Loading AI tools
অস্ট্রীয় পদার্থবিজ্ঞানী উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
লুডভিগ এডুয়ার্ড বোলৎসমান (জার্মান: Ludwig Boltzmann) (২০শে ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৪ - ৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯০৬) প্রখ্যাত অষ্ট্রীয় পদার্থবিজ্ঞানী, দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ। তিনিই প্রথম বলেছিলেন, পরমাণুকে না দেখলেও কিছু পরিসাংখ্যিক সমীকরণের মাধ্যমে তাদের গতিবিধি বর্ণনা করা সম্ভব। এভাবেই তিনি পরিসাংখ্যিক গতিবিদ্যার জন্ম দেন। তখনকার প্রতিষ্ঠিত নিয়মের বাইরে গিয়ে তিনি আরও বলেছিলেন, তাপগতিবিদ্যায় সম্ভাব্যতার ধারণা সংযোজন করা উচিত। এভাবে তার হাত ধরে পরিসাংখ্যিক তাপগতিবিদ্যারও জন্ম হয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্রকৃতির বিশৃঙ্খলাকে এনট্রপি নামক একটি গাণিতিক রাশির মাধ্যমে পরিমাপ করা সম্ভব। সে সময় প্রচলিত ধ্রুব প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রকৃতির বাস্তব বিশৃঙ্খলা এবং সম্ভাব্যতার প্রভাব আবিষ্কার করেছিলেন বলেই তাকে বলা হয় দ্য জিনিয়াস অফ ডিসঅর্ডার।[1]
লুডভিগ বোলৎসমান | |
---|---|
জন্ম | ভিয়েনা, অস্ট্রীয় সম্রাজ্য | ২০ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৪
মৃত্যু | সেপ্টেম্বর ৫, ১৯০৬ ৬২) | (বয়স
মৃত্যুর কারণ | আত্মহত্যা |
জাতীয়তা | অস্ট্রীয় |
মাতৃশিক্ষায়তন | ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনা |
পরিচিতির কারণ | বোলৎসমান ধ্রুবক বোলৎসমান সমীকরণ এইচ-তত্ত্ব বোলৎসমান বণ্টন স্টেফান-বোলৎসমান সূত্র ম্যাক্সওয়েল-বোলৎসমান বণ্টন |
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন | |
কর্মক্ষেত্র | পদার্থবিজ্ঞানী |
প্রতিষ্ঠানসমূহ | ইউনিভার্সিটি অফ গ্রাৎস ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অফ মিউনিখ ইউনিভার্সিটি অফ লাইপৎসিগ |
ডক্টরাল উপদেষ্টা | ইয়োসেফ স্টেফান |
ডক্টরেট শিক্ষার্থী | পাউল এরেনফেস্ট ফ্রিলিপ ফ্রাংক গুস্তাফ হের্গলোৎস Franc Hočevar Ignacij Klemenčič লিজে মাইটনার |
যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন | মাক্স প্লাংক আলবার্ট আইনস্টাইন শন ক্যারল |
যাদেরকে প্রভাবিত করেছেন | জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল |
স্বাক্ষর | |
পেশাগত জীবনে আর্নস্ট মাখ-এর মত বিজ্ঞানীদের সক্রিয় বিরোধিতায় তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। মাখ এবং তার সমর্থকরা পরমাণু পর্যবেক্ষণ করা যায় না বলে তা বিশ্বাস করতেন না, বরং সবকিছু শক্তি দিয়ে ব্যাখ্যার চেষ্টা করতেন। আজীবন মাখ এবং অস্টভাল্ডদের শক্তিবাদ (এনার্জেটিক্স) নামের এই তত্ত্বের বিরোধিতা করেছেন বোলৎসমান। অন্যদিকে ব্যক্তিগত জীবনে তার মা এবং ১১ বছরের ছেলের মৃত্যুতে তিনি ভেঙে পড়েন। মনস্তত্ত্ববিদদের মতে, এই জিনিয়াস অফ ডিসঅর্ডার যে রোগে ভুগছিলেন তার নাম বাইপোলার ডিসঅর্ডার। জার্মানির লাইপৎসিগে একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। সবশেষে ১৯০৬ সালে ইতালির ত্রিয়েস্তের নিকটে একটি স্থানে আত্মহত্যার মাধ্যমেই এই মহান বিজ্ঞানীর জীবনাবসান ঘটে। বলা হয় আর ২০ বছর বেঁচে থাকলে তিনি দেখে যেতে পারতেন যে, তার পরমাণু এবং সম্ভাব্যতার প্রতি নিরংকুশ সমর্থনই জয়লাভ করেছে, শক্তিবাদ ছদ্ম-বিজ্ঞান হিসেবে পরিত্যক্ত হয়েছে।
বোলৎসমানের গবেষণা আধুনিক কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান এবং কোয়ান্টাম বিশ্বতত্ত্বের জন্যও খুব প্রয়োজনীয়। বোলৎসমান মনে করতেন সমগ্র মহাবিশ্ব (বহুবিশ্ব) তাপীয় সাম্যাবস্থায় আছে। তিনি এও বুঝতে পেরেছিলেন, তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র পরম নয়, বরং পরিসাংখ্যিক। সুতরাং সেই সমগ্র মহাবিশ্বের মধ্যে অপরিহার্যভাবেই পরিসাংখ্যিক ব্যত্যয় (ফ্লাকচুয়েশন) শুরু হবে এবং তার স্থানে স্থানে সাম্যাবস্থা থেকে বিচ্যুতি দেখা দেবে। এই স্থানীয় বিচ্যুতিগুলোই জন্ম দেবে আমাদের মত অসংখ্য মহাবিশ্বের। বর্তমানে অবশ্য এ ধরনের চিন্তাধারাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা হয় না। কারণ পরিসাংখ্যিক ব্যত্যয় বিরল এবং একটি মহাবিশ্ব সৃষ্টির মত ব্যত্যয় আরও বিরল। তবে জ্ঞানের এই ধারার অগ্রদূত হিসেবে লুক্রেতিউসের পরই বোলৎসমানের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।[2]
লুডভিগ এডুয়ার্ড বোলৎসমানের পিতামহ গটফ্রিড লুডভিগ বোলৎসমান ১৭৭০ সালে জার্মানির রাজধানী বার্লিন থেকে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় এসে বাদ্যযন্ত্র নির্মাণের ব্যবসা শুরু করেন। এখানেই বিয়ে করেন, ছেলের নাম রাখেন লুডভিগ গেয়র্গ বোলৎসমান। গেয়র্গ বড় হয়ে অস্ট্রীয় সরকারের রাজস্ব বিভাগে যোগ দেন, ১৮৩৭ সালে বিয়ে করেন সালৎসবুর্গের এক বণিকের কন্যা কাথেরিনা মারিয়া পাউয়েনফাইন্ডকে। উল্লেখ্য গেয়র্গ প্রোটেস্ট্যান্ট হলেও মারিয়া ছিলেন ক্যাথলিক মতের অনুসারী। গেয়র্গের আর্থিক অবস্থা খুব ভাল না হলেও মারিয়ার বাবা ছিলেন খুবই ধনাঢ্য।[3] তাদের পরিবারের নামানুসারে সালৎসবুর্গ শহরে এখনও Pauernfeindgasse এবং Pauernfeindstrasse নামে দুটি স্থান আছে।[4]
গেয়র্গ ও মারিয়ার বড় সন্তান লুডভিগ বোলৎসমানের জন্ম হয় ১৮৪৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে, অর্থাৎ শ্রোভ মঙ্গলবার এবং অ্যাশ বুধবারের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে। পরবর্তী জীবনে তিনি বলতেন, এমন একটা সময়ে জন্ম নেয়ার কারণেই তার আবেগ মূহুর্মূহু পরিবর্তিত হয়, তীব্র আনন্দের মধ্যে থেকেই আবার হঠাৎ তীব্র হতাশায় নিমজ্জিত হন। উল্লেখ্য অ্যাশ বুধবার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের একটি বিশেষ দিন যা ইস্টারের ৪৬ দিন পর পালিত হয়, এই দিন থেকেই কঠোরভাবে ধর্মপালন শুরু হয় যা পরবর্তী ইস্টারের পূর্ব পর্যন্ত চলে। আর অ্যাশ বুধবারের আগের দিনটিই হচ্ছে শ্রোভ মঙ্গলবার।
বোলৎসমানের জন্মস্থান ভিয়েনার তৃতীয় জেলা (গেমাইন্ডেবেৎসির্কে), লান্ডস্ট্রাসেতে। ১৮৪৬ সালে তার ছোট ভাই আলবার্ট এবং দুই বছর পর ছোট বোন হেডভিগের জন্ম হয়। তিন ভাইবোনেরই ব্যাপ্টিজম হয় ক্যাথলিক ধর্মমত অনুসারে এবং তারা ক্যাথলিক হিসেবেই বেড়ে উঠতে থাকে। আলবার্ট মাধ্যমিক স্কুলে থাকার সময় নিউমোনিয়ায় মারা যায়।[5]
বোলৎজমানের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় বাড়িতে গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে। তারা বাবাকে প্রথমে ভেল্স এবং পরে লিনৎস শহরে চলে আসতে হয়। লিনৎসেই বোলৎসমান স্থানীয় জিমনেসিয়ামে পড়াশোনা শুরু করেন। স্কুলে সব সময়ই খুব ভাল করতেন, বিজ্ঞান এবং গণিতের প্রতি তখন থেকেই তার খুব আগ্রহ ছিল। শেষ জীবনে তার চোখের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, ছোটবেলায় সন্ধ্যার পর মোমবাতি জ্বালিয়ে দীর্ঘক্ষণ পড়াশোনা করা। লিনৎসে তিনি আন্টোন ব্রুকনারের কাছে পিয়ানো বাজাতে শিখেন। অবশ্য শিক্ষক নিয়ে মায়ের অসন্তুষ্টির কারণে এক সময় তাকে পিয়ানো শেখা ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু নিজে নিজে পিয়ানো বাজানো কখনও ত্যাগ করেননি। বয়স কালে ছেলের সাথে বাজাতেন, ছেলে আর্থুর লুডভিগ বাজাতো বেহালা আর তার সাথে তাল মিলিয়ে তিনি বাজাতেন পিয়ানো। ১৫ বছর বয়সে বোলৎসমানের বাবা যক্ষ্ণায় মারা যান। ছোট ভাইয়ের মৃত্যুও হয় এর কিছুকাল পর। এই দুটি মৃত্যু তার জীবনে বড় ছাপ ফেলেছিল।
১৯ বছর বয়সে তিনি উনিফেরসিটেট ভিয়েন-এ (ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়) পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে ভর্তি হন। সেখানকার পদার্থবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট মাত্র ১৪ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ডপলার ক্রিয়ার আবিষ্কারক বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান ডপলার (১৮০৩-৫৪)।[3] উনিফেরসিটেট ভিয়েন অস্ট্রিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি। এটি সে সময় যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন ভোগ করত। বোলৎসমান যখন এখানে আসেন তখন আনড্রিয়াস ফন এটিংসহাউজেন সবেমাত্র পরিচালকের পদ ত্যাগ করেছেন, নতুন পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন ইয়োসেফ স্টেফান (১৮৩৫-৯৩)। বেশ কম বয়সেই স্টেফান পরিচালক হয়েছিলেন এবং পরে বিকিরিত তাপ ও তাপমাত্রার মধ্যে সম্পর্ক আবিষ্কারের জন্য অনেক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।[6] স্টেফান তার শিক্ষার্থীদের সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কথাবার্তা বলতেন, এই গুণটি বোলৎসমান খুব পছন্দ করেন। স্টেফানের মৃত্যুর পর এক শোকবাণীতে তিনি লিখেছিলেন,
“ | স্টেফানের সাথে যখন আমার ঘনিষ্ঠতা হওয়ার পরপরই সে আমার হাতে ম্যাক্সওয়েলের কিছু গবেষণাপত্র ধরিয়ে দেয়। আমি তখন ইংরেজি একেবারেই বুঝতাম না, এজন্য সে সাথে একটি ইংরেজি ব্যকরণের বইও দিয়ে দেয়, আর একটি ইংরেজি অভিধান আমি বাবার কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। | ” |
ভিয়েনার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ৩ বছর পর বোলৎসমান পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এর মধ্যেই তার দুটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে তার পিএইচডি গবেষণার কোন অভিসন্দর্ভ ছিল না। কারণ ১৮৭২ সালের পূর্বে ভিয়েনায় পিএইচডি (দর্শন) ডিগ্রির জন্য কোন অভিসন্দর্ভ জমা দিতে হতো না।
১৮৬৭ সালে বোলৎসমান ভিয়েনায় সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। তখন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটটি ছিল খুব ছোট, এর্ডবের্গারস্ট্রাসে-তে তাদের একটিমাত্র ছোট গবেষণাগার ছিল। কিন্তু ইনস্টিটিউটের সদস্য সবাই ছিলেন তুখোড়। এই সদস্যদের প্রশংসায় বোলৎসমান লিখেছিলেন,
