Loading AI tools
জার্মান রসায়নবিদ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
হের্মান এমিল ফিশার (অক্টোবর ৯, ১৮৫২ - জুলাই ১৫, ১৯১৯) একজন জার্মান রসায়নবিদ। তিনি কার্বহাইড্রেট সংক্রান্ত গবেষণার জন্য ১৯০২ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ফিশার এস্টারিফিকেশন আবিষ্কারের কারণে তিনি সমধিক পরিচিত। ১৮৭৫ সালে তিনি ফিনাইল হাইড্রাজিন প্রস্তুত করেন যা অ্যালডিহাইড ও কিটোনের সাথে বিক্রিয়া করে নির্দিষ্ট গলনাঙ্ক বিশিষ্ট হাইড্রাজোন উৎপন্ন করে। তিনি এ বিকারক ব্যবহার করে সুগার রসায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সুগারের গাঠনিক সংকেত নির্ণয়ে ও সংশ্লেষণে তার ব্যাপক অবদানের জন্য তাকে “সুগার রসায়নের জনক” হিসেবে অভিহিত করা হয়।[1] তিনি প্রোটিন ও রঞ্জক পদার্থের রসায়নেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।
হের্মান এমিল ফিশার | |
---|---|
জন্ম | অক্টোবর 1852 |
মৃত্যু | জুলাই ১৫ ১৯১৯ |
জাতীয়তা | জার্মানি |
মাতৃশিক্ষায়তন | বন বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্রাসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় |
পরিচিতির কারণ | চিনি ও কার্বহাইড্রেড সংক্রান্ত গবেষণা |
পুরস্কার | রসায়নে নোবেল পুরস্কার (১৯০২) |
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন | |
কর্মক্ষেত্র | রসায়ন |
প্রতিষ্ঠানসমূহ | মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৭৫-৮১) এর্লাঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৮১-৮৮) উর্জবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৮৮-৯২) বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৯২-১৯১৯) |
হের্মান এমিল ফিশার জার্মানির ইউস্কিরচেনে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিনেল একজন ব্যবসায়ী। স্নাতক শেষ করার পর তিনি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার বাবা তাকে পরিবারের ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। এরপর ১৮৭২ সালে ফিশার বন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, কিছুদিন না যেতেই তিনি আবার স্ট্রাসবার্গ বিশ্ববিদ্যাললয়ে ভর্তি হন। ১৮৭৪ সালে ফিশার ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়েই তার চাকরিজীবন শুরু করেন।
১৮৭৫ সালে ফিশার মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেক জার্মান বিজ্ঞানী ভন লিবিগের স্থলাভিষিক্ত হন এবং তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈব রসায়নের সহকারী অধ্যাপক হিসিবে নিযুক্ত হন। ১৮৭৮ সালে ফিশার বিশ্লেষণধর্মী রসায়নের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। একই সালে তাকে চ্যাপেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান পদে যোগ দেয়ার আমন্ত্রন জানানো হয়, কিন্তু তিনি এ আমন্ত্রন প্রত্যাখ্যান করে। ১৮৮১ সালে তিনি এর্লাঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং এসময় সে আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়ে উঠে। ১৮৮৫ সালে তাকে উর্জবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপক পদে যোগ দেয়ার আমন্ত্রন জানালে তিনি তা গ্রহণ করেন এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮৮২ সাল পর্যন্ত চাকরিরত থাকেন। পরে তিনি রসায়নের চেয়ারম্যান পদে এই. ডব্লিউ. হফম্যানের স্থলাভিষিক্ত হন এবং ১৯১৯ সাল পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন।
