Loading AI tools
হযরত শাহ জালালের অন্যতম সঙ্গী উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন; সিলেট বিজেতা হযরত শাহ জালালের অন্যতম সঙ্গী অনুসারী ও সিলেট অভিযানে প্রেরিত মুসলিম বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন। সিলেটের ইতিহাসে বহুল আলোচিত তরফ রাজ্য ১৩০৪ খ্রিষ্টাব্দে তার মাধ্যমে বিজিত হয়। সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলায় মুড়ারবন্দ নামক স্থানে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের মাজার অবস্থিত।[1] তার জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ সম্পর্কে জীবনী গ্রন্থে আনুমানের ভিত্তিতে ১২৫০ সালে জন্ম হয়েছে এবং শাহ জালালের মৃত্যুর পূর্বে (১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে) তিনি মৃত্যুর বরণ করেন বলে উল্লেখ্য রয়েছে। [2]
আরবের বাগদাদ শহরে বসবাসরত হযরত আলী এর বংশের অধস্তন পুরুষ সৈয়দ হাসান আরাবী ছিলেন সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের পিতা। তার ঊর্ধ্বতন বংশ পুরুষ ছিলেন; যথাক্রমেঃ হযরত আলী -> হুসাইন ইবন আলী -> ইমাম জয়নুল আবেদীন -> ইমাম বাকের -> ইমাম জাফর সাদেক -> ইমাম মুসা কাজেম -> ইমাম আলী রেজা-> ইমাম মোহাম্মদ তকী -> ইমাম নকী আল হাদী -> ইমাম হাসান আসকারী -> ইমাম মাহদী আল মন্তজিন -> সৈয়দ আবুল ফজল -> সৈয়দ আবুল ফাত্তাহ -> সৈয়দ দাউদ আ'তায়ী -> সৈয়দ হাসান আরাবী[2]
হযরত আলী এর বংশে হযরত ইমাম হুসাইন দিক থেকে সৈয়দ পরিবারে আরবের বাগদাদ নগরীতে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের জন্ম হয়। তার বংশধররা তৎকালে বাগদাদের আব্বাসী রাজপরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা সূত্রে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিভিন্ন কারণে রাজপরিবারের সাথে নিজ বংশের কলহ বিবাদ বাধলে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তার বংশের অনেকেই বাগাদাদ ত্যাগ করে ভারত আগমন করেন এবং তথায় স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। তাদের মধ্যে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনও ছিলেন। পরিবারের ব্যয় ভার নির্বাহের জন্য সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন দিল্লীর সুলতানের অধীনে সৈনিক বিভাগে চাকরি নেন। পরবর্তিতে (১৩০৩ খ্রিঃ) সিপাহসালার পদে উন্নত হয়ে দিল্লী হতে বাংলাদেশে সিলেটাভিমূখে (শ্রীহট্টে) রাজা গৌড় গোবিন্দের হাতে প্রতারির মুসলমানদের সহায়তায় প্রেরিত হন। পথিমধ্যে পূর্বে প্রেরিত সিকান্দর গাজীর সাথে সোনারগাঁওয়ে ও আরব হতে আগত প্রখ্যাত আউলিয়া হযরত শাহ জালাল এর সাথে ত্রিবেণীতে দেখা হয়। সেখান থেকে দিল্লীর সুলতানী আদেশানুসারে শাহ জালাল ও সিকান্দর গাজীর সম্মতিক্রমে সেনা বাহিনীর প্রধান হয়ে সিলেট অভিযানে রওয়ানা হন। সিলেট বিজয় সমাপ্ত করে শাহ জালালের আদেশে বারজন সঙ্গী দরবেশদের নিয়ে ১৩০৪ সালে তরফের সামন্ত ত্রিপুরা রাজা আচানক নারায়নকে শায়েস্তা করতে তরফ রাজ্যে গমন করেন। তরফের অত্যাচারী ত্রিপুরা রাজা আউলিয়াগণের আগমন সংবাদ অবগত হয়ে বিনা সমরে রাজ্য পরিত্যাগ করে ত্রিপুরার রাজাদের আশ্রয়ে চলে যায়। এদিকে তরফ রাজ্য সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের অধিকারে আসে।