বাংলাদেশী কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্র গবেষক এবং সমাজকর্মী উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী (২৬ ডিসেম্বর ১৯২১ – ১৫ জুন ১৯৮৮) ছিলেন একজন বাংলাদেশী কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্র গবেষক এবং সমাজকর্মী।[১] বামপন্থায় বিশ্বাসী তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, কৃষকদের তেভাগা আন্দোলনে, ভাষা আন্দোলনে, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিসংগ্রামসহ প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সর্বত্রই সক্রিয় ছিলেন। [২]
রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী | |
---|---|
জন্ম | বালুচর গ্রাম, পালং-শরীয়তপুর ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে বাংলাদেশ) | ২৬ ডিসেম্বর ১৯২১
মৃত্যু | ১৫ জুন ১৯৮৮ ৬৬) ঢাকা বাংলাদেশ | (বয়স
ভাষা | বাংলা |
জাতীয়তা | ব্রিটিশ ভারতীয়(১৯২১-১৯৪৭) বাংলাদেশী(১৯৭১-১৯৮৮) |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান | কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় |
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি | রবীন্দ্র তরুমূলে |
দাম্পত্যসঙ্গী | রাণী ঘটক চৌধুরী (স্ত্রী) (মৃ.২০১৮) |
সন্তান | ৯ জন |
রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর জন্ম ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ডিসেম্বর (১৩২৮ বঙ্গাব্দের ১১ পৌষ) অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন ঢাকা জেলার কলাগাছিয়া থানার অধুনা শরীয়তপুর জেলার পালং থানার দক্ষিন বালুচর গ্রামে। পিতা ছিলেন জমিদার সূর্যকান্ত ঘটক চৌধুরী এবং মাতা রত্নাবালা দেবী। তার পিতামহ রজতকান্ত ঘটক চৌধুরী পূর্বে নডিয়া থানার রাজনগরে বসবাস করতেন। পরে পালং-এর জমিদার হন এবং ওকালতি করতেন। রথীন্দ্রকান্ত তার পিতামাতার নয়টি সন্তানের তৃতীয় সন্তান ছিলেন। তার বিদ্যালয়ের পাঠ শুরু হয় তুলাসার গুরুদাস উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করেন। প্রবেশিকা পাশের পর তিনি তার অগ্রজ রথীন্দ্রকান্তের ন্যায় শান্তিনিকেতনে চলে যান। সেখান থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে আই. এ পাশের পর ভরতি হন কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে এবং বি. এ পাশ করেন।[১]
ছাত্রাবস্থায় তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। ‘'অনুশীলন সমিতি’'-র সদস্য ছিলেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। অবিভক্ত বাংলায় 'প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ'-র সক্রিয় কর্মীও ছিলেন তিনি। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফরিদপুর জেলার সংগঠক এবং ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ওই জেলা কমিটির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ও শান্তি সেন তে-ভাগা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।[৩]
রথীন্দ্রকান্ত ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে চকন্দী হাই স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। স্বাধীনতা লাভ আর দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তার বাড়িতে পুলিশি তল্লাশি শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং যোগদান করেন স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যের "অগ্রণী" পত্রিকায়। কিছুদিন কলকাতায় অবস্থান করার পর ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে নিজের গ্রামে ফিরে আসেন এবং পালং হাই স্কুলে অস্থায়ী শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে তুলাসার গুরুদাস উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে শিক্ষকতা করেন ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে দাঙ্গাকবলিত ও দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলার হিন্দু-মুসলমান ঐক্য রক্ষার্থে, মজুতদারের অবৈধ কাজ বন্ধ করতে, লঙ্ঘনের আয়োজনে, চিকিৎসা সেবা প্রদানের বিভিন্ন কাজে লিপ্ত ছিলেন।
