ্ধি পায় এবং এক পর্যায়ে বৃটিশ কর্তৃপক্ষ দেশ ও বিদেশে অবস্থিত ভারতীয় সকল রাজবন্দীকে বিনাশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এ সময় দেওবন্দি ও মাদানি সহ মাল্টার বন্দীগণ মুক্তির পরওয়ানা লাভ করেন। ফলে ১৯২০ সালের ৮ জুন তাদেরকে মাল্টা থেকে প্রিজন জাহাজে করে বােম্বাই বন্দরে এনে বেড়ী খুলে দিয়ে মুক্তি প্রদান করা হয়।[64]
খেলাফত কমিটির শওকত আলি সহ জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি, দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম হাফেজ মুহাম্মদ আহমদ প্রমুখ সহ বহু লােক বন্দরে তাদের স্বাগত জানান। তখন স্থানীয় মিনার মসজিদ মাঠে খেলাফত কমিটির মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। মুক্তিপ্রাপ্ত নেতৃবৃন্দ নিজেদের বাড়ি না গিয়ে খেলাফত অধিবেশনে যােগ দেন। বােম্বাইয়ে তাদের অবস্থান কাল ছিল ২ দিন। এ সময়ে আব্দুল বারি ফিরিঙ্গি মহল্লী ও মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীও তাদের সাক্ষাতে মিলিত হন।[65]
মাল্টার কারাগার থেকে মুক্তির আদেশ পাওয়ার পর তিনি নতুনভাবে নিজের অবস্থানের ক্ষেত্র নির্ধারণের চিন্তাভাবনা শুরু করেন। ইতঃপূর্বে তিনি নিজ দেশ ত্যাগ করে ২১ বছর বয়সে মদিনায় বসবাস শুরু করেছিলেন। সেখানে বসবাস করার কিছুটা ব্যবস্থা থাকলেও কারাগারে আসার পর তা লুণ্ঠিত হয়ে যায় এবং তার পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান সবাই মৃত্যুবরণ করেছিল।[65] তখন তার বয়স হয়েছিল ৪১। তিনি জীবনের অবশিষ্টাংশ মসজিদে নববীতে হাদিস চর্চার কাজে অতিবাহিত করার মনঃস্থ করলেন। সে মোতাবেক তিনি মুম্বইয়ে আসার পর স্থায়ীভাবে মদিনায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।[66] কিন্তু তার এই ইচ্ছা মাহমুদ হাসান দেওবন্দির কাছে ব্যক্ত করলে দেওবন্দি তাতে অনুমতি দেন নি।[67]
ভারতে প্রত্যাবর্তনকালে সুয়েজ অতিক্রম করার সময় দেওবন্দির কাছে এ মনোভাব ব্যক্ত করলে উত্তরে দেওবন্দি বলেন, “আমি বুখারী শরীফের ‘তারাজিমুল আবওয়াব’ এর ভাষ্য রচনা করতে ইচ্ছুক। এ কাজ আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়।[67] দেওবন্দি ঐ শর্ টির কথা পরে বলেন নি। বলে থাকলেও মাদানি কোথাও তা উল্লেখ করেননি।
তিনি দেওবন্দির সঙ্গে তারাজিমের কাজ করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু মুম্বাই পৌছার পর তিনি দেখলেন ভারতে খিলাফত আন্দোলনের তােড়জোর চলছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দেওবন্দিকে ঘিরে রেখেছেন এবং দেওবন্দিও স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজকর্মের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছেন। এমতাবস্থায় তারাজিমের কাজ শীঘ্র শুরু করা আদৌ সম্ভব হবে না অনুমান করে তিনি দেওবন্দিকে আবারাে মদিনার চলে যাওয়ার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেন। উত্তরে দেওবন্দি শরিফ সরকারের আমলে কোনোক্রমেই তার মদিনায় ফিরে যাওয়া উচিত হবে না বলে মন্তব্য করেন।[68]
দেওবন্দে পৌছার পর মাহমুদ হাসান দেওবন্দির পূর্ণ সময় ও পূর্ণ মনােযােগ স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজে নিবেদিত দেখে তিনিও নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ভারতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।[69]
ভারতে আসার পর মাহমুদ হাসান দেওবন্দি রাজনীতিতে পূর্ণ মনোনিবেশ করেন। তখন মাদানি তার অন্যতম সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে আমরুহা মাদ্রাসার পরিচালক হাফেজ জাহিদ হাসান মাদানিকে তার মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদানের অনুরোধ করেন। দেওবন্দি অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাদানিকে শিক্ষকতা করার অনুমতি প্রদান করেন।[70] শিক্ষকতা শুরুর পর মাদানি তৃতীয় বিবাহের কাজ সম্পন্ন করেন। ইতঃপূর্বে তার দুই স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেছিল। শিক্ষকতা শুরুর ২ মাসের মাথায় দেওবন্দি মাদানিকে তার নিকট চলে আসার নির্দেশ দেন। সংবাদ পেয়ে মাদানি তার সাথে দেখা করেন এবং আমরুহা মাদ্রাসায় তার পদে বিকল্প ব্যবস্থা করার জন্য ১ মাস সময় নিয়ে যান। ঐ সময় মাহমুদ হাসান দেওবন্দি তাকে নিয়ে পুরো ভারত সফর করার মনঃস্থ করেন। এরই মধ্যে দেওবন্দি জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার উদ্বোধনের জন্য আলিগড়ে আগমন করেন এবং মাদানিকে তার সাথে আলীগড় সম্মেলনে মিলিত হওয়ার আদেশ দেন।[70]
এ সম্মেলনের পর দেওবন্দি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে চিকিৎসা করার জন্য দিল্লি নেওয়া হলে মাদানিও তার সাথে দিল্লিতে যান। তখন দিল্লিতে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের ২য় বার্ষিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। অসুস্থতা নিয়ে দেওবন্দি সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন এবং জাতির উদ্দেশ্যে সর্বশেষ বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তব্যে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করার নির্দেশ দেন।[71]
ঐদিকে খিলাফত আন্দোলনের কলকাতা শাখার সভাপতি আবুল কালাম আজাদও স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেগবান করার লক্ষ্যে শহরের নাখোদা মসজিদে একটি জাতীয় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। আজাদ মাহমুদ হাসান দেওবন্দিকে সেই মাদ্রাসার প্রধান হওয়ার অনুরোধ করেন। দেওবন্দি বার্ধক্যে উপনীত হওয়ায় সে অনুরোধ পালন করতে পারেন নি।[72] অনেক যাচাই বাছাইয়ের পর মাহমুদ হাসান দেওবন্দি মাদানিকে সেই পদে যোগদানের নির্দেশ দেন।[73][74]
মাদানি কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করলে পথিমধ্যে আমরুহায় যাত্রা বিরতি করতে বাধ্য হন। সেখানে শিয়া-সুন্নি বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছিল। মুহাম্মদ আলি জওহরের মত জনপ্রিয় নেতাও তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন নি। ফলে খলিল আহমদ সাহারানপুরির অনুরোধে তিনি সেখানে একদিন যাত্রা বিরতি করেন।[74] তিনি সেখানে শিয়া-সুন্নি প্রসঙ্গে না গিয়ে সবাইকে ব্রিটিশদের অত্যাচারের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং দেশ স্বাধীন না হলে ধর্ম টিকবে না বলে বক্তব্য দেন। তার এই বক্তব্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। পরদিন কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলে পথিমধ্যে মাহমুদ হাসান দেওবন্দির মৃত্যু সংবাদ পান। ফলে কলকাতা না গিয়ে তিনি দেওবন্দে চলে যান।[75]
দেওবন্দির মৃত্যুর পর দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ তাকে কলকাতা না গিয়ে দেওবন্দে থাকার পরামর্শ দেন, দারুল উলুম দেওবন্দে শিক্ষকতার জন্যও তার প্রয়োজন ছিল। তিনি দেওবন্দির জীবদ্দশায় তার নির্দেশকে অলঙ্ঘনীয় মনে করতেন। তাই সবার পরামর্শ গ্রহণ না করে কলকাতায় চলে যান এবং মাহমুদ হাসান দেওবন্দির মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প করেন।[76]
দেওবন্দির মৃত্যুর পর মাদানি তার স্থলাভিষিক্ত হন। দেওবন্দির পরিবার, ছাত্র-শিষ্য ও ভক্তরা সবাই তাকে “জানাশীনে শায়খুল হিন্দ” উপাধিতে ভূষিত করে।[77] পত্র-পত্রিকায় তার নামের পূর্বে এই শব্দটার অবশ্যই উল্লেখ থাকত।[78]
১৯২০ সালের ডিসেম্বরে মাদানি কলকাতায় পৌছেন। এখানে আবুল কালাম আজাদ ও মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর উপস্থিতিতে নতুন মাদ্রাসার ভিত্তি স্থাপিত হয়।[79] তিনি এই মাদ্রাসায় হাদিস, তাফসীর ও ইসলামি শিক্ষার অধ্যাপনা শুরু করেন। এখান থেকেই তার পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়। তিনি খিলাফত আন্দোলন ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভায় প্রধান অতিথি কিংবা সভাপতি হিসেবে অংশগ্রহণ করতেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসে যোগদান করেন।[80] এই ব্যপারে তিনি বলেন,
“ | আমি মাল্টা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর নিয়মতান্ত্রিক ভাবে কংগ্রেসের সদস্যপদ গ্রহণ করি এবং স্বাধীনতার কাজে নিজেকে জড়িত রেখে সর্বদা দেশবাসীর জেল-জুলুমের কষ্টও বরণ করতে থাকি। | ” |
— [80] |
এই সময়ে তিনি রাজনীতিতে প্রথম সারির নেতৃত্বে চলে আসেন। মদিনায় অবস্থানরত তার দুই ভাই তাকে মদিনায় চলে আসার অনুরোধ করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ভারতেই থেকে যান। কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি সিলেটের মৌলভীবাজারে একই সময়ে অনুষ্ঠিত জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ ও খেলাফত অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।[81] ১৯২১ সালের ২০-২১ ফেব্রুয়ারি ভারতের সিউহারায় খেলাফত আন্দোলন ও জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের একইস্থানে উভয়ের বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন এবং তৎকালীন ভারতে ইংরেজদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিপীড়নের অবস্থা উপস্থাপন করেন।[82] একই বছর ২৫ মার্চে রংপুরের মহিমাগঞ্জে “আঞ্জুমানে উলামায়ে বাঙ্গাল” কর্তৃক আয়োজিত মহাসম্মেলনে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেমসমাজের কর্তব্যের বিবরণ দেন এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানান। তিনি তৎকালীন অবস্থায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা অত্যাবশ্যক বলে মন্তব্য করেন।[83]
১৯২১ সালের ৮-৯ জুলাই মুহাম্মদ আলি জওহরের নেতৃত্বে করাচিতে অনুষ্ঠিত “অল ইন্ডিয়া খেলাফত কনফারেন্সে” তিনি ভারতবর্ষকে স্বাধীন ও শৃঙ্খলমুক্ত করার প্রয়োজনীতা ব্যাখ্যা করেন।[84] এই সম্মেলনে তিনি ইংরেজ সরকারের সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীতে চাকরি করা হারাম ঘোষণা করেন। পরবর্তী নেতারা তাদের বক্তব্যে এই ফতোয়ার উপর সমর্থন দিয়ে বক্তব্য দেয়।[85] পরবর্তীতে এটি আরও কয়েকজন বড় আলেমের স্বাক্ষর সহ ফতোয়া আকারে মুদ্রিত হলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তার এই ফতোয়াকে বৃটিশ সরকার উস্কানিমূলক ও সহিংস প্রস্তাব আখ্যা দিয়ে তা বাজেয়াপ্ত করে এবং ৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।[84]
সম্মেলনের আড়াই মাস পর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে আসে, তখন মাদানি দেওবন্দে অবস্থান করছিলেন। দিনভর পুলিশ ও সাধারণ জনতার সংঘর্ষ চলার পর সন্ধ্যার দিকে তিনি স্বেচ্ছায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন।[86] করাচির ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট “খালেকদীনা” হলে অভিযুক্তদের উপস্থিত করে জেরা করা হয়। মাদানিকে জেরা করা হলে তিনি লিখিত বক্তব্যে এর জবাব দিবেন বলে জানান। পরবর্তীতে তার ১৬ পৃষ্ঠার এই বক্তব্যটি “বেনজীর পহেলা বয়ান” শিরোনাম প্রকাশিত হয়। এই বক্তব্যে তিনি কুরআনের ৯টি আয়াত এবং ৩৪টি সহিহ হাদিস সহ কালাম শাস্ত্রের গ্রন্থগুলির উদ্ধৃতি দেন।[87]
তিনি এই বক্তব্যে তার দুটি পরিচয়: মুসলমান ও আলেম তুলে ধরেন বলেন, “প্রথমত আমি মুসলমান হিসেবে কুরআন হাদিসের কথা আমার মানতে হবে। দ্বিতীয়ত আলেম হিসেবে কুরআনের হক কথা মানুষদের জানাতে হবে”। এরপর তিনি তার ফতোয়ার পক্ষে এবং বৃটিশের দুঃশাসন নিয়ে কথা বলেন। সর্বশেষে ইসলামের জন্য তিনি সর্বপ্রথম শহীদ হবেন বলে উল্লেখ করেন।[88]
তার এই বক্তব্যে “খালেকদীনা” হলে মারহাবা, মারহাবা ধ্বনি উচ্চারিত হয় এবং মুহাম্মদ আলি জওহর সম্মুখ অগ্রসর হয়ে তার পদ চুম্বন করেন।[89] জবানবন্দির পর মামলাটি নিম্ন কোর্ট থেকে স্থানান্তর করে সেশন কোর্ট জুডিশিয়াল কমিশনারের হাতে ন্যস্ত করা হয়। এখানেও তিনি আরো বিস্তারিতভাবে পূর্বের বক্তব্য তুলে ধরেন। যা “দেলীরানা ওয়া শুজাআনা দুসরা বয়ান ” নামে পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়। তার এই বক্তব্য আদালতে উপস্থাপন করা হলে তাকে ২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।[88]
মাল্টা থেকে মুক্তির ১৫ মাস পর তার আবার কারাবরণ শুরু হয়। তিনি পূর্বের ন্যায় জেলেও বিভিন্ন অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে আপত্তি জানান। যেমন: শুধু হাটু পর্যন্ত পায়জামা পড়তে দেয়া, তল্লাশীকালে উলঙ্গ করে ফেলা, উচ্চ আওয়াজে আজান দিতে নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি। তার এই প্রতিবাদের কারণে তাকে অতিরিক্ত শাস্তি প্রদান করা হত। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এই অতিরিক্ত শাস্তির বিরুদ্ধে "ইয়ং ইন্ডিয়া" পত্রিকায় প্রতিবাদ জানান, ফলে অতিরিক্ত শাস্তি মওকুফ করা হয় এবং দাবিসমূহ মেনে নেয়া হয়।[90] তিনি বন্দি অবস্থাতেও সেখানে বিভিন্ন ইসলামি ও আধ্যাত্মিক সাধনা অব্যহত রাখেন। জেলখানায় মুহাম্মদ আলি জওহর তার কাছে তাফসীর অধ্যয়ন করেন।[91]
দুই বছর পর তিনি ১৯২৩ সালের অক্টোবর মাসে মুক্তিলাভ করেন। তার জন্য বিভিন্ন জায়গায় সংবর্ধনার আয়োজন করা হলেও তিনি সংবর্ধনায় অংশ নেন নি।[92]
তার মুক্তির আগের বছর ১৯২২ সালে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের উসমানীয় খিলাফতের খলিফা ৬ষ্ঠ মুহাম্মদকে পদচ্যুত করেছিলেন। তার আহ্বানকৃত আন্দোলনটিও প্রায় নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছিল। তিনি মুক্তির পর আন্দোলনটিতে পুনরায় জনসাধারন এবং আলেমগণকে উৎসাহিত করতে থাকেন। এক সময় চৌরী-চৌরা ঘটনায় রাগান্বিত হয়ে জনতা থানায় অগ্নিসংযোগ করে, যার ফলে ১২জন পুলিশ অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হন। এই ঘটনার কারণে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু মাদানি তার আন্দোলন অব্যহত রাখেন।[93]
১৯২৩ সালে মুক্তির পর তার জন্য কর্মসংস্থান আবশ্যক হয়ে পড়ে। ইতঃপূর্বে কলকাতা মাদ্রাসায় চাকরি করলেও দীর্ঘ সময় কারাবাস করায় তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।[94] তার আবাসনেরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাকে বিভিন্ন জায়গা থেকে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং একই সঙ্গে আন্দোলন থেকে বিরত থাকার শর্তও প্রদান করা হয়। কাউন্সিল অব বেঙ্গল থেকে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন ৪০ হাজার টাকা অগ্রিম ও মাসিক ৫০০ টাকা দিয়ে অধ্যাপনার আমন্ত্রণ জানানো হয়।[95] এরকম আরেকটি প্রস্তাব আসে মিশর সরকারের পক্ষ থেকে যেখানে তাকে মাসিক ১ হাজার টাকায় আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শায়খুল হাদিস পদ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।[95]
সিউহারার কাজী জহুরুল ইসলাম তার দারিদ্র্য দেখে তৎকালীন হায়দ্রাবাদের নিযাম সরকারের সাথে যোগাযোগ করে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত ভাতার ব্যবস্থা করার উদ্যােগ নেন। তৎকালীন ভারতের বিভিন্ন আলেম, কবি-সাহিত্যিক নিযাম সরকার কর্তৃক ভাতাপ্রাপ্ত ছিলেন। তবে মাদানি এই ভাতাকে "লজ্জাজনক" মন্তব্য করে তা প্রত্যাখ্যান করেন।[96]
সিলেটে অবস্থিত তার অনুসারিগণ তার অধ্যাপনায় মুগ্ধ হয়ে তাকে সিলেটে আগমনের প্রস্তাব দেন যেন সেখানকার ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন করতে পারেন।[97] কেননা তখন উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা বা আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হত।[98] তাই তারা মাদানিকে লিখেছিলেন,
সুবা আসাম ও বঙ্গদেশে তিন কোটি মুসলমান বসবাস করে। কিন্তু এখানে মুসলমানদের শিক্ষাগত অবস্থা খুব নিম্নমানের। বিশেষতঃ ধর্মীয় ও ইলমে হাদিসের শিক্ষাব্যবস্থা খুবই দুর্বল। তাই আপনাকে একবার এখানে এসে অবস্থান করা এবং সিহাহ সিত্তাহর পাঠদান করা আবশ্যক। যার মাধ্যমে আমরা হাদিস অধ্যয়ন করতে পারব।[99]
অন্য জায়গা থেকে তার কাছে শিক্ষকতার প্রস্তাব আসলেও সিলেটিদের পীড়াপীড়ির কারণে তিনি ২ বছরের জন্য সিলেটে আগমন করেন।[100]