“ | এর্ডবের্গ আজীবন আমার কাছে সৎ এবং উদ্যমী গবেষণার প্রতীক হয়েছিল। গ্রাৎসের ইনস্টিটিউটে যখন একটু প্রাণ সঞ্চার করতে পেরেছিলাম তখন তাকে আমি ছোট্ট এর্ডবের্গ নামে ডাকতাম। এর মানে এই নয় যে গ্রাৎসের সুযোগ-সুবিধা কম ছিল, বরং আকার-আয়তনে এটি ছিল স্টেফানের ইনস্টিটিউটের প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু এর্ডবের্গের সেই চেতনা এখানে তেমন ছিল না। এমনকি মিউনিখে পিএইচডি শিক্ষার্থীরা যখন আমাকে প্রশ্ন করত তারা কি নিয়ে কাজ করবে তখন আমি ভাবতাম, "এর্ডবের্গে সবকিছু কতটা ভিন্ন ছিল, বর্তমানে পরীক্ষণের জন্য সব যন্ত্রপাতি আছে, কিন্তু গবেষকদের মাথায় আইডিয়া নেই। আর তখন আমাদের মাথায় প্রচুর আইডিয়া ছিল, কিন্তু সেগুলো নিয়ে কাজ করার মত যথেষ্ট যন্ত্রপাতি ছিল না। | ” |
১৮৬৮ সালে বোলৎসমান শিক্ষকতায় কৃতিত্বের জন্য ফেনিয়া লেগেন্ডি পুরস্কার লাভ করেন এবং ১৯৬৯ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে গ্রাৎস বিশ্ববিদ্যালয়ে গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান মনোনীত হন। সে সময় গ্রাৎস ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি হতে চলেছিল। বোলৎসমান এখানে আসার কিছুদিন পূর্বে স্থির-তড়িৎ গবেষণায় অবদানের জন্য বিখ্যাত বিজ্ঞানী আউগুস্ট টোয়েপলার এখানকার পদার্থবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক হয়ে আসেন। টোয়েপলার তার অন্যতম বন্ধু ও উপদেষ্টায় পরিণত হয়েছিলেন। টোয়েপলার প্রশাসনিক কাজেও খুব দক্ষ ছিলেন। তিনি কিছুদিনের মধ্যেই পদার্থবিজ্ঞানের জন্য একটি নতুন ভবন, নতুন যন্ত্রপাতি এবং আরও বেশি অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থার করেন। বোলৎসমান গ্রাৎসে তাই গবেষণার খুব ভাল পরিবেশ পেয়েছিলেন। এর বদৌলতেই ১৮৭২ সালে ইম্পেরিয়াল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস-এর (বর্তমান নাম - Österreichische Akademie der Wissenschaften, অস্ট্রীয় বিজ্ঞান একাডেমি) প্রসিডিংসে তার সবচেয়ে বিখ্যাত গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করতে সক্ষম হন। গবেষণাপত্রটির নাম ছিল Weitere Studien über das Wärmegleichgewicht unter Gasmolekülen (ইংরেজি ভাষায়: Further Studies on the Thermal Equilibrium of Gas Molecules) যার বাংলা করলে দাঁড়ায় গ্যাস অণুর তাপীয় সাম্যাবস্থা বিষয়ে নতুন গবেষণা। ম্যাক্সওয়েল-বোলৎসমান বণ্টনের প্রাথমিক রূপ এই রচনাতেই প্রকাশিত হয়েছিল। এতে তিনি এমন একটি সমীকরণ প্রকাশ করেন যার মাধ্যে অসংখ্য অণু দিয়ে গঠিত একটি গ্যাসের বিবর্তন ব্যাখ্যা করা যায়। উল্লেখ্য, এটিই প্রথম সমীকরণ যাতে সম্ভাবনার উপর ভিত্তি করে সময়ের সাথে কণার বিবর্তন দেখানো হয়েছিল।
সে সময় তাত্ত্বিক গবেষণার পাশাপাশি বোলৎসমান গ্রাৎসে একটি পরীক্ষণও চালিয়ে যাচ্ছিলেন, বিষয় ছিল প্রতিসরাংক এবং dielectric permittivity-র মধ্যে সম্পর্ক। এই পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন ১৮৭৩ সালে। ইয়োহান ইয়োসেফ লশমিট মারা যাওয়ার পর তার শোকবাণীতে বোলৎসমান লিখেছিলেন, তখন আমি সালফার কেলাসের গোলক নিয়ে গবেষণা করতে চাচ্ছিলাম। কেউ যেহেতু এই কেলাস গুঁড়ো করতে চায় না সেহেতু লশমিট আমাকে পরামর্শ দিল বুর্গথেয়াটার এর টিকেট কেনার লাইনে দাঁড়িয়ে তার সাথে কাজটা করতে। এতে কার্বন ডাইসালফাইডের গন্ধে সবাই লাইন ছেড়ে পালাবে।
টোয়েপলার যথেষ্ট অর্থ সংস্থান করতে পেরেছিলেন বলেই বোলৎসমান তখন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করতে যেতে পারতেন। সে সময় তিনি জার্মানির হাইডেলবার্গে বিখ্যাত রসায়নবিদ রবার্ট ভিলহেল্ম ফন বুনসেন (১৮১১-৯৯) এবং গণিতজ্ঞ লেও কোনিগসবের্গারের (১৮৩৭-১৯২১) সাথে কাজ করেন। বার্লিনে কাজ করেন গুস্তাফ কির্খফ (১৮২৪-৮৭) এবং শক্তির একটি নিত্যতা সূত্র প্রদানের জন্য বিখ্যাত হেরমান লুডভিগ ফের্ডিনান্ড ফন হেল্মহোলৎসের সাথে। এরা সবাই সে সময় খুব বিখ্যাত ছিলেন। বোলৎসমান হেল্মহোলৎসকে খুব পছন্দ করতেন। এমনকি অনেক সময় হেল্মহোলৎস ছাড়া তিনি কথা বলার মত আর কাউকে পেতেন না। তার সম্পর্কে একবার মাকে লিখেন,
“ | গতকাল আমি বের্লিন ফিজিক্যাল সোসাইটিতে বক্তৃতা করলাম। বুঝতেই পারছ, নিজেদের দেশকে ভালভাবে তুলে ধরতে আমি কতটা চেষ্টা করেছি। এজন্য গতকাল আমার মাথা ভর্তি ছিল কেবল সমাকলনীয় সমীকরণ... অবশ্য, এ নিয়ে খুব শ্রম দেয়ার প্রয়োজন ছিল না, কারণ আমার কথা এমনিতেও কেউ বুঝত না। কিন্তু, হেল্মহোলৎসও সেখানে উপস্থিত ছিল এবং সেই সূত্রে তার সাথে আমার একটি চমৎকার আলোচনার সূচনা ঘটে। তুমি তো জানোই আমি বৈজ্ঞানিক আলোচনা কত পছন্দ করি, তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ হেল্মহোলৎসের সাথে কথা বলে আমি কতটা আনন্দ পেয়েছিলাম। বিশেষ করে এইজন্য যে, অন্যভাবে সহজে হেল্মহোলৎসের নাগাল পাওয়া যায় না। সে আমার পাশের গবেষণাগারে কাজ করে, কিন্তু এর আগে ভাল করে একটু কথা বলারও সুযোগ পাইনি। | ” |
১৮৭৩ সালে বোলৎসমান ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনায় গণিতের অধ্যাপক পদে আমন্ত্রণ পান। ভিয়েনার অধ্যাপক হওয়া সে সময় অস্ট্রিয়ায় সবচেয়ে বড় সম্মান বলে বিবেচিত হয়, এখনও হয়। অনেক সময় অবশ্য এতে হিতে বিপরীতও হতো। কিন্তু বোলৎসমানের ভিয়েনায় যাওয়ার ব্যাপারে সম্ভবত আরেকটি বিষয়ও কাজ করেছিল, তিনি আরও পরীক্ষণমূলক কাজ করতে চাচ্ছিলেন। বোলৎসমান পরিচিত ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে। কিন্তু ভিয়েনায় গণিত বিভাগে নিয়োগ দিতে গিয়ে সেখানকার নির্বাচকরা যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, তার গবেষণাপত্রগুলো গণিতের কাজ হিসেবেও চমৎকার, বিশেষত তাত্ত্বিক বলবিদ্যা এবং সম্ভাব্যতার ক্যালকুলাস নিয়ে তার কাজ প্রশংসা করার মত এবং তাপ নিয়ে কাজ করার সময়ও তিনি গণিতে বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।
গ্রাৎস ত্যাগ করার পূর্বেই বোলৎসমানের সাথে তার ভবিষ্যৎ স্ত্রী হেনরিয়েটে ফন আইগেন্টলারের পরিচয় হয়েছিল। সোনালী লম্বা চুল ও নীল চোখের এই তরুণী বোলৎসমানের ১০ বছরের ছোট ছিলেন। হেনরিয়েটের বাবা-মা মারা গিয়েছিলেন, তিনি থাকতেন গ্রাৎসের দক্ষিণে স্টাইনৎসের একটি বাড়িতে। এই বাড়ির কর্তা-কর্ত্রীর সন্তান হচ্ছেন নামকরা অস্ট্রীয় সঙ্গীতজ্ঞ ভিলহেল্ম কিনৎসল। তিনি পেশায় শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু বোলৎসমানের সাথে পরিচয় হওয়ার পর আবার গণিত পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সে সময় মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার চল ছিল না, তবে তা নিষিদ্ধও ছিল না। গ্রাৎসের দর্শন অনুষদের প্রধান অধ্যাপক হিরৎসেলজানতেন না হেনরিয়েটে কেন গণিত পড়তে চায়। তিনি তার আর্জি শোনার পর বলেছিলেন, মেয়েদের কাজ রান্নাবান্না, ঘর-সংসার করা। তবে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়েই প্রথম সেমিস্টারের লেকচারগুলোর শোনার অনুমতি দিয়েছিলেন।
কিন্তু দ্বিতীয় সেমিস্টারের শুরুর আগেই মেয়েদের দর্শন অনুষদ মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া নিষিদ্ধ করে একটি আইন জারি করে। হেনরিয়েটে এই আইনের বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়ার গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পিটিশন পেশ করেন। মন্ত্রণালয় থেকে তাকে পড়ার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু পরের সেমিস্টার শুরুর আগে আবারও সেই সমস্যার উদ্ভব ঘটে। অবশ্য বোলৎসমানের সাথে বাগ্দান হওয়ার পর তার পড়াশোনার ইচ্ছা চলে যায়, অধ্যাপক হিরৎসেল যা বলেছিলেন তাই পালন শুরু করেন, রান্না শিখেন গ্রাৎসের লর্ড মেয়রের বাসায়, যিনি তার বাবার বন্ধু ছিলেন।
১৯৭৩ সালেই বোলৎসমান ভিয়েনায় চলে যান। ভিয়েনা থেকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন হেনরিয়েটেকে। বাগ্দানের পর বোলৎসমানের সাথে তার হবু-স্ত্রীর যেসব চিঠি আদান-প্রদান হয়েছিল সেগুলো নিয়ে জার্মান ভাষায় একটি বই বেরিয়েছে, যার ইংরেজি নাম Illustrious Professor: Dearly beloved Louis: Ludwig Boltzmann, Henriette von Aigentler, Correspondence।[7] বইটি সম্পাদনা করেছেন বোলৎসমান ও হেনরিয়েটের পৌত্র অধ্যাপক ডিটার ফ্লাম। এই চিঠিগুলোতে বোলৎসমানের জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য দিকের পরিচয় পাওয়া যায়। বইয়ের শিরোনাম থেকে দেখা যায় ঘনিষ্ঠতা হওয়ার পর হেনরিয়েটে লুডভিগকে কেবল "লুইস" বলে সম্বোধন করত। বোলৎসমান প্রথমে তাকে Hochgeehrtes Fraulein নামে সম্বোধন করলেও পরে শুধু "ইয়েটি" (Jetty) ব্যবহার শুরু করেন। সম্বোধনের এই পরিবর্তন ঘটে ৩০শে নভেম্বর ও ৬ ডিসেম্বরের মাঝের সপ্তাহটিতে, চিঠি থেকে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বোলৎসমান ১৮৭৫ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর হেনরিয়েটেকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, চিঠির মাধ্যমে। এই চিঠি থেকে দেখা যায় তখনও ভিয়েনায় মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা ছিল। এই চিঠিতে তিনি নিজের আর্থিক অবস্থার বিবরণ দেন, ১৮৭৪ সালে তার বার্ষিক আয় ছিল ৫৪০০ ফ্লোরিন। দুজনের জন্য এটা যথেষ্ট বলেই মনে হয়েছিল বোলৎসমানের। কিন্তু চিঠিতে এও লিখেন যে, ভিয়েনায় দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেলে হেনরিয়েটার অবসর বিনোদন এবং আনন্দের জন্য এই অর্থ যথেষ্ট হবে না। এই চিঠিতে তিনি বিয়ে সম্পর্কেও তার চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেন, "পরিবারের সার্বিক দেখভাল একজন স্বামীর জন্য আবশ্যকীয় এবং এক্ষেত্রে তার একমাত্র মূলধন তার কর্ম। কিন্তু আমার মতে স্ত্রী যদি কেবল স্বামীর গৃহপরিচারিকা হয়ে থাকে, তার আনন্দ এবং উদ্যমগুলো ভাগাভাগি না করে বা বুঝতে না পারে, তার সাথে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করতে না পারে তাহলে ভালবাসা চিরস্থায়ী হতে পারে না।"