মিউনিখে অবস্থানকালে ফিশার তার চাচাত ভাই অটো ফিশার হাইড্রাজিনের উপর গবেষণা করেন। তারা ট্রাইফিনাইল মিথেন থেকে প্রাপ্ত বিশেষ রঞ্জক পদার্থের গঠনসংক্রান্ত নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করেন এবং তা পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন। এর্লাঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থাকাকালে ফিশার চা, কফি এবং কোকোয়া এর গঠন সম্পর্কিত গবেষণা করেন এবং এওসকল পদার্থের গঠনের উপর এক নতুন সাংশ্লেষনিক ধারা প্রতিষ্ঠা করেন। তবে পিউরিন এবং সুগার রসায়নের উপর গবেষণার জন্য ফিশার সর্বাধিক খ্যাতি অর্জন করেন। ১৮৮২ হতে ১৯০৬ সালের মধ্যে তিনি এই গবেষণা করেন। এই গবেষণাই প্রমাণ করলো যে উদ্ভিদে প্রাপ্ত অ্যাডেনিন, জ্যানথিন, ক্যাফেইন, প্রাণীর বিষ্ঠায় প্রাপ্ত ইউরিক এসিড, গুয়ানিন-সমস্তই একই সমগোত্রীয় শ্রেণীর। এগুলোর যেকোন একটি থেকে অপরগুলো পাওয়া যায়। এরা নাইট্রজেন চক্রের মাধ্যমে গঠিত এক মৌলিক ব্যবস্থা যাতে ইউরিয়ার ন্যায় আণবিক গঠন বিদ্যমান, সেই ব্যবস্থার অন্তর্গত বিভিন্ন হাইড্রক্সিল ও অ্যামিনের সাথে সদৃশ। প্রথমে প্রাপ্ত এই মৌলিক ব্যবস্থাকেই ১৮৮৪ সালে তিনি পিউরিন নামকরণ করেন এবং ১৮৯৮ সালে সংশ্লেষণ করেন। ১৮৮২ হতে ১৮৯৬ সালের মধ্যে তার গবেষণার মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে ঘটিত পদার্থের সাথে কম-বাশি সদৃশ এরকম অসংখ্য কৃত্রিম পদার্থ উদ্ভূত হয়।
১৮৮৪ সালে ফিশার তার বিখ্যাত সুগার রসায়ন সংক্রান্ত গবেষণা শুরু করেন, যা এসকল পদার্থ সম্পর্কিত জ্ঞানকে এক নতুন মাত্রা প্রদান করে এবং এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। ১৮৮০ সালের আগেও গ্লুকোজের অ্যালডিহাইড সংকেত বিজ্ঞানীদের জানা ছিল, কিন্তু ফিশার একে রুপান্তর ধারা মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেন। যেমন এ্যালডোনিক এসিডে অক্সিডেশন ও ফিনাইল-হাইড্রাজিনের ক্রিয়া যা তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন এবং এটি ফিনাইল-হাইড্রাজোনের গঠনকে সম্ভবপর করে তোলে। এছাড়া ১৮৮৮ সালে তিনি গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ ও ম্যানোজের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন।১৮৯০ সালে তিনি গ্লুকোনিক ও ম্যানোইক এসিডের এপিমেরিজেশনের মাধ্যমে সুগারের সমাণু ও স্টেরিও রসায়ন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯১ হতে ১৮৯৪ সালের মধ্যে ফিশার পরিচিত সকল সুগারের স্টেরিও রাসায়নিক বিন্যাস বের করেন এবং বিজ্ঞানী জ্যাকোবাস হেনরিকাসের অপ্রতিসম কার্বন পরমাণু তত্ত্বের সুপ্রযুক্ত প্রয়োগের মাধ্যমে সঠিকভাবে এদের সমাণুর ভবিষ্যদ্বাণী করতে সমর্থ হন। এক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় সাফল্য হছে গ্লিসারল হতে গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ ও ম্যানোজ সংশ্লেষণ।
সুগার রসায়নের উপর ফিশারের গবেষণা অমর কীর্তি স্বরূপ প্রতীয়মান। গ্লুকোসাইড সংক্রান্ত গবেষণা এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ।
১৮৯৯ থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে প্রোটিন সম্পর্কিত জ্ঞানের জগতে ফিশার ব্যাপক অবদান রাখেন। সে পৃথক পৃথক অ্যামিনো এসিডের বিচ্ছেদ, শনাক্তকরনের ক্ষেত্রে কার্যকর ও বিশ্লেষনিক পদ্ধতি অনুসন্ধান করেছিল। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রোলিন ও অক্সিপ্রোলিন নামক দুইটি নতুন ধরনের চাক্রিক কাঠামোর অ্যামিনো এসিড আবিষ্কার করেন। তিনি বিভিন্ন অ্যামিনো এসিডসমূহকে একত্র করার জন্য প্রোটিনের সংশ্লেষণ সম্বন্ধে গবেষণা করেছিলেন। তিনি এমন একটি বন্ধন আবিষ্কার করেছিলেন যা প্রোটিনসমূহকে একত্রে শিকল কাঠামোতে যুক্ত করে। এ বন্ধনটির নাম পেপ্টাইড বন্ধন। এর মাধ্যমে তিনি পরবর্তিতে ডাই-পেপ্টাইড, ট্রাই-পেপ্টাইড ও পলি-পেপ্টাইড বন্ধন আবিষ্কার করেন। ১৯০১ সালে ফিশার ডাই-পেপ্টাইডের গ্লাইসিল-গ্লাইসিন সংশ্লেষণ করতে সমর্থ হন। এই বছরে তিনি দুধের ননীর হাইড্রোলাইসিসের উপর তার গবেষণা প্রকাশ করেন। এই গবেষণা ও এ সংক্রান্ত তার পরবর্তি গবেষণার ফলে প্রোটিনের গঠন আরও ভালভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হল। তার এ গবেষণাই প্রোটিনের উপর পরবর্তি অন্যান্য গবেষণার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে।
