Loading AI tools
রঙ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বাদামী (ভিন্ন বানান বাদামি) একটি যৌগিক রঙ। মুদ্রণ বা চিত্রকলায় ব্যবহৃত সিএমওয়াইকে রং মডেলে লাল, কালো ও হলুদ মিশিয়ে বাদামি তৈরি করা হয়,[1][2] অথবা লাল, হলুদ ও নীল মিশিয়ে[3] কম্পিউটার-টেলিভিশনের পর্দায় ব্যবহৃত আরজিবি রং মডেলে বাদামির উপাদান হলো নির্দিষ্ট অনুপাতে লাল ও সবুজ। প্রকৃতিতে কাঠ, মাটি, মানুষের ত্বক প্রভৃতিতে বাদামি রং দেখা যায়। এটি মূলত গাঢ় কাঠ বা উর্বর মাটির রঙ।[4] ইউরোপ-আমেরিকার জনজরিপ অনুসারে লোকদের সবচেয়ে কম প্রিয় রং বাদামি। একে সাধারণত সরলতা, গ্রাম্যতা, মল ও দারিদ্র্যের রং বলে ভাবা হয়।[5]
বাংলা বাদাম শব্দটি এসেছে সংস্কৃত বাতাম্র থেকে, সেখান হতে বাদামি বা বাদামী। বাদামিকে রঙনাম হিসেবে লিখিতভাবে প্রথম ব্যবহার করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ১৮৯১ সালে।[10]
বাদামির ইংরেজি নাম Brown (ব্রাউন)। শব্দটা এসেছে প্রাচীন ইংরেজির শব্দ brún থেকে, মূলত এর অর্থ ছিল রঙের কোনো গাঢ় বা কালচে রূপ। ইংরেজি রঙনাম হিসেবে এর প্রথম লিখিত ব্যবহার হয় ১০০০ সালে।[11][12] কমন জার্মান ভাষার বিশেষণ *brûnoz, *brûnâ বলতে গাঢ় রং এবং ঝকঝকে বা জ্বলজ্বলে বৈশিষ্ট্য বোঝাতো, যেমন বার্নিশ। বর্তমান অর্থটি বিকশিত হয় ১৪শ শতক থেকে, মধ্য ইংরেজিতে।[13]
বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় বাদামি রঙের নামটা প্রায়ই খাদ্য-পানীয়ের সাথে যুক্ত; পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে, বাদামির প্রতিশব্দ এসেছে কফি রং থেকে। তুর্কিতে বাদামিকে বলে kahve rengi; গ্রীকে kafé, মেসিডোনিয়ায় kafeyev। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় নামটা এসেছে চকলেট থেকে: মালয় ভাষায় coklat; ফিলিপিনোতে tsokolate। আর জাপানী প্রতিশব্দ chairo অর্থ চায়ের রঙ।[14]
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই ছবি আঁকতে বাদামী রং ব্যবহার করা হচ্ছে। লৌহ অক্সাইড ও ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইডের যৌগ একধরনের কাদার প্রাকৃতিক পিগমেন্ট হলো আম্বার (umber) যা ব্যবহার করে খ্রিষ্টপূর্ব ৪০,০০০ অব্দে আঁকা চিত্রকর্মের সন্ধান পাওয়া গেছে।[15] 17,300 বছর আগে আঁকা বাদামী ঘোড়া ও অন্যান্য প্রাণীর ছবি পাওয়া গেছে ল্যাসকক্স গুহার দেয়ালে। প্রাচীন মিশরীয় সমাধিগুলোতে নারী অবয়বের ত্বক আঁকা হয়েছে বাদামী রঙে, আম্বার দিয়ে। গ্রীসে কুঁজো ও ফুলদানি অলঙ্করণ করতে প্রায়ই হালকা হলদে-বাদামি রং লাগানো হতো, কখনো কালো অবয়বের পটভূমি আঁকতে, কখনো তার উল্টোটা।