২৫শে নভেম্বর হেনরিয়েটের লেখা আরেকটি চিঠি থেকে জানা যায় বোলৎসমানকে ফ্রেইবুর্গে একটি পদে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। উল্লেখ্য তখন তিনি ভিয়েনায়। হেনরিয়েটে তার চিঠিতে এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত দেননি। তিনি যেহেতু কেবল লুডভিগকেই চান সেহেতু তিনি কোথায় থাকবেন তা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে এটুকু নির্লিপ্ততা দেখিয়ে তিনি আবার ভিয়েনা ছেড়ে যাওয়ার সুবিধা-অসুবিধার কথা বলেন, যেহেতু বোলৎসমান তার পরামর্শ চেয়েছিলেন। সুবিধার মধ্যে তিনি বলেন, ফ্রেইবুর্গে পেশাদারী কাজ কম, স্ত্রী ও পরিবারকে বেশি সময় দিতে পারবেন, একটি পদার্থবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রধান হতে পারবেন। কিন্তু মূল অসুবিধা হচ্ছে, ফ্রেইবুর্গের বেতন ভিয়েনার প্রায় অর্ধেক, অবশ্য সেখানে খাবার খরচও ভিয়েনা থেকে কম আর বাসার কোন ভাড়া দিতে হবে না। বোলৎসমানের পৌত্রের কাছ থেকে জানা যায় হেনরিয়েটে তাকে Mein liebes dickes Schatzerl (sweet fat darling) বলে ডাকতেন। বোলৎসমান খুব নরম মনের মানুষ ছিলেন, স্ত্রীর কাছ থেকে দূরে কোথাও যেতে হলে চোখের পানি ধরে রাখতে পারতেন না।
১৮৭৫ সালে বোলৎসমানের প্রথম বিখ্যাত গবেষণাপত্রের সেই সমীকরণটি তার বন্ধু লশমিটের সমালোচনার মুখে পড়ে। এ বিষয়ে লশমিটের বক্তব্য অপ্রত্যাবর্তন হেঁয়ালি বা লশমিটের হেঁয়ালি নামে পরিচিত। বোলৎসমান এই সমালোচনার জবাবও দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত পরে আলোচিত হবে।
ভিয়েনায় প্রশাসনিক কাজ অনেক বেশি ছিল, নরম মনের বোলৎসমানের পক্ষে সবকিছু চালিয়ে যাওয়া সহজ ছিল না। তার পুরোটা সময়ই চলে যেতো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কাজে। ১৮৭৬ সালেই তার গ্রাৎসে ফিরে যাওয়ার একটি সুযোগ তৈরি হয়। তার বিয়েও হওয়ার কথা সে বছর। হেনরিয়েটে যেহেতু গ্রাৎসের মেয়ে এবং সে যেহেতু ভিয়েনায় উপযুক্ত বাসা খুঁজে পাচ্ছিল না সেহেতু বিয়ের পর গ্রাৎসে থাকাটাই তার জন্য সবচেয়ে ভাল ছিল। তাই সুযোগটির জন্য বোলৎসমান অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন।
গ্রাৎসের পদার্থবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সমৃদ্ধির পেছনে মূল অবদান টোয়েপলারের। নতুন ভবনও তিনি নির্মাণ করিয়েছিলেন। ১৮৭৩ থেকে ১৮৭৬ এর মধ্যে ইনস্টিটিউটের জন্য ২৮,০০০ ফ্লোরিনের যন্ত্রপাতি কিনেছিলেন। কিন্তু ১৮৭৬ এ বোলৎসমানকে লেখা এক চিঠিতে টোয়েপলার বলেন, তিনি সরকারের কাছ থেকে যথেষ্ট অর্থ পাচ্ছেন না। সে বছরই তিনি গ্রাৎস ছেড়ে জার্মানির ড্রেসডেনে চলে যান। এতে গ্রাৎসের পদার্থবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রধানের পদটি ফাঁকা হয়ে যায়। এই পদ বোলৎসমানের কাছে ছিল স্বপ্নের মত। কিন্তু এই পদে তার একজন প্রতিদ্বন্দী ছিলেন, যিনি আবার পেশাগত ক্ষেত্রেও বোলৎসমানের বিরুদ্ধমনা ছিলেন। তার নাম আর্নস্ট মাখ। মাখ ১৮৬৪ থেকে ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত গ্রাৎসের গণিত বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। তার Die Mechanik in Hirer Enlwickelung historisch-kritisch dargestellt (ঐতিহাসিক ও সমালোচনামূলক দৃষ্টকোণ থেকে বলবিজ্ঞানের উন্নয়ন) নামক গবেষণাপত্রটি বিজ্ঞানীদের একেবারে নতুন একটি প্রজন্মের জন্ম দিয়েছিল যে প্রজন্মের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তি হচ্ছেন আলবার্ট আইনস্টাইন।
১৮৭৬ সালে মাখ প্রাগ-এ ছিলেন কিন্তু চাচ্ছিলেন গ্রাৎসে ফিরে যেতে। অন্যদিকে বোলৎসমান ও হেনরিয়েটের বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে গিয়েছিল জুলাইয়ের ১৭ তারিখ। তখনও তিনি নিশ্চিত না বিয়ের পর তাকে ভিয়েনায় থাকতে হবে নাকি গ্রাৎসে, বাসা কোথায় দেখতে হবে- ভিয়েনায় নাকি গ্রাৎসে। বিয়ের তারিখের ৫ দিন পূর্বে তারা বিয়ে করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়, যেখানে যেতে হবে হোক। কিন্তু এর পরপরই মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত আসে, গ্রাৎসের পদার্থবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রধান মনোনীত হন বোলৎসমান। বিয়ে করে গ্রাৎসে থাকতে শুরু করে নবদম্পতি।
বোলৎসমান দম্পতি গ্রাৎসে ১৪ বছর ছিলেন। এই শহরেই তাদের দুই ছেলে লুডভিগ হুগো (১৮৭৮-৮৯) ও আর্থুর (১৮৮১-১৯৫২) এবং দুই মেয়ে হেনরিয়েটে (১৮৮০-১৯৪৫) ও ইডার (১৮৮৪-১৯১০) জন্ম হয়। গ্রাৎস ছেড়ে যাওয়ার পর তাদের তৃতীয় মেয়ে এলসার (১৮৯১-১৯৬৬) জন্ম হয়। অবশ্য গ্রাৎসে থাকার সময়ই বোলৎসমানের মা মারা যান, ১৮৮৫ সালে। এই মৃত্যুটি ছাড়া গ্রাৎসে তার জীবন ছিল সুখের। এ সময় অস্ট্রিয়ার অনেক রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পান তিনি। এ সময়ই তিনি প্রকৃতি সম্পর্কে তার পরিসাংখ্যিক মনোভাবকে শাণিত করেন। অস্ট্রীয় সরকার তার প্রশাসনিক কাজগুলো করে দেয়ার জন্য গ্রাৎসে Extraordinarius (সহযোগী অধ্যাপক) নামে একটি পদ তৈরি করে তাতে আর্থুর ফন এটিংসহাউজেনকে (১৮৫০-১৯৩২) মনোনয়ন দেয়।
১৮৭৮ সালে বোলৎসমান অনুষদের প্রধান হন। ১৮৮১ সালে সরকারী কাউন্সিলর, ১৮৮৫ তে ইম্পেরিয়াল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস এর সদস্য এবং ১৮৮৯ সালে কোর্ট কাউন্সিলর হন। অন্যান্য দেশ থেকেও তাকে অনেক সম্মাননা দেয়া হয়। পদার্থবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পাশাপাশি গ্রাৎসে আরেকটি পদ ছিল, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের চেয়ার। প্রথমবার যখন গ্রাৎসে ছিলেন তখন এই পদ বোলৎসমানের ছিল। কিন্তু এবার এই পদে থাকেন আরেক অস্ট্রীয় বিজ্ঞানী হাইনরিখ স্ট্রাইনৎস। স্ট্রাইনৎসের ক্যারিয়ার খুব বেশি সফল নয়। কিন্তু বোলৎসমান সব সময় তাকে সহায়তা করেছেন। এ সময় বোলৎসমানকে রাজকীয় উপাধি দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করে রাজপরিবার। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি, উত্তরে বলেছিলেন, তার জন্য তার মধ্যবিত্ত পরিবারের উপাধিই ভাল, এবং তার সন্তান ও তাদের বংশধরদের জন্যও আশাকরি সে উপাধিই যথেষ্ট হবে।
এ সময়টা বোলৎসমানের জন্য খুব ব্যস্ততারও ছিল না। তাকে সাহায্য করার জন্য ছিল এটিংসহাউজেন। অনুষদের প্রধান হিসেবেও খুব বেশি কিছু করতে হতো না, ব্যস্ত থাকলে উপ-প্রধানকে দায়িত্ব দিতে পারতেন। তাই সে সময়কার বিখ্যাত সব পদার্থবিজ্ঞানীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন। এদের মধ্যে রয়েছেন হেনড্রিক আন্টুন লরেনৎস, হেল্মহোলৎস, ভিলহেল্ম অস্টভাল্ড, এবং কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ক্যাভেন্ডিশ অধ্যাপক পদে ম্যাক্সওয়েলের উত্তরসূরী জন উইলিয়াম স্ট্রাট। এ সত্ত্বেও তার সে সময়কার চিঠি পড়ে মনে হয়, তিনি ভাবতেন তিনি বিজ্ঞানীদের মূল গোষ্ঠীর বাইরে আছেন, ভেতরে থাকলে আরও আলোচনা করতে পারতেন। অবশ্য তিনি টোয়েপলারকে এও বলেছিলেন যে, বিয়ে মানুষকে অলস করে দেয়, যতটা ভেবেছিলেন তার চেয়েও বেশি। এ কারণেই বোধহয় ইনস্টিটিউটের প্রধান পদে তার উত্তরসূরী লেওপোল্ড ফাউন্ডলার বলেছিলেন, তিনি এসে দেখেন ইনস্টিটিউটের ভবনটি শূকরের খামাড় হয়ে আছে। বোঝাই যায়, গবেষণার চাপে হয়ত বোলৎসমান ইনস্টিটিউটের দিকে নজর দিতে পারেননি।
১৮৭৭ সালে বোলৎসমান দুটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যার একটির (১৮৭৭খ) আলোচ্য বিষয়ে ছিল এনট্রপি। এতে তিনি পরমাণুর বিশৃঙ্খলার গাণিতিক পরিমাপ হিসেবে এনট্রপি ব্যবহার করেছিলেন। বিকিরণ চাপ নিয়ে ইতালীয় পদার্থবিজ্ঞানী আদোলফো বারতোলির গবেষণা থেকে খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তিনি। এই অনুপ্রেরণায় ১৮৮৬ সালে তার শিক্ষক ইয়োসেফ স্টেফানের সূত্রের একটি অনন্যসাধারণ প্রমাণ আবিষ্কার করেন। একই বছর তার আরেকটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় যাতে তিনি এমন সব গ্যাসীয় অণু নিয়ে আলোচনা করেন যারা মিথস্ক্রিয়া করছে এবং যাদের বিভব শক্তি আছে। এই গবেষণাপত্র খুব একটা পরিচিত না হওয়ায় অনেক বিজ্ঞানী এখনও মনে করেন বোলৎসমান কেবলই আদর্শ গ্যাস নিয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু এটি দেখলে মনে হয় উইলার্ড গিবস নয় বরং বোলৎসমানকেই সাম্যাবস্থার পরিসাংখ্যিক বলবিদ্যার জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা উচিত।
১৮৮৬ সালে হাইনরিশ হেরৎস এর তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ এবং আলো বিষয়ক গবেষণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি নিজেই হেরৎসের পরীক্ষণটি পুনরায় করার চেষ্টা করেন। উল্লেখ্য ম্যক্সওয়েল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ এবং আলো একই, হেরৎস তা প্রমাণ করেন। এ বিষয়ে বোলৎসমানের গবেষণা গ্রাৎস ত্যাগের পূর্বে তার শেষ প্রকাশিত লেখাগুলোতে লিপিবদ্ধ আছে। গ্রাৎসে থাকার সময় তার চরিত্রের একটি লক্ষ্যণীয় দিক হচ্ছে, এ সময় তিনি বিজ্ঞান এবং সাধারণ অর্থে জ্ঞানের দার্শনিক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা থেকে বিরত থাকতেন। ১৮৮৭ সালের একটি গবেষণাপত্রে বোলৎসমান তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেন।
বেশ স্বল্প সময়ের মধ্যেই গ্যাসের গতীয় তত্ত্ব বিষয়ে বোলৎসমানের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে, পরিচিত হয়ে উঠে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত এইচ ডব্লিউ ওয়াটসনের বইয়ে যাতে তিনি গ্যাসের গতি তত্ত্ব ব্যাখ্যায় বোলৎসমানের পদ্ধতি ব্যবহার করেন। ১৮৮২ সালে লেখা ম্যাক্সওয়েলের একটি জীবনী গ্রন্থে তাকে গ্যাসের গতি তত্ত্বের জনকদের একজন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানীদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল ১৮৮৫-৮৭ সালের মধ্যে দুজন ব্রিটিশ বিজ্ঞানীর (পিটার টেইট এবং উইলিয়াম বার্নসাইড) সাথে তার বিতর্ক। বোলৎসমানের গবেষণাপত্রগুলো অনেক দীর্ঘ হওয়ায় সবাই সেগুলো পড়ার ধৈর্য রাখত না। তাই এই আলোচনাগুলো তাকে ইংরেজভাষী বিশ্বে পরিচিত হতে সাহায্য করেছিল। তাই বিশ্বের নানা দিক থেকে তার জন্য পুরস্কার ও সম্মাননা আসতে থাকে। গ্রাৎসের এই ১৪ বছরে তিনি পৃথিবীর সেরা পদার্থবিজ্ঞানীদের একজনে পরিণত হন।
বোলৎসমানের জীবনের কালপঞ্জি | |
---|---|
লুডভিগ এডুয়ার্ড বোলৎসমানের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি (১৮৪৪-১৯০৬) | |
১৮৪৪ | অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় জন্মগ্রহণ |
১৮৬২ | লিনৎসের জিমনেসিয়ামে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা |
১৮৬৩ | ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনায় ভর্তি |
১৮৬৬ | ইয়োসেফ স্টেফানের অধীনে পিএইচডি সমাপ্তি |
১৮৬৭ | স্টেফানের সহকারী হিসেবে ভিয়েনায় |