১৯২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি সিলেটে আগমন করেন এবং মানিক পীরের টিলা মহল্লায় নয়া সড়ক মসজিদের নিকট অবস্থিত "খেলাফত বিল্ডিং মাদ্রাসায়" শিক্ষকতা শুরু করেন।[101] দৈনিক পাঁচ ঘণ্টার ক্লাসে তিনি শারহু নুখবাতিল ফিকার, আল ফাওযুল কাবীর, জামি তিরমিজি ও সিহাহ সিত্তার প্রভৃতি গ্রন্থ পাঠদান করতেন। তিনি এখানে তাসাউফের কাজও চালিয়ে যান।[102]
তার জীবনে তাসাউফের কাজ প্রধানত সিলেটেই সম্পাদন করেন।[103][104] এছাড়া নানা সমাবেশে বক্তৃতাও দিতেন। ৩ বছর পর তার প্রত্যাবর্তনকালে অনুসারীদের তিনি প্রতি রমজান মাসে সিলেট আগমনের অঙ্গীকার করেন এবং ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত তা পালন করেন।[105]
১৯২৩ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত ভারতে চরম রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। হিন্দু-মুসলমান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা আত্মদ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে, ফলে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক ঐক্য প্রায় ভেঙে গিয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলনকারী প্রায় ২০ হাজার বন্দি থেকে কতিপয় বন্দিকে বিনা শর্তে মুক্তি দেয়া হলে তারা রাজপুতনার সদ্য ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হিন্দুদেরকে পুনরায় হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করা শুরু করে। এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অপরদিকে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম রক্ষার্থে মুসলমানরা দিল্লিতে 'তাবলীগ' ও পাঞ্জাবে 'তানযিম' নামে দু'টি সংগঠন গড়ে তোলে। তবে খিলাফত ও কংগ্রেসপন্থী বেশিরভাগ নেতাই ধর্মীয় বৈষম্যরোধে হিন্দু-মুসলিম কোনো সংগঠনেই যোগদান করেন নি। মাদানি মুক্তিলাভের পর এই ধর্মীয় বৈষম্যকে স্বাধীনতা আন্দোলনরোধে "ইংরেজদের ষড়যন্ত্র" বলে দাবি করেন। সিলেট অবস্থানকালে ধর্মীয় বৈষম্য করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান করেন।[103] তখন বাদশাহ সৌদের নামে চলমান সমালোচনার ব্যাপারে তিনি বলেন, যেহেতু তার কুফুরির প্রমাণ পাওয়া যায়নি, সেহেতু তাকে কাফের জ্ঞান করা অনুচিত এবং যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো শরিয়ত বিরোধী আইন জারি না করেন, ততক্ষণ তার অনুসরণ করা আরবদের উপর আবশ্যক।[106]
১৯২৮ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ কর্তৃপক্ষের জরুরি নির্দেশনার কারণে সিলেট থেকে দেওবন্দে গমন করেন এবং সেখানে ‘সাদরুল মুদাররিস’ (প্রধান অধ্যাপক) পদে যোগদান করেন।[107]
১৯২৮ সালে মাদানি যখন দারুল উলুম দেওবন্দে আসেন, তখন মাদ্রাসার অভ্যন্তরীন কিছু মতানৈক্য চলছিল। যার মূল বিষয়টি ছিল, আনোয়ার শাহ কাশ্মীরির প্রশাসনিক বিষয়াদিতে মতামত প্রদানের অধিকার নিয়ে। এই মতানৈক্য ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেলে এক পর্যায়ে কাশ্মীরি অনুসারীদের নিয়ে মাদ্রাসা ত্যাগ করেন।[108] পরবর্তীতে তিনি সব দাবি মেনে নেয়ার শর্তে মাদ্রাসায় প্রত্যাবর্তন করলেও তার অনুসারীদের অনুরোধে তিনি পুনরায় মাদ্রাসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন নি।[109] এমতাবস্থায় মাদানি বাধ্যতাপূর্বক মজলিশে শূরার ১৯টি শর্তে "সদরুল মুদাররিসিন" পদ গ্রহণ করেন।[110] যেহেতু আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি খিলাফত আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র ছিলেন, সেহেতু এই মতানৈক্যের সূত্র ধরে এই ধারনার জন্ম নেয় যে, দারুল উলুম দেওবন্দ খিলাফত আন্দোলন-বিরোধী মনোভাবধারী।[111] পরবর্তীতে এই সংবাদ প্রকাশিত হয় যে, মাদ্রাসার অবস্থা স্থিতিশীল পর্যায়ে রয়েছে। তারীখে দারুল উলুম দেওবন্দ গ্রন্থে বলা হয়েছে, মাদানি সদরুল মুদাররিসের দায়িত্ব পাবার পর মাদ্রাসার ছাত্র সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। ১৩৪৬ থেকে ১৩৭৭ হিজরি পর্যন্ত আনুমানিক ৩২ বছর যাবত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন।[112] তার দায়িত্বাধীন অবস্থায় হাফেজ মুহাম্মদ আহমদ ও হাবিবুর রহমান উসমানি মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে মুহতামিম নিযুক্ত হন কারী মুহাম্মদ তৈয়ব। তিনি তার কাছেও পূর্বের ১৯টি শর্ত মঞ্জুর করে নেন।[113]
১৮০৩ সালে সূচিত আলেমদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নীতি রেশমি রুমাল আন্দোলন পর্যন্ত ছিল সশস্ত্র বিপ্লব।[114] তবে মাহমুদ হাসান দেওবন্দি মাল্টা থেকে মুক্তির পর এই নীতির পরিবর্তন ঘটে। তিনি প্রস্তাব দেন যে, সরকারকে যদি জনগণের পক্ষ থেকে কোন সহযোগিতা প্রদান করা না হয়, তবে সরকার স্বেচ্ছায় পদচ্যুত হতে বাধ্য হবে। কেননা জনসাধারণের সর্বাত্মক সহযোগিতা ব্যাতিরেকে কোন সরকার ব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারবেনা। তার এই নীতি গ্রহণের ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু, মুসলিম, আলেম ও দেশীয় রাজনীতিবিদের মাঝে অনেকাংশে ঐক্য স্থাপন হয়।
দেওবন্দি, মাদানি এবং তাদের অনুসারীগণ মুক্তিলাভের পর তৎকালীন ভারতীয় রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও খেলাফত কমিটিতে যোগদান করেন। দেওবন্দি জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের বার্ষিক অধিবেশনে বলেছিলেন, মুক্তির জন্য হিন্দু, মুসলিম ও শিখদেরকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করতে হবে।[115] মুক্তির ৫ মাস পর মাহমুদ হাসান দেওবন্দি মৃত্যুবরণ করলে মাদানি তার স্থলাভিষিক্ত হন এবং আন্দোলন অব্যহত রাখেন।
মাদানি সশস্ত্র বিপ্লবের শেষ দিকে মদিনা থেকে স্বাধীনতার কার্যক্রমে সংযুক্ত হন। তারপর ভারতে এসে পরিস্থিতি মোতাবেক অসহযোগ নীতির আন্দোলন শুরু করেন। দেওবন্দির মৃত্যুর পর প্রধানত তিনিই সিপাহসালারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তার সক্রিয় উদ্যোগে খিলাফত আন্দোলন ১৯২১ সালে দেশজুড়ে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছিল। মুসলিম-অমুসলিম এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করায় একটি বৃহৎ ঐক্য গড়ে উঠে, যা ব্রিটিশ সরকারের জন্য স্বস্তির ছিল না। ফলশ্রুতিতে মাদানি ও মুহাম্মদ আলি জওহর সহ প্রমুখ নেতাকে ২ বছরের জন্য করাচির জেলে আটক করে রাখা হয়।[116]
ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের জন্ম হয়েছিল। ১৯২৩ সালেই কোকনাদ অধিবেশনে জমিয়ত এ দাবীর স্পষ্ট ঘােষণা প্রদান করে। মাদানির সভাপতিত্বে এ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি করাচির জেলে ২ বছরের কারাভােগ থেকে মুক্তি পেয়ে সম্মেলনে যােগ দেন। ভাষণ শেষে জমিয়তের পক্ষ থেকে তিনি এ সময়ে তাদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হিসেবে ব্রিটিশ অপকৌশলসমূহের পূর্ণ শক্তি দিয়ে মােকাবেলা করা এবং এই মােকাবেলাকে নিজেদের প্রধান উদ্দেশ্য ও আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার ঘােষণা দেন।[117]
ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে যাওয়ায় ১৯২১ সালে শুরু হওয়া গণজোয়ার অব্যহত রাখা সম্ভব হয়নি। ১৯২৩ সাল থেকে সূচিত সাম্প্রদায়িক হানাহানি ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পরিবেশ সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে দেয়। জমিয়তে উলামা তখন সাম্প্রদায়িক ঐক্য ফিরিয়ে আনা এবং জনগণকে স্বাধীনতার মূল চেতনা ও দাবীর দিকে নিয়ে যাওয়ার সার্বিক চেষ্টা চালিয়ে যান।
১৯২৭ সালে সাইমন কমিশনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ক্রমে সম্প্রীতির পরিবেশ ফিরে আসে। কমিশন বয়কটের ব্যাপারে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও জমিয়তে উলামা সকলে ঐকমত্য হয়ে কাজ করেন। পেশাওয়ারে আনোয়ার শাহ কাশ্মীরির সভাপতিত্বে জমিয়তে উলামা এবং কলকাতা অধিবেশনে খেলাফত কমিটি কমিশন বয়কটের প্রস্তাব পাস করে। মাদানি কমিশন বয়কটের দাবী নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান সফর করে জনমত গঠন করেন। তার বক্তব্য ছিল, দেশ আমাদের, সমস্যা আমাদের, জনগণ আমাদের, অথচ আইন রচনা ও আইনের সংস্কার করবে ইংরেজ–এটি কখনাে হয় না, হতে পারে না।[118]
সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে ১৯২৭ সালের ২০ মার্চ দিল্লিতে মুহাম্মদ আলি জওহরের উদ্যোগে এবং মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে ৩০ জন মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক সম্মেলন আহূত হয়। সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবগুলাে ‘দিল্লি প্রস্তাব’ নামে পরিচিত।[119] মুসলিম নেতৃবৃন্দ প্রস্তাবগুলাের সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করেন। ঐ বছর ডিসেম্বরে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে কংগ্রেসও প্রস্তাবগুলাের স্বতঃস্ফুর্ত মঞ্জুরী দেয়।[120]
ভারত সচিব লর্ড বার্কেন হেড দু’বার ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে সকল রাজনৈতিক দলের গ্রহণযােগ্য একটি সংবিধান রচনার চ্যালেঞ্জ করলে ১৯২৮ সালে মতিলাল নেহেরুর সভাপতিত্বে সাংবিধানিক সংস্কারের একটি প্রস্তাবনা গৃহীত হয়, যা নেহরু রিপোর্ট নামে পরিচিত।[121] ঐ রিপোর্টে দিল্লি প্রস্তাবগুলাে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়। এটি চূড়ান্ত মঞ্জুরী লাভের জন্য ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় সর্বদলীয় সম্মেলন আহ্বান করা হয়। সম্মেলনেও জিন্নাহর দিল্লি প্রস্তাবের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা হয় নি। ফলে জিন্নাহর সাথে কংগ্রেসের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। কলকাতার সর্বদলীয় অধিবেশনের ১ বছর পরই ১৯২৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর লাহােরে জওহরলাল নেহেরুর সভাপতিত্বে কংগ্রেসের অধিবেশন বসে। অধিবেশনের নেহরু রিপোর্ট রহিত করে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গৃহীত হয়। নেহরু রিপাের্ট রহিত হলেও এটি ভারত বিভক্তির একটি ভিত্তি স্থাপন করে গিয়েছিল।[122]
কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব পাস করলে জমিয়ত ও কংগ্রেসের মধ্যে সাংগঠনিক সম্প্রীতির পরিবেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে। এভাবে রাজনৈতিক প্রধান দাবীর ক্ষেত্রে উভয়ের ঐক্য সৃষ্টি হওয়ায় সংগঠনদ্বয়ের যুক্ত কর্মসূচি শুরু হয়। ১৯৩০ সালের মে মাসে মাদানির সভাপতিত্বে আমরূহায় জমিয়তের বার্ষিক অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে হিফজুর রহমান সিওহারভির প্রস্তাব ক্রমে জমিয়ত সাংগঠনিকভাবে কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে এবং প্রস্তাব পাস করে যে, জমিয়তের নেতৃত্বে মুসলমানগণ স্বাধীনতার যুদ্ধে জাতীয় কংগ্রেসের সাথে যুক্ত হয়ে একজোটে কাজ করবে।[123] কর্মসূচির ঐক্য স্থাপিত হওয়ায় ঐ বছরই জমিয়ত ও কংগ্রেসের যৌথ আহবানে ইংরেজের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়।
দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৩২ সালে কংগ্রেস ও জমিয়তের যৌথ নেতৃত্বে পুনরায় আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়। ইংরেজ সরকার প্রচণ্ড দমননীতি অবলম্বন করলে উভয় সংগঠনকে বেআইনী ঘােষণা করে কাগজপত্র ও তহবীল বাজেয়াপ্ত করা হয়। জমিয়তে উলামা তখন নিজের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার প্রয়ােজনে কার্যনির্বাহী পরিষদ বাতিল করে তদস্থলে একটি ‘অ্যাকশন কমিটি’ গঠনপূর্বক ধারাবাহিক অধিনায়ক নিযুক্ত করে। তন্মধ্যে ৩য় অধিনায়ক মনােনীত হন মাদানি। ১ম এবং ২য় অধিনায়ক ছিলেন যথাক্রমে কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি ও আহমদ সাঈদ। এ সকল অধিনায়কের নাম গােপন রাখা হয়েছিল যেন ইংরেজরা সকলকে একসাথে গ্রেফতারের সুযােগ না পায়। অধিনায়কমণ্ডলী আন্দোলনের ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে একজন গ্রেফতার হলে পরবর্তী জন আপনা থেকেই নেতৃত্বের ঝাণ্ডা হাতে তুলে নিতেন।[124] প্রথম ২ জন গ্রেফতার হওয়ার পর ৩য় অধিনায়ক মাদানি নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি শুক্রবার জুমার নামাজের পর দিল্লি জামে মসজিদে বক্তব্য দানের উদ্দেশ্যে দেওবন্দ থেকে রওয়ানা হন। পথিমধ্যেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি ব্যাপারটি পূর্বেই উপলব্ধি করে নিজের বক্তব্য একখানা কাগজে লিপিবদ্ধ করে রাখেন। মজঃফরনগর স্টেশন থেকে তাকে গ্রেফতার করে তুলে নেওয়ার মুহূর্তে তিনি ঐ কাগজটি দিল্লি জামে মসজিদে তার পক্ষ থেকে পড়ে শােনানাের জন্য আবুল মুহাসিন মুহাম্মদ সাজ্জাদের নিকট পাঠিয়ে দেন। করাচির জেল থেকে মুক্তির পর এটি ছিল তার তৃতীয়বারের মত কারাবরণ।[125]
১৯৩২ সালের হিন্দু–মুসলিমের পৃথক নির্বাচন নীতি বহাল ও গভর্ণর কিংবা ভাইসরয়ের জন্য চূড়ান্ত রায় প্রদানের অধিকার সংরক্ষিত রেখে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন ১৯৩৫ পাস করে। এ আইনে ভারতীয়দের প্রদেশে ও কেন্দ্রে বিধানসভা ও মন্ত্রিপরিষদ গঠনের সুযোগ করে দেয়।[126] মন্ত্রিত্বের সুযোগ প্রাপ্তি রাজনীতিকদের এই আইন দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। জমিয়ত ও কংগ্রেস উভয়ই নির্বাচনে অংশগ্রহণে অসম্মতি জানায়। জিন্নাহ এর প্রাদেশিক বিধানগুলো সমর্থন করে অবশিষ্ট বিধানের নিন্দা করেন। কিন্তু কংগ্রেস ১৯৩৬ সালে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে নির্বাচনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে মুসলিম লীগও নির্বাচনে যোগ দেয়।[126]
মুসলমানদের সমর্থন পাওয়ার জন্য মুসলিম লীগের আলেমদের সমর্থন প্রয়োজন ছিল। নির্বাচন সফল করার লক্ষ্যে ওই বছর মার্চে দিল্লিতে মুসলিম নেতৃবৃন্দের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয় যে সকলেই মুসলিম লীগের নির্বাচনী বোর্ড থেকে নির্বাচনে লড়াই করবে, আলাদা কোনো পার্লামেন্টারি বোর্ড খুলবে না। জিন্নাহকে বোর্ড গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয় কিন্তু শর্ত দেওয়া হয় জাতিসংগঠক দলগুলোর সদস্যরা সংখ্যাগুরু থাকবে। মাদানি জরুরি কাজে দিল্লির বাইরে ছিলেন বিধায় মিটিংয়ে অংশ গ্রহণ করতে পারেননি। এতদসত্ত্বেও জিন্নাহ ও অন্যান্য নেতারা ঐক্যের ব্যাপারে মাদানির সম্মতি অত্যাবশ্যক মনে করেন। ফলে মাদানিকে টেলিগ্রাফ করে আনা হল এবং স্থানীয় একটি হােটেলে কয়েকজন নেতার সাথে দীর্ঘ আলোচনার আয়োজন করা হল। জিন্নাহ মাদানিকে আশ্বস্ত করেন যে, নির্বাচিত হওয়ার পর সকলে মিলে একযােগে স্বাধীনতা আন্দোলন ঝাঁপিয়ে পড়বেন। আর বর্তমান পার্লামেন্টারী বাের্ড এমনভাবে গঠন করবেন, যেন বিপ্লবের মন-মানসিকতা সম্পন্ন লােকের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। এ আলােচনার পর জমিয়তের সকলে লীগের পতাকাতলে একজোট হয়ে কাজ শুরু করেন। অঙ্গীকার অনুযায়ী জিন্নাহ জমিয়তের ২০ নেতা সহ মোট ৫২ জন নিয়ে বোর্ড গঠন করেন।[127]
মাদানি দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ২ মাসের ছুটি নেন এবং গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে মানুষের কাছে লীগের আহ্বান পৌছিয়ে দেন।[128] লীগ নির্বাচনে মুসলিম জনসাধারণের ৮০ শতাংশ ভোট কুড়িয়ে আনতে সক্ষম হয়। তাছাড়া নিজেকে মুসলমানদের অন্যতম রাজনৈতিক দলের মর্যাদায় উপনীত করে। এ প্রসঙ্গে মাদানি বলেন,
“ | আমরা লীগের পূর্ণ সহযােগিতা করি। আমি নিজে দারুল উলুম থেকে ২ মাসের ছুটি নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় আত্মনিয়ােগ করি। আমাদের প্রচেষ্টার ফলে মুসলমানদের মধ্যে এগ্রিকালচারিস্ট পার্টিসহ অন্যান্য তাবেদার দলগুলাের ব্যাপক পরাজয় ঘটে। প্রায় ৩০-এর অধিক প্রার্থী লীগ থেকে জয়লাভ করেন। এরই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখেন যে, আপনি ৩০ বছরের মৃত মুসলিম লীগকে নতুনভাবে জীবন্ত করে দিয়েছেন। | ” |
— [129] |
কিন্তু নির্বাচন বৈতরণী অতিক্রান্ত হওয়ার পর জমিয়ত ও লীগ নেতাদের মধ্যে ক্রমে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। বিজয়ের পর লীগ নেতাদের কাছে স্বাধীনতার আওয়াজ ক্রমে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে এবং মন্ত্রিত্ব অর্জনের ব্যাপারটি মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়।[130] নির্বাচনে লীগ মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও সামগ্রিকভাবে সমস্ত দেশে গরিষ্ঠ সংখ্যক আসনের অধিকারী ছিল কংগ্রেস। তাই ভাইসরয় আগে কংগ্রেসকেই সরকার গঠনের আহ্বান জানান। সরকার গঠনকে কেন্দ্র করে লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমে তিক্ততার দিকে চলে যায়।[131]