প্রাচীন গ্রীক এবং রোমকরা সেপিয়া নামে একরকম চমৎকার লালচে-বাদামি কালি বানিয়েছিল। কালিটি তৈরি করা হতো বেশ কয়েকরকম কাটলফিশের কালি থেকে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, রাফায়েল এবং রেনেসাঁযুগের অন্য শিল্পীরাও কালিটি ব্যবহার করতেন, এখনো করেন।
প্রাচীন রোমে, বাদামি বা গেরুয়া পোশাক পরতো নিচু শ্রেণীর বা অশিক্ষিত লোকেরা। শহুরে দরিদ্র বা আমজনতাকে বলা হতো "pullati", যার অর্থ "বাদামি পোশাক পরে যারা"।[16]
মধ্যযুগে ফ্রান্সিসকান সন্ন্যাসীরা তাদের নিরহঙ্কার ও দারিদ্র্যের চিহ্নস্বরূপ বাদামি বা ধূসর আলখেল্লা পরতো। সমাজের প্রত্যেক শ্রেণীকে তাদের মর্যাদা অনুসারে রং পরতে হতো; ধূসর ও বাদামি ছিল গরিবদের রঙ। রুসেট ছিল একরকম খসখসে ঘরেবোনা উলের কাপড়। সেই উল রঞ্জিত করা হতো ওড এবং ম্যাডার দিয়ে, ফলে কাপড়ে ধূসর বা বাদামির কোমল শেড পড়তো। ১৩৬৩ সালের আইন অনুসারে গরিব ইংরেজরা রুসেট পরতে বাধ্য হতো। মধ্যযুগীয় কবিতা Piers Plowman-তে পুণ্যবান খ্রিস্টানের বর্ণনা:[17]
And is gladde of a goune of a graye russet
As of a tunicle of Tarse or of trye scarlet.
মধ্যযুগের শিল্পকলায় গাঢ় বাদামী পিগমেন্ট কদাচিৎ ব্যবহার করা হতো। সেকালের চিত্রশিল্পী এবং বই অলঙ্করণকারীরা গাঢ় রঙের বদলে লাল, নীল, সবুজ প্রভৃতি উজ্জ্বল ও স্বতন্ত্র রং পছন্দ করতেন। পনেরোশো শতাব্দী শেষ হবার আগে ইউরোপেও আম্বার রঙটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়নি। রেনেসাঁ চিত্রশিল্পী ও লেখক জর্জিও ভাসারি (১৫১১–১৫৭৪) রঙগুলোকে তাদের যুগে বেশ নতুন বলে মন্তব্য করেছেন।[18]
পনেরো শতকের শেষদিকে শিল্পীরা তৈলচিত্রে বাদামী রঙের ব্যবহার বাড়ান। রেনেসাঁর সময়ে তারা সাধারণত চার রকমের বাদামী ব্যবহার করতেন; কাঁচা আম্বার, ইতালির আম্ব্রিয়া থেকে উত্তোলিত ঘোর বাদামী কাদামাটি; কাঁচা সিয়েনা, টাস্কানির সিয়েনা হতে লালচে-বাদামী মাটি; পোড়া আম্বার, আম্ব্রিয়ান কাদার পোড়ানো গাঢ় ছায়ারূপ; আর পোড়া সিয়েনা, পুড়িয়ে গাঢ় লালচে-বাদামী করা মাটি। উত্তর ইউরোপে, জ্যান ভ্যান আইক তার আঁকা প্রতিকৃতিগুলোতে উর্বর মাটির মতো বাদামী রং ব্যবহার করে অন্য উজ্জ্বল রঙগুলোকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছেন।
১৭ ও ১৮ শতকে বাদামী রঙের সর্বাধিক ব্যবহার হয়। কারাভাজিও এবং রেমব্র্যান্ট ছবিতে চেয়ারোসকুরো (আলো-ছায়া) রূপ ফুটিয়ে তুলতে বাদামী রং কাজে লাগাতেন। রেমব্র্যান্ট তার ছবির মূল স্তরেও আম্বার ব্যবহার করতেন যাতে রং তাড়াতাড়ি শুকাতো। তিনি ক্যাসল মাটি বা কোলোন মাটি নামে বাদামীর নতুন এক পিগমেন্ট ব্যবহার করতে শুরু করেন। এটি ছিল একটি প্রাকৃতিক মেটে রঙ, যার নব্বই ভাগের বেশিই জৈব যৌগ, যেমন মাটি ও পিট। রুবেনস এবং অ্যান্থোনি ভ্যান ডাইকও রঙটি ব্যবহার করতেন। পরবর্তীতে এটি ভ্যান ডাইক বাদামী নামে পরিচিত হয়।