১৮৬৯ | গ্রাৎসের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান |
১৮৭৩ | ভিয়েনার গণিত বিভাগে অধ্যাপনা শুরু |
১৮৭৬ | হেনরিয়েটে আইগেন্টলারের সাথে বিয়ে (৩ মেয়ে, ২ ছেলে) |
১৮৭৮ | গ্রাৎসে অনুষদের প্রধান মনোনীত |
১৮৮৫ | অস্ট্রীয় বিজ্ঞান একাডেমির সদস্যপদ লাভ |
১৮৮৭ | গ্রাৎসে রেক্টর মনোনীত |
১৮৮৮ | অস্ট্রিয়ার সরকারী কাউন্সিলর মনোনীদ |
১৮৮৯ | অস্ট্রিয়ার রাজার কোর্টে কাউন্সিলর মনোনীত |
১৮৯০ | মিউনিখের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান |
১৮৯৩ | ভিয়েনার পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে |
১৮৯৪ | অক্সফোর্ড থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট লাভ |
১৮৯৫ | ইতালির আক্কাদেমিয়া দেই লিনচেই-এর বিদেশী সদস্য |
১৮৯৯ | প্রথম যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ। ম্যাসাচুসেটস থেকে ডক্টরেট |
১৯০০ | লাইপৎসিগের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান |
১৯০১ | ভূমধ্যসাগর পাড়ি |
১৯০২ | পুনরায় ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনা-তে |
১৯০৪ | যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুইসের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহন |
১৯০৬ | ইতালির ত্রিয়েস্তের নিকটে দুইনো-তে আত্মহত্যা |
বিশ্ববিখ্যাত হওয়ার পরই ১৮৮৮ সালের জানুয়ারি থেকে বোলৎসমানের শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। এত বিখ্যাত এবং ধিরস্থির একজন মানুষ কেন হঠাৎ এমন হয়ে গেলেন তার কোন সুস্পষ্ট কারণ জানা যায় না। তবে বেশ কিছু ঘটনাকে তার পূর্বসূত্র হিসেবে উল্লেখ করা যায়। খুব বেশি হতাশা এবং উদ্বিগ্নতায় ভোগা এবং খুব নরম মনের মানুষ হওয়ার কারণেই সম্ভবত তার উপর এই ঘটনাগুলো এতোটা প্রভাব ফেলেছিল। বোলৎসমানের জীবনীকার Carlo Cercignini পূর্বসূত্র হিসেবে যে ঘটনাগুলো উল্লেখ করেছেন সেগুলোই এখানে বর্ণীত হবে।
ঘটনার সূত্রপাত ১৮৮৫ তে। এই বছর তার মা মারা যান। ৪১ বছর বয়সে মাকে হারানো অস্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়। কিন্তু বোলৎসমান ১৫ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন এবং সে কারণে মার প্রতি তার আকর্ষণ একটু বেশিই ছিল। উল্লেখ্য এই বছর তিনি কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেননি, এবং কোন চিঠি লিখেছেন বলেও জানা যায়নি।
পরবর্তী ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত। বোলৎসমান ছিলেন গ্রাৎস বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের আবাসিক ভবনের দায়িত্ব ছিল তার উপর। এমন দায়িত্বের জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। এর মধ্যে আবার ১৮৮৭ সালের ২২শে নভেম্বর গ্রাৎসের জার্মানিবাদী ছাত্ররা আবাসিক ভবনের একটি থেকে অস্ট্রিয়ার রাজার মূর্তি সরিয়ে নেয় এবং হাব্সবুর্গ রাজপরিবারবিরোধী শ্লোগান দিতে থাকে। রেক্টর হিসেবে এই পরিস্থিতি সমাধানের দায়িত্ব ছিল বোলৎসমানের উপর এবং স্টিরিয়ার গভর্নর, ভিয়েনার প্রশাসন ও স্বয়ং রাজা তার উপর ভরসা করে ছিল। এই বিদ্রোহ ৪ মাস স্থায়ী হয়েছিল।
এদিকে ১৮৮৭ সালের ১৭ অক্টোবর জার্মানির বার্লিনে বোলৎসমানের বন্ধু গুস্তাফ কির্খফ মৃত্যুবরণ করেন। ইউনিভার্সিটি অফ বার্লিনের কর্তৃপক্ষ তাকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি এ বছরের শেষ দিকে বার্লিনে যান। সেখানে তাকে কির্খফের পদে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর মানে তিনি হতে পারবেন কির্খফের উত্তরসূরী এবং হেল্মহোলৎসের সহকর্মী। তিনি প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন এবং এমনকি বিভাগে তার কক্ষও ঠিক করে ফেলেন। ১৮৮৮ সালের মার্চে তিনি আবার পদটি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান, যদিও ততোদিনে জার্মানির রাজা কাইজার চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ফেলেছিলেন। এর কারণ হিসেবে অনেকে উল্লেখ করেন, জার্মানিতে চাপ গ্রাৎসের চেয়ে অনেক বেশি ছিল কিন্তু বোলৎসমান চাপ পছন্দ করতেন না। তবে কারণ আরও রয়েছে।[8] বোলৎসমানের সম্ভাব্য অস্ট্রিয়া ত্যাগের খবর জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে গ্রাৎসে পৌঁছে যায়। এই সুযোগে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রধান হাইনরিশ স্ট্রাইনৎস তার অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবী জানান। ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে তার সহযোগী এটিংসহাউজেন টেখনিশে হোখশুলে (গ্রাৎসের তৎকালীন পলিটেকনিক) তে একটি পদে যোগ দেন। এতে নিজের বিভাগেই বোলৎসমান সমর্থন ও সহযোগিতা হারান। গ্রাৎসে ফিরে বোলৎসমান বুঝতে পারেন তিনি দুঃসাহসিকতা দেখিয়ে ফেলেছেন, অস্ট্রীয় সরকারের অনুমতি না চেয়ে বার্লিনকে সম্মতি দিয়ে দেয়াটা ঠিক হয়নি। অস্ট্রীয় সরকারও চাচ্ছিল না তাদের সবচেয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের একজনকে এভাবে হারাতে। তারাও বোলৎসমানকে বোঝাতে শুরু করে।
এই চাপেই তিনি মানসিক ভারসাম্য কিছুটা হারাতে শুরু করেন। তিনি মার্চে বার্লিনকে চিঠি লিখে জানান, চোখের সমস্যার কারণে বার্লিনের পদটিতে ঠিকমত কাজ করা তার পক্ষে কষ্টকর হবে। কিন্তু সেখান থেকে জবাব আসে, এ নিয়ে তার চিন্তা করার কোন প্রয়োজন নেই। অগত্য তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে ব্যাখ্যা করেন কেন তিনি এই পদটির জন্য যোগ্য নন:[9]
“ | বার্লিনের পদটি গ্রহণ করলে আমাকে সম্পূর্ণ নতুন একটি ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে হবে, তা হচ্ছে গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান। গত ১৫ বছরে আমি কেবল গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান, ব্যবকলনীয় এবং সমাকলনীয় ক্যালকুলাসের মৌলিক ধারণাগুলো পড়িয়েছি।... কিন্তু গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশদ অধ্যায়ই আমার অধরা রয়ে গেছে। বার্লিনে থাকার সময় আমার মনে হয়েছে, এখানে পড়ালে আমি নিজের এই সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করার সুযোগ পাব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সম্পূর্ণ নতুন এই অধ্যায়টি শুরু করলে তা আমার চোখের জন্য ভাল হবে না। অপরদিকে, বিষয়টি নিয়ে সম্পূর্ণ ধারণা এবং অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও এত দায়িত্বশীল একটি পদে যোগ দেয়াটা আমার বিবেকে বাধবে। | ” |
কিন্তু অন্য সূত্র থেকে জানা যায় বোলৎসমান তার গবেষণা ক্ষেত্র নিয়ে সব সময়ই খুব ওয়াকিবহাল থাকতেন। তার এই লেখা থেকে বোঝা যায়, তিনি কারও প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলে প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তেন, সব সময় নিখুঁত হতে চাইতেন। যাহোক, অবশেষে ১৮৮৮ সালের ৯ই জুলাই কাইজার ভিলহেল্ম ২ তাকে মনোনয়ন দিয়ে করা চুক্তিটি বাতিল করে দেন।
এসব ঘটনার পরই বোলৎসমানের মধ্যে নিউরাস্থিনিয়া (মনঃগ্লানি) এবং চরম হতাশার লক্ষণ (বাইপোলার ডিসঅর্ডার) দেখা দিতে শুরু করে। তার জীবনের শান্তি এবং সুন্দরের দিন শেষ হয়ে আসে, হতাশা, অসন্তোষ এবং অস্থিরতা তাকে অধিকার করে নেয়। তিনি ঘনঘন স্থান পরিবর্তন করতে থাকেন এই আশায় যে, হয়ত নতুন স্থানে শান্তি মিলবে। যেহেতু তিনি বার্লিন নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়েছিলেন, সেহেতু গ্রাৎসে থাকতে তার অসুবিধা থাকার কথা না। কিন্তু বাইপোলার ডিসঅর্ডার থাকার কারণে এটাই তার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। বার্লিনকে কেন না বলেছিলেন তা তিনি নিজেই জানতেন না। আর গ্রাৎসে ফিরে আসার পর মনে হচ্ছিল, তিনি কি আর সেই মহান বিজ্ঞানী নেই। নিজের বিখ্যাত এবং মহান সত্তাটির সাথে গ্রাৎসের তাকে তুলনা করতে শুরু করেছিলেন।
এই অস্থিরতা এবং হতাশার মধ্যেই ১৮৮৯ সালে তার ছেলে, লুডভিগ, মাত্র ১১ বছর বয়সে অ্যাপেন্ডিসাইটিসের রোগে মারা যায়। আরও ভয়াবহ হচ্ছে, তিনি এই মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করতেন। তিনি মনে করতেন, রোগের ভয়াবহতা বুঝতে না পারা এবং ভুল ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কারণেই তার ছেলে মারা গেছে। এই মৃত্যু তার হতাশা ও মানসিক রোগে নতুন মাত্রা যোগ করে। তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন এবং একা থাকতে শুরু করেন।
তার প্রথম চিন্তা ছিল গ্রাৎস ত্যাগ করা। গ্রাৎসে তার প্রতি তার সহকর্মীদের আচরণ পাল্টে গিয়েছিল, তিনি নিজেও মনে করতেন তার আরও ভাল কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার যোগ্যতা রয়েছে এবং তার ছেলে মারা গেছে এই শহরে। সব মিলিয়ে গ্রাৎস তার কাছে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। ১৮৮৮ সালের জুলাইয়ে যেখানে কাইজার তার চুক্তিপত্র বাতিল করলেন সেখানে সে বছরেরই শেষ দিকে তিনি হেল্মহোলৎসকে চিঠি লিখে জানালেন, তিনি সুস্থ হয়ে গেছেন এবং বার্লিনে যেতে চান। এমনকি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার যত বন্ধু ছিল তাদের সবাইকে জানাতে থাকলেন যে তিনি গ্রাৎস ত্যাগ করতে চান। তার এই বন্ধুদের মধ্যে যে প্রথম তাকে আনার সুযোগটি কাজে লাগালেন তিনি হচ্ছেন জার্মানির মিউনিখের অয়গেন ফন লোমেল। তিনি নোবেল বিজয়ী রসায়নবিদ আডোলফ ফন বাইয়ার এর সহায়তায় ইউনিভার্সিটি অফ মিউনিখের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে বোলৎসমানের জন্য একটি পদের ব্যবস্থা করেন। মিউনিখে তখন এমন কোন পদ ছিল না, কেবল তার জন্যই এই পদটি তৈরি করা হয়। মিউনিখ কর্তৃপক্ষ যুক্তি হিসেবে দেখায়, তাত্ত্বিক ও পরীক্ষণমূলক পদার্থবিজ্ঞান দিনদিন আলাদা হয়ে যাচ্ছে এবং একজনের পক্ষে দুই বিষয়ে পারদর্শীতা অর্জন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে, বোলৎসমান যেহেতু গণিতে খুবই দক্ষ সেহেতু তিনি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারবেন যা ম্যক্সওয়েল, ক্লাউসিয়ুস এবং হেল্মহোলৎসের গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
গ্রাৎস ত্যাগের সময় বোলৎসমানের সম্মানে একটি বিদায়ী অনুষ্ঠান হয়। নতুন রেক্টর এবং এইচ স্ট্রাইনৎস তাদের বক্তৃতায় আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, বোলৎসমান আবার অস্ট্রিয়ায় ফিরে আসবেন। উত্তরে বোলৎসমান বলেন,[10]
