Remove ads
সাহিত্যর একটি ধরণ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
লোকসাহিত্য বা কথ্য সাহিত্য হল সাহিত্যের একটি রূপ, যেখানে লিখিত শব্দের ব্যবহারযুক্ত সাহিত্যের মত কথ্য বিষয়সমূহই সাহিত্যের উল্লেখযোগ্যতা লাভ করে।
লোকসাহিত্য সংস্কৃতির একটি মৌলিক উপাদান গঠন করে, তবে তা বিভিন্ন রূপে পরিচালিত হয় যা একজন সাহিত্য থেকে আশা করতে পারে। উগান্ডার পণ্ডিত পিও জিরিমু বিপরীতালঙ্কার শব্দটি এড়ানোর প্রয়াসে বক্তব্য শব্দটি প্রবর্তন করেন, তবে লোকসাহিত্য একাডেমিক এবং জনপ্রিয় লেখনীতে খুব বেশি দেখা যায়।[1]
শিক্ষিত সমাজও লোকঐতিহ্য বহন করে থাকে - যেমন পরিবারে ঘুমপাড়ানো গল্প বা অন্যান্য সামাজিক সংগঠনে। শহুরে কিংবদন্তির গল্প বলাও লোকসাহিত্যের উদাহরণ বলে বিবেচিত হতে পারে, যেমন কৌতুক ও লোকপদ্য হয়ে থাকে। লোকপদ্যের অন্তর্গত বিষয় হল পোয়েট্রি স্ল্যাম, যা টেলিভিশনে রাসেল সিমন্সের ডেফ পোয়েট্রি অনুষ্ঠানে দেখানো হয় এবং পরিবেশন পদ্য, যা একটি ধারা যা সচেতনভাবে লিখিত রীতি এড়িয়ে চলে।[2]
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার বুকে লোক সাহিত্য প্রচলিত। বাংলা বলতে এখানে অবিভক্ত বাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। এই এলাকাগুলিতে লোকসাহিত্যের বিচরণ খুবই উল্লেখযোগ্য। এই বাংলার বুকে নদী যেমন শতধারায় উৎসারিত, সেইরকম লোকসাহিত্যও শত ধারায় বিরাজমান। চিত্তের অন্দরমহলে গাঁথা হয়ে আছে লোকসাহিত্য। মানুষের সুখ- দুঃখ, আশা-আকাঙ্খা, কামনা-বাসনা, প্রতিফলিত হয়েছে লোকসাহিত্যে। কখনও সঙ্গীত, কখনও ছড়া, কখনও আবৃত্তি কখনও বা গল্পরূপে লোকমুখে প্রচলিত লোকসাহিত্য। লোকসাহিত্যের মাধ্যমেই মানুষের চিরাচরিত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অভিব্যক্তি ঘটে। সমাজের রীতিনীতি, আচার ব্যবহার, শিল্প সাহিত্য সভ্যতাজনিত উৎকর্ষ সবকিছুর মধ্যেই মানবজাতির যে পরিচয় তাই তো সংস্কৃতি। সংস্কৃতির বিকাশে লোকসাহিত্যের ভূমিকাও কম নয়।
লোকসাহিত্য সবসময় হয়তো ঠিক শিল্পসম্মত বা ছন্দোবদ্ধ হয়নি। তা না হোক, মানুষের মনের অন্দরমহলের গোপন দরজা খুলে দিয়েছে লোকসাহিত্য। দোলায়িত করেছে মানুষের প্রাণ ও মনকে। লোকসাহিত্য কোন একক সাহিত্যিকের সৃষ্টি নয়। অসংখ্য মানুষের সম্মিলিত সাধনার ফসল। লোকসাহিত্যের ধারা বংশপরম্পরায় প্রবাহিত হয়। মানুষের জীবনপ্রবাহের বার্তা বহন করে। রঙীন কল্পলোকের দ্বার উন্মুক্ত করে। বাংলার ঘরে ঘরে লিখিত অলিখিত প্রচলিত অপ্রচলিত লোকসাহিত্যের যে কত নিদর্শন আছে তার ইয়ত্তা নেই। শিশুসাহিত্য, মেয়েলি ব্রতকথা,ধর্মসাহিত্য,সভাসাহিত্য,পল্লীসাহিত্য, প্রবচনসাহিত্য, ইতিবৃত্তিমূলকসাহিত্যে ভরপুর লোকসাহিত্য।[3]
