সাম্ব হলেন মহাভারতে বর্ণিত একটি চরিত্র। ইনি কৃষ্ণ এবং তাঁর এক মহিষী জাম্ববতীর পুত্র।

জন্ম

একবার শ্রীকৃষ্ণের শিবের মত গুণসম্পন্ন একটি পুত্রলাভের ইচ্ছা হয়। তখন তিনি উপযুক্ত পরামর্শের জন্য এক ঋষির কাছে যান। তখন সেই ঋষি কৃষ্ণকে বলেন যে তিনি যদি এক হাজার ফুল নিবেদন করে বহু বছর ধরে শিবের আরাধনা করেন তাহলেই শিব তুষ্ট হয়ে তাঁর মত একটি পুত্র দান করবেন। সেই পরামর্শ অনুসারে কৃষ্ণ নিভৃতে গিয়ে সারা অঙ্গে ভস্ম মেখে এবং বল্কল (গাছের ছাল) ধারণ করে শিবের আরাধনা করতে আরম্ভ করেন। সেই উপাসনায় প্রসন্ন হয়ে দেবী পার্বতী এবং শিব উভয়েই কৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হন তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে। তখন কৃষ্ণ তাঁদের কাছে শিবের সকল গুণসম্পন্ন একটি পুত্র প্রার্থনা করলে শিব তাঁকে সেই পুত্রলাভের বরদান করেন। এরপর কৃষ্ণ প্রত্যাবর্তন করেন এবং এর কিছুকাল পরেই জাম্ববতীর গর্ভে শাম্বের জন্ম হয়।[1]

ঋষির অভিশাপ

একদিন কয়েকজন যাদব একত্রিত হয়ে কয়েকজন ঋষির সাথে ছলনা করার চেষ্টা করে। তারা শাম্বকে এক গর্ভবতী নারীর বেশে সজ্জিত করে ঋষিদের জিজ্ঞাসা করে যে সেই নারীর আগত সন্তান পুত্র হবে না কন্যা। ঋষিরা ধ্যানে সমস্ত ছলনা জানতে পেরে ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ দেন যে নারীবেশী শাম্বের গর্ভে এক মুসল জন্মগ্রহণ করবে এবং সেই মুসলই হবে যদুবংশের ধ্বংসের কারণ।[2]

বিবাহ

শাম্ব মহাভারতে বর্ণিত কৌরবদের প্রধান দুর্যোধনের কন্যা লক্ষ্মণাকে বিবাহ করেন। প্রথমে শাম্ব লক্ষ্মণাকে বিবাহ করতে চাইলেও লক্ষ্মণার তাতে সম্মতি ছিল না। বিবাহযোগ্যা কন্যা লক্ষ্মণার জন্য দুর্যোধন এক স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করেছিলেন যাতে সে নিজেই নিজের পতি নির্বাচন করতে পারে। তখন শাম্ব লক্ষ্মণাকে সেই স্বয়ম্বর সভা থেকে বলপূর্বক হরণ করে নিয়ে এসে বিবাহ করেন। এতে কুরু বংশের প্রধানরা ক্রুদ্ধ হয়ে শাম্বকে আক্রমণ করেন এবং তাঁকে ও লক্ষ্মণাকে হস্তিনাপুরে আটক করেন। দেবর্ষি নারদের মুখে এই সংবাদ পেয়ে যদু বংশের প্রধানরাও ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁদের রাজা উগ্রসেনের নেতৃত্বে হস্তিনাপুর আক্রমণ করতে প্রস্তুত হন। তখন কৃষ্ণের অগ্রজ বলরাম উভয়পক্ষের মধ্যে সন্ধিস্থাপনের উদ্দেশ্যে হস্তিনাপুরে যাত্রা করেন। সেখানে তিনি কৌরবদের অনুরোধ করেন যাতে তাঁরা শাম্ব এবং লক্ষ্মণাকে ফিরিয়ে দেন। এই অনুরোধে কৌরবেরা প্রথমে সম্মত হননি। তখন বলরাম রুষ্ট হয়ে বলেন যে তিনি যুদ্ধ করে সমগ্র হস্তিনাপুরকেই গঙ্গায় নিক্ষেপ করবেন। বলরামের ক্রুদ্ধ মূর্তি দেখে ও ভয়াবহ যুদ্ধের ইঙ্গিত পেয়ে তাঁরা শাম্ব ও লক্ষ্মণাকে মুক্তি দেন।[3]