“ | এই সম্মান ব্যক্তি আমার প্রতি নয় বরং আমার চিন্তাধারার প্রতি হিসেবে গ্রহণ করছি, যে চিন্তাধারা আমার মন এবং কর্মের জগৎজুড়ে বিরাজ করে। এই সম্মান আবিষ্কৃত সেই সব তত্ত্বের প্রতি, কোন মহান বিসর্জন দিয়েই যাদেরকে যথেষ্ট মহিমান্বিত করা সম্ভব নয়। তত্ত্বই যেহেতু আমার জীবনের সবকিছু সেহেতু এই তত্ত্বই হোক আপনাদের উদ্দেশ্য বলা আমার ধন্যবাদ। | ” |
মিউনিখে বোলৎসমান প্রতি সপ্তাহে হোফব্রেউহাউসে বিয়ার নিয়ে সহকর্মীদের সাথে বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনার জন্য। এখানে আসতেন গণিতবিদ ভালটার ফন ডুক, আলফ্রেড প্রিংশাইম, পদার্থবিজ্ঞানী লোমেল ও লেওনহার্ড সোনকে, রসায়নবিদ বাইয়ার, জ্যোতির্বিজ্ঞানী হুগো ফন সেলিগার এবং প্রকৌশলী কার্ল ফন লিন্ডে। এ সময় তিনি পরিবার নিয়ে থাকতেন মাক্সিমিলিয়ান স্ট্রাসেতে, বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার প্রিয় অপেরা দুটোই ছিল বাসা থেকে কাছে। প্রায় রিচার্ড ভাগনারের সুর শুনতে যেতেন।
দিনদিন তার চোখের অবস্থা আরও খারাপ হতে শুরু করে, অনেক সময় বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র বা বই তার স্ত্রী পড়ে শোনাতেন যাতে তার চোখ অধিক পরীশ্রম থেকে রেহাই পায়। তবে বাভারিয়ার সরকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কোন পেনশন দেয় না বলে তখন থেকেই বোলৎসমান তার পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। চোখের অবস্থা ভাল নয় দেখেই ১৮৯৬ সালের মধ্যে তার বিখ্যাত বই Lectures on Gas Theory লিখে ফেলেন। ১৮৯২ সালে লোশমিটকে লেখা এক চিঠি থেকে জানা যায় ততোদিনে তার আবার দেশের বাড়ির জন্য খারাপ লাগতে শুরু করে। তিনি লিখেন যে ভাল আছেন কিন্তু অস্ট্রিয়ার চেয়ে ভাল নয়। এই বছর তার পুরনো শিক্ষক ইয়োসেফ স্টেফান মারা যান। ভিয়েনা কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করুন স্টেফানের পদে বোলৎসমানকে নিয়ে আসতে। কিন্তু এদিকে মিউনিখ তার বেতন বাড়িয়ে দেয় এবং তার জন্য একজন ব্যক্তিগত সচিবের ব্যবস্থা করে দিয়ে তাকে থাকতে অনুরোধ করে। তিনি ভিয়েনাকে বলেন, আপাতত অন্তত ১ বছর তিনি মিউনিখে থাকতে চান।
এ সময় বোলৎসমানের জীবনের একজন উল্লেখযোগ্য সাক্ষী হচ্ছেন জাপানে পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা উন্নয়নের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হানতারো নাগাওকা। তার একটি চিঠি থেকে জানা যায়, বোলৎসমান মিউনিখে পড়াচ্ছেন জেনেই তিনি মিউনিখে এসেছেন। এতেই বোঝা যায় বোলৎসমান কতোটা বিখ্যাত ছিলেন।
১৮৯৪ সালে মিউনিখে থাকা অবস্থায় বোলৎসমান ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ডের পিএইচডি অনারিস কজা হন। অক্সফোর্ডে তিনি প্রভূত সম্মান পেয়েছিলেন। এ বছরের বসন্তে ভিয়েনা এবং মিউনিখের মধ্যে তার পছন্দ ঘন ঘন পরিবর্তিত হতে থাকে। অবশেষে জুনে মিউনিখ ছেড়ে ভিয়েনা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন তিনি অস্ট্রিয়ার সেরা বিজ্ঞানী। ভিয়েনায় তাকে গ্রহণের জন্য বিশাল আয়োজন করা হয়েছিল। দর্শন অনুষদ রাসায়নিক পদার্থবিজ্ঞানের একটি পদ বাতিল করে তাকে অর্থ যোগান দেয়। শর্ত থাকে, তিনি হঠাৎ দায়িত্ব পালনের অযোগ্য বিবেচিত হলে তাকে পূর্ণ অবসরকালীন ভাতা দিতে হবে।
বোলৎসমানকে ভিয়েনায় আনার জন্য অস্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ যে মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছিল তার মোহ অচিরেই কেটে যায়। বোলৎসমান বুঝতে পারেন, ১৮ বছর ভিয়েনার বাইরে থাকার কারণে এখন এখানে তার কোন বন্ধুমহল নেই। তার উপর আছে আর্নস্ট মাখের তীব্র বিরোধিতা। মাখের দর্শন ছিল বোলৎসমানীয় দর্শনের একেবারে বিপরীত এবং আরও সমস্যা ছিল, একটি সঠিক হলে অন্যটি সঠিক হতে পারে না। মাখ মনে করতেন, পরমাণু দেখা যায় না বলে তা নিয়ে কথা বলার কোন প্রয়োজন নেই, তবে গণিত মেলানোর খাতিরে কিছুটা আলোচনা করা যেতে পারে। এর বদলে তিনি শক্তির আদান-প্রদাণের মাধ্যমে সব ব্যাখ্যা করতে চাইতেন। তার এই দর্শনের নাম হয়েছিল শক্তিবাদ বা এনার্জেটিক্স। তবে বর্তমানে একে বিজ্ঞান না বলে ছদ্ম-বিজ্ঞান বলা হয়। বোলৎসমান মাখের বিরোধিতার সাথে মানসিকভাবে পেরে উঠতেন না, কারণ মানসিকভাবে তিনি মাখের চেয়ে দুর্বল ছিলেন।
১৮৯৫ সাল থেকে মাখ ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনার দর্শন ও বিজ্ঞানের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছিলেন। তার সাথে বোলৎসমানের সরাসরি কোন বিতর্ক না হলেও মাখ বোলৎসমানকে মূল্য দিতেন না, নিজেকে বোলৎসমানের তুলনায় বুদ্ধিমান মনে করতেন। এমনকি বোলৎসমানের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও তিনি নেতিবাচক মন্তব্য করতেন। একবার দার্শনিক হাইনরিশ গোমপেরৎস-কে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেন, "বোলৎসমান ক্ষতিকর নয়, তবে প্রচণ্ড কাঁচা এবং খাপছাড়া। কোথায় সীমারেখা টানতে হবে এ নিয়ে তার কোন ধারণাই নেই। তার ব্যক্তিগত জীবনের অনেক বিষয় সম্পর্কেও এই কথা খাটে, এগুলো তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।" শক্তিবাদ নিয়ে মাখ, অস্টভাল্ড এবং হেল্ম-এর সাথে বোলৎসমানের বিতর্ক আলাদা অনুচ্ছেদে আলোচিত হবে।
এসব বৈজ্ঞানিক বিতর্কের কারণে বোলৎসমান ভাবতে শুরু করেন, জার্মানিতে তার কাজ খুব কম মূল্য পাচ্ছে। তিনি একা হয়ে যান। এইচ-তত্ত্বের বিরোধিতা করে সেরমেলোর মন্তব্যের জবাবে তিনি লিখেছিলেন, "সেরমেলোর গবেষণাপত্র প্রমাণ করে যে আমার লেখা সবাই ভুল বুঝছে। অবশ্য এই ভেবে আমি সন্তুষ্ট যে, এটা প্রমাণ করে জার্মানিতে আমার লেখা অন্তত কেউ পড়তে শুরু করেছে।" এর মাঝে ভিয়েনা নিয়ে তার অসন্তুষ্টি বেড়েই চলে। তিনি গবেষণাগারের কোর্স থেকে অব্যাহতি চান। কিছুদিন পর অস্টভাল্ডকে লিখেন, জার্মানির চেয়ে এখানে অনেক কম ছাত্র গবেষণা করতে চায়, এখানে বৈজ্ঞানিক আলোচনাও খুব কম হয়। বছর বছর খানেক পর তার স্ত্রী বলেছিলেন, ভিয়েনার তার কাজ ছিল স্কুল-মাস্টারের মত। এটি অবশ্যই বোলৎসমানের মেধার প্রতি সুবিচার ছিল না। তিনি অস্ট্রিয়ার রাজনীতি নিয়েও অসন্তুষ্ট ছিলেন।
১৯০০ সালে বোলৎসমান ইউনিভার্সিটি অফ লাইপৎসিগে অধ্যাপনার একটি পদ গ্রহণ করেন। এখানে ভৌত রসায়নবিদ ভিলহেল্ম অস্টভাল্ড ইতিমধ্যে গবেষণার একটি চমৎকার পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়ার সময় তাকে জার্মানি এবং বহির্বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। নিয়োগপ্রাপ্তির সম্ভাবনা যখন দেখা দিচ্ছিল তখন বোলৎসমান খুশিই হয়েছিলেন। কিন্তু প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে গিয়ে তার প্রচণ্ড মানসিক ধকল যায়। তিনি মানসিক ভারসাম্য হারাতে বসেন, এমনকি কিছুদিন একটি মানসিক হাসপাতালে অবস্থান করেন।
যথারীতি লাইপৎসিগেও বোলৎসমানের শান্তি আসেনি। অস্টভাল্ড ব্যক্তিগত জীবনে তার বন্ধু হলেও মাঝে মাঝে তাদের বিতর্ক এত চরমে উঠে যেতো কেউই ভারসাম্য রাখতে পারতেন না। এসব কারণে বোলৎসমানের অবস্থা ভিয়েনার চেয়েও খারাপ হয়ে পড়ে। একসাথে কাজ করতে তিনি পছন্দ করতেন, কিন্তু অস্টভাল্ডের সাথে প্রতিনিয়ত বিতর্ক করতে গিয়ে তিনি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। এখানেই একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। অবশেষে স্বাস্থ্যহানির কারণ দেখিয়ে প্রাদেশিক সরকারের কাছে অনুরোধ করেন তাকে অব্যাহতি দিতে। এরপর তিনি আবার ভিয়েনা ফিরে যেতে চান। উল্লেখ্য তিনি যাওয়ার পরও ভিয়েনায় তার পদটি শূন্যই ছিল। তাই ১৯০২ সালে আবার ভিয়েনা ফিরে যেতে সক্ষম হন। এর মধ্যে ১৯০১ সালে স্ট্রোক করার কারণে মাখ অবসরে চলে গিয়েছিলেন।
ভিয়েনায় ফিরে আসলেও, লাইপৎসিগ গমনের কারণে অস্ট্রীয় সরকার বোলৎসমানকে পুরোপুরি ক্ষমা করেনি। উপরন্তু তার মানসিক ও শারীরিক অবস্থা নিয়ে বিভিন্ন গুঞ্জন ছড়াচ্ছিল। অনেকে বলছিল, সে মানসিকভাবে অসুস্থ এবং দায়িত্ব পালনের অযোগ্য। গবেষণা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে তাই রাজা এবং ভিয়েনা কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। মন্ত্রী বোলৎসমানের ডাক্তারদের সাথে কথা বলেন এবং তাকে এই মর্মে একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল তিনি পুনরায় অস্ট্রিয়া ত্যাগের চেষ্টা করবেন না। স্বভাবতই তিনি হয়ে পড়েছিলেন অস্ট্রিয়ার বৈজ্ঞানিক স্বাধীনতার প্রতীক।
তবে এখানেও সুখে থাকতে পারেননি। তার ইনস্টিটিউটের জন্য অর্থ সংস্থান কমে যায়। এমনকি তাকে পুনরায় অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞান একাডেমির সদস্য হতে ঝামেলা পোহাতে হয়। কারণ মিউনিখ যাওয়ার কারণে তাকে এই সদস্যপদ ত্যাগ করতে হয়েছিল। ১৯০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার স্ত্রী লাইপৎসিগে রয়ে যাওয়া কন্যা ইডাকে লিখেন, "তোমার বাবার অবস্থা দিনদিন আরও খারাপ হচ্ছে। সে আমাদের ভবিষ্যতের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। আমি ভেবেছিলাম ভিয়েনায় জীবন ভাল হবে।" চোখের অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে বেশ কিছুকাল ধরে তার স্ত্রী বিভিন্ন গবেষণাপত্র পড়ে শোনাতেন। কিন্তু এ সময় অবস্থা এতোই খারাপ হয়ে যায় যে তাকে টাকা দিয়ে গবেষণাপত্র পড়ে শোনানোর জন্য একজন সেক্রেটারি রাখতে হয়, আর তার গবেষণাপত্রগুলো লিখে দেন স্বয়ং তার স্ত্রী। পাশাপাশি মাঝেমাঝেই তার হাঁপানির সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে, বেশি কাজ করতে গিয়ে প্রচণ্ড মাথা ব্যথায় ভুগেন। এ সময় শিক্ষকতার কাজ ছিল এমন: তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের একটি কোর্সের জন্য সপ্তাহে ৫ ঘণ্টা, একই বিষয়ে একটি সেমিনার, এবং প্রতি ২ সেমিস্টার পরপর সপ্তাহে ১ ঘণ্টার আরেকটি কোর্স। উপরন্তু, ১৯০৩ থেকে তিনি সপ্তাহে দুই ঘণ্টার দর্শনের কোর্সটিও পড়ানো শুরু করেন, যেটি আগে মাখ পড়াতেন। এত চাপ তার সইছিল না।
