Loading AI tools
১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে গঠিত একটি সংগ্রাম পরিষদ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পূর্ব পাকিস্তান তথা তৎকালিন স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের একটি প্রাচীনতম ছাত্র আন্দোলনের নাম। এটি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানকে সুসংহত করতে ও প্রথম সারিতে থেকে নেতৃত্বে প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান হলো পূর্ব পাকিস্তান তথা তৎকালিন স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটে এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। এ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঐতিহাসিকভাবে পরিচিতি পায়।[1][2]
ধরন | ছাত্র আন্দোলন |
---|---|
উদ্দেশ্য | এগারো দফা কর্মসূচী উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান |
যে অঞ্চলে | পূর্ব পাকিস্তান, ঢাকা |
পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) স্বায়ত্তশাসনের দাবি বাস্তবায়ন ও রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটাতে তীব্র ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি তৎকালিন প্রধান ছাত্র সংগঠনসমূহকে নিয়ে "ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ" গঠিত হয়। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, রাশেদ খান মেনন সমর্থিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, মতিয়া চৌধুরী সমর্থিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ৮ জন ছাত্রনেতা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। একই বছরের জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন এনএসএফ ভেঙ্গে তাদের সদস্য মাহবুবুল হক দুলন, ইব্রাহিম খলিল, নাজিম কামরান সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে যোগ দেয়। পর্যায়ক্রমে সংগঠনের বিস্তৃতি হয় এবং ১৯৬৯ সালের ১৪ জানুয়ারি এ সংগঠনটি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাছে এগারো দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। যা ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি হিসেবে পরিচিত।[3]
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সকল আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা শহর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলেও তাদের ঘোষিত কর্মসূচি পূর্ব পাকিস্তান তথা স্বাধীনতাকমাী বিভাগীয় শহর এবং জেলা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ওইসব শহরগুলো ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিকগণ রাস্তায় নেমে আসেন। এর সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্রদের একাংশ ও কয়েকটি ছাত্র সংগঠন পরিষদের এগারো দফার সমর্থনে আন্দোলন করে। ছাত্রদের আন্দোলনে সাধারণ মানুষে সাড়া পড়ার কারণ হিসেবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহৎ রাজনৈতিক দলসমূহে মতাদর্শগত ও আন্তঃবিরোধের পাশাপাশি দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবকে ঐতিহাসিকগণ চিহ্নিত করে। তখন প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের বিপরীতে ছাত্রদের আন্দোলন তথা সংগ্রাম পরিষদ এক প্রকার প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।[4]
১৯৬৮ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে জারি থাকা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ‘দাবি-দিবস’ ঘোষণা করে ১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় প্রথম ছাত্রসমাবেশের ঢাক দেয়। বটতলা ছাত্রদের একটি বড় মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বের হলে পুলিশ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস, রঙিন পানি নিক্ষেপ ও বেধড়ক লাঠিচার্জ করে। সে সময় ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মোশাররফ হোসেনসহ একাধিক ছাত্র আহত হন।
আন্দোলনে পুলিশের হামলায় ছাত্র আহতদের প্রতিবাদে ১৯৬৯ সালে ১৮ জানুয়ারি ঢাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক দেয়। ধর্মঘট পালনকালে ছাত্ররা ই.পি.আর বাহিনীর ডবল ডেকার বাসে আগুন দেয়। এ সময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। আবার ছাত্র গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রথম ধর্মঘটের ডাক দেয় এবং ধর্মঘট পালনে মিছিল বের করলে পুলিশ আট ছাত্রকে গ্রেফতার করে।[5]
আন্দোলন সংগ্রামে পুলিশের নির্যাতন বন্ধ, ১১ দফা কর্মসূচির বাস্তবায় ও গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তির ২০ জানুয়ারি প্রদেশব্যাপী ছাত্র সংগ্রম পরিষদ ধর্মঘটের ডাক দেয়। এ দিন ঢাকাযর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররা ধর্মঘটের সমর্থনে মিছিল বের করে। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে এক পুলিশ কর্মকর্তার গুলিতে মেনন সমর্থিত পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আসাদুজ্জামান শহীদ হন। একই সময়ে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাও মিছিল বের করে এবং প্রায় সবকটি মিছিলেই ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ বাধে।[6]
পুলিশের গুলিতে আসাদুজ্জামান নিহতের প্রতিবাদে ১৯৬৯ সালের ২১ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকায় হরতাল পালন করে এবং আসাদের জন্যে গায়েবানা জানাজার আয়োজন করে। এ দিন সংগ্রাম পরিষদ ২২ জানুয়ারি প্রদেশব্যাপী (পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান) মিছিল ও প্রতিবাদ সভা, ২৩ জানুয়ারি মশাল মিছিল এবং ২৪ জানুয়ারি হরতাল পালন করে।[7]
২৪ জানুয়ারির হরতাল পালনের সময় ময়মনসিংহে ২ জন শহীদ ও ২০ ছাত্র আহত হয়। ঢাকায় নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিয়ূর রহমান ও জনৈক রুস্তম আলী শহীদ হয়। নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ এবং টাঙ্গাইলে ৯ জন আহত হয়।
এসবের প্রতিবাদে সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে ২৪ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সংবাদপত্রসমূহে বিবৃতি প্রদান করে পুনরায় একাধিক কর্মসূচি ঘোষণা করে। তখন ইত্তেফাক নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আজাদ, মর্নিং নিউজ, পাকিস্তান অবজারভার, সংবাদ - এসব পত্রিকায় প্রতিদিন এই আন্দোলনের খবর গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ হতো। [8]
১১ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা ছিল তখনকার পরিস্থিতির সাপেক্ষে অত্যন্ত সময়োপযোগী। ছাত্রদের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আন্দোলন ও একই দাবিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ আন্দোলনের মধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি প্রাধান্য পেতে শুরু করে।[9]
১. শিক্ষা সমস্যার আশু সমাধান : অর্থাৎ, হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় সমস্ত আইন বাতিল করা এবং ছাত্রদের সকল মাসিক ফি কমিয়ে আনা।
২. প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দেওয়া এবং দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনার নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়া।
৩. ছয় দফা দাবির শর্তানুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা।
৪. পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশগুলোকে (অর্থাৎ, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব, সিন্ধু) স্বায়ত্তশাসন দিয়ে একটি ফেডারেল সরকার গঠন করা।
৫. ব্যাংক, বীমা, পাটকলসহ সকল বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ।
৬. কৃষকদের উপর থেকে কর ও খাজনা হ্রাস এবং পাটের সর্বনিম্নমূল্য ৪০ টাকা (স্বাধীনতার দলিলপত্রে উল্লেখ রয়েছে) ধার্য করা।
৭. শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা এবং শ্রমিক আন্দোলনে অধিকার দান।
৮. পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জল সম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা গ্রহণ।
৯.জরুরি আইন, নিরাপত্তা আইন এবং অন্যান্য নির্যাতনমূলক আইন প্রত্যাহার।
১০. সিয়াটো (SEATO), সেন্ট্রো (CENTRO)-সহ সকল পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং জোট বহির্ভূত নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ।
১১. আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও রাজনৈতিক কর্মীদের মুক্তি ও অন্যান্যদের উপর থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করে নেয়া। [10]
মূল নিবন্ধ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.