ছেলেভুলানো ছড়া, ঘুমপাড়ানি গান, রূপকথা, উপকথা এসব নিয়েই শিশু সাহিত্য। শিশুসাহিত্যের ছড়া ও গানকে রবীন্দ্রনাথ তুলনা করেছেন নানা রঙের ভাসমান মেঘের সাথে। এই মেঘ শিশু-শস্যকে প্রাণ দান করে। এই মেঘ শিশুমন ও হৃদয়কে উর্বর করে। ছেলেভুলানো ছড়া এই রকম;
'ইকিড় মিকিড়, চাম চিকিড়
চামের কৌটা মোকদ্দমা হাঁড়িকুড়ি।
দুয়ারে বসে চাল কাড়ি।
চাল কাড়তে হল বেলা
ভাত খেয়ে যা দুপুর বেলা।
ভাতে পড়লো মাছি
কোদাল দিয়ে চাঁছি।
কোদাল হল ভোঁতা
খা কামারের মাথা।'
খোকার চোখে ঘুম নেই। মা ধরেছেন ঘুম পাড়ানি গান;
'ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি
মোদের বাড়ি এসো।
খাট নেই পালঙ্ক নেই
চাটাই পেতে বোসো।
বাটা ভরে পান দেব
গাল ভরে খাও।
খোকার চোখে ঘুম নেই
ঘুম দিয়ে যাও।'
ব্রত কথা বাংলার আদিকাব্য। সেঁজুতি ব্রত, সাবিত্রী ব্রত, তুষ- তুষালি ব্রত, পূণ্যপুকুর ব্রত আদিম নির্দশন। এই ব্রতকথা জীবনে শান্তি ও সুখ আনে বলে মনে করা হয়। মেয়েরা অন্তঃপুরে থাকলেও তাদের চিত্তবৃত্তিকে দমিয়ে রাখা যায়নি। নিজেদের কামনা বাসনা সুখ দুঃখ প্রকাশিত হয়েছে ব্রত ছড়ার মাধ্যমে। কোন ছড়ায় মঙ্গল কামনা করা হয়েছে। কোনটিতে সতীনের সর্বনাশ চাওয়া হয়েছে। আবার কোনটিতে ধনসম্পদ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। একটি ছড়া:
'আমি সতী লীলাবতী
ভাইয়ের বোন পুত্রবতী
হয়ে পুত্র মরবে না
পৃথিবীতে ধরবে না।'
নববধূর করুণ চিত্র প্রকাশিত হয়েছে একটি ছড়ায়;
এপারেতে কালো রঙ, বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম
ও পারেতে লঙ্কা গাছটি রাঙা টুকটুক করে,
গুণবতী ভাই আমার মন কেমন করে।
এ মাসটা থাক দিদি কেঁদে ককিয়ে
ও মাসেতে নিয়ে যাব পালকি সাজিয়ে। হাড়
হল ভাজা ভাজা মাস হল দড়ি
আয়রে আয় নদীর জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ি।
বাংলার মানুষের মনে দেবতাদের স্থান সবার উপর। কল্পনার দেবতা হয়ে যান জীবন্ত। দেবতাদের কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে ধর্মসাহিত্য। ধর্মমঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল, শীতলা মঙ্গল, লক্ষ্মীর পাঁচালী, সত্যনারায়ণ পাঁচালী ধর্মসাহিত্যের উপকরণ। আগমনি বিজয়ার গান, শ্যামা সঙ্গীত, বাউলগান ধর্ম সাহিত্যের অঙ্গীভূত। শিব দুর্গার কাহিনি কে অবলম্বন করে লোকসাহিত্যের ধারাও দেখা যায়। বাৎসল্য রসের প্রবাহ আগমনি বিজয়ার গানে প্রতিফলিত;
'বৎসর হয়েছে গত করছে শিবের ঘর
যাও গিরিরাজ আনতে গৌরী কৈলাস
শিখর।'
পিতামাতার কন্যা বিচ্ছেদজনিত ব্যথা ফুটে ওঠে;
'ওরে গিরি কেমন কেমন করে উঠে প্রাণ
এমন মেয়ে কারে দিয়ে হয়েছ পাষাণ!'