ফরাসী ইমপ্রেশনিস্টরা সাধারণত বাদামী রং ঘৃণা করতেন, তাদের পছন্দ ছিল উজ্জ্বল, বিশুদ্ধ রঙ। ১৯ শতকের এসব শিল্পীদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন পল গোগাঁ; তিনি ফরাসী পলিনেশিয়ার প্রাকৃতিক দৃশ্য ও লোকজন এঁকেছেন সপ্রভ বাদামী বর্ণে।
২০ শতকের প্রান্তে, পশ্চিমা সভ্যতায় বাদামী হয়ে ওঠে সরল, সস্তা, প্রকৃতি বা সুস্বাস্থ্যের প্রতীক। ব্যাগ লাঞ্চ (ফলমূল, স্যান্ডউইচজাতীয় টিফিন) নেয়া হতো বাদামী কাগজের ব্যাগে; প্যাকেজও মোড়ানো হতো বাদামী কাগজে; বাংলায় যেটাকে বলা হয় বাঁশ কাগজ। তখন সাদা পাউরুটি বা চিনির চেয়ে বাদামী পাউরুটি ও বাদামী চিনিকে (লাল চিনি বলে পরিচিত) বেশি প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর বলে ধারণা করা হতো।
বাদামি একটি যৌগিক রঙ; লাল, হলুদ ও কালোর মিশ্রণে এটি তৈরি করা হয়।[19] কম্পিউটার-টেলিভিশনের পর্দায় ব্যবহৃত আরজিবি রং মডেলে নির্দিষ্ট অনুপাতে লাল ও সবুজ আলো মিশিয়ে বাদামি রং দেখানো হয়।
দৃশ্যমান বর্ণালির হিসাবে "বাদামি" হলো উচ্চ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (কম কম্পাঙ্ক) হিউ, যেমন- হলুদ, কমলা বা লাল আলোর কম ঔজ্জ্বল্য বা স্যাচুরেশন।[20] বাদামি বর্ণালির একটা বড় অংশে বিস্তৃত হওয়ায় লালচে বাদামি, হলদে বাদামি, গাঢ়/ফিকে বাদামি প্রভৃতি যৌগিক বিশেষণ ব্যবহার করতে হয়।
কম তীব্রতার রং বলে বাদামি একটি টারশিয়ারি রঙ: তিনটি বিয়োজক মূল রঙের মিশ্রণ যেখানে সায়ান রঙ-উপাদান কম থাকে। কেবল উজ্জ্বলতর রঙের বিপরীতেই বাদামি দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়।[21] স্বাভাবিক আলোকমাত্রা কম হলে হলুদ, কমলা, লাল বা গোলাপি রঙের বস্তু এমন দেখায়, যদিও তারা স্বাভাবিক আলোতে বাদামির প্রতিফলিত লাল/কমলা আলোর সমপরিমাণই প্রতিফলিত করে।
মানবচোখে আইরিসের স্ট্রোমাতে মেলানিনের ঘনমাত্রা তুলনামূলক বেশি হলে স্বল্প ও দীর্ঘ উভয় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোই শোষিত হয় এবং চোখের রং বাদামী দেখায়[28][29] আর পৃথিবীর অনেক অঞ্চলে অধিকাংশ লোকই বাদামী আইরিসের অধিকারী।[30] বাদামী চোখের গাঢ় পিগমেন্ট দেখা যায় পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম আফ্রিকা, ওশেনিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা প্রভৃতি অঞ্চলে, পূর্ব ইউরোপ ও দক্ষিণ ইউরোপের কিছু অংশ সহ।[31] সার্বিক হিসাবে পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষের চোখের রঙই গাঢ় বাদামী। হালকা বা মধ্যম-পিগমেন্টের বাদামী চোখ দেখা যায় ইউরোপ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং উত্তর ভারতে, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশসহ।