উল্লিখিত গবেষণা ছাড়াও ফিশার এনজাইম ও লাইকেনে উপস্থিত রাসায়নিক পদার্থ সম্পর্কে গবেষণা করেন। চামড়া পাকা করার কাজে ব্যবহৃত ট্যানিনের রাসায়নিক গঠন সম্পর্কেও তিনি গবেষণা করেন। জীবনের শেষভাগে ফিশার চর্বি সম্পর্কেও গবেষণা করেন। ১৮৯০ সালে এনজাইমের পারস্পারিক ক্রিয়া প্রত্যক্ষ করার জন্যে “লক এন্ড কী মডেল” প্রস্তাব করেন, যদিও এ সংক্রান্ত পরবর্তি গবেষণা তার মডেলকে সব এনজাইমের ক্ষেত্রে সমর্থন করেন। সুগার রসায়ন, গ্লুকোজের জৈব সংশ্লেষন,[2] পিউরিনের উপর গবেষণার জন্য ফিশার বিখ্যাত হয়ে আছেন।
১৮ বছর বয়সে, বন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পূর্বে ফিশার পাকাশয় প্রদাহে ভুগছিলেন। এর ফলে এর্লাঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের চেয়ারম্যান পদে আর বহাল থাকতে পারেননি। এছাড়া এই কারণে জুরিখের ফেডারেল টেকন্নিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেক জার্মান রসায়নবিদ, ভিক্টোর মেয়ারের পদে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হলে তাকে তা প্রত্যাখ্যান করতে হয়। এই প্রদাহের কারণে ১৮৮৮ সালে উর্জবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পূর্বে তিনি এক বছরের ছুটি নেন। জীবনব্যাপী ফিশার ছিলেন অসাধারণ মেধাশক্তির অধিকারী। এজন্য তিনি যেসব বক্তৃতা লিখেছিলেন, সবগূলোর পাণ্ডুলিপি তার মুখস্থ ছিল; যদিও তিনি ভাল বক্তৃতা দিতে পারতেন না। উর্জবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে ফিশার পাহাড়ের পাদদেশে এবং জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্টে ঘুরে বেড়াতে খুব ভালবাসতেন। তিনি রসায়ন ও বিজ্ঞানের যেসব শাখায় গবেষণা করেছিলেন, তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল। বৈজ্ঞানিক সমস্যার প্রতি ফিশারে গভীর অনুরাগ, সত্যের প্রতি আকর্ষণ, অন্তর্জ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক প্রস্তাবস্মূহের নিরীক্ষামূলক প্রমাণের প্রতি তার নির্বন্ধতা তাকে সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানিদের অন্যতম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
১৮৮৮ সালে ফিশার এর্লাঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানাটমির অধ্যাপক জোসেফ ভন গার্লেচের কন্যা অ্যাগনেস গার্লেচকে বিয়ে করেন। বিয়ের মাত্র হাত বছরের মাথায় ফিশারের স্ত্রী মারা যান। তাদের তিনটি ছেলে ছিল, যাদের একজন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মারা যায় এবং আরেকজন ২৫ বছর বয়সে বাধ্যতামূলক মিলিটারি প্রশিক্ষণের সময় আত্মহত্যা করে। ১৯১৯ সালে ফিশার বার্লিনে তার ছেলের মত আত্মহত্যা করেন।[3][4] বড় ছেলে হের্মান অটো লরেঞ্জ[5] ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বার্কলে) প্রাণরসায়নের অধ্যাপক ছিলেন।
ফিশার তার অবদানের জন্যে ইংল্যান্ডের ক্রিস্টিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়, ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয় হতে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। তাকে প্রুসিয়ান অর্ডার অফ মেরিট প্রদান করা হয়। ১৯০২ সালে ফিশার সুগার রসায়ন ও পিউরিন সংশ্লেষণে অবদানের জন্য রসায়নে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া এবং ধারণা ফিশারের নামে নামকরণ করা হয়েছেঃ
১৯১৯ সালে ফিশারের মৃত্যুর পর জার্মান রসায়ন সমিতি এমিল ফিশার মেমোরিয়াল মেডেল প্রচলন করে।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.