শ্যামা সঙ্গীতে আছে ভক্তি ও শ্রদ্ধার সুর। বাউল গানে আমরা খুঁজে পাই আবেগ ও প্রকাশের সারল্য। বাউল গানে শুধু ভক্তি বা বিশ্বাস নেই। উপমার রূপক সহযোগে প্রতিদিনের ছোট বড় সব ঘটনাই এতে স্থান পেয়েছে।
বাউলগান মানবধর্মকে বড় করে তুলেছে;
'সব লোকে কয় লালন কি জাত এ
সংসারে
লালন বলে জাতের কিরূপ দেখলাম না এ
নজরে।'
বাউলের গীতিবৈচিত্র অপূর্ব:
'খাঁচার মাঝে অচিনপাখি কেমনে আসে যায়
ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতেম পাখির পায়।'
মানুষের মননে অমরত্ব লাভ করেছে এই সব গান। বাউল গানের মধ্যে সুন্দর ভাবে ধরা পড়েছে ঈশ্বর তত্ত্ব।
'আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের
মানুষ যেরে।'
কবি গান, পাঁচালী গান, সীতার সতীধর্ম, রামচন্দ্রের পিতৃভক্তি। কর্ণের ত্যাগ ধর্ম, ভীষ্মের আত্মত্যাগ ইত্যাদির অভিনয় ও ব্যাখ্যা মানুষ শুনে আসছে। বাংলার যাত্রা- কথকতা সভা-সাহিত্যের রূপ।
গ্রাম বাংলার পল্লীর সহজ সরল মানুষের মনেপ্রাণে জড়িয়ে আছে পল্লী সাহিত্য। ভাটিয়ালী গান, তরজা গান, টুসু গান, ভাদু গান, সারি গান, মানিক চাঁদের গান, ময়নামতির গান, বঙ্গ গীতিকা ইত্যাদি বাংলার হৃদয় ভূমিতে জন্ম লাভ করেছে। এখন অবশ্য গ্রাম ও শহরকে একাকার করে দিয়েছে এই গান। গ্রামের মানুষ এখন টুসুর শ্বশুর বাড়ি কলকাতায় হয়েছে বলে ভাবে। টুসুকে বিদায় জানানো হয় দুঃখে;
'টুসু যাবেক শ্বশুর বাড়ি
কলকাতা শহরে।
আমাদের ছাইড়ে যাতে লারে
মন কেমন করে।'
ভাদু গানে বিরহের সুর;
'ভাদু কাঁদছ ক্যানে
আসছে বছর আনবো গো অ্যামন দিনে।
ভাদু কাঁদছ ক্যানে'।
বঙ্গ গীতিকা বা পল্লী গীতিকা লোক সাহিত্যের বিরাট সম্পদ। মধু মালা, কাঞ্চন মালা, শঙ্খ মালা, মালঞ্চ মালা এবং পুষ্প মালা এই পাঁচ কন্যার কাহিনির মধ্যে পরিচয় পাওয়া যায় মানব জীবনের জীবনধারা। আবার মুসলিম কন্যা মদিন্যা তার স্বামীর প্রতীক্ষায় আছে। সে-
'ছিক্কাতে তুলিয়া রাখে গামছা বাঁধা দৈ।
আইজ বানায় তালের পিঠা
কাইল বানায় খৈ।।'
খনার বচন, শুভঙ্করের আর্যা, ডাকেরকথা প্রবাদপ্রবচন পুষ্ট করেছে বাংলার লোক সাহিত্যকে। মানুষের জ্ঞান যেন ধরা আছে প্রবচন সাহিত্যের অফুরন্ত ভাণ্ডারে। ভক্তিগীতির কিছু পঙ্ক্তি প্রবাদপ্রবচনের মতোই মানুষের মুখে মুখে;
'মা আমায় ঘোরাবি কত
কলুর চোখ ঢাকা বলদের মতো।'
'মনরে কৃষি কাজ জান না।
এমন মানব জনম রইল পতিত
আবাদ করলে ফলতো সোনা।'