মন্ত্রিত্বের ভাগাভাগি নিয়ে কংগ্রেসের সাথে লীগের যেই বিরােধ ঘটেছিল সেটি শেষ পর্যন্ত উভয় দলের রাজনৈতিক মৌলিক আদর্শকেও বিঘ্নিত করে। নির্বাচনে জমিয়তের সাহায্য করার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল লীগকে বিপ্লবী দলে পরিণত করা। তারা মনে করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী স্বাধীনতা সংগ্রামের রণক্ষেত্রে কংগ্রেস তাে আছেই, যদি লীগকেও সংগ্রামী ও বিপ্লবী দলে পরিণত করা যায় তাহলে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় স্বাধীনতা অর্জন খুব সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর পরিস্থিতি বিগড়ে এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌছল যে, লীগের প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়াল কংগ্রেস। ফলে জমিয়ত স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেগবান করার যেই উদ্দেশ্যে লীগের সমর্থন করেছিলেন সেটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় লীগের প্রতি তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখে নি।[132]
অন্যদিকে নির্বাচনের পরে লীগের পার্লামেন্টারী বাের্ড ও ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা ১৩ মার্চ লখনউতে ১ম অধিবেশনে বসেন। অধিবেশনে জিন্নাহ ইংরেজ ঘনিষ্ঠ দল এগ্রিকালচারিস্ট পার্টি ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টি থেকে বিজয়ী মুসলিম সদস্যদেরকে নিজ দলে ভিড়ানাের তদবীর শুরু করেন। নির্বাচনের পূর্বে ঐ সকল সদস্য লীগের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল। জিন্নাহ ঐ সদস্যদের প্রতি অধিক মনােযােগ প্রদান করলে মাদানি তাকে স্মরণ করিয়ে বলেছিলেন, আপনি ইতঃপূর্বে আমাদের ওয়াদা দিয়েছিলেন যে, আপনি স্বার্থপূজারী ও তাবেদার লােকদের লীগ থেকে সরিয়ে দিবেন এবং জাতি সংগঠক ও প্রগতিশীল লােকজনকে অন্তর্ভুক্ত করবেন। উত্তরে জিন্নাহ বললেন, সেটা তো আমার রাজনৈতিক ওয়াদা।[133]
কংগ্রেসের সাথে লীগের উপরােক্ত মনােমালিন্যের পর লীগের রাজনৈতিক পলিসি বদলে যায়। ১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল কংগ্রেস নতুন আইন প্রয়ােগের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী হরতালের ঘােষণা দেয়। জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ হরতালের সমর্থন করে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাতে লীগ খুবই অসন্তুষ্ট হয়। লীগ থেকে তখন হরতাল বিরােধী প্রচারণা চালানো হয়েছিল।[134] জমিয়ত লীগের প্লাটফর্ম থেকে সরে পড়লে জিন্নাহ তাদের উপর ক্ষিপ্ত হন। তার মধ্যে মাদানির উপরই ছিল তার ক্ষোভ সবচেয়ে বেশী। নানামুখী সমালোচনার সাথে মাদানি কংগ্রেস থেকে ‘ঘুষ’ গ্রহণ করেছেন এমন প্রচারণাও চালানো হয়। এ সব কারণে মাদানি লীগের পার্লামেন্টারী বাের্ড থেকে ইস্তফা দেন। তার ইস্তফার কয়েক মাস পর লীগ পার্লামেন্টারী বাের্ডের সভাপতি রাজা সেলিমপুর নিজেও ইস্তফা দেন। উভয়ই একই সভায় পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছিল।[135] উপস্থিত সভায় যহীরুদ্দীন ফারুকীসহ লীগের কয়েকজন উচ্চপদস্থ নেতা প্রতিবাদ করে বলেছিলেন যে,
“ | জমিয়ত নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে হুসাইন আহমদ মাদানির কাছে লীগ বিশেষভাবে ঋণি। কেননা তাঁদেরই ত্যাগ তিতিক্ষার কারণে লীগের পরিচিতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে পৌছেছে। তাদেরই পরিশ্রমে লীগ কাঙিক্ষত বিজয় লাভে সক্ষম হয়েছে। এমতাবস্থায় তাঁদের সাথে আমাদের আচরণ মার্জিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। | ” |
— [135] |
কিন্তু জিন্নাহ কারও কথায় কর্ণপাত করেন নি। ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে পাটনায় লীগের ৩৬ তম বার্ষিক অধিবেশন বসে। জিন্নাহ তাতে সভাপতির ভাষণে কংগ্রেসের প্রচণ্ড সমালােচনা করেন। ইত্যবসরে ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকারের সাথে কংগ্রেসের মতানৈক্য ঘটে এবং প্রতিবাদ স্বরূপ কংগ্রেস মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করলে জিন্নাহর নির্দেশে লীগ বিভিন্ন শহরে নাজাত দিবস পালন করে। কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে মন্ত্রিত্বের এই লড়াইয়ের পরিণামে লীগের গণসংযােগ তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। তবে জমিয়তের সাথে লীগের সম্পর্ক দারুনভাবে ক্ষুণ্ণ হয়।
লীগ ও কংগ্রেসের মনােমালিন্য ঘটে যাওয়ার পর লীগ নেতারা জমিয়তে উলামার কঠোর সমালােচনায় লিপ্ত হয়। জমিয়তের কাজকর্ম প্রধানত মাদানির নির্দেশে পরিচালিত ছিল বিধায় তিনি সমালােচনার মূল টার্গেটে পরিণত হন। জিন্নাহ নিজে সমালােচনার সূত্রপাত ঘটান। মাদানিকে তারা আধুনিক রাজনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ, কংগ্রেসের সেবাদাস ইত্যাদি বলে শরবিদ্ধ করে। ঐ উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃত মুহাম্মদ ইকবাল মাদানিকে বিদ্রুপ করে এক কবিতা প্রকাশ করেন।[136] যা ইতিহাসে ইকবাল-মাদানি বিতর্ক নামে পরিচিত। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ জিন্নাহ ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
১৯৩৮ সালের ৮ জানুয়ারি দিল্লি সদর বাজারে অনুষ্ঠিত একটি মাহফিলে মাদানি বক্তব্য দেন। সেই বক্তব্যে জাতীয়তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে বিশ্বে কওমিয়্যত (জাতীয়তা) ভূখণ্ডের নিরিখে নিরূপিত হচ্ছে। বংশ কিংবা ধর্মের নিরিখে নয়। পরদিন দিল্লীর দৈনিক আল আমানে এ কথামালা বিকৃত করে ছাপানাে হয়। সেখানে বলা হয় যে, হুসাইন আহমদ বলেছেন, জাতীয়তা ভূখণ্ডের নিরিখে নির্ণীত হয়; ধর্মের নিরিখে নয়।[137][74] মুহাম্মদ ইকবাল এই সংবাদটি পেয়ে মাদানিকে বিদ্রুপ করে ৩ পঙক্তির একটি কবিতা প্রকাশ করেন, যা বাঙ্গে দারা কাব্যগ্রন্থে সংকলন করা হয়েছে। মাদানির বক্তব্য ছিল কওম প্রসঙ্গে, মিল্লাত প্রসঙ্গে নয়।[lower-alpha 6]ইকবালের সমালোচনার বিষয় ছিল মিল্লাত প্রসঙ্গে, কওম প্রসঙ্গে নয়।।[139][140]
সমকালীন অন্যান্য কবিগণ ইকবালের প্রতিবাদ করেন। এরকম জবাবী কবিতার সংখ্যা একশরও বেশি। মাদানির এক ভক্ত ঐ কবিতাগুলাের একটি সংকলন প্রকাশের অনুমতি চাইলে তিনি অনুমতি দেননি।[138] জবাবদানকারী কবিগণ বিভিন্ন দিক থেকে ইকবালের ক্রটি নির্দেশ করেছেন। কবি ইকবাল সুহায়ল তাকে মিথ্যাচারিতার অভিযােগে অভিযুক্ত করেছেন। সবচেয়ে রুঢ় বাক্যে ইকবালের সমালােচনা করেছেন কবি সৈয়দ আজিজ আহমদ। তিনি ইকবালের ৩ পঙ্ক্তি বিদ্রুপের জবাবে ১ পঙ্ক্তির কবিতা রচনা করেছেন। এই ঘটনার ৩ মাস পরই ইকবাল মারা যান। মৃত্যুর পূর্বে ইকবাল মাদানির কাছে ক্ষমা চেয়ে পাঠিয়েছিলেন বলে লােক মুখে প্রচলিত আছে। মৃত্যুর পূর্বে ইকবাল লাহােরের দৈনিক ইহসান পত্রিকায় এক বিবৃতি পাঠান। ২৮ মার্চ সেই বিবৃতি প্রকাশিত হয়। তাতে দুটি শিরােনাম ছিল নিম্নরূপ:[141]
মাহমুদ হাসান দেওবন্দির মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে মাদানি পরিচিত হয়ে উঠেন।[142] ১৯২০ সালে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের সভাপতি হিসেবে কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি ১৮ বছর দায়িত্ব পালনের পর ১৯৩৮ সালে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেন।[142] ১৯৩৮—৩৯ সালের ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত নাজুক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশকেও যুদ্ধদেশ ঘোষণা করা হয়। এর প্রতিবাদে কংগ্রেসের মন্ত্রিসভা একযোগে পদত্যাগ করে।[143]
কেফায়াতুল্লাহ দেহলভির পদত্যাগের পর মাদানি জমিয়তের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪০ সালের ৭—৯ জুন জৌনপুরে জমিয়তের বার্ষিক অধিবেশন বসে।[144] অধিবেশনে সভাপতি হিসেবে তিনি দেশ ও জাতির উদ্দেশ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। তার এই ভাষণ ৪০ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়েছিল। ভাষণে তিনি কুরআন ও হাদিসের আলোকে স্বাধীনতা জিহাদের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন এবং ব্রিটিশদের সাহায্য করা সম্পূর্ণ অবৈধ ঘোষণা করেন।[145]
১৯৩৯ সালে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করলে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম তীব্র হয়ে উঠে। মাদানির নেতৃত্বে জমিয়ত বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশকে কোনো ধরনের সাহায্য প্রদান না করার জোর প্রচারণা চালান। জমিয়তের ওয়ার্কিং কমিটির দিল্লি অধিবেশনেও এ সিদ্ধান্ত পুনরায় ব্যক্ত করা হয়। বিশ্বযুদ্ধের এক পর্যায়ে ব্রিটিশদের জন্য ভারতের সহযোগিতা অপরিহার্য হয়ে উঠে। এজন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ভারতের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকের জন্য স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে পাঠান। ক্রিপস ভারতের নেতৃবৃন্দের সাথে এক সপ্তাহ আলোচনা করে একটি প্রস্তাব পেশ করে। সেই প্রস্তাবে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদানের স্পষ্ট উল্লেখ না থাকায় কংগ্রেস ও জমিয়ত প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে।[146]
মাদানির নেতৃত্বে জমিয়ত তাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম আরও তীব্র করে তুলে। ১৯৪২ সালের ২২ মার্চ মাদানির সভাপতিত্বে লাহোরে জমিয়তের বার্ষিক অধিবেশন বসে। লাহোর ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের রূপকার মুসলিম লীগের প্রধান ঘাঁটি। এখানেই লীগের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উপস্থাপিত হয়েছিল। এসব কারণে মাদানির জন্য এখানে সমাবেশ করা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সমাবেশের আগে মুসলিম লীগের সমর্থকরা নানারকম বিদ্রূপাত্মক পোস্টার ছড়িয়ে দিয়েছিল এবং সমাবেশের দিন ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে সমাবেশ পণ্ড করার প্রচেষ্টা চালায়।[147] এ সম্মেলনে তিনি ব্রিটিশদেরকে সাহায্য না করার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।[148] ওই বছর ২৫ জুন মোরাদাবাদে জমিয়তের অপর একটি সম্মেলনেও তিনি বক্তৃতা দেন। এই সম্মেলন থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে সাহারানপুর রেলস্টেশন থেকে তাকে গ্রেফতার করে এলাহাবাদের অন্তর্গত নৈনির জেলে প্রেরণ করা হয়।[149]
এটি ছিল তার চতুর্থবারের মত গ্রেফতার। এর কয়েকদিন পর কোর্টে হাজির হয়ে তিনি ২৫ পৃষ্ঠায় একটি লিখিত জবানবন্দি দেন, যেখানে তিনি স্বাধীনতার পক্ষে তার অবস্থানের কথা জোড়ালোভাবে ব্যক্ত করেন।[150] এজন্য তাকে ৬ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে মোরাদাবাদ জেলে প্রেরণ করা হয়। সেখান থেকে নৈনি জেলে স্থানান্তরিত হলে ২৬ ডি.আই.আর ধারায় আরও ২ বছর কারাদণ্ড বৃদ্ধি করা হয়। ১৩ আগস্ট তার রায়ের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত আপিলের শুনানি হওয়ার কথা থাকলেও ওই তারিখে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়ে গেলে আপিলের শুনানি সম্ভব হয়নি।[151]
১৯৪৩ সালের শেষদিকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিও মিত্রপক্ষের সম্পূর্ণ অনুকূলে চলে আসে। ফলে ব্রিটিশ সরকার নীতির পরিবর্তন করে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে ক্রমে মুক্তি দেয়। ২ বছর ২ মাস কারাবরণের পর ১৯৪৪ সালের ২৬ আগস্ট মাদানি মুক্তি পান। ১৪ রমজান তিনি দেওবন্দ পৌঁছান, এর ২ দিন পর রমজান কাটানোর জন্য পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সিলেটে চলে আসেন।[152]
১৯৪৫ সালের ৭—৯ মে সাহারানপুরে মাদানির সভাপতিত্বে ৩০ হাজার সদস্যের উপস্থিতিতে জমিয়তের এক অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনের ভাষণে তিনি ভারতে ইংরেজ শাসনের কুফল ও বর্বরতা, দুর্ভিক্ষ কবলিত বাংলার করুণ পরিস্থিতি, সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টির লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন অপকৌশল এবং পাকিস্তানের নামে ভারত বিভক্তির চক্রান্ত ইত্যাদির উপর বিস্তারিত আলোচনা করেন। এ ভাষণে তিনি মুসলিম লীগেরও কড়া সমালোচনা করেন এবং স্বাধীনতার সংগ্রামকে আরও বেগবান করতে মুসলমানদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানান। অধিবেশনে জমিয়তের প্রস্তাবিত ‘খসড়া সংবিধান ও তার মূলনীতি’ এর মঞ্জুরী গ্রহণ করা হয়।[153]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন আরও গতি পায়। ব্রিটিশ সরকারের উপর বৈদেশিক চাপ ও ব্রিটিশ গণপরিষদ নির্বাচনে লেবার পার্টির বিজয় ইত্যাদি ভারতের স্বাধীনতার বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত করে দেয়। ছেচল্লিশের নির্বাচনের মাধ্যমে কার্যত ভারতের স্বাধীনতা অবিভক্ত নাকি বিভক্ত করে দেওয়া হবে সেটির ফয়সালা হয়ে যায়।
মুসলিম লীগ পূর্ব থেকেই পৃথক নির্বাচন ও পৃথক ভূখণ্ডের জোর প্রচারণা চালিয়ে আসে। কংগ্রেস নেতারা অবিভক্তির পক্ষে ছিলেন। জমিয়ত উলামায়ে হিন্দও ভারত বিভাজনের কট্টর বিরােধী ছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল, এটি ব্রিটিশদেরই বানানো পলিসি। দেশ তো ন্যায্য বিভক্তি হবেই না, অধিকন্তু বিভক্তির শিরােনামে দাঙ্গা ও রক্তক্ষয়ের সূচনা হবে। যারা পাকিস্তানের ভূখণ্ডে হিজরত করে যাবে তারা সেখানে গিয়েও স্থায়ী বাসিন্দার মর্যাদা পাবে না। বরং বিদেশি নাগরিক হিসেবে সর্বদা দ্বিতীয় কাতারে অবস্থান করবে। পক্ষান্তরে যারা নিরুপায় হয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডে রয়ে যাবে তারা বাস্তবিক অর্থেই সংখ্যালঘু হিসেবে আজীবন নিষ্পেষিত জীবন যাপনে বাধ্য হবে। বিভক্তির কারণে ভারত ভূখণ্ডে অবস্থিত হাজার বছর থেকে প্রতিষ্ঠিত মুসলমানদের সকল ঐতিহ্য বিধ্বস্ত হবে।[154]
এই নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় মুসলমানদের নিজেদেরই দুটি দলের মধ্যে। এটি ছিল সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচন। ভােট প্রয়ােগের দ্বারা মুসলমানগণ মুসলিম প্রতিনিধি আর হিন্দুগণ হিন্দু প্রতিনিধি নির্বাচন করে দেয়। নির্বাচনে অবিভক্তির সমর্থক কংগ্রেস বহু কেন্দ্রে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাস করে। আর কোথাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও সেটি ছিল নামমাত্র। পক্ষান্তরে মুসলিম নেতৃবৃন্দ ছিলেন দুটি শিবিরে বিভক্ত। একদিকে জাতীয়তাবাদী অপর দিকে বিভক্তির সমর্থক। এই নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ আরও একটি দিক এই ছিল যে, ভােটে মুসলমানদের যে দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে, সেটিই তাদের প্রধান প্রতিনিধিত্বকারী দল বিবেচিত হবে এবং সেই দলের রায় অনুসারে ভারতের বিভক্তি কিংবা অবিভক্তি সংক্রান্ত ভাগ্য নির্ধারণ করা হবে।[155]
এ উপলক্ষে জাতীয়তাবাদী মুসলিম দলগুলোর সমন্বয়ে একটি জোট গঠিত হয় এবং নির্বাচন পরিচালনার জন্য জোটের উদ্যোগে ‘মুসলিম পার্লামেন্টারী বাের্ড’ গঠিত হয়। জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ, মজলিসে আহরারে ইসলাম, নিখিল ভারত মোমিন সম্মেলন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টি বিহার, কৃষক প্রজা পার্টি বঙ্গদেশ প্রভৃতি জোটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মাদানিকে জোটের সভাপতি মনােনীত করা হয়।[156]
মুসলিম লীগও সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের সর্বাত্মক চেষ্টা করে৷ নির্বাচনে লীগের বিশেষভাবে আলেমদের সমর্থন প্রয়োজন ছিল। শাব্বির আহমদ উসমানির মাধ্যমে মুসলিম লীগ এ সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়। উসমানি দারুল উলুম দেওবন্দের সদরে মুহতামিম ছিলেন। অভ্যন্তরীণ কিছু কারণে তিনি পদ থেকে ইস্তফা দেন। তার সাথে মুহাম্মদ শফি উসমানি সহ আরও কয়েকজন অব্যাহতি নেন। এসময় লীগ নেতারা তার প্রতি বিশেষভাবে মনােযােগী হন। উসমানি জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম নামে নতুন দল গঠন করে মুসলিম লীগের সমর্থনে কাজ শুরু করেন।[157][158]