কৃষ্ণের অভিশাপ

একবার মহর্ষি নারদ তাঁর কয়েকজন শিষ্য সহ দ্বারকায় আগমন করেন। তাঁর আগমন সংবাদ পাওয়া মাত্র কৃষ্ণ এবং তাঁর বংশধরেরা সহ দ্বারকার প্রত্যেক যদুবংশীয় ব্যক্তি এসে তাঁকে অভ্যর্থনা করেন। কিন্তু শাম্ব তখন পার্শ্ববর্তী একটি কাননে কয়েকজন রমণীর সাথে প্রেমালাপে রত থাকায় নারদের প্রতি অবহেলা করলেন। শাম্বর এই আচরণে অপমানিত বোধ করে নারদ তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার সংকল্প করেন। দ্বারকাত্যাগের আগে তিনি একবার কৃষ্ণের সাথে একান্তে সাক্ষাৎ করে অভিযোগ করলেন যে নরকাসুরের কারাগার থেকে উদ্ধার হওয়া কৃষ্ণের ষোল হাজার রমণী শাম্বের প্রতি আসক্ত। কিন্তু কৃষ্ণ নারদের অভিযোগ অবিশ্বাস করে বললেন যে তাঁর প্রতি ষোল হাজার স্ত্রী সহচরী রমণীদের একনিষ্ঠ প্রণয় বিষয়ে তাঁর মনে কোন দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব নেই এবং শাম্বের বিশ্বস্ততা ও পিতৃভক্তিও প্রশ্নাতীত। এই কথা শুনে এবং শাম্বকে দণ্ড দিতে না পেরে দেবর্ষি নারদ আরও ক্রুদ্ধ হলেন। সেইসময় তিনি দ্বারকা ত্যাগ করে কিছুকাল পরে আবার দ্বারকায় ফিরে এলেন। তখন এসে প্রথমেই তিনি রৈবতক পর্বতের গভীরে কৃষ্ণের প্রমোদকাননে গেলেন। সেখানে গিয়ে দূর থেকে নারদ দেখলেন যে কৃষ্ণ, তাঁর মহিষীগণ ও ষোল হাজার রমণীদের সঙ্গে সুখে জলকেলিতে মগ্ন। কৃষ্ণকে ঘিরে বিভিন্ন রমণী নানা ক্রীড়াকৌতুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ সুরাপান করে প্রমত্তা হয়ে প্রণয়বাক্য উচ্চারণ করছে ও অন্যান্য রমণীদেরও সুরাপাত্র এগিয়ে দিচ্ছে। কৃষ্ণও অতি উদার ও প্রমত্ত বাঞ্ছায় তাঁর প্রিয় রমণীদের ইচ্ছাপুরণ করে তাদের আহ্লাদিত করছেন। নারদ লক্ষ্য করলেন যে সুরাপানে আসক্ত রমণীদের বসনভূষণের শৈথিল্য ও নগ্নতার বিষয়ে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই কারণ রৈবতকে অবস্থিত সেই প্রমোদ উদ্যান ও সরোবরে একমাত্র কৃষ্ণ ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের উপস্থিতির কোন উপায় নেই। দ্বারকায় এইকথা সর্বজনবিদিত যে কৃষ্ণের প্রমোদকানন ও জলকেলি স্থান একমাত্র কৃষ্ণ ছাড়া আর সকল পুরুষের অগম্য। কেবলমাত্র কোন বিশেষ প্রয়োজন বোধ করলে কৃষ্ণ স্বয়ং সেখানে কাউকে ডেকে আনতে পারেন। রমণীদের সাথে কেলিতে মত্ত কৃষ্ণকে দেখে নারদ ছলনাপূর্বক শাম্বকে গিয়ে সংবাদ দিলেন কৃষ্ণ তাঁর প্রমোদ উদ্যানে শাম্বকে ডেকে পাঠিয়েছেন। অন্য সকলের মত শাম্বও জানতেন যে সেই প্রমোদকাননে কৃষ্ণ ছাড়া আর কারও প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু নারদের ছলনায় প্রভাবিত হয়ে তিনি ভাবলেন যে সত্যিই কৃষ্ণ তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তাই তিনি দ্রুত সেখানে উপস্থিত হলেন। রমণীদের সাথে জলক্রীড়ারত কৃষ্ণ শাম্বকে সেই কেলিস্থলে দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। কিন্তু তাঁর ষোল হাজার রমণীকুল শাম্বকে দেখে সহসা উল্লসিত হয়ে উঠল। ক্ষণিকের জন্য তারা শাম্বের প্রতি আসক্তি বোধ করল। যে রমণীদের জীবনে একমাত্র পুরুষ কৃষ্ণ ছাড়া আর কারও স্থান নেই সেই রমণীরা স্বয়ং বাসুদেবের সামনেই অপর পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার স্পর্ধা দেখানোয় তাঁর ক্রোধানল প্রজ্জ্বলিত হল। পরমুহূর্তেই কৃষ্ণ ক্রোধে ও গ্লানিতে তাঁর রমণীদের প্রতি জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন ও তাদের শাপ দিলেন যে তাঁর মৃত্যুর পর তারা তস্কর দ্বারা লাঞ্ছিত হবে। এরপর তিনি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে শাম্বকে অভিসম্পাত করলেন যে শাম্ব কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত হবে। তখন বিস্মিত ও আতঙ্কিত শাম্ব কৃষ্ণকে অনুনয় করে বোঝালেন যে তিনি স্বেচ্ছায় তাঁর প্রমোদকাননে আসেননি। তখন কৃষ্ণ প্রকৃত সত্য অনুধাবন করতে পেরে শাম্বকে বললেন যে শাম্ব যদি দেবর্ষি নারদের পরামর্শে চন্দ্রভাগা নদীর তীরে অবস্থিত সূর্যক্ষেত্রে গিয়ে সূর্যের আরাধনা করেন তাহলেই তিনি রোগমুক্ত হবেন। তখন শাম্ব তদনুসারেই কাজ করলেন এবং আরোগ্যলাভ করলেন। প্রচলিত মত অনুসারে অধুনা কোনারক সূর্য মন্দিরই শাম্বের প্রতিষ্ঠিত সূর্যমন্দির।[4]

তথ্যসূত্র

Wikiwand in your browser!

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.

Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.