সুখ, দুঃখ, প্রেম, দুর্ঘটনা কিম্বা ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করেই মানব মানসে রচিত হয় ইতিবৃত্তিমূলক সাহিত্য। মৈমন সিংহ গীতিকা এই সাহিত্যের উপযুক্ত উদাহরণ। মহুয়া, মলুয়া, কাজলরেখা, সোনাই-এর কাহিনি সাহিত্যকে জীবন দান করেছে। বাংলায় মহুয়া, মলুয়া ইত্যাদি শিরোনামে গাথা কাব্য আছে। গাথা কাব্য গাওয়ার জন্য। এখানে সহজ সুর বার বার আসে কবিতার ধুয়ো বা ধ্রুবপদ অংশে। মহুয়া গাথা কাব্যে দেখা যায়:
'ফুল যদি হৈতারে বন্ধু ফুল হৈতা তুমি।
কেশেতে ছাপাইয়া রাখতাম
ঝাইরা বানাতাম বেণী।'
এতে প্রেমিকার প্রেম প্রকাশিত। মলুয়ার দিন যায় এই ভাবেই। কবির কলমে প্রকাশিত রূপ এই রকম;
'নাকের নথ বেচ্যা মলুয়া আষাঢ় মাস খাইল
গলার যে মতির মালা তাহা বেচ্যা গেল।
শায়ন মাসেতে মলুয়া পায়ের খাড়ু বেচে
এত দুঃখ মলুয়ার কপালেতে আছে।
হাতের বাজু বান্ধ্যা দিয়া ভাদ্র মাস যায়
পাটের শাড়ি বেচ্যা মলুয়া আশ্বিন মাস খায়।
জ্যৈষ্ঠ মাসে আম পাকে কাকে করে রাও
কোন বা দেশে আছে স্বামী নাহি জানে তাও।'
নগরায়ণ ও সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে লোক সাহিত্যের অনুশীলন ও সংরক্ষণ এক বড় প্রশ্ন চিহ্নের উপর দাঁড়িয়ে। বাংলার ঘরে ঘরে আগের মতো আর লোক সাহিত্যের চর্চা হয় না। অনুশীলন হয় না। মানুষের অবসরের সময় কেড়ে নিয়েছে কম্পিউটার, টেলিভিশন। লোকসাহিত্যের কথা শোনাবার লোক কমে যাচ্ছে। ধুঁকতে ধুঁকতে কোন ক্রমে বেঁচে আছে আমাদের লোকসাহিত্য। তবে এখনো সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন লোকসাহিত্য চর্চাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। উৎসাহিত করছে। অনুষ্ঠানও হচ্ছে। মা ঠাকুমার কাছ থেকে যে শিশু গল্প শুনত এখন তা শুনছে রেডিও, টেলিভিশন, কম্পিউটারের কাছ থেকে। বাংলার লোক সাহিতা শুধু মানুষের মনে নয় এখন গাঁথা হয়ে যাচ্ছে যন্ত্রের শরীরেও। সভ্যতার অগ্রগতি ও যান্ত্রিক যুগের যন্ত্রে ঠিক মতো শ্বাস নিতে পারছে কি লোকসাহিত্য? অকালেই সে চলে যাবে না তো?[4]
যদিও বোবা মানুষগণ আঙ্গিক ঈশারার মাধ্যমে ভাব বিনিময় করে, তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য লোকসাহিত্য হিসেবেই বিবেচিত হয়। গল্প, কৌতুক, ও পদ্য এক ব্যক্তির থেকে অন্য ব্যক্তির নিকট কোন প্রকার লিখিত মাধ্যম ছাড়াই আদান-প্রদান হয়ে থাকে।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.