কালোর পরে বাদামীই মানবচুলের সবচেয়ে কমন রঙ। প্রাকৃতিক গাঢ় পিগমেন্ট ইউমেলানিনের উচ্চমাত্রা এবং ফিকে পিগমেন্ট ফিয়োমেলানিনের নিম্নমাত্রার কারণে চুলের রং বাদামী হয়। ইউরোপীয়দের মধ্যে বাদামী ইউমেলানিন বেশি কমন, কিন্তু অ-ইউরোপীয়দের চুলে কালো ইউমেলানিন অধিক। অন্যান্য পিগমেন্ট না থাকলে অল্প পরিমাণ কালো ইউমেলানিন চুলে ধূসর বর্ণ সৃষ্টি করে। আর অন্যান্য পিগমেন্টের অনুপস্থিতিতে সামান্য বাদামী ইউমেলানিন সৃষ্টি করে সোনালী বা ব্লন্ড চুল।
জনপ্রিয় পশ্চিমা সংস্কৃতিতে প্রচলিত ধারণা হলো ব্রন্টিরা (বাদামী চুলের নারী) সুস্থির, সিরিয়াস, স্মার্ট এবং বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন। চুলের রং ও আকর্ষণের তীব্রতা সম্পর্কে এক ব্রিটিশ জরিপে দেখা গেছে অংশগ্রহণকারী পুরুষদের ৬২ শতাংশই বাদামী-চুলো নারীদেরকে স্থৈর্য ও পারদর্শিতার সাথে সম্পৃক্ত করেছে। ৬৭ শতাংশ পুরুষ ব্রন্টিদের বলেছে স্বাধীনচেতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণ, ৮১ শতাংশ বলেছে বুদ্ধিমান।[32]
বিশ্বের মানুষের বড় এক অংশের ত্বকের রং বাদামী বা তার শেড, মধুর মতো ফিকে বাদামী বা সোনালী বাদামী থেকে শুরু করে তামাটে বা ব্রোঞ্জের রং পর্যন্ত, কিংবা কফির রং বা কড়া চকলেটের। ত্বকের রং ও জাতি এককথা নয়; শ্বেতাঙ্গ বা কৃষ্ণাঙ্গ যাদের বলা হয় তাদের অনেকের গায়ের রং বাদামীর কোনো না কোনো ছটা। ত্বকের মেলানোসাইট কোষে উৎপন্ন হয় প্রাকৃতিক পিগমেন্ট মেলানিন যা গায়ের রঙের জন্য দায়ী। মানবত্বকের ভেতরে প্রতিনিয়ত জৈবরাসায়নিক প্রভাবক যে অতিবেগুনী রশ্মি প্রবেশ করে তা নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজনেই ত্বকের পিগমেন্ট বিবর্তিত হয়েছে।[33]
সূর্যালোকে রোদ পোহালে তথা সান ট্যানিং করলে ত্বকের প্রাকৃতিক রং গাঢ় হয়ে যেতে পারে। এসম্পর্কে প্রচলিত মতবাদ হলো, ত্বকের রং অতিরিক্ত সূর্যালোক বিকিরণের সাথে অভিযোজিত হয়ে যায় যেন অতিবেগুনী কণা ত্বককোষের ডিএনএর ক্ষতি বা মিউটেশন করতে না পারে।[34] পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে অতিবেগুনী বিকিরণের সাথে সেসব স্থানের আদিম অধিবাসীদের গায়ের রঙের সম্পর্ক আছে। বিষুবরেখার কাছাকাছি যেসব অঞ্চলে তিবেগুনী রশ্মি সর্বাধিক, সেসব অঞ্চলে লোকজনের ত্বক গাঢ় বা শ্যামলা বর্ণের। পক্ষান্তরে মেরুর দিকের কম অতিবেগুনী রশ্মির অঞ্চলে লোকেরা ফিকে বা ফর্সা রঙের। তবে দেশান্তর ও অভিবাসনের ফলে এসব ছাঁচ অনেকটা বদলে গিয়েছে।[35]