[2] উল্লেখ্য যে, সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের সাথে বার জন আউলিয়া তরফ রাজ্যে আগমন করেছিলেন। তাদের প্রভাবে তরফ রাজ্য বিজিত হওয়ায় এটি বার আউলিয়ার মুলুক বলে খ্যাত হয়। অতপর তরফে মুসলমানদের অধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে, উক্ত বার আউলিয়া ইসলামের বাণী নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে গমন পূর্বক ধর্ম সাধনায় নিয়োজিত হন। তাদের অধ্যুষিত স্থানে নিজ নিজ নামে একেকটি দরগাহ বা মাজার বিদ্যমান আছে। এদিকে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন তরফের শাসনভার প্রাপ্ত হন। তিনি সৈন্য গণ সহ যে স্থানে বাস করে রাজ্য পরিচালনা করেন, সে স্থান লস্করপুর নামে খাত্য হয়। সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন সময় সময় সিলেট গিয়ে দরবেশ শাহ জালালের সাথে সাক্ষাত করতেন। এক সময় তিনি এক স্বপ্ন দেখে বুঝতে পারেন যে তার পরকালের যাত্রার ডাক এসে গেছেন। তাই তিনি সিলেট গমন পূর্বক শাহ জালালের সাথে শেষ দেখা করেন। শাহ জালালের সাথে শেষ দেখার উল্লেখ করে সৈয়দ মোস্তফা কামাল সহ ঐতিহাসিকগণ লিখেন যে, শাহ জালালের পূর্বে তিনি (সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন) পরলোক গমন করেন।[2][3] সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের পরে তার পুত্র সিরাজ উদ্দীন তরফের শাসনভার প্রাপ্ত হন। এই সিরাজ উদ্দীনের থেকে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের বংশ বিস্তৃত হয়। পরবর্তীতে তার বংশ হতে ওলী-আউলিয়া, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ সহ অনেক জ্ঞানী-গুণীর আবির্ভাব ঘটে। মুলক-উল-উলামা, আরাকান রাজ্যের রাজ দরবারী সৈয়দ মুসা, কুতুব-উল-আউলিয়া, বিখ্যাত সাধক গদাহাসন, শাহ নূরী, মধ্যযুগের মহাকবি সৈয়দ সুলতান,সাত আনি জমিদার সৈয়দ মোহাম্মদ আসির, তার দুই পুত্র সৈয়দ মোঃ নাজির ও সৈয়দ মোঃ হাজির, নাজির পুত্র সৈয়দ মোঃ বাতির কাজিহাটা পীরের বাড়ি (বাহুবল)। তাদের অধস্তন পুরুষ অসংখ্য জারীগানের লেখক সৈয়দ আপ্তাব উদ্দিন আবন মিয়া সাহেব (কাজিহাটা) অন্যতম ব্যক্তি। সাধক ও সমাজ সংস্কারক সৈয়দ গোয়াস উদ্দীন, ঐতিহাসিক সৈয়দ মুজতবা আলী, সৈয়দ মোস্তফা আলী, সৈয়দ মুর্তাজা আলী, সৈয়দ মোস্তফা কামাল, সৈয়দ মোহাম্মদ জোবায়ের সৈয়দ আব্দুল হক (পইল),সৈয়দ আহমদুল হক(পইলের সাব)যাঁদের মধ্য অন্যতম।[2]
শ্রীহট্টে ইসলাম জ্যোতি সহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে পাওয়া যায়; শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যের অধিবাসী বুরহান উদ্দীন নামক জৈনক মুসলমান নিজ ছেলের জন্ম উৎসব উপলক্ষে গরু জবাই করে গৌড়ের হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের কাছে অপরাধী সাবস্ত হন। ফলে গোবিন্দ বুরহান উদ্দীনের শিশু ছেলেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। বুরহান উদ্দীন বাংলার তৎকালীন রাজা শামস উদ্দীন ফিরুজ শাহের নিকট গিয়ে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ করলে রাজা তার ভাগিনে সিকান্দর গাজীকে প্রখণ্ড সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যে প্রেরণ করেন। শাহী সৈন্য যখন ব্রহ্মপুত্র নদী পার হতে চেষ্টা করে তখনই রাজা গোবিন্দ ভোতিক শক্তির সাহায্যে মুসলিম সৈন্যের উপর অগ্নীবাণ নিক্ষেপ করে সমস্ত চেষ্টাকে বিফল করে ফেলে। গোবিন্দের ঐন্দ্রজালিক শক্তির প্রভাবে সিকান্দর গাজীর প্রতিহত ও বিফল মনোরথের সংবাদ দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজীর নিকট পৌছলে সম্রাট এ সংবাদে মর্মাহত হন। পরবর্তিতে সম্রাট তার রাজদরবারী আলেম-উলামা সহ জ্যোতিষদের সাথে আলোচনায় এই মর্মে অবহিত হন যে, সুলতানের সেনাবাহিনীতে আধ্যাতিক শক্তি সম্পন্ন এক ব্যক্তি রয়েছে, তার নেতৃত্বে অভিযান প্রেরণ করা হলে গৌড়গোবিন্দের যাদু বিদ্যার মোকাবেলা করে সিলেট বা শ্রীহট্ট জয় সম্ভব হবে। জ্যোতিষিরা উক্ত আধ্যাতিক শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তির পরিচয়ের পন্থা হিসেবে এও বলে ছিল, আগামী দুই/এক রাত্রের মধ্যে দিল্লী নগরীতে প্রখণ্ড ঝড় বৃষ্টিতে সমস্ত নগরী ভেসে যাবে, প্রতিটি ঘর বাড়ির বিষম ক্ষতি লক্ষিত হবে, কোথায় কোন প্রদিপ থাকবেনা একটি মাত্র তাবু ব্যতীত। সম্রাট জ্যোতিষদের কথামত অনুসন্ধান করে সেই ঝড় বৃষ্টির রাতে দেখতে ফেলেন এক জন সাধারণ সৈনিক একটি তাবুতে একাগ্র মনে বসে কোরান পড়ছেন। সম্রাট সেখানে উপস্থিত হয়ে তার সব বিষয় অবগত হয়ে সিলেট অভিযানের নেতৃত্ব দেয়ার অনুরোধ জানান। তিনি সৈয়দ নাসির উদ্দীন সম্রাটের আদেশে সম্মত হলে সম্রাট তাকে সিপাহসালার সনদ প্রদানের মাধ্যে সিকান্দর গাজীর কাছে প্রেরণ করেন। সে থেকে তিনি সৈয়দ নাসির উদ্দীন হতে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন নামে খ্যাত হন।[2][3][4]
