ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বলতে মূলত আঠারো শতকের শেষের দিকে (১৭৬০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলাতে ফকির ও সন্ন্যাসী বা মুসলিম ও হিন্দু তাপসদের তৎকালীন ব্রিটিশ শাসন বিরোধী আন্দোলনকে বোঝানো হয়ে থাকে। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন মাদারিপন্থী পীর মজনু শাহ। ইতিহাসবিদগণ বিদ্রোহটির পটভূমি নিয়েই শুধু দ্বিধা বিভক্তই নন, বরং ভারতবর্ষের ইতিহাসে এর গুরুত্ব নিয়ে তাদের মধ্যে কিছুটা মতদ্বৈততা লক্ষণীয়। ১৭৭১ খ্রীস্টাব্দে প্রায় ১৫০ জন ফকিরকে ইংরেজরা হত্যা করে।যামিনী মোহন ঘোষ ছাড়া সকল দেশীয় ইতিহাসবিদ একে বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার বলে মনে করেন যেহেতু ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর খাজনা উত্তোলনের কর্তৃত্ব ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে তুলে দেয়া হয়। কিন্তু ইংরেজ লেখকরা শুরু থেকেই এ বিদ্রোহকে দস্যুদের লুটতরাজ বলে চালাতে চেয়েছে। অন্যদিকে্, ইংরেজের অনুগত, রেকর্ডবিভাগের কর্মচারী যামিনী মোহন ঘোষ উপনিবেশী প্রশাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে একদল উচ্ছৃঙ্খল ফকির ও সন্ন্যাসীর চুরিচামারি ও লুটতরাজ বলে আখ্যায়িত করেন।[1] এ জন্য ভারতের গবেষক গৌতম ভদ্র তাকে ব্যঙ্গ করে ‘দাঙ্গা হাঙ্গামা’ ও ‘লুটতরাজে’র ঐতিহাসিক বলে আখ্যায়িত করেছেন।[2]
পটভূমি
অন্তত তিনটি আলাদা ঘটনাকে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামে অভিহিত করা হয়। যার একটি মূলত সম্মিলিত হিন্দু সন্ন্যাসী ও মুসলিম মাদারী এবং ধার্মিক ফকিরদের বৃহত্ গোষ্ঠী যারা পবিত্রস্থান দর্শনের উদ্দেশ্যে উত্তর ভারত থেকে বাংলার বিভিন্নস্থান ভ্রমণ করতেন। যাওয়ার পথে এসব সন্ন্যাসীগণ গোত্রপ্রধাণ,জমিদার অথবা ভূস্বামীদের কাছ থেকে ধর্মীয় অনুদান গ্রহণ করতেন যা তখন রেওয়াজ হিসেবে প্রচলিত ছিল। সমৃদ্ধির সময়ে গোত্রপ্রধান, জমিদারগণও এসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদার ও অনুগত ছিলেন। কিন্তু যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানী ক্ষমতা লাভ করে তখন থেকে করের পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় স্থানীয় ভূস্বামীদের পক্ষে অনেক সময়ই ফকির সন্ন্যাসীদেরকে আর্থিক সহায়তা প্রদান সম্ভব হতো না। উপরন্তু ফসলহানি, দুর্ভিক্ষ যাতে প্রায় এক কোটি মানুষ প্রাণ হারায় যা তৎকালীন বাংলার মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ, সমস্যাকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয় কারণ আবাদী জমির বেশিরভাগ থেকে যায় ফসলশূন্য ।
পন্ডিত ভবানীচরণ পাঠক ছিলেন অষ্টাদশ শতকে বঙ্গভূমিতে ইংরেজ শাসন-শোষণ এবং অত্যাচারী নবাবের বিরুদ্ধে সংঘঠিত দীর্ঘস্থায়ী ধর্মযুদ্ধ 'সন্ন্যাসী বিদ্রোহ'র প্রধান নায়ক । সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ভারতবর্ষের প্রথম ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম ।
১৭৭১ সালে, ১৫০ জন ফকিরকে হত্যা করা হয় দৃশ্যত বিনা কারণে। এটি ছিল অনেকগুলো কারণের একটি যা ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং এ ক্ষোভ পরবর্তীকালে রূপ নেয় সংঘাতে বিশেষত নাটোরে, রংপুরে যা এখন আধুনিক বাংলাদেশের অন্তর্গত।
