হাজরে আসওয়াদ
কাবার দেয়ালের কালো পাথর উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
কাবার দেয়ালের কালো পাথর উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
হাজরে আসওয়াদ (আরবি: الحجر الأسود al-Ḥajar al-Aswad বাংলা:কালো পাথর) হলো মক্কার কাবা গৃহে রক্ষিত কালো পাথর। যা কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মাতাফ থেকে দেড় মিটার (চার ফুট) উঁচুতে অবস্থিত।[1][2] মুসলিম বিশ্বাস অনুযায়ী এই পাথর আদম ও হাওয়ার সময় থেকে পৃথিবীতে রয়েছে।[3]
প্রাক ইসলামি পৌত্তলিক সমাজেও এই পাথরকে সম্মান করা হত। ইসলামি বর্ণনা অনুযায়ী, রাসুল মুহাম্মদ(সাঃ) ৬০৫ সালে এটি কাবার দেয়ালে স্থাপন করেছিলেন। বর্তমানে এটি একটি রূপার ফ্রেমে আটকানো অবস্থায় কাবার সাথে সংযুক্ত রয়েছে। এর রং গাঢ় কালো এবং লক্ষাধিক হাজির স্পর্শের কারণে এটি মসৃণ আকার লাভ করেছে। এটি আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ) এর সময় বেহেশত থেকে পৃথিবীতে এসে পড়ে। [4]
হজ্জ বা উমরার অংশ হিসেবে মুসলিমরা তাওয়াফ করে থাকেন। এর শুরুতে হাজরে আসওয়াদে চুমু দেওয়ার রীতি রয়েছে।[5][6] ফ্রেমে মুখ ঢুকিয়ে হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করতে হয়। এর পাশে ২৪ ঘণ্টা উপস্থিত থাকে সৌদি পুলিশ। তারা খেয়াল রাখে, ফ্রেমে মাথা ঢোকাতে বা চুম্বন করতে কারও যেন কষ্ট না হয়।[2] তবে চুমু দেওয়া সম্ভব না হলে হাত ইশারা করে তাওয়াফ শুরু করা হয়।[7] মুুুসলিমরা এটিকে উপাসনা করে না।[8][9]
হাজরে আসওয়াদ মূলত পাথরের একটি একক অংশ ছিল তবে আজ বেশ কয়েকটি টুকরো নিয়ে গঠিত যা একসাথে সিমেন্ট করা বা জোড়া দেওয়া হয়েছে। এগুলি একটি রূপালী ফ্রেম দ্বারা বেষ্টিত যা কাবার বাইরের দেওয়ালে রুপোর নখর দ্বারা বাঁধা থাকে।[10] টুকরোগুলি নিজেরাই ছোট ছোট টুকরো দিয়ে গঠিত যা আজ দৃশ্যমান সাত বা আটটি টুকরো তৈরি করেছে। পাথরের উন্মুক্ত মুখের পরিমাপ প্রায় ২০ সেন্টিমিটার (৭.৯ ইঞ্চি) × ১৬ সেন্টিমিটার (৬.৩ ইঞ্চি )। এর মূল আকার অস্পষ্ট এবং রেকর্ড করা মাত্রা সময়ের সাথে সাথে যথেষ্ট পরিবর্তিত হয়েছে, কারণ টুকরোগুলি বেশ কয়েকবার তাদের সিমেন্ট ম্যাট্রিক্সে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়েছে।[4] দশম শতাব্দীতে, একজন পর্যবেক্ষক কালো পাথরটিকে এক কিউবিট (৪৬ সেমি বা ১৮ ইঞ্চি) দীর্ঘ বলে বর্ণনা করেছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে, এটি ১৪০ বাই ১২২ সেমি (৪ ফুট ৭ ইঞ্চি বাই ৪ ফুট ০ ইঞ্চি) পরিমাপ হিসাবে রেকর্ড করা হয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আলী বে'র মতে, এটিকে ১১০ সেন্টিমিটার (৩ ফুট ৭ ইঞ্চি) উঁচু হিসেবে বর্ণনা করা হয় এবং মুহাম্মদ আলী পাশা এটিকে ৭৬ সেন্টিমিটার (২ ফুট ৬ ইঞ্চি) লম্বা বাই ৪৬ সেমি (১ ফুট ৬ ইঞ্চি) চওড়া বলে জানিয়েছেন।[4]
হাজরে আসওয়াদ কাবার পূর্ব কোণে সংযুক্ত, যা আল-রুকন আল-আসওয়াদ ('কালো পাথরের কোণ') নামে পরিচিত।[11] আরেকটি পাথর, যা হাজার আস-সাদাহ ('ফেলিসিটির পাথর') নামে পরিচিত, কাবার বিপরীত কোণে, আল-রুকন আল-ইয়ামানি ('ইয়েমেনি কর্নার') এর মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে, যা হাজরে আসওয়াদের চেয়ে কিছুটা কম উচ্চতায়।[12] পূর্ব কোণের পছন্দটির আচার-অনুষ্ঠান তাৎপর্য থাকতে পারে; এটি বৃষ্টি-আনয়নকারী পূর্ব বাতাস (আল-কাবুল) এবং ক্যানোপাস যে দিক থেকে উঠে আসে তার মুখোমুখি হয়।[13]
কালো পাথরে চারপাশে রৌপ্য ফ্রেম এবং কাবাকে আচ্ছাদিত কালো কিসোয়াহ বা কাপড় শত শত বছর ধরে উসমানীয় সুলতানরা দুটি পবিত্র মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে তাদের ভূমিকায় বজায় রেখেছিল। তীর্থযাত্রীদের ক্রমাগত পরিচালনার কারণে ফ্রেমগুলি সময়ের সাথে সাথে শেষ হয়ে যায় এবং পর্যায়ক্রমে প্রতিস্থাপিত হয়। জীর্ণ ফ্রেমগুলি ইস্তাম্বুলে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, যেখানে সেগুলি এখনও তোপকাপি প্রাসাদের পবিত্র ধ্বংসাবশেষের অংশ হিসাবে রাখা হয়।[14]
হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কর্তৃক ইসলাম প্রচারের আগে কালো পাথরটি শ্রদ্ধার সাথে কাবায় স্থাপিত হয়েছিল। এটি দীর্ঘদিন ধরে কাবার সাথে যুক্ত ছিল, যা প্রাক-ইসলামিক যুগে নির্মিত হয়েছিল এবং নাবাতেয়ানদের তীর্থস্থান ছিল যারা বছরে একবার তীর্থযাত্রা করতে মাজারে যেতেন। কাবাতে মাক্কী দেবতাদের ৩৬০ টি মূর্তি ছিল।[15] মধ্যপ্রাচ্যের সেমিটিক সংস্কৃতিতে উপাসনাস্থল চিহ্নিত করার জন্য অস্বাভাবিক পাথর ব্যবহারের ঐতিহ্য ছিল, যা হিব্রু বাইবেলের পাশাপাশি কুরআনেও প্রতিফলিত হয়[16], যদিও তানাখে এই ধরনের পবিত্র বস্তুকে প্রণাম করা বা চুম্বন করাকে বারবার প্রতিমাবাদী হিসাবে বর্ণনা করা হয়[17] এবং এটি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক তিরস্কার বিষয় ছিল।[18][19][20][21][22][23] কালোপাথরের উল্কাপিণ্ড-উৎপত্তি তত্ত্বে এটিকে কিছু লেখক উল্কাপিণ্ডের সাথে তুলনা করতে দেখা যায় যেমনটি গ্রিক টেম্পল অফ আর্টেমিস-এ স্থাপন করা হয়েছিল এবং উপাসনা করা হয়েছিল।[24][25][26] আসল পাথরটি ভেঙে যাওয়ার পরে টুকরোগুলি সুরক্ষিত করার জন্য সিলভার ফ্রেমটি হাজরে আসওয়াদ উপর স্থাপন করা হয়েছিল।[27][28]
দক্ষিণ আরবের ঘাইমান শহরের দেবতার সাথে একটি "লাল পাথর" যুক্ত ছিল এবং আল-আবালাতের কাবাতে (মক্কার দক্ষিণে তাবালা শহরের কাছে) একটি "শ্বেত পাথর" ছিল। সেই সময়ে উপাসনা প্রায়শই পাথরের শ্রদ্ধা, পর্বত, বিশেষ শিলা গঠন বা স্বতন্ত্র গাছের সাথে যুক্ত ছিল।[29] কাবা হলো পবিত্র জগৎ এর সাথে পৃথিবীর সাথে ছেদবিন্দু, এবং কালোপাথর স্বর্গ ও পৃথিবীর মধ্যে সংযোগ হিসাবে প্রতীক ছিল।[30] আজিজ আল-আজমেহ বলেন, "আল-রহমান" শব্দটি, যা দেবতার জন্যও ব্যবহৃত হত, মক্কায় সূক্ষ্ম দেবতাদের জন্য ব্যবহৃত হত এবং সম্ভবত তা কালোপাথরের সাথেও যুক্ত ছিল।[31] পাথরটি লাতের সাথে যুক্ত বলে মনে করা হয়।[32]
ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে কাবার দেয়ালে বর্তমান স্থানে হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের কৃতিত্ব হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)। ইবনে ইসহাকের সিরাতে রসুল আল্লাহ তা'আলার কাছে পাওয়া একটি গল্প বলছে যে কীভাবে মক্কার গোত্রগুলো একটি বড় আগুনের পরে কাবা সংস্কার করেছিল যা কাঠামোটি আংশিকভাবে ধ্বংস করে দিয়েছিল। পুনর্নির্মাণের কাজের সুবিধার্থে পাথরটি সাময়িকভাবে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। তাদের মধ্যে থেকে পাথরটিকে তার জায়গায় ফিরিয়ে রাখার সম্মানার্থে সে বিষয়ে গোত্রগুলি একমত হতে পারেনি।[33][34]
তারা একমত হয় যে পরবর্তী দিন যে ব্যক্তির গেট দিয়ে সবার আগে কাবার চত্বরে আসবে এবং তার সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিবে। সেই ব্যক্তি ছিলেন ৩৫ বছর বয়সী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ), তার নবীত্বের পাঁচ বছর আগে। তিনি গোত্রের প্রবীণ প্রধানদেরকে তাকে একটি কাপড় আনতে এবং কালো পাথরকে তার কেন্দ্রে রাখতে বলেছিলেন। গোত্রের প্রত্যেক নেতা কাপড়ের কোণগুলি ধরে কালো পাথরটিকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যান। তারপর,হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)সমস্ত গোত্রের সম্মান সন্তুষ্ট করে পাথরটি স্থাপন করেছিলেন।[34][33] ৬৩০ সালে মক্কা বিজয়ের পর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার উটের উপর সাতবার কাবার চারপাশে তাওয়াফ করেন এবং শ্রদ্ধার ভঙ্গিতে লাঠি দিয়ে কালো পাথর স্পর্শ করেন বলে জানা যায়।[35]
ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মদ (সা.) এর সময়ে পবিত্র কাবাঘর পুনর্নির্মাণের পর হাজরে আসওয়াদকে আগের জায়গায় কে বসাবেন—এ নিয়ে কুরাইশদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেধেছিল। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজের গায়ের চাদর খুলে তাতে হাজরে আসওয়াদ রেখে সব গোত্রপ্রধানকে চাদর ধরতে বলেন এবং দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটান।[2]
এই পবিত্র পাথরের দৈর্ঘ্য ৮ ইঞ্চি ও প্রস্থ ৭ ইঞ্চি। বর্তমানে এটি আট টুকরো।[1] আগে হাজরে আসওয়াদ ছিল আস্ত একটি পাথর। হজরত আবদুল্লাহ বিন জোবায়েরের শাসনামলে কাবা শরিফে আগুন লাগলে হাজরে আসওয়াদ কয়েক টুকরা হয়ে যায়। আবদুল্লাহ বিন জোবায়ের পরে ভাঙা টুকরাগুলো রুপার ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেন। ফ্রেম সংস্করণের সময় চুনার ভেতর কয়েকটি টুকরা ঢুকে যায়। বর্তমানে হাজরে আসওয়াদের আটটি টুকরা দেখা যায়। বড় টুকরাটি খেজুরের সমান।[2]
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন এ পাথর আবু কুবাইস পাহাড় থেকে বড় আকার ধারণ করে উপস্থিত হবে। তার একটি জিহ্বা ও দুটি ঠোঁট থাকবে, কে কোন নিয়তে তাকে চুম্বন করেছে, সে সম্পর্কে বক্তব্য দেবে। ’ (ইবনে খুজায়মা : ৪/২২১, মুসতাদরাকে হাকেম : ১/৪৫৭) [36][37] [38][39]
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-কে হাজরে আসওয়াদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে তা স্পর্শ ও চুম্বন করতে দেখেছি।’ (মুসলিম, হাদিস : ১২৬৭)[40]
সাহাবি আবু তুফাইল (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করতে, তাঁর সঙ্গের লাঠি দিয়ে রোকন স্পর্শ করতে এবং লাঠিতে চুম্বন করতে দেখেছি। (মুসলিম, হাদিস : ২৯৬৭)
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.