মাদানি জেল থেকে বের হওয়ার পূর্বেই নতুন দল গঠিত হয়। পুরাতন জমিয়তের ভাঙ্গন ও নতুন জমিয়ত গঠনের দ্বারা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয় মুসলিম লীগ। নির্বাচন উপলক্ষে আলেমগণের সমর্থন পাওয়ার যে অভাব লীগের ছিল, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম গঠিত হওয়ার দ্বারা সেই সমস্যার উত্তম সমাধান সম্ভব হয়।[159] ঐ সময় ভারতবর্ষের বিশিষ্ট আলেম মুহাম্মদ শফি উসমানি ‘কংগ্রেস আওর মুসলিম লীগ কে মুতাআল্লাক শরয়ি ফায়সালা’ শিরােনামে ফতওয়া প্রকাশ করে লীগ সমর্থনের প্রতি মুসলমানদের উৎসাহিত করেন।[160] অনুরূপে ৩ নভেম্বর জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি উসমানি কলকাতার ভাষণে বলেন,
“ | পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা হল আমাদের প্রাথমিক পদক্ষেপ। এর অগ্রযাত্রা সবশেষে ইসলামি নীতিমালার ভিত্তিতে মহান রাব্বুল আলামিনের প্রদত্ত ন্যায় নীতির শাসন প্রতিষ্ঠায় গিয়ে শেষ হবে। | ” |
— [161] |
নির্বাচন চলাকালে মুসলিম পার্লামেন্টারী বাের্ডের সভাপতি মাদানি মুসলমানদের বারবার বােঝাতে চেয়েছিলেন যে, মুসলমানরা বিভক্ত না হয়ে সকলের ঐক্যবদ্ধ ও অবিভক্ত থাকার মধ্যেই অধিকতর কল্যাণ নিহিত আছে। মুসলিম লীগের প্রতিপক্ষ জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে মাদানিকে এসময় খুন করার প্রচেষ্টাও হয়েছে। নির্বাচনি বছরের অক্টোবর মাসে পাঞ্জাব যাওয়ার পথে অমৃতসর জংশন রেলওয়ে স্টেশন, জলন্ধর স্টেশনে তিনি হামলার শিকার হন। ভাগলপুরে তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা চেষ্টা করা হয়।[162]
১৯৪৬-এর নির্বাচনে কংগ্রেস সমগ্র ভারতে ব্যাপক বিজয় ও সরকার গঠনের উপযুক্ততা অর্জন করে। মুসলিম লীগ একমাত্র বঙ্গদেশ ব্যতীত অন্য কোন সুবায় সরকার গঠনের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। তবে এ নির্বাচনে লীগ নিজেকে মুসলমানদের বৃহত্তম দল প্রমাণে সক্ষম হয়। মুসলিম সীটগুলাের মধ্যে লীগ ৮৫% সীট অর্জন করে। অবশিষ্ট ১৫% সীট অর্জন করে মুসলমানদের জাতীয়তাবাদী অন্যান্য সংগঠন। ফলে মুসলমানের প্রতিনিধিত্বকারী একক দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে লীগের যেই দাবী প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন ছিল, সেটি প্রমাণিত হয়।[163]
ঐ বছর মার্চে স্বাধীনতার রূপরেখা ও পদ্ধতি আলােচনার জন্য ব্রিটিশ মন্ত্ৰীমিশন ভারতে আগমন করেন। মন্ত্রীমিশন ১ এপ্রিল থেকে শিমলায় কংগ্রেস ও লীগ নেতৃবন্দের সাথে বৈঠক শুরু করেন। কিন্তু কোন মতৈক্যে পৌছা সম্ভব হয়নি। মিশন জমিয়তে উলামার নেতৃবৃন্দকেও আহ্বান করে। জমিয়ত ঐ বৈঠকে মাদানি ফর্মূলা পেশ করে। ১৬ এপ্রিল বিকাল ৪টা থেকে সােয়া ৫টা পর্যন্ত মিশনের সাথে জমিয়ত নেতৃবৃন্দের বৈঠক চলে। মন্ত্রীমিশন ঐ ফর্মুলার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে প্রশ্ন করেন এবং উত্তর শুনে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।[164] এই বৈঠকের কার্যকরিতা সম্পর্কে গবেষক মুশতাক আহমদ বলেন,
“ | ১ মাস যাবত আলােচনা পর্যালােচনার পর রাজনৈতিক দলগুলাের অনৈক্যের কারণে মিশন নিজের পক্ষ থেকে যেই পরিকল্পনা পেশ করেছিল সেটি ছিল বস্তুতঃ মাদানি ফর্মুলারই ছায়া বিশেষ। | ” |
— [165] |
ভারতের বিভক্তি ও পাকিস্তান নামে পৃথক ভূখণ্ড রচনার প্রস্তাব মিশন সদস্যদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। তাদের দৃষ্টিতে ঐ প্রস্তাবের মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের গন্ধ রয়েছে। কিন্তু লীগনেতারা একমাত্র পাকিস্তান ব্যতীত অন্য কোন প্রস্তাবে সম্মত ছিল না বিধায় মিশন শেষ পর্যন্ত নিজস্ব পরিকল্পনার ঘােষণা দিতে বাধ্য হয়। কংগ্রেস সেই পরিকল্পনা অনুমােদন করে।[166] শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগও এটি গ্রহণ করে।[167] মন্ত্রীমিশনের উপরােক্ত উদ্যোগের ফলে বহু দিন পর পুনরায় কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে ঐকমত্যের পরিবেশ ফিরে আসে। তবে এ ঐকমত্য স্থায়ী হয়নি। পরিকল্পনা মঞ্জুরীর পর আবুল কালাম আজাদ কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। নতুন সভাপতি হিসেবে মনােনীত হন জওহরলাল নেহেরু। তখন সাংবাদিকরা জওহরলালকে মিশন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি লঘু মন্তব্য করেন। পরদিন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘােষণা দেন যে, কংগ্রেস সভাপতির লঘু মন্তব্যের কারণে লীগ নিজের সিদ্ধান্ত পুনরায় বিবেচনা করবে। এভাবে মতৈক্যের পরিবেশ পুনরায় ঘােলাটে হয়ে যায়।[165]
জিন্নাহ ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ঘােষণা দেন। ঐ তারিখে লীগ শাসিত বঙ্গদেশে সরকারি ছুটি ঘােষণা করা হয়। এ দাঙ্গায় উভয়পক্ষের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।[168] উত্তর ভারতে জমিয়ত উলামার নেতৃবৃন্দ ও মাদানি যথাসময়ে পৌছে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে উত্তর ভারত দাঙ্গার রক্তপাত থেকে রক্ষা পায়। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম অভিযান পরিচালিত হওয়ার পর ভারতবর্ষে হিন্দু–মুসলিমের বিভক্তি অনিবার্য হয়ে পড়ে।[169] ১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ নতুন ভাইসরয় নিযুক্ত হয়ে ভারতে পদার্পণ করেন মাউন্টব্যাটেন। তিনি কংগ্রেসের গান্ধীসহ অনেক নেতাকে সম্মতকরতঃ ভারত বিভক্তি করে স্বাধীনতা প্রদান করেন, যদিও মাদানি শেষ পর্যন্ত অখণ্ড ভারতের পক্ষেই ছিলেন।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভাজন হয়। বিভক্তির পর উভয় দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এম. জে. আকবরের মতে এই সহিংসতার সূচনাপর্বে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ নিহত ও ১ লক্ষ মানুষ বাস্তুহারা হয়। ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হওয়ায় তারা নানারকম ক্ষতির সম্মুখীন হয়।[170]
১৫ আগস্ট মাদানি দেওবন্দে অবস্থান করছিলেন। এরকম নাজুক পরিস্থিতিতে ভারতে অবস্থানরত ৩ কোটি মুসলমানদের উদ্দেশ্যে তিনি দেওবন্দের জামে মসজিদে একটি বক্তৃতা প্রদান করেন। সেই বক্তৃতায় তিনি মুসলমানদেরকে ধৈর্য ধারণ করার উপদেশ দেন এবং আগ বাড়িয়ে কোনরূপ সহিংসতা না করার নির্দেশ দেন। কেউ সহিংসতা সৃষ্টি করতে চাইলে তাদেরকে প্রথমে ভালোভাবে বোঝাতে বলেন এবং তা সম্ভব না হলে শেষমেশ বীরত্বের সাথে লড়াই করতে বলেন।[171]
দেশ বিভাগের কারণে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের শক্তিও বিভক্ত হয়ে পড়ে। মাদানি তাদেরকে আবার সংগঠিত করেন। তিনি হিফজুর রহমান সিওহারভি, আবুল কালাম আজাদ, হাবিবুর রহমান লুধিয়ানভি, মুহাম্মদ মিয়া দেওবন্দি সহ প্রমূখ আলেমকে সাথে নিয়ে নতুনভাবে কাজ শুরু করেন এবং নাজুক পরিস্থিতিতে ভারতের মুসলমানদের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন।
মাদানি এই দুর্যোগের ভিতর থেকে সাহারানপুর ও দিল্লি গমন করেন। মুসলমানদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য জওহরলাল নেহেরু ও মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সাথে সাক্ষাত করেন। আইনশৃঙ্খলার অবনতি হওয়ায় তিনি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পান্তের সাথে বৈঠক করেন। মুখ্যমন্ত্রী দারুল উলুম দেওবন্দ রক্ষার জন্য সেনা পাঠাতে চাইলে মাদানি দেওবন্দে প্রয়োজন নেই উল্লেখ করে সাহারানপুরের খোঁজখবর নিতে বলেন। পরবর্তীতে সাহারানপুরের প্রশাসনে রদবদল আনা হলে ক্রমে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসে। বিভিন্ন মাজার ও সেখানকার কার্যক্রম নিয়ে মাদানির ভিন্নমত থাকলেও সেই সময় তার প্রধান লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। তাই তিনি দখল হয়ে যাওয়া বিভিন্ন মাজার ও তার প্রতিবেশীদের রক্ষার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন।[172] নিরাপত্তার প্রাথমিক ব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়ার পর লখনউতে জমিয়তের উদ্যোগে অল ইন্ডিয়া আজাদ মুসলিম কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়।
ভারতে অবস্থিত তাবলিগ জামাতের কেন্দ্র দিল্লির নিজামউদ্দিন মারকাজ মসজিদ নিয়েও জটিলতা দেখা যায়। সেসময় তাবলিগ জামাতের আমীর মুহাম্মদ ইউসুফ কান্ধলভিকে পাকিস্তানে হিজরত করার জন্য মানুষ জোরাজুরি করতে থাকে। তখন তিনি নির্ভর করেন মুহাম্মদ জাকারিয়া কান্ধলভির সিদ্ধান্তের উপর। পশ্চিম পাঞ্জাবের আরেকজন প্রসিদ্ধ পীর ছিলেন আব্দুল কাদের রায়পুরী। ভক্তরা তাকে জোরাজুরি করলে তিনি এবং মুহাম্মদ জাকারিয়া কান্ধলভি মাদানির নিকট পরামর্শের জন্য আসেন। তখন মাদানি জানান, তিনি কাউকে হিজরত করতে নিষেধ করেন নি। কিন্তু মুসলমানদের এই দুর্যোগের ভিতর ফেলে রেখে নিরাপদে কোথাও যাওয়া তিনি পছন্দ করেন না। তার এই পরামর্শের ফলে রায়পুরী ও কান্ধলভি ভারতে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তের কারণে তাবলিগ জামাতের আমীর মুহাম্মদ ইউসুফ কান্ধলভিও হিজরত করেন নি।[173] তাদের এ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে গবেষক মুশতাক আহমদ বলেন,
“ | সেদিন জাকারিয়া কান্ধলভির সিদ্ধান্ত ভিন্ন হলে আজকে ভারতে মুসলমানদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যেত। | ” |
— [174] |
সহিংসতা থেমে গেলেও ভারতে অবস্থানরত মুসলমানরা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, সরকারি চাকুরি করা ইত্যাদি বিষয়ে সমস্যার সম্মুখীন হয়। অনেক স্থানে মুসলমানদের মসজিদ, মাদ্রাসা, ওয়াকফ সম্পত্তি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জায়গা-জমি হিন্দুদের জবরদখলে চলে যায়। পূর্ব পাঞ্জাব, দিল্লি ও মেওয়াতসহ বহু স্থানে মুসলমানরা প্রাণ ভয়ে ধর্ম ত্যাগ করে। আইনগত জটিলতার কারণে পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এ ধরনের আরও অনেক নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়।[175]
মাদানি শেষ বয়সে ভারতীয় প্রশাসনের সাথে দেনদরবার করে এসব সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট হন। পাকিস্তানে হিজরতকারী মুসলমানদের স্থাবর সম্পত্তি যথানিয়মে সংরক্ষণ এবং ঐগুলাে পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দু শরণার্থীদের মধ্যে বিতরণের জন্য সরকার কাস্টুডিন নামে একটি নতুন বিভাগ খােলে। পরিস্থিতির দাবী অনুসারে এ ব্যবস্থার প্রয়ােজন থাকলেও শেষ পর্যন্ত এর মাধ্যমে মুসলমানরা নানারকম নিপীড়নের শিকার হন। এরকম নিপীড়নের আলোচিত একটি ঘটনা ছিল দিল্লির ব্যবসায়ী মুহাম্মদ দীন ছতরী ওয়ালারা সঙ্গে।[lower-alpha 7] মাদানি কাস্টডিনের এই অবৈধ হস্তক্ষেপ ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিরােধে আইনের আশ্রয় নেন এবং নিজে জওহরলাল ও অন্যান্য নেতার সাথে দরবার করে সমাধানের ব্যবস্থা করেন। ছতরী ওয়ালার ঐ মামলা তিনি জমিয়তের পক্ষ থেকে পরিচালনা করেন। কাস্টুডিনের সাথে লড়াইয়ের জের গড়ায় মন্ত্রিসভা পর্যন্ত। মন্ত্রিপরিষদ কাস্টুডিন মহাপরিচালক আচ্ছুরামের রায় বাতিল করে এবং ছতরী ওয়ালার সম্পত্তি প্রত্যর্পণের সিদ্ধান্ত দেয়। আচ্ছুরাম ক্ষোভে চাকুরি থেকে ইস্তফা দেন। বিষয়টি পরে সংসদেও উথাপিত হয়।[176] এভাবে মাদানির নেতৃত্বে জমিয়ত নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের যে সকল বাড়ীঘর, দোকানপাট বেআইনীভাবে ক্রোক করা হয়েছিল, সেগুলাে প্রত্যর্পণ করানাে হয়। পানিপথ, লুধিয়ানা, আম্বালা প্রভৃতি স্থানে তাদের পুনঃ বসবাসের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। তাদের মসজিদ, মাদ্রাসা, আওকাফ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যথাসম্ভব দখলমুক্ত করে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যে সকল স্থানে মুসলমানরা সমগ্র এলাকাই খালি করে চলে গিয়েছিল, সেখানকার ব্যবস্থা পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি।
মুসলমানদের যারা বিভিন্ন স্থানে প্রাণ ভয়ে কিংবা জবরদস্তির কারণে ধর্ম ত্যাগ করেছিল, মাদানি তাদের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এক আদেশ জারী করান। আদেশে বলা হয় যে, ঐ ধর্মান্তরকরণ ছিল জবরদস্তি মূলক। এ ধরনের ধর্মান্তরকরণ ভারতীয় সংবিধান সমর্থিত নয়। কাজেই যারা পূর্বধর্মে ফিরে যেতে চাইবে তাদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে আইনগত সাহায্য প্রদান করা হবে। উপরােক্ত আদেশ জারী হওয়ার পর তিনি আলেমগণের প্রচেষ্টায় ধর্মত্যাগী লোকদের স্বধর্মে ফিরিয়ে আনেন। যে সব মুসলমান ইতােপূর্বে সরকারি চাকরিতে ছিলেন তাদেরকে চাকরিতে পুনর্বহালের ব্যবস্থা করেন। এমনকি যারা পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল, নির্ধারিত সময়ের ভিতর ফিরে আসার শর্তে তাদের জন্যও প্রত্যাবর্তনের সুযােগ সৃষ্টি করেন। এ ভাবে হারিয়ে যাওয়া শিশু ও মহিলাদের খুঁজে বের করা এবং তাদেরকে ঠিকানামত পৌছানাের জন্যও ব্যবস্থা করেন।
দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম কারী মুহাম্মদ তৈয়ব পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। দেশভাগের পর তিনি পাকিস্তান চলে যান। কিন্তু পাকিস্তানে তার উদ্দেশ্য সফল না হওয়ায় ভারতে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছে করেন। ততদিনে ভারতে ফেরত আসার নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল। তিনি ফেরত আসার জন্য ভারতীয় হাই কমিশনের সাথে যােগাযােগ করেন কিন্তু কোন উপায় করতে সক্ষম হননি। অবশেষে পাকিস্তান থেকে মাদানিকে চিঠি লিখে অনুরােধ করলে তিনি তাকে ফেরত আনেন এবং দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম পদে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেন।[177]
পাকিস্তান সৃষ্টির ক্ষেত্রে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড় ভূমিকা ছিল। দেশ ভাগের পর বিশ্ববিদ্যালয়টি বেশ ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। এর অস্ত্বিত্ব টিকিয়ে রাখতে মাদানির নেতৃত্বে আলেমদের একটি দল পরিশ্রম করে। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রায়ই বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তিনি সাইদ আহমদ আকবরাবাদী সহ একটি দল পাঠিয়ে এটি রক্ষা করেন।[178]
স্বাধীনতার পর তিনি সরকারি কোনোরুপ সুযোগ-সুবিধা নেওয়া থেকে দূরে থাকেন। ভারতের স্বাধীনতায় অবদানের জন্য ভারত সরকার বহুজনকে নানাভাবে পুরষ্কৃত করে। এজন্য মাদানিকেও ১৯৫৪ সালে পদ্মভূষণ পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করা হয়। একটি চিঠির মাধ্যমে তিনি সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে পুরস্কার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন।
১৮০৩ সালে শাহ আবদুল আজিজের মাধ্যমে আলেমগণের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে সৈয়দ আহমদ বেরলভি, শাহ ইসমাইল শহীদ, ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি, মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবি, রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি, মাহমুদ হাসান দেওবন্দি প্রমূখ এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।[179] মাদানি ১৯১৬ সালে এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন।[180] ১৯২০ পর্যন্ত তিনি মাহমুদ হাসান দেওবন্দির একান্ত সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯২০ সালে দেওবন্দির মৃত্যুর পর এ আন্দোলন পরিচালনার প্রধান দায়িত্ব তার উপর অর্পিত হয়।