অন্য দুটি আন্দোলন ছিল হিন্দু সন্ন্যাসীদের একটি অংশ দশনামী নাগা সন্ন্যাসীদের, যারা একইভাবে তীর্থ ভ্রমণের পাশাপাশি ছোটখাটো জমিদার-জোতদার ও বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিদের চড়া সুদে অর্থ ধার দিত। পরে ঋণগ্রহিতা ঋণ শোধে ব্যর্থ হলে জোরপূর্ব্বক তা আদায় করতো। ব্রিটিশদের কাছে মুসলিম ফকির ও হিন্দু সন্ন্যাসী উভয়ই ছিল লুটেরা। এদেরকে কোম্পানীর প্রাপ্য অর্থে ভাগ বসানো থেকে এবং এমনকি সম্ভব হলে বাংলায় প্রবেশ ঠেকাতে তারা ছিল সদা তত্পর। তাদের কাছে ভ্রাম্যমাণ মানুষের এই বিশাল স্রোত সম্ভাব্য হুমকি বলে মনে হত।
সন্ন্যাসী ও কোম্পানীর মধ্যে সংঘর্ষ
ফকির-সন্ন্যাসীদের সাথে কোম্পানির সৈন্যদের সংঘর্ষের উল্লেখ্যোগ্য কয়েকটি ঘটনা হলো: ১৭৬৩ সালেই একদল ফকির কর্তৃক ঢাকার ফ্যাক্টরি দখল এবং পরে ইংরেজদের বৃহত্তর আক্রমণে পরাজয় ও পলায়ন, ১৭৭১ সালে তৎকালীন বগুড়া জেলার ঘোড়াঘাটে ফকির নেতা মজনু শাহর বাহিনীর সাথে বৃটিশ বাহিনীর সংঘর্ষে প্রায় ১৫০ জন ফকির যোদ্ধার শাহাদাৎ বরণ, ১৭৭৩ সালে ময়মনসিংহে ফকির যোদ্ধাদের সাথে সংঘর্ষে বৃটিশ সেনা-সর্দার এডওয়ার্ড-এর মৃত্যু, ১৭৭৪ সালে পুনরায় ঢাকার ফ্যাক্টরি দখলের ব্যর্থ আক্রমণ, ১৭৭৬ সালে ফকিরদের গুলিতে বৃটিশ সেনা কর্মকর্তা রাবার্টসন মারাত্মক আহত ও ইংরেজ বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, ১৭৮২-৮৩ সালে ফকির ও সন্ন্যাসীদের রংপুরের প্রজাবিদ্রোহে অংশগ্রহণ, ১৭৮৬ সালের ডিসেম্বরে মজনু শাহ শিষ্যগণসমেত বগুড়ার মহাস্থানগড়ের নিকটে অবস্থানকালে বৃটিশ ক্যাপ্টেন এ . ব্রেনানের অতর্কিতে হামলায় ফকিরবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও মজনু শাহ মারাত্মক আহত; এর পরের বছর মজনু শাহ মৃত্যুবরণ করায় ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহের তীব্রতা হ্রাস পায়।[3] তবে মজনু শাহর শিষ্য মুসা শাহ ও সন্ন্যাসীদের নেতৃত্বে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পরযন্ত ছোটো্ খাটো সংঘর্ষ চলছিলো। এসব সংঘর্ষে সব সময়ই যে কোম্পানীর সৈন্যরা বিজয়ী হতো তা নয়। বেশির ভাগ সংঘর্ষের তথ্য নথিভুক্ত করা হয়েছে দুর্ভিক্ষের পরবর্তী বছরগুলোতে। কিন্তু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ১৮০০ সাল পর্যন্ত, যদিও তুলনামূলকভাবে কিছুটা অনিয়মিতভাবে। এমন কি উন্নততর প্রশিক্ষণ সুবিধা ও সৈন্য সম্ভার থাকা সত্ত্বেও কোম্পানী ভ্রাম্যমাণ ফকির-সন্ন্যাসীদের সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণ প্রতিহত করতে অনেক সময়েই সমর্থ হতেন না।
ঐতিহাসিক তাৎপর্য
বাংলার পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাসমূহতে ধারাবাহিকভাবে যে বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে তার মধ্যে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ প্রথম। এছাড়া ১৭৯৯ সালের চুয়াড় বিদ্রোহ ১৮৩১ ও ১৮৩২ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বাংলায় প্রথম বৃটিশ-বিরোধী সংগ্রামের সূচনা করে। ফকির মজনু শাহ রাজনৈতিকভাবেও সচেতন ছিলেন এবং বৃটিশদেরকে বহিরাগত জবরদখলকারী মনে করতেন। তিনি বৃটিশদের অত্যাচারের প্রতিকার চেয়ে নাটোরের রাণী ভবানীর নিকট এইমর্মে পত্রও লেখেন যে, ফকিররা তাকে দেশের শাসক বলে মানেন। এটি তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রমাণ। অসিত নাথ চন্দ্র যথার্থই লিখেছেন: "মজনু শাহর বিদ্রোহ তার সময়ে ব্যর্থ হলেও একে পরবর্তীকালে সংগঠিত স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রদূত বলে ধরে নেয়া যায়।"[4]
তথ্যসূত্র
Wikiwand in your browser!
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.