এ সময় বোলৎসমানের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেকচার ছিল দর্শনের উপর লেকচারগুলো। তিনি ভেবেছিলেন, দর্শনই তার আসল জায়গা। প্রথম লেকচারে তার অভাবনীয় সাফল্য আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় মিলনায়তন নির্বাচন করার পরও তার লেকচারে অনেককে আসন না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তার লেকচার উপলক্ষে কক্ষটি সাজানো হয় এবং লেকচারের পর শিক্ষার্থীরা প্রচুর সম্ভাষণ জানাতে থাকে। সকল সংবাদপত্রই খবরটি ছাপে। অস্ট্রিয়ার ফিরে আসার কারণে খুব খুশি হয়ে সম্রাট ফ্রানৎস-ইয়োসেফ বলেন, খবরের কাগজে তার লেকচার সম্পর্কে জেনেছেন। অবশ্য দু-তিনটি লেকচারের পর তার উৎসাহে ভাটা পড়ে, সেই সাথে শিক্ষার্থীদেরও। এতে তার মধ্যে ব্যর্থতার অনুভূতি আসে। এ সময় ফ্রানৎস ব্রেন্টানো-কে লেখা কিছু চিঠি থেকে জানা যায় লেকচারগুলো তার কাছে কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। উল্লেখ্য, ব্রেন্টানো ভিয়েনায় দর্শন পড়াতেন, কিন্তু ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারক হয়ে বিয়ে করার কারণে তাকে অস্ট্রিয়া ত্যাগে বাধ্য করা হয়। বোলৎসমান যখন চিঠিগুলো লিখেছেন তখন তিনি ইতালিতে ছিলেন। বোলৎসমান একবার এমন ভাব নিয়ে ফ্লোরেন্সে তার সাথে দেখা করার জন্য গিয়েছিলেন যে মনে হচ্ছিল তিনি তার মনঃরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাচ্ছেন।
তখনও তিনি সন্ধ্যায় বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা দিতেন। তথাপি ভোর ৫ টায়ও তাকে কাজ করতে দেখা যেতো। এটিও চরম হতাশার রোগে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ। এই রোগে আক্রান্তরা অনেক যখন ম্যানিক তথা পাগলামির দশায় থাকে তখন ভোরে ঘুম থেকে উঠে অনেক কাজ করে, আর হতাশার দশা আসার সাথে সাথে তার মাঝে অবসাদ এবং ঘুম ঘুম ভাব নেমে আসে। এমনটি হলে সে কাজের উৎসাহ হারিয়ে ফেলে, সকাল সকাল তার ঘুমকাতর চোখ দেখা যায় এবং সে আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
বোলৎসমান তিন বার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে গিয়েছিলেন। ১৮৯৯ সালে প্রথম বারের মত যান, স্ত্রীকে সাথে নিয়ে। ব্রেমেন থেকে কাইজার ভিলহেল্ম ডের গ্রোসে জাহাজে চড়ে সাউদাম্পটন এবং Cherbourg হয়ে নিউ ইয়র্ক পৌঁছান। প্রথমে ম্যাসাচুসেটসের ক্লার্ক ইউনিভার্সিটি ইন ওরচেস্টারে বলবিদ্যার মৌলিক নীতি ও সূত্র নিয়ে চারটি লেকচার দেন। ক্লার্ক ইউনিভার্সিটি তখন ১০ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করছিল। এখানে তিনি সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রিও গ্রহণ করেন। এই ভ্রমণের সময় বোলৎসমান তার বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে ৬টি চিঠি লিখেছিলেন। লিখেছিলেন, নিউ ইয়র্ক সিটি দেখে তিনি এবং হেনরিয়েটে দুজনেই মুগ্ধ, এখানে আছে ঘন ঘন ইলেকট্রিক ট্রাম, উপরে বাষ্প ইঞ্জিনের ট্রেন আর নিচে সুন্দর রাস্তা। বস্টন-কে তাদের বেশ ধূলিমাখা মনে হয়েছিল। এছাড়া তারা মন্ট্রিল, বাফেলো, ওয়াশিংটন ডিসি, বাল্টিমোর এবং ফিলাডেলফিয়া গিয়েছিলেন।
শারীরিক ও মানসিক অবস্থা খারাপ থাকা সত্ত্বেও বোলৎসমান ১৯০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুইসে একটি সম্মেলনে যোগ দিতে যান। এবার সাথে নেন ছেলে আর্থুর লুডভিগকে। উল্লেখ্য ১৯০১ সালে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য তিনি এই ছেলেকে নিয়েই ভূমধ্যসাগরে জাহাজ ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। এবার নিউ ইয়র্ক যান হামবুর্গ থেকে বেলগ্রাফিয়া নামক একটি জাহাজে করে। ১০ দিনের এই ভ্রমণ তার জন্য খুব কষ্টের ছিল, মূলত হর্নের আওয়াজে ঘুমাতে না পারার কারণে। এ সময় তারা ডেট্রয়েট ও শিকাগো যান, ফিরে আসেন ডয়েচলান্ড জাহাজে করে। ১৯০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র যান শেষবারের মত, একা। এবার ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলি-র একটি গ্রীষ্মকালীন স্কুলে ৩০টি লেকচার দেন। অস্টভাল্ড এবং তিনি দুজনেই এই স্কুলের দাওয়াত পেয়েছিলেন। বোলৎসমানের Reise eines deutschen Professors ins Eldorado (এলদোরাদো-তে এক জার্মান অধ্যাপক) নামক রচনায় এই ভ্রমণের একটি চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়। শেষবার আমেরিকায় থাকাকালে তিনি আবারও হাঁপানিতে আক্রান্ত হতে শুরু করেন। ক্যালিফোর্নিয়ার আবহাওয়া তার সহ্য হয়নি।
বোলৎসমানের আগমন সম্পর্কে মার্কিন সংবাদপত্র The Daily California এ ধরনের খবর ছাপে: "প্রেসিডেন্ট হুইলার গ্রীষ্মকালীন স্কুলে নামীদামী অধ্যাপকদের আনার ব্যাপারে যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা সাদরে গৃহীত হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনার তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক লুডভিগ বোলৎসমান তার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। তার গবেষণার ক্ষেত্রে বোলৎসমান পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীদের অন্যতম। ভৌত রসায়নের জন্য অধ্যাপক আরহেনিয়ুস যা করেছেন তিনি গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের জন্য তাই করেছেন।"
বোলৎসমান তার ইংরেজি নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু তার ইংরেজি লেকচার যারা শুনেছেন তাদের মন্তব্য সে কথা বলে না। অনেকেই তার ইংরেজির সমালোচনা করেছেন। একজন লিখেছেন, "তিনি জার্মান ভাষায় কথা বললে অধিকাংশ শ্রোতাই তাকে বুঝতে পারত। কিন্তু সপ্তাহে ৪ দিন করে তথাকথিত ইংরেজিতে বলেছেন এবং বলার বিষয়টি ছিল Mechanical Analogies of Thermodynamics with Special Reference to the Theorems of Statistical Mechanics"। বার্কলির সবাই এখনও তার ব্যাপারে খানিকটা ক্ষুব্ধ, এর একটি কারণ ছিল তার খাপছাড়া আচরণ এবং একজন জার্মান অধ্যাপক হয়ে দর্শকদের অতিরিক্ত মুগ্ধ করার জন্য বলা ইংরেজি।[8]
লুডভিগ বোলৎসমান ১৯০৬ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর ইতালির ত্রিয়েস্তের নিকটে দুইনো নামক একটি ছোট গ্রামে আত্মহত্যা করেন। এই গ্রামটি আড্রিয়াটিক সাগরের তীরে অবস্থিত। এখানে এসেছিলেন মূলত স্বাস্থ উদ্ধারের জন্য বেড়াতে, সপরিবারে। ৬ তারিখেই তাদের ভিয়েনা ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। সম্ভবত, দুইনোতেও এতদিন থেকেও স্বাস্থ্যের বিশেষ কোন উন্নতি না হওয়ার কারণে তিনি আবার সেই চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছিলেন, নিজের বৈজ্ঞানিক কর্মদক্ষতা নিয়ে শংকিত হয়ে পড়েছিলেন এবং সেই তাড়না থেকেই নিজেকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু যে ঘটনার সাথে এই আত্মহনন একেবারেই মেলানো যায় না তা হচ্ছে, মাত্র এক মাস আগেই তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ভ্রমণ নিয়ে রসাত্মক একটি লেখা লিখেছিলেন।
তবে সম্ভবত তিনি শেষ যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে আরও হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। বার্কলির গ্রীষ্মকালীন স্কুল বা ভিয়েনার দর্শনের ক্লাস, কোথাওই লেকচারগুলো তার মনমত হয়নি। ছাত্রদের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, তিনি শিক্ষক হিসেবে খুবই উঁচু মানের ছিলেন এবং শিক্ষার্থীরা মনে করত লেকচার দিতে তার খুব ভাল লাগে। কিন্তু তার সেক্রেটারি স্টেফান মায়ারের ভাষ্য থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, বোলৎসমান লেকচার দেয়াকে খুবই কষ্টকর মনে করতেন এবং হঠাৎ কোন লেকচার বাতিল হলে খুশিই হতেন। কিন্তু প্রতিটি লেকচারেই নিজের সর্বোচ্চটা দেয়ার চেষ্টা করতেন, এবং বক্তৃতাটি সফল না হলে ভেঙে পড়তেন। ভিয়েনায় দর্শনের লেকচারগুলোর ক্ষেত্রে বোধহয় তার এমনটিই হয়েছিল। ক্যালিফোর্নিয়া ভ্রমণের কাহিনী রচনাটি ছিল তার জীবনের শেষ আনন্দের ছটা। কিন্তু বাইপোলার ডিসঅর্ডারের রোগীদের ক্ষেত্রে প্রায়ই আনন্দের পর হঠাৎ তীব্র হতাশা নেমে আসে। এক মাসের মধ্যেই তিনি এমন হতাশা এবং কষ্টে ভুগতে শুরু করেছিলেন যে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন।
তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, সে সময় ভিয়েনার বুদ্ধিজীবীদের আত্মহত্যার ঘটনা খুব বেশি বিরল ছিল না। একটি অস্থির সময়ে নড়বড়ে রাজতন্ত্রের শাসনের ভেতরে থেকে ভিয়েনায় গড়ে উঠেছিল একটি শক্তিশালী স্বাধীন বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী। বোলৎসমানের মৃত্যুর বেশ কিছুকাল পরে এখানেই জন্মেছিল ভিয়েনা সার্কেল। কিন্তু আত্মহত্যা করেছিলেন অনেকেই। যেমন: অস্ট্রিয়ার রাজপুত্র রুডলফ যিনি সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেছিলেন, লুডভিগ ভিটগেনস্টাইনের তিন ভাই, অটো ভাইনিংগার যিনি আত্মহত্যার কিছুদিন পূর্বেই সেক্স অ্যান্ড ক্যারেক্টার নামের একটি অসামান্য বই লিখেছিলেন, গীতিকবি গেয়র্গ ট্রাকল, গুস্তাফ মালারের ছোট ভাই অটো মালার, আলফ্রেড রেডল এবং স্থপতি এডুয়ার্ড ফান ডার নুল যে নিজ হাতে নির্মিত রাজকীয় অপেরা হাউজের সমালোচনা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন।
তবে বোলৎসমানের আত্মহত্যার পূর্বে কিছু সুনির্দিষ্ট ঘটনা উল্লেখ করা যায় যেগুলো হয়থ তার হতাশায় ইন্ধন যুগিয়েছিল।[11] ১৯০৬ সালের মে মাসে ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনার দর্শন অনুষদের প্রধান মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি লিখে জানান যে, বোলৎসমান নিউরাস্থিনিয়ায় ভুগছে এবং তার বৈজ্ঞানিক কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিত নয়।[9] তার চোখের অবস্থা ভাল যাচ্ছিল না।[12] একজন বেনামী সাংবাদিকের কথা থেকে জানা যায়, ১৯০৫ সালের শেষ দিকে বোলৎসমানে মিউনিখে একটি মানসিক হাসপাতালে গিয়েছিলেন, কিন্তু অচিরেই মিউনিখ ছেড়ে ভিয়েনা চলে যান।[13] তার ছাত্র লুডভিগ ফ্লাম (যিনি তার মেয়ে ইডাকে বিয়ে করেছিলেন) বলেন, "ছাত্র হিসেবে আমার বোলৎসমানের দেয়া শেষ লেকচারটি শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল, ১৯০৫-০৬ মৌসুমের শীতকালীন সেমিস্টারে। মানসিক সমস্যার কারণে তিনি লেকচার বন্ধ করে দেন। আমি এবং আরেকজন ছাত্র তার ভেরিং-এর বাসায় মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছিলাম। পরীক্ষা শেষে আমরা যখন ফিরে আসছি তখন তার কাতর গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।"[14]