১৯১৬ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত মোট ৩১ বছর মাদানি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছেন। এই ৩১ বছরের মধ্যে ৮ বছরের অধিক সময় তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন। অবশিষ্ট ২৩ বছর তিনি মাঠে-ময়দানে সক্রিয় আন্দোলনের সুযোগ পান। তিনি জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, খিলাফত আন্দোলনের অসংখ্য সভা ও সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তার অনেক বক্তৃতা পুস্তিকা আকারেও প্রকাশিত হয়েছে। তার স্বরচিত নকশে হায়াত এ বিষয়ে সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ। তাছাড়া মাকতুবাতে শায়খুল ইসলামের বিশাল অংশ তার রাজনৈতিক বিষয়ের উপরে লিখিত।[181] এসব রচনা ও বক্তৃতা থেকে তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায়:
তিনি বিশ্বাস করতেন, তুমুল আন্দোলন ও সংগ্রাম ছাড়া সাম্রাজ্যবাদকে ভারত ত্যাগে সম্মত করা যাবে না। তাছাড়া স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ভারতীয় সকল সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে ব্রিটিশ সরকারকে বয়কট করা আবশ্যক। এ নীতির আলােকেই তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং বিলাতি পণ্য পরিহারের নীতি অবলম্বন করেন। তিনি মাল্টা থেকে প্রত্যাবর্তনের পরই কংগ্রেসের সাথে যুক্ত হন। তারপর প্রাদেশিক শাখার নেতৃত্ব দেওয়া, বিভিন্ন সম্মেলনে সভাপতিত্ব করা, কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় যােগদান ইত্যাদির মাধ্যমে শেষ অবধি কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সাহায্য করে যান। এ দীর্ঘ সময়ে কংগ্রেসের কোন কোন সিদ্ধান্তের সাথে তার মতানৈক্য ঘটে থাকলেও ব্রিটিশ বিতাড়ন আন্দোলনের ব্যাপারে কখনাে তিনি বিচ্ছিন্ন হননি। প্রথম দিকে তিনি সশস্ত্র বিপ্লব ও সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সমর্থক দলগুলাের সাথে যুক্ত ছিলেন। এজন্য তাকে মল্টায় ৪ বছর কারাবাস করতে হয়েছিল। মল্টা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে যােগ দেন। ১৯২০ থেকে নিয়মিত বাৎসরিক ফি আদায়সহ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ঐ সময় থেকে তিনি খেলাফত কমিটির সদস্য ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে খেলাফত আন্দোলন বিলুপ্ত হওয়ায় খেলাফতের কাজ করার সুযোগ থাকেনি।[188]
কংগ্রেসে যােগদানের বিষয়কে তিনি কেবল সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রয়ােজনেই নয় বরং ধর্মীয় প্রয়ােজনেও গ্রহণ করেন। তার দৃষ্টিতে যেহেতু বিশ্ব মুসলিমের মুক্তি লাভের বিষয়টি ভারতের স্বাধীনতার উপর নির্ভরশীল, সেহেতু কংগ্রেসে যােগ দিয়ে হলেও স্বাধীনতার আন্দোলন বেগবান করে তােলা জরুরী। এ যােগদানকে তিনি বিশ্ব মুসলিমের স্বার্থে সম্পাদিত একটি ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেন।[189] এক বক্তব্যে তিনি বলেন,
“ | “কোন সন্দেহ নেই যে, আমি কংগ্রেসের একজন সদস্য হিসেবে আছি। কংগ্রেস একটি সম্মিলিত দল। এ দলের সদস্যপদ গ্রহণে অসুবিধা কোথায়? ভারতের সকল সম্প্রদায়ের লােকেরা এখানে সদস্য হিসেবে আছে এবং থাকতে পারে। ১৮৮৫ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে প্রায় ৮/৯ জন সভাপতি মুসলমান ছিলেন। মুসলিম লীগ, খেলাফত কমিটি, জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ প্রভৃতির সকলেই ১৯২০ সালে এ সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েই কাজ করেছেন। তখন কংগ্রেসের সাথে মিলিত হয়ে কাজ করতে কারােই তাে আপত্তি ছিল না। এটি কেবল হিন্দুদের একান্ত ধর্মীয় সংগঠন নয়। হিন্দুদের একান্ত ধর্মীয় সংগঠন হল হিন্দু মহাসভা। ঐ সংগঠন শুধুমাত্র হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক দাবী-দাওয়া নিয়েই কাজ করে। অনুরূপে মুসলিম লীগ মুসলিম সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংগঠন। কাজেই যেভাবে অন্যান্য মুসলমান নিজেদের নাগরিক সুযােগ সুবিধা আদায়ের জন্য ইংরেজদের সাথে মিউনিসিপালিটি বাের্ড, ডিস্ট্রিক বাের্ড, কাউন্সিল ও এসেম্বলিতে যােগ দেয় এবং যােগদান করাকে অবৈধ মনে করে না, তেমনি আমিও ইংরেজ শাসনের অক্টোপাস থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজের যথাসাধ্য শক্তি নিয়ােগের জন্য কংগ্রেসে যােগদান করাকে অবৈধ মনে করি না। বরং পরিস্থিতির দাবী অনুসারে এটিকে আমি জিহাদ, এমনকি উত্তম জিহাদ, বলে মনে করি।” | ” |
— [189] |
মাদানি বিলাতি পণ্য ব্যবহারের ঘাের বিরােধী ছিলেন। তিনি স্পষ্ট বর্ণনা করেন যে, বাণিজ্যের পথ ধরেই ইংরেজ ভারতের সিংহাসন দখল করেছে এবং এ পথ দিয়েই ভারতের ধনভাণ্ডার ইংল্যান্ডে পাচার করছে। বিলাতি পণ্যের বাণিজ্যই তাদের সকল উত্থানের বুনিয়াদ। কাজেই এ বুনিয়াদ বিধ্বস্ত করা আবশ্যক। তিনি ইংরেজকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার লক্ষ্যে এবং স্বদেশি পণ্যের বৃহত্তর বিকাশের স্বার্থে বিলাতি পণ্য পরিহারের আন্দোলন করেন। তার ব্যক্তিগত নীতি ছিল, একান্ত বাধ্য ও নিরুপায় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কখনো বিদেশি পণ্য ব্যবহার করতেন না। নিজের ঘরবাড়ি ও আসবাব পত্রের সর্বত্র ছিল দেশি পণ্য। ভুলক্রমে কখনাে যদি কোন বিদেশি পণ্য তার গৃহে এসে যেত, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেটি ফিরিয়ে দিতেন কিংবা নষ্ট করে ফেলতেন। উপমহাদেশের সর্বত্র তার অসংখ্য শিষ্য ও ভক্ত ছিল। তিনি তাদের কাউকে কোন বিদেশি পণ্য ব্যবহার করতে দেখলে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন। এ ব্যাপারে তিনি এত কঠোর ছিলেন যে, কোন জানাজার কাফন যদি বিদেশি কাপড় দ্বারা করা হত তাহলে তিনি ঐ জানাযায় শরিক হতেন না। আর শরিক হলেও নিজে জানাজার নামাজ পড়াতেন না।[190]
রাজনীতি সম্পর্কে ইসলামের বিধান আলােচনায় দুটি প্রান্তিক অভিমত পাওয়া যায়। কারাে মতে ইসলামে রাজনীতি নেই। আবার কেউ বলেন ইসলাম মানেই রাজনীতি। মাদানি দুটি অভিমতকেই অতিশয়তা ও বাড়াবাড়ি বলে মনে করেন। তার মতে রাজনীতি করা ইসলাম বহির্ভূত নয়। সততা ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে রাজনীতি চর্চায় ইসলামের কোথাও নিষেধ করা হয়নি। পক্ষান্তরে মিথ্যা, প্রতারণা ও শঠতার অবলম্বন করা, সেটি রাজনীতির ক্ষেত্রে হােক কিংবা অন্য যে কোন ক্ষেত্রে হােক সর্বত্র পরিত্যাজ্য।[191]
তিনি ছাত্র রাজনীতির সমর্থক ছিলেন না। তার দৃষ্টিতে, শিক্ষার্থীদের যারা নিজেদের শিক্ষা কোর্স সম্পন্ন করেনি এবং শিক্ষা লাভের কাজে রত আছে তাদের জন্য শিক্ষা বাদ দিয়ে রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ উচিত নয়। শিক্ষার্থীকে শিক্ষা সম্পন্ন করার প্রতি প্রথম মনােযােগ দান জরুরী। তবে ছুটির সময়ে কিংবা অবসর সময়ে রাজনীতি সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞতা অর্জনে দোষ নেই।[192]
স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বার্থে তিনি ভারতীয় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে যে ঐক্য স্থাপন করেন সেটি ছিল একান্ত রাজনৈতিক। আকীদা বিশ্বাস কিংবা ধর্মীয় কাজকর্মের ক্ষেত্রে ঐক্য নয়। তার মতে, ইসলামে এ ধরনের ঐক্য স্থাপনে বাধা নেই। তিনি দলীল দিয়ে বলেন, “মদিনায় পৌঁছার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার ইহুদিদের সাথে সন্ধি স্থাপন করে মক্কার মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। আবার হুদায়বিয়ায় তিনি ঐ মুশরিকদের সাথে সন্ধি করে ইহুদীদের সাথে যুদ্ধ করেন। উপরােক্ত ২ টি ঘটনা থেকে বােঝা যায়, ইসলামের দৃষ্টিতে বিশেষ প্রয়ােজনে অমুসলিমদের সাথে ঐক্য করা বৈধ।” তিনি আরও ব্যাখ্যা করে বলেন, “আমরা শরীয়তের বিধি-বিধানে বিকৃতি সাধন কিংবা মুসলিম বা অমুসলিম কারও নির্দেশে শরীয়তের কোন বিধান পরিত্যাগ বা পরিবর্তন করা কোন ক্রমেই বৈধ মনে করি না।”[193]
মোহনদাস করমচন্দ গান্ধীর নেতৃত্বাধীন আইন অমান্য আন্দোলনে বিপ্লবী ইসলামি পণ্ডিতগণ বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলনে বহু পণ্ডিত কারারুদ্ধও হন। কতিপয় সমালােচক এটিকে তিরস্কার করে বলেছিল যে, কোন অমুসলিমের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলন ইসলামের পবিত্র জিহাদ হতে পারে না। তাদের যুক্তি ছিল, অমুসলিমের নেতৃত্ব মুসলমানের জন্য নাজায়েজ ও হারাম। মাদানি উপরােক্ত অভিযােগের খণ্ডনে বলেন, “অমুসলিমকে জিহাদের ইমাম নিযুক্ত করা যায় না। তবে জিহাদের অধীনে পরিচালিত কোন কাজে অমুসলিমের সহযােগিতা নেওয়া বা নেতৃত্ব দ্বারা নিজেরা উপকৃত হওয়া দোষের বিষয় নয়। যেমন কোন হিন্দুকে মসজিদের ইমাম বানােনো যায় না। কিন্তু মসজিদের নির্মাণ কাজে কিংবা কোন মুসলিম রােগীর চিকিৎসা কাজে অমুসলিমকে নেতা বানানাে যায়।”[194]
তিনি বলেন, এ কথা সম্পূর্ণ ভুল যে, জমিয়ত কোন অমুসলিমকে নিজদের ইমাম নিযুক্ত করেছে। জমিয়ত স্বায়ত্তশাসিত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এটি অন্য কোন দল বা সংগঠনের তাবেদার বা লেজুড় নয়। কংগ্রেস ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল যে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, জমিয়ত ঐ সকল সিদ্ধান্ত নিজেদের বৈঠকে গভীর পর্যালােচনা করে থাকে। তারপর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তথা কুরআন-হাদীস ও ফিকহের আলােকে ঐ সিদ্ধান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা পূর্বক মুসলমানদের জন্য যতটুকু সঠিক ও উপযুক্ত বিবেচিত হয়, ততটুকুই গ্রহণ করেন। আর যা শরীয়তের খেলাফ কিংবা উম্মতের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত হয় তা বর্জন করেন। যদি ইমামত ও নেতৃত্বের অর্থ সেটিই হয় যা সমালােচকরা বলে বেড়াচ্ছেন এবং যদি অমুসলিমের কোন ধরনের নেতৃত্বই মুসলমানের জন্য নাজায়িয হয়, তা হলে মিউনিসিপ্যালিটি বাের্ড, ডিস্ট্রিক বাের্ড প্রভৃতিতেও কোন মুসলমানের অংশগ্রহণ জায়িয হবে না। কারণ ঐ সকল বাের্ডের অধিকাংশেরই প্রেসিডেন্ট কিংবা সেক্রেটারি অমুসলিম। অনুরূপ ইংরেজ সরকারের প্রশাসন, সামরিক, বাণিজ্য, শিক্ষা ইত্যাদি বিভাগেও মুসলমানদের চাকরি করা বৈধ হবে না। অথচ সমালােকরা কখনাে ঐ ক্ষেত্রগুলিতে অংশ গ্রহণ হারাম বলেন না বরং নিজেরা প্রতিযােগিতা করে সেখানে প্রবেশ করে থাকেন।[194]
তিনি অভিন্ন জাতীয়তাবাদের পক্ষে ছিলেন। কতিপয় ইসলামি পণ্ডিত তার মতাদর্শকে ইসলাম পরিপন্থী বলেও ফতোয়া দেন। তাদের বক্তব্য ছিল যে, হিন্দু মুসলিম অভিন্ন জাতি হতে পারে না। মুসলমানদের জাতীয়তা হল ইসলাম। মাদানি তাদের জবাবে বলেন, হিন্দু মুসলিম অভিন্ন মিল্লাত হতে পারে না। তবে অভিন্ন জাতি হতে পারে। কুরআনের অসংখ্য স্থানে মুসলিম ও অমুসলিম সকলকে যুক্ত করে অভিন্ন জাতি হিসেবে নির্দেশ করা আছে। ‘জাতি’ শব্দটি ব্যাপক অর্থবােধক। এই ব্যাপকতার দরুন বহু নবী নিজের অমুসলিম জাতিকে ‘ইয়া কওমি' (হে আমার জাতি) বলে সম্বােধন করেছেন। তাছাড়া বিশেষজ্ঞদের মতেও জাতীয়তার মৌল উপাদান শুধুমাত্র ধর্ম নয়। ভাষা, অঞ্চল, ভূখণ্ড, পেশা ইত্যাদির নিরিখেও জাতীয়তা গড়ে উঠে। কাজেই হিন্দু-মুসলিমকে অভিন্ন জাতি বলা ইসলাম পরিপন্থী নয়।[195]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ভারত দ্রুত স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হয়। স্বাধীনতার মূহুর্ত যত ঘনিয়ে আসে ভারতের শাসনতন্ত্র ও তার রূপরেখা বিষয়ক প্রশ্ন তত প্রকট হতে থাকে। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ প্রত্যেকে নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গির আলােকে শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি চিন্তাভাবনা করতে থাকে। শাসনতন্ত্রের ব্যাপারে কংগ্রেসের উচ্চপদস্থ নেতারা অবিভক্তি ও অসাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতে আগ্রহী থাকলেও সেখানে এমন কতিপয় নেতা ছিল, যারা কট্টর হিন্দু সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী। এ অংশটি মুসলমানদেরকে সংখ্যালঘুর পর্যায়ে রেখে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের নেতৃত্বে সরকার গঠনের চিন্তা ভাবনা করে। ।
মাদানি তাদেরকে এ ধরনের চিন্তা ভাবনা করা অন্যায় বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন।”[196]
স্বাধীন ভারতের শাসনতন্ত্র কিরূপ হবে তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি জটিলতা দেখা দেয় মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে। সমগ্র ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৯—১০ কোটি আর হিন্দুদের সংখ্যা ৩৫ কোটির বেশি। মুসলমানরা হিন্দুদের ৪ ভাগের ১ ভাগ। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার গঠিত হলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ৪টি সুবায় মুসলিম সরকার গঠিত হলেও মুসলিম সংখ্যালঘু অন্যান্য সুবা এবং কেন্দ্রীয় সরকারে সব সময়ই প্রাধান্য থাকবে হিন্দুদের। এ সমস্যা লক্ষ্য করেই মুসলিম লীগ নেতারা পূর্ব থেকেই মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলাের সমন্বয়ে একটি পৃথক ভূখণ্ড রচনার চিন্তা করেন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, আমরা ৫ কোটি মুসলমানের নিরাপত্তা বিধানের স্বার্থে ৩ কোটি মুসলমানের ক্ষতিগ্রস্ততা সহ্য করে যাচ্ছি। কিন্তু মুসলিম লীগের এ চিন্তার সাথে মাদানি একমত হতে পারেন নি। তিনি মনে করেন যে, পৃথক ভূখণ্ড রচনার পদক্ষেপ হিন্দু-মুসলিম সকলের স্বার্থবিরােধী। এ পদক্ষেপ দ্বারা ভারতীয়দের বর্তমান সমস্যার নিরসন তাে হবেই না বরং আরও জটিল আকার ধারণ করবে।[197] এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে সংখ্যালঘু সুবার ৩ কোটি মুসলমানের প্রতি নির্মমতা প্রদর্শন করা হবে। অধিকন্তু উপমহাদেশীয় মুসলিম সমাজের উপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানাবিধ সমস্যার উদ্রেক হবে। তাছাড়া শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলেও এটি খিয়ানতমূলক সিদ্ধান্ত যা গ্রহণ করা কোন মুমিনের পক্ষে সম্ভব নয়।
মাদানির মতে কয়েকটি বিশেষ দিকে লক্ষ্য রেখে; যথা: ভূখণ্ডের অখণ্ডতা বজায় রাখা, প্রধান ২ টি সম্প্রদায় তথা হিন্দু ও মুসলিমের রাজনৈতিক ও সামাজিক সমান অধিকার ভােগের ব্যবস্থা করা, ছােট বড় প্রত্যেক সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করা, সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষিত রাখা এবং সর্বপ্রকারের সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরােধের চেষ্টা করা; জমিয়ত উলামার নেতৃত্বে আলেমগণ শাসনতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনের একটি ফর্মুলা তৈরি করেন।[198] ১৯৪২ সালে জমিয়তের লাহাের অধিবেশনে ঐ ফর্মূলা গৃহীত হয়। মাদানির উদ্যোগে ফর্মুলা রচিত হয়েছিল বিধায় এটি ‘মাদানি ফর্মুলা’ নামে পরিচিত। এ ফর্মুলার নিরিখে স্বাধীন ভারতের জন্য শাসনতান্ত্রিক রূপরেখার প্রস্তাবনা ছিল নিম্নরূপ:[199]
- স্বাধীন ভারতের জন্য মৌলিক কিছু নীতিমালার আলােকে সুবাগুলাের সমন্বয়ে কনফেডারেশন ধরনের একটি কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হবে।
- এই কনফেডারেশনে যােগদানকারী প্রত্যেক সুবা নিজ নিজ স্থানে থাকবে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসনের অধিকারী।
- কেন্দ্রীয় সরকার কোন সুবার স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করবে না।
- কেন্দ্রের হাতে কেবল ঐ সকল অধিকারই থাকবে যেগুলাে ফেডারেশন সদস্যদের সম্মিলিত রায়ে গৃহীত হবে।
- সুবা সরকারের হাতে থাকবে অলিখিত অন্যান্য সকল ক্ষমতা।
- প্রত্যেক সরকার সংখ্যালঘুদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও রাজনৈতিক অধিকার সংরক্ষণে বাধ্য থাকবে এবং তারা যেভাবে ভাল মনে করবে, সে ভাবে সংখ্যালঘুদের পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে। লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন সংখ্যাগরিষ্ঠরা নিজেদের গরিষ্ঠতার কারণে উপকৃত হতে পারে, পাশাপাশি সংখ্যালঘিষ্ঠরা সামগ্রিকভাবে সুস্থির ও নিরাপদ জীবন যাপনের পূর্ণ সুযােগ পায়।
এ ফর্মুলা জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের বিপরীত ছিল। এই ফর্মুলায় দেশীয় সম্প্রদায়গুলাের মধ্যে ধর্মীয় কিংবা আঞ্চলিকতার কোন প্রতিহিংসা পছন্দ করা হয়নি এবং বিদেশী কোন শক্তিকেও এমন কোন সুযােগ দেওয়া হয়নি, যার দ্বারা বিদেশীরা ভারতকে খণ্ডিত করে মুসলমানদেরকে নিজেদের কূটনৈতিক আধিপত্য কায়েমের হাতিয়ারে পরিণত করতে পারে।[200]