নিজগ্রামে প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা, রাস্তাঘাট নির্মাণ, বালিকাদের জন্য উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন, পাবলিক লাইব্রেরি এবং শিল্পকলা অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত (মাঝে দু'বছর স্বেচ্ছাবিরতি বাদে) পঁচিশ বৎসর নিজের জেলা শরীয়তপুরের পালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন।
শরীয়তপুর মহকুমা (১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর গঠিত) এবং পরবর্তীতে শরীয়তপুর জেলা ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ গঠিত) গঠনে তিনিই নেতৃত্ব দেন।
বিভিন্ন সময়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয়তার পাশাপাশি তিনি বাংলা ভাষা আন্দোলনেও নেতৃত্বদান করেছেন। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তার যথেষ্ট অবদান ছিল। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে প্রথম 'লোকসংগীত উৎসব' প্রবর্তনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। কথিকা পাঠের মাধ্যমের তিনিই সূচনা করেছিলেন সেই উৎসবের এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে বেতারে লোককবি সংক্রান্ত কথিকা প্রদান করেছেন। লালন ফকির, গগন হরকরা, কাঙাল হরিনাথ প্রমুখ বাংলার লোকশিল্পীদের নিয়ে তিনি যেমন গবেষণা করেছেন, তেমনই বাংলার ভাওয়াইয়া, কবিগান, জারিগান, মুর্শিদী-ভাটিয়ালি প্রভৃতির গানকে জনপ্রিয় করে তার উদ্যম ছিল অসামান্য। [৪]
রথীন্দ্রকান্তের পরিবারের সকলেই রবীন্দ্র অনুরাগী ছিলেন। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় রবীন্দ্র শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান আয়োজনে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন তার পিতা সূর্যকান্ত। রথীন্দ্রকান্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্য ছিলেন। শান্তিনিকেতনে অধ্যয়ন কালে তিনি কবিগুরুর সঙ্গ লাভ করেছিলেন। শান্তিনিকেতনের সাহিত্যসংস্থা সাহিত্যিকা-র সম্পাদক হিসাবে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে কবির সভাপতিত্বে সাহিত্য সভায় রথীন্দ্রনাথ স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। রথীন্দ্রকান্ত রবীন্দ্রনাথের দুষ্প্রাপ্য কবিতার আবিষ্কার ও রবীন্দ্র গবেষক হিসাবে উভয় বাংলার বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের শেষ শ্রদ্ধাবাসরের সম্মাননাপত্র রচনা ও পাঠ করার দায়িত্ব পালন ছিল তার সাহিত্যকীর্তির উদাহরণ।[৪] শান্তিনিকেতনে তার শিক্ষা জীবনের স্মৃতি নিয়ে তিনি রচনা করেন রবীন্দ্র তরুমূলে। গ্রন্থটি অবশ্য তার মৃত্যুর পর ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে 'রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন' পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত হয়।
রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অসংখ্য কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ নাটক ইত্যাদি রচনা করেছেন। তার রচিত ও প্রকাশিত গ্রন্থ ছয়টি। সেগুলি গ্রন্থগুলি হল- [৫]
তার অনেক লেখা এখনও অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত রয়ছে।
রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী অসুস্থতার জন্য ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভরতি হয়ছিলেন। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুন (১৩৯৫ বঙ্গাব্দের ৩২ জ্যৈষ্ঠ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যু কালে তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বৎসর। বিখ্যাত কণ্ঠসংগীত শিল্পী ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যা রাণী ঘটক চৌধুরী (বন্দ্যোপাধ্যায়) ছিলেন তার স্ত্রী। তিনি ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ জানুয়ারি বুধবার নিজ বাসভবনে মারা যান। তাদের নয় জন সন্তান ( তিন পুত্র ও ছয় কন্যা)। [৬] কবি ও সাহিত্যিক রথীন্দ্রকান্তের স্মৃতিরক্ষার্থে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই সাহিত্যিক আবু ইসহাকের সভাপতিত্বে শরীয়তপুরে গঠিত হয় "রথীন্দ্র সাহিত্য পরিষদ"।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.