এ বছরেরই গ্রীষ্মকালীন সেমিস্টারে স্বয়ং মাখের মুখে শোনা যায়,[15]
“ | বোলৎসমান ১৯০৬ এর গ্রীষ্মকালীন সেমিস্টারের জন্য তার লেকচার ঘোষণা করেছিল। কিন্তু মানসিক ভারসাম্যহীনতার জন্য তাকে সেগুলো বাতিল করতে হয়েছে। পরিচিত মণ্ডলে সবাই জানত, তার পক্ষে আর কোনদিন অধ্যাপনা করা সম্ভব হবে না। যেহেতু সে এর আগে একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল সেহেতু সবাই বুঝত যে, তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসায় রাখা কতটা জরুরী। | ” |
তিনি সপরিবারে দুইনো গিয়েছিলেন তার স্ত্রীর একটি বহু পুরনো ইচ্ছা পূরণের উদ্দেশ্যে।[16] তবে এ সময়ও তার অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। ডি ৎসাইট পত্রিকার ৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯০৬ এর একটি নিবন্ধে এমনটি বলা হয়েছিল, "দুইনোতে বোলৎসমান খুব চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন ছিলেন, বিশেষত ভিয়েনায় ফিরে আসার জন্য। তবে এছাড়া তার অবস্থা ছিল আগের তুলনায় ভাল। মৃত্যুর দিন তাকে খুব উৎফুল্ল দেখা গিয়েছিল। তার স্ত্রী এবং মেয়ে সাঁতার কাটতে গেলে তিনি আত্মহত্যার কাজটি করেন।"[17]
ডি ৎসাইটেরই আরেকটি লেখা থেকে জানা যায়, তিনি কীভাবে আত্মহত্যা করেছিলেন: কেসমেন্ট জানালার আড়াআড়ি দণ্ডের সাথে একটি ছোট রশি ঝুলিয়ে। তার মেয়েই তাকে প্রথম মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করেছিল।[17] তবে কোথায় আত্মহত্যা করেছেন তা নিয়ে দুই ধরনের কথা আছে। অধিকাংশের বর্ণামতে তার হোটেল রুমে, তবে আউগুস্তে ডিকের ভাষ্যমতে, বোলৎসমানের সহকর্মী, গণিতবিদ মের্টেন বলেছেন, বোলৎসমান দুইনোর গীর্জায় আত্মহত্যা করেছিলেন। তার মৃত্যুর পরও হেনরিয়েটে অনেকদিন বেঁচে ছিলেন, ১৯৩৮ সালের ৩রা ডিসেম্বর মারা যান।
বোলৎসমানের মৃত্যুতে প্রচণ্ড আহত হয়েছিলেন এরভিন শ্রোডিঙার, তখন তার বয়স ছিল ১৯ বছর। তিনি বোলৎসমানের কাছে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান পড়ার ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলেন।[18] প্রচণ্ড আশাহত হয়েছিলেন দার্শনিক লুডভিগ ভিটগেনস্টাইন, তিনিও ১৯০৬ সালে লিনৎস ছেড়ে বোলৎসমানের কাছে শেখার পরিকল্পনা করছিলেন। উল্লেখ্য ভিটগেনস্টাইন তার সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ Tractatus Logico-Philosophicus-এ হাইনরিশ হেরৎস ও বোলৎসমানের পদার্থবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের দর্শনের সাথে সারেন কিয়েরকেগর ও ল্যেভ তল্স্তোয়-এর নীতিবিদ্যা মেলানোর চেষ্টা করেছিলেন। দুইনোতে বোলৎসমানের মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে মুর দুইনোর-ই বিখ্যাত কবি রাইনার মারিয়া রিলকে-র তিনটি চরণ উদ্ধৃত করেন। বোলৎসমানের জীবনীকার কার্লো কেরচিনিয়ানি তার পূর্বে আরও দুটি চরণ যোগ করেন। এই পাঁচটি চরণ বোলৎসমানের মৃত্যুকালীন মনস্ততত্ত্বকেই তুলে ধরে।[18][19]
“ | Consider: the Hero continues, even his fall was a pretext for further existence, an ultimate birth. But lovers are taken back by exhausted Nature into herself, as though such creative force could never be re-exerted |
” |
তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র এবং তাপীয় সাম্যাবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট সম্ভাব্যতা তত্ত্বের মধ্যে সম্পর্ক (১৮৭৭খ) গবেষণাপত্রে বোলৎসমান যা প্রকাশ করেছিলেন তাকে পরবর্তীতে আইনস্টাইন বোলৎসমান নীতি নামে আখ্যায়িত করেন। তিনি তার ১৮৭২ এর গবেষণাপত্রের ফলাফলগুলোকে এখানে আরও বিস্তৃত করেন এবং পরমাণুর বিশৃঙ্খলাকে এনট্রপির মাধ্যমে গণিতে প্রকাশ করেন। বোলৎসমানের আগে পদার্থবিজ্ঞানের পরমাণুর গঠন বিষয়ক কোন আলোচনা ছাড়াই পরমাণুর গতির বিশৃঙ্খলা নিয়ে গবেষণা করা হতো। আর যদি দেখা যেতো কোন প্রক্রিয়া ঘটা নিষেধ তাহলে সেটা ব্যাখ্যার জন্য এনট্রপি নিয়ে আসা হত। কিন্তু বোলৎসমান দেখান, এনট্রপি একটি ম্যাক্রো দশার সম্ভাব্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়, যাকে আবার মাইক্রো পর্যায়ের সম্ভাব্যতার সাথে মেলানো যায়। অণুগুলোর সম্ভাব্যতা বর্ণনার মাধ্যমে ম্যাক্রো পর্যায়ে সম্ভাব্যতা বোঝার জন্য তিনি একটি সমীকরণ প্রণয়ন করেন যা ভিয়েনায় তার সমাধিফলকে মুদ্রিত আছে। এনট্রপির এই সমীকরণটি হচ্ছে:
যেখানে = 1.3806505(24) × 10−23 J K−1 হচ্ছে বোলৎসমান ধ্রুবক, Wahrscheinlichkeit, তথা একটি ম্যাক্রো দশা কতবার ঘটে তা। একে একটি ব্যবস্থার ম্যাক্রো দশার সাথে সংশ্লিষ্ট যতগুলো মাইক্রো অবস্থা আছে তা। মাক্স প্লাংক এই সমীকরণটির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, "এনট্রপি এবং সম্ভাব্যতার মধ্যে লগারিদমিক সংযোগ প্রথম উত্থাপন করেছিলেন বোলৎসমান, তার গ্যাসের গতি তত্ত্ব বিষয়ক গবেষণায়"।
আমরা কেন কিছু ঘটনা একবারের বেশি বা একেবারেই দেখতে পাইনা তা বোলৎসমানের পরিসাংখ্যিক বণ্টন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় যে কাজটি তিনি নিজেই করেন। আগে এর ব্যাখ্যা দেয়া হত তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের মাধ্যমে। এর পরপরই এনট্রপি ধারণার জন্ম হয়েছিল। আসলে সে সময় বাষ্প ইঞ্জিনের ব্যবহার বাড়তে থাকায় তাপগতিবিদ্যার সাথে গালিলেও গালিলেই এবং আইজাক নিউটন দের চিরায়ত গতিবিদ্যার সমন্বয় সাধন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল। এই সমন্বয় তৈরি করা হয়েছিল গ্যাসের গতীয় তত্ত্বের মাধ্যমে এনট্রপি যার একটি ফসল।
১৮৭২ সালে গ্যাস অণুর তাপীয় সাম্যাবস্থা বিষয়ে নতুন গবেষণা নামক গবেষণাপত্রে বোলৎসমান গ্যাস অণুর বণ্টন নিয়ে তার সবচেয়ে বিখ্যাত সমীকরণ প্রকাশ করেন যা বোলৎসমান সমীকরণ নামে পরিচিত। পাশাপাশি, এতেই প্রথমবারের মত ম্যাক্রো তথা বৃহৎ পরিমণ্ডলে অপ্রত্যাবর্তী প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন। এতে সম্ভাবনার মাধ্যমে অপ্রত্যাবর্তী প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করাটা ছিল বৈপ্লবিক। গ্যাস অণুগুলোর মধ্যে অসংখ্য সংঘর্ষ হয় এবং একটি সংঘর্ষ থেকে আরেকটি সংঘর্ষের দূরত্ব খুবই কম, এক মিলিমিটারের প্রায় ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ। অণুগুলোর এই মিথস্ক্রিয়া অসংখ্যভাবে হতে পারে। মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে তারা ধীরে ধীরে বিশৃঙ্খল হবে এবং এই বিশৃঙ্খল হওয়ার জন্য অসংখ্য প্রক্রিয়া রয়েছে, অর্থাৎ তারা অসংখ্য প্রক্রিয়ায় বিশৃঙ্খল হতে পারে। তাই শুরুতে কিছু অণুর অবস্থান বা বেগ সামান্য পরিবর্তন করলে শেষ দশায় তেমন কোন পরিবর্তন হবে না। কিন্তু এই বিশৃঙ্খল গ্যাস অণুগুলোকে আবার শুরুর অবস্থায় ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা হবে খুবই কম। বিশৃঙ্খল হওয়ার অসংখ্য প্রক্রিয়া থাকলেও পুনরায় শৃঙ্খলিত হওয়ার প্রক্রিয়া কেবল একটি, বা খুবই কম সংখ্যক। অর্থাৎ অণুগুলোকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা তাত্ত্বিকভাবে অসম্ভব নয়, কিন্তু খুবই অসম্ভাব্য। অসম্ভব এর বদলে অসম্ভাব্য শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমেই বোলৎসমান পরিসাংখ্যিক বলবিদ্যার জন্ম দেন।
বোলৎমান এমন একটি সমীকরণ লিখেছিলেন যার মাধ্যমে একটি গ্যাস অণুর কোন সময়ে একটি নির্দিষ্ট বেগ এবং অবস্থানে থাকার সম্ভাবনা নির্ণয় করা যায়। একটি ঘরের মধ্যকার গ্যাস অণু থেকে শুরু করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশোদ্যত মহাকাশ খেয়াযান পর্যন্ত সবকিছুর ক্ষেত্রেই এই সমীকরণ প্রয়োগ করা যায়। সমীকরণটির গাণিতিক রূপ হচ্ছে:
যেখানে, হচ্ছে কণার বণ্টন অপেক্ষক (ডিস্ট্রিবিউশন ফাংশন) যা একটি নির্দিষ্ট সময়ের কণার অবস্থান ও ভরবেগ নির্দেশ করে। কণার উপর প্রযুক্ত বল, কণার বেগ, কণার ভর এবং t হচ্ছে সময়।
আবিষ্কারের পরপর বোলৎসমান ঠিক বুঝতে পারেননি তিনি কি অর্জন করেছেন। তিনি ভেবেছিলেন চিরায়ত বলবিদ্যার গণ্ডির মধ্যে থেকেই তিনি নতুন কিছু একটা করেছেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তার গবেষণাপত্রের শুরুর কথাগুলোতে, "এটা মনে করা ভুল হবে যে, সম্ভাব্যতার তত্ত্ব ব্যবহার করেছি বলে বলবিদ্যায় তাপের তত্ত্ব অনিশ্চয়তা হয়ে পড়বে... বরং বোঝা উচিত, এখন থেকে উপসংহারে পৌঁছার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হতে হবে।" কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি চিরায়ত নিয়ম ভেঙে একেবারে সম্ভাব্যতার নতুন যুগ শুরু করেছিলেন। শুরুতে বোলৎসমান ভাবছিলেন, চিরায়ত নিয়মের কিছু ব্যতিক্রম হয়ত তিনি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু তার তত্ত্বে সম্ভাবনার ব্যবহার ছিল অনেক বেশি। দেখা যাচ্ছে, তার সমীকরণ যতটা বৈপ্লবিক ছিল তিনি নিজেও ১৮৭২ সালে ততটা বৈপ্লবিক কথা বলেননি। তবে সমীকরণের অব্যর্থতা বোঝা যায় তার সহকর্মীদের প্রতিক্রিয়া দেখে। প্রায় সবাই তার তত্ত্বকে পরিবর্তন করতে বলেছিলেন, বলেছিলেন তিনি যেন এসব ছেড়ে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করেন।
মূলধারার দর্শনে লুডভিগ বোলৎসমানের কোন যুগান্তকারী অবদান নেই, কারণ তিনি ছিলেন মূলত গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী। কিন্তু দর্শন বিষয়ে তিনি বিস্তর পড়াশোনা করেছিলেন এবং একটি নিজস্ব দার্শনিক চিন্তাধারার জন্মও দিয়েছিলেন। দার্শনিক দিক দিয়ে তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর বাস্তববাদী এবং বস্তুবাদী। অবশ্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মূলেই রয়েছে এই বাস্তববাদ। তার দার্শনিক চিন্তাধারা লিপিবদ্ধ আছে তার লেখা জনগণের প্রতি নামক বইটিতে।[20] ১৯০৩ সালের দিকে ভিয়েনায় দার্শনিক হিসেবেও তিনি স্বীকৃত ছিলেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় আর্নস্ট মাখের অবসর গ্রহণের পর বিজ্ঞানের দর্শন বিষয়ক একটি পদে তাকে নিয়োগদান।[3]