মাদানির পূর্ণ অসম্মতির উপরই ভারত বিভক্ত হয়। বিভক্তির পর তিনি উভয় ভূখণ্ডের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষিত রাখা জরুরি বলে মত প্রকাশ করেন। তার অবিভক্তির চেষ্টা ব্যর্থ হলেও তিনি পরিস্থিতি মেনে নেন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মুসলমানদের জন্য যা করণীয় তা সম্পাদনে পুনরায় আত্মনিয়ােগ করেন। ভারত বিভক্তির কারণে মুসলমানরা উভয় ভূখণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। উভয় ভূখণ্ডেই তার শিষ্য, কর্মী ও ভক্তরা ছিলেন। তিনি প্রত্যেককে স্ব-স্ব ভূখণ্ডে অবস্থিত মুসলমানদের সেবায় আত্মনিয়ােগের আদেশ দেন।[201] এ আদেশের কারণে পাকিস্তান ভূখণ্ডে অবস্থিত বহু জমিয়তকর্মী পরবর্তীকালে মুসলিম লীগে যােগদান করে পাকিস্তানের সেবায় নিয়ােজিত হয়।
বিভক্তির পূর্বে ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৯ কোটির বেশি। কিন্তু বিভক্তির পর ভারতের মূল ভূখণ্ডে মুসলমানদের সংখ্যা ৩/৪ কোটিতে নেমে যায় এবং তারা দুর্বল একটি সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। মাদানি তাদেরকে সান্ত্বনা দেন এবং ভাগ্য মেনে নেওয়ার উপদেশ দিয়ে তাদেরকে নতুনভাবে একটি শক্তিশালী সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে উঠার সাহস যােগান। তার মতে শক্তির মানদণ্ড জনসংখ্যার আধিক্য নয়। শক্তির মানদণ্ড হল খাঁটি ঈমান, তাকওয়া ও জিহাদের অনুপ্রেরণা।
তিনি পাকিস্তান ও পাকিস্তানি মুসলমানদের সাথে রাজনৈতিক ও সামাজিক সকল দিক থেকে সুসম্পর্ক রক্ষা করার নির্দেশ দেন। বিভক্তির যৌক্তিকতা ও অযৌক্তিকতা বিষয়ে দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর কোথাও কোন বিতর্কে লিপ্ত হওয়া তার দৃষ্টিতে একটি নিষ্ফল কর্ম ছাড়া কিছুই নয়।
তবে কখনাে এই দুই ভূখণ্ডের মধ্যে রাজনৈতিক কোন বিষয়ে মতবিরােধ দেখা দিলে মুসলমানদের কী করণীয় হবে সেটিও তিনি আলােচনা করেন। তার মতে, যেহেতু উভয় ভূখণ্ডেই উল্লেখযােগ্য সংখ্যক মুসলমান আছেন সেহেতু প্রত্যেক দেশের মুসলমানরা নিজ নিজ দেশের মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার যিম্মাদার। পাকিস্তানি মুসলিম জনগণ পাকিস্তানে অবস্থিত মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়কে অগ্রাধিকারের সাথে চিন্তা করবে। ভারতীয়রা ভারতীয় মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করবে।
শিক্ষা দর্শনে তিনি মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবির অনুসারি ছিলেন। দেওবন্দে পড়ার সময় তিনি নানুতুবিকে পান নি, এর আগেই নানুতুবির মৃত্যু হয়। তবে নানুতুবির শিষ্য মাহমুদ হাসান দেওবন্দির মাধ্যমে তার উপর এই দর্শন প্রভাব বিস্তার করে। তার শিক্ষালাভ, শিক্ষকতা ও শিক্ষা বিস্তারের কাজকর্ম নানুতুবি শিক্ষাদর্শনের ভিত্তিতে বিকশিত হয়েছিল।
১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে ভারতে মুসলিম সমাজ চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মুসলমানদের রাজত্ব, নওয়াবী জায়গিরদারী ও জমিদারি থেকে উচ্ছেদ করা হলে তাদের পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও অচল হয়ে যায়। এমতাবস্থায় মুসলমানদেরকে সামাজিকভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ২টি সংস্কারপন্থী চিন্তাধারার উদ্ভব ঘটে। এক দলের নেতৃত্ব দেন সৈয়দ আহমদ খান, অন্য দলের নেতৃত্ব দেন মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবি। উভয়ে মামলুক আলী নানুতুবির ছাত্র ছিলেন।[202] সৈয়দ আহমদ খান ১৮৭৭ সালে তার চিন্তাধারার আলোকে আলিগড় কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।[203] তিনি ইংরেজদের সাথে আপোষকামিতার পথ অবলম্বন করে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি গ্রহণপূর্বক মুসলমানদের বৈষয়িক উন্নতিতে উৎসাহিত করেন। অন্যদিকে নানুতুবি তার চিন্তাধারার আলোকে ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলুম দেওবন্দ। তিনি বেছে নিয়েছিলেন বিপ্লবের পথ। তিনি ইসলামের শিক্ষা ও সংস্কৃতি গ্রহণপূর্বক ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের মাধ্যমে মুসলমানদের ভাগ্য পরিবর্তনে অনুপ্রাণিত করেন।[204] এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদ নিজামুদ্দিন আসির আদ্রাভি বলেন,
“ | একদলের অভিমত হল আগে মুসলমান পরে ইসলাম। আর অন্য দলের অভিমত হল এ দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থাৎ আগে ইসলাম ও পরে মুসলমান। প্রথমােক্ত দলের নেতৃত্ব দেন আলিগড়ের স্যার সৈয়দ আহমদ খান। আর শেষােক্ত দলের পথ নির্দেশক ছিলেন দেওবন্দের হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবি রহ.। | ” |
— [205] |
আবু সালমান শাহজাহানপুরী বলেন,
“ | এটি পরম দুঃখজনক ঘটনা যে, তখন শাহ ওয়ালিউল্লাহর অনুসারীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সামনে অস্ত্র-শস্ত্র ও হাতিয়ার ত্যাগ করেন এবং ক্ষমতাসীন ইংরেজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আনুগত্যের সার্টিফিকেট অর্জন করে সুখ সমৃদ্ধির জীবন অবলম্বন করেন। আর অপর দল সত্য ও ন্যায়ের সেই আদর্শকেই দৃঢ়ভাবে ধরে রাখেন যেটি ভারতীয় মুসলমানদের কর্মসূচি হিসেবে ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহ পূর্বেই চিহ্নিত করে গিয়েছিলেন। | ” |
— [206] |
ব্রিটিশ শিক্ষানীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীকে কেবল তাদের অধীনে চাকরি করার উপযুক্ত বানানো। মাদানির সমর্থিত শিক্ষাদর্শনে ঐ দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ পরিহার করা হয়। এখানে শিক্ষার্থীকে জ্ঞানগত, আমল ও চারিত্রিক দিক থেকে যােগ্যতাসম্পন্ন বানানাে এবং এদের মধ্যে বিপ্লবের চেতনা সম্প্রসারিত করা প্রধান লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। মাদানির মতে শিক্ষা শুধু পেশাই নয়, একটি উচ্চমানের ইবাদাতও বটে । তিনি মনে করেন শিক্ষার মাধ্যমে এমন ব্যক্তিত্ব গড়ে তােলা আবশ্যক যারা গবেষণা ও জ্ঞানচর্চার অঙ্গনে বিশ্বাস ও নির্ভরযােগ্যতার সাথে পূর্ণ অংশগ্রহণে সক্ষম হবে এবং নিজ ধর্ম ও নিজ দেশের সেবা করার উদ্দেশ্য নিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।[207] বিশেষতঃ ইসলামের উপর যেকোনো দিক থেকে আক্রমণ আসুক না কেন সেটি দক্ষতার সাথে প্রতিরােধে সক্ষম হবে। এই নিরিখেই নানুতবি শিক্ষাদর্শনের পাঠ্যক্রমে ধর্ম ও নৈতিকতার অধ্যয়নকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। গবেষক নিজামুদ্দিন আসির আদ্রাভি ঐ পাঠ্যক্রম সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে নানুতুবির বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, নানুতুবি পরিষ্কার বলে দেন যে,
“ | বৈষয়িক জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য সরকার পরিচালিত বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কাজেই যারা বৈষয়িক জ্ঞান আহরণ করতে চায় তারা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়া উচিত। আমরা ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৈষয়িক শাস্ত্রসমূহের মিশ্রণ ঘটিয়ে কর্মসূচিকে আধাখেঁচড়া করতে রাজি নই। দু'দিকের মিশ্রিত শাস্ত্র শিক্ষাদানের ফল দাঁড়াবে যে, শিক্ষার্থী কোন দিকেরই পাণ্ডিত্য অর্জনে সক্ষম হবে না। তাদের না বৈষয়িক শাস্ত্র অর্জিত হবে, আর না ধর্মীয় শাস্ত্র। এটি বৈষয়িক শিক্ষার প্রতি কোন বিদ্বেষভাব পােষণের কারণে নয় বরং ধর্মীয় শিক্ষাকে নিখুঁত, ত্রুটিমুক্ত ও পরিপূর্ণ রাখার লক্ষ্যে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। | ” |
— [208] |
মাদানির শিক্ষাদর্শনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদান কার্যক্রম যেন কোনভাবে প্রভাবিত কিংবা বাধাগ্রস্ত না হয় সে লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানের উপর সরকারি কোন কর্তৃত্বের সুযােগ রাখা হয়নি। এমনকি কোন সরকারি আমলা কিংবা কোন বিত্তশালীর মােটা অংকের চাঁদা গ্রহণেরও অনুমতি নেই। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এ ধরনের চাঁদা গ্রহণের দ্বারা প্রতিষ্ঠানের উপর চাঁদাদাতার প্রভাব প্রতিফলিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতি বা উসূলে হাশতেগানায় নানুতুবি এ ধরনের চাঁদা পরিহারের কথা বলে গিয়েছেন।[209] তাদের মতে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমাজের নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও ধার্মিক লোকদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাঁদা দ্বারা পরিচালিত হবে। তাহলে মাদ্রাসা তাদের পক্ষ থেকে পূর্ণ চাপমুক্ত হয়ে আর্থিক সহায়তা লাভ করবে, আর তারা মাদ্রাসা থেকে বিশুদ্ধ ধর্মীয় পরামর্শ লাভ করবে। সিলেট ও আসাম অঞ্চলে মাদানি যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন, তার সবগুলাে এই নিয়মে আজও পরিচালিত হচ্ছে।
নানুতবি শিক্ষাদর্শনের ভিত্তিতে স্থাপিত প্রথম মাদ্রাসা দারুল উলুম দেওবন্দ। এরপর এ আঙ্গিকে আরও মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। এগুলাে কওমি মাদ্রাসা বা দেওবন্দি মাদ্রাসা নামে পরিচিত। নানুতুবির জীবদ্দশায়ই ৭/৮ টি প্রতিষ্ঠান অস্তিত্ব লাভ করে। তারপর মাহমুদ হাসান দেওবন্দির যুগে প্রচারভিযান বিস্তৃতি লাভ করে। তার শিষ্যরা নিজ নিজ অঞ্চলে পৌছে শত শত মাদ্রাসা স্থাপন করেন। তারপর আসে মাদানির যুগ। এ যুগে এর প্রচারাভিযান শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই নয়, এশিয়া ও আফ্রিকার বিশাল অংশেও সম্প্রসারিত হয়ে যায়।[210] দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম কারী মুহাম্মদ তৈয়ব বলেন,
“ | ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের পর এ শিক্ষাদর্শন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্বে ছিলেন হযরত নানুতুবি, যিনি এর শুভ সূচনা করে গিয়েছেন। তারপর মধ্যবর্তী পর্বে ছিলেন হযরত শায়খুল হিন্দ, যিনি এটিকে পূর্ণ যৌবনে উপনীত করেন এবং সর্বশেষ পর্বে ছিলেন হযরত শায়খুল ইসলাম মাদানি, যিনি এটিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছিয়ে দেন। এভাবে ১৮৫৭ থেকে ১৯৫৭[lower-alpha 8] পর্যন্ত এক শতাব্দীর মধ্যে নানুতুবি শিক্ষাদর্শন একটি পরিপূর্ণ অধ্যায়কে অতিক্রম করে। | ” |
— [211] |
মাদানির পরিবার ঐতিহ্যগতভাবে শরিয়ত ও তরিকতের জ্ঞানচর্চার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। তার পিতা ছিলেন একজন শিক্ষক। তাই অতি শৈশব থেকে তিনি শিক্ষা লাভে অনুপ্রাণিত হন। মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্ব পর্যন্ত তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে হাদিসের পাঠদান অব্যাহত রাখেন। তার জ্ঞানচর্চার প্রধান কেন্দ্র ছিল দু’টি। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ ও মদিনার মসজিদে নববী।[212] মাদানি ১৯০৯ সালে দেওবন্দে আগমণ করলে মাহমুদ হাসান দেওবন্দি তাকে নিজের বিশেষ তত্ত্বাবধানে গড়ে তুলতে শুরু করেন। এখানে মাদানি সাড়ে ছয় বছরে ১৭টি বিষয়ে ৬৬টি পাঠ্যবই অধ্যয়ন করেছিলেন। তন্মধ্যে ২৪টি এককভাবে দেওবন্দির কাছেই অধ্যয়ন করেন। ক্লাস টাইমের পরবর্তী সময়গুলােও দেওবন্দির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হত।[213] প্রথমবার তিনি নিজ পিতামাতার সাথে মদিনা চলে যাওয়ার পরে এক বছর পুনরায় দেওবন্দ এসে দেওবন্দির নিকট সহীহ বুখারী ও সুনান আত-তিরমিজী অধ্যয়ন করেন। দেওবন্দির সাথে মাল্টার কারাগারে অবস্থানের দীর্ঘ ৩ বছরকালও জ্ঞান আহরণে কাটে।[214]
এই সান্নিধ্য ও ঘনিষ্ঠতার ফলে মাদানির চিন্তা-চেতনা ও আচার-ব্যবহারে দেওবন্দির প্রভাব পরিলক্ষিত হত। জ্ঞানচর্চায় মাদানির অপর কেন্দ্র ইসলামের দ্বিতীয় পবিত্র শহর মদিনা। সেখান থেকেই শুরু হয় তার অধ্যাপনার জীবন। তিনি ভারতীয় আলিমগণের প্রথম ব্যক্তি যিনি রওজাতুন্নবীর পাশে উপবেশন করে ইলমে হাদিসের অধ্যাপনা করেন।[215] শিক্ষকতায় মাদানির সর্বাধিক কৃতিত্ব প্রদর্শিত হয় দারুল উলুম দেওবন্দে। দীর্ঘ ৩১ বছর তিনি এখানে হাদিসের অধ্যাপনা করেন। তার আমলে দারুল উলুমের খ্যাতি দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। আফ্রিকা ও ইউরােপের বিভিন্ন দেশ থেকেও বিদেশী ছাত্ররা অধ্যয়নের জন্য দারুল উলুম আগমন করে। গবেষক মুশতাক আহমদ তার শিক্ষা পরিচালনাকে বাগদাদ নিযামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষা পরিচালক আবু ইসহাক সিরাজীর সাথে তুলনা করেন। তিনি বলেন,
“ | হযরত শায়খ সিরাজীর দ্বারা নিযামিয়া মাদ্রাসার পরিচিতি যেমন আলেমগণের মহল অতিক্রম করে সর্বসাধারণ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, তেমনি হযরত শায়খুল ইসলামের দ্বারা দারুল উলুমের পরিচিতি উপমহাদেশের নগর বন্দর অতিক্রম করে নিভৃত পল্লীর মুসলমান পর্যন্ত পৌছে যায়। | ” |
— [216] |
মাদানিকে সমকালীন শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদদের সাথে তুলনা করা হয়। হাদিস, তাফসির ও ফিকহ সহ শরিয়তের বহু বিষয়ে তিনি ছিলেন ব্যুৎপন্ন ও পারদর্শী। তার এ পারদর্শিতার প্রধান ভিত্তি দারুল উলুম দেওবন্দের পাঠ্যক্রম। তিনি এ পাঠ্যক্রমে এতটুকু ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন যে, মদিনা গিয়ে ভিন্ন পাঠ্যক্রমের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালনে অসুবিধা হয়নি। ভারত ও মদিনার পাঠ্যক্রমে পার্থক্য ছিল। মদিনায় সাধারণতঃ মিসর কিংবা ইস্তাম্বুলের পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হত। সেখানকার পাঠ্য কিতাবাদি ভারতের পাঠ্য কিতাবাদি থেকে ভিন্ন ছিল। তাছাড়া ভারতে সাধারণতঃ হানাফি ফিকহের উপর আলােচনা করা যথেষ্ট বিবেচিত হলেও মদিনায় এতটুকু যথেষ্ট ছিল না। মদিনায় শিক্ষার্থীদের বহুসংখ্যক ছিল শাফিঈ কিংবা মালিকি ফিকহের অনুসারী। তাই মাদানিকে অধ্যাপনার সময়ে অন্যান্য ফিকহের মূলগ্রন্থ, উসুল ও ফাতাওয়া ইত্যাদির উপর অধ্যয়ন করতে হয়েছিল।[217]
শিক্ষাজীবনে যদিও যুক্তিবিদ্যা ও গ্রীকদর্শনের প্রতি তার বেশি আগ্রহ ছিল কিন্তু মদিনার পরিবেশে পৌঁছে এ মনােভাবের পরিবর্তন ঘটে। তিনি ক্রমে ফিকহ, তাফসীর ও হাদিসের প্রতি বেশি অনুরাগী হন। মসজিদে নববীতে তার পাঠদান প্রধানত এ তিনটি বিষয়ে ছিল। মদীনার তদানীন্তন প্রধান মুফতি আহমদ আল বাসাতী ফিকহের ক্ষেত্রে তারই অভিমতকে চূড়ান্ত রায় মনে করতেন। মদিনাস্থ শিক্ষকদের অনেকে পাঠদানের সময় সম্মুখে ভাষ্যগ্রন্থ নিয়ে বসতেন। কিন্তু মাদানি ভারতের ‘খায়রাবাদী পদ্ধতি’ অনুসারে মূল কিতাব ব্যতীত কোন ভাষ্যগ্রন্থ সম্মুখে রাখতেন না। ফলে শিক্ষার্থীদের মনে তার পাণ্ডিত্য অত্যধিক গ্রহণযােগ্যতা অর্জন করে।[218] দারুল উলুমে অবস্থানকালেও তার কাছে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বহু স্থান থেকে জটিল মাসাইল সম্পর্কে ফতোয়া চেয়ে পাঠানাে হত।[219]
তবে মাদানির সর্বাধিক পাণ্ডিত্য ছিল হাদিসশাস্ত্রে। হিজাযে অবস্থানকালেই তিনি হাদিসশাস্ত্রে পারদর্শিতার স্বীকৃতি লাভ করেন। বলা হয়, মসজিদে নববীতে তার দরসে বিপুল শিক্ষার্থীদের যে ভিড় জমেছিল, ইমাম মালিক ইবনে আনাসের পর এমন দৃষ্টান্ত আর কখনাে দেখা যায়নি। তিনি শায়খুল হারাম নামে প্রসিদ্ধ হন। মাকতুবাতে শায়খুল ইসলাম শিরােনামে প্রকাশিত পত্রাবলীতে তিনি হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, আকায়িদ, তাসাওউফ, ইতিহাস ও রাজনীতি সংক্রান্ত গবেষণামূলক বহু বিষয়ের সারনির্যাস তৈরী করে দিয়েছেন। তিনি এগুলাের অধিকাংশ লিখেছেন সফর অবস্থায় কিংবা জেলখানায় বসে, যেখানে প্রয়ােজনীয় কিতাবাদি সঙ্গে রাখার সুযােগ ছিল না। তাকে দারুল উলুম দেওবন্দের সদরুল মুদাবৃরিসীন ও শায়খুল হাদীস পদে মনােনীত করার কারণ ব্যাখ্যা করে তারিখে দারুল উলুম দেওবন্দ গ্রন্থে সৈয়দ মেহবুব রিজভী বলেন,
“ | হিজরী ১৩৪৬ সালে আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি যখন দারুল উলুম থেকে ইস্তফা দেন, তখন দেওবন্দি ধারার আলেমগণের মধ্যে তিনি ব্যতীত অপর কোনো ব্যক্তিত্ব বিদ্যমান ছিলেন না, যিনি দারুল উলুমের এহেন গুরুত্বপূর্ণ পদে যথাযােগ্য মর্যাদা রক্ষা করে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তার কারণে কর্তৃপক্ষের নির্বাচনী দৃষ্টি তাঁরই উপর পড়েছিল। | ” |