সাদা/শ্বেতাঙ্গ ও কালো/কৃষ্ণাঙ্গ বলতে জাতি বোঝালেও বাদামী দিয়ে তেমনটা বোঝায় না, কারণ তা সব জাতিতেই বিদ্যমান। ব্রাজিলে পর্তুগিজ শব্দ pardo অর্থ বাদামীর বর্ণচ্ছটা, কিন্তু তা ব্যবহার করা হয় বহুজাতিক লোকদের সম্পর্কে। ব্রাজিলিয়ান ইন্সটিটিউট অফ জিওগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্স (IBGE) এক জরিপে জনগণকে বলে তাদের নিজেদেরকে branco (সাদা), pardo (বাদামী), negro (কালো), বা amarelo (হলুদ) হিসেবে চিন্হিত করতে। ২০০৮ সালে ৪৩.৮ শতাংশ লোক নিজেদেরকে pardo বা বাদামী বলে চিহ্নিত করে।[36] (See Human skin color)
পৃথিবীর উপরের পাতলা স্তর তথা ভূত্বক বেশিরভাগই বিভিন্ন ছটার বাদামী মাটি দিয়ে গঠিত।[37] ভালো মাটিতে থাকে শতকরা ৪৫ ভাগ খনিজ উপাদান, ২৫ ভাগ পানি, ২৫ ভাগ বায়ু এবং ৫ ভাগ জৈব পদার্থ। মাটির অর্ধেক রং আসে খনিজ থেকে আর তাতে আছে লৌহ, জারিত হলে হলদে বা লালচে বর্ণধারণ করে; ম্যাঙ্গানিজ, নাইট্রোজেন ও সালফার প্রাকৃতিকভাবে ক্ষয়ে গিয়ে বাদামী বা কালচে হয়। উর্বর ও সমৃদ্ধ মাটি সাধারণত গাঢ় রঙের হয়; মাটিস্থ জৈব পদার্থ পচে রং গাঢ়তর হয়। মরা পাতা ও শিকড় ক্ষয়ে কালো বা বাদামী রং নেয়। তুলনামূলক অনুর্বর মাটির রং হয় ফিকে বাদামী আর তাতে পানি বা জৈব পদার্থও কম থাকে।
বহু স্তন্যপায়ী এবং শিকারী পাখিতে বাদামী রং দেখা যায়। এটা কখনো মৌসুমভেদে বদলায়, কখনো সারাবছর একই থাকে। বাদামী রঙটা প্রকৃতিতে প্রায়ই ক্যামোফ্লেজ হিসেবে কাজ করে, যেমন - বনের মাটি বাদামী, তাই বিশেষত বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে তুষারপায়া খরগোশের মতো প্রাণীদের দেহে বাদামী লোম গজায়।
বাদামী হলো সবচেয়ে কম পছন্দের রঙ। এক জরিপে দেখা গেছে যে অংশগ্রহণকারীদের মাত্র ১ শতাংশের প্রিয় রং বাদামী, সাদা ও পিঙ্কের পরের স্থানে; আর ২০ শতাংশ লোকের সবচেয়ে কম পছন্দের রঙ, এমনকি পিঙ্ক, ধূসর ও বেগুনী থেকেও কম।[38]
১৮ শতকের শেষ ভাগ থেকেই সহজলভ্যতা এবং কম দৃশ্যমানতার কারণে মিলিটারি ইউনিফর্ম হিসেবে বাদামী রং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আমেরিকান বিপ্লব জড়িয়ে পড়ার পর ১৭৭৫ সালে যখন কন্টিনেন্টাল আর্মি গঠিত হয়, তখন প্রথম কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস ঘোষণা করে যে তাদের দাপ্তরিক ইউনিফর্মের রং হবে বাদামী। কিন্তু অনেক মিলিশিয়া এটা পছন্দ করেনি, কারণ তাদের অফিসাররা আগে নীল পোশাক পরতো। ১৭৭৮ সালে কংগ্রেস জর্জ ওয়াশিংটনকে নতুন করে ইউনিফর্মের ডিজাইন করে দিতে বলে। তখন ১৭৭৯ সালে তিনি সব ইউনিফর্মের রং নীল ও বাফ (ভয়সা) করার আদেশ দেন।[39]
১৮৪৬ সালে ব্রিটিশ ভারতে সেনাবাহিনীর কর্পস অফ গাইডস রেজিমেন্টের ভারতীয় সৈনিকরা হলদে শেডের ট্যান রঙের পোশাক পরতে শুরু করে। উর্দুতে সেটাকে বলে খাকি, অর্থাৎ মেটে রঙ, মূলত শব্দটা ফার্সি। রঙটা খুব চমৎকার প্রাকৃতিক ক্যামোফ্লেজ হিসেবে কাজ করতো। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ১৮৬৭-৬৮ সালে তাদের আবিসিনীয় ক্যাম্পেইনে খাকি পোশাক পরেছিল, পরবর্তীতে বুয়র যুদ্ধেও তারা সেটা ব্যবহার করে। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী রঙটা প্রথম পরে স্পেনিশ-আমেরিকান যুদ্ধের (১৮৯৬) সময়, পরে ইউনাইটেড স্টেটস নেভি এবং ইউনাইটেড স্টেটস মেরিন কর্পসও এটা পরা শুরু করে।