গ্রাৎসে তার শিক্ষকতার মূল বিষয় ছিল পরীক্ষণমূলক পদার্থবিজ্ঞান। এখানে তিনি তাত্ত্বিক ধারণা ব্যাখ্যার জন্য যান্ত্রিক নমুনা ব্যবহার করতেন। যেমন, ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকীয় তত্ত্ব ব্যাখ্যার জন্য তিনি বিসিকেল (সাইকেল) নামে একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেন। দুটি তড়িৎ বর্তনীর পারষ্পরিক প্রভাব ব্যাখ্যার জন্য এটি খুবই কার্যকর একটি যন্ত্র ছিল। যন্ত্রটি বানানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন গ্রাৎসের প্রধান মেকানিক গাস্টাইগারকে। যন্ত্রটি সম্পর্কে বোলৎসমানের ছাত্র এরেনফেস্ট ১৯০৬ সালে তার মৃত্যুর পর শোকবাণীতে বলেছিলেন, চলন এবং বিভিন্ন বলের ক্রিয়া পরিষ্কারভাবে উত্থাপন করাটা বোধহয় বোলৎসমানের কাছে নৈসর্গিক আনন্দের বিষয় ছিল। আর্নল্ড সমারফেল্ড বলেছিলেন, "মিউনিখে আমার প্রাক্তন বিভাগের পাশে বোলৎসমানের বিসিকেলের একটি নমুনা সংরক্ষিত ছিল যা তার আদেশেই বানানো হয়েছিল।... তবে এটি তড়িৎগতিবিদ্যার চেয়ে যন্ত্রকৌশলের কাজে বেশি ব্যবহৃত হতো।" এই বিসিকেলের দুটি নমুনা ছিল, একটি গ্রাৎসে, অন্যটি মিউনিখে। যুদ্ধের সময় দুটিই হারিয়ে যায়। ১৯৮৫ সালে বোলৎসমানের উদ্দেশ্যে নিবেদিত এবটি প্রদর্শনী উপলক্ষে গ্রাৎসে যন্ত্রটির একটি নকল তৈরি করেন তৎকালীন প্রধান মেকানিক কুর্ট আন্সপের্গার।[21]
মিউনিখে থাকার সময় বোলৎসমানের শিক্ষকতার একজন সাক্ষী হানতারো নাগাওকা। নাগাওকার চিঠি থেকে বোলৎসমানের শিক্ষকতা জীবন সম্পর্কে যা যা জানা যায় তা হচ্ছে: "তিনি সেখানে গ্যাসের গতি তত্ত্ব এবং পদার্থবিজ্ঞানে হ্যামিল্টনের নীতির প্রয়োগ বিষয়ে পড়াতেন। তার মতে হেল্মহোলৎস ছাড়া বোলৎসমানের মত শিক্ষক আর নেই, তবে বোলৎসমান হেল্মহোলৎসের তুলনায় অনেক স্পষ্টভাবে কথা বলেন, তার কথা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে বোলৎসমানের কিছু কাজে বুদ্ধিহীনতার লক্ষণ দেখা যায়। তিনি ম্যক্সওয়েলকে অনেক পছন্দ করেন, তার লেকচারগুলো ম্যক্সওয়েলীয় ধারায় গড়া। তিনি এমন একজন মানুষ যাকে সবারই ভালবাসতে পারার কথা।"[9]
বোলৎসমান তার ক্লাসে কোন দরিদ্র ছাত্র অকৃতকার্য হলে নিজেকেই দোষী মনে করতেন। জীবনের শেষ বছরগুলোতে তার ক্লাসে কোন ছাত্র কোনদিন অকৃতকার্য হয়নি। তার লেকচারগুলো ছিল খুব প্রাণবন্ত, সময় সময় অনেক স্থূল উদাহরণ দিয়ে বোঝাতেন। তার ক্লাসে শিক্ষার্থীরা যেকোন ধরনের প্রশ্ন করতে পারত, এমনকি তার সমালোচনাও করতে পারত। কোন একটি ধারার প্রতি পক্ষপাতিত্ব তিনি সমর্থন করতেন না, বিজ্ঞান বা দর্শন কোনকিছুতেই নয়। শিক্ষার্থীদের সাথে তার সম্পর্কও ছিল খুব আন্তরিক। তার সাথে দূরত্ব বা অতিভক্তি বজায় রেখে কথা বলতে হতো না কারও। লিজে মাইটনারের লেখা থেকে জানা যায় তিনি শিক্ষার্থীদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপনে বিশ্বাস করতেন, তাদের প্রশংসা করতেন এবং চরিত্র বোঝার চেষ্টা করতেন। সময় সময় তাদেরকে নিজের বাসায় নিমন্ত্রণ করতেন এবং নিজে পিয়ানো বাজিয়ে শোনাতেন।[22]
বোলৎসমান প্রকৃতি খুব ভালবাসতেন। প্রায়শই বাগানে হাঁটতে বেরোতেন, হাঁটতে হাঁটতে তার বাচ্চাদেরকে বিভিন্ন গাছগাছালি চিনিয়ে দিতেন। অন্যান্য অধ্যাপকদের মত বোলৎসমানকেও পদার্থবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট থেকে একটি বাড়ি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এর বাইরে তিনি ওবেরক্রোইসবাখের নিকটে একটি খামাড় বাড়ি ক্রয় করেন। সেখান থেকে স্টিরিয়ার গ্রামাঞ্চল দেখা যেতো, পরিবারের সাথে তিনি এই বাড়িতেই থাকতেন। গাছগাছালি খুব ভাল চিনতেন। নিজ বাড়িতে বাগান করেছিলেন, এমনকি প্রজাপতিও সংগ্রহ করতেন। ছোটবেলায় তিনি খুব একটা শরীর চর্চা করার সুযোগ পাননি। এজন্য নিজের বাড়িতে ব্যায়ামের কিছু উপকরণ কিনে রেখেছিলেন যাতে তার বাচ্চারা তা থেকে বঞ্চিত না হয়। নিজের পড়ার ঘর থেকে বাইরের পরিবেশ দেখতে পেতেন। তার প্রতিবেশী সবাই ছিল কৃষক।
তার একটি অ্যালসেশিয়ান কুকুর ছিল। প্রতিদিন যখন বোলৎসমানের কাজ শেষের পথে তখন কুকুরটি খামাড় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ইনস্টিটিউটে চলে আসত। তার জন্য অপেক্ষা করত। বোলৎসমান এলে তার সাথে সাথে পাশের একটি পাবে যেতো। তিনি যখন দুপুড়ের খাবার খেতেন তখন কুকুরটি তার পায়ের সাথে বসে থাকত। বোলৎসমান এমনকি একটি গাভীও কিনেছিলেন। মাঝেমাঝেই তাকে গাভীটিকে নিয়ে গ্রাৎসের রাস্তায় হাঁটতে দেখা যেতো। কারণ তিনি প্রাণিবিজ্ঞানের সহকর্মীদের কাছ থেকে শুনেছিলেন এটাই কুকুরের দুধ দোয়ানোর সর্বোত্তম পন্থা।
বোলৎসমান খেতেন খুব আস্তে আস্তে, সম্ভবত মায়োপিয়া থাকার কারণে। রাজবাড়িতে আমন্ত্রণে গেলে সমস্যা হতো তার। কারণ রাজবাড়িতে নিয়ম হচ্ছে রাজার খাওয়া শেষ হওয়ার পর কেউ খেতে পারবে না। দেখা যেতো বোলৎসমান ঠিকমতো খাওয়া শুরুর আগেই বাবুর্চি তার চোখের সামনে দিয়ে সব খাবার নিয়ে চলে যেতো। তিনি নিজের বাচ্চাদের খুব পছন্দ করতেন। একবার তার ছোট মেয়ে একটি পোষা বানর কিনতে চেয়েছিল। তার মা এতে একেবারেই রাজি হয়নি। কিন্তু বোলৎসমান তার আবদার কিছুটা হলেও মেটাতে তাকে খরগোশ কিনে দেন এবং খরগোশগুলোর জন্য নিজের গ্রন্থাগারে একটি খাঁচাও স্থাপন করে দেন।
বোলৎনমানের প্রিয় শখের মধ্যে ছিল বরফে স্কেটিং, হাঁটা এবং সাঁতার কাটা। সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেও পছন্দ করতেন। নিজের বাড়িতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন এবং তাতে তার পিএইডি শিক্ষার্থীদেরকেও আমন্ত্রণ করতেন। অনুষ্ঠানে প্রথম বক্তৃতা দিতেও তার জুড়ি ছিল না। কারণ তিনি ভাল কৌতুক করতে পারতেন, মাঝেমাঝে ব্যঙ্গাত্মক কবিতাও লিখতেন যার মধ্যে একটি হচ্ছে Beethoven im Himmel বা স্বর্গে বেটোফেন।
ধ্রুপদী জার্মান সাহিত্য সম্পর্কে বোলৎসমান অনেক জানতেন। মাঝেমাঝে বিভিন্ন সাহিত্যিকের লেখা থেকে উদ্ধৃতিও দিতেন। তার Populdre Schriften (জনগণের প্রতি) নামের বইটি উৎসর্গ করেছিলেন বিখ্যাত জার্মান কবি ফ্রিডরিশ শিলারের উদ্দেশ্যে। শিলারই সম্ভবত লুডভিগের প্রিয় কবি ছিলেন। কারণ শিলার ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলতেন এবং সৌন্দর্য্যকে কখনও নৈতিকতা থেকে আলাদা করতেন না।
সঙ্গীতজ্ঞদের মধ্যে তার প্রিয় ছিল লুডভিগ ফান বেটোফেন। বেটোফেনের গান পিয়ানোতে বাজাতে খুব পছন্দ করতেন তিনি। ছেলে আর্থুরকে সাথে নিয়ে কখনও কখনও চেম্বার সঙ্গীত বাজাতেন। কনসার্টে যেতে পছন্দ করতেন এবং ভিয়েনার অপেরা মঞ্চের নিয়মিত দর্শক ছিল। জীবনের শেষ ৫-৬ বছরে বোলৎসমান বেটোফেনকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন যার নাম বেটোফেন ইম হিমেল (লাতিন বর্ণমালায়: Beethoven im Himmel)। কবিতার বিষয়বস্তু ছিল মানব জীবনের কষ্ট এবং মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা। একে তিনি Scherzgedicht তথা ব্যঙ্গাত্মক কবিতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।[3]
কবিতার প্রথমে দেখা যায়, বোলৎসমান পৃথিবীর দুঃখ-কষ্ট এবং পীড়ন আর সহ্য করতে না পেরে মৃত্যু কামনা করছেন। এর সাথে তার ব্যক্তি জীবনও মিলে যায়, কারণ তিনি সে সময় মৃত্যুই চাচ্ছিলেন। কিন্তু এক সময় ভাষা ব্যঙ্গাত্মক রূপ নেয়। দেখা যায়, তার প্রার্থনা ঈশ্বর শুনেছে, তিনি মারা গেছেন। মৃত্যুর পর তার আত্মা স্বর্গে আরোহণ করছে। পথে তিনি আরও অনেক বিশ্বের সন্ধান পান, কিন্তু স্বর্গই মূল লক্ষ্য হওয়ায় ভ্রুক্ষেপ করেননা সেদিকে। অবশেষে স্বর্গে পৌঁছালে পর পরী ও ঈশ্বরের বার্তাবাহকেরা তাকে গান গেয়ে শোনায়। সেই গান তার কাছে বড় একঘেয়ে লাগে। গানটি আরও কিছুক্ষণ শোনার পর তিনি এর সাথে বেটোফেনের সুরের সামঞ্জস্য লক্ষ্য করেন। পরীদের কাছ থেকে জানতে পারেন, গানটি ঈশ্বরের আদেশে বেটোফেনই লিখেছেন। এই প্রেক্ষিতে বোলৎসমান বেটোফেনের সাথে দেখা করতে চান এবং পরীরা তাকে সে পথে নিয়ে যায়। সাক্ষাতে বেটোফেন তাকে জিজ্ঞেস করেন গানটি তার ভাল লেগেছে কিনা। তিনি নিরব থাকেন। বেটোফেন বলতে উৎসাহ দিলে তিনি জানান, তার এখানকার গানগুলো পৃথিবীর মত ভাল লাগছে না।
উত্তরে বেটোফেন বলেন, তিনি স্বর্গে এসে গান লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কারণ এখানে তার সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে গেছে, তার গান এবং সুরের মূল অনুপ্রেরণা ছিল মানুষের বেদনা। সেই বেদনাই যখন নেই তখন গানও নেই। কেবল শেষ বিচার বলে কিছু একটা আছে বলেই তিনি ঈশ্বরের আদেশে এই গানটি লিখেছেন। তিনি বোঝান যে, পৃথিবীতে বিরাজমান বেদনাই আমাদের মানবীয় অনুভূতির মূল উপজীব্য। এসব শোনার পর বোলৎসমান মানব জীবনের আয়রনি বুঝতে পারেন। তার কবিতার শেষ পংক্তিগুলো এমন:
“ | In shock almost I gazed upon his face. "How truly wondrous are these worldly ways! Just hours ago I begged for death again, 'Oh spare my heart the suffering and the pain' But here in heaven pain is what one yearns Oh human heart your ways one never learns. |
” |
ঘণ্টা খানেক পূর্বে তিনি বেদনামুক্তির আশায় মৃত্যু প্রার্থনা করছিলেন। অথচ স্বর্গে এসে সেই মানুষই পৃথিবীর বেদনা ফিরে পেতে আকুতি করে।[23]
বোলৎসমানের রচনাগুলোকে চারটি সময় ভাগ করা যায়। প্রথম সময়কালটি হচ্ছে গঠনের কাল, ১৮৬৬ থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত। ১৮৬৮ থেকে ১৮৭১ পর্যন্ত প্রকাশিত পেপারগুলোতে ম্যাক্সওয়েলের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ম্যক্সওয়েল পড়ার পরই তিনি এগুলো লিখেছিলেন। এগুলোতে তাপীয় সাম্যাবস্থায় থাকা গ্যাসের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সম্ভাবনাভিত্তিক বিন্যাসের সাহায্যে। তবে তিনি আরও সাধারণ তত্ত্বে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করছিলেন, যেমন এক সময়ে বাইরে থেকে প্রযুক্ত বল এবং বহু-পরমাণু গ্যাসের উল্লেখ শুরু করেন। সম্ভাবনার বিভিন্ন ধারণা নিয়ে কথা বলেছেন এগুলোতে, যেমন: কালিক গড়, কণা গড়, বা এনসেম্বল গড়। এই গবেষণাপত্রগুলোর মূল ফলাফল ছিল, Stoßzahlansatz (সমভাবাপন্ন অনুমিতি) এর আলোকে ম্যক্সওয়েলের বণ্টন অপেক্ষক স্থিতিশীল, বা সাম্যাবস্থায় থাকে। অবশ্য এই সময়ে তিনি একেবারে ভিন্ন একটি পদ্ধতিও প্রয়োগ করেন যা স্টোসৎসালআনসাৎস-এর উপর নির্ভর করে না, বরং এর্গোডিক অনুকল্পের উপর নির্ভর করে। এতে একটি নতুন বণ্টন অপেক্ষকের জন্ম হয় সীমায় যা ম্যক্সওয়েলীয় বণ্টনে পরিণত হয়। এ সময় এনসেম্বল এর ধারণাও দেন, কিন্তু ৮০-র দশকের আগে তা গুরুত্ব পায়নি।[24]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.