— [112] |
তিনি শায়খুল হাদিস পদে যােগদানের ফলে দারুল উলুম দেওবন্দের দরসে হাদীস পূর্বের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি জমজমাট হয়। আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি হানাফি ফিকহের পণ্ডিত ছিলেন। মাদানির শিক্ষকতা কালে যেভাবে বিভিন্ন পথ ও মতের শিক্ষার্থীদের সমাগম ঘটে, যাদের অনেকে এমনও ছিলেন যে, নিজে কয়েক বছর শিক্ষকতা করার পর শরিয়তের গভীর উপলব্ধি অর্জনের লক্ষ্যে দারুল উলুম আগমন করেছেন - এমন শিক্ষার্থীদেরকে হাদিস পড়ানাের জন্য শুধু হানাফি ফিকহের পাণ্ডিত্য ও বিদগ্ধতাই যথেষ্ট ছিল না। দারুল উলুমের সদরুল মুদাররিসীন পদে হিজরী ১৩৪৬ থেকে ১৩৭৭ সালের মৃত্যু পর্যন্ত ৩১ বছর তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তার অধ্যাপনায় ছিল ইমাম বুখারী সংকলিত সহীহ বুখারী ও মুহাম্মাদ ইবনে ঈসা আত-তিরমিজি সংকলিত সুনান আত-তিরমিজী। প্রত্যেক বছর পাঠদানের শুরুতে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে নিজ পর্যন্ত পূর্ণ সনদ পেশ করতেন।[220] উপমহাদেশে শাহ ওয়ালিউল্লাহ সর্বপ্রথম সিহাহ সিত্তাহ শিক্ষাদান করেন এবং অধ্যাপনার পূর্বে ধারাবাহিক সনদ বর্ণনার নিয়ম প্রবর্তন করেন।[221] মাদানি এ নীতিই অনুসরণ করেন।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী পর্যন্ত তার সনদ নিম্নরূপ: হুসাইন আহমদ মাদানি > মাহমুদ হাসান দেওবন্দি > মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবি > আবদুল গনী মুজাদ্দেদী > মুহাম্মদ ইসহাক দেহলভী > শাহ আবদুল আজিজ > শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী। এটি ছিল তার প্রধান সনদ।[222]
তিনি রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি, মাজহার নানুতুবি, খলিল আহমদ সাহারানপুরি প্রমুখ থেকেও হাদিস বর্ণনার ইজাযত পেয়েছেন। এদের প্রত্যেকের সূত্র সর্বশেষে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী পর্যন্ত গিয়ে পৌছে।
পাঠ দানের সময় তিনি উপরােক্ত সনদ, আসমাউর রিজাল ও মতনের বিশ্লেষণ করতেন।[223]
সিহাহ সিত্তাহ সংকলকমণ্ডলীর কেউ হানাফি ফিকহের অনুসারী ছিলেন না। তাই আপাত দৃষ্টিতে হানাফি ফিকহকে হাদিস থেকে দূরে বলে ভুল ধারণার উদ্রেক হয়ে থাকে। মাদানি নিজে হানাফি ফিকহের অনুসারী ছিলেন। তিনি হানাফি ফিকহের প্রত্যেকটি মাসয়ালা সিহাহ গ্রন্থের হাদিস দ্বারা এমনভাবে প্রমাণ করতেন যে, শিক্ষার্থীদের মনে হত যেন হানাফি ফিকহই হাদিসের অধিক অনুকূলে অবস্থিত।[224] তার শ্রেণীকক্ষের ঐ সকল বক্তৃতা শিক্ষার্থীরা লিপিবদ্ধ করে। অনেকে সেগুলাে ‘তাকরীরে মাদানি’ শিরােনামে গ্রন্থাকারে মুদ্রণ করেছেন। রেজাউল করীম ইসলামাবাদীর নিকট শ্রেণীকক্ষে লিখিত অনুরূপ একটি অমুদ্রিত পাণ্ডুলিপি আজো বিদ্যমান।
‘আনফাসুল আরিফীন’ গ্রন্থে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী হাদিস অধ্যাপনার তিনটি নিয়ম উল্লেখ করেছেন। ১. কোন ব্যাখ্যা ব্যাতিরেকে শিক্ষার্থীদেরকে সহীহ সনদের মাধ্যমে শুধু মাত্র হাদীসটি শুনিয়ে দেওয়া। ২. হাদিস শােনানাের সময় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা করা। ৩. হাদীসের ভিত্তিতে শরিয়তের বিধি-বিধান বিস্তারিত আলােচনা ও পর্যালােচনা করা। শাহ ওয়ালিউল্লাহ নিজে প্রধানত দ্বিতীয় নিয়মে হাদিস পড়াতেন। দেওবন্দে আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি তৃতীয় নিয়মে অধ্যাপনা করেন। মাদানির পাঠদানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় উভয় নিয়মের অনুসরণ পাওয়া যায়। তিনি মদিনার মসজিদে নববীতে অধ্যাপনাকালে তৃতীয় নিয়মকে বেশি অনুসরণ করেছেন। দেওবন্দে তার নিয়ম ছিল শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ছয় মাস পর্যন্ত প্রত্যেক হাদিসের বিশদ ও বিস্তারিত আলােচনা করা। পরবর্তী চার মাস চলত সংক্ষিপ্ত আলােচনা। অবশেষে শিক্ষাবর্ষের শেষ দিনগুলােতে শুধু সামা (শুধু মাত্র হাদিস শুনিয়ে দেওয়া)-এর নিয়মে অধ্যাপনা চালিয়ে কিতাব সমাপ্ত করে দিতেন।[225]
মুহাদ্দিসের কাছে হাদিস অধ্যয়নের সাধারণ পদ্ধতি দু’টি। কোথাও মুহাদ্দিস নিজে হাদীস পাঠ করেন আর শিক্ষার্থীরা তা শ্রবণ করে। আবার কোথাও শিক্ষার্থীরা হাদিস পাঠ করে আর মুহাদ্দিস তা শ্রবণ করেন। মাদানির সবকে উভয় পদ্ধতিই চালু ছিল।[226] তার দরসে বছরের শুরু ভাগে সাধারণতঃ শিক্ষার্থীরাই হাদীস পাঠ করত। কিন্তু বছরের শেষভাগে তিনি নিজেই হাদিস পাঠ করতেন এবং শিক্ষার্থীরা শ্রবণ করত। তার নিকট হাদিস অধ্যয়নকারীদের সর্বমােট সংখ্যা ছিল ৪৪৮৩। এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ইতােপূর্বে কোন সদরুল মুদাররিসীনের আমলে তৈরী হয়নি।[227]
সদরুল মুদাররিসীন হিসেবে মাদানির উপর দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষা বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত ছিল। শিক্ষা বিভাগের মৌলিক নীতিমালা নানুতুবি নিজেই স্থির করে গিয়েছিলেন। মাদানির আমলে ঐ নীতিমালার বাস্তবায়ন ঘটে। ফলে শিক্ষা বিভাগ পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি উন্নতি লাভ করে। শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। তার বিশ্বাস ছিল, শুধু সনদ প্রদানের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানের কর্তব্য শেষ হয় না। বরং শিক্ষার্থীকে সকল দিক থেকে যােগ্যতা সম্পন্ন আলেম বানানাের প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া কর্তব্য।[228] এ দৃষ্টিভঙ্গির আলােকে তিনি দারুল উলুমের পাঠ্যক্রমও সংস্কার করেন। দারুল উলুমের পাঠ্যক্রমে তাফসীর শিক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। তিনি তাফসীরের বিভিন্ন মৌলিক গ্রন্থ পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেন। দাওরায়ে হাদীস শ্রেণীতে ভর্তির পূর্বশর্ত হিসেবে তিনি তাফসীরে জালালাইন ও তাফসীরে বায়যাবীর অধ্যয়ন আবশ্যকীয় করে দেন। তাছাড়া দাওরায়ে হাদীসের পর দাওরায়ে তাফসীর নামে একটি নতুন বিভাগ খােলেন। এ বিভাগে তাফসীর ও উসূলে তাফসীর সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন।[229] ইতােপূর্বে দারুল উলুমে উচ্চ পর্যায়ের ইতিহাস, ভূগোল, রাষ্ট্রদর্শন, সমাজদর্শন ইত্যাদি পড়ানাের ব্যবস্থা ছিল না। এ বিষয়গুলাে সরাসরি ধর্মীয় বিষয় না হলেও ধর্মীয় বিষয়াদির সঙ্গে এগুলাের অনেক সম্পর্ক রয়েছে বিধায় তিনি প্রয়ােজন উপলব্ধি করে সপ্তাহে একদিন এ সকল বিষয়ে আলােচনা ও শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন। আলােচক হিসেবে তিনি নিজেও অংশগ্রহণ করতেন।[230]
দারুল উলুমে প্রধানত উর্দু ও আরবি ভাষায় শিক্ষাদান করা হয়। তিনি ছাত্রদেরকে নিজ নিজ মাতৃভাষাসহ অন্যান্য ভাষা শিক্ষার প্রতি অনুপ্রাণিত করেন। তার আমলে হিন্দি ভাষা ও ইংরেজি ভাষার অধ্যয়ন এবং শরীরচর্চার জন্য নতুন ৩টি বিভাগ খােলা হয়েছিল। প্রত্যেক বিভাগের জন্য তিনি প্রশিক্ষক নিযুক্ত করে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।[231] তিনি শিক্ষার্থীদের বিশুদ্ধ কুরআন পাঠের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেন। তার উদ্যোগে দারুল উলুম থেকে দাওরায়ে হাদিসের সনদ প্রাপ্তির জন্য ইলমে কেরাআতের পারদর্শিতা ও পরীক্ষা শর্ত হিসেবে গৃহীত হয়।[230]
নানুতুবির জীবদ্দশায় সাহারানপুর, মজঃফরনগর, বুলন্দশহর প্রভৃতি স্থানে ৭/৮ টি মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। মাদ্রাসাগুলাে প্রথম দিকে দারুল উলুমের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হত।[232] মাহমুদ হাসান দেওবন্দির আমলে চতুর্দিকে এ প্রক্রিয়ার মাদ্রাসার সংখ্যা শতাধিকে পৌছে যায়। শিক্ষা অভিযানে মাদানি সবিশেষ মনােযােগী ছিলেন। মদিনা থাকাকালে,[lower-alpha 9][233] তার প্রেরণা পেয়েই আলজেরিয়া মুক্তি আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা আব্দুল হামিদ ইবনে বাদিস হিজরতের ইচ্ছা পরিত্যাগ করে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১০ বছর পর্যন্ত মাদ্রাসা স্থাপন ও ইসলামি শিক্ষা বিস্তারের অভিযান চালান।[234] মাদানির ঐ প্রেরণাদানের কথা উল্লেখ করে ইবনে বাদিস বলেন,
“ | তারই নির্দেশে আমি আলজেরিয়ায় পূর্ণ ১০ বছর ধর্মীয় শিক্ষা ও সচেতনতা সৃষ্টির কাজ চালিয়ে যাই। এ দশ বছর আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে যােগ্যতা সম্পন্ন আলেম তৈরী করা। আল্লাহর শােকর যে, আমরা এ কর্মসূচির উত্তম ফলাফল লাভ করেছি। | ” |
— [235] |
বাংলাদেশের সিলেটে অবস্থানকালে তার প্রধান কর্মসূচি ছিল গ্রাম-গঞ্জে গিয়ে মক্তব, মাদ্রাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা। মাদানির অভিযানের ফলে অদ্যাবধি সিলেট ও আসাম অঞ্চলে মাদ্রাসার সংখ্যা অন্যান্য স্থানের তুলনায় অনেক বেশি। এ প্রসঙ্গে নিজামুদ্দিন আসির আদ্রাভি বলেন,
“ | সিলেটে আজ থেকে ৬০ বছর পূর্বে শায়খুল ইসলাম মাদ্রাসা শিক্ষার আলাে প্রজ্জ্বলিত করেন। তাঁর প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ থেকে ক্রমে আরাে প্রদীপ জ্বলতে থাকে। তাই সিলেটের ভূখণ্ড আজ ইসলামী চেতনা, শিক্ষাদীক্ষা, ধার্মিকতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্যান্য সকল অঞ্চলের তুলনায় বহু গুণ এগিয়ে আছে। | ” |
— [236] |
বিহারের পূর্ণিয়া জেলায় পূর্বে কোন মাদ্রাসা ছিল না। মাদানি পূর্ণিয়ার এক ধর্মীয় সভায় গমন করেন। তিনি তার স্বাভাবিক কর্মসূচী মােতাবেক মাদ্রাসা ও মক্তব স্থাপনের প্রতি মানুষকে অনুপ্রাণিত করেন। ফলে সেখানে মাদ্রাসা বিস্তারের অভিযান শুরু হয়। বর্তমানে পৃর্ণিয়া জেলায় প্রত্যেক গ্রামে একাধিক আলেম রয়েছে।[237]
পূর্ব থেকেই উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে শিশুদেরকে জীবনের শুরুতে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান পারিবারিক ঐতিহ্য রূপে চলে আসছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলমানরা সামাজিকভাবে বিপর্যয়গ্রস্ত হয়ে পড়লে ঐ ঐতিহ্য অনেক ক্ষেত্রে অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি। মাদানি সেই ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন।[238]
তিনি মনে করেন, ভারতের মত দেশে মুসলিম শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষার দায়িত্ব সরকারের উপর ফেলে রাখা ভুল হবে। মুসলমানদের নিজেদেরকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে এবং নিজেরাই ব্যবস্থা করতে হবে।[239]
ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবারের যিনি কর্তা তার উপর পরিবারস্থ শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা কর্তব্য। কিন্তু যেহেতু আর্থিক অসচ্ছলতা ও অন্যান্য কারণে ভারতীয় অনেক পরিবারের পক্ষেই সেই কর্তব্য পালন সম্ভব হয় না। তাই তিনি মসজিদভিত্তিক মক্তব শিক্ষা চালু করতে উদ্যোগী হন। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের পক্ষ থেকে কার্যকরী ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়।[238]
শিশুশিক্ষায় শিক্ষকের ভূমিকা উপলব্ধি করে মাদানি এ দিকে মনােযােগ দেন। শিক্ষকদের সুষ্ঠ দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে তিনি শিক্ষক প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। ১৯৫৫ সালে জমিয়তে উলামার কলকাতা অধিবেশনে এ প্রস্তাব গৃহীত হয়।[238]
তিনি মসজিদের ইমাম সাহেবানের জন্যও প্রশিক্ষণের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। মসজিদ মুসলিম সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মাদানির মতে, ইমামদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে ব্যাপক ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তারের কাজ সহজে সম্পাদন করা যেতে পারে।[240]
তার দৃষ্টিতে মুসলিম শিশুদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বৈষয়িক বিষয়ের শিক্ষাদানও জরুরী। ধর্মীয় শিক্ষার নামে জাগতিক অন্যান্য শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত ও বিমুখ করে রাখা তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক স্বার্থের পরিপন্থী। [241]
মক্তব শিক্ষাকে বস্তুনিষ্ঠ ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদানের লক্ষ্যে তার নেতৃত্বে ‘দ্বীনি তালিমী কনভেনশন’ নামে একটি শিক্ষা বাের্ড গঠন করা হয়। তিনি এ বাের্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে কাজ করার জন্য ভারতের সকল মত ও পথের অনুসারী মুসলমানদের আহবান জানান। ১৯৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে বােম্বাইতে এ বাের্ড গঠিত হয়। এ মর্মে কলকাতার ভাষণে তিনি বলেন,
“ | শিক্ষা বাের্ড গঠিত হওয়া যে কোন জাতির জীবনের উন্নতি ও অগ্রগতি লাভের একটি শুভ লক্ষণ। আপনাদের কর্তব্য হবে, আপনারা যে যেই মত ও পথের সমর্থক হােন না কেন, বাের্ডকে সাহায্য করা এবং দ্বীনি তালিমী কনভেনশন নামে সকলের যে অভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, সেটিকে পারস্পরিক মতানৈক্য পরিহার করে দৃঢ় ও শক্তিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। | ” |
— [238] |
তার এ প্রচেষ্টার ফলে গােটা ভারতে মক্তব শিক্ষা ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।
উপমহাদেশের আলেমগণ সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের চিন্তাধারা ও সভ্যতার অনুকরণ ও অনুসরণের নিন্দা করেছেন।[242] তবে তাদের ভাষা কিংবা তাদের উদ্ভাবিত বৈষয়িক জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা করতে নিষেধ করেননি। এ ক্ষেত্রে মাদানির দৃষ্টিভঙ্গি পূর্বসূরিদেরই অনুরূপ ছিল। তিনি ইউরােপীয় জড়বাদী সভ্যতা অপছন্দ করেছেন। তবে ইউরােপের ভাষা কিংবা তাদের উদ্ভাবিত বৈষয়িক জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে কখনাে আপত্তি করেননি।[243] তার মতে, ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করা ফরযে কেফায়া আর বৈষয়িক জ্ঞান শিক্ষা করা মুবাহ।
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত স্কুল কলেজের শিক্ষা ইংরেজ আমল থেকে শুরু হয়। উপমহাদেশের পাঠ্যক্রম ঔপনিবেশিক সরকার কর্তৃক রচিত ও প্রবর্তিত হওয়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতীয়দের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার চেয়ে সম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষায় মনােযােগ দেওয়া হয়েছে বেশি। উপমহাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত সরকার ইংরেজদের ঐ পাঠ্যক্রম বহাল রেখেছিল বলে মাদানি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি স্কুল কলেজের পাঠ্য পুস্তক সংস্কারপূর্বক জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব করেন।[244]
জমিয়তে উলামার লখনউ অধিবেশনে বক্তৃতাকালেও তিনি প্রচলিত ইতিহাসের তীব্র সমালােচনা করেন।[245]
ভারতীয় উপমহাদেশে উর্দু ভাষার প্রচলন বহু পূর্ব থেকে চলে আসে। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকলের চেষ্টার ফলে উর্দু ভাষা অন্যতম সাহিত্যমান লাভে সক্ষম হয়। ভারতীয় মুসলমানদের শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রধান বাহন হল উর্দু। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর উর্দুর সাথে শুরু হয় বিমাতাসুলভ আচরণ। উর্দুর স্থলে হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষা চালু করা হয়। ফলে মুসলমানগণ শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে যায় এবং মন-মানসিকতার দিক থেকে হীনমন্যতার শিকারে পরিণত হয়। মাদানি ভারতীয় মুসলমানদের মাতৃভাষা উর্দুকে জীবন্ত রাখার জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি জমিয়তে উলামার পক্ষ থেকে সরকারের কাছে উর্দুকে প্রাদেশিক সরকারি ভাষার মর্যাদা প্রদানের দাবী জানান।[238]
১৯৫৭ সালের ২৭-২৮-২৯ অক্টোবর মাদানি জীবনের সর্বশেষ সভাপতির ভাষণ দেন। এ ভাষণে তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকোর্সে মুসলমানসহ ভারতের সকল সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু ও পবিত্র স্থানসমূহের আলােচনা অন্তর্ভুক্ত রাখার সুপারিশ করেন।[246]