১৯২০-এর দশকে, জার্মানির নাৎসী পার্টির ইউনিফর্মের রং ছিল বাদামী। নাৎসী আধাসামরিক বাহিনী Sturmabteilung (SA) বাদামী ইউনিফর্ম পরতো এবং 'বাদামীশার্ট' বলে তারা পরিচিত ছিল। জার্মানিতে নির্বাচনী জেলার মানচিত্রে নাৎসি ভোটগুলো বাদামী রং দিয়ে উপস্থাপন করা হতো। কেউ নাৎসিদের ভোট দিলে বলা হতো, সে বাদামী ভোট দিয়েছে ("voting brown")। মিউনিখে নাৎসি পার্টির জাতীয় সদর দপ্তরগুলোকে বলা হতো Brown House বা বাদামী বাড়ি। এমনকি ১৯৩৩ সালে নাৎসিদের ক্ষমতা দখলকেও বলা হয়েছিল বাদামী বিপ্লব।[40] এডলফ হিটলারের ওবেরস্যাল্জবার্গের বাড়ি বারঘফে তার বিছানা "সাধারণত ঢাকা থাকতো একটি বাদামী কম্বল দিয়ে যার ওপর আঁকা ছিল বিরাট স্বস্তিকা চিহ্ন। হিটলারের বাদামী স্যাটিনের পাজামাতেও স্বস্তিকা ছিল, পকেটের লাল পটভূমিতে কালো সুতোয় বোনা। এর সাথে মিল করে ছিল তার বাদামী রঙের রেশমী বহির্বাস।"[41] নাৎসি পার্টির রং হিসেবে বাদামী বাছাই করার আসল কারণ ছিল বৈষয়িক সুবিধা; জার্মানির সাবেক উপনিবেশ আফ্রিকায় মোতায়েন করা সেনাদের প্রচুর অতিরিক্ত পোশাকগুলো যুদ্ধের পর ১৯২০ দশকে অনেক সস্তায় পাওয়া যেতো। এছাড়া পার্টির শ্রমিক-মিলিটারি ভাব বজায় রাখতেও রঙটা ছিল মানানসই। ১৯৩০ দশকে পার্টির বাদামী ইউনিফর্মগুলো বিপুল পরিমাণে উৎপাদন করতে থাকে ফ্রাশন ডিজাইনার হুগো বসের (1885-1948) কোম্পানি। বস ১৯৩১ সালে পার্টির সদস্য হয় এবং এসএ, এসএস ও হিটলার ইয়ুথের পোশাক সরবরাহের লাইসেন্স পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তার ভোটাধিকার এবং কোম্পানির প্রেসিডেন্সি কেড়ে নেয়া হলেও কোম্পানিটি এখনো চলছে, তার নাম বহন করে।[42][43]
বিজ্ঞাপনে বাদামী রঙের ব্যবহার বৈরি অবস্থায়ও কার্যকর এবং টেকসই পণ্যের ইঙ্গিত করে।[44] পুলম্যান ব্রাউন[45] হলো ডেলিভারি কোম্পানি ইউনাইটেড পার্সেল সার্ভিস (UPS)-এর রঙ, তাদের ট্রেডমার্ক বাদামী ট্রাক ও ইউনিফর্মের রঙও এটাই। এই রঙটি আগে পুলম্যান কোম্পানির পুলম্যান রেলগাড়ির রং ছিল। ইউপিএস রঙটা গ্রহণ করে কারণ একেতো এটি পরিষ্কার রাখা সহজ, আর দ্বিতীয়ত এর একটা বিলাসবহুল ভাব আছে। ইউপিএস বাদামী রং নিয়ে দুটি ট্রেডমার্ক নথিবদ্ধ করেছে যাতে অন্য কোম্পানিরা সেটা ব্যবহার করে ক্রেতাদের ঠকাতে না পারে। বিজ্ঞাপনে ইউপিএস নিজেদেরকে "ব্রাউন" বলে সম্বোধন করে থাকে ("What can Brown do for you?")।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.