শাহ জালাল দিল্লি হতে বুরহানউদ্দীনকে সহ ২৪০ জন সঙ্গীসহচর সিলেটের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলেন। শাহ জালাল সাতগাঁও এসে ত্রিবেণীর নিকট দিল্লীর সম্রাট প্রেরিত অগ্রবাহিনী সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের সাথে মিলিত হন। সৈয়দ নাসির উদ্দীন শাহ জালাল সম্পর্কে অবগত হয়ে তদীয় শিষ্যত্ব গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। পথে পথে শাহ জালালের শিষ্য বর্ধিত হতে লাগল। ত্রিবেণী থেকে বিহার প্রদেশে আসার পর আরো কয়েকজন ধর্মযোদ্ধা অনুষঙ্গী হলেন। যাদের মধ্যে হিসাম উদ্দীন, আবু মোজাফর উল্লেখযোগ্য। এখান থেকে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের আনিত এক হাজার অশ্বারোহী ও তিন হাজার পদাতিক সৈন্যসহ শাহ জালাল নিজ সঙ্গীদের নিয়ে সোনারগাঁ অভিমুখে সিকান্দর গাজীর সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।[5]
সিলেট আসার পথে বিভিন্ন স্থানে শাহ জালাল আউলিয়ার কেরামতি ও আলৌকিক বিভিন্ন ঘটনায় শ্রীহট্টের (সিলেট) রাজা গোবিন্দ বীতশ্রদ্ধ হয়। শাহ জালাল সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বে নিজ সৈন্য বাহিনী নিয়ে সিলেটের চৌকি পরগনায় উপস্থিত হইলে রাজা গৌড় গোবিন্দ তাদেরকে প্রতিরোধ করার লক্ষে যাদু-মন্ত্র সহ এক প্রকাণ্ড লৌহ ধুনুক শাহ জালালের কাছে প্রেরণ করে । যার শর্ত ছিল যদি কেহ একা উক্ত ধনুকের জ্যা ছিন্ন করতে পারে তখন গোবিন্দ রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে। শাহ জালাল তার দলের লোকদের ডেকে বললেন; যে ব্যক্তির সমস্ত জীবনে কখনও ফজরের নামাজ কাজা হয় নাই বা বাদ পরে নাই একমাত্র সেই পারবে গোবিন্দের লৌহ ধনুক "জ্যা" করতে। অতপর মুসলিম সৈন্য দলের ভেতর অনুসন্ধান করে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনকে উপযুক্ত পাওয়া গেল এবং তিনিই ধনুক জ্যা করলেন।[4] সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের অলৌকিক ঘটনা সমুহের মধ্যে তার কবর বা মাজার উত্তর দক্ষিণ হতে পূর্ব পশ্চিমে মুড়ে যাওয়া নিয়ে বহুল প্রচারিত আছে। ঘটনাটি ছিল এমনঃ সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন মৃত্যুর পূর্বে তার ভক্ত সহচর দিগকে নসিয়ত করেছিলেন; মৃত্যুর পরে তাকে যেন পূর্ব পশ্চিম করে দাফন করা হয়। তৎকালীন আলিম সমাজের আপত্তির মুখে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের ভক্ত সহচরগণ তার নসিয়ত উপেক্ষা করে ইসলামি নিয়মানুসারে তাকে উত্তর দক্ষিণ করেই দাফন করা হয়। দাফন কার্য্য শেষে সকল লোক তার হতে চল্লিশ কদমের ব্যবধান পার হতে না হতেই এক প্রকণ্ড শব্দ শুনে উপস্থিত লোক জন পিছে ফিরে তাকিয়ে দেখতে পান সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের কবর মুড়ে গিয়ে পূর্ব পশ্চিম হয়ে রয়েছে। তৎক্ষণাৎ সকলে ইসলামিক কলেমা আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে আউলিয়ার শেষ নসিয়তের কথা স্মরণে নিজের ভুল স্বীকারে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। শ্রুতির এই স্মৃতিকে আকঁঢ়ে তার কবর খানা আজও পূর্ব পশ্চিম হয়ে কালের সাক্ষী স্বরূপ বিদ্যমান আছে।[2]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.