মাদানির বিভিন্ন পরিচয় থাকলেও তার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল আধ্যাত্মিকতা, এটিই তার মূল পরিচয়।[247][248] আধ্যাত্বিকতা চর্চায় তার প্রথম ও প্রধান উৎস ছিল নিজ পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তিনি বংশগতভাবে ও শিক্ষাগতভাবে আধ্যাত্মিকতার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার পূর্বপুরুষ সকলেই পীর ছিলেন।[249] দেওবন্দ আগমনের পর তিনি যে সকল শিক্ষকের কাছে অধ্যয়ন করেছেন তারাও সমকালীন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিল।[250] তৎকালীন ভারত উপমহাদেশের দুই প্রসিদ্ধ আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন ফজলুর রহমান গঞ্জে মুরাদাবাদী ও ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি। মাদানির পিতা গঞ্জে মুরাদাবাদীর খলিফা ছিলেন। তিনি পিতার কাছ থেকে খেলাফত পাওয়ার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতায় গঞ্জে মুরাদাবাদীর সাথে সম্পৃক্ত হন। মুহাজিরে মক্কির খলিফা ছিলেন রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি। মাদানি গাঙ্গুহির কাছ থেকে খেলাফত পাওয়ার মাধ্যমে মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতায় মুহাজিরে মক্কির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন।[250][251] সমকালের অন্যান্য আধ্যাত্মিক মনীষীর দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন কুতুবুল আলম।[252]
তাসাউফ বা তরিকত নিয়ে ৩টি মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। একদল তরিকতকে শরিয়তের বাইরে মনে করেন এবং তরিকত পালন করতে গিয়ে শরিয়ত বাদ দেন। আরেকদল তরিকত বিষয়টাই অস্বীকার করেন। অন্যদল শরিয়ত ও তরিকত দুইটাই অনুসরণ করেন। তাদের মতে তরিকতের নামে কোনো প্রকার শিরক ও বিদআতকে প্রশ্রয় যেমন দেওয়া যায় না তদ্রূপ তরিকতকে অস্বীকার করাও উচিত নয়। পরিভাষায় আলেমগণের এ দলটিকে ‘ইতিদালপন্থী’ বলা হয়। মাদানি এই শেষােক্ত মতেরই সমর্থক ছিলেন।[253] এ কারণেই তিনি একই সাথে তরিকতের দীক্ষা দিতেন, আবার অন্যদিকে শিরক ও বিদআতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যেতেন। ইসলামের প্রামাণ্য গ্রন্থাবলি উদ্ধৃতি করে তরিকত ও বায়আত সম্পর্কে তিনি এক বক্তব্যে বলেন,
“ | আজকাল কিছু লােক বলে বেড়াচ্ছে যে, তরিকত শরিয়তের পরিপন্থী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তরিকতের কোন প্রমাণ নেই। তাদের এ মন্তব্য সত্য নয়। তরিকত ও বায়আত মূলতঃ শরিয়তেরই হুকুম পালনে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ার নাম। | ” |
— [254] |
তার মতে সঠিক ও সুষ্ঠ পদ্ধতিতে রিয়াযত ও মুজাহাদা করার মাধ্যমে মানুষ ওলী হতে পারে। কিন্তু ওলী কখনাে নবির মাকামে পৌছতে পারেন না। এমনকি সাহাবা যুগের পরবর্তীকালীন ওলীগণ মুজাহাদার মাধ্যমে কোন সাধারণ সাহাবীর মাকাম পর্যন্ত পৌছেন না।[255] তার মতে তরিকত শরিয়তের ঊর্ধ্বে নয়। তরিকতের দ্বারা মানুষ এমন কোন মাকামে পৌছে না, যেখানে পৌছলে তার থেকে শরিয়তের আদেশ-নিষেধ রহিত হতে পারে। বরং তরিকত হল শরিয়তেরই সেবক ও সাহায্যকারী।
কোন কোন সূফী মনে করেন যে, কাশফ, কারামত, নূর, লতীফা, ফানা ও বাকা - এগুলাে অর্জনই হল তাসাউফের কাম্য বিষয়। অনেকে এগুলাে অর্জনের জন্যই নিরন্তর সাধনা করে থাকেন। মাদানির মতে এগুলাে তাসাউফ ও তরিকতের কাম্য বিষয় নয়। তরিকতের কাম্য বিষয় হল নবির সুন্নত অনুসরণ ও শরিয়তের যাবতীয় আহকাম পালনে দৃঢ় অভ্যাস গড়ে তােলা, নিজের মনে আল্লাহ ও রাসূলের ভালবাসা পয়দা করা এবং ইবাদতের ও বন্দেগীর ক্ষেত্রে ইহসানের স্তর অর্জন করা। মুরিদদের কাছে লিখিত চিঠিপত্র ও উপদেশ বাণীতে তাই তিনি এগুলাের উপরই বেশি জোর দিতেন।[256]
তরিকতকে পরিমিতি বজায় রাখার মাধ্যমে গ্রহণ করাই ছিল তার প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি কুরআনকে তাসাউফ বা তরিকতের উৎস মনে করতেন। তার মতে ইসলামের আকায়েদ, ফিকহ, কালাম ও হাদিস প্রভৃতি যেমন নবীযুগ থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী কালে চূড়ান্ত বিকাশ লাভ করেছে, তেমনি তাসাউফ ও তরিকতও নবীযুগ থেকেই শুরু হয়। তারপর প্রয়ােজন ও প্রেক্ষিত অনুসারে এ ইলম ক্রমান্বয়ে বিকশিত ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়।[257]
তিনি নীতিগতভাবে তরিকতের নাম বিদআত পালনের ঘাের বিরােধী ছিলেন। চতুর্দিকে বিদআতের সয়লাব দেখে তিনি মুরীদদের প্রথম শপথ বাক্যের মধ্যেই ‘বিদআত করব না’ কথাটি যুক্ত করে বিদআত প্রতিরােধের উদ্যোগ নেন। বেরলভি আলেমদের নেতা আহমদ রেজা খান আরব দেশে গিয়ে বিদআতের সমর্থনে ফতোয়া সংগ্রহের চেষ্টাকালে তিনি তাকে আরব থেকে তাড়া করেন। এক পর্যায়ে তাকে মদিনা থেকে বহিষ্কারের ব্যবস্থাও গ্রহণ করেন। তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘আশ শিহাবুস সাকিব’ এ মর্মেই রচিত হয়।[258] মুরিদ হওয়াকে তিনি আধ্যাত্মিক বরকত লাভের দিক থেকে বিশ্লেষণ করেছেন।
তিনি তরিকতের সিলসিলা চতুষ্টয়ের ইজাযতপ্রাপ্ত ছিলেন বলে চার তরীকার উপরই বায়আত করতেন।[259] তার মতে মুরিদের জন্য পীর হলেন একজন শিক্ষক ও চিকিৎসক। কাজেই কোন ব্যক্তি পীর হওয়ার জন্য তার মধ্যে মুরিদের সে সব কাজ সম্পাদনের যােগ্যতা থাকা আবশ্যক। যে ব্যক্তি শরিয়তের যাহিরী ও বাতিনী আহকাম সম্পর্কে জানে না, আত্মিক রােগ ব্যাধির স্বরূপ ও প্রতিকার সম্পর্কে যার পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই — এমন ব্যক্তি পীর হওয়ার উপযুক্ত নয়। পীর হওয়ার জন্য তাকে শরিয়ত ও সুন্নাতের পূর্ণ পাবন্দ থাকা, নিজে দীর্ঘকাল যাবত রিয়াযত ও সাধনায় অভ্যস্ত হওয়া এবং কোন কামিল পীরের সান্নিধ্যে দীর্ঘ সময় অবস্থানপূর্বক এ সব কাজ রপ্ত করে নেওয়া আবশ্যক।
ইসলাহ মানে সংশােধন। তরবিয়ত মানে গড়ে তােলা।[lower-alpha 10] মুরিদের ইসলাহ ও তরবিয়তের ক্ষেত্রে সুফিগণ সাধারণত চার পর্যায়ে কাজ করে থাকেন। যথা: আখলাক, মুজাহাদা, শােগল ও হাল।[lower-alpha 11] এগুলো নিয়ে সুফিগণের মধ্যে নানারকম নীতি প্রচলিত রয়েছে।
মাদানি ভারতীয় উপমহাদেশের বাসিন্দা ছিলেন। উপমহাদেশীয় মানুষের প্রকৃতি আরব জাতি থেকে ভিন্ন। তাই তার দীক্ষানীতির মধ্যেও কিছুটা ভিন্নতা ও পৃথক বৈশিষ্ট্য ছিল। তার প্রধান নীতি ছিল মুরিদের মনে আল্লাহর প্রচণ্ড ভালবাসার উদ্রেক করে দেওয়া। এটি চিশতিয়া তরিকার অন্যতম মূলনীতিও। তিনি মুতাকাদ্দিম সুফিগণের মত প্রথমেই আখলাক গঠনের ব্যাপারে মনােযােগ না দিয়ে মুতাআখখির সুফিগণের অনুসরণে প্রথমে শােগলের তালিম দেন। তার এ নীতির উদ্দেশ্য হল, বিন্যাসের ক্ষেত্রে শোগলকে অগ্রবর্তী করে দেওয়া। এর দ্বারা স্রষ্টার প্রতি ভালবাসা বৃদ্ধি পায়। এ ভালবাসা ক্রমে মুরিদের আখলাক ও নৈতিকতাকেও সংশােধিত করে দেয়।
শোগলে তিনি আহমেদ সিরহিন্দির নীতি অনুসরণ করতেন। এজন্য তিনি তিনটি বিষয়কে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন করার প্রতি বেশি জোর দেন। বিষয়গুলাে হল: ইলম, আমল ও ইখলাস।[261] তরবিয়তের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন তার আরেক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল। তাসাউফের পথ দিয়ে যুগে যুগে নানা রকমের বিদআত মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশের কারণে তিনি মুরিদদের এমন কোন শােগল অনুশীলনের জন্য দিতেন না যেটি উত্তরকালে বিদআতের দিকে মােড় নিতে পারে। সুফিদের ব্যবহৃত শােগলসমূহের মধ্যে যেগুলাে কোন প্রকার ক্ষতির আশংকাযুক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল তিনি সেগুলাে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করেন। সামা, কাওয়ালি, ইশকে মাজাযী প্রভৃতি অনুশীলনের জন্য কোন মুরিদ অনুমতি প্রার্থনা করলেও তিনি অনুমতি দিতেন না। তবে ‘তাসাববুরে শায়খ’[lower-alpha 12] সম্পর্কে কিছুটা নমনীয়তা প্রদর্শন করে গিয়েছেন।[262] শাহ ইসমাইল শহীদ, সৈয়দ আহমদ বেরলভি, আশরাফ আলী থানভী প্রমুখ সুফিগণ ‘তাসাববুরে শায়খ’ নিষেধ করেছেন। মাদানির মতে তাসাববুরে শায়খ ভিত্তিগতভাবে নাজায়েজ নয়। তবে শায়খকে হাজির-নাজির জ্ঞান করা কিংবা মুরিদের অন্তরে তিনি অদৃশ্য থেকে কোন তাসাররুফ করেন মনে করা শিরক।
মুরিদদেরকে তিনি যে সব শোগলের মাধ্যমে তালিম দিতেন সেগুলাে ছিল: ৬ তাসবীহ, ১২ তাসবীহ, পাস আনফাস যিকর, যিকরে কলবী ও মােরাকাবা। পূর্ববর্তীদের মধ্যে ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি, রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি প্রমুখ সুফিও এ নীতিতে দীক্ষা দেন।
মাদানির নির্ধারিত কোন খানকাহ ছিল না। আহমেদ সিরহিন্দির ন্যায় মুরিদদের সঙ্গে তার যােগাযােগের প্রধান মাধ্যম ছিল চিঠিপত্র।[263] তাছাড়া প্রতি রমযানে অনেক ভক্ত ও মুরিদ নিয়ে তিনি ইতিকাফ করতেন। তার দৃষ্টিতে তাসাউফ মানে বৈরাগ্যবাদ নয়। মাদানি দীক্ষাপ্রাপ্তদের মধ্যে এক বা একাধিক লােককে খলিফা তথা স্থলাভিষিক্ত ঘােষণা করেন। তার মতে, বায়আত দু'প্রকারের। বায়আতে তওবা ও বায়আতে ইরশাদ।[lower-alpha 13][264]
মাদানি ১৬৭ জনকে খেলাফত দিয়েছেন বা উত্তরসূরি মনোনীত করেছেন। তাদের প্রত্যেকের নাম ও ঠিকানা তার জীবদ্দশায়ই প্রকাশিত হয়েছে। খলিফাগণের অধিক সংখ্যক বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের অধিবাসী। মিয়ানমার ও দক্ষিণ আফ্রিকায়ও তার খলিফা রয়েছে।[265] তার উল্লেখযোগ্য খলিফাগণের মধ্যে রয়েছেন:
মাদানি লেখক হিসেবেও সমাদৃত ছিলেন। তিনি ধর্ম, অর্থনীতি এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে অসংখ্য বই লিখেছিলেন।[268] মুত্তাহেদায়ে কাওমিয়াত আওর ইসলাম তার সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য রচনা। এই বইয়ে তিনি সম্মিলিত জাতীয়তাবাদ ও অখণ্ড ভারতের পক্ষে কথা বলেছেন। বিভিন্ন সময়ে দেওয়া তার বক্তৃতা সমূহ সংকলন করেও কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তার রচনার মূল্যায়ন করে সত্যেন সেন লিখেছেন,[269]
“ধর্মীয় ব্যাপারে মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানির দৃষ্টি ছিল অত্যন্ত গভীর ও উদার। উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস এবং মুসলিম দেশগুলির সঙ্গে পাশ্চাত্য শক্তিগুলির আন্তর্জাতিক অবস্থা সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান ছিল। তাঁর মত একান্ত ধর্মপ্রাণ একজন মাওলানার পক্ষে এটা কি করে সম্ভব হয়েছিল, সে কথা ভাবতে গেলে বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। মাওলানা মাদানি সমাজ ও রাষ্ট্রের সমস্যাগুলি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতেন। উপমহাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে তাঁর যে সমস্ত রচনা আছে, তা থেকে এর যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।”
১৯৫৫ সালে তিনি হজ্জে গমন করেন, যা ছিল তার জীবনের শেষ হজ্জ। এ হজ্জের পর তিনি বেশিদিন বেঁচে থাকেন নি। ঐ বছর জেদ্দা নৌবন্দরে তাকে রাজকীয় সম্মান জানানো হয় এবং তাকে স্বাগত জানিয়ে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ‘শায়খুল আরব ওয়াল আজম’ খেতাব দিয়ে বিশেষ প্রবন্ধ ছাপানো হয়।[140] হজ্জ শেষে মদিনা থেকে বিদায়ের সময় তিনি মুআজাহা শরীফে তিন ঘণ্টা দাড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন করেছিলেন।[270] এ সফরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে ভারতে এসে পূর্বের ন্যায় একটানা সফর করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১৯৫৭ সালের ৪ জুলাই তিনি দেড় মাসের সফর সূচি নিয়ে মাদ্রাজ গমন করেন। অত্যধিক অসুস্থতায় ১৫ দিন যেতেই সফর থেকে ফিরে আসেন। ২৫ আগস্ট হাদিসের অধ্যাপনা করাও তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তিনি এই দায়িত্ব সৈয়দ ফখরুদ্দিন আহমদের নিকট ন্যস্ত করে বাসায় অবস্থান করেন।[271] ১ ডিসেম্বর তিনি কিছুটা সুস্থতা অনুভব করেন। ৫ ডিসেম্বর সকাল ৯টা বাজে কামরা থেকে বের হয়ে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করে নিজ কামরায় বিশ্রামে চলে যান এবং এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।[272] পরদিন শুক্রবার সকাল ৯টায় দারুল উলুম দেওবন্দ চত্বরে মুহাম্মদ জাকারিয়া কান্ধলভির ইমামতিতে তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে মাজারে কাসেমিতে মাহমুদ হাসান দেওবন্দির পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।[273] মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর ৬ মাস ২৪ দিন।
ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ তার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে বলেছিলেন,
“দারুল উলুম দেওবন্দ ও জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের সভাপতি মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানির মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি খুবই ব্যথিত। তিনি একজন মহান ব্যক্তি, ইসলামি পণ্ডিত এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সৈনিক ছিলেন। এটি জাতির জন্য এক অসামান্য ক্ষতি হল।”
— [274]
প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন,
“মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানির মৃত্যুর সংবাদ আমার অনুভূতিকে মারাত্মকভাবে আহত করেছে, হুসাইন আহমদ মাদানির মৃত্যু একজন দেশপ্রেমিকের মৃত্যু। তিনি জাতীয় আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই ঘটনায় আমি তার পরিবার ও দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতি সমবেদনা জানাই।
— [274]
শিক্ষামন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন,
“হুসাইন আহমদ মাদানি জাতির জন্য যে ভূমিকা পালন করেছেন তা অনেক মূল্যবান,আমরা তাকে ভুলতে পারি না যিনি জাতির পক্ষে নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন। তিনি কংগ্রেসে একটি নতুন চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছেন। কারাগারে ও বাইরেও তিনি বহু কষ্টের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু এক বিরাট জাতীয় ক্ষতি।”
— [274]
ভারত সরকার যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার শেষকৃত্যের আয়োজন করেছিল। প্রধান মন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সহ ভারত সরকারের অনেক মন্ত্রী এই আয়োজনে সশরীরে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।[275]
১৯৫৪ সালে ভারত সরকার কর্তৃক তিনি পদ্মভূষণ পুরস্কারে ভূষিত হন।[6] ২০১২ সালের ২৯ আগস্ট ভারতীয় ডাক বিভাগ তার সম্মানে একটি স্মারক ডাকটিকিট বের করেছিল।[274] দেওবন্দে তার নামে একটি সড়কের নাম “মাওলানা মাদানি রোড” এবং সিলেটে তার স্মৃতি বিজড়িত স্থানে মাদানি চত্বর নির্মিত হয়েছে।[276] ২০০১ সালে ভারতে “হুসাইন আহমদ মাদানি এডুকেশনাল ট্রাস্ট” নামে একটি শিক্ষা ও সেবামূলক সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।[277] তার শিষ্যরা বিশ্বব্যাপী তার নামে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। দেওবন্দে এরকম একটি কারিগরি কলেজের নাম মাদানি টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট। দারুল উলুম দেওবন্দে তিনি যে ভবনে অবস্থান করতেন তার নাম মাদানি মনযিল এবং যে গেইট গিয়ে যাতায়াত করতেন সেটি মাদানি গেইট নামকরণ করা হয়েছে।
মাদানি জীবদ্দশায় ১৯৫৩ সালে নকশে হায়াত নামে স্বরচিত একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার মৃত্যুর পর ১৯৫৮ সালে তার জীবন-কর্ম নিয়ে রোজনামা আল জমিয়ত শায়খুল ইসলাম সংখ্যা বের করেছে। পরবর্তীতে তার অনেক জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং তার উপর অনেক পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। তার অন্যান্য জীবনীগ্রন্থের মধ্যে হুসাইন আহমদ মাদানি: দ্য জিহাদ ফর ইসলাম এন্ড ইন্ডিয়াস ফ্রিডম[278], মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি: এ বায়োগ্রাফিকাল স্টাডি এবং জীবনীকারদের মধ্যে আবুল হাসান আলী নদভী, মুহাম্মদ মিয়া দেওবন্দি, নিজামুদ্দিন আসির আদ্রাভি, কাজী মুতাসিম বিল্লাহ, মুহিউদ্দীন খান, মুশতাক আহমদ, দেশ রাজ গোয়েল, বারবারা ডি. মেটকাল্ফ, আবু সালমান শাহজাহানপুরী অন